রোজনামচা ও উপেক্ষার কবিতা । এ কে শেরাম
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ৯:২০ পূর্বাহ্ণ, | ১৭৯৪ বার পঠিত
উপেক্ষা
আকাশ চিরটাকাল তাকিয়ে থাকে সমুদ্রের দিকে।
সমুদ্র তার পরোয়া করে না মোটেও।
সে কেবল তার অন্তর্গত যন্ত্রণায়
গর্জনে গর্জনে ফেনিল করে তোলে নিজেরই বেদনার্ত বুক।
আর আকাশ
উপেক্ষার যন্ত্রণায় কেবলই নীল হয়,
আর গোপনে ঝরায় একাকী
হৃদয় পুড়ানো অশ্রুবিন্দু।
কবিতা, এক প্রগল্ভা রমণী
গ্রীস্মের অগ্নিময় ক্রোধ
ডুবে গেছে প্রেমময় বর্ষার অশ্রুজলে,
বৈশাখের খরতাপদগ্ধ রুদ্র দৃষ্টি
আর্দ্র হয়েছে আজ আষাঢ়ের স্নিগ্ধ করতলে।
বাইরে বৃষ্টি, ভেতরে বৃষ্টি
সর্বত্র কেবলই বৃষ্টির অবিশ্রান্ত ক্রন্দন,
বৃষ্টির এই অনবরত ধারাপতন
হৃদয়ের বিরান প্রান্তরে জাগায় বিরহের অনুরণন।
আমি বৃষ্টিকে দেখি
বৃষ্টি দেখে আমার শূন্যতা,
হৃদয়ের গভীরে জাগে তাই
এক আদিম বন্যতা।
বাইরে অবিশ্রান্ত বর্ষণ
আকাশ-প্রকৃতির হৃদয় উজাড় করা এক মহাক্রন্দন।
বৃষ্টির ঘন ফলার মধ্যে কোথাও কোনো ফাঁক নেই
কোথাও যাবার তাই নেই কোনো উপায়,
একাকী গৃহে বন্দী — অসহায়।
তবু, বৃষ্টির শরজাল সরিয়ে উঁকি দেয় কবিতা,
সমস্ত ভয়-দ্বিধা-লোকলজ্জা উপেক্ষা করে
গোপন কোনো দয়িতার মতো
বারেবারে ফিরে ফিরে সে আসে
আমারই কাছে
চেতনে-কি-অবচেতনে,
যেন প্রগল্ভা রমণী।
অবৈধ প্রেমের আনন্দে আমি তাই
এই বিরহবেলায়
কবিতাকে নিয়ে ঘর বাঁধি
পূর্ণতায় ভরে দিই আমার এ-বিরহ রজনী।
সৃজনের সুনন্দ ভেলায় ভেসে ভেসে
তুমি শুয়ে আছো আমার পাশাপাশি,
কাছাকাছি — একেবারে নিঃশ্বাস-দূরত্বে।
অথচ, আমাকে কিছু না বলেই
একা ফেলে রেখে তুমি নির্বিকার চলে গেলে ঘুমপরীদের দেশে।
আর আমি, ঈর্ষার আগুনে পুড়ে পুড়ে,
অবদমিত বাসনার বল্লমে ছিন্নভিন্ন করে চলি রাত্রির কুমারী শরীর।
তরুণী রাত্রি ক্রমশ রমণী হয়ে ওঠে;
উর্বশীর মতো সে মেলে ধরে তার মদির আঁখি,
আমাকে উদ্ভ্রান্ত করে দিয়ে
নেচে চলে সে নৃত্যপটিয়সী অপ্সরী-কিন্নরীর মতো।
আর, রহস্যময়ী রজনীর মতোই,
চপল-চঞ্চল ঘুমপরীরাও লুকোচুরি খেলে আমার সাথে,
অপূর্ব সব দেহবল্লরীর অমোঘ আহ্বানে উদ্বেল করে তোলে আমাকে।
বিস্ময়-বিহ্বল আমি বাড়িয়ে দিই আমার বাসনার দীর্ঘ হাত।
কিন্তু কোথাও যে কেউ নেই! না নেই!
না লাস্যময়ী রাত্রি, না উচ্ছল ঘুমপরীরা,
এমনকি তুমিও নেই আমার পাশে।
আমার বাসনার ব্যগ্র হাত কেবলই রিক্ততায় দীর্ণ হয়।
তখনই আমার শিয়রে এসে দাঁড়ায় কবিতা-কিশোরী;
আর তারই সাথে দলে দলে উড়ে আসে
বর্ণের বিভা ছড়ানো রঙবেরঙের শব্দের প্রজাপতিরা।
আমি কবিতা-কিশোরীকে নিয়ে মেতে ওঠি শব্দের খেলায়,
মেতে ওঠি তার অনুপম শরীর-শিল্পকে নিয়ে;
সাজাতে থাকি উপমা-প্রতীক আর চিত্রকল্পের কম্র কারুকাজে।
সৃজনের সুনন্দ-ভেলায় ভেসে ভেসে
কেটে যায় আমার ঘুমহীন রাত।
রোজনামচা
আমার দিন শুরু হয়
উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার রেসিপিতে ভরা প্রাকৃত প্রাতরাশ দিয়ে।
কুণ্ঠিত হৃদয়ের লাল রঙে রাঙানো চায়ের পেয়ালা হাতে
চোখ বুলাই পত্রিকার পাতা ভরা দুঃসংবাদের শিরোনামে,
নিজের অশক্ত মনকে প্রমত্ত প্রত্যাশায় ভরিয়ে দিয়ে
বিষাদের ধূসর উত্তরীয় সারা গায়ে জড়িয়ে
বেরিয়ে পড়ি সাত-তাড়াতাড়ি আশাবরী সুর ভাঁজতে ভাঁজতে।
দুঃখের দারোয়ান বিমর্ষ হেসে স্যালুট ঠুকে আমাকে,
ক্লান্তির কুয়াশা হয় বিশ্বস্ত সঙ্গী।
পথে পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় দ্বিধার পাহাড়,
দূষিত বাতাসের পিরানহা
ঝাঁকে ঝাঁকে এসে রক্ত থেকে শুষে নেয় সবটুকু প্রাণ,
আর আহত দুপুর আমার উপর ঢেলে দেয় তার গনগনে রাগ।
আকাশ তখন
আমার মাথার উপর টাঙিয়ে দেয় বেদনার নীল সামিয়ানা,
শ্রান্তির পরীরা অবসিত স্বেদবিন্দু ছড়িয়ে উড়ে চলে চারপাশে,
বিষণ্ণ বিকেল উড়িয়ে দেয় আত্মসমর্পণের অর্ধনমিত পতাকা,
আর মুমুর্ষু সন্ধ্যা বাজাতে থাকে অবসন্নতার অশ্রুত গান।
অবশেষে,
আবার দিনশেষে ফিরে আসি পুনরাবৃত্ত জীবনের গৃহবাসে,
সাথে করে নিয়ে আসি দিবসের যা কিছু প্রাপ্তি
অভিজ্ঞতার প্রাণরসে জারিত অনন্য সে অর্জন।
আমার জীবনপাত্র পূর্ণ হয়ে ওঠে জীবনের নানা সুধারসে।
আর নয় বৃহন্নলা-জীবন
প্রতিদিন রাতে আমি দুঃস্বপ্ন দেখি।
ঊর্ণনাভের সর্বগ্রাসী তন্তুজালের মতো
চারদিকে বিস্তৃত হতে থাকা ইতিহাস ও সভ্যতার নানা সঙ্কট
আমাকে ক্রমশ ঠেলে নিয়ে যায়
. এক ভয়ঙ্কর পতনের প্রান্তমুখে।
সেই স্বপ্নের ভয়াবহতায়
কেঁপে কেঁপে ওঠে আমার জীবন ও জগৎ,
. অতীত ও বর্তমান।
দুঃস্বপ্ন আমাকে তাড়া করে বেড়ায়
এক অন্ধকার থেকে আরেক অন্ধকারের চক্রব্যূহে।
কিন্তু ভোর হলেই
সকালের নরোম রোদ মুছে দেয় সব অন্ধকার
. সমস্ত কলুষ-কালিমা,
জীবন আবার জেগে ওঠে জীবনের সবুজ উপত্যকায়।
আর আমি,
নতুন স্বপ্নে বিভোর এক স্বপ্নাক্রান্ত মানুষ,
জীবনের গাঙে আবার ভাসাই স্বপ্নের বেহুলা-ভেলা,
বৃহন্নলা-জীবন ছেড়ে এক তীক্ষ্ন তীরন্দাজের মতো
দ্বিধাহীন এগিয়ে যাই গন্তব্যের দিকে
. একলব্যের স্থির একাগ্রতায়।