গাধা সময়ের পদাবলী | রোমেল রহমান
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ জুন ২০১৮, ১২:৫৬ পূর্বাহ্ণ, | ২০২৮ বার পঠিত
পরোয়ানাহীন মৃত্যুভূমিতে বেঁচে আছি।
তাই বলে বিক্রি কমে নি চারিদিকে
খুনের খবর আজ বিনোদন,
ব্যথাহীন পালকের ছোঁয়া কিংবা কোমল কিছু চুমু।
তবু ওৎ পেতে থাকে মন
খবর কাগজে যদি লেখা আসে,
‘ভালোবাসা তোমাকে একলা ফেলে ভালো নেই আমি!’
এই আশা বুকে নিয়ে রোজ ভোরে পত্রিকা খুলি
কর গুনে দেখি, নিহতের মিছিলের ভিড়ে আমার নামেই কারো নাম!
এই দেখে নড়েচড়ে উঠি চিবুকের মাছিকে সরাই।
তুমুল বাজনা যেন করতালি আজ
চারদিকে আকাশচুম্বি প্রচারণা,
তাই কি হে গাধা তুমি নিরবেই গান গেয়ে গেয়ে সমগ্র রাত্রির বুকে
শত শত বকুল ফুলের ঝরা দেখে
আরও কিছুদিন বেদনার ভার বয়ে যেতে সম্মত?
আমি সেই গাধা সময়ের পিঠে চোখ বেঁধে পাড়ি দেই
আমার নিহত নাম শিরোনাম হবে ভেবে ভেবে।
তবু দেখি মাছের দামের সাথে বিক্রি হয় গন্ধ সাবান
পচে গেলে আমাদের রাষ্ট্রের দায় নাম মুছে ফেলা।
জন্মসূত্রে আমি পিতা ও মাতার ভাগফল
রাষ্ট্রের নাম আমি কোন হাতে লিখবো এবার?
২
মাছিদের সুখ দেখে নিজের লজ্জা লাগে।
মনে এক ফোঁটা সুখ নেই মাছিদের মতো,
তাই আমি নিহত মানুষ দেখে থুতু দেই নিজের দিকেই।
একবার যদি এইসবে আগুন দেবার মতো দাবানল পাই
নির্ঘাত আমি, আমার আগুন নিয়ে রাজবাড়ি ছারখার করে দেবো!
এইসব ভেবে ভেবে চেয়ে থাকি মাছিদের উল্লাস মিছিলের দিকে
মনে হয় একফোঁটা মাছিদের মতো সুখি হতে পারি নি জীবনে।
তাই থুতু এলে আয়নার নিজের দিকেই তাক করি,
গুলিতে নিহত কোন মানুষের জন্য আমার এইটুকু বেদনা প্রকাশ।
৩
আফিম ফুলের মতো নির্মল ভোরে।
একটি চড়ুই যদি দেখি মৃত ছাদে,
মনে হয় বুকের খিলান সব ভেঙে আসে
চেপে আসে পাঁজরের নদী;
টবের গোলাপ নুয়ে এলে রক্তের ছোপ ভেবে ছিঁড়ে ফেলি সমগ্র শোভন।
এইখানে জরুরত নেই কোন সান্ত্বনা,
নিহত পাখির নামে আহাজারি প্রয়োজন আজ।
অনেক কফিন দেখে দেখে আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে শোকাভিনয়ের,
তত্ত্ব গুঁড়িয়ে;
মিছিলের পূর্বে আমাদের হৃদয় উজাড় করে কান্না জরুরী।
৪
ভালো আছি সন্ত্রস্ত মাছের মতন বটির মুখোমুখি।
খ্যাপলা জালের ফাঁদে আমাদের সব অনুভূতি,
চুম্বন ছুঁড়ে দিলে তাও শুষে নেয় পেয়াদার চোখ!
তোমাকে আঁকড়ে ধরে ভালোবাসি বলবার মতো একটু যায়গা নেই,
তাই;
খিঁচ মেরে বসে থাকি গাধা সময়ের ভারবাহী!
অগাধ জলেতে আমি মাছ শিকারের লোভে ফন্দি করি নি,
‘ভালোবেসে একদিন তোমার চুলের ভাঁজে কনক ফুলের ঘ্রাণ পুরে দেবো!’
এইসব সাধ বুকে এসে আমিও বন্দি হয়ে গেছি শিকারির জালে।
তাই আজ আমাদের বুদ্ধির চারাগাছ পালিত বুদ্ধিজীবী দেখে দেখে বেড়ে ওঠে আপন মহিমা বুকে করে।
‘তবু তুমি আজ কিরকম আছো?’ এই একটি প্রশ্নবোধক ছুঁড়ে দিয়ে টের পাই,
আকাশে রক্তমেঘ বুক চিরে কান্না ঝরাতে প্রস্তুত।
৫
গাধারাই ভালো আছে আজ!
গাধারাই ভালো থাকে সমগ্র জীবন!
কিংবা আমরা সব গাধা হয়ে গেছি,
খাইদাই চুপি চুপি পিপাসা মেটাই
নিয়মিত গান গেয়ে ঘুম পেলে তলিয়ে ঘুমাই।
তবু কালে কালে গাধাদের কেউ কেউ চিৎকার দেয়
কামড়েও দিতে পারে!
তাই গাধা নিরাপদ হলেও তো পুরোপুরি নিরাপদ নয়!
দ্রোহের সূর্য দেখে গাধা যদি নেমে পরে রাজপথে?
নিস্তার নেই তবে!
সকল বুলেট ব্যর্থ হবে ব্যারিগেট গাধার সমুখে!
এখন সময় যায় গাধার পিঠের পর বসে।
আমারা কেবল দেখি মানুষের বেচাকেনা,
হঠাৎ নিখোঁজ হলে চিঠি আর আসে না বাড়িতে!
কারো কারো ভাগ্যে বন্দুকযুদ্ধের পর, নষ্ট খেতাব জিতে ফেরা হয় কফিন বাড়িতে।
এইসব নিয়ে গাধারাও ভাবে,
তাদের ভাবনা নিয়ে ভাবে আরো অনেক চতুর!
গাধার পেছনে আছে রাজকীয় ফেউ।
নজরবন্দী দিনগুলো আমাদের ইতিহাসে লেখা হবে ঘৃণার হরফে,
অথবা জরিন রঙে আঁকা হবে রাজ কুর্নিশে।
তবু ভালো, গাধারা নিজের মনে মাতম জানায়,
গাধাশাস্ত্রই আজ আমাদের আশ্রয়!
শোকপ্রস্তাবে গাধারাই হত্যার বিরুদ্ধে চিৎকার দেয়,
মুলোর ব্যাপারী শুধু বোঝে না সে ভাষার আগুন।
৬
সন্ত্রাসীর মতো এক চাঁদ
সমগ্র রাত্রির দেশ দখল নিয়েছে বলে,
বালকেরা বহুদিন পর মুঠো খুলে জোনাকি ওড়ায়!
সেই বাতি আমাদের আশ্বাস দেয়, অনেক অঢেল আছে বালক বালিকা যারা,
মুঠোর ভেতর কিছু জোনাকির গান জমা রাখে!
তাই দেখে বাঁচি; জোছনার বুকে কিছু ঝিকিমিকি তারা!
বরমাল্যে সজ্জিত শূকরেরা শৃঙ্খলা রক্ষার ভার নিয়ে ভারি!
নিজ মনে নিজেকেই ঘৃণা করি আজ।
ভালোবেসে চুমু খাই বেদনার ঠোঁটে,
চাঁদের কলঙ্ক মুছে যায় প্রতিদিন মানুষের পরাজয় দেখে।
৭
‘গাধা একটি মহৎ জীব!’
এইকথা শুনে, আমার নিজেকে মনে হল, গা…ধা!
যেহেতু ভীষণ ভারি মনে হয় এই বেঁচে থাকা;
তবুও পারি না থেমে যেতে, বয়ে যাই টেনে যাই টাল খেয়ে খেয়ে।
পুরোটা আঙিনা আজ রাণীর পোশাক পরে আছে,
ধর্ষকের পাহারায় ফুটছে মালতী ফুল;
জন্মের অপরাধে রক্তাক্ত বালিকা
তোমার চিবুকে শোক, চোখে ব্যথা, চুলে মাকড়ের জাল,
এইসব দেখে; আমার নিজেকে মনে হয়: অব্যর্থ গাধা।
মহৎ পদবী চেটে নিজেকে নিজের হাতে সান্তনা দেই;
বিচারহীনতা যেন গৌরবের পালক এখন।
নিজহাতে নিজেকে হত্যা করা ছাড়া আপাতত নির্বাণ নেই,
অথবা
পাল্টা খুন জনতার শেষ তলোয়ার।