বাংলাভাষার সাঁওতালি প্রেম! । সাখাওয়াত টিপু
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ মার্চ ২০১৮, ১১:৪৭ অপরাহ্ণ, | ১৭৪১ বার পঠিত
The whole set of phonetic and the conceptual difference which constitute a language are the product of two kinds of comparison, associative and syntagmatic.
** Course in General Linguistics: Ferdinando De Saussure
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছেন, ‘বাঙ্গালাটা যে একটা স্বতন্ত্র ভাষা, উহা পালি, মাগধী, অর্ধ মাগধী, সংস্কৃত, পার্সি, ইংরেজি প্রভৃতি ভাষার সংমিশ্রণে উৎপন্ন, গ্রন্থকারগণ সে কথা একবারও ভাবেন না।’ বাংলাভাষা নিয়ে পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দুঃখ আমরা কখনো ভেবে দেখেছি কি? খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই আক্ষেপ আছে, ‘সংস্কৃত ব্যাকরণের একটু ইতস্ততঃ করিয়া বাংলা ব্যাকরণের নাম দেওয়া হয়।’ কথাটার মাঝে খানিক বেদনা আছে। ভাববার অবকাশ আছে, ভাষা গঠনে ক্ষমতা কাঠামোর কারসাজি কি? একদা বাংলাভাষা নিয়ে ক্ষমতাকেন্দ্রীক দুই সম্প্রদায়ের রশি টানাটানি হয়েছে। এক সম্প্রদায় টেনেছে ‘সংস্কৃত ভাষা’র দিকে। এই সম্প্রদায় মনে করে, ‘বাংলাভাষার জননী সংস্কৃত’। আরেক সম্প্রদায় সংস্কৃত বিদ্বেষ হতে বাংলাকে ‘পার্সি ভাষা’র কুঠুরিতে ঢোকাতে চেয়েছে। দুইপদের লোকেরই মননে গাঁথা ছিল ‘ক্ষমতাকেন্দ্রীক ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা’। সেই ইতিহাস কমবেশি সকলের জানা। তবে সত্য এই, ভাষা বেঁচে থাকে একটা জনগোষ্ঠীর প্রকৃতির সম্পর্ক, অর্থনৈতিক উৎপাদন ব্যবস্থা আর সামাজিক সাংস্কৃতিক আচারের ভেতর দিয়ে। এই সম্পর্ক বস্তু আর ভাব দুই ধর্মে ধরেছে। দর্শন বলছে, বস্তু মাত্রই ভাব। আর ভাব মাত্র ভাষা। কারণ ভাষা মাত্রই বস্তুর অর্থ আরোপ করে। এমন সহজ সূত্রে আমরা ‘বাংলাভাষার সাঁওতালি প্রেম’ দেখব। কিংবা দেখা যেতে পারে, ‘সাঁওতালি বাংলার প্রেম’।
প্রশ্ন হলো, ‘সাঁওতালি বাংলা’ কি জিনিস? তার উত্তর সাধন করলে আমরা প্রেমের কুঠুরিতে ঢু মারতে পারব। বলে রাখা ভাল, বাংলাভাষা সাঁওতালি ভাষা নয়। দুই ভাষা আলাদা আলাদা রূপ আর রসে ভরপুর। দুই ভাষার বিচ্ছেদ — প্রচলিত ক্ষমতা কাঠামোয়। আর সম্পর্ক — সমাজ উৎপাদন কাঠামোয়। জনগোষ্ঠীর দিক হতে সাঁওতাল বাঙালিদের অধিক নয়। ফলে ক্ষমতা কাঠামোর দিক হতে সাঁওতাল জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রে আর সমাজে ‘অপর’ হয়ে আছে। ‘অপর’ কি অর্থে? প্রথা মতে সামাজিক সম্পর্কে যার ‘আপন’ নাই। অন্য অর্থে ‘অপর’ মানে পরের অভাব। মানে যার কোন পর নাই। সবই ‘আপন’। তাহলে বিচ্ছেদ কোথায়? ক্ষমতাকেন্দ্রীক শ্রেণী বিভাজন। বিভাজন বা বিচ্ছেদ ‘জাতে জাতে’ ‘ধর্মে ধর্মে’ ‘ভাষায় ভাষায়’ ‘ধনী গরিবে’ ‘শাসক শোষিতে’ নানান কিছুতেই। রাষ্ট্র আর সমাজে বিভাজন থাকলে এক জনগোষ্ঠীর ভাষা অপর জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক সম্পর্ক সৃষ্টিতে বাধা সৃষ্টি করে। সম্প্রদায়ের ভাষা সামাজিক হয় না। মানে উৎপাদন সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটায়। এই সম্পর্ক কেবল শিল্প উৎপাদনের সম্পর্ক নয়, ভাষা বা ক্রিয়ার অর্থ উৎপাদনেরও সম্পর্ক। ফলে এক ভাষার সঙ্গে অন্য ভাষার সম্পর্ক মূলত সামাজিক অর্থ উৎপাদন কাঠামোর। সেটা কেমন?
আপাতত ক্ষুদ্র পরিসরে ভাষার প্রশ্নে কিছু তর্কের ইশারা দিয়ে গেলাম। একভাষার শব্দ অন্য ভাষায় আত্মীকরণের ফলাফল মূলত বিদ্যমান সংস্কৃতিরই কার্যকারণ। শুধু ক্ষমতা কাঠামো তার নির্ণায়ক নয়। অর্থনীতি, প্রথা, জীবনাচরণ ও উৎপাদন ব্যবস্থাও ভাষার নির্মিতি ঘটায়। ফলে আত্মীকরণের স্বতঃস্ফূর্ততা এক ভাষার শব্দ অন্য ভাষায় প্রবেশ করে…
ইতিহাসের দিকে ফেরা যাক। সাধারনভাবে সাঁওতালি ভাষাকে মুণ্ডাভাষা বলে। কেউ কেউ বলেন ‘কোল-মুণ্ডা’। ভাষা গবেষক ক্ষুদিরাম দাশ ‘সাঁওতালি বাংলা সমশব্দ অভিধান’ বইয়ের ভূমিকায় বলেছেন, ‘কোল-মু- খেরোয়ালদের সাঁওতাল নামকরন সম্ভবত বিমিশ্রিত আর্যভাষী বা আমাদেরই। ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিতদের অনুমান ‘সামন্ত পাল’ এই সংস্কৃত শব্দ হতে প্রাকৃতের মধ্যে দিয়ে ‘সাঁওতাল’ শব্দ এসেছে।’ ক্ষুদিরাম মহাশয়ের দুই বাক্য হতে দুটি শব্দ তুলে আনব। শব্দ দুটি ‘সম্ভবত’ আর ‘অনুমান’। প্রশ্ন হচ্ছে, এমন সংশয়বাচক ধারণা কেন? আদতে ‘মুণ্ডা’ বা ‘কোল-মুণ্ডা’ যে নামে বলি না কেন, সেটা ইতিহাসের ক্ষমতাকেন্দ্রীক ভাষ্য তৈরি করেছে। কেন সাঁওতালি ভাষাকে আলাদা ভাষার মর্যাদা দেয়া হয়নি? ক্ষুদিরাম আরও জানান, ‘ইতিহাস সম্মত সত্য এই যে, এই নিষাদবর্গের মানুষ তিরধনু নিয়ে সামন্ত রাজা বা ভূমাধিকারীদের রাজা রক্ষা করত, যুদ্ধ করত।’ ক্ষুদিরাম দাশ প্রাচীন মঙ্গলকাব্যের স্মরণ নিয়েছেন। বলছেন, কোল বা নিষাদদের যুদ্ধের কথা। ইতিহাসে দেখা গেল জাত-পরিচয় ভেদ জ্ঞান। তবে কি কোল-মু-াদের কোন ভাষা-ভূমি ছিল না? শুধু সামন্ত পালের আমলে কোল বা মুণ্ডা ছিল না, এমন নয়। তাদের ছিল ভূমি আর ভাষা। রাজার আগেও যা ছিল, পরেও তাই।
ক্ষুদিরামের কথা মতো কোল সম্প্রদায় যোদ্ধা। সে কথা ঠিক আছে। কোল বা সাঁওতালরা ভূমিহীন ছিল একথা মানা কষ্টকর তো বটেই। এমন ধারণা নিয়ে ইতিহাসের অন্যপিঠও দেখা যাবে না। আমরা ক্ষুদিরামের কথাটা একটু ঘুরিয়ে বললে বাস্তব ব্যাখ্যার দিকে যেতে পারব। কথাটা এভাবে বলব, ভূমাধিকারের ‘রাজা’ নয়, ‘রাজ’ রক্ষা করতো সাঁওতালরা। রাজার এক অর্থ ক্ষমতার কেন্দ্রীকতা। অপর অর্থে রাজা শাসিত প্রজা অধ্যুষিত জনতাবর্গ। কিন্তু ‘রাজ’ ভাব রাজা আর প্রজা দুইয়েরই অর্থবহন করতে পারে। অপর অর্থে ভূমি রাজের জনগোষ্ঠীর ভাষাবসতির ক্ষমতা। ভাষার দিকও এতে বিবেচ্য। কেননা মুণ্ডা ভাষায় শব্দান্তে অ-কারের উচ্চারণ বিশেষ নাই। আরও আছে অক্ষর ভেদ। ব্যঞ্জনবর্ণে মিল থাকলেও মুণ্ডা ভাষার স্বরবর্ণে ঈ, ঊ, ঋ, ঐ, ঔ নাই। ফলে সাঁওতালি ভাষার গঠন ধনাত্মক। ভাষায় ধনাত্মক ক্রিয়ার মূল ভাষারই প্রকৃতি। প্রত্যয় ভিন্ন। ভাষা গঠনের দিক থেকে মুণ্ডা ভাষার সাথে বাংলা ভাষার ধনাত্মক ক্রিয়ার সম্বন্ধ সংস্কৃত ভাষার চেয়ে কম নয়। একই ভূমি, প্রকৃতি আর উৎপাদন কাঠামোয় জন্ম নেয়া বাংলাভাষা যেমন সাঁওতালি ভাষা থেকে নিয়েছে, মুণ্ডা ভাষাও নিয়েছে সেই রূপ। কেননা ভাষার উৎপাদন অচেতনেরই রূপ। কেহ কেহ বলেন, সহজাত প্রবৃত্তি। কেননা অচেতন চেতনা পেলে ভাষা হয়ে ওঠে। একে আত্মীকরণ অর্থে সামাজিক সংস্কৃতি উৎপাদনের ভাষা বলা যায়। একক ব্যক্তির ভাব অপর চেতনায় অর্থ উৎপদান করলেই সামাজিক সম্পর্কেই পরিণত হয়। এই গঠন কারণ নয়, ভাষারই কার্য। ফলে এক ভাষা অপর ভাষায় আত্মীয় রূপ গড়ে। কেন?
আপাতত ক্ষুদ্র পরিসরে ভাষার প্রশ্নে কিছু তর্কের ইশারা দিয়ে গেলাম। একভাষার শব্দ অন্য ভাষায় আত্মীকরণের ফলাফল মূলত বিদ্যমান সংস্কৃতিরই কার্যকারণ। শুধু ক্ষমতা কাঠামো তার নির্ণায়ক নয়। অর্থনীতি, প্রথা, জীবনাচরণ ও উৎপাদন ব্যবস্থাও ভাষার নির্মিতি ঘটায়। ফলে আত্মীকরণের স্বতঃস্ফূর্ততা এক ভাষার শব্দ অন্য ভাষায় প্রবেশ করে। শব্দের আত্মীকরণ সামাজিক সম্পর্ক গঠনে ভাষার একক জাতীয়তাবাদ কোন রাষ্ট্রের মূল পথ্য হতে পারে না। তাতে অপরাপর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যে শ্রেণী বিভাজন তৈরি করে সেটা ভয়ানক। নিপীড়নমূলক এই ভাষা সম্পর্ক সংঘাত ঘটাতে বাধ্য। তবে এই কথা আজ সত্য, বাংলাভাষার ন্যায় মু-াও আলাদা ভাষা জনগোষ্ঠী। এটা ভাষা মর্যাদার প্রশ্ন। কিন্তু একই নদী একই জলে, একই ভূমি একই ফসলের যে উৎপাদন ক্রিয়া সমাজ-সম্বন্ধ সৃষ্টি করে সেটাই প্রেম। কেননা প্রেমতো ভাষার অধরা সম্পর্ককে ধরবারই সহজ রাস্তা। সেই রাস্তাকে ক্ষমতার চুল দিয়ে বেধে রাখা যায় না। ইতিহাসে সেই সত্য একদিন জাহির হবেই।
তালাশ:
১. Ferdinando De Saussure : Course in General Linguistics, translated by Roy Harris, (Bloomsbury: London), 2013
২. বাংলা ব্যাকরণ: ডক্টর মুহম্মদ শহীদুলাহ, (মাওলা ব্রাদার্স: ঢাকা), ২০০৮
৩.ক্ষুদিরাম দাশ: সাঁওতালি বাংলা সমশব্দ অভিধান, (পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি: কলকাতা), ১৯৯৮