পাণ্ডুলিপি থেকে । মহ্সীন চৌধুরী জয়
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১২:১৯ পূর্বাহ্ণ, | ১৮৩০ বার পঠিত
কবি মহ্সীন চৌধুরী জয় উনার এবার গল্প বই অদৃশ্য আলোর চোখ বের হচ্ছে ২০১৮ সালের একুশে বইমেলায়। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী মির্জা মুজাহিদ এবং প্রকাশিত হচ্ছে বাঙ্ময় প্রকাশনী থেকে।
ভাবনার মৃত্যু অথবা নির্ভার জীবনের গল্প
শনিবার। অফিস বন্ধ। অফিস খোলা থাকলেও আজকের যাত্রাপথ ভিন্ন হতো না। ট্রেনের শব্দে ঘুম ভাঙল। ট্রেন আমার নিত্যসঙ্গী। কৈশোর, যৌবনের অনেক আনন্দ মিশে আছে ট্রেনকে ঘিরে। ট্রেনকে ভালোবেসেছি, ট্রেনের বুকে চড়ে প্রকৃতিকে ভালোবেসেছি—নিলাকে ভালোবেসেছি।
৮ টার ট্রেনে নারায়ণগঞ্জ যাব। বোস কেবিনে চা খাব—পূর্ণ সতেজতায় কাটবে সারাদিন। রঙের শো-রুমে ঢুকে পাঞ্জাবি কিনব—পছন্দের পরিধেয়। নারায়ণগঞ্জ পাঁচ নং ঘাটে যেয়ে নৌকাতে চড়ব—প্রেমের প্রথম প্রহরে যেভাবে নিলাকে নিয়ে ভেসেছি ভালোবাসার সাম্পানে। মাওরা হোটেলে যেয়ে লাঞ্চ সারব—স্বাদ! ঢেকুর তুলব। দুপুরের পর সুধীজন পাঠাগারে যেয়ে মানিক বাবুর দিবারাত্রির কাব্য উপন্যাসের শেষ কয়েক পৃষ্ঠা পড়ব—বইয়ের পৃষ্ঠাতে আনন্দের চন্দ্রকলা নাচ দেখব—দাউ দাউ আগুনের তাপ নেব। বিকেলে নারায়ণগঞ্জের শরীরে হেঁটে বেড়াব—চাষাড়া থেকে নারায়ণগঞ্জ স্টেশনে চলে যাব এবং আমার ইচ্ছাপূরণ করব ট্রেনের সাথে মিশে। ঝিকঝিক ঝিকঝিক।
মা রুমে বসে আছে। উঁকি দিলাম। ফ্যাকাশে আর ফিকে হয়ে আছে মায়ের রূপ। ঘুমের সময় মায়ের সহজাত রূপ ফিরে আসে—নির্মল—গাঢ় নৈঃশব্দ্য ঘিরে থাকে মায়ের শরীর—মুখাবয়ব।
এখন চলছে মায়ের গালিগালাজ পর্ব। নিলার উদ্দেশ্যে—নিলার চৌদ্দ পুরুষসহ। যতক্ষণ ঘরে থাকব ততক্ষণ চলতে থাকবে প্রতিদিনের নিয়মমাফিক এই গালিবর্ষণ। চেয়েছিলাম মায়ের ঘুমন্ত মুখ দেখে বের হতে। ঘুমিয়ে থাকত ভেতরের অশুভসকল—বাইরে পূর্ণ রূপ জেগে উঠত সৌন্দর্যমেখে।
ঢাকা থেকে ট্রেন ফতুল্লায় চলে এসেছে। ট্রেনে আজও সমান ভিড়—অন্যান্য ক্ষণ ও দিনের মতো। আজ কারো সাথে বিবাদে যাব না। প্রথম বর্ষের কলেজ পড়ুয়া কিছু ছাত্রছাত্রীদের নোংরামি দেখেও না-দেখার ভান করব। দু’জনের সিটে তিনজনের বসা নিয়ে অযথা বাক-বিতণ্ডায় জড়াব না। দরজা দখল করে দাঁড়িয়ে থাকা উঠতি মাস্তানদের কিছু বলব না। আজ তারা খিস্তি চালিয়ে যাক। বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা সাধারণ মানুষকে থুতু ছিটাক। ট্রেনে উঠতে যাওয়া যাত্রীদের পকেটে হাত দিক। মেয়েদের শরীর নিয়ে অশোভন আচরণের সময়ও আমার ভূমিকা নীরব দর্শক হয়ে থাকবে।
নারায়ণগঞ্জ হতে ছেড়ে ঢাকার উদ্দেশে ফতুল্লায় ক্রসিং হওয়া ট্রেনটা লেট করছে। আমার ইচ্ছাপূরণও কি তাহলে লেট হয়ে যাবে?
জানলার সাথে সিট পেয়েছি। পাশের সিটে এক যুবক এসে বসল—বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া হবে। আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আমি ঢাকা থেকে এসেছি। কামরা চেঞ্জ করে এখানে আসলাম। আপনি কোথায় যাবেন?’
কী উত্তর দেবো? সহজ করে বললাম, ‘নারায়ণগঞ্জ যাব।’
—‘জানেন আমি এবারই প্রথম নারায়ণগঞ্জ যাচ্ছি।’
—‘কারো সাথে দেখা করতে যাচ্ছেন?’
নিলার বেহিশেবি খরচে মা অতীষ্ঠ হয়ে উঠল। মায়ের অহেতুক মিতব্যয়ী মনোভাব এবং নীচু মানসিকতার আচরণও নিলা মানতে পারল না। শুরুটা খরচের সীমা আর সীমা-অতিক্রম নিয়ে হলেও পরবর্তীতে আরো অনেক উপাদান যোগ দিল তাদের নিত্য ঝগড়ার রসদে। মায়ের অভিযোগ, নিলা আমাকে কিনে ফেলছে শরীর দিয়ে। কী নোংরা চিন্তা-ভাবনা! নিলার অভিযোগ, মা যা শেখাবে ছেলে তো তাই শিখবে। মানসিকতা উন্নত হলো না আমার। সেই আদিকালের ধ্যান-ধারণা—স্ত্রী মানেই দাসী।
লাজুক হাসি দিয়ে মাথা নাড়ল। বুঝলাম, কোনো মেয়ের সাথেই দেখা করতে যাচ্ছে। মোবাইলে কথোপকথন, নয়তো ফেসবুক আইডি থেকে পরিচয় এবং প্রেমের অক্ষরে অক্ষরে যুগল হৃদয়ে ভালোবাসার শব্দগঠন—হয়তো…
জানলা দিয়ে বাইরে চোখ রাখলাম। ছবির মতো—নির্মল প্রকৃতি।
সেই দিনগুলোর মতো—এখনও চোখের সামনে ভাসছে। চলে গেলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি-প্রস্তুতির সেই সময়ে। নাকি সেই সময়ই আমার চোখের সামনে এসে দাঁড়াল। নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশে রওয়ানা দিয়েছি নিলার সাথে দেখা করতে। আমি আর সজীব। নিলাকে ফতুল্লায় নিয়ে আসব। নিলা একাই আসতে চেয়েছিল—আমরা রাজি হই নি। নিলাকে সাথে করে নিয়ে আসার লোভ মনে জেগে উঠেছিল। স্কুল-জীবনে ওরা ফতুল্লাতেই ছিল। সজীবদের এলাকায়। স্কুল শেষ করার পরপরই নারায়ণগঞ্জে সেটেল্ড হয়।
স্কুলের রি-ইউনিয়ন প্রোগ্রাম উপলক্ষে নিলাকে দেখতে পাওয়া—নিলার সাথে পরিচয় হওয়া। প্রোগ্রামে সজীব আর নিলা কবিতা আবৃত্তি করবে। কবিতা আমাকেই লিখতে হয়েছে রাত জেগে। দিনে কিছুতেই লিখতে পারছিলাম না। নিলার অবয়ব কল্পনাতে আসছিল না। রাতে নিলা কাছে আসলেই কবিতা দাঁড়িয়ে যায়। শতবার প্রেমে পড়া এ হৃদয় অদেখা নিলার প্রেমেও পড়ে। যদিও মনকে শর্ত দিয়ে—নিলার সৌন্দর্যে যদি প্রেম জাগে—দেহের সৌন্দর্য প্রথমে, মনের সৌন্দর্য প্রথম পর্যায় পরে।
সজীব নিলার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। লাবণ্যময় একটা মুখে চোখ রাখলাম। কামনা জেগে উঠল—সব সময়ে এ মুখ চোখের সামনে ধরে রাখার। এ কি নিছক লাম্পট্য নাকি ভালোবাসার আর্তি? নিলা নাম বলল। নাম জিজ্ঞাসা করল। আমি কিছুই বলতে পারলাম না। সজীবই বলল। প্রথম দেখাতে কেউ তুমি করে বলুক সেটা আমার পছন্দ নয়। একই ইয়ার এবং নিলা বলেই হয়তো মেনে নিলাম। ধাক্কা সামলে স্বাভাবিক আচরণ করলাম। তুমিই বলুক। তোমাকে চাই এবং তোমার তুমিকেও চাই।
নারী স্বরে অন্যরকম কমনীয়তা থাকে, তবুও নিলার আবৃত্তি ভালো হচ্ছিল না। অনুভূতি, আবেগ, ভাব, ছন্দ ইত্যাদির সমন্বিত ও ব্যঞ্জনার প্রকাশই আবৃত্তি তা নিলার জানা ছিল না। আমার বারংবার তাগাদায় নিলা রাগ করল। চলে গেল। আগামীকাল আসবে কিনা তাও বলে গেল না। আমারও মন খারাপ হলো—সজীবের হলো তারচেয়ে বেশি। প্রেমের কবিতা! সজীব তো প্রেমিক-পুরুষ ভেবে নিজেকে সঁপে দিচ্ছিল পূর্ণ রসে। এ রসবোধ যাকে ঘিরে তার প্রত্যাখান কতটুকু মেনে নেওয়া যায়!
রি-ইউনিয়নের প্রোগ্রামের আর মাত্র দুদিন বাকি। সজীব আর আমি নির্দিষ্ট সময়ে পায়চারি করছি। গতকাল রাতও আমার সাথে বিট্রে করেছে—খুব বোর হয়ে গেছিল। সূর্যও যেন উঠতে দেরি করেছে। সকালও ছিল বৃষ্টির দখলে। এ কাদা, নোংরা পরিবেশ নিয়ে কি ভালোবাসার কথা চিন্তা করা যায়? প্রকৃতি অপ্রকৃতিস্থ—আমরাও অস্থির। কী যেন নাই আমাদের মাঝে। আমাদের ক্লান্তিহীন অপেক্ষাতেও ক্লান্তি চলে আসবে, এমন সময় নিলাকে দেখা গেল। ম্রিয়মাণ, নিষ্প্রভ—রাতের নিষ্ঠুরতা কি ওকেও গ্রাস করেছে? দেরি করে আসাতে নিলা স্যরি বলে নি। সৌন্দর্যে মিশে-থাকা মেয়েরা সহজে স্যরি বলতে পারে না।
আবৃত্তি শুরু হলো। সজীবদের বাসাতেই আবৃত্তি চলে। খালাম্মা চা, বিস্কিট দিয়ে যায়। নিলার সাথে খালাম্মার খুব ভাব। আমার ভেতরে ভেতরে অস্থিরতা! নিলা আর খালাম্মার উদ্দেশ্য কি এক? আমি বাইরে থেকে ঘুরে আসি। সিগারেট ধরাই। প্রজ্বলন, ধোঁয়া, কুয়াশা—পুরোটাই ধোঁয়াশা বটে! সজীবকে বিশ্রী লাগে—নিলার সাথে মানায় না। সজীবের আম্মার সাদরে গ্রহণকেও তোষামুদে মনে হয়। আজই শেষ। আর আসব না। আমার প্রেমের কবিতা দিয়ে প্রেম করবে ওরা! আবৃত্তি করবে? হাততালি পাবে?
ভেতরে গেলাম। সজীব বাজারে যাবে। নিলা আর আমি—আমি আর নিলা। সজীব আমাকে সাথে নিয়ে যাবে। নিলাই বাধা দিল। একা একা সময় কাটাবে কিভাবে? ভেতরে মন নেচে উঠল। সজীব নিশ্চিত মরে গেল ভেতরে ভেতরে।
—‘তুমি কি আমার প্রতি রাগ করেছ?’
প্রশ্নটা শোনার সাথে সাথে মাথার ভেতরে প্রশ্নটা চট করে জেগে উঠল—যুবতী মেয়েরা মুখের আদল দেখেই কি সব পড়তে পারে? যদিও প্রশ্নটা শুনে আমার ভেতরের সব রাগ-অভিমান চলে গেল। সুন্দরী মেয়ে বলে কথা। চাওয়া থেকে বেশি পেয়ে যাচ্ছি কি? মুখে স্বস্তির হাসি চলে এল—শরীরময়।
—‘না না কী বলছ, রাগ করব কেন? রাগ করার মতো কি কিছু হয়েছে?’
অপ্রত্যাশিত হলেও নিলা কেমন বিনয়ের সাথেই বলল, ‘কাল আমি বোধহয় একটু বাজে আচরণই করে ফেলছি। আমি কী আর জানতাম কবিতা তুমি লিখেছ। ভেবেছিলাম কোনো প্রখ্যাত কবির ধার করা কবিতা নিয়ে অযথা মাতব্বরি করছ। বেশ লেখ তুমি। আগে বলো নি কেন?
আমার আগে আমার কবিতার প্রেমে পড়েছিল নিলা।
২
বাইরে হট্টগোল। শরীরে হাতের স্পর্শ।
ঢাকা থেকে আসা যুবক বলল, ‘কোথায় ডুবে গেলেন? শুনেছেন নাকি, নারায়ণগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনে নাকি কোন এক মহিলা আত্মহত্যা করেছে। দেখেছেন মানুষের মধ্যে কী অহেতুক কৌতূহল!’
আমার হাসি পেল। নিলা আত্মহত্যা করলে বেশ হতো। অবশ্য, নিলা তা করবে না। ও জীবনকে বড্ড ভালোবাসে। জীবন নিয়ে যুদ্ধ করতে চায়, জীবনকে উপভোগ করতে চায়—নৈতিক-অনৈতিক দু’পন্থাতেই।
যুবক বলল, ‘আপনি যাবেন? চলুন না দেখে আসি। একা একা যেতে গা ছমছম করছে।’
—‘গা ছমছম করার কিছু নেই। মৃত্যুময় শরীর এক শৈল্পিক দৃশ্য। ইচ্ছামৃত্যুতে স্বস্তি প্রকাশ পায়। দেহে হাসি ফুটে ওঠে।’
—‘আপনি কি আত্মহত্যার পক্ষে?’
—‘মৃত্যু আমার ভালো লাগে।’
যুবকটি হতভম্ব। ‘মৃত্যু আপনার ভালো লাগে? মৃত্যুর স্বাদ নিয়েছেন?’
—‘আপনার কি সমুদ্র ভালো লাগে?’
—‘মৃত্যুর সাথে সমুদ্রের সম্পর্ক কী?’
আমি যুবক ছেলেটির দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললাম, ‘সমুদ্র আপনার ভালো লাগে কিন্তু সমুদ্রে আপনি থাকেন নি। স্পর্শ করেছেন, স্নানও করেছেন। তাতে কি সমুদ্রের তলকে ছুঁতে পেরেছেন? মৃত্যু আমরা দেখি নি সত্যি, তাতে কী, কোনোদিন মৃত্যুর মুখোমুখি কি হই নি? মৃত্যুর স্বাদ কী রকম তা কি মৃত ব্যক্তি আমাদের বলবে? মৃত্যু নিয়ে গান, কবিতা তো জীবিতরাই লিখে তাই না?’
—‘আপনি তবে ইচ্ছামৃত্যুর পক্ষেই।’
—‘আমি আমার নিজের সিদ্ধান্তের পক্ষে।’
যুবকটি জোর দিয়ে বলল, ‘আমি ইচ্ছামৃত্যুর পক্ষে না। মৃত্যু তো নির্দিষ্ট সময়ে হবেই। ইচ্ছামৃত্যুর পরেও হয়তো আমাদের জন্য সুখ আর স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন অপেক্ষা করবে।’
—‘জীবনের জোয়ার-ভাটার কথা বলছেন? মাঝে মাঝে ভাটার টানে অস্তিত্ব এতটাই তলিয়ে যায় যে, জোয়ারের আর কোনো সম্ভাবনাই থাকে না।’
—‘আপনার কথায় কেমন কাব্যিক কাব্যিক ঘ্রাণ পাচ্ছি। আপনি কি লেখালেখি করেন?’
—‘হ্যাঁ, আমি কবি আলতাফ হক। আমার নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই?’
—‘না তো, আপনার নাম কখনোই শুনি নি। এ নামে কোনো কবি আছে তাই তো জানা ছিল না। কেন শুনি নি বলুন তো, আমি কিন্তু অনেক বই পড়ি।’
অন্য সময় হলে আমি নিশ্চিত দমে যেতাম। ভেতরে ঠিক ব্যথার একটা ঘণ্টা বাজত। আজ কেন জানি এসবের ঊর্ধ্বে চলে যাচ্ছি। চলে যাচ্ছি অনিশ্চিত পথে। ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠল। আমাকে বহন করে নিয়ে চলছে চলমান ট্রেন। ঝিকঝিক ঝিকঝিক—কু ঝিকঝিক।
ট্রেন ছাড়ার সাথে সাথে কোলাহল শুরু হয়ে গেল। অন্য দিনের মতো আজ বিরক্তি জাগছে না মনে। ভালো লাগছে মানুষের ছোটাছুটি, দাপাদাপি—অহেতুক হেসে ওঠা, হৈ-হুল্লোড়।
প্রতিটি মানুষের চোখ ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলছে। কেউ সৌন্দর্য খুঁজে বেড়াচ্ছে্। কেউ নিজের সৌন্দর্য চোখে ফুটিয়ে তুলছে। কারো চোখে কৌতূহল। কারো চোখ হাসছে প্রাপ্তির হাসিতে। আমার দু’চোখের ভাষাতে মা আর নিলার জন্য উদ্বেগ আর ভালোবাসার কথা ফুটে উঠছে, সকলের অলক্ষ্যে।
৩
বুঁদ হয়ে মনশ্চক্ষে আবারও ফিরে যাচ্ছি সেই সময়ে। যে সময়ে রঙিন ছিল জীবন—আগামীর ভাবনা-চিন্তাগুলোও রঙিন ছিল। নিলাকে দেখে মার খুব পছন্দ হয়ে গেল। নিলা পছন্দ হওয়ার মতোই ছিল—নির্মল প্রকৃতির মতো চেহারা—দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে হতো। নিলার বাবার বাড়ি ছিল, গাড়ি ছিল—মা আর আমার জন্য নিলা তো ছিলই। আমার কোনো বোন ছিল না—নিলাকে পেয়ে মা একটা মেয়েও পেল।
কিন্তু কতদিন! কতদিন ছিল সুখ-স্পর্শের সেই দিনযাপন?
নিলার বেহিশেবি খরচে মা অতীষ্ঠ হয়ে উঠল। মায়ের অহেতুক মিতব্যয়ী মনোভাব এবং নীচু মানসিকতার আচরণও নিলা মানতে পারল না। শুরুটা খরচের সীমা আর সীমা-অতিক্রম নিয়ে হলেও পরবর্তীতে আরো অনেক উপাদান যোগ দিল তাদের নিত্য ঝগড়ার রসদে। মায়ের অভিযোগ, নিলা আমাকে কিনে ফেলছে শরীর দিয়ে। কী নোংরা চিন্তা-ভাবনা! নিলার অভিযোগ, মা যা শেখাবে ছেলে তো তাই শিখবে। মানসিকতা উন্নত হলো না আমার। সেই আদিকালের ধ্যান-ধারণা—স্ত্রী মানেই দাসী।
কী করে সম্ভব দু’প্রজন্মের দু’জন বিপরীত স্রোতে চলা নারীকে একই ছাদের নিচে বসবাস করানো।
একদিন রাতে নিলা খাটে শুয়ে শুয়ে বলল, ‘চলো আমরা আলাদা হয়ে যাই। তোমার মায়ের জন্য না-হয় একটা মেয়ে রেখে দেবো। উনি তো আমাকে সহ্যই করতে পারেন না।’
আমি কথা বলি নি দেখে নিলাও পাশ ফিরে শুয়ে রইল। যেন ওর শরীরও কথা বলবে না।
সকালে মা রুমে ডেকে নিয়ে বলল, ‘খোকা, আমাকে বৃদ্ধাশ্রমেই রেখে আয়। তোদের সংসারে আমি কাঁটা হয়ে থাকতে চাই না। আমার জন্য চিন্তা করবি না। সেখানে আমি খুব ভালো থাকব।’
—‘তা কি কখনো হয় মা। তোমাকে কি আমি ছাড়তে পারি?’
—‘তবে এই বউ ছেড়ে দে। আমি তোকে আবার বিয়ে করাব।’
বেরিয়ে গেলাম রুম থেকে। নিলাকেও তো ছাড়তে পারব না। চোখে দেখা শততম ভালো লাগা মেয়ে পার করে নিলার সাথে সম্পর্ক গড়েছি—নিলাও আমাকে ভালোবেসেছে। কী করে সম্ভব নিলাকে পরিত্যাগ করা!
মাঝে মাঝে মনে হয়েছিল চলে যাই এ বাড়ি ছেড়ে। পড়ে থাকুক বউ-শাশুড়ি—অসন্তোষ, গালিগালাজ, দ্বন্দ্ব, ঘৃণা, মিথ্যা, কুৎসা আর যন্ত্রণার সংসার নিয়ে। গতকাল বাড়ি ফিরে শুনলাম—মা আর নিলা শুধু মুখের ঝগড়া নয়, হাতের ঝগড়াতেও লিপ্ত হয়েছিল। মা নিলার উপর হাত চালিয়েছে আর নিলা মাকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দিয়েছে। বাবার বাড়িও চলে গেছে একেবারের জন্য। প্রচণ্ড ঘৃণা জন্মাল মনে। শরীর রি রি করে উঠল। অসভ্য, বর্বর সব। অথচ লক্ষ করলাম, কাজের মেয়েটা বেশ উৎসাহ নিয়েই কথাগুলো বলল।
৪
আবারও হাতের স্পর্শ। হর্ন। মানুষের ছোটাছুটি। কোলাহল।
—‘আমি নেমে যাচ্ছি। আপনার মোবাইল নাম্বার দেওয়া যাবে? আপনাকে আমার ভালো লেগেছে। আগামীতে আপনার বই পড়ব।’
যুবকের মুখে হাসি। আন্তরিক। ওর মন আজ প্রসন্ন, নতুন স্বপ্ন পুরো শরীরময় ছুটে বেড়াচ্ছে। আমি বিব্রতবোধ করছি। কী হবে নাম্বার দিয়ে—যোগাযোগ করে।
—‘আমার ফোন বন্ধ। কাল থেকে মোবাইলও অ্যাকটিভ থাকবে না।’
—‘এ যুগে মোবাইল ছাড়া কি চলে? আপনার কথায় কেমন রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি।’
—‘জীবনটাই তো রহস্য। মৃত্যুও রহস্য হয়ে ওঠে কখনো কখনো।’
নাম্বার দিতেই হলো। আমাদের দুজনের পথ ভিন্ন। ও যাচ্ছে স্বপ্ন কুড়াতে আর আমি…
আমার নিত্যসঙ্গী সেই ট্রেন আসবে—মিশে যাব ট্রেনের সাথে—আমিও না-হয় বলে উঠব, ঝিকঝিক ঝিকঝিক। কু ঝিকঝিক।
বোস কেবিনে চা খেতে পারি নি। আমায় দেখে কাপের ভেতর দুধ কেমন হাসছে—চিনি থেকে মিষ্টি ধার নিয়ে। মিষ্টি হাসি! নাকি তাচ্ছিল্য! আমি বিব্রত। কাপুরুষতা নাকি সঠিক সিদ্ধান্ত!
পাঞ্জাবি কিনেছি লাল রঙের। মৃত্যু রঙের। নৌকায় চড়া বাদ দিয়েছি—নিলা নেই। আজ সকালে নিলা আত্মহত্যা করলে বেশ হতো। লালে রাঙা হয়ে থাকত পুরো শরীর। লালটিপসহ—মৃত্যুরং।
দুপুরে খেতে পারলাম না। চোখের পানিতে মাংস ঠান্ডা হয়ে গেল। মায়ের মাংস রান্নার হাত চমৎকার। শৈল্পিক! নান্দনিক! শুধু ঝালটা একটু বেশি…
আবারও ফোন বেজে উঠল। এবার অপরিচিত নাম্বার। রিসিভ করলাম। যেই যুবক। ভাঙা কণ্ঠ। ব্যথার সুরে বেজে উঠছে কথামালা। ধোঁকা খেয়েছে। সব ঠিক আছে—শুধু ছবি পরিবর্তন করে দিয়েছিল রমণী। এ ছবি তো বুকের মধ্যে ধারণ করে নি—তবে ভালোবাসবে কিভাবে? ওর হৃদয়ে ক্ষরণ হচ্ছে বুঝতে পারছি।
মাঝে মাঝে মনে হয়, বউয়ের চেয়ে আমি বইকেই বেশি ভালোবেসেছি। সুধীজন পাঠাগার হতে বের হতে মন চায় নি। কিন্তু থাকি কী করে? নৈঃশব্দ্যের গাঢ় অন্ধকারের ভেতর ঝনঝন শব্দে ঝঙ্কার তুলছে একটি ট্রেন। আমায় ডাকছে। আমার শিল্পিত মন কেঁপে উঠছে। পারিবারিক বন্ধন আলগা হয়ে যাচ্ছে। সভ্যতা, মানুষ, প্রকৃতি সবকিছু কেমন দূরে চলে যাচ্ছে। নীল ছবির দুনিয়াও আবছা হয়ে আসছে। পরিচিত মুখ, শত্রু-মিত্র সবাই কেমন উল্লাস করছে। আমি চলে যাচ্ছি রেল লাইনের পথে—ট্রেন! আমাকে সঙ্গী করে নিবে ওর দুরন্ত যাত্রায়—হেঁটে যাচ্ছি—ভেসে যাচ্ছি—চাঁদের মতো আলো বয়ে চলা ট্রেনের দিকে—ঝিকঝিক ঝিকঝিক—কু ঝিকঝিক।
আজও ট্রেন লেট! আমার ইচ্ছাপূরণও কি লেট হয়ে যাবে?
ফোনটা চালু করা দরকার। মা আর নিলার সাথে শেষবারের মতো কথা বলা দরকার।
মায়ের ফোন বেজে উঠল। কেঁপে উঠলাম। এমন দ্রুত হয়ে যাচ্ছে কেন বিষয়গুলো? ট্রেনও চলে আসছে—সুর করে। হর্ন দিয়ে—নিজেকে জানান দিয়ে—চারদিকের ধুলো উড়িয়ে।
—‘খোকা, সারাদিন কোথায় ছিলি? তোকে যে হাজারবার ফোন দিয়েও পাচ্ছি না।’
আমি নির্লিপ্ত। উৎসাহ পাচ্ছি না। মিলে যাচ্ছে—আবেগ তো আগেই মরে যায়।
—‘বেয়াই ফোন করেছিল। তু্ই বাবা হবি। আমার নিলা মাও নাকি সুস্থ আছে। খোকা, বাড়ি চলে আয়। আসার সময় মিষ্টি নিয়ে আসবি।’
ট্রেন শব্দ তুলে দ্রুত এগিয়ে আসছে। আমার ভেতরে কী এক অদ্ভুত তাড়না জেগে উঠছে? সম্মোহন! একটা ফুটফুটে কন্যা-শিশুর কান্নার আওয়াজও কানে ঢুকে যাচ্ছে। কী অদ্ভুত! ট্রেনের ভেতরেও কান্নার শব্দ—বয়ে চলছে—পুরো শরীরজুড়ে।
নিলার ফোন। ধরব কী ধরব-না বুঝতে পারছিলাম না। প্রথমবার কেটে গেল। পরেরবার ঠিক ধরতে হলো।
—‘কী ব্যাপার তুমি ফোন ধরছ না কেন? সারাদিন কোথায় ছিলে? ফোন বন্ধ ছিল কেন? জানো, আমি কী অস্থিরতায় সারাদিন কাটিয়েছি। আমার উপর রাগ করেছ? ক্ষমা করো। মাথার ঠিক ছিল না। ধাক্কা কি আমি ইচ্ছে করে দিয়েছি? লেগে গেছে। মাকে কি আমি ধাক্কা মারতে পারি?’
নিলা কি কাঁদছে…
আমি বোধহয় শুনতে পাচ্ছি না কিছুই, বুঝতে পারছি না নিলার কথা।
—‘কী হলো, কথা বলছ না কেন? কথা বলবে না আমার সাথে? মায়ের কাছ থেকে তো সবই শুনেছ। আমার যে কী ভালো লাগছে—তুমি খুশি হও নি? কাল চলে এসো মাকে নিয়ে। বাবা তোমাদের দাওয়াত করেছে।’
স্বাভাবিকভাবেই বললাম, ‘শরীরের যত্ন নিও। এখন রাখছি।’
ট্রেন দ্রুত চলে আসছে আমার দিকে। আমর কৈশোর, যৌবনের নিত্যসঙ্গী ট্রেন। আলো বয়ে আনছে। ঢুকে পড়ছে আমার ভেতরে। ধারণ করতে কষ্ট হচ্ছে। ভেতরটাও কেঁদে চলছে—ট্রেনের সাথে—সদ্য ফুটে ওঠা বাচ্চার কান্নার সাথে।
আবারও ফোন বেজে উঠল। এবার অপরিচিত নাম্বার। রিসিভ করলাম। যেই যুবক। ভাঙা কণ্ঠ। ব্যথার সুরে বেজে উঠছে কথামালা। ধোঁকা খেয়েছে। সব ঠিক আছে—শুধু ছবি পরিবর্তন করে দিয়েছিল রমণী। এ ছবি তো বুকের মধ্যে ধারণ করে নি—তবে ভালোবাসবে কিভাবে? ওর হৃদয়ে ক্ষরণ হচ্ছে বুঝতে পারছি।
বলল, ‘জানেন, মনে হচ্ছে আত্মহত্যা করি। এ জীবন রেখে আর কী লাভ।’
আতঙ্কিত হলাম। ট্রেনের শব্দ আসছে অলৌকিক গতিতে—ট্রেনও। অন্ধকার কেটে আলো ফুটে উঠছে। লাল রং! মৃত্যু রং! ইচ্ছামৃত্যু! দেহের স্বস্তি—হেসে ওঠা এবং কথা বলা!
—‘হতাশ হবেন না। ইচ্ছামৃত্যু তো সমাধান নয়। হয়তো আগামীতে আপনার জন্য স্বস্তির জীবন, সাফল্যের জীবন অপেক্ষা করছে।’
ট্রেন চলে এসেছে। এগিয়ে যাচ্ছি ট্রেনের শরীরে বসে। দুলে উঠছে ট্রেন—আমার মনও দুলছে। জানালা দিয়ে দ্রুত ছুটে আসছে হাওয়ার বেগ—শীতল অনুভূতি। কানে খেলা করছে সুর—সদ্য জন্ম নেওয়া একটা কন্যা শিশুর কান্নার আওয়াজ। ট্রেন হেসে চলছে—ঝিকঝিক ঝিকঝিক—কু ঝিকঝিক।