বিশাখা আলদেবারান | অদিতি ফাল্গুনী
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ মে ২০১৮, ১২:৪২ অপরাহ্ণ, | ১৬৪৬ বার পঠিত
‘ভাবতে গেলে এটা কি বেশ অবাক করাই নয়, হে আমির, যে ইসলামের মহান খলিফা হযরত উমর যে সমস্যায় পড়েছিলেন পারস্য জয়ের পরে- সেই একই সমস্যা মোগল সালতানাতকেও সহ্য করতে হচ্ছে ভারতবর্ষে এসে?’
‘বিলকুল একমত জাঁহাপনা!’ আবুল ফজল বিচলিত অবস্থায় ঘামতে থাকেন, ‘একদম সেই একই সমস্যা। আরবের হিজরি বর্ষপঞ্জি কিনা চাঁদের হিসেবে চলে আর তাই ওদের বছর ছিল ছোট- ৩৫৪ দিনেই ফুরিয়ে যেত। অন্যদিকে পারস্যের বর্ষপঞ্জি চলে খোদ সূর্যের হিসেবে। ৩৬৫ দিনের কমে একেবারেই নয় শাহেনশাহ! কাজেই ইরাণী চাষীদের ভাগ্যে বলতে গেলে জুলুমের মত দেখা দিল যে ফসল কাটার আগেই তাদের খাজনা শোধ করতে হচ্ছে। হযরত ওমর দেখলেন মহা বিপদ। একে নয়া দেশে ভিন ভাষী মানুষদের সাথে যুদ্ধে জেতা- ভেতরে ভেতরে অনেকেরই বিদ্রোহ বা অভিমাণ ছিল- উপরে উপরে হয়তো বশ মেনেছে। ধর্ম বদলেছে। কিন্ত সব দেশেরই নিজের মতো করে কৃষি থাকে জাঁহাপনা, নিজের মত ভুগোল, খাবার, পোশাক কি উৎসব! সে সব ধরে টান মারতে গেলে-’
‘পারস্যই তবে হাতের মুঠো থেকে বরবাদ হয়ে যায়!’
অমাত্য আবুল ফজলকে থামিয়ে দিলেন শাহেনশাহ । আজ তাঁর মন খুব একটা কাব্য-পরিহাস-সঙ্গীতের জন্য প্রসন্ন হয়ে নেই। তানসেনকে ডাকা হয়নি। আসবেন না বীরবল। অর্থনীতির নানা জটিল আলাপ যেদিন আবুল ফজলের সাথে তাঁকে করতে হয়, সেদিন পরিহাস বা সঙ্গীত দূরে থাকে।
‘খোদ খলিফা ওমরের মত মানুষকে যেখানে অগ্নি উপাসকদের বর্ষপঞ্জির সাথে আপোষ করতে হয়েছে, সেখানে আমি জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবর কোথাকার কে? দরবারের মোল্লারা তো এসব বুঝবে না- তারা শুধু কথায় কথায় বলবে, আকবর কাফেরদের তোয়াজ করে। আকবর আল্লা-খোদা মানে না। আরে- দেশটাই তো বলতে গেলে হিন্দুদের! সংখ্যাগরিষ্ঠ তো ওরাই। নেহাৎ এরা খুব নিরীহ প্রকৃতির মানুষ বলে- অনেক ফসল হয় বলে, আমাদের পূর্বপুরুষ যেখান থেকে এসেছেন সেই ফারগানার মতো এখানে রুক্ষ প্রকৃতি নয় বলে মানুষগুলো আরামে থাকতে চায়। গান-বাজনা করে, বারো মাসে তেরো পার্বণে মত্ত থাকে। আমাদের মত লড়াইটা করতে জানে না। কিন্ত, বাংলা মুল্লুকে দ্রুতই যদি চাষীদের খাজনার বিষয়টির একটি সুরাহা আমরা না করতে পারি, তবে বিদ্রোহ আবার শুরু হবে বলে!’
‘সে আশঙ্কা ওড়ানো যায় না বাদশাহ্! বাংলা একেই বিদ্রোহের মুল্লুক। তাতে হিজরি সণের জন্য ঐ ইরাণের চাষীদের মতোই এখানেও একই হাল। খাজনা যখন আদায় করতে হচ্ছে তখন ফসল তোলার মৌসুম না। বেচারাদের কষ্ট হচ্ছে খুব। আর এই কষ্ট বেশিদিন চললেই দেখা দেবে বিদ্রোহের ফুলকি। কি করা যায়?’
দরবারের সব পদস্থ অভিজাতবর্গকে আজকের সভায় আমন্ত্রণ জানানোর মাধ্যমে একথা সুবিদিত হোক যে আজকের সভার মূল লক্ষ্য এমন একটি নতুন কালের প্রতিষ্ঠা যার মাধ্যমে প্রকৃতির সময় পরিবর্তনের চক্রগুলো নির্দ্ধারণ করা তথা ঋৃতু গণনার বিষয়টি যেন নিখুঁতভাবে সম্পন্ন হয়, সেই বিষয়ে নতুন প্রচেষ্টার শুরু হতে যাচ্ছে। যেন রাজকীয় সব কার্যক্রম নির্ভুল সম্পন্ন হতে পারে এবং কোন ক্ষেত্রেই দিন-তারিখ হিসাবে কোন ব্যত্যয় না ঘটে।’
‘আমির ফতুল্লা সিরাজি কোথায়? তাঁকে বলো কিছুদিন গোলা-বারুদ বা কামানের নতুন নক্সা আবিষ্কার না করে তাঁর আসল কাজ- জ্যোতির্বিজ্ঞানের দিকে যেন মন দেয়। পার্সী গ্রহ-নক্ষত্র আর এখানে হিন্দু জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সাথে মিলে ভারতীয় গ্রহ-নক্ষত্র নিয়ে এক বছর পড়া-শুনা করুক। দরবার থেকে তাঁর গবেষণার খরচ সব বহন করা হবে। কিন্ত বাংলার চাষীর জন্য একটি নতুন বর্ষপঞ্জি তৈরি করুক সে।’
‘খুব ভাল সিদ্ধান্ত, জাঁহাপনা! কিন্ত এই সিদ্ধান্ত কি দ্রুতই দরবারে ফরমান আকারে আসবে বলে প্রত্যাশা করা যায়?’
‘অবশ্যই। ফরমান মুসাবিদা করার নির্দেশ দেয়া গেলো।’
২
দরবারে মোল্লারা কি আবার হৈ চৈ শুরু করবে? জালালুদ্দিন মোহাম্মদ আকবরের দোষ-ত্রুটি ত’ কম নয়। পাঁচ স্ত্রীর ভেতর প্রধানা স্ত্রী রাজপুত আর তাঁর পুত্রই পরবর্তী বাদশাহ্! হিন্দুদের এখন আর ‘জিজিয়া’ কর দিতে হচ্ছে না। প্রধান সেনাপতি মান সিংহ রাজপুত- অমাত্য থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীতে প্রচুর হিন্দু বড় বড় পদে আসীন। দ্বীন-ই-ইলাহী নামে এক নয়া ধর্মের কথাও ভাবছেন জালালুদ্দিন । ভারতীয় উপনিষদ আর ইসলামী শাস্ত্রের বাণী মিলিয়ে মিশিয়ে এক নব বিধানের গুরু ভাবনা তাঁর মাথায়। যে নয়া ধর্ম একই দেশের দুই সম্প্রদায়ের ভেতর কথায় কথায় বিবাদ-বিসম্বাদ তৈরি করবে না, পারষ্পরিক মৈত্রী বা আত্মীয়তা গড়ায় সৃষ্টি করবে না প্রতিবন্ধকতার অনড় দেয়াল। তারপর এখন আবার আকবরের মাথায় চেপেছে এই বর্ষপঞ্জি সংস্কারের ভাবনা। কিন্ত একটা জিনিষ বেশ বোঝেন আবুল ফজল। জালালুদ্দিন একশো ভাগ শাসক। দেশ কত ভাল ভাবে, কতটা ঠান্ডা মাথায় আর বিচক্ষণতার সাথে শাসন করতে হয় সেটা ছাড়া আর কিছু তাঁর মাথায় নেই। সারাদিন ধর্ম নিয়ে ভাবতে গেলে দেশ শাসন মাথায় উঠতো! কোষাগারে সম্পদ দিন দিন বেড়েই চলেছে। দেশে মানুষ মোটামুটি খেয়ে-পরে আছে। ধর্ম নিয়ে রাতদিন খুনোখুনি, উত্তেজনা নেই। কবিতা, দর্শণ, জ্যোতির্বিজ্ঞান, নৃত্য আর সঙ্গীত, চিত্রকলার অনুশীলন বাড়ছে। খুব অন্যরকম দৃষ্টির মানুষ না হলে পিতা হুমায়ুন যখন পাঠাগারের মর্মর সিঁড়িতে পা পিছলে মারা গেলেন, তখন নিতান্ত বারো বছরের বালক আকবর। সেই অনভিজ্ঞ বালক আজ তামাম হিন্দুস্থানের শাসক- বাংলা থেকে দাক্ষিণাত্য অবধি । তিনি যা করেন নিশ্চিত বুঝে-শুনেই করেন। এছাড়া আবুল ফজল নিজেও বুঝছেন এই কৃষিপ্রধান দেশে- মধ্য এশিয়ার মত পশুপালন বা বাণিজ্য যার অর্থনীতির প্রধান দিক নয়- সেখানে চাষীদের কাছ থেকে খাজনা নিয়মতান্ত্রিক ভাবে আদায় করতে হলে হিজরি সণ সংষ্কার না করলেই নয়!
‘গোটা ভারত এতদিন চলে এসেছে হিন্দু জ্যোতিষীদের তৈরি পঞ্জিকার শাসনে। আজো প্রচলিত এই পঞ্জিকাগুলোয় বছরের হিসাব হয় সৌর বছরে। আর হিজরি সণের মাসগুলো আমরা চাপিয়ে দিয়েছি চান্দ্র মাসের হিসেবে। এতেই গোলমাল বাঁধছে, বুঝলে আবুল ফজল? নতুন যে বর্ষপঞ্জি আমরা করবো, তাতে মাসগুলোও সৌর মাস হতে হবে। নাহলে চাষীদের ফসল তোলা আর খাজনার হিসাব কিছুতেই মেটানো যাবে না। আসলে জোর করে, উপর দিয়ে চাপিয়ে কিছুই হয় না। তোমার স্ত্রীকেও যদি তুমি জোর করে পেতে চাও তো দূর্ঘট ঘটে!’ বলেছিলেন বাদশাহ্ ।
আজ তাই দরবারে নয়া বর্ষপঞ্জি তৈরির জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতুল্লাহ্ সিরাজিকে ডাকা হয়েছে। তাঁকে বাদশাহি ফরমান পড়ে শোনানো হবে যেখানে বলা হবে তাঁকে দেয়া নতুন কাজের দায়িত্বের কথা। রাজকীয় এই ফরমানের মুসাবিদা করতে গত তিনটি রাত বিনিদ্র কেটেছে আবুল ফজলের:
‘এই সুন্দর সময়ে এবং কল্যাণকর এই যুগে, যখন ক্রমাগত বিজয়ের কার্ণ বা চক্র ঘূর্ণায়মান আর সৌভাগ্যের প্রসন্ন দিনগুলো হাসিমুখে নতুন বার্তার সূচনা করছে, গোটা বিশ্ব শাহেনশাহের সামনে অবনত।
দরবারের সব পদস্থ অভিজাতবর্গকে আজকের সভায় আমন্ত্রণ জানানোর মাধ্যমে একথা সুবিদিত হোক যে আজকের সভার মূল লক্ষ্য এমন একটি নতুন কালের প্রতিষ্ঠা যার মাধ্যমে প্রকৃতির সময় পরিবর্তনের চক্রগুলো নির্দ্ধারণ করা তথা ঋৃতু গণনার বিষয়টি যেন নিখুঁতভাবে সম্পন্ন হয়, সেই বিষয়ে নতুন প্রচেষ্টার শুরু হতে যাচ্ছে। যেন রাজকীয় সব কার্যক্রম নির্ভুল সম্পন্ন হতে পারে এবং কোন ক্ষেত্রেই দিন-তারিখ হিসাবে কোন ব্যত্যয় না ঘটে।’
মখমলের লেফাফা খুলে চিত্রার্পিত, মনোযোগী সভাসদদের সামনে আবুল ফজল বিশুদ্ধ, সুললিত ফার্সীতে লেখা ফরমান পাঠ করতে থাকেন:
‘তামাম হিন্দুস্থানের বাদশাহ জালালউদ্দিন মোহাম্মদ আকবর নতুন যে পবিত্র যুগ গণনা শুরু করতে যাচ্ছেন, সেখানে সব ঋৃতু চক্রের নতুন হিসাব প্রবর্তনের দায়িত্ব পেতে যাচ্ছেন যে আফলাতুন (প্লেটো) তিনি আর কেউ নন- আমাদের দরবারেরই সুপন্ডিত, জ্যোতির্বিজ্ঞানী আলওয়ানী আজাদ-উদ-দৌলা আমির ফতুল্লা সিরাজি। ইরাণের সিরাজ শহর থেকে আরো অনেকের মতো এই দূর হিন্দুস্থানে যৌবনের শুরুতেই তিনি এসেছিলেন ভাগ্যান্বেষণে। নিজের মেধা আর প্রচেষ্টায় আজ তিনি মোঘল দরবারের প্রধান জ্যোতির্বিজ্ঞানী।
জনাব আলওয়ানী আজাদ-উদ-দৌলা আমির ফতুল্লা সিরাজি, আপনি কি আপনার প্রতি সমর্পিত এই দায়িত্ব গ্রহণে ইচ্ছুক ও সম্মত?’
‘সবই উপরওয়ালার হুকুম ও খোদা তা’আলার অশেষ মর্জি,’ মাথা নিচু করে কুর্ণিশের ভঙ্গীমায় শ্রদ্ধা জানান আমির ফতুল্লা সিরাজি।
‘আমার উপদেশ হবে- হে প্রিয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী- নক্ষত্রমন্ডলীর রহস্য সম্পর্কে নেহাৎই নাদান ও অনভিজ্ঞ এই তলোয়ারবাজ বুড়ো লোকটি মনে করে যে পারস্য ও আরবের জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে আপনার অনুশীলন ত’ আছেই। তবে, নতুন বর্ষপঞ্জি তৈরির কাজে আপনি হিন্দু জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সাথেও বসেন। তাদের কাছ থেকেও এই অঞ্চলের মহাকাশ সম্পর্কিত যাবতীয় বিদ্যার তালিম নিন। তবেই আমরা একটি কার্যকরী বর্ষপঞ্জি পেতে পারি,’ বললেন মহামতি আকবর।
সভা সেদিনের মত সমাপ্ত হলো।
৩
পন্ডিত নারায়ণ বালচন্দ্রন জাতে তামিল ব্রাক্ষ্মণ। দক্ষিণের মানুষগুলো দেখতে কালো কালো হলে কি হবে, গণিতে এদের মাথা খুব ভাল। হিন্দু জ্যোতির্বিজ্ঞান অনুশীলনের গণিত আর বিজ্ঞান নির্ভর চর্চা এই দক্ষিণের কালো মানুষেরাই করেছে বেশি। আকবরের বিশেষ ফরমান বলে নারায়ণ বালচন্দ্রনকে তিন মাসের জন্য দিল্লি আনা হয়েছে। ফতুল্লাহ্ সিরাজির সাথে বালচন্দ্রনের আলাপ হয় কখনো বিশুদ্ধ ফার্সিতে আবার কখনো সংস্কৃতে। হ্যাঁ, আকবর নিজেও যা জানেন না তা’ হলো বিশ্ব জ্যোতির্বিজ্ঞানের খোঁজ রাখতে ফতুল্লাহ্ সিরাজি নিজেই গত কিছু বছর যতœ করে সংস্কৃত শিখেছেন, সংস্কৃতে লেখা কিছু কিছু জ্যোতিষ শাস্ত্রের পুঁথি পাঠও করেছেন।
‘আমি সংস্কৃত কিছু শিখেছি পন্ডিত বালচন্দ্রন! জ্যোতিষ শাস্ত্রের কিছু পুঁথি পাঠও করেছি। তবু, দাক্ষিণাত্যের নামী জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেবে আপনার কাছ থেকে হিন্দু জ্যোতির্বিজ্ঞানের একদম শুরু থেকে একটি ছোট ধারণা চাই। মনে করুন আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না। আমাকে একদম অ-আ-ক-খ থেকে আপনি শেখাবেন।’
‘আমি সেটাই বলতে যাচ্ছি ওস্তাদ ফতুল্লাহ্ সিরাজি। শর্ত একটাই যে ফার্সি বা আরবিতে আমিও যদিবা আরবী ও ইরাণী জ্যোতির্বিজ্ঞান কিছুটা পড়েছি, সেটা আনাড়ির পড়া। আমার বলার পরে আপনাকে ইসলামী জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে কিছু বলতে হবে। আর দু’জনেই আমরা যবন দেশীয় অর্থাৎ গ্রিক আর রোমক, মিশরীয় ও চৈনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কেও যা জানি পরষ্পরের সাথে আলাপ করবো। আপনি সম্মত তো?’
‘সে আর বলতে আচার্য? শুরু করুন- আমার ধৈর্য্য বাঁধ মানছে না!’
‘বেদ হিন্দুর আদি গ্রন্থ হলেও ওস্তাদ- বেদাঙ্গ বলেও একটি শাস্ত্র আছে আমাদের। বেদ যদি হয় কোরাণের মত অবশ্যপাঠ্য, বেদাঙ্গ পাঠ তবে ঐ খানিকটা হাসিদ পাঠের মতই। যতগুলো বেদাঙ্গ আছে আমাদের, তার ভেতর প্রাচীনতম বেদাঙ্গ হলো ‘বেদাঙ্গ জ্যোতিষ।’ তবে এই হিন্দু জ্যোতিষ শাস্ত্র চর্চায় বিদেশীদের সাথে আদান-প্রদান ঘটেছে বিস্তর। যেমন, চতুর্থ শতকের যবনজাতক-য় গ্রিক দেশের জ্যোতিষজ্ঞান উল্লিখিত রয়েছে জনাব সিরাজি। কিম্বা ‘রোমক সিদ্ধান্ত’ গ্রন্থের কথাই ধরুণ- দ্বিতীয় শতাব্দীতে যবন জ্যোতিষ শাস্ত্রের একটি বইয়ের সংস্কৃতে অনুবাদ কে করেছিলেন তা’ অবশ্য আজ আর জানা যায় না। তবে, জীর্ণ সেই পুঁথির পাতায় পাতায় রয়েছে গ্রহ-নক্ষত্রের না জানা নানা সঙ্কেতের লিপি।’
‘তবু পরমগুরু আর্য ভট্টের সময় থেকেই কি হিন্দু জ্যোতিষ শাস্ত্র বিকশিত হতে শুরু করেনি?’ ফতুল্লাহ্ সিরাজি একবার ফার্সি থেকে সংস্কৃত আবার সংস্কৃত থেকে ফারসিতে চলে যেতে থাকেন।
‘যথার্থ বলেছেন। ৫ম বা ৬ষ্ঠ শতক থেকে আমাদের জ্যোতিষ শাস্ত্রের বিকাশ শুরু হয়। আর্যভট্ট- মানব সভ্যতাকে যিনি শুণ্য দান করেছেন, তাঁর কাজের উপর নির্ভর করে পরবর্তীসময়ে আরো কাজ করেছেন পন্ডিত ব্রহ্মগুপ্ত, বরাহ মিহির এবং লাল্লা।’
‘আপনাদের দক্ষিণে তো গণিত এবং মহাকাশ চর্চা প্রবল, তাই না?’
‘সিন্ধুতে প্রথম হিন্দু জ্যোতির্বিজ্ঞানের অনুশীলন শুরু হয়েছিল। বেদে মহাকাশ নিয়ে কিছু ভাবনার কথা আছে। স্বর্গীয় যেসব দেহের আন্দোলনের কথা স্তোত্রগুলোয় বিরাজিত বা একটি বছরের আয়ুষ্কাল কতদিনের সেসব থেকেই জ্যোতির্বিজ্ঞানের চর্চা শুরু। কিম্বা শুলবা সূত্রের কথাই মনে করুন জনাব সিরাজি! বেদাঙ্গজ্যোতিষে সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র থেকে শুরু করে আপনি যে বিষয়ে কাজ করতে যাচ্ছেন অর্থাৎ চান্দ্রেয়-সৌর বর্ষপঞ্জি…এ সবকিছু নিয়েই আলাপ আছে।’
‘বেদাঙ্গ জ্যোতিষের কিছু পৃষ্ঠার হস্তলিখিত অনুলিপি আমি গতবছর পেয়েছিলাম। কিন্ত সূর্য সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আমি কৌতুহলী মহাশয়!’
ঐসময়েই চাষীরা দিতে পারে সব কর। এই সময়টা থেকেই নতুন বছর শুরু হোক তাহলে! আর এই বারোটা নক্ষত্র আছে কি করতে? ওদের নামে নতুন মাসের নাম হোক! আগের ‘বিক্রম সম্বৎ’-এ রাখা মাসের নামগুলো হিজরি সণ আসার পর তো মুছে গেছে। কিন্ত আকবর যখন বলছেন স্থাণীয় চাষীদের জন্য, স্থাণীয় জ্যোতির্বিজ্ঞিন অনুসারেই নয়া বর্ষপঞ্জি করতে…তখন কেন নয়- কেন নয় হে ফতুল্লা সিরাজি?
‘সত্যি বলতে আপনারা মুসলিমরা যাকে সিকান্দার শাহ বলেন, সেই যবন রাজ যখন চতুর্থ শতকে ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিলেন, তখনি যবনদের নক্ষত্রবিজ্ঞানের সাথে আমাদের পন্ডিতদের কিছু পরিচয় হয়। সূর্য সিদ্ধান্ত গুপ্ত যুগের পুঁথি হে বুজুর্গ! আর্য ভট্ট তখন জীবিত। তবে আমাদের জ্যোতিষ শাস্ত্রের আরো উন্নতি হলো গুপ্ত যুগের শেষ দিকে। বরাহ মিহির রচনা করলেন ‘পঞ্চ সিদ্ধান্তিকা’ আর সূর্যঘড়ির আবিষ্কারও হলো এসময়েই। আর্যভট্টের সময় নাগাদ আমাদের হিন্দু জ্যোতিষ শাস্ত্র জেনে গেছে যে গ্রহগুলোর গতি যতটা না বৃত্তাকার তার চেয়ে বেশি উপবৃত্তাকার। এছাড়াও এসময় নাগাদই সময়ের বিভিন্ন একক, গ্রহগুলোর গতিপথের অদ্ভুত নমুনা, স্থলজ নানা এলাকার জন্য গ্রহভিত্তিক দ্রাঘিমা সংশোধনের কাজ ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান আয়ত্ব করতে সমর্থ হয়।’
‘তোফা! ভারতে তো ঋৃতুগুলো হচ্ছে বসন্ত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, শীত আর শিশির- তাই না? আপনাদের তো পন্ডিত একাধিক বর্ষপঞ্জি?’
‘বেদাঙ্গ জ্যোতিষে শীতকালের অয়তান্ত বিন্দু থেকে বছর গণনা শুরু হচ্ছে। হ্যাঁ, একাধিক বর্ষপঞ্জি আছে। যেমন, বিক্রম সম্বৎ শুরু হয়েছে বারো শতকে। আছে শক বর্ষপঞ্জি যা ৭৮ সালের মহাবিষুব বিন্দু হতে শুরু। সপ্তর্ষি বর্ষপঞ্জি ৩০৭৬ অব্দে শুরু হয়েছিল। তা’ আমি তো অনেকক্ষণ বকবক করলাম হিন্দু জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে। এবার ওস্তাদ আমি আপনার কাছে পার্সী জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে জানতে চাইবো। কিছু প্রশ্ন করতে পারি কি?’
‘মুস্কিল। আমার যে আরো কিছু প্রশ্ন ছিল।’
‘বলুন!’
‘আপনাদের তৈত্তিরীয় সংহিতায় কি ৩৬০ দিনের সৌর বছরকে ২৭ দিনের করে ১২টি চান্দ্রেয় মাসে বিভাজন করা হয়েছে? সেটাই ছিল আদিতম হিন্দু বর্ষপঞ্জির হিসাব!’
‘হায় ফতুল্লাজি! আপনি যে আমাকে বোকা বানিয়ে ছাড়লেন! আপনি আমাদের শাস্ত্র এতটা পড়েছেন?’
‘অথর্ববেদে তেমনটাই বলা হয়েছে। এতে করে গণিতের হিসেবের যে বেমিল ছিল তার জন্য প্রতি ৬০ মাস অর্থাৎ পাঁচ বছর পর পর একটি বাড়তি মাস যুক্ত করা হলো-এমন নয় কি ব্যপারটা? আসলে পন্ডিতজি- কি বলবো? ৭৭১ সালে আরবি ভাষায় অনূদিত ব্রহ্মস্ফুট সিদ্ধান্ত আমি পড়েছি। বাগদাদের লাইব্রেরি থেকে এই বইয়ের একটি কপি করে এনেছিলেন আমার সরাসরি শিক্ষক যার কাছে আমার জ্যোতির্বিজ্ঞানের হাতে খড়ি। এবার বলুন, আপনি কি জানতে চান?’
‘আমাকে পার্সী বা ইরাণী বর্ষপঞ্জি, ঋৃতুসকল আর জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে কিছু বলেন।’
‘পারস্যে বর্ষপঞ্জির সূচনা হযেছিল জরস্থুসের আবির্ভাবেরও আগে। তবে প্রথম আকামেনীয় শাসকদের সময়েই আমরা একটি পুরোপুরি, সংরক্ষিত বর্ষপঞ্জি পাই। তবে, আমাদের দেশে সবসময়ই সৌর বর্ষপঞ্জিকে চান্দ্রেয় বা চান্দ্রসৌর বর্ষপঞ্জির উপরে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আমাদের সংস্কৃতিতে সূর্য সর্বদাই ছিল এক বড় প্রতীক আর এমনকি মহান সাইরাসকে নিয়ে গাওয়া লোকগীতিতেও সূর্যের প্রাধান্যের কথা বলা হয়েছে।’
‘সৌর বর্ষপঞ্জি ছিল যখন, তখন বছরের দিন কতগুলো মোট গনণা করা হতো ফতুল্লাজি?’
‘৩৬০। শুরুতেই দিনগুলোর কোন নাম ছিল না। চাঁদের বাড়া-কমা অনুযায়ী প্রতি মাসের দু’টো কি তিনটা ভাগ থাকতো। প্রতি ছয় বছর অন্তর ১৩ তম মাস হিসেবে একটি মাস যোগ করা হতো।’
‘বারোটি মাসের আদৌ কোন নাম ছিল না?’
‘একদম ছিল না তা’ নয়। আদুকানৈ যাকে ব্যাবীলনিয়রা বলতো নিসান্নু, উরাবাহার যাকে ব্যাবীলনীয়রা বলতো আয়ারু… ছিল ঐগ্রাশিস, গর্মপদ, বাগায়াদি, ভারকাজানা, আচিয়াদিয়া, অনামাক, ওয়াভৌভ বা ভিয়াক্সানা নামে মাস ছিল।’
‘বড় কোন পার্বণাদি ছিল?’
‘তা’ ত’ ছিলই। হমস্পথমইদ্যেম পালিত হতো বছরের ৭৫তম দিনের মাথায়, মেইদ্যোশাহেম পালিত হতো ১০৫ দিনের মাথায়, আয়াথ্রেম পালিত হতো ১০৫ দিনের মাথায় এবং মৈদ্যারেম পালিত হতো- সে-ও সেই ৭৫ দিনের মাথায়। চারটিই ছিল কৃষি ও ফসলের অনুষ্ঠান। পরে আরো দু’টো পার্বণ যুক্ত হলো- আর এভাবে ছয়টা ‘গাহাম্বের’ বা পর্ব এলো আমাদের।’
‘আজো কি এই নামেই মাসগুলো ডাকা হয়?’
‘না- জরস্থ্রুসিয়ান নক্ষত্রবিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করে একটি পরিপূর্ণ বর্ষপঞ্জি প্রথম এলো আকামেনীয় যুগের শেষ দিকে। মিশরীয় রীতি অনুসারে ১২টি মাস ত্রিশ দিন করে গণনা শুরু হলো। আজকের এই মধ্যযুগের পহ্লভী বা পার্সি ভাষায় আমাদের বারো মাসের নাম হলো: ফরওয়ারদিন, আর্দি, খোরদাদ, তীর, আমারদাদ, শাহারিয়ার, ভিহিসু, আবান, আজার, দে, বাহমান এবং ইসফান্দা মিজ। সত্যি বলতে আমাদের মহামতি স¤্রাট সাইরাস (তিনি অবশ্য অগ্নি উপাসক ছিলেন না) ব্যাবিলন যখন জয় করেন, তখন ব্যাবিলনের চান্দ্র-সৌর বর্ষপঞ্জি তাঁর দৃষ্টি কাড়ে। দারিয়ুস যখন পারস্যের স¤্রাট হলেন, তখন তিনি মিশরীয়দের ত্রিশ দিনের বারো মাসের ভ্রাম্যমান সৌর বর্ষপঞ্জিটি নিয়ে নিলেন। মিশরীয়দের ভেতর বসন্তকালেই নতুন বছর শুরু হতো- আমাদেরও যেমন নওরোজ শুরু হতো এই ফসল কাটার সময় থেকেই। এজন্যই ইসলাম আসার পর- খলিফা ওমর প্রথমে হিজরি বর্ষপঞ্জি শুরু করলেন ঠিকই- কিন্তÍ সেক্ষেত্রে চাষীদের ফসল কাটার আগেই খাজনা দেবার ফেরে পড়ে যেতে হলো। বাধ্য হয়ে খলিফা পুনরায় পার্সী বর্ষপঞ্জি চালু করলেন।’
‘বুঝতে পেরেছি। একই সমস্যা বোধ করি আমাদের এখানেও হচ্ছে, তাই না?’
‘তা’ বটে। আজ এটুকুই থাক? যবনের স্থানে পানাহার করবেন না জানি- নয়তো দুপুরের আহার করতে পারতেন!’
‘হিন্দু পরিচারক সেজে দিলে এক ছিলিম তামাকু সেবন করে যেতে পারি!’
‘অবশ্যই।’
৪
মধ্যরাত। ফতুল্লা সিরাজি মানমন্দিরের ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছেন। মিশরে প্রতি ১৪৬০ বছরে একবার নীলনদের বন্যা নামে যে তারার কারণে, পারস্যে সেই তারাকে বলে ‘বৃষ্টি তারা।’ ৩৬৫ দিনের হিসেবে ৩৬৫ জন যুবক গাঢ় বেগুনী রঙের পোশাক পরে নতুন বছরের যে অভিনয় করতো অগ্নি উপাসক দিনগুলোয়, তা’ আজো ফার্সি জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের অবিদিত নয়। ঐ তো রাতের আকাশে দেখা যাচ্ছে পার্সী জ্যোতির্বিজ্ঞানের চার রাজকীয় নক্ষত্র: আলদেবারান, রেগুলাস, আন্তারেস আর ফোমালহোত। স্বর্গের চার পাহারাদার এই নক্ষত্র রাতের আকাশের ২৫টি উজ্জ্বলতম নক্ষত্রের ভেতর সেরা। আলদেবারাণ পূর্ব আকাশ পাহারা দেয় আর মেষরাশি মন্ডলীর প্রধানতম নক্ষত্র। রেগুলাস খেয়াল রাখে উত্তরে আর সিংহ নক্ষত্রমন্ডলীর প্রধানতম নক্ষত্র। আন্তারেস খেয়াল রেখেছে পশ্চিমে এবং বৃশ্চিক নক্ষত্রমন্ডলীর সে-ই তো প্রধান নক্ষত্র। ফোমালহোত দক্ষিণের আকাশে পাহারা দিয়েছে আর কুম্ভমন্ডলীতে সে-ই তো প্রধান। আবার ঐ যে দ্যাখো ভারতীয় নক্ষত্ররাজির বারোটি প্রধান নক্ষত্র। সপ্তর্ষি মন্ডল ছাড়াও আছে বিশাখা, জিয়াষ্ঠ, ষাঢ়, শ্রাবণী, ভদ্রপদ, অশ্বিনী, কার্তিক, অগ্রাইহন, পুষ্যা, মঘা, ফাল্গুনী, চিত্রা…মাথায় একটি ভাবনা খেলে যাচ্ছে তার। পার্সি বর্ষপঞ্জিতে যেটা মুহররমের মাস, ঠিক সেসময়টাই ভারতে বা বাংলাতেও ফসল কাটার শুরু হয়। ঐসময়েই চাষীরা দিতে পারে সব কর। এই সময়টা থেকেই নতুন বছর শুরু হোক তাহলে! আর এই বারোটা নক্ষত্র আছে কি করতে? ওদের নামে নতুন মাসের নাম হোক! আগের ‘বিক্রম সম্বৎ’-এ রাখা মাসের নামগুলো হিজরি সণ আসার পর তো মুছে গেছে। কিন্ত আকবর যখন বলছেন স্থাণীয় চাষীদের জন্য, স্থাণীয় জ্যোতির্বিজ্ঞিন অনুসারেই নয়া বর্ষপঞ্জি করতে…তখন কেন নয়- কেন নয় হে ফতুল্লা সিরাজি?