চুপ । রোমেল রহমান
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ আগস্ট ২০১৮, ১১:৫২ অপরাহ্ণ, | ১৬১৬ বার পঠিত
শহরের পুরানা পাগল ব্যাপারটা প্রথমে লক্ষ করে। গতরাতে তার ঘুম হয় নাই ভালো। এবং সে টের পায় জটিল কিছু ঘটতে যাচ্ছে। আগেও এমন হয়েছে। বড় ঘটনার আগের রাত্রে ঘুম আসে না। রাত্রে যখন সে সাতরাস্তার মোড় আইল্যান্ডের উপর শুয়ে ছিল কম্বল মুড়ি দিয়ে আর রাতের নিস্তব্ধতার মধ্যে মধ্যে হুশহাস্ শব্দ করে ছুটে যাওয়া গাড়ির শব্দ ব্যতীত একমাত্র প্রাণ মশা যারা বিরক্ত করেছে গতরাতে। পুলিশ এবং কুকুর কারোর নজরদারি কিংবা পাহারা আমল দেয় না মশা নামক পতঙ্গ।
এইসব বড় ঘটনা সে অনেক আগেই টের পায়। তার ভেতরে যে ব্যাপার আছে সেইটা লোকেরা জানে, কারণ সে যেখানেই যায় একটা না একটা কুকুর তার সঙ্গে জুটে যায়। ব্যাপারটা অনেকটা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাবানদের মতো। যেন স্কট করে তাকে নিয়ে যায়, যখন সে যেই এলাকায় ঢোকে সেই এলাকার অন্ততপক্ষে একটা কুকুর এসে তার পাশে পাশে হাটে। আর পূর্বের কুকুরটা ফিরে যায়। ফলে আজ যে ঘটনা ঘটবে তার রাজসাক্ষি বা প্রথম দেখনেওয়ালা হচ্ছে আমাদের শহরের এক পাগল, যিনি সাতরাস্তা মোড়ে ঘুমিয়ে ছিলেন একটা কম্বল মুড়ি দিয়ে আর যখন তিনি প্রথম মোটরসাইকেলের শব্দ শুনতে পান তখন তিনি কম্বল উঁচা করে মাথা বের করে তাকিয়ে দেখেন যে, সাতরাস্তার মোড়ে তিনটা মোটরবাইকে তিনজন ছেলে মেয়ে মুখোমুখি! তাদের তিনজনের বাইকের সামনের চাকা পরস্পরের সামনের চাকার সঙ্গে লাগিয়ে তারা বাইকের সিটে বসে আছে। আসমান থেকে দেখলে হয়তো মনে হবে একটা ঘূর্ণি! এর পরপরই ঘটনার শুরু…
তারা তিনজন তিনজনের মোটরবাইকের হর্নের সুইচ চেপে ধরে বসে থাকে! ফলে একনাগাড়ে শব্দ হতে থাকে, পিপ্পপ্পপ্পপ্পপ্পপ্পপ্পপ্পপ্পপ্পপ্পপ্পপ্পপ্পপ্পপ্প…… কিংবা প্যাআআআআআ…। প্রথমে কুকুরেরা কিছুক্ষণের জন্য বিভ্রান্ত হয়, আর একসময় নজরে আসে যে, এরা সচেতনভাবেই এই কাজ করে। ফলে যেইসব চা দোকানীরা দোকানের ঝাঁপি খুলতে আসে খুব ভরে তারা দাড়িয়ে ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করে কিন্তু কেউ কোন প্রশ্ন করে না বা বাঁধা দেয় না। একটা হেভি গাড়ি যাওয়ার পথে থমকে দাড়ায় ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করে, কিন্তু কিছুই বুঝতে না পেরে গাড়ি চালক কয়েকবার হর্ন মারে। যখন সে দেখে মোটরবাইকের তিন ছেলেমেয়ে তাকে পাত্তা দেয় না তখন সে গাড়ি টেনে বেরিয়ে যায়।
এর কিছুক্ষণের মধ্যে আরো কয়েকটা গাড়ি থামে, কারণ আলো ফোটার সঙ্গে গাড়ি বেরনোর প্রবণতা বাড়ে। ফলে সেই সব গাড়ির ড্রাইভার বা মালিকেরা ব্যাপারটা বোঝার জন্য থমকে দাড়ায় আর হঠাৎ দেখা যায় একটা চমৎকার গাড়ির মালিক ড্রাইভিং সিটে বসে তার গাড়ির হর্ন চেপে ধরেন! ফলে কিছুক্ষণের মধ্যে এরকম আরো কয়েকজন একজায়গায় হয়ে গেলে, খবরটা ডানা মেলে ছড়িয়ে যায়! এবং কিছুক্ষণের মধ্যে পুলিশ এসে যায়। পুলিশ অবাক বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে কেনোনা চিন্তার বিষয় একটাই, এরা হর্ন দেয় কেন? পুলিশেরা মাথায় মোটাতার জনিত কারণে বুঝতে পারে না কাহিনী, তাই চোখমুখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। ফলে একসময় আরো পুলিশ আসে এবং ব্যাপারটা তরুণ তরুণীদের মধ্যে এমন উস্কানি দেয় যে, দ্রুত তরুণ তরুণীদের একটা ঢল নামে সাতরাস্তা এলাকায়।
নিরাপত্তার মধ্যে বসে যখন মহামান্য সিস্টেমের চালক সিদ্ধান্ত গ্রহণে মাথার ঘাম পায়ে ফেলছেন এবং ভাবছে যদি পালাতেই হয়, তাকে বহনকারী হেলিকাপ্টরের পাইলট কতোটা বিশ্বাসী? কেননা তার চিন্তাকে তো তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন নি। ঠিক তখন সেনাপ্রধানে এসে নতশিরে বলে, মাননীয় আপনার এখানে যদি আক্রমণ হয় তাহলে তো আমরা আটকাতে পারবো না! মহামান্য সিস্টেম চালক বিস্ময়ে তাকিয়ে বলেন, মানে?
ফলে বিভ্রান্ত পুলিশেরা রাস্তা ফাঁকা করতেও সাহস পায় না, তাই ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষকে জানানোই উত্তম বলে তারা এই খবর হাওয়ায় পাঠায়। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে এই কাণ্ডের ভিডিও ক্লিপ্স দ্রুতই ছড়িয়ে যায় আর যারা সকালে ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে যাবার আগেই সোশ্যাল মিডিয়ায় উঁকি মারে তারা ব্যাপারটা দেখে এবং তারা তাদের অন্য ঘুমিয়ে থাকা বন্ধু বা বাড়ির লোকদের জানায় আর ঘটনাটা আরো দ্রুত ছড়িয়ে যায়। ফলে থমকে থাকা পুলিশ ভ্যান থেকে যখন একজন পুলিশ হঠাৎ এই দ্রোহের সঙ্গে একাত্মতা জানাতে পুলিশ ভ্যানের হর্ন চেপে ধরে তখন ঘটনাটা নিউজ হয়ে যায়! ফলে এই খবর দীর্ঘদিন ঘুমন্ত রাষ্ট্রযন্ত্রের জন্য একটা আচানক যন্ত্রণা হয়ে যায়।
ফলে সচিবদের ঘুম ভাঙে এই মুহূর্তেই হাজির হওয়ার ধমক শুনে আর মন্ত্রীরা আতংকে অস্থির বোধ করতে করতে বেরহয়। এবং তাদের সকলের গাড়ি কোন রকম শব্দ করে না! হর্ন না বাজিয়েই তারা মিটিঙয়ে পৌঁছায় কেনোনা সারা দেশে এই ঘটনা ছড়িয়ে গেছে, দেশের সকল মোড়ে মোড়ে কেউ না কেউ অন্তত একজন হলেও হর্ন বাজাচ্ছে! যাদের ইঞ্জিন নেই তারা বাইসাইকেলের বেল বাজাচ্ছে, কেউ কেউ নাকি কলিংবেল বাজাচ্ছে! ফলে রাষ্ট্রযন্ত্রের চালক হেল্পারদের মিটিং যখন শুরু হয় তখন একজন উপেক্ষিত কর্মচারীর মোবাইল ফোনটা আচমকা বেজে ওঠায় অন্য সকলেই প্রায় চেয়ার থেকে লাফিয়ে ওঠে আর তখন তারা শুনতে পায় মিটিং কক্ষের বাইরে থাকা মন্ত্রী সচিবদের কোন কোন গাড়ির ড্রাইভারেরা হর্ন চেপে বসে আছে! ফলে নিউজ দ্রুত ছড়ায়ে যায়, আর প্রত্যেক বিভাগের মানুষদের কেউ না কেউ শব্দ তোলে।
ফলে পুলিশ ব্যারাকে একজন তরুণ পুলিশ তার অস্ত্র থেকে অনুমতি ব্যতীতই আচমকা ফাঁকা আওয়াজ শুরু করার পর ভয় দ্রুত ছড়িয়ে যায়, কেনোনা তাকে থামানোর জন্য সিস্টেমগ্রস্ত পুলিশেরা অস্ত্র তাক্ করে! একমাত্র গুলিকরা তাকে থামানোর উৎকৃষ্ট উপায়। কিন্তু তারা দেখে তাদের দিকেও তাক হয়ে আছে অন্য কয়েকটা বন্দুক!
ফলে সব কিছু যেন অতিমাত্রায় শব্দ করতে থাকে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে জমায়েত হওয়া হাজারো তরুণ তরুণীদের ভেতর এক তরুণ তার তরুণীর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, কি মনে হচ্ছে? তরুণীটি বলে, অনেকদিন পর চারপাশটা জীবিত লাগছে। তরুণ হেসে বলে, অভ্যস্ত না হলেই হয় তাহলেই কেবল ভাংবে। তখন আমরা খবর পাই সেনাবাহিনী, নৌ বাহিনী এবং বিমান বাহিনীকে প্রস্তুত করে ফেলা হয়েছে পুরো সমস্যা সমাধানের জন্য। এবং সাতরাস্তা মোড়ের মূল মবটাকে এক মিনিটের মধ্যে ছাই করে দিতে এয়ারফোর্সের বিমান কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশে উড়বে। কিন্তু প্রতিরক্ষা বাহিনীর লোকেরা কয়েক মিনিটের মধ্যে জানতে পারে, বোমারু বিমান নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া পাইলটেরা প্যারাস্যুট বেয়ে মাটিতে নামছে আর বিমানটা একটা মস্ত মাঠের মধ্যে আছড়ে ফেলে তারা বিকট শব্দ তৈরি করেছে। ফলে ভয় এবার ছড়িয়ে যায় সকল স্তরে। কেউ কিছু বুঝতে পারে না, আর রাষ্ট্রপ্রধান অফিসের চারপাশে দেখা যায় সৈনিক, ট্যাঙ্ক সাঁজোয়ার দেয়াল।
নিরাপত্তার মধ্যে বসে যখন মহামান্য সিস্টেমের চালক সিদ্ধান্ত গ্রহণে মাথার ঘাম পায়ে ফেলছেন এবং ভাবছে যদি পালাতেই হয়, তাকে বহনকারী হেলিকাপ্টরের পাইলট কতোটা বিশ্বাসী? কেননা তার চিন্তাকে তো তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন নি। ঠিক তখন সেনাপ্রধানে এসে নতশিরে বলে, মাননীয় আপনার এখানে যদি আক্রমণ হয় তাহলে তো আমরা আটকাতে পারবো না! মহামান্য সিস্টেম চালক বিস্ময়ে তাকিয়ে বলেন, মানে? সেনাপ্রধান নতশিরে বলেন, প্রতিরোধের জন্য গুলি করলেই তো শব্দ করা হয়ে যাবে, আপনার সিস্টেমে শব্দ করাই তো নিষেধ!