বাংলার ধ্রুপদী সরদার । সাখাওয়াত টিপু
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ জুন ২০১৮, ১২:৪৯ অপরাহ্ণ, | ১৬১৫ বার পঠিত
বাংলার জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের নামে নানা অনুষ্ঠানে নানা মিথ চালু আছে। ‘মিথ’ সত্য না আবার ‘মিথ্যা’ না। মিথ মানে সত্য মিথ্যার মিলন চিহ্ন। ফরাসি দার্শনিক রলাঁ বার্ত এই রকম ইশারা করেছেন। আমরা কিন্তু রলাঁ বার্তের যুগে নাই। আমাদের যুগে ‘মিথ’ গল্পের মত শোনায়। আমরা আপাতত মিথকে গল্প আকারে নিলাম। গল্প এই – একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনতিতরুণ শিক্ষক আমাকে একখানা মিথ শুনিয়েছিলেন। আর মিথ হচ্ছে, আবদুর রাজ্জাক একদিন শ্রেণিকক্ষে শিক্ষা বিলাতে এসেছেন। কিন্তু শিক্ষা না বিলিয়ে তিনি বললেন, ‘আপনেরা আমার ক্লাস কইরা কি করবেন! আমার ক্লাস থিকা নিচে গিয়া সরদার ফজলুল করিমের বক্তৃতা শোনেন। জীবনে কামে আইব। তার বক্তৃতায় সমসাময়িক রাজনৈতিক অনেক বিষয়ে জানবার পারবেন।’ মদীয় বাংলার সাহিত্যিক আহমদ ছফাও রাজ্জাকের নামে একথা চাউর করেছিলেন। যদ্যপি আমার গুরু বইতে সেই গল্প চালু আছে। তবে একই গল্প আরেকজনের মুখে বিবরণ ভিন্ন রকম হতে পারে। বক্তব্যের একই। আবদুর রাজ্জাকের দোহাই খানিক সত্য হতে পারে। কারণ আবদুর রাজ্জাকের সাথে সরদার ফজলুল করিমের সম্বন্ধ নিছক ছাত্র-শিক্ষক না। সম্পর্ক বলতে, জ্ঞানালয়ে অপর জ্ঞানকে চিহ্নিত করা। মানে একটা সমাজে চিন্তার বিকাশমান ধারা সৃষ্টি করা। আগায়ে বললে, সমভাবে বন্ধন বা সেতু তৈয়ার করা। আমাদের তর্ক অধ্যাপক রাজ্জাক যদি দার্শনিক হন, তাহলে সরদার ফজলুল করিম দার্শনিক নন কেন — এমন পান্থপথে নহে। এহেন তর্ক বাতুলতা মাত্র। আমরা বলব, যিনি দেখেন — বস্তু আর ভাবের বিচার করেন, তিনিই দার্শনিক। কথাটা হেয়ালি মনে হতে পারে কারো কারো। তবে খেয়ালি বিষয়। কি খেয়াল করবেন?
সরদারের ব্যক্তিত্ব তিনে-ই। একাধারে তিনি রাজনীতিক, শিক্ষক আর ভাবুক বা লেখক। রাজনীতির জন্য তিনি শিক্ষকতা পেশা ত্যাগ করেছেন। ত্যাগ করেছেন বিলেতি বৃত্তিও। ১৯৪৬ সালে কমরেড মুজফ্ফর আহম্দের পরামর্শে বিলেতের শিক্ষা বৃত্তি প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। আর ১৯৪৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে শিক্ষকতা ছাড়েন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক মনোনীত হন। কমিউনিস্ট পার্টি তখন নিষিদ্ধ। নেতা-কর্মীরা নানাখানে আত্মগোপনে। সেবারকার ঘটনা। গোপনে পার্টির লোকজন সন্তোষ গুপ্তের বাড়িতে যাওয়া-আসা করতেন। ১৯৪৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর জ্ঞান চক্রবর্তী, সরদার ফজলুল করিম, সন্তোষ গুপ্তসহ কয়েকজন গ্রেপ্তার হন। মজার ব্যাপার — সন্তোষ গুপ্ত তখন আইজি অব প্রিজন্সের কনফিডেন্সিয়াল ক্লার্ক। কারাগারে আইজি আমিন হোসেন নিজের ক্লার্ক সন্তোষকে দেখে বিস্মিত হন। বলেন, ‘সন্তোষ — তুমিও এর মধ্যে আছো।’ এক নাগারে কয়েক বছর জেল খাটেন সরদার ফজলুল করিম। আরও ২/১ বার কারাবরন করতে হয়েছিল তাকে। বন্দিদের অধিকার নিয়ে অনশনও করেছেন কয়েকবার। কারাগারে থেকে সংবিধান সভার সদস্য হন। প্রশ্ন হল – সরদারের আদর্শ আসল কোথা থেকে? আদর্শ তো ব্যক্তি প্রধান ব্যাপার না। নিছক সামাজিকও না। বলা যায়, বিপ্লবীপনার রাজনীতি। পাঠিকা একটু খেয়াল করবেন। রুশ লেখক ফিয়েদোর দস্তয়েভস্কির প্রভাবও কি পড়েছিল সরদারের জীবনে?
ফরাসি বিপ্লবের পরের কথা। তার ঢেউ নানা দেশে যাচ্ছে। রাশিয়ায় তখন চলছে জার স¤্রাট নিকোলাসের শাসন। সে সময় ফিয়েদোর দস্তোয়ভস্কিরা রাজনীতি, সাহিত্য আর দর্শন নিয়ে আড্ডা চালাতেন পেত্রোস্ভস্কির বাড়িতে। সব ধরনের লোকই আড্ডার সদস্য। আড্ডার কারো কারো মত, ‘চাষাভুষাদের যে সব অখাদ্য খেতে দেয়া হয়, তা যদি সম্ভ্রাট নিকোলাসকে খেতে হতো তাহলে কেমন হতো?’ মূলত ওই আড্ডা মতাদর্শিক বিপ্লবীদের। একবার এই আড্ডার সিদ্ধান্ত হয় পত্রিকা প্রকাশের। প্রেসের ভার দেয়া হয়েছিল দস্তোয়ভস্কিকে। কিন্তু পত্রিকাটির একবর্ণও ছাপা হয়নি। তবুও আড্ডা থেকে গ্রেফতার করা হয় ২৮ জনকে। অভিযোগ আনা হয় জার সম্ভ্রাট নিকোলাসের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদোহীতার। আদালত সকলের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। দস্তোয়ভস্কির অপরাধ ছিল, বেলোনস্কি আর গোগোলের চিঠি পাঠ। আদালতে দস্তোয়ভস্কি বলেন, ‘নিজের স্বাধীন মত যদি প্রকাশ করতে না পারি তাহলে আমাকে শিক্ষা দিয়ে কি লাভ হয়েছে?’ সম্ভ্রাট নিকোলাস নির্মম রসিকতা করেছিলেন মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামিদের নিয়ে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবেন না। কিন্তু মৃত্যু পরোয়ানার দিনক্ষণ মোতাবেক, খোলা মাঠে সবাইকে হাজির করা হল। প্রত্যেকের জন্য খাটিয়াও হাজির। পুরোহিত ডাকা হল। সৈন্য-পুলিশ আনা হল। গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবে এমন ভাব! কিন্তু দস্তোয়ভস্কি বললেন, ‘আমরা কিন্তু এত তাড়াতাড়ি মরছি না।’ দস্তোয়ভস্কির কথায় করুণ রস আছে। রস হল, মৃত্যুর চেয়ে বড় সত্য আদর্শ। ব্যক্তি মানুষ হয়ে ওঠার রূপ বা লড়াই। এই রূপ ব্যক্তির নিছক আকার নয়, সমাজেরই সাকার। ফলে আদর্শগতভাবে একজন মানুষ যে সমাজ দেখতে চান সে সমাজ তাকে বাঁচিয়ে রাখে। ফলে দস্তোয়ভস্কির পদাঙ্কের প্রভাব সরদারের ওপর পড়েছে। সেটা এখনো আমাদের চিন্তাশাস্ত্রে ক্রিয়া করছে বৈকি! আমরা সেটাকে কিভাবে দেখব?
আমাদের ঢাকায়, শহরে চিন্তাশীল লোকের বড়ই অভাব। মাঝে মাঝে বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগে। নানা ‘ব্যক্তি’ আছেন বটে, তবে ‘মানুষ’ নাই বললেই চলে। ব্যক্তি অবয়বগুলো ইটের পর ইটে চাপা পড়ে বালিকণা হয়ে আছেন। কখনো কখনো ইটের রঙ আর রক্তের রঙের ফারাক বোঝাটাই মুশকিল। একদা হয়ত এখানকার মানুষজন ‘রক্ত দিয়ে চিন্তা’ [আহমদ ছফা] করতেন। আর ‘প্রাণ দিয়ে চিন্তা’ করেন এখন। এমন বেদনাময় দর্শনের উত্তর উত্তরে নাই।
দর্শন নিয়ে বাঙাল সমাজে নানা কুসংস্কার আছে। কুসংস্কার এই – বাংলা ভাষায় দর্শনের অনুবাদ করা সম্ভব নয়। ধারণাটি, সংস্কার মধ্যবিত্ত সংস্কৃত সমাজের। সরদার ফজলুল করিম সেই বেলায় অতিক্রম। তিনি ‘অসম্ভব’কে সম্ভব করেই দেখালেন। কারণ অপূর্ববাংলায় তিনিই প্রথম বাংলা ভাষায় দর্শন কোষ রচনা করেছেন। সরদারের দর্শন কোষ প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে। তার আগে বাংলা ভাষায় যে দুটি বহি পাওয়া যেত সেগুলো ঠিক দর্শন কোষ নয়। বই দুটোর একখানা শ্রী নগেন্দ্রনাথ বসুর ‘বিশ্বকোষ’। অন্যখানা কলিকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ‘ভারত কোষ’। দর্শন কোষ লিখতে সরদার ‘ডিকশানারি অব ফিলোজফি’, ‘এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটেনিকা’, ‘এনসাইক্লোপিডিয়া অব ফিলোজফি’, ‘এনসাক্লোপিডিয়া আমেরিকানা’, ‘চেম্বার’স এনসাইক্লোপিডিয়া’, ‘এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলেজিয়ন এন্ড এথিকস’, ‘হিস্টোরি অব ওয়েস্টার্ন ফিলোজফি’, ‘এভরিম্যান’স এনসাইক্লোপিডিয়া’ বইয়ের দেনা করেছেন। এটি নিছক অনুবাদের দর্শন কোষ নয়। এতে যুক্ত আছে বাঙাল দার্শনিকদেরও একগুচ্ছ ভাবার্থ। বলা যায়, বাংলায় দর্শনের আভিধানিক জ্ঞানের সূত্রপাত বটে। আমরা হয়ত দোষ পাড়তে পারি, দর্শন কোষে ‘এই নাই’ ‘সেই নাই’। যা নাই তা তো নাই। সেটা আলোচ্য নহে। আলোচ্য যে, সরদার দর্শন চিন্তার সূত্র দেখিয়ে দিলেন। সরদার বলেন, ‘দর্শন কোষ’-এর অবশ্যই দর্শন আছে। … সেটি জটিল দর্শন নয় । সে কেবল এই সহজ বিশ্বাস যে, মানুষের সামাজিক জীবন নিয়ত বিকাশশীল। প্রবহমান। কেবল যান্ত্রিকভাবে নয়। সচেতন, সংঘবদ্ধ, সমাজগত যৌথ প্রচেষ্টায় উত্তম থেকে অধিকতর উত্তম জীবন সৃষ্টির লক্ষ্যে বিকাশমান প্রয়াস।’ জ্ঞানগত জগতে সরদার স্থিত নন। স্থিতির সূত্রকে বদলানোর পথিক তিনি। এবং প্রবহমান। ধ্রুব পথ বটে। সেটা কেমন?
বাংলা শব্দশাস্ত্রে ধ্রপদ শব্দকে ধুরপদ অথবা ধ্রুবপদ বোঝায়। আদতে চালু বাংলায় ধ্রুপদ শব্দের অর্থ চারি তুকের গীত বিশেষ। অথবা কলির গীতও বলা যেতে পারে। চারি তুকের ভিন্ন ভিন্ন নাম আছে। তবে ধ্রুপদ, খেয়াল আর টপ্পার মধ্যে ধ্রুপদই প্রাচীনতম। যারা ধ্রপদ গান তাদের বলা হয় ধ্রুপদী। আমাদের বিবেচনায় সরদার ফজলুল করিম একজন ধ্রুপদী মানুষ। তিনি কখনো গান গেয়েছিলেন কি না জানি না। তবে বাংলাভাষা তার নামের সাথে প্লেটো, এরিস্টোটল, জাঁ জাক রুশোর মতো ধ্রুপদী দার্শনিকদের নাম মিলিয়ে নিয়েছেন। কথাটা কেমন? সরদারের মুখে শুনি, ‘‘রুশো অবশ্যই আবেগময় ছিল। এখানে আমার বলা উচিত ছিল: ‘রুশো অবশ্যই আবেগময় ছিলেন।’ আমি তা বলিনি। কারণ রুশো আমার সমগোত্রীয় এবং বন্ধুপ্রতীম। তাকে সম্মানবাচক ক্রিয়াপদে ভূষিত করতে চায়নি। তাহলেই তার সঙ্গে আমার একটা মানসিক ব্যবধান তৈরি হত। কিন্তু প্রথাগত পণ্ডিতরা তাকে তাদের গোত্রভূক্ত পণ্ডিত মনে করেনি। তাই নিন্দার ভঙ্গিতে তাকে অভিযুক্ত করেছে এই বলে যে, রুশো আবেগ দ্বারা চালিত।’’ কথা হলো, সরদার ফজলুল করিমের কেন এমন পান্থে হাঁটলেন?
একদিন ইন্দিরা রোডের বাসায় আড্ডায় জিজ্ঞাসা করেছিলাম, রুশোর আবেগ বিষয়ে। তার দুই টুকরো উত্তর, ‘আবেগ ছাড়া মানুষ মানুষ থাকে না। আবেগ বাদে মানুষ যন্ত্র। যান্ত্রিক মানুষ যন্ত্রেই পরিণত হয়।’ বললাম, ‘আবেগে যুক্তি কই?’ তিনি বললেন, ‘যে যুক্তি বা ঘটনার কারণে আবেগের জন্ম সেটাকে তুমি যুক্তি হিসেবে নিচ্ছ না কেন?’ বললাম, ‘নিছক সংবেদনশীলতা সত্য বা ন্যায় প্রকাশের পথ প্রশমিত করে।’ তিনি মুচকি হাসলেন। আর থমাস হবসের গল্প বললেন। বললেন, হবসের কথা মানলে বলতে হবে ‘প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ আসলে হিংসাত্মক। পরস্পর পরস্পরকে হত্যাকারী’। তিনি তো রুশোর মতো ভাবছেন না, আদিতে মানুষ মানুষ ছিল। কিন্তু রুশো তো ‘স্টেট অব ন্যাচার’ [মানে রাষ্ট্রের চরিত্র] প্রশ্নকে উপেক্ষা করেননি। ফলে বলা যাবে, ‘আবেগেরও যুক্তি আছে।’ হবস মানুষের স্বাধীনতাকে ভেবেছিলেন, ‘আইন-কাঠামোর ভেতরে মানুষ স্বাধীন’। আর রুশো জন্মে ‘মানুষের স্বাধীনতা দেখেছেন।’ তো তুমি এখন বলতে পারো, রুশো সহজ দার্শনিক। কেননা রুশোর স্বাধীনতা দেখা থমাস হবসেরও আগে। মানে ‘শৃংখলার ভেতর স্বাধীনতা তো অপরের অধীনতা।’ রুশো দার্শনিক হিসেবে হবসের চেয়ে ভাল। কারণ এটা স্বভাবজাত। এই কারণে রুশোকে আমার সমগোত্রীয় আর বন্ধু বলেছিলাম।
আমাদের ঢাকায়, শহরে চিন্তাশীল লোকের বড়ই অভাব। মাঝে মাঝে বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগে। নানা ‘ব্যক্তি’ আছেন বটে, তবে ‘মানুষ’ নাই বললেই চলে। ব্যক্তি অবয়বগুলো ইটের পর ইটে চাপা পড়ে বালিকণা হয়ে আছেন। কখনো কখনো ইটের রঙ আর রক্তের রঙের ফারাক বোঝাটাই মুশকিল। একদা হয়ত এখানকার মানুষজন ‘রক্ত দিয়ে চিন্তা’ [আহমদ ছফা] করতেন। আর ‘প্রাণ দিয়ে চিন্তা’ করেন এখন। এমন বেদনাময় দর্শনের উত্তর উত্তরে নাই। আমরা তো আরিস্ততলের প্রাণ খুলে বলি না, ‘সকল অন্তর্ঘাতের কারণ অসাম্য’। যদি বলতাম, সরদারের বিপ্লবের ধারণা আমলে নিতাম। হয়ত সরদারের সুরে বলতাম, ‘আমরা তো বিপ্লবের মধ্যেই আছি।’ সরদার এই থাকাকে ‘মানুষ’ বলে ধরে নিয়েছেন। তিনি এও মনে করতেন, সরদার ‘নাই’ কথাটা বস্তুগত। ভাবগতভাবে তিনি ‘মানুষ’ আকারে হাজির। অন্তত বাংলার চিন্তার জগতে। বাংলার দর্শনের কুঠুরিতে।