পাণ্ডুলিপি থেকে । জহিরুল মিঠু
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১১:২৪ পূর্বাহ্ণ, | ১৩৬৯ বার পঠিত
জহিরুল মিঠু’র দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘নোঙর তার লুঠ হয়ে গেছে’। বইটি ‘অগ্রদূত’ প্রকাশনী থেকে বের হয়েছে।
আহ্বান
সবুজে দিব ঝাঁপ
বুকটা খড়খড়ে হয়ে গেছে
পারো যদি সঙ্গি হও !
বিশ্বাস করো,
এ শূন্যেই নোঙর ফেলবো
মেলে দেব অকৃপণ হাত !
কথোপকথন -৩
নন্দিনী আজকাল বড্ড অন্য মনস্ক থেকে জবাব দেয়,
তাই তাকে কোনো কথা জিজ্ঞেস না করে নিজেই
সমাধানে তৎপর হই। এতে অনেক সময় সব
গুবলেট হয়ে গেলে নন্দিনী চিরায়ত মায়ের মত
এগিয়ে আসে, যেন আজন্মকাল থেকে সে আমাকে
লালন পালন করছে এমন ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলবে, এটা
আপনি কখনও করেননি যে আজ করবেন!
আমি তার এ কথায় লজ্জিত হই, অনুশোচনা
আসে কিন্তু দুদিন পরেই ভুলে যাই। ভুলে যাওয়া রোগটা
আমায় বেশ ধরেছে। বিশ বছর আগের ঘটনা
অবলীলায় বলে যাই, আবার গত বিশ্বকাপে কে
কাপ নিল ফুটবলে সেটাও মনে করতে পারি না!
এ কথা একদিন নন্দিনীকে বলার পর সে
বললো,তুমি ভালোবেসে দেখছো না,দেখার জন্যে
দেখছো, অতীতকে কামড়ে বর্তমান চলে না,
বর্তমান সব সময় বর্তমান। তোমার এখন যেটা
ভালো লাগে সেটাই করো!
আমি বেশ খেয়াল করেছি , তার কাছ থেকে ধাক্কা
মার্কা কিছু কথা শুনলে আমার ভেতরের চোখ
আরও খুলে যায়, সাধে কি আর বস
বলেছেন,’অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার
নর ‘। আমার সব লেখা,সব চিন্তায়, কোনো না
কোনো ভাবে নন্দিনীর উপস্হিতি আছেই।
অতীত মনে রাখার জন্য কেউ যদি কাউকে
পদক দেয় তবে আমি ডেকে বলে দেব, এটা যেন
নন্দিনী পায়। এই তো গত পরশু, আইয়ুব বাচ্চু
যেদিন চলে গেলেন, তার পরের দিন, নন্দিনী
আমায় আইয়ুব বাচ্চুর গানগুলো গাইতে বলে
চোখ বন্ধ করে চা খাচ্ছিল। চা খাবার সময় সে
এটা করে। তার বাবার অভ্যেসটা সে রপ্ত করেছে শিরায়
শিরায়, সে বলে,চা খেতে হয় ধ্যান করে। এই
ধ্যানের মধ্যেই আমি চার-পাঁচটা গানের মুখ
শুনিয়ে দিলাম।
নন্দিনী হাসতে হাসতে বলে,আমার হৃদয় ছোঁয়া
গানটা এখনো আসেনি। আমি বললাম,
কোনটা,নিশিদিন তোমায় ভালোবাসি? সে মাথা
নাড়ায় ডানে বামে।আমি ভড়কে যাই, মনে মনে
বলি, আল্লাহরে মনে হচ্ছে না কেনো!
সে বলে, তুমি ভুলে গেছো? সেই যে তোমার
কবিতা পড়ে আমি যখন তোমায় ফোন
করেছিলাম, তখন যে গানটা বাজতো তোমার
মোবাইলে। কতবার শুনতাম। তোমাকে বলতাম,
তিনবারের সময় ধরো, আমি গানটা শুনি!
আমার মনে হয়েছিল, ব্ল্যাকহোল নিয়ে কেউ
আমাকে বেশ বিপদে ফেলার মত প্রশ্ন
করেছে,আমি সুন্দরী প্রতিযোগিতার মেয়েদের
মত আমতা আমতা করে বলে ফেলি, সুস্মিতার
সবুজ ওড়না ওড়ে যায়?
ধুর, এটা জেমসের গান। নন্দিনীর মেজাজ
চরমে। দক্ষ উকিলের মত জেরার স্রোত টেনে
সে আমাকে তুলোধুনো করে ফেলে। আমি তন্ময়
হয়ে থাকি। অতীত ধরা দেয় না। আইয়ুব বাচ্চুর
মুখটা মনে করি বারবার।কিছুতেই কিছু হয় না।
বলি,যে রদ্দি মার্কা কবিতা তখন লেখতাম, তখন
পছন্দ অত যুৎসই ছিল না। কোন গান! কোন গান?
নন্দিনীর চোখে তখন বিসর্জনের বাদ্য।
সে মন্ত্রবলে উচ্চারণ করে, তোমরা লেখকরা
ভালোবাসতে পারো না,তোমরা ভালোবাসা
সাজাও, তোমরা তোমাদের মত করে চলো,
তোমরা তোমাদের দিকে তাকিয়ে অন্যকে
আঁকো আর আমরা ভাবি তোমরা সেটাই।
মিথ্যুক! তোমরাই এক একটা বিরাট শিশু!
আমি বিষম খাই। ওস্তাদের ‘সত্য বড় কঠিন’
মানি তবে কঠিনকে ভালোবাসতে পারি না।
নন্দিনীর দিকে চেয়ে চেয়ে মনে মনে লিজেন্ডের
মুখ আবার দেখি। না,আমার অপচিতিই শুরু
হয়ে গেছে। গতকালই তো আরেকটা জন্মদিন
হাপিস হয়ে গেল! মনে হয় বছরে দুটো জন্মদিন।
লাফিয়ে লাফিয়ে বয়স দৌড়াচ্ছে। মোমবাতি
এখন প্রায় চারডজনে পৌঁছে গেছে। আর
কত মিয়া, আর কত!
কলেজ রোড
জ্ঞান হবার পর জানতাম থানা রোড এটা,
তখন একলা ছিল নীরব নিথর জোড়াপুলটা।
পুলের পরে ইটবিছানো রাস্তা মিশেছে কোথায়,
শুনেছি সেদিক শেষে বাগান, চায়ের রাজ্যে যায়।
বুঝতে বুঝতে একদিন শীত-ভোরে সেদিক ধায়
স্কুল ব্যাগ নিয়ে ছোট কলম্বাস হেঁটে যায়
মা-বোনকে শোনায় ফিরে নতুন রাজ্যের গল্প
তারপর দিন- মাস-বছর, সময় কত অল্প।
রিক্সায় বসে ইট-রাস্তাকে কষ্ট দিতে দিতে,
ছুটে চলে তার শৈশব —কৈশোর আর যৌবন।
এই রোডেই যেন মিশে যায় তার শিরা ধমনীতে।
জৌলুস জয় করে নেয় সে রোড, যেন মৌ-বন।
পৃথিবীর কত কী দেখা চর্ম-অচর্ম চোখেতে
কলেজ রোডের রূপের কাছে নস্যি সব ভুবন!
গোল্ডফিশ
(রূপান্তর: আবিদ আজাদের ‘বিষণ্ণ চিবুকের সেই মেয়েটি’)
মোটা লাল পাড়ের শাদা শাড়িতে সে ছিল অপূর্ব।
সাথের ছেলেটি বেশভূষায় সাধারণ তারপরেও
স্বতন্ত্র ।কুমিল্লার খদ্দরের পাঞ্জাবী, পুরো লেন্সের
চশমা,টায়ারের কালো চপ্পল।হাতে,কখনো বগলে
থাকতো দু’একটা বই।বই পাগল ছিল ছেলেটি!
‘কত পড়তে পারো! ‘
মেয়েটি কপট রাগ দেখাতো। ছেলেটি হাসতো।
টোল পড়া গালে মাথার সামনের চুলগুলো সরিয়ে
বলতো- ‘মানুষ হবার জন্য পড়ছি! ‘
মেয়েটিও এককাঠি সরেস। তবে এখন কী, অমানুষ?
তারপর মেয়েটি চিবুক টিপে আদর করে দেয় ছেলেটিকে।
মেয়েটির ওপরের ঠোঁটের বাঁ দিকেই ছিল সুন্দর একটা তিল।
কত কবিতা অঞ্জলি হত ঐ তিলটির জন্যে। মাঝে মাঝে
ছেলেটি গেয়ে ওঠতো,
‘এ কী অপরূপ রূপে মা তোমার,হেরিনু পল্লী জননী ‘
সবুজের খোঁজে, প্রাণের খোঁজে গ্রামে চলে যেত দুজন কদাচিৎ।
এভাবেই…!
গ্রীষ্ম,বর্ষা,শরৎ,হেমন্তের পর শীত।
প্রকৃতির রূপ তখন অন্য-রুক্ষ।বৃক্ষরা যেন কুণ্ঠা বোধ করে
সবুজ হতে।শেফালী -শুভ্র এক ভোরে মফস্বলের কোমল
ঘুমে ঘাই মেরে যায় রিক্সার করুণ টুংটাং।
বাতাসের মাঝে হাহাকার ফুটতে থাকে।ওপরের ঠোঁটের বাঁ
দিকে তিল ছিল যে মেয়েটির—সে আর নেই!
কেউ জানলো না।জানলো না কেউই।মোটা লাল পাড়ের
শাদা শাড়ির সেই অপূর্ব মেয়েটি,কোন অভিমানে গলায়
পরেছিল ফাঁস!
আর ছেলেটি?
চল্লিশ পেরিয়েও পানসে হয়নি। নতুন যৌবন মৌ মৌ করছে
তার আশপাশ। ক্লিন শেভড থাকলে কেউ কেউ টগবগে
যুবক বলেও ধরে নেয়!
মেয়েটির কথা অনেকেই আর মুখে আনে না!
মাগো আমার
মা’র বয়সটা আশি ছুঁই ছুঁই
প্রতিদিনই তার একই কথা,
‘কত আর ভাল লাগে বল,
কত আর বিছানায় চোখ বুজে
মিছামিছি ঘুমাই আর শুই ! ‘
মা’র বয়সটা আশি ছুঁই ছুঁই!
প্রতিটা রাত তার কাছে একই সুরে আসে,
প্রতিটা ভোর ধরা দেয় একই সুবাস ঘেঁষে।
নামাজ পড়ে জায়নামাজে তসবিটা রেখে
দুহাত তুলে মোনাজাতে ভেতর বুকটা অাঁকে।
মা,তোমার কথায় অহর্নিশ কেটে যায় বেলা
কথার ছলে ‘বাবা’ ‘খোকা’ কত ডাকের মেলা।
মাগো তুমি কেমন করে, বোবা কান্না বুঝো,
থাকলেও কাছে বারেবারে আবার ফিরে খোঁজো।
স্বপ্ন ভেঙে, সৌধ ভেঙে, বুকটা তোমার পাথর,
তবু মুখপোড়া এ অভাগারে কাছে টানার কাতর।
হাজার বর্গমাইলের বুকে রাখো তুমি আগলে,
আমার ভোর তো শুরু হয় যখন তুমি জাগলে।
মাগো আমার দারুণ আকাশ যেমনি ওড়াই ঘুড়ি,
তোমার হাতে থাকবো হয়ে আশীর্বাদের চুড়ি!
সুরমা চোখে মায়ার বাঁধন, কপালে নীরব কথা,
‘বাপ রে আমার থাকিস ভালো, দুধে-ভাতে যেথা! ‘
দর্শন
একবার তার চোখে দেখেছিলাম—
পৃথিবী,
কী করে থমকায় !
আরেকবার সে চোখেই —
বাজ,
কী ভয়ানক চমকায় !