বাস্তব প্রেম । মহসীন চৌধুরী জয়
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ জুন ২০১৭, ১১:০৯ পূর্বাহ্ণ, | ১৫৮৭ বার পঠিত
জীবনে মিছেমিছি অনেক খেলা খেলেছে। স্বপ্ন জেগেছে, বিভ্রমে পড়েছে। পার্থিব মোহ জীবনের ঘরে রঙের আচড় টেনেছে আর শাদাকালো জীবনের মর্মে বাস্তব আর সত্য সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মরশুম আর রিতু এভাবেই জীবনের আলো–আঁধারীতে পথ রচনা করেছে। আজ তাদের সুখের পায়রার বিচরণ পুরো আকাশময়। ফলাফল পেয়েছে জীবনযুদ্ধের অন্যরকম এক প্রাপ্তির। আগামীর নির্বিঘ্ন যাত্রাপথে এ প্রাপ্তি পাথেয় হয়ে থাকবে নিশ্চিত। মরশুম ও রিতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। একই বিষয়ে। হিসাব বিজ্ঞানে। হিসাবে তারা যতই পারদর্শী হোক, ঢাবির জটিল সমীকরণ পেরিয়ে হিসাবের খাতায় দুর্লভ সাফল্য যোগ করা চাট্টিখানি কথা নয়। জীবনের বালুকাবেলায় হেঁটে, মাটির স্বাদ ও সৌন্দর্য মেখে এখন পর্যন্ত জীবনযুদ্ধে তাদের সফলই বলা চলে। অদূর ভবিষ্যতেও উভয়ে সাফল্য ধরে রাখতে দৃঢ় প্রত্যয়ী।
মরশুম সুন্দর। রিতু সুন্দরী। দুজনই মেধাবী। মরশুম ও রিতুর মধ্যে অদ্ভুতরকম মিল — যদিও জীবন শেখায় প্রতিটি ব্যক্তিরই মস্তিষ্ক ও মনের মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। আবেগ ঘোড়া দাপড়িয়ে বেড়ায় আর বিবেক লাগাম টেনে ধরে। দুজনই রাজনীতি অপছন্দ করে। রাজনীতিবিদদের নীতি-বহির্ভূত কাজ ওদের অবাক করে, কষ্ট দেয়, বিরক্তি জাগায়। খেলার পাগল — এখন পর্যন্ত খেলার সৌন্দর্য ওদেরকে ভেতরেও আন্দোলিত করে। সিনেমার বাস্তবতায় যদিও আস্থা নেই — তবুও মরশুমের পছন্দ সুচিত্রা সেন, রিতুর উত্তম কুমার।
দুজন দুজনকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। প্রতিদিন কথা না বললে শরীরে অস্থির–অনুভব জাগে। দেখা তো নিয়মিতই হয় — পরস্পরের বাড়িতে। চলার পথে প্রাণ উজার করে গল্পে মাতে — রিকশা নয়তো গাড়িতে। পরিচিত অনেকে এ জুটি দেখে ঈর্ষান্বিত হয়। বন্ধুদের অনেকে গর্ববোধ করে।
ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনাতেও ওদের আন্তরিক মিল লক্ষ করার মতো। জীবনের সোনালি দিলগুলো অবশ্যই তারা দেশের মাটিতে কাটাতে অনাগ্রহী। রাজনৈতিক পরিস্থিতি এতটাই নাজুক যে, সহজ সরল জীবনপথে নিশ্চিত বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে গুম, খুন কিংবা হরতাল — এমনটাই ওদের বিশ্বাস। এছাড়া পরিবহন ব্যবস্থা, চিকিৎসার সুবিধা, শিক্ষাসহ নিত্য প্রয়োজনীয় আর মৌলিক চাহিদার যোগান দেশ দিতে পারবে না বলে তারা নিশ্চিত। ইউরোপের উন্নত জীবনধারা ওদের মুগ্ধ করে। ইউরোপীয় সভ্যতা ওদের আকৃষ্টও করে। নিরুদ্বেগ জীনবযাপনে দেশ ছাড়ার কোনো বিকল্প নেই। তাই তো পরস্পর সম্মোহিত হয়ে পড়ে দেশ ত্যাগের কল্পনানন্দে।
ভাবনার সৌন্দর্য, শরীরিক সৌন্দর্য জাগিয়ে তোলে। অতঃপর পরস্পর প্রমত্ত চুম্বনে মেতে ওঠে ইউরোপীয় সভ্যতায়।
১ম বর্ষের পরীক্ষার পর ভার্সিটির অঘোষিত বন্ধে দেখা–সাক্ষাৎ কমে আসে মরশুম ও রিতুর। বিনা নোটিশে তিনদিন যাবৎ রিতুর মোবাইল ফোনও বন্ধ। মরশুম চিন্তিত। ফেসবুকও ডি–অ্যাকটিভ। সমযের প্রয়োজনীয় দুদুটো অপশন থেকে রিতুর বিরত থাকাটা স্বভাববিরুদ্ধ বৈকি!
আজ মরশুম চিন্তিত নিজেকে নিয়েও। অস্তিত্বের হুমকি! বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। ছেলে সুদর্শন আর মেধাবী হলে সময়ের আগেই বাজারমূল্য চড়া হয়। অনেক মেয়ের বাবাই তখন জামাই খরিদ করতে মাঠে নেমে যায়। আর এ মেয়ের বাবা জানে তার কন্যাটির মনে শিশু বয়স থেকেই ইউরোপীয় কালচার গেঁথে আছে। মনে আছে, শিশু বয়সে মেয়ের আবদারে কুকুর কিনে দিতে হয়েছিল। বাড়ন্ত বয়সে সেই মেয়েরই আবদারে কি জামাই কিনে দিতে পারবে না? মরশুমের পরিবারও এ প্রস্তাব লুফে নিয়েছে। ঘরজামাই দেশে মন্দ হলেও লন্ডনে মন্দ নয় নিশ্চয়ই।
রিতুর বাড়িতে হরহামেশাই যাতায়াত মরশুমের। প্রেমিকার বাড়িতে পা দিয়ে পূর্বে কখনোই সংকুচিতবোধ করে নি। তবে আজ ওর পদক্ষেপে কাঁটায় ফুটা পা নিয়ে বন অতিক্রমের মতো। পা পড়ে নিয়েছে মুখাবয়বের কথা আর রিতু পড়তে পারবে না মনের কথা!
এখানেও ওদের মধ্যে কী অদ্ভুত মিল। পরস্পর দীর্ঘক্ষণ চেয়ে আছে পরস্পরের মুখের দিকে। রিতুই শুরু করে। ‘তোমাকে এমন বিমর্ষ লাগছে কেন?’ একটু হেসে, ‘আমাকেও একই কথা বলবে? আমার চেহারায় বিমর্ষ–ছাপের কারণ আছে।’
‘কী এমন কারণ যে যোগাযোগই ছিন্ন করতে হলো?’
‘তোমাকে ত্যাগ করে ইউরোপ পাড়ি দেবার কারণ।’
মরশুমকে আরো বিমর্ষ দেখায়। ‘সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছ?’
রিতু অবাক হয়। ‘তোমাকে ছাড়া সিদ্ধান্ত নেব? তোমাকে ছেড়ে যাওয়াও তো অসম্ভব।’
মরশুম নিজেকে যেন ফিরে পায়। বলল, আমরা দুজনই পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ত।’
‘তোমার কথা বল। তোমাকে এমন রোগা লাগছে কেন? আমার ইউরোপ যাত্রার কথা তোমার তো জানার কথা নয়।’
‘তোমার ইউরোপ যাত্রার কথা ভেবে নয়, তোমাকে ছেড়ে আমার ইউরোপ যাত্রার কথা ভেবেই মন খারাপ।’
‘সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছ? মেয়েটি কে?’
‘পিংকি।’
‘কোন পিংকি? তোমাকে যে কাকু বলে ডাকত? ও তো অনেক ছোট।’
‘এখন আর ছোট্টটি নেই। মেয়েদের শরীর বলে কথা। তোমার পাত্রটি কে?’
‘দিদার।’
‘সেকি, তুমি না ওকে কাকু বলে ডাকো?’
‘আমি কিছুই ডাকি না। তবে দিদার সাহেব বাবাকে ভাই বলে ডাকত।’
‘বয়স তো অনেক।’
‘পুরুষ মানুষের আবার বয়স। অল্প বয়সের পুরুষ কি সচরাচর এমন প্রতিষ্ঠিত হয়? তুমি কি হয়েছ? নাকি তোমার সাথে লন্ডনে যেতে পারব?’
‘বাবার পছন্দের বাইরে গেলে আমাকে বাড়ি থেকেই বের করে দিবে।’মরশুম হাসে। ‘সত্যিই তাই। আমাদের একত্রে লন্ডনে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে আলাদা আলাদা সম্ভব।’
দুজনই কিছুটা সময় চুপ করে থাকে।
আবারও রিতুই মুখ খোলে। ‘আমি যা ভাবছি তুমিও কি তাই ভাবছ?’
‘আমিও তাই ভাবছি। তবে… আমরা ভুল করছি না তো? অনেক বছর পরের একদিন স্টেশনে দেখা হলে কিংবা লন্ডনের কোনো এক পার্কে ঘন ঘন দেখা হলে আমাকে দোষারোপ করবে না তো?
রিতু চমকে ওঠে। ‘ছি, তা কেন হবে! তোমার সাথে পরামর্শ করেই তো ভাবছি। যদিও আমি এখনও সিদ্ধান্তে পৌঁছাই নি।’
মরশুম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ‘তা অবশ্য ঠিকই বলেছ।’
এখন রিতুকেও উদ্বিগ্ন দেখায়। ‘কোনো এক পার্টিতে নয়তো বিমানের একই ফ্লাইটে আমাদের দেখা হয়ে গেলে তুমি আমাকে দোষ দিবে না তো? তখন বলবে না তো ইউরোপ নয়, আমাদের মিলনটাই জরুরি ছিল?’
মরশুমের চেহারার সজীবতাই যেন হারিয়ে যায়। ‘তুমি এমনটা বলতে পারলে? তোমার অনুমতি না নিয়ে আমি কি কোনো সিদ্ধান্ত নেবো?
‘হুম।’ রিতুর অস্থিরতা কমে। ওকে শান্ত দেখায়।
অতঃপর দুজনই সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়।