ছোটদের গৌতম বুদ্ধ, ‘পর্ব ১’ । অদিতি ফাল্গুনী
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ অক্টোবর ২০১৮, ১২:১৮ পূর্বাহ্ণ, | ১৯০৮ বার পঠিত
‘রাজপুত্র পরিয়াছে ছিন্ন কন্থা, বিষয় বিবাগী পথের ভিক্ষুক—
মহাপ্রাণ সহিয়াছে পলে পলে প্রত্যহের কুশাঙ্কুর।’
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
জন্ম: ৫৬৩ অব্দ
লু্ম্বিনী (আজকের নেপাল)
প্রয়াণ : ৪৮৩ অব্দ (বয়স : ৮০) অথবা ৪১১ এবং ৪০০ অব্দ
মৃত্যুর স্থান : কুশীনগর, উত্তর প্রদেশ।
বিখ্যাত : বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে।
ছোট্ট বন্ধুরা, এতদিন তোমরা গ্রিস দেশের নানা গল্প শুনলে। এখন তোমাদের শোনাবো ভারত উপমহাদেশের কিছু গল্প। গৌতম বুদ্ধ অথবা সিদ্ধার্থ গৌগম বুদ্ধ ভারত উপমহাদেশেরই সন্তান ছিলেন। তিনি পৃথিবীর চারটি ধর্মের (ইসলাম, হিন্দু, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ) অন্যতম প্রধান বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। বুদ্ধ’ শব্দের অর্থ হলো যিনি জাগ্রত। অধিকাংশ বৌদ্ধ ধর্মীয় গ্রন্থেই সিদ্ধার্থ গৌতমকে প্রধানতম বুদ্ধ মনে করা হয়। তাঁকে অনেকে শাক্য মুনী বলেও ডাকে।
গৌতমের জন্ম এবং মৃত্যুর তারিখ অনিশ্চিত। বিশ শতকের ঐতিহাসিকবিদের মতে, বুদ্ধের জন্ম ৫৬৩ অব্দ থেকে ৪৮৩ অব্দের মধ্যে হয়ে থাকবে। তবে, আরো সাম্প্রতিক সময়ে ইতিহাসবিদদের মতে, বুদ্ধের জন্ম ৪৮৬ থেকে ৪৮৩ অব্দ অথবা ৪১১ থেকে ৪০০ অব্দের মধ্যে হয়ে থাকবে। বুদ্ধের জন্ম, তাঁর জীবনের নানা ঘটনা এবং উপদেশগুলো তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ছাত্র বা শিষ্যরা মুখে মুখে বলে গেছেন। তাঁর মৃত্যুর প্রায় ৪০০ বছর পর তাঁর প্রচারিত উপদেশগুলো সঙ্কলিত করা হয়েছে বলে মনে করা হয়।
বুদ্ধের জন্ম ও জীবন নিয়ে নানা মত
বুদ্ধচরিত, ললিতবিস্তার সূত্র, মহাবাস্তু এবং নিদানকথার বুদ্ধের জন্ম ও জীবন নিয়ে নানা ধরনের গল্প রয়েছে। এদের মাঝে বুদ্ধচরিত সবচেয়ে সম্পূর্ণ জীবনীগ্রন্থ। মহাকাব্যের আকারে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় অব্দে কবি অশ্বঘোষ এই গ্রন্থ রচনা করেন। ললিতাবিস্তার সূত্র এর পরের প্রচীনতম জীবনীগ্রন্থ। এটি মহাযান জীবনীগ্রন্থ যা তৃতীয় শতাব্দী থেকে আজও প্রচলিত। Ôমহাবাস্তু’ বুদ্ধের জীবন নিয়ে লেখা আর একটি চমৎকার জীবনীগ্রন্থ যা খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে লেখা হয়েছে। বুদ্ধকে নিয়ে লেখা `ধর্মগুপ্তকা’ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ এবং এই বইটি Ôঅভিনিষ্কর্মণ্য সূত্র’ নামেও প্রচলিত যার চীনা ভাষায় অনেকগুলো অনুবাদও হয়েছে। অনুবাদগুলো মূলত খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ শতকে করা হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে শ্রীলংকায় বুদ্ধঘোষ কর্তৃক থেরবাদী সম্প্রদায়ের `নিদানকথা’ রচিত হয়। এছাড়াও জাতক কাহিনি (মহাপাদনা সুত্ত) এবং Ôআচার্যভূত সুত্ত’-এ বুদ্ধের জন্ম নিয়ে অদ্ভুত সব গল্প রয়েছে।
যা হোক, বর্তমান নেপালের কপিলাবাস্তুতে গৌতম বুদ্ধের জন্ম হয়েছিল। এছাড়াও বর্তমান নেপালের লুম্বিনীকেও মতান্তরে গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান বলে অনেকেই মনে করেন। সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী জীবনীগ্রন্থগুলোর মতে, বুদ্ধ জন্মেছিলেন শাক্য ক্ষত্রিয় বংশের নেতা রাজা শুদ্ধোদনের ঘরে। রাজা শুদ্ধোদনের রাজধানী ছিল কপিলাবাস্তু। পরবর্তী সময়ে বুদ্ধর জীবৎকালেই কোশল রাজ্যের রাজা কপিলাবাস্তু দখল করে নেয়। গৌতম ছিল তাঁর পারিবারিক নাম। তার মা, রানি মহা মায়া এবং রাজা শুদ্ধোদনের স্ত্রী, যে রাতে গৌতমকে গর্ভে ধারণ করেন সেই রাতে স্বপ্ন দেখেন যে ছয়টি শুভ্র দাঁতঅলা একটি শ্বেত হস্তী তাঁর গর্ভের ডান দিকে প্রবেশ করছে। এই স্বপ্ন দেখার দশ মাস পরেই সিদ্ধার্থ জন্মগ্রহণ করেন। শাক্য ক্ষত্রিয়দের প্রথা অনুযায়ী সিদ্ধার্থ গর্ভে আসার পর রানি মায়া তাঁর বাবার বাড়িতে যাচ্ছিলেন। পথেই লুম্বিনী কাননে একটি শাল গাছের নিচে গৌতমকে তিনি প্রসব করেন।
তবে জন্মের ছয়/সাত দিনের মধ্যেই বুদ্ধের মা মারা যান। নবজাতক শিশুর নাম রাখা হয় `সিদ্ধার্থ’ যার অর্থ হলো ‘যিনি তাঁর লক্ষ্য পূর্ণ করেন।‘ নবজাতকের জন্মোৎসব পালনের সময় সন্ন্যাসী অসিত পাহাড় থেকে এসে রাজপ্রাসাদে এসে শিশুকে দেখে ভবিষ্যদ্বাণী করলেন যে, হয় এই শিশু এক `বড় রাজা (চক্রবর্ত্তী)’ হবে অথবা একজন `পবিত্র সাধক’ হবেন। নবজাতকের জন্মের পঞ্চম দিনের মাথায় রাজা শুদ্ধেদন একটি বড় ভোজের আয়োজন করলেন। আটজন জ্যোতিষীকে সেদিন ডাকা হলো শিশুর ভবিষ্যৎ গণনা করতে। আটজন জ্যোতিষী এক বাক্যে রায় দিলেন যে বুদ্ধ হয় একজন বড় রাজা অথবা একজন বড় সাধক হবেন। শুধুমাত্র জ্যোতিষী কৌন্ডিন্য বললেন যে, সিদ্ধার্থ বড় হয়ে সাধকই হবেন, রাজা নন। তবে সিদ্ধার্থের পিতা রাজা শুদ্ধোদনকে সূর্য বংশীয় রাজা ইক্ষাকুর পুত্র বলা হলেও বর্তমান সময়ের ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে তিনি ছিলেন শাক্য ক্ষত্রিয়দের একটি গোষ্ঠী বা উপজাতির নির্বাচিত রাজা।
সে-সময় গোটা প্রাচীন ভারতেই অনেক ছোট ছোট নগর-রাষ্ট্র ছিল। এই নগর-রাষ্ট্রগুলোকে `জনপদ’ বলা হতো। এই জনপদগুলো পরিচালনায় `গণসংঘ’ বিশেষ ভূমিকা রাখত। সিদ্ধার্থদের গোত্রে জাতি বিভাজন প্রথা ছিল না। এখানে তাই `রাজতন্ত্র’ ছিল না বলেই মনে হয়। তবে অভিজাততন্ত্র বা এক ধরনের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ছিল বলে মনে হয়।
গৌতম বুদ্ধকে তাঁর পিতা রাজা শুদ্ধোদন অবশ্য ধর্মীয় শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে রাখেন। একজন রাজা হিসেবে তিনি চেয়েছিলেন যে, তাঁর ছেলে রাজাই হোক। তিনি চাননি তাঁর ছেলে সন্ন্যাসী বা সাধক হোক। কাজেই ছেলেকে তিনি ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করতে দেননি। কিন্তু একবার জরাগ্রস্ত বৃদ্ধ, একটি মৃতদেহ ও একজন নির্ভীক সন্ন্যাসীকে দেখে তাঁর মনে প্রশ্ন আসে যে, জীবনের উদ্দেশ্য কী? বার্ধক্য আর মৃত্যুবরণই যদি জীবনের শেষ কথা হয়, তাহলে এই রাজ্যপাট, ধন-সম্পদ দিয়ে কী হবে? এই ভাবনা যৌবনেই তাঁকে সন্ন্যাসীর পথে পরিচালিত করল।
সে-সময় গোটা প্রাচীন ভারতেই অনেক ছোট ছোট নগর-রাষ্ট্র ছিল। এই নগর-রাষ্ট্রগুলোকে `জনপদ’ বলা হতো। এই জনপদগুলো পরিচালনায় `গণসংঘ’ বিশেষ ভূমিকা রাখত। সিদ্ধার্থদের গোত্রে জাতি বিভাজন প্রথা ছিল না। এখানে তাই `রাজতন্ত্র’ ছিল না বলেই মনে হয়। তবে অভিজাততন্ত্র বা এক ধরনের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ছিল বলে মনে হয়।