জীর্ণ-মায়া । মোহছেনা ঝর্ণা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ ডিসেম্বর ২০১৭, ১১:২৩ অপরাহ্ণ, | ১৪৮৭ বার পঠিত
খুব ছোটখাটো বিষয় নিয়েও ইদানীং সায়ানের সাথে আমার ঝগড়া লেগে যায়।আমার মনে হয় সায়ান বদলে গেছে। সায়ানের মনে হয় আমি বদলে গেছি।আসলে আমরা দুজনেই বদলে গেছি।কেউ কারো কথা শুনতে রাজী নই। দুজনেই বলতে চাই। আর দুজনেই বলতে চাইলে তো সমস্যা হবেই। আমাদের ও হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিন ই ঝগড়া হয়।ঝগড়াটা মূলত শুরু হয় রাতে। রাতে শুরু হওয়ার কারণ হচ্ছে সারাদিনে রাতেই আমাদের কিছু সময় থাকে। খুব সকালেই সায়ান চলে যায় অর ব্যবসার কাজে। নতুন একটা ব্যবসা দাঁড় করানো বেশ ঝক্কির ব্যাপার। আর ঘর সংসার সামলে এনজিওতে পার্ট টাইমে একটা চাকরী করি আমি।। বলা যায় দুজনেই ব্যস্ত থাকি দিনভর। তাই হতো দিনের সময়টাতে ঝগড়া হয় না।
সায়ান আমার সাথে এখন আর আগের মতো সব কথা বলে না। লুকোচুরি করার চেষ্টা করে। যেহেতু মানুষটাকে আমি অনেকদিন ধরে চিনি তাই তার লুকোচুরির ব্যপারটা আমি ধরে ফেলতে পারি।
আমি পায়েল। সমাজ উন্নয়নের জন্য কি অক্লান্ত চেষ্টাটাই না আমার বন্ধুদের সাথে আমি করে যাচ্ছি । আমার সহকর্মীদের সাথে আমি যখন বিভিন্ন রূরাল এরিয়াগুলোতে ভিজিটে যাই ,তাদের সঙ্গে যখন আমি তাদের একজন হয়ে কথা বলি ওরা আমার খুব প্রশংসা করে বলে আমি নাকি জীবনে অনেক উন্নতি করতে পারব। অনেকে তো বলে পায়েল ম্যাডাম মাটির মানুষ। সব পরিবেশে খাপ খাওয়াতে পারে।ওদের কথা শুনতে আমার ভালো লাগে।
কিন্তু মানুষ হিসেবে নিজেকে আমি খুব একটা উঁচু মানের দাবি করতে পারি না।
গতকাল রাতের ব্যাপারটা যে এতো খারাপ পর্যায়ে চলে যাবে সত্যি আমি ভাবতে পারিনি।
ও প্রথম দিকে কিছুক্ষণ সময় চুপ করে ছিল।পরে আসল রূপটা আর আড়াল করতে পারেনি।
শেষ মুহুর্তে রাগ করে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া ওর রাগের স্বাভাবিক লক্ষন। তারপরও প্রতিবার ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে আমি তাকে আটকানোর চেষ্টা করতাম।যদিও বরাবরই তা ছিল ব্যর্থ চেষ্টা।
আমরা কতোদিন বাঁচব , বলোতো? বড়জোড় ষাট বছর। বত্রিশ বছর তো কেটেই গেল। আজ সারাদিন অফিসে বসে বসে অনেক ভাবলাম এবং ভেবে ঠিক করলাম জীবনের বাকি আটাশ বছরও কষ্ট করে হলেও আমি তোমার সংগেই থাকবো। সায়ান মজার ছলে বললেও শেষের কথাগুলোতে কেমন যেন আবেগ উছলে পড়ছিল। ঠিক প্রথম দিককার মতো। আমি পুনরায় ধরাশায়ী হই। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। ঢোক গিলতে গিয়ে বুঝি সেখানেও কোনো কিছু এলোমালো আচরণ করছে।জীবনটা আবার খুব সুন্দর হয়ে ধরা দিতে চায়। বাঁচতে ইচ্ছে করে আরো অনেকদিন, অনেক বেশি দিন, অনেক বেশি বেশি দিন…।
ডিভোর্সের কথাটা যেদিন প্রথম এল আমাদের মাঝে আমি কিছুক্ষণ থ হয়ে সায়ানের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এই শব্দটা আমাদের মধ্যে আসতে পারে আমি এটা বিশ্বাস ই করতে পারছিলাম না। কিন্তু যেদিন ও আমার মোবাইলে ম্যাসেজ করে পাঠিয়েছিল যে ও ডিভোর্স চায়, আমাদের দুজনের ভালোর জন্যি নাকি এটা প্রয়োজন, কারণ আমরা আসলে একসঙ্গে থাকলে কখনও সুখী হতে পারব না, কারন আমাদের দুজনের চিন্তা ভাবনা সম্পুর্ণ আলাদা, তাই আমাদের নিজেদের ভালো থাকার সবচেয়ে ভাল উপায় হচ্ছে আলাদা হয়ে যাওয়া।
মনে আছে সেদিন আমি ট্রেনে করে সকাল বেলায় আমার অফিসের কাজে যাচ্ছিলাম। ওর ম্যাসেজট পড়ে সারাটা পথ আমি শুধু কেঁদেছিলাম। মনে হচ্ছিল আমি কিভাবে থাকব ওকে ছাড়া। ওই বা কিভাবে থাকবে আমাকে ছাড়া।আমি ছাড়া কে বুঝবে ওকে?
এক সপ্তাহের ট্রেনিং ছিল। এই এক সপ্তাহ আমি ওকে একবারও ফোন করিনি।অথচ সারাক্ষণই মোবাইলটা হাতে নিয়ে বসে থাকতাম। মনে হতো এই বুঝি ও ফোন করবে। পরে অবশ্য সায়ানই ফোন করেছে। আমি ওর গলা শুনে বুঝেছি ও ভালো নেই।আমি রাগ ধরে রাখতে পারিনি। এখন মনে হচ্ছে সেটা আমার ঠিক হয় নি। গতকাল অবশ্য ডিভোর্সের কথাটা আমিই তুলেছি। ও যখন রাগ করে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল আমি ওকে আটকানোর চেষ্টাও করিনি। আবার যখন ঘন্টা দুয়েক পরে ফিরে এলো তাতেও অবাক হইনি।
সারারাত দুজন একই বিছানায় পাশাপাশি শুয়েছিলাম। অথচ দুজনেই ভাল বুঝতে পারছিলাম আমরা অনেক দূরে সরে গেছি।
সকাল বেলা ও যখন ওর জামা কাপড় গুছিয়ে ব্যাগে ভরছিল আমার বুকটা হঠাৎ একটা ভয়ে ধক করে উঠলেও আমি খুব স্বাভাবিক আচরণ করছিলাম, যেন এমটাই হবার কথা ছিল।
আমি আর অফিসে গেলাম না। সহকর্মী রাজু ভাইকে ফোন করে বললাম, শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। কাজে আমি কখনো ফাঁকি দেই না দেখে অফিসে আমার অবস্থানটা বেশ ভাল।
শুধু পারিবারিক জীবনটাই ভাল হতে পারল না। জীবনটা শুধু সায়ান কে নিয়ে হলে হয়তো এই সমস্যা গুলো কষ্ট হলেও কাটিয়ে উঠা যেতো। কিন্তু জীবনটা তো শুধু সায়ানকে ঘিরে না । সায়ানের সাথে জড়িয়ে আছে আরও অনেকগুলো মানুষ। যাদের সাথে আমার যোজন যোজন দুরত্ব।
একটা ভিন্ন পরিবারের মানুষ আরেকটা ভিন্ন পরিবারে গিয়ে পুরোপুরি তাদের মতো হয়ে যাবে এমন আশাটা হয়তো অন্যায় নয়,তবে আশারও একটা লাগাম থাকা উচিৎ। মানুষ সাপ না। যে ছয় মাস পরপর খোলস পাল্টাবে।আবার খোলস যদি পালটে যায়ও কিছু ভেতরট কি পালটাবে? প্রতিটা মানুষ বেড়ে ওঠে আলাদা সত্ত্বা নিয়ে। সেই সত্ত্বা কি এতই ঠুনকো যে কেউ বলল আর তা বদলে গেল রাতারাতি। আমিও বদলাতে পারলাম না। অন্যভাবে বলতে গেলে বলা যায় আমি বদলাতে চাইলাম না। প্রিয় কারো জন্য নিজেকে বদলে নেয়ার মধ্যে আলাদা কিছু সুখও থাকে। কিন্তু এখানে আমার পরিবর্তনটা মূল্যায়ীত হোতো অবধারিত হিসেবে। যার তার কথা ভেবে নিজেকে, নিজের সত্ত্বাকে আমি এত অনায়াসে বদলে দেব এতখানি নির্বোধ আমি এখনো হইনি।
সায়ান কখনোই ঘর-সংসার, আপনজন নিয়ে অহেতুক মাতামাতি করা টাইপের ছেলে ছিল না। আমিত্ব জাহির করার বিষয়টা ওর ধাতে নেই। ওর আচার-আচরণ,পোশাক আশাক চলন সই। কিন্তু দশে দশ পাবার মতো না। ছোটখাটো গড়নের মানুষ। তাই বলে আবার বাট্টুসদের দলে ফেলা যাবে না।খুব পড়ুয়া টাইপের ছেলে ছিল। ছিল বলা ঠিক হচ্ছে না। কারণ এখনো পুরনো এই একটা বিষয়ই ও ধরে রেখেছ। সেই পড়ুয়া মানুষটা যখন আমার সাথে কোনো বিষয় নিয়ে চালাকি করতে চায় কিংবা আমাকে না জানিয়ে অনেক বড় কোনো সিদ্ধান্তে চলে আসতে পারে তখন মন খারাপের পাশাপাশি আমি খুব অবাকও হই, একটা মানুষ এতটা বদলে যায় কিভাবে!! ঘর-সংসার বৈরাগী বোহেমিয়ান মানুষটি আমাকে বাদ দিয়ে ঘরের মায়ায় আচ্ছন্ন হয় কিভাবে!!
কতদিন আমরা একসংগে কোথাও বেড়াতে যাই না। অথচ আগে আমরা প্রায়ই বলতাম ,আমাদের যদি সংসার সামলে একটুখানি সামর্থ্যও তার পুরোটাই ব্যয় হবে ঘুরে ঘুরে।প্রথমে চোখ মেলে দেখব পুরো দেশটাকে। দেশের ৬৪ জেলায় যাব।আনাচে–কানাচে ছড়িয়ে থাকা প্রতিটা সৌন্দর্য দেখব। দেখব রক্তরাঙ্গা ভোর, স্নিগ্ধ সকাল,উত্তপ্ত দুপুর, বিষন্ন বিকেল,কনে দেখা আলোর প্রহর, মায়াবী সন্ধ্যা, আর আঁধারে নিমজ্জমান রহস্যে ঘেরা রাত। দেখা হয়নি চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে দু’পা বাহিরে ফেলিয়া জাতীয় কোনো আক্ষেপ আমরা আমাদের এই ক্ষুদ্র জীবনে রাখবনা এমন এক কঠিন সংকল্প ছিল আমাদের। তখন আমাদের আর্থিক দৈন্যতা ছিল। তাই বলে এখন যে খুব বেশি সছ্বল তা কিন্তু নয়। দৈন্যতা কেটেছে, আবার বেড়েছেও। আর্থিক দৈন্যতা কেটে মানসিক দৈন্যতা বেড়েছে। তার মানে আমরা এখনো আসলে দৈন্যই রয়ে গেছি। আমরা আমাদের পছন্দের জায়গাগুলোর একটা তালিকা করলাম। দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দির, বগুড়ার মহাস্থান গড়, সোমপুর বিহার, লক্ষিন্দরের বাসর ঘর, কুষ্টিয়ার লালনের আখড়া, শিলাইদহ কুঠিবাড়ি, রংপুরের পায়রাবন্দ গ্রাম, কুমিল্লার লালমাই পাহাড়। তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। সায়ান আর আমি প্রতিদিন সেই তালিকাটা হাতে নিয়ে নামগুলো পড়তাম আর নতুন নতুন স্থানের নাম যোগ করতাম। এইযে একটা স্বপ্ন খেলে যেত আমাদের চোখের মনিতে তাতেও ভীষণ রকম সুখ ছূঁয়ে যেত আমাদের।বন্ধুদের সাথে একবার আমি ময়নামতিতে গিয়েছিলাম। তখনো সায়ানের সাথে পরিচয় হয়নি। দুপুরের কড়া রোদে লালমাই এর লালরূপ কিংবা বৌদ্ধবিহারের খোপ খোপ ঘর যেগুলো অনেকটা কবরের মতো নিচের দিকে বড় বড় গর্ত তার কোনো রূপই ঠিক সেভাবে ধরা পড়ছিল না চোখে। শুধু মনে হচ্ছিল কিছু একটার মায়া এখানে আছে। পড়ন্ত বিকেলের দিকে ফিরে আসার আগ মুহূর্তে আবার যখন গেলাম খাঁড়া পাহাড়গুলো দেখতে চোখ যেন আটকে যাচ্ছিল। খাঁজকাটা পাহাড়্গুলো চারপাশ থেকে লাল দ্যুতি ছড়িয়ে সে এক অপার্থিব সৌন্দর্য। আমার মুখ থেকে আলটপকা বেরিয়ে গেল,এত সুন্দর! উফ্ কি অসহ্য সুন্দর!পাশে থাকা বন্ধু বীণা আর সৈকত বলেছিল,তোর খুব পছন্দ হয়েছে না? এ কথা জজ্ঞেস করার কারণ ছিল, আমার খুব প্রিয় বিষয়গুলো আমি সবসময় আলাদা করে টুকে রাখতাম। সুযোগ পেলে এইসব প্রিয়ের কাছে আমি আসব বারবার। সায়ানকে যখন লালমাইয়ের অপার্থিব রূপের কথা বলেছিলাম ও বলেছিল এরপর আমরা একসংগে যাব।সায়ান আমাকে নীলিগিরি আর চিম্বুক পাহাড়ের কথা বলেছিল। বলেছিল স্বর্ণ মন্দিরের কথা। আমাদের দেখা হয়নি কিছুই।দূরে কোথাও বাদই দিলাম।সমুদ্র আমার এত প্রিয়! আমার ঘরের পাশেই আছে পতেংগা সমুদ্র সৈকত।অথচ মনে হয় এই সমুদ্র দেখতেও আমাকে পাস্পপোর্ট ভিসার জন্য ট্রাভেল এজেন্সীর অফিসে ছুটতে হবে।
অনেক বছর আগে একদিন তীব্র মন খারাপের মুহূর্তে সায়ানের সাথে গিয়েছিলাম সমুদ্র দেখতে। আমরা বসে ছিলাম একটা এবড়ো থেবড়ো পাথরের উপর।অনেকক্ষণ বসে ছিলাম।এর মধ্যেই হঠাৎ হঠাৎ দমকা ঢেউ এসে আছাড় খেয়ে পড়ছিল পায়ের উপর।পায়ের তলা থেকে বালুগুলো শিরশির করে সরে যাচ্ছিল কিন্তু খলি খালি লাগছিল না।ভাংগা গড়ার এই আজব খেলার কৌশলটা সমুদ্রের ঢেউয়ের মধ্যেই লুকিয়ে আছে কিনা কে জানে। মাঝে মাঝে পথশিশুগুলো এসে ঘ্যান ঘ্যান করছিল।প্রথম প্রথম ওদের জন্য মায়া হচ্ছিল। এরপর একটা সময় বিরক্তি লেগে উঠল। আমি বুঝতে পারলাম যেখান থেকে মায়ার শেষ, সেখান থেকেই বিরক্তির শুরু। এরপরও কয়েকবার পতেংগা বীচে গিয়েছি। তবে সেখানে আরও অনেকে ছিল। যাওয়াটাও তাদের জন্য। নিজেদের জন্য নিজেরা সমুদ্রের ঢেউয়ে পা ভিজিয়ে বসে থাকার মতো সময় আর আমাদের হয়নি। আমাদের বাসার এত কাছে শিল্পকলা একাডেমী আমার খুব ইচ্ছে হয় মাঝে মাঝে সায়ানকে নিয়ে ছবির প্রদর্শনীগুলো দেখে আসি। ইচ্ছেগুলো হয়না পূরণ। আর তখনই মনে হয়,আগেকার দৈন্যতা ঢের ভালো ছিল। মানসিকভাবে আমরা অনেক পরিপুর্ণ সমৃদ্ধ ছিলাম।
কিছুতেই মনে করতে পারছিনা শেষ কবে আমরা খুব আবেগীভাবে নিজেদের জন্য নিজেরা কিছু সময় কাটিয়েছি। কিংবা শেষ কবে প্রচন্ড ভালোবাসায় একে অন্যকে গভীরভাবে আলিংগন করেছি। আমরা একসংগে আছি রুটিনমাফিক জীবনের তাগিদে।যদি কখনো সায়ানকে বলি,তুমি এমন বদলে যাচ্ছ কেন? কিংবা আমরা?
সায়ান খুব সহজ করে খুব কঠিন একটা বাক্য বলে জবাবে। বলে,আমার কিংবা আমাদের এই বদলে যাওয়াতে তোমার ভূমিকাটা বোঝার চেষ্টা করো, উত্তরটা খুঁজে পাওয়া খুব খুব একটা কঠিন হবে বলে মনে হয় না।
মানুষের ভঙ্গুর সময়ে কেউ যখন শুধু একটু ভালোবেসে কথা বলে তাতেই আমার চোখে কৃতজ্ঞতায় পানি উছলে পড়তে চায়।আর যারা ভালোবেসে ঐ সময়টাতে মাথার উপর স্নেহের হাত, ভালোবাসার হাত, কিংবা সবকিছু উপেক্ষা করে ভরসার হাত রাখে তাদের কাছে তো আমার ঋনের কোনো সীমা পরিসীমা থাকার কথা না।
ঠিক একই ভাবে ভঙ্গুর সময়ে কেউ যখন কেবলই পরিহাস আস উপহাসটাকেই মূল্যায়নের মাপকাঠি বিবেচনা করে আমি তা ভুলতে পারি না। শিং মাছের কাঁটা যেমন হাতে ঢুকে ঘাঁই মারে সেসব দিনের দুঃখ জাগানিয়া স্মৃতিগুলো আমাকে শিং মাছের কাঁটার মতোই ঘাঁই মারতে থাকে।
সায়ান অকৃতজ্ঞ টাইপের মানুষ নয়। কিন্তু আমার দুর্বলতার জায়গাটাতে সে যখন নির্দয় আচরণ করে আবার পাশাপাশি আমার ঘাঁই এর জায়গাটাতে অনেক বেশি কোমল থাকে সত্যি বলতে তখনই আমাদের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়। আমার মনে হয় ও অকৃতজ্ঞ। আবার ওর মনে হয় আমি ট্র্যাডিশনাল স্বার্থপর।দিনে দিনে নাকি আমার মাঝ থেকে উদারতা শব্দটি হারিয়ে যাচ্ছে।
আমাদের মন খারাপের প্রহরগুলো বাড়তে থাকে। চন্দ্রবোড়া সাপের মতো ভেতরে ফোঁসফাঁস করতে থাকে গোপন দীর্ঘশ্বাস। তবু আমরা কিছুতেই এক বিন্দুতে স্থির হই না। এক প্রহর,দুই প্রহর করে কেটে যায় অজস্র প্রহর। আচমকা কি হয় কে জানে। মনটা কেমন হালকা হালকা লাগে। সাবানের ফেনার মতো ওজনহীন হালকা হয়ে ফুলে থাকে। রাতে না ঘুমানোর কারণে দিনভর যে সূক্ষ যন্ত্রণা তোলপাড় করে দিচ্ছিল করোটির ভেতরের মস্তিষ্ক নামক পদার্থকে সেটিও বেমালুম গায়েব হয়ে গেল। পুকুরে অনেকক্ষণ মনের আনন্দে সাঁতার কাটার পর যেমন একটা প্রশান্তি হয় আমি আমার ৬ ফিট বাই ১২ ফিটের গোসলখানায় প্রায় আধঘন্টা শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে সেই প্রশান্তির আবেশটুকু নিলাম।
আমার ভাল লাগছিল। আমি খুব স্বভাবিকভাবে আমার দৈনন্দিন কাজে মন দিলাম। আজকে একটু বেশি করে রান্নায় মনোনিবেশ করলাম। খুব অলপ সময়ে সাংসারিক কাজ সামলে নিয়ে আমার থিসিসের কাজগুলো নিয়ে বসলাম। আর মনে মনে হাসলাম,মানুষ খুব আজব প্রাণী।সব কিছু সামলে নিতে শুধু একটু সময় লাগে।
সন্ধ্যার পরপরই সায়ান বাসায় ফিরল। ও সাধারণত অনেক রাত করে ফিরে। আজ তাড়াতাড়ি ফেরার কারণেই হয়তো একটা লাজুক হাসি দিল।
ফ্রেশ হয়ে পেপার আর টিভির রিমোট হাতে নিয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে মুখে চাপা একটা হাসি ঝুলিয়ে বলল, তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম। ভেবে দেখলাম, ক্ষমার উপর কোনো ওষুধ নাই।
আমি কপালে ভাঁজ ফেলে ভ্রু কুঁচকে তাকাই।
সায়ান বলল,আমরা কতোদিন বাঁচব , বলোতো? বড়জোড় ষাট বছর। বত্রিশ বছর তো কেটেই গেল। আজ সারাদিন অফিসে বসে বসে অনেক ভাবলাম এবং ভেবে ঠিক করলাম জীবনের বাকি আটাশ বছরও কষ্ট করে হলেও আমি তোমার সংগেই থাকবো। সায়ান মজার ছলে বললেও শেষের কথাগুলোতে কেমন যেন আবেগ উছলে পড়ছিল। ঠিক প্রথম দিককার মতো। আমি পুনরায় ধরাশায়ী হই। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। ঢোক গিলতে গিয়ে বুঝি সেখানেও কোনো কিছু এলোমালো আচরণ করছে।জীবনটা আবার খুব সুন্দর হয়ে ধরা দিতে চায়। বাঁচতে ইচ্ছে করে আরো অনেকদিন, অনেক বেশি দিন, অনেক বেশি বেশি দিন…।
আমি এবং সায়ান আমরা খুব ভাল করেই জানি খুব শীঘ্রই আবার আমাদের ঝগড়া হবে।কারণ ঝগড়ার বীজতো উপড়ে ফেলার সাধ্য আমাদের নাই।আমাদের সাধ্য হচ্ছে সব কিছুর পরেও একসঙ্গে থাকা। সুখ-দুঃখের সারথী হওয়া।আমাদের সাধ্যের কাজটিই আমরা করছি।