ছোটদের গৌতম বুদ্ধ, ‘পর্ব ২’ । অদিতি ফাল্গুনী
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ অক্টোবর ২০১৮, ৯:১৫ পূর্বাহ্ণ, | ১৮৬৬ বার পঠিত
যৌবন এবং বিয়ে
জন্মের পরপরই মা মহামায়ার মৃত্যুর পর সিদ্ধার্থ মানুষ হন মাসী মহা প্রজাপতির কাছে। রাজা শুদ্ধোদন ছেলে যেন সন্ন্যাসী না হয় এ জন্য তাঁর জন্য তিনটি প্রাসাদ বানান। ছেলেকে সাধু-সন্ন্যাসীদের হাত থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা করতে থাকেন। তবে, বাবা শুদ্ধোদন ছেলের বিয়ে দিলেও বা ছেলের জীবনটা নানা বিলাস দ্রব্য নিয়ে পরিপূর্ণ রাখার চেষ্টা করলেও সিদ্ধার্থ বুঝতে পারেন যে, শুধুমাত্র আর্থিক বা বৈষয়িক সুখই জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। সিদ্ধার্থের বয়স যখন ষোলো হলো, তখন তাঁর বাবা সিদ্ধার্থকে ছেলের সমবয়সী মাসতুতো বোন যশোধরার সাথে বিয়ে দেন। যেন ছেলের মন অন্যদিকে চলে না যায়। বিয়ের পর ২৯ বছর বয়স অবধি সিদ্ধার্থ প্রাসাদে থাকেন। এরই ভেতরে একদিন সিদ্ধার্থ প্রাসাদের বাইরে বের হলেন প্রজাদের দেখার জন্য। তাঁর বাবা শুদ্ধোদন এতদিন যদিও চেয়েছেন ছেলে যেন কোনো অসুস্থ ব্যক্তি, বৃদ্ধ এবং যন্ত্রণা কাতর মানুষকে না দেখেন তবু পথে বের হয়ে তিনি এক জরাগ্রস্ত বৃদ্ধকে দেখলেন। এতদিন তো সিদ্ধার্থের বাবা তাঁকে পৃথিবীর সব কষ্টের দৃশ্য দেখা থেকে আগলে রেখেছেন যাতে ছেলে মন-টন খারাপ করে সন্ন্যাসী না হয়ে যায়। কিন্তু এবার এই বৃদ্ধকে দেখার পরপরই তাঁর রথের চালক চান্না তাঁকে ব্যাখ্যা করলেন যে বয়স হলে সবাই বৃদ্ধ হয়ে যায়। সবারই তখন হাঁটা-চলায় কষ্ট হয়। প্রাসাদ থেকে রথ যতই আরো সামনে এগোল, সিদ্ধার্থ আরো দেখতে পেলেন এক অসুস্থ ব্যক্তি, একটি মৃতদেহ আর একজন তরুণ সন্ন্যাসী। দৃশ্যগুলো দেখে তাঁর মন খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে সংকল্প করলেন ঐ নির্ভীক, তরুণ সন্ন্যাসীর মতোই সাধনার পথে গিয়ে দুঃখকে জয় করবেন। তাই স্ত্রী যশোধরা ছেলে রাহুলকে জন্মদানের মাত্র এক মাসের মাথায় এক শ্রাবণের পূর্ণিমাতে স্ত্রী যশোধরা ও পুত্র রাহুলের মুখটি শেষবারের মতো দেখে নিয়ে প্রিয় ঘোড়া কণ্ঠকের পিঠে সওয়ার হয়ে সিদ্ধার্থ বেরিয়ে পড়লেন জীবনের অর্থ খুঁজতে। কেন মানুষ জন্মায়, কেন অসুস্থ হয়, বৃদ্ধ হয় আর মারা যায় আর কেনই বা মানুষ কিছুতেই সুখী হয় না এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফিরতে।
কিন্তু এতেও তৃপ্তি বোধ হয় না তাঁর। তিনি আবার অন্যত্র চলে যান। এরপর সন্ন্যাসী কৌন্ডিন্যের অধীনে আরো পাঁচজন তরুণ সন্ন্যাসীর সাথে শুরু করেন কঠিন সাধনা। খাবারসহ যাবতীয় পার্থিব মোহ ত্যাগ করে, শবাসনে দীর্ঘ দীর্ঘ সময় পার করে সিদ্ধার্থ তাঁর সন্ন্যাসী বন্ধুদের সাথে সময় পার করতে থাকেন। দিনের পর দিন গাছের একটা পাতা বা শুধুই একটি বাদাম খেয়ে সারাদিন উপবাস থাকার ফলে একদিন নদীতে স্নান করতে গিয়ে তিনি ক্লান্ত হয়ে প্রায় ডুবেছিলেন।
সিদ্ধার্থ গৌতমের ‘‘মহাত্যাগ’, তার চারপাশে অসংখ্য যড়্গ-রড়্গ, নর-নারী এবং দেবতা যারা তাঁর সাধনায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে সম্মান জানাতে এসেছে।
উৎস: গান্ধার শিল্প, কুশান যুগ (খ্রিষ্ট পূর্ব প্রথম-তৃতীয় শতক)।
বাড়ি ছাড়ার সময় তাঁর রথের চালক চন্ন এবং ঘোড়া কণ্ঠকও তাঁর সাথে সাথে চলল। বলা হয়ে থাকে স্বয়ং দেবতারই সেদিন ঘোড়ার ক্ষুরে যেন শব্দ না হয়, সেই দিকে লক্ষ রেখেছেন। যাতে প্রাসাদের অন্য প্রহরীরা টের না পায় যে সিদ্ধার্থ চলে যাচ্ছেন। শুরুতে সিদ্ধার্থ চললেন রাজগৃহের দিকে এবং ভিক্ষা করে জীবন শুরু করলেন। কিন্তু পথে রাজা বিম্বিসারের প্রহরীরা সিদ্ধার্থকে চিনতে পারলেন। রাজা বিম্বিসার তাঁর প্রহরীদের কাছ থেকে যখন জানতে পারলেন যে, কপিলাবাস্তুর রাজপুত্র পথে ভিক্ষা করতে বের হয়েছেন, তখন তিনিই নিজে সিদ্ধার্থকে ডেকে তাঁর সিংহাসনে বসতে বললেন। সিদ্ধার্থ এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তবে নিজে জানান যে `বোধি’ লাভের পর তিনি মগধ রাজ্যে আবার বেড়িয়ে যাবেন।
সিদ্ধার্থ এরপর রাজগহ ছেড়ে দুজন সন্ন্যাসীর অধীনে কিছুদিন শাস্ত্র শিক্ষা করেন। তিনি এরপর উদাকা রামপুত্তের কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। উদাকা রামপুত্তের কাছেই তিনি উচ্চ স্তরের ধ্যানিক চেতনা অর্জনে সক্ষম হন। কিন্তু এতেও তৃপ্তি বোধ হয় না তাঁর। তিনি আবার অন্যত্র চলে যান। এরপর সন্ন্যাসী কৌন্ডিন্যের অধীনে আরো পাঁচজন তরুণ সন্ন্যাসীর সাথে শুরু করেন কঠিন সাধনা। খাবারসহ যাবতীয় পার্থিব মোহ ত্যাগ করে, শবাসনে দীর্ঘ দীর্ঘ সময় পার করে সিদ্ধার্থ তাঁর সন্ন্যাসী বন্ধুদের সাথে সময় পার করতে থাকেন। দিনের পর দিন গাছের একটা পাতা বা শুধুই একটি বাদাম খেয়ে সারাদিন উপবাস থাকার ফলে একদিন নদীতে স্নান করতে গিয়ে তিনি ক্লান্ত হয়ে প্রায় ডুবেছিলেন। তখন নিজের সাধনার পথ নিয়ে তাঁর নিজের ভেতরেই আবার প্রশ্ন জাগে। হঠাৎই শৈশবের কথা তাঁর মনে পড়ে যায়। তাঁর স্মরণ হয় শৈশবে তাঁর বাবাকে যখন দেখেছেন কীভাবে মৌসুমের প্রথম চাষের সময় কাজ শুরু করতেন। তেমনি একাগ্র ও লক্ষ্যাভিমুখী মানসিকতা নিজের ভেতর গড়ে তোলেন তিনি।
জাগরণ
গৌতম বুদ্ধ বুঝলেন খুব বেশি কৃচ্ছ্রতা সাধন-ও তপস্যার রাস্তা নয়। `ঝন’ বা মধ্যপন্থাই সাধনার প্রকৃত রাস্তা বলে তিনি বেছে নিলেন। অতিরিক্ত ভোগ বা অতিরিক্ত কৃচ্ছ্রতা, দুটোরই ঊর্ধ্বে উঠে তিনি সাধনার পন্থা হিসেবে মধ্যপন্থাকে শ্রেয় ঘোষণা করলেন। দিনের পর দিন উপবাস আর অনাহারে থেকে তিনি প্রায় কঙ্কালসার হয়ে যাবার পর একদিন এক গ্রাম্য তরুণী সুজাতা গাছের নিচে ধ্যানস্থ বুদ্ধকে দেখে কোনো বৃক্ষ দেবতা ভেবে তাঁকে দুধ এবং পায়েস খেতে দিলেন। পায়েস খেয়ে সিদ্ধার্থ আবার তপস্যা বা ধ্যানে বসার শক্তি ফিরে ফেলেন।
পায়েস খেয়ে শক্তি সঞ্চয়ের পর গৌতম বর্তমান ভারতের বোধি গয়ায় একটি পিপুল গাছের নিচে বসলেন।
বললেন,
‘ইহাসনে শুষ্যতু মে শরীরং,
ত্বগস্থিমাংসং প্রলয়ঞ্চ যাতু,
অপ্রাপ্যবোধিং বহুকল্পদূর্লভাং,
নৈবাষনাৎ কায়ামতোশ্চলিষ্যতে।‘
(এই আসনে আমার শরীর শুকিয়ে যায় যাক। দেহের ত্বক-অস্থি-মাংস লয় হয়ে যায় যাক। যে `বোধি/জ্ঞান’ কখনোই পাওয়া যায় না, তা’ না পাওয়া অবধি আমি এই আসন ছেড়ে উঠব না।)
বোধি লাভের তপস্যায় মন্দত্বের রাজা ‘মার’-এর সাথে বুদ্ধের সংগ্রাম
সংস্কৃত ভাষায় ‘মার’ (তিব্বতি ভাষায় উইলি) হলো সেই দানব যে কিনা বুদ্ধকে তাঁর বোধি অর্জনের সংগ্রাম থেকে নিবৃত্ত করার জন্য তাঁর তিনজন পরমা সুন্দরী কন্যাকে বুদ্ধের ধ্যান ভাঙাতে পাঠান। কেউ কেউ বলেন যে, মার তাঁর পাঁচ সুন্দরী কন্যাকে পাঠিয়েছিলেন। বৌদ্ধ শাস্ত্র অনুযায়ী `মার’ হলো মানুষের প্রবৃত্তি, অদক্ষতা, আত্মিক জীবনের মৃত্যুর প্রতীক। মানুষকে তাঁর আত্মিক জীবনের পথ থেকে দূরে সরিয়ে পার্থিক লোভ-লালসায় মত্ত রাখাই `মার’-এর কাজ। বৌদ্ধ ধর্মে কামদেবতা ` মার’- কে চারটি অর্থে দেখা হয় :
ক্লেশ-মার, মার যখন সংসারে যাবতীয় অর্থহীন আবেগের প্রতিমূর্তি,
মৃত্যু-মার, মার যখন জন্ম ও মৃত্যুর বিরতিহীন চক্রে পুনরাবৃত্ত,
স্কন্ধ-মার, মার যখন পার্থিব অস্তিত্বের প্রতীক,
দেবপুত্র-মার, মার যখন প্রতীকী অর্থে সীমায়ত না থেকে এক নিরপেক্ষ অস্তিত্বের বাহক।
শুরুতে বৌদ্ধ ধর্মে মারকে আক্ষরিক ও মনস্তাত্ত্বিক— উভয় অর্থে দেখা হতো। ‘মার’ আসলে মানুষের আত্মিক সাধনার পথে নানা সন্দেহ ও প্রলোভনের মূর্ত রূপ। বৌদ্ধ ভাস্কর্যে ‘মার’—কে হারিয়ে বুদ্ধের জয় একটি জনপ্রিয় মুদ্রা। এই মুদ্রায় বুদ্ধকে দেখা যায় তাঁর বাম হাতটি কোলে রেখে হাতের তালুটি উপরের দিকে এবং ডান হাঁটুর উপরে হাত রাখতে। তাঁর ডান হাতের আঙুলগুলো মাটি ছুঁয়েছে। এ যেন মাটিকে মারের সাথে লড়াইয়ের মাধ্যমে বোধি অর্জনের বিষয়টি সাক্ষ্য মানা। এই মুদ্রাকে ` ভূমিস্পর্শী’ মুদ্রাও বলা হয়।
ভাষাতাত্ত্বিকভাবে `মার’ শব্দটি প্রত—ইন্দো-ইউরোপীয় ধাতু `মের’ থেকে এসেছে যার অর্থ ‘মৃত্যু’— স্নাভিক `মারজানা’ এবং লাতভীয় `মারা’ থেকে এর উৎপত্তি। লাতভীয় পুরাণে `মারা’ অর্থ মা পৃথিবী যিনি কিনা প্রজ্ঞাময়ী এবং উদার। আবার স্নাভ ভাষায় `মারা’ অর্থ হলো শীত এবং মৃত্যুর দেবী। কারণ, মৃত্যু একটি সত্যিকারের পরিবর্তন বা রূপান্তর। `মার’-এর এই তিন কন্যার নাম হলো তানহা (বাসনা), আরতি (ক্লান্তি) এবং রাগ (আবেগ)। উদাহরণস্বরূপ `সমুত্ত নিকায়া’-তে বলা হয়েছে যে `মার’-এর তিন কন্যা সামনে এসেও বুদ্ধকে ভুলাতে পারলেন না।
অনিন্দ্য রূপসী তিন কন্যা
তানহা, আরতিআররাগ—
পিতারনির্দেশেছুটলোবুদ্ধেরধ্যানভাঙাতে,
কিন্তুবুদ্ধসরিয়েদিলেনতাদের,
বাতাসেরএকফুৎকারেযেমনউড়েযায়
দীর্ণ শিমুল তুলা।
কেউ কেউ আবার বলেন যে `মার’—এর এই পাঁচ কন্যার ভেতরে প্রথম তিনজন হলেন, আকর্ষণ, বিকর্ষণ ও মোহভঙ্গ এবং শেষের দুজন হলেন অহংকার ও ভয়।
বুদ্ধ `মার’—এর এই পাঁচ কন্যাকে হারিয়ে জয়ী হলেন তাঁর `বোধি’ অর্জনের লড়াইয়ে।
পালি ভাষায় লিখিত গ্রন্থ আয়াকানা সুত্ত মতে (সমুয়ত্ত নিকায়া ৬.১) ধ্যান থেকে জেগে উঠার পরই বুদ্ধ নিজেকে বিতর্কে জড়িয়ে গেছেন যে, তাঁর কি অন্যদের ধর্ম বা ধম্ম শিক্ষা দেওয়া উচিত অথবা অনুচিত। তাঁর উদ্বেগ ছিল এই যে, প্রকৃতপক্ষে অধিকাংশ মানুষই এত বেশি অশিক্ষিত, লোভ ও ঘৃণায় পরিপূর্ণ থাকে যে, তীক্ষ, গভীর ও অনায়ত্ত্ব এই প্রজ্ঞার পথ তাদের পক্ষে অর্জন করা প্রায় অসম্ভব।
এদিকে সন্ন্যাসী কৌন্ডিন্য এবং তাঁর চার সহচর সিদ্ধার্থ সাধনা হারিয়ে বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছে ভেবে তাঁকে পরিত্যাগ করলেন। এর পরপরই ৪৯ দিনের টানা ও সুবিখ্যাত তাঁর ধ্যানের পর মাত্র ৩৫ বছর বয়সে বুদ্ধ তাঁর `বুদ্ধত্ব’ অর্জন করেন। কোনো কোনো বৌদ্ধ শাস্ত্রের মতে পঞ্চম চান্দ্রেয় মাসে বুদ্ধ তাঁর বুদ্ধত্ব অর্জন করেন। আবার কেউ কেউ বলেন, চান্দ্রেয় দ্বাদশ মাসে বুদ্ধ বুদ্ধত্ব অর্জন করেন। বুদ্ধের শিষ্যরা তাঁকে `বুদ্ধ’ বা `যিনি জাগ্রত’ বলে ডাকেন। তাঁকে ‘শাক্যমুনী বৌদ্ধ’ বলেও ডাকা হয় যার অর্থ ‘শাক্য গোত্রের জাগ্রত যেই জন।‘
বৌদ্ধ ধর্মমতে, ধ্যান থেকে বুদ্ধ যখন আবার তাঁর চৈতন্যে ফিরে এলেন ততক্ষণে পৃথিবীতে মানবজাতির দুঃখ-দুর্দশার কারণ তিনি জেনে গেছেন এবং কী প্রক্রিয়ায় তা দূর করা যাবে তাও তিনি অবগত। এই আবিষ্কারই `চার পরম সত্য’ হিসেবে বিখ্যাত বা বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষার সারবস্তু। এই `চার পরম সত্য’ বিষয়ে প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমেই কেবল কেউ `নির্বাণ’ বা `বোধি’ অর্জন করতে পারবেন বলে মনে করেন। বুদ্ধ `নির্বাণ’-কে ব্যাখ্যা করেন মনের এমন এক অবস্থা হিসেবে যা সব ধরনের অজ্ঞানতা, লোভ, ঘৃণা এবং অন্যান্য দুর্দশা থেকে মুক্ত। নির্বাণ হলো চিত্তের এমন এক অবস্থা অর্জন যখন `পৃথিবীর শেষ’টা দেখা হয়ে যায়। যখন আর কোনো ব্যক্তি সত্তা বা মনের কোনো দেয়াল থাকে না। এমতাবস্থায় `নির্বাণ’ অর্জন করেছেন এমন প্রত্যেক `বুদ্ধ’—কেই চরিত্রের দশটি গুণ অন্তত অর্জন করতেই হয়।
পালি ভাষায় লিখিত গ্রন্থ আয়াকানা সুত্ত মতে (সমুয়ত্ত নিকায়া ৬.১) ধ্যান থেকে জেগে উঠার পরই বুদ্ধ নিজেকে বিতর্কে জড়িয়ে গেছেন যে, তাঁর কি অন্যদের ধর্ম বা ধম্ম শিক্ষা দেওয়া উচিত অথবা অনুচিত। তাঁর উদ্বেগ ছিল এই যে, প্রকৃতপক্ষে অধিকাংশ মানুষই এত বেশি অশিক্ষিত, লোভ ও ঘৃণায় পরিপূর্ণ থাকে যে, তীক্ষ, গভীর ও অনায়ত্ত্ব এই প্রজ্ঞার পথ তাদের পক্ষে অর্জন করা প্রায় অসম্ভব। যা হোক ব্রাহ্ম সহমপতি নামে একজন বুদ্ধকে এই বলে বোঝালেন যে, সব মানুষ না হলেও কিছু মানুষ তাঁর কথা অবশ্যই বুঝবে। বুদ্ধ তখন তাঁর ধর্ম প্রচারে রাজি হলেন।
বৌদ্ধ ধর্মের মূল শিক্ষা বা নীতিমালাসমূহ
বৌদ্ধ ধর্মের ত্রি (তিন) রত্ন:
১. বুদ্ধ (বুদ্ধং শরনং গচ্ছামি—আমি বুদ্ধের শরণ নিচ্ছি),
২. ধম্ম (ধম্মং শরনং গচ্ছামি—আমি ধর্মের শরণ নিচ্ছি),
৩. সঙ্ঘ (সঙ্ঘং শরনং গচ্ছামি—আমি সঙ্ঘের শরণ নিচ্ছি),
চার আর্য সত্য
১) মানব জীবন দুঃখে পরিপূর্ণ। জন্ম দুঃখ, মৃত্যু দুঃখ, অসুস্থতা বা বার্ধক্য দুঃখ। প্রিয়জনের সাথে বিচ্ছেদ দুঃখ, অপ্রিয়ের সাথে মিলন দুঃখ।
২) এই দুঃখের কারণ হলো আমাদের ভেতরের আকাক্সক্ষা বা কামনা-বাসনা।
৩) দুঃখ ভুলবার পথ আছে।
৪) আমাদের আকাক্সক্ষা বা কামনা-বাসনা দমন করলেই আমাদের দুঃখও আপনা-আপনি চলে যাবে।
গৌতম বুদ্ধ ধ্যানের মাধ্যমে আরো উপলব্ধি করেছিলেন যে, সুখ মানুষের জীবনে খুবই ক্ষণস্থায়ী ব্যাপার। কাজেই জীবনের যত ব্যথা এবং যন্ত্রণার সাথে লড়াই করতে হলে নিচের আটটি পথ অবলম্বন করতে হবে। এই আটটি পথকে বলা হয় `আর্য অষ্টাঙ্গ মার্গ’:
১) সম্যক দর্শন : মানব জীবনে দুঃখের শেষ নেই। জন্ম দুঃখ, মৃত্যু দুঃখ, অসুস্থতা বা বার্ধক্য দুঃখ। প্রিয়জনের সাথে বিচ্ছেদ দুঃখ, অপ্রিয়ের সাথে মিলন দুঃখ।
২) সম্যক চিন্তা : মানুষের আকাক্সক্ষা ও কামনা-বাসনাই এই দুঃখের মূল কারণ।
৩) সম্যক সংকল্প : আকাক্সক্ষা বা কামনার নিবৃত্তিই মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারে।
৪) সম্যক ব্যায়াম : মনকে সমস্ত বাসনা, হিংসা, অন্যের প্রতি বৈরীতা বোধ থেকে মুক্ত করার প্রচেষ্টাই হলো সম্যক ব্যায়াম।
৫) সম্যক আজীব : পালি ভাষায় `আজীব’ অর্থ জীবিকা। সৎ পথে জীবিকা নির্বাহ করা যেমন চুরি, ডাকাতি, মদ/মাদকের ব্যবসা এবং অস্ত্রের ব্যবসা থেকে দূরে থাকাই হলো সম্যক আজীব।
৬) সম্যক বাক : মিথ্যা না বলা, কাউকে অপ্রিয় বা কর্কশ কথা না বলা, বেশি কথা না বলাই হলো সম্যক বাক।
৭) সম্যক স্মৃতি : তীব্র বাসনা বা শত্রুতার স্মৃতি মনে না করা।
৮) সম্যক সিদ্ধি : উপরের সাতটি পথ কঠোরভাবে পালন করলেই সিদ্ধি লাভ সম্ভব।
পঞ্চশীল
উপরের আটটি পথই অনুসরণ করা সাধারণ মানুষের পক্ষে অনেক সময় সম্ভব না-ও হতে পারে। তাই সাধারণ মানুষকে বুদ্ধ `পঞ্চশীল’ বা পাঁচটি নীতি মেনে চলতে বলেছেন। সেই পাঁচটি নীতি হলো : ক. কোনো মানুষ বা প্রাণীকে হত্যা করো না, খ. চুরি করো না, গ. ব্যভিচার করো না, ঘ. মিথ্যে কথা বলো না এবং ঙ. মদ বা মাদক দ্রব্য সেবন করো না।