দহনদয়িতা : প্রেমের নতুন রূপকথা । জ্যোতি সিনহা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১০:২৭ অপরাহ্ণ, | ২৫০১ বার পঠিত
‘কেবল প্রেমের দায়ে
কেবল প্রেমের দায়ে
কেবল প্রেমের দায়ে… আমি…’কী নিদারুণ হাহাকার!
সেই প্রেম-অভিশপ্ত নারীর!
মায়ার কথা বলছি।
ওহ! ঠিক বোঝা গেল না, ঠিক চেনা গেল না মায়াকে, নাহ্?
তবে বলি :
বনে, মাঠে, পানিতে, হাওয়ায় বেড়ানো, বেণী দোলানো এক মেয়ে মায়া। অভাবী এক মা-বাবার ঘরে জন্ম তার, বেড়ে ওঠা। হঠাৎ তাদের জীবনে ঘটে এক দুর্ঘটনা, পাড়ায় লাগে আগুন, সকলের বসতবাড়ি পুড়ে যায়, অসহায় মায়া বাবা-মাকে নিয়ে পাড়ি জমায় এক অজানার উদ্দেশ্যে, কিশোরী সেই মায়ার তখন সকল কিছুতেই বিস্ময়! নতুন জায়গা, নতুন মানুষ, নতুন বন্ধু, বিশাল পাহাড়, গাড়ি, ঘোড়া, ক্ষেত, দীঘি, নালা, বালি জমা চর, ছোট সাঁকো দেখে আর সাথে তার ভাবনার খেলা চলে, এমনকি ঐ আগুনসূর্য দেখে বিভ্রমে পড়ে,- সূর্যে পুরুষ নাকি নারীর রূপ? ভাবে, চতুর্দিক জ্বেলে দিলে রোদ বুঝি মনে হয় পুরুষ আর যখন সে অস্ত যায় গোধুলির লাল আলো ছড়াতে ছড়াতে তখন একদম মায়ার পরাণসখী যেন লাজরাঙা বউ। এইসব ভেবে ভেবে মায়া হাঁটে পথ। শেষে পৌঁছায় গ্রামের সকলের সাথে এক বিজন ঠিকানায়, মেলে আশ্রয়, রাত হয়ে এলে সকলে ঘুমিয়ে গেলে তার চোখে ঘুম নেই। কতশত ভাবনার ভেতর হঠাৎ নিজের ভেতর এক নারী হয়ে ওঠার পুলক ভাসে, চেনা শরীর অচেনা ভাষায় রচিত হয়ে ওঠে।
এমন চেনা-অচেনার ভেতর হঠাৎ তার কানে ভেসে আসে এক সুর!
যেন মায়াকে বলছে, ‘তুমি বের হয়ে আসো, ছুটে আসো, ঘর এক খাঁচা, বন্ধ করে রাখে ইচ্ছের সকল পাখি।’
ভাবনায় পড়ে মায়া…
মনে মনে খুঁজতে থাকে সে সুরের উৎস।
খুঁজতে খুঁজতে শেষে দেখা পায় তার, যে ঝরিয়েছে এমন সুরের প্রপাত।
দুজনে চুপচাপ যেন অবাক, পরস্পরকে চিনে-বুঝে নিতে চায়। সে সুরওয়ালা, মায়া করে পাঠ সে পুরুষের সমগ্র, দেখে কাঁধে ঝুলে আছে নতুন অপরিচিত এক যন্ত্র, জিজ্ঞেস করে, যন্ত্রের নাম কী?
‘ভেলা’
‘ভেলা! কী বা হয় তার মানে?’
‘যে সুর ভাসিয়ে ভাসিয়ে নেয় দূর-দূরান্তরে, তার নাম ভেলা।’
মুগ্ধ মায়া।
‘আর যন্ত্র যে বাজায়, সেই মহাযন্ত্রীজন তার কী নাম?’
‘ভাসান, হাওয়ায় শূন্যে সুরে সুরে ভেসে চলি, তাই নাম ভাসান।’
আহা! এও কভু হয়! জীবন ভাসমান তাই নাম হয় ভাসান!
দেখে মায়া, দূরকল্পে এক ভেলায় ভাসছে ভাসানের সঙ্গে উথালতরঙ্গে।
তবু ‘জীবন ছলনা, জীবনের সত্য নাই কোনো
আমরা কেবল তার সত্যছবি খুঁজি,
আর তাই গড়ে তুলি মিথ্যার বেসাতি।’
এক নামগোত্রপরিচয়হীন ভাসানের জীবনের পরিহাসের বেদনা বুঝি সুরে সুরে বেজে ওঠে, বেদনার রস প্রেম হয়ে ফোটে মায়ার বাগানে। তবে সব গল্পই দাঁড়ায় ঐ এক কিন্তু-র ওপর।
এখানেও তাই। বাবা এসে দাঁড়ায় সম্মুখে বাধা হয়ে, তার নিজের অসহায় জীবনের সাথে কী করে জুড়বে এই নামগোত্রপরিচয়হীন এই রাখাল ভাসানকে! আসে রূঢ় সিদ্ধান্ত, ছেড়ে যেতে হবে এই ভূমি, এই ঠিকানা, পুড়ে যাওয়া ভিটেবাড়ি পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে, ঠিকানা না বোঝার জন্য রাতের অন্ধকারে বাবা ফিরিয়ে নিয়ে আসে মায়াকে।
মায়ার কাছে তখন সকল কিছুই শূন্য। বেদনা, ব্যথার ভার, হাহাকার।
তারপর…
তারপর মায়া ঘটায় সেই অমোঘ অঘটন! এক ত্রাস!
গ্রামের সকলে অবাক!
হতাশায়, ঘৃণায় হয়তোবা ভালোবাসায়,
মায়া হয়ে ওঠে এক অভিশপ্ত-নারী।
‘কেবল প্রেমের দায়ে’ — বলে চিৎকার করে ওঠা এক প্রেম-অভিশপ্ত নারী।
কী দুর্ঘটনা ঘটিয়েছিল মায়া জানতে যদি চান, তাহলে আপনাকে একটু কষ্ট করে সংগ্রহ করে পড়ে নিতে হবে শুভাশিস সিনহার ‘দহনদয়িতা’ নামক আখ্যানকাব্যটি। চমকটা সেখানেই থাকবে। পাওয়া যাচ্ছে এবার একুশে বইমেলায় বাতিঘর-এর স্টলে, স্টল নাম্বার ৪১৮-১৯। আশা করছি, বইটি পড়ে নিরাশ হবেন না।
এবার বলি, শুভাশিস মানে আমাদের সমীরদার কথা।
আপাদমস্তক এই কবি নিতান্ত অলস, তার গণ্ডির বাইরে বেরোতে না চাওয়া এক অন্তর্মুখী মানুষ (মনে পড়ে না কবে কখনও কোথাও বেড়িয়ে আসার অন্তত প্রস্তাবনা নিজে থেকে দিয়েছে)। কত না সহজ করে এক আখ্যান রচনা করে, জার্নি করে তার চরিত্রগুলোর সাথে, তাদের সাথে ঘুরে বেড়ায় কত পথ-তেপান্তর। তার এই ভ্রমণের সঙ্গী বাস্তবের হাড়-মাংসের এই আমরা নয়, কাল্পনিক ঐ চরিত্রগুলো, আহা!
এখানে সে স্বাধীন, তাই তো নিমেষে তার মনের ভাবনাগুলো প্রকাশ করে। পড়তে এতোটুকু বাধা নেই, যেন বা কঠোর সে গদ্যভাষাকে তিনি করেছেন সহজ ও গীতল, পড়তে পড়তে হয়তো মনে হবে কোথাও রবীন্দ্রনাথের ছোঁয়া, কখনো জসীমউদ্দীন অথবা হয়তো কোন এক অজানা গ্রামের মণ্ডপে বসা পুঁথিপাঠের কাহিনী, যেখানে কাহিনী, কাব্য আর জীবনদর্শন পরতে পরতে মিশে থাকে। মনে হয়, এক অসমাপ্ত অতৃপ্ত কাল্পনিক জীবনভ্রমণ…
তবু ভালো আমরা, রক্তমাংসের মানুষগুলো তো ঠিকই হারিয়ে যাবো, বেঁচে থাকবে দহনদয়িতা-র বইয়ের পাতার এই কাল্পনিক চরিত্রেরা!
আখ্যানকবি স্বয়ং বলেছেন —
“গল্প কারও কোনোদিন শেষ হয় নাকো
মানুষের মরণের পরও গল্প বেঁচে থাকে
আমি তো দেখেছি দুনিয়ায় শুধু গল্প থাকে বেঁচে
আর কেউ নয়, কিছু নয়।”