বিশিষ্ট ধান্ধাবাজ ও বিশিষ্ট চোর । মহিউদ্দীন আহ্মেদ
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ আগস্ট ২০১৮, ১:০৮ পূর্বাহ্ণ, | ১৬৯১ বার পঠিত
২৪ ঘণ্টা ধরিয়া যুব উন্নয়ন সংঘের সভাপতি মালেক মনসুর কেচকিকলে আটকা পড়িয়া রহিয়াছেন, পেরেশানে। চুল পরিমাণ নড়িতে পারিতেছেন না, এক ফোঁটা ঘুমাইতে পারিতেছেন না, খাইতে পারিতেছেন না—উপরন্তু কোনো কর্মে স্বস্তি পাইতেছেন না। গায়ের কোথাও চুলকাইলে মনে হইতেছে উহা কেচকিলে পড়িবার ফল, হাঁচি দিলেও মনে হইতেছে উহা কেচকিকলের ফল এমনকি ক্ষণে ক্ষণে যে সিগারেট ফুঁকিতে হইতেছে ইহার কারণ ওই একই। অধিক চিন্তার কারণে তাহার মাথা ও কপাল বাহিয়া ঘাম ঝরিতেছে। যুব উন্নয়ন সংঘের বাৎসরিক ফাংশনে প্রধাণ অতিথি একজন নহে, ঘটনাক্রমে হইয়া গিয়াছে দুইজন। ইহাই কারণ। দুইজনই সমাজে জাঁদরেল-সম্মানিত ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত। ইহাদের একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ি আজগর আলী এবং অপর জন বিশিষ্ট সমাজসেবক জব্বার শেখ।
দুইজনেই আয়োজক কমিটিকে ১ লক্ষ করিয়া টাকা অনুদান দিয়াছেন। চাঁদার পরিমাণ সমান সমান হইয়া যাওয়াতে দুইজনকে লইয়া মালেক মনসুর বড়ই মুসিবতে পড়িয়াছেন; এমতাবস্থায় কাকে রাখিয়া কাকে প্রধান অতিথি বানাইবে, সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারিতেছেন না। ফলে ফাংশনের দিন যতই ঘনাইয়া আসিতেছে সভাপতি সাহেবের কপালে চিন্তার বলিরেখা ততই গাঢ় হইয়া ফুটিয়া উঠিতেছে। তিনি সামান্য ভুল করিয়াছিলেন বটে। অনুদান চাহিবার সময় দুইজনের নিকটই ১ লক্ষ করিয়া টাকা চাহিয়াছিলেন। সমপরিমাণ না চাহিয়া যদি একজনের নিকট কিছুটা বেশি চাহিতেন বা অপর জনের নিকট কম চাহিতেন তাহা হইলে তাহাকে এই কেচকিকলে পড়িতে হইত না।
সামান্য ভুলের মাসুল এখন তাহাকে দিতে হইতেছে পলে পলে। কেননা উহারা যে-ধরনের ক্ষমতাবান মানুষ, ত্রুটি পাইলে মালেক মনসুরের মতো সংস্কৃতিকর্মীকে একটিমাত্র ডলা দিয়া পিষিয়া ছাইভস্ম বানাইয়া ফেলিবে। যুব উন্নয়ন সংঘের সাধারণ সম্পাদক অনন্ত আকাশ সভাপতির উদ্দেশ্যে কিঞ্চিৎ ক্ষোভ প্রকাশপূর্বক বলিল, মালেক ভাই, আপনাকে বেকুব জানিতাম, কিন্তু আপনি যে এতটা বেকুব তাহা জানিতাম না। অনন্ত ছোকড়ার কথা শুনিয়া সভাপতি সাহেব রাগিয়া চেঁচিয়া উঠলেন, দ্যাখো আকাশ, আমি যেবার মেট্টিক পাশ করি সেবার তোমার জন্ম, কথাবর্তাা যাহা বলিবা, হিসাব করিয়া বলিবা। আচ্ছা ভাই, মাফ চাহিলাম।
কিন্তু এখন এই মুসকিল আসান করিবেন কেমন করিয়া? মাথা খাটাও। একটা বুদ্ধি বাহির করো। এমন একটা বুদ্ধি বাহির করো যাহাতে সাপও মরে লাঠিও না ভাঙে। তাহা হইলে এক কাজ করেন। কী? দুইজনকেই প্রধান অতিথি বানাইয়া দেন। কীভাবে? আরে পানির মতো সহজ।
স্টেজের দুই পাশ হইতে দুই উপস্থাপক একই সাথে দুই প্রধান অতিথির নাম ঘোষণা করিবে। দুই প্রধান অতিথি একইসাথে মঞ্চে আসিবে। উহারা একইসাথে হাত নাড়িবে। হাত নাড়িতে নাড়িতে বক্তৃতা শুরু করিবে। তাহার পর কী হইবে? বক্তৃতা দিতে দিতে হট্টগোল বাধিবে। শেষে দুইজনে মারামারি করিয়া একজন আর একজনের কপাল ফাটাইবে। আমরা উহাদের হাসপাতালে লইয়া যাইব। ফাজলামি করিয়ো না আকাশ। ফাজলামি রাখো। ভীষণ চিন্তার ভিতর আছি। তাহা হইলে প্রধান অতিথি-১, প্রধান অতিথি-২—এইরূপে করেন। এইটা অবশ্য খারাপ বলো নাই। এইটা হইতে পারে। খালি তো বয়স নিয়া বড়াই করেন। দেখিলেন—কম বয়সের পোলার মাথা হইতে কী চমৎকার আইডিয়া বাহির হইল? তা তো বাহির হইল, এইবার বলো, প্রধান অতিথি — ১ কাহাকে বানাব, প্রধান অতিথি— ২ কাহাকে বানাব? দুইজনের সাথেই কথা বলেন। দেখেন কে কী হইতে রাজি হয়। কেউ কী প্রধান অতিথি— ২ হইতে চাইবে? তাহা চাইবে না। তারপরও কোনো ক্লু পাইতে পারেন। কথা বলেন।
তাই? হুম। ওকে। মালেক মনসুর কানে মোবাইল ধরিয়া কাঁচুমাঁচুভঙ্গিতে অনন্ত আকাশের দিকে তাকানোমাত্র আকাশ ফিক করিয়া হাসিয়া ফেলিল। মালেক মনসুর ভীষণ রাগ করিলেন। আকাশকে মাইর দেখাইলেন। আকাশ তাহার দিকে এক গ্লাস পানি আগাইয়া ধরিল। পানির গ্লাস নিয়া তাতে চুমুক বসাবেন এমন সময় ওপাশ হইতে ফোন রিসিভ করিল বিশিষ্ট ব্যবসায়ি আজগর আলী। মালেক মনসুর তাহার উদ্দেশ্যে একখানি মোলায়েম সালাম পাঠাইলেন! ভাই সালামালাইকম। অলাইকম সালাম মালেক মিঞা। খবর তো পাই না তোমার? টাকা-পয়সা নিয়া দেখি ডুব দিলা? না ভাই। ডুব দিয়া আর কোথায় যাব? হ্যাঁ সেটাই।
১ লক্ষ ৪৪ হাজার বর্গমাইল। কোথায়ইবা যাইবা? যাগ্যে, ফাংশনের কী অবস্থা বলো? ছোট্ট একটা সমস্যায় পড়িয়াা গিয়াছি ভাই। ফাংশন কি তবে ক্যান্সেল? ক্যান্সেল হইলে টাকা ফেরত দিয়া দাও। না না না ওরকম কিছু না ভাই। ফাংশন অবশ্যই হইবে। আমাদের ফাংশন কোনো বছর মিস হয় না। তাহা হইলে প্রব্লেমটা কী? কীভাবে যে বলি ভাই—তাহারপরও বলি—হইয়াছে কী, এবার ঘটনাক্রমে দুইজন প্রধান অতিথি হইয়া গিয়াছে। কেমনে হইল?
আচ্ছা ঠিক আছে। ফোন দেন। মালেক মনসুর জব্বার শেখকে ফোন করিলেন। জব্বার শেখও আজগর আলীর মতোই কথা বলিল। অর্থাৎ আজগর আলীর নামটি প্রধান অতিথি-১ এবং তাহার নামটি প্রধান অতিথি-২ হিসাবে থাকিবে। কিন্তু আজগর আলীর মতো সেও একখানা শর্ত জুড়িয়া দিলো। সেটা হইল আজগর আলীর নামের আগে বিশিষ্ট চোর কথাটা লিখিতে হইবে। না লিখিলে ১ লক্ষ টাকা ফেরত দিতে হইবে। উপায় না দেখিয়া মালেক মনসুর এখানেও রাজি হইলেন। ফাংশনমঞ্চ তইয়ার যখন শেষ হইল তখন নিশারাত্র।
আর বলিয়েন না, আমি আমন্ত্রণ জানাইয়াছি আপনাকে। ওদিকে আমার সাথে কোনো আলাপ না করিয়া অনন্ত আকাশ আমন্ত্রণ করিয়াছে জব্বার শেখ ভাইকে। অনন্ত আকাশের নামে ডাহা মিথ্যা বলিবার কারণে অকস্মাৎ মালেকের হাত হইতে পানির গ্লাস ছিনাইয়া লইয়া ফেলিয়া দিলো আকাশ। যুব উন্নয়ন সংঘের সামনে একটি কুকুর আরামে ঘুমাইতেছিল। আকাশের ছিটানো পানি ঘুমন্ত কুকুরের গায়ে পড়িবামত্র উহার ঘুম ভাঙিয়া গেল। উহা ধড়ফড় করিয়া উঠিয়া চলিয়া গেল। জব্বার শেখ! এই মালটা আবার কে? আরে চিনিলেন না? ভুড়িঅলা জব্বর ভাই। ধান্ধাবাজ জব্বইরার কথা বলিতেছ? জি ভাই জি। ধান্ধবাজ জব্বর ভাই। তা এত কথা না বলিয়া ধান্ধাবাজ জব্বইরা বলিলেই পারো।
নামি-দামি মানুষ, কেমন করিয়া বলি ভাই। তা সে আবার শেখ হইল কবে? সে তো জব্বর মিঞা। অঢেল টাকা পয়সা হওয়ার পর শেখ হইয়াছে ভাই। তো জব্বইরাও প্রধান অতিথি হইবে আমি প্রধান অতিথি হইব—এটা কেমন করিয়া সম্ভব? সব দোষ আকাশের ভাই। আকাশের ছোট্ট একটা ভুলের কারণে বিশাল এই ফ্যাকরাটা হইয়া গিয়াছে। আমি ওর হইয়া আপনার কাছে মাফ চাইতেছি ভাই। তো আমি এখন কী করিব? ফাংশনে যাওয়া বাদ দিয়া দিবো? যদি বাদ দিতে বলো আমার কোনো আপত্তি নাই। শুধু টাকাগুলা ফেরত দিয়া যাও। না ভাই ব্যাপারটা ওইভাবে নিয়েন না। কাউকে আমরা বাদ দিতে চাই না। আপনারা গণ্যমান্য ব্যক্তি। আমরা চাই আপনারা দুইজনই থাকেন। ছোট ভাই হিসেবে এইটা আমার রিকোয়েস্ট। তাহা তো চাহিবাই। দুইজনের নিকট হইতে ২ লাখ নিয়া গিলিয়াছ।
কী যে বলেন ভাই! টাকা গিলার কি আর সুযোগ আছে? যদি দুই/চার টাকা বাঁচে তা-ও ফান্ডে জমা হইবে।
আচ্ছা আচ্ছা। প্যাচাল থামাও। দুইজনই যেহেতু হইয়াই গিয়াছে জব্বইরার নামটাই আগে দিয়া দাও।
ধন্যবাদ ভাই। আপনি আমাকে বাঁচাইলেন।
না পুরোপুরি বাঁচাইনি। একটা ফ্যাকরা রাখিয়া দিয়াছি।
কোনটা ভাই?
ব্যানারে এবং পোস্টারে জব্বইরার নাম আগে দিবা কিন্তু উহার নামের আগে বিশিষ্ট ধান্ধাবাজ কথাটা উল্লেখ করিতে হইবে।
এইটা কেমন করিয়া করিব ভাই? না করিতে পারিলে আমার টাকা ফেরত দিয়া যাও। কথা এখানেই শেষ। রাখি। না ভাই প্লিজ। ফোন রাখিয়েন না। একটা কথা শোনেন। কথা হাজারটা শুনিব। কিন্তু তাহার আগে বলো, তুমি আমার শর্তে রাজি কি-না? পাঁচ সেকেন্ড চিন্তা করিয়া মালেক মনসুর বলিয়া ফেলিলেন, জি ভাই রাজি। আলহামদুলিল্লা। আজিকের মতো কথা তবে এইখানেই শেষ। এখন একটু ব্যস্ত রহিয়াছি। বাকি বথা পরে হইবে। রিসিভার রাখিয়া গোল গোল চোখে আকাশের দিকে তাকাইলেন মালেক মনসুর। আকাশ বলিল, তেলাপোকা মাছের মতো চাহিয়া কী দেখিতেছেন? নতুন কেচকিকলে পড়িয়া গেলাম যে! বুঝাইয়া বলেন। মালেক মনসুর আকাশকে নতুন কেচকিকল বৃত্তান্ত সবিস্তারে বুঝাইয়া বলিলেন।
অনন্ত আকাশ হো হো করিয়া হাসিতে হাসিতে বলিল, মানুষের নিকট হইতে টাকা আনিয়া ফাংশন করিবেন আবার কেচকিকলেও পড়িবেন না, তাই কি হয়? আরে! তুমি দেখি নিমকহারামির মতো কথা বলিতেছ? সংগঠন কি আমার একলার? তুমি এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক। আমার পরের পদ। পরের পদ হইলে কী হইবে? ভাগ দেওয়ার সময় তো দিবেন দশ ভাগের এক ভাগ। ধুর মিঞা! তুমি হইলা ঘরের শত্রু বিভীষণ। ঠিক আছে — ঠিক আছে, আপনি যাহা বলিবেন তাহাই সই। কাজ আগাইয়া যান। কেমন করিয়া? দুই নাম্বার প্রধান অতিথিকে ফোন দেন। দিতেছি, তবে সাবধান। ফোনের মাঝখানে পানি ছিটাছিটি করিবা না। আপনি আমার দোষ দিয়া নিজের গা বাঁচাইবেন আর আমি বুঝি চাহিয়া চাহিয়া আঙ্গুল দেখিব?
আরে পাগল ওটা দোষ নহে, আদর। আচ্ছা ঠিক আছে। ফোন দেন। মালেক মনসুর জব্বার শেখকে ফোন করিলেন। জব্বার শেখও আজগর আলীর মতোই কথা বলিল। অর্থাৎ আজগর আলীর নামটি প্রধান অতিথি-১ এবং তাহার নামটি প্রধান অতিথি-২ হিসাবে থাকিবে। কিন্তু আজগর আলীর মতো সেও একখানা শর্ত জুড়িয়া দিলো। সেটা হইল আজগর আলীর নামের আগে বিশিষ্ট চোর কথাটা লিখিতে হইবে। না লিখিলে ১ লক্ষ টাকা ফেরত দিতে হইবে। উপায় না দেখিয়া মালেক মনসুর এখানেও রাজি হইলেন। ফাংশনমঞ্চ তইয়ার যখন শেষ হইল তখন নিশারাত্র। মঞ্চশোভা বর্ধনের কাজ করিতে করিতে পূর্বাকাশ তখন ফরসা হই হই অবস্থা। ঠিক সেই সময় মঞ্চে একটা ব্যানার সাঁটানো হইল। তাতে বড় বড় হরফে লেখা বিশিষ্ট ধান্ধাবাজ জনাব আজগর আলী এবং বিশিষ্ট চোর জনাব জব্বার আলী।
কিন্তু সূর্য উঠিবার আগে মালেক মনসুর এবং অনন্ত আকাশ এলাকা ছাড়িয়া ভাগিল।
ইহার পর কাহিনিতে কী ঘটিয়াছিল তাহা জানা না গেলেও ইহা জানা গিয়াছে যে, মালেক মনসুর এবং অনন্ত আকাশ ঢাকার বাড্ডা নামক এলাকায় গা ঢাকা দিয়া রহিয়াছে।