অনুপল (চতুর্থ প্রবাহ) । আহমদ মিনহাজ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ জানুয়ারি ২০১৯, ৮:১৯ পূর্বাহ্ণ, | ১৬৭৬ বার পঠিত
অনুপল—১৬৩ : আলোকবর্ষ
লক্ষ আলোকবর্ষ ছুটে
তারাটি নিভে গেল নভোমণ্ডলে।
কবি তবু মিনতী করে—
“রেখো মা দসেরে মনে।”
“তুমি যা লিখছ সেটা কি নতুন?”
উত্তরে কবি হাসেন—
“নতুন শব্দটি জেনো নিজেই পুরাতন।”
অনুপল—১৬৪ : প্রেত
অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে প্রেত
রক্ত ঝরে ছুরির কিনারায়।
অনুপল—১৬৫ : ভবিষ্যৎ
নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে এখন আর ভাবি না—
ওটা ঈশ্বর ও শয়তানের হাতে ছেড়ে দিয়েছি
ওনারা সানন্দে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন দেখলাম।
অনুপল—১৬৬ : মুক্তি—১ : মহাশূন্য
মুক্তির কথা যদি বলো
এই উপমাটি স্বস্তিকর:
একটা দমকা হাওয়া শা করে
ঢুকে পড়েছে ঘরে,
তোমায় উড়িয়ে নিতে
—মহাশূন্যে।
অনুপল—১৬৭: জীবন
দিগন্তরেখা ধরে ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড়।
মাটিতে পাক খেয়ে ওপরে উঠছে ধূলিঝড়।
ঘূর্ণি ও ধূলির মাঝখানে সরু পথ ধরে
সটকে পড়ার তালে আছে, —জীবন।
বারবার একই ভুল করি প্রতিদিন—
‘যাই’ বলে নির্ভুল ফিরে আসি ঘরে।
অনুপল—১৬৮ : সুমো কুস্তিগির
নিজেকে সুমো কুস্তিগির মনে হয়—
চর্বি ও মাংসে ঠাসা পেল্লাই দেহ নিয়ে
রিংয়ে ঢুকে পড়েছি, আমার চেয়ে দশাসই
প্রতিপক্ষকে কুস্তির প্যাঁচে মাটিতে ফেলে দিতে।
অনুপল—১৬৯ : এনট্রপি—১ : হট্টগোল
রাস্তায় ভীষণ হট্টগোল
মন শান্ত ভেবে—
বিশৃঙ্খলা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে।
অনুপল—১৭০ : এনট্রপি—২ : বধিরতা
১০০ বা ৫০০ ডেসিবেল সোরগোল
ওসবে আজকাল কিছু হয় না—
১০০০ ডেসিবেল হয়ত দরকার
—বধির হতে।
অনুপল—১৭১ : এনট্রপি—৩ : শৃঙ্খলা
শৃঙ্খলা ভীষণ চৌকস!
ওকে দায়িত্ব দিয়েছি—
বিশৃঙ্খল হদয়কে শান্তি দিতে।
যেন কোনো ত্রুটি না হয়
—রোজকার আহার ও সঙ্গমে।
অনুপল—১৭২ : এনট্রপি—৪ : জীবনের ভুলচুক
জীবনের ভুলচুক হিসেব করে কি লাভ?
ঝরপাতারা বিশৃঙ্খলভাবে মিশে যাচ্ছে মাটিতে,
এটা—সেটা ভুলচুকের পরোয়া না করে।
অনুপল—১৭৩ : এপিটাফ
আমি মারা গেলে মনে রেখো এই সমাধিফলক—
“এইখানে শায়িত ব্যক্তির নাম—পরিচয় অজ্ঞাত
—হি ইজ একচুয়ালি মিসিং।”
অনুপল—১৭৪ : নিয়ম
ভেবে অবাক হই, কী করে পারছি…!
নির্ভুল নিয়মে প্রতিদিন…
ব্রেডে জেলি মাখিয়ে কামড় বসাই!
অনুপল—১৭৫ : ভুল—১ : পুনরাবৃত্তি
বারবার একই ভুল করি প্রতিদিন—
‘যাই’ বলে নির্ভুল ফিরে আসি ঘরে।
অনুপল—১৭৬ : ভুল—২ : নির্ভুল ভুল
সানজিদা শারমিনকে বলছি—
চিনির বদলে চায়ে লবণ মেশানোয়
ভুলের কিছু হয়নি।
ওরা দেখতে নির্ভুল একরকম
—এই ধরো মানুষ যেমন!
অনুপল—১৭৭ : তুলনা
কে বেশি সুন্দর, তুমি, নাকি
তোমার খোঁপার রক্তজবা ফুল—
মাঝেমধ্যে এ-নিয়ে ধন্ধে পড়ে যাই।
দুজনে অবশ্য ঝরে যাচ্ছ
ঘড়ির কাটার নির্ভুল সংকেতে!
অনুপল—১৭৮ : বিলোপ
বটগাছের ন্যায় তুমি শিকড় ছড়িয়েছ মাটিতে
শাখা-প্রশাখায় সমাকীর্ণ ন্যগ্রোধ মুখের বলিরেখায়
হাতের আঙুলে থোকা-থোকা পরিপক্ক বটফল
নিজের বিস্তারে অভিভূত তুমি—
তবু হায়! কেন শঙ্কিত বিলোপে?
অনুপল—১৭৯ : সুন্দর—১ : গোলাপ
সুন্দর সতত আপেক্ষিক
টবে ফোটা গোলাপের সঙ্গে
জংলী গোলাপ যেমন।
অনুপল—১৮০ : সুন্দর—২ : স্বৈরাচার
সুন্দর হয়ত অনুপম স্বৈরাচার
উদ্ধত ও পেশীবহুল, তবুও পেলব,
ওর সমুখে দাঁড়ালে বামন মনে হয় নিজেকে
এন্ডি ওয়ারহোলের এমনটি মনে হয়েছিল—
মুসোলিনি স্টেডিয়ামে ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে।
অনুপল—১৮১ : পুনরাবৃত্তি—১
“তুমি যা লিখছ সেটা কি নতুন?”
উত্তরে কবি হাসেন—
“নতুন শব্দটি জেনো নিজেই পুরাতন।”
অনুপল—১৮২ : বিস্মরণ
র্যাপিড ফায়ারে ছেলে প্রশ্নের তীর ছোঁড়ে ঝটপট—
‘আমাদের দেশের নাম কি বলো, সময় দশ সেকেন্ড’
আমি মাথা চুলকাই, দশ সেকেন্ড ফুরায় নিমেষ।
ছেলে অবাক আমার নীরবতায়—
‘ছিঃ বাবা! দেশের নামটাও জানো না!’
ওকে কী করে বুঝাই, পড়েছি বিস্মরণের ফাঁদে!
লজ্জায় অধোবদন, বলতে পারি না মুখ ফুটে-
‘হে শিশু হে দেবদূত, এখন দুঃসময়…
নিজেকেও ঠিকঠাক মনে রাখাটা কঠিন।
অনুপল—১৮৩ : মানুষ—২
আছেন এমন কেউ, যিনি বলে দেবেন
আজকাল কেন এমন হয়—
‘মানুষ’ বলে কেউ শুভাশিস জুড়ে দিলে
আতংকে হিম হয়ে আসে বুক।
অনুপল—১৮৪ : মানুষ—৩
মানুষ শব্দে একসময় খুব রুচি ছিল
ভালোই লাগত নিজেকে মানুষে প্রীতিমুগ্ধ ভেবে—
এখন অগ্নিমান্দ্য, মানুষে রুচি উবে গেছে,
মাঝেমধ্যে ভুল করে নিজেকে মানুষ ভেবে বসি
—টের পাই বদহজম, চোঁয়া ঢেকুর সারাদিন।
অনুপল—১৮৫ : মানুষ—৪
তোমরা কেউ ফিরেও দেখলে না
সে মরে পড়ে আছে রাস্তার ধারে
ওর মৃত চোখে সবুজ ঘাসফড়িং
ক্ষণে-ক্ষণে পুচ্ছ নাচায়; —মানুষ হিসাবে
তার মূল্যহীনতার হিসাব চোকাতে।
অনুপল—১৮৬ : মানুষ—৫
সারাদিন একটাই কাজ, —মানুষ দেখা
গলায় কাঁটা বিঁধে থাকার অস্বস্তি নিয়ে।
অনুপল—১৮৭ : মানুষ—৬
সে এখন চলতে-ফিরতে পারে না
লাচাড়…নিজের ক্লান্ত মাথার ভারে।
অনুপল—১৮৮ : মানুষ—৭
ট্রাম্পেট ক্লারিনেট সেক্সোফোন
চেলো ভায়োলিন লিড গিটার
বাঁশি তবলা ঢোলক করতাল
মন্দিরা মৃদঙ্গ তাম্বুরা সানাই
সেতার সরোদ পিয়ানো ও হারমোনিয়াম…
সব একসঙ্গে মিছিল করে চলেছে—
শবাধারে যে শুয়ে আছে তাকে গোর দিতে।
অনুপল—১৮৯ : মানুষ—৮
অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি রাতে—
আমাকে বনসাই করে কেউ
সাজিয়ে রেখেছে ড্রইরুমে।
ছেলেবেলা থেকে শুনছি—
গন্ত্যবহীন ট্রেনে চড়ে তুমি যাচ্ছ…
ওদিকে আমি ট্রেন বদলে চলেছি—
কারণ ওরা কেউ গন্তব্যহীন নয়।
অনুপল—১৯০ : মানুষ—৯
মানুষ কিংবদন্তির সাপ—
নিজের লেজ নিজে খাচ্ছে প্রতিদিন।
অনুপল—১৯১ : মানুষ—১০
মানুষ দেখলে হাত নিশপিশ করে
কষে থাপ্পড় দিতে ইচ্ছে হয় গালে।
মনে থাকে না, থাপ্পড়টা শেষমেষ
নিজের গালেই এসে পড়ছে।
অনুপল—১৯২ : ঈশ্বর—১ : আকাশগঙ্গা
এখন সময় সুস্থির হয়ে ভাবার
—আর কত অনর্থ রক্তপাত ঘটালে
তুমি শান্তি ফিরে পাবে, মনে হবে অশান্ত
আকাশগঙ্গায় প্রগাঢ় শান্তি নেমেছে।
অনুপল—১৯৩ : ঈশ্বর—২ : ট্রেন
ছেলেবেলা থেকে শুনছি—
গন্ত্যবহীন ট্রেনে চড়ে তুমি যাচ্ছ…
ওদিকে আমি ট্রেন বদলে চলেছি—
কারণ ওরা কেউ গন্তব্যহীন নয়।
অনুপল—১৯৪ : ঈশ্বর—৩ : করুণা
মাঝরাতে টের পেলাম তুমি জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছ
খুব বৃষ্টি হচ্ছিল বাইরে, ওদিকে তুমি ভিজে সপসপে,
অপ্রভিত হেসে বলছ, “একটা ছাতা দিতে পারো কিংবা বর্ষাতি?”
কী যে মায়া হচ্ছিল তোমায় দেখে! আমি তখন বলে উঠেছি—
করুণা করুণা, বাইরে কেন, ভিতরে্ এসে বসো, শুকনো কাপড় দিচ্ছি।
তুমি অপ্রতিভ হলে, “না, এখন আর ঢুকব না, ঘরটা ভিজে যাবে”।
মাঝ রাত্তিরে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে তুমি ছাতা বা বর্ষাতি চাইছ—
করুণা করুণা বলে ছাতাটা আমি জানালা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে দিলাম
তুমি ওটা চট করে লুফে নিলে, যেন অদৃশ্য এ্যাক্রোবেট, তারপর
বৃষ্টির মধ্যে মিশে গেলে নিমিষে।
বৃষ্টির ছাটে ঘর এখন ভিজে সপসপে,
তুমি ভিতরে ঢোকোনি তবু ঘরটা ভিজিয়ে দিয়েছ করুণায়
—আমায় এখন ঘর শুকাতে হবে এই মাঝরাত্তিরে।
বৃষ্টি আছড়ে পড়ছে বন্ধ জানালায়—
একরাশ করুণা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে ঘরে।
অনুপল—১৯৫ : নীরবতা
একবার ভাব, কী দুঃসহ এই নীরবতা!
বাক্যের মধ্যখানে দুটি ‘কমা’ হয়ে দুজনে
মুখোমুখি বসে আছি বাকস্ফুরণের আশায়।
শীতের শিশির নির্দয়—
নীরব ঝরছে বাকহীন দুটি ‘কমা’র ওপর।
অনুপল—১৯৬ : বীজ
এখন সেই বয়স,
সুন্দর গাঁদাফুল মনকে টানে না,
গাঁদাফুলের বীজকে বরং
অর্থবোধক সুন্দর মনে হয়।
অনুপল—১৯৭ : ভালো লাগা
বলে বোঝানো যাবে না —কী যে ভালো লাগছে!
ল্যাঞ্জা বালিহাসের দল তোমার গলার নেকলেসের মতো,
আকাশে ডানা মেলে উড়ছে, ভালো লাগছে ওদের দেখে।
হেমন্তের সোনা রোদে ম্রিয়মান সোনালী ধানখেত—
ভালো লাগছে হলুদ সর্ষে ফুলে মৌমাছির গুঞ্জন,
বেশি ভালো লাগছে তুমি পাশে বসে আছ তাই।
তোমার পায়ের পাতায় শরতের শাদা কাশবন—
বলে বোঝানোর নয়, কী ভীষণ ভালো লাগছে!
ভালো লাগছে…লাগছে…সবকিছু ভালো লাগছে,
ভালো লাগতে লাগতে…এখন কিচ্ছু ভালো লাগছে না।
এখন সেই বয়স,
সুন্দর গাঁদাফুল মনকে টানে না,
গাঁদাফুলের বীজকে বরং
অর্থবোধক সুন্দর মনে হয়।
অনুপল—১৯৮ : হাসি এবং কান্না
খিল খিল হাসিতে তুমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ছ, ওদিকে
অচিন পাখি নাকি সুরে কান্না করছে দূর জঙ্গলে।
তোমার খিল খিল হাসি আর পাখির গুনগুন কান্না
—পরস্পর-বিপরীত ডেসিবেল ইথারে ভেসে ভেসে
পৌঁছে গেছে পাণ্ডুর তারাদের দেশে।
হাতে সময় বেশি নেই, একটু পরে বিকট শব্দে চুপসে যাবে
এমন একটি উজ্জ্বল সুপারনোভাকে ওরা ঠিকানা করে নিয়েছে।
ফুরিয়ে যাবার আগে তারাটি দপ করে জ্বলে উঠেছে—
হাসি ও কান্না এখন ব্যাকুল ওকে খানিক ভরসা যোগাতে।
হতভাগা তারার প্রাণান্ত চেষ্টার সঙ্গে তাল দিয়ে তুমি হাসছ—
খিল খিল হাসিতে মাতিয়ে তুলেছ এই নরলোক কিংবা প্রেতলোক,
ওদিকে পাখিটির নাকিস্বরের কান্নায় কিছুটা বিরক্ত দূরবর্তী জঙ্গল।