কিশওয়ারের জন্য প্রতীক্ষা ও অন্যান্য । মঈনুস সুলতান
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ১১:৫৭ অপরাহ্ণ, | ১৫৬৭ বার পঠিত
আয়না থেকে উঠে যাচ্ছে পারা
শিশুটি তোমার বড় হবে আমার অনুপস্থিতিতে
কিছুদিন নিমগ্ন ছিলাম যুগলে — মনে আছে
ব্লুগ্রাসের বিদগ্ধ গীতে
বাচ্চাটি বিছানায় ছোটাবে নীলসবুজ রেসকার
মেঝেতে ছড়ানো থাকবে
প্লাস্টিকের আনুবীক্ষণিক ডাইনোসর
কথা হয়েছিল — চিমনি-রকের কাছাকাছি
বনানীর ছোট্ট কটেজে আমরা বাঁধব ঘর।
শর্ট স্কার্ট পরেছিলে তুমি — ঝরাপাতার মোটিফে চিত্রিত
টপের ব্রোচে ঝলমল করছিল রূপালি প্রজাপতি
তোমার বুককেস থেকে নিরলে সরিয়ে নেব
আমার বইপত্র-দিনপঞ্জিকাতে ধৃত ভাবনার নথি
পার্সের ছোট্ট আয়নায় তুমি আঁখিতে বুলাবে
বনানীর সবুজ মাসকারা
ড্যাফোলব্যাগ গোছাতে গোছাতে
দেখব কাউন্টারের আয়না থেকে উঠে যাচ্ছে পারা।
শেষবারের মতো আমরা বাজাব টেইলার সুইফটের সিডি
নিকেশ করে লেনদেন — স্মৃতি হবে তোমার সহিষ্ণুতা অপার
ইউ নো, “উইআর নেভার, এভার, গেটিংব্যাকটুগেদার”
ভিন্ন সরণিতে হাঁটব আমি অজানা ভাষায় পড়ব বইপত্র
দেখব শিশিরে স্নাত হয়ে
গোলাপের পাপড়িতে টলমল করছে জলসত্র।
হারিয়ে মানচিত্র
আরশিতে দেখি আমার অক্ষিগোলকে
জমছে স্ফটিকের বিন্দু — ছড়াচ্ছে রূপালি আভা,
ঝরাপাতার উপর দিয়ে হাঁটে আবির-মাখা সাপ
খোয়াবের মাউন্ট-মিরাপিতে উদ্গীরণ হয় লাভা।
নিদ্রায় শুনি পুলিশের বেফজুল বিভ্রান্ত বাঁশি
তীর্থযাত্রীরা তুষার পাড়ি দিয়ে পৌঁছে হরিদ্বার,
প্রত্যাশার নীলগিরিতে নামে পাথরের ধ্বস
উচ্চাশার থার্মোমিটার ভেঙে পারদ হয় ছারখার।
আমার ভেতরে জমে রাজ্যের বিভ্রান্তি
অবগাহনে আমার অশ্রু ছোঁয় পুকুরের শাপলা,
মাউন্টেনবাইক কর্দমে দাগ কেটে এগোয়
হারিয়ে মানচিত্র সড়কের বাঁকে থামে পথচলা।
রোদের তরুণ সয়লাবে আমার অশ্রু হয় বাষ্প
মেঘের পরমাণুতে মিশে জুড়ায় স্নায়ুর ক্লান্তি,
স্বাতী নক্ষত্র প্রতিফলিত হয় আসমানী তুষারে
সুমাত্রার মন্দিরে সন্ন্যাসীরা জপে শান্তি-রস্তু-শান্তি।
বৃষ্টি হই আমি, ছুঁই আবার পৃথিবীর পাললিক মৃত্তিকা
ঝরাপাতার পুষ্টিতে জমিনে ফোটেব অর্কিডের কুসুম,
ফিরে আসি — তসবিরের রেখায় হয় রঙের বিবর্তন
বৃক্ষ বাড়ে — নীড়ের ডিমে বসে মা সারস ছড়ায় উম।
কিশওয়ারের জন্য প্রতীক্ষা
রাশিচক্র অতিক্রম করে বিকালের দিকে আগুয়ান হয়ে
সুরুজ হয়েছে পেরেশান
কিনব্রিজ থেকে আমি নেমে আসি পায়ে হেঁটে
ঠেলাগাড়িতে মুরগির খাঁচার পাশে টুকরি-ভরা ইন্দ্রশাইল ধান
সারাসকাল আমার কেটেছে পুঁথিপত্রে জারিগান ঘেঁটে
রিক্সায় ফিরোজাবর্ণের ওড়না-জড়ানো এক কন্যা
ছড়িয়ে যায় পেট্রার দগ্ধদিল সুরভি
প্রতীক্ষায় জেরবার হয়ে সড়কের বাঁকে এসে দাঁড়াই
ফটোস্টুডিওর কাচের দেয়ালে দেখি —
রাজাসাহেবের সাথে মৌলানা ভাসানীর ছবি।
হেঁটে হেঁটে চলে আসি চান্নিঘাটের সিঁড়িতে
কিনার বেয়ে ভেসে যায় নৌকা — দাঁড়ের ছলাৎছলাৎ আওয়াজ
আলী-আমজদের ঘড়ির কাঁটা আটকে আছে বেলা বারোতে
শব্দের ছাকরবন্ধ কিশওয়ার এখনো এল না তো আজ
সারদা হ্যলের ছাদ মশগুল হয়ে আছে জালালী পারোতে।
এল না তো কিশওয়ার —
বাঁধছে কী সে নিরালায় বসে বাক্যের চৌচালা ঘর
কিছু কথা — চাঁপা-রঙিন কিছু ব্যথা কখনো পত্রিকায় হবে না ছাপা
নিরালা রেস্তোরাঁর জানালার পাশে বসে শুনব ফেরিআলার কণ্ঠস্বর
মননের সিদ্ধ জলে কল্পনার পিঠা হবে না তো ভাঁপা।
রঙমহলের দেয়ালে সাঁটা বাইস্কোপের স্থিরচিত্র দেখে
টঙ থেকে আবগারি তামাক কিনে যাব মানিকপীরের টিলাতে
আধভাঙা রেকর্ডের বিক্ষত পিন স্মৃতির লালিত রাগ যায় এঁকে
মাজারের বেহাগ মর্মরিত বনস্পতির ডালে ঝিমাচ্ছে কী বুড়ো ধনেশ
সংশয়ের ভিজে আলোয়ান শুকাতে দিয়ে কাঁপছি
দোলাচলের লীলাতে
লাল শালুর গিলাফ জড়িয়ে নিশিভর জিকিরে কারা করে অভিনিবেশ।
নদীজলে কটনউড বৃক্ষের সোনালি ছায়া
সারাদিন — যেখানেই যাই না কেন
যে পাহাড়ে করি সাহসী হাইক
অজানা হ্রদে খুঁজি চক্রবাক
যে ট্রেইলে হাঁকাই না কেন মাউন্টেনবাইক
ফিরে আসি অপরাহ্ণে রিও-গ্র্যান্ড নদীটির তীরে
পাড়ে একসারি কটনউডের গাছ
অটামের সোনালি পত্রালির ছায়া ভাসে
তার বহতা নীরে।
ফিরে আসি নদী ও বৃক্ষের নিরালায়
নীলিমা মুখরিত হয় চক্রাকারে ওড়া চিলে
কটনউডের সরণিতে হাঁটি আনমনা
দেখি — ঝরাপাতা ভেসে যায় স্বচ্ছ সলিলে।
ভাটিতে সাংগ্রে-ডে-ক্রিস্তো পাহাড়ের
শিলাপাথরে-গড়া নাজারাতের গির্জার ইমারত
অপরাহ্ণের আলো পড়ে দীর্ঘ ছায়ায় উদ্ভাসিত হয়
ক্রুশ-কাঁধে যিশুর অন্তিম যাত্রাপথ।
রিও-গ্র্যান্ডের পাড়ে বসে আমি আজ
রূপার চামচে করি
ক্যাক্টাস-নিঙড়ানো পেওটি সেবন
নদী ও পাহাড়ের পূরাতাত্তি¡ক অবয়বে
আঁকা হয় বিবলিক্যাল ফ্রেস্কোরাজি
আমার করোটিতে তৈরি হয় মন্সটারি — দিব্য তপোবন।
ক্যাক্টাসের মায়াবি নির্যাস ছড়িয়ে যায় শরীরে
স্নায়ুতন্ত্রে হয় তা ক্রিয়াশীল
বেলা যায় — বুকের পাঁজরে নেমে আসে আকাশ
গোধূলি ছড়ায় লোহিতে থোকা থোকা নীল।
নদীটি সাঁঝের বর্ণিল আভায় সেরে নেয় প্রসাধন
পরে সে বিয়ের কনের জলজ রূপালি গাউন
পাশে কটনউডের বৃক্ষগুলো
ব্রাইড মেইড সেজে ছড়ায় সোনালি আগুন
তারা উঠে যায় কল্পিত নাজারথের গির্জায় —
ফুলের সাঁজি হাতে দাঁড়ায় বেদির সিঁড়িতে
বিয়ের মহড়া চলে — তৈরি হয় প্রতিশ্রুতির খসড়া
দিব্য বরের প্রতীক্ষায় ইঞ্জিল-শরিফ হাতে
আমি বসে থাকি মেহগিনির পিঁড়িতে।
অপরাজিতার নীল রোদে রাগভূপালি
আমার পৃথিবী জুড়ে ফুটেছিল একদিন
অজস্র অপরাজিতা — থোকা থোকা নিখাদ নীল,
শিরদাঁড়া সোজা করে বেরিক্যাড দিয়েছিলাম
বেঈনসাফের পথপরিক্রমায়
অসহিষ্ণু শদ্দাদের হুকুম করিনি তামিল।
ছেড়েছি ঘর একদিন, খুঁজেছি নীলিমা
স্নোরক্যাল পরে করোটিতে —
জলতলে ছুঁয়েছি সমুদ্রের প্রবাল,
আমাজনের বহতা তীর বিছারি খুঁড়েছি মাটি
বেরিয়ে এসেছে পর্তুগিজ পাইরেটদের গড়া ক্যাথিড্রাল।
পরিযায়ী হওয়া হরিণের পিছু পিছু গিয়েছি হেঁটে
মুস প্রজাতির বিপুল শিংগাল মুখ ডুবিয়েছে ঝিলে,
পিঁপড়ার সামনে রেখেছি শর্করা-মেশানো ককোর প্রলোভন
সৃজন করেছি সহমর্মী রহম এ-দগ্ধদিলে।
বসেছি রেলগাড়ির জানালায়
জলমগ্ন ধানের ক্ষেত — আলেশাদ বক
ব্যাঙাচির সাঁতারে কেঁপেছে তালগাছের স্থির ছায়া,
ভেবেছি একদিন তর্জমা করতে শিখব
নিসর্গের মরমি তসবি ধরে রাখে কী যে মায়া!
মন্দিরের আঙিনায় শিশিরভেজা শিউলি কুড়িয়ে
উঠে দাঁড়িয়েছে কিশোরী — হাতে তার নৈবেদ্যের থালি,
আমার হৃদয়সায়রে মেঘনা কুলকার্নি একদিন
গেয়ে উঠেছিল বিদুর তানপুরায় রাগভূপালি।