শারদীয় দুর্গোৎসব । রীমা দাস
প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১২:০৬ পূর্বাহ্ণ, | ১৬০৬ বার পঠিত
.
নীল আকাশে সাদা পেঁজা তুলার মত মেঘ, ঝলমলে আকাশ, মায়াবি প্রকৃতি, ভোরে শিশির সিক্ত ঘাস, নদী ধারের কাশফুল আর শিউলি বিছানো পথ আমাদের মনে আনন্দের ঢেউ বইয়ে দেয়। এই আনন্দ আনন্দময় হয়ে ওঠে যখন মনে হয় ‘মা’ এর আগমনীর কথা। নিজের আবেগ প্রকাশে যেতে হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে, কারণ আমাদের সব আবেগ, সব অনুভূতি তিনি যেভাবে প্রকাশ করেছেন তাতে তাঁর কাছে না যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।
গোপনে এল, স্বপনে এল, এল সে মায়াপথেপায়ের ধ্বনি নাহি।ছায়াতে এল,কায়াতে এল,এল যে মনোরথেদখিন হাওয়া বাহি।অশোকবনে নবীন পাতাআকাশ পানে তুলিল মাথাকহিল,’ এসেছ কি’?
প্রকৃতি আর মানব আত্মা একসাথে বলে ওঠে — এসেছ কি? এই ধ্বনি হৃদয়ের অন্তঃস্থল হতে উৎসারিত, উচ্চারিত। ‘মা’ এর আগমনে স্বর্গ ও মর্ত্যে দোলা লাগে। সর্বত্র শোনা যায় এক তান, এক গান — এসেছ কি? অবশেষে তাঁর আগমনে দিকে দিকে বেজে উঠছে শঙ্খ ধ্বনি,কাঁসর, ঢোল। আনন্দময়ীর আগমনের এই উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসব নামে পরিচিত। এই পূজার অপর নাম ‘অকালবোধন’।
“অকালবোধন”কে ভাংলে আমরা দুটো শব্দ পাই। অকাল এবং বোধন। শব্দ দুটো তৎসম শব্দ থেকে এসেছে। অকাল শব্দের অর্থ অসময়/ শুভ কাজের অযোগ্যকাল/ অনুপযুক্ত এবং বোধন মানে জাগরণ/ উদ্বোধন/ নিদ্রাভঙ্গকরণ। দেবতাদের দুটো কাল। একটা দক্ষিনায়ন এবং অপরটি উত্তরায়ন। দক্ষিণায়ন দেবতাদের রাত। শ্রাবণ থেকে পৌষ এ ছয় মাস দক্ষিণায়ন। এই সময় দেবতারা ঘুমন্ত অবস্থায় থাকেন। মাঘ থেকে আষাঢ় এই ছ’মাস উত্তরায়ন। এসময় দেবতাদের দিন। শ্রী রামচন্দ্র শরৎকালের দক্ষিণায়নে দুর্গা পূজা করেছিলেন বলে এই পূজাকে “অকালবোধন” বলে। মহামায়ার এই নিদ্রা ভঙ্গের জন্য শারদীয় দুর্গা পূজায় “বোধন” পূজার একটি প্রারম্ভিক অনুষ্টান।
মায়ের আগমনি মানে সীমার মধ্যে অসীমকে পাওয়ার সাধনা, সুন্দরের সাধনা, আনন্দ ও অমৃত আহরণের সাধনা। বর্তমান সময়ে দেখা যাচ্ছে কিছু মানুষ অন্ধকার টেনে আনছে, আলো বন্ধ করতে চাচ্ছে। যারা অন্ধকারের চর, অসুন্দরের প্রতীক তারাই অসুর
শারদীয় দুর্গা পূজার শুরু হয় রামায়ন যুগে। রাক্ষসরাজ রাবণ শ্রীরাম চন্দ্রের স্ত্রী সীতাদেবীকে হরণ করে লংকায় নিয়ে যায়। রাবণের বন্দীশালা থেকে সীতাকে উদ্ধার করার জন্য শরৎ ঋতুতে দেবী মহামায়ার আরাধনা করেন রাম। রাবণ এবং মেঘনাদও মহামায়ার আরাধনা করতেন। ভগবান শ্রীরাম চন্দ্র ১০৮টি নীলপদ্ম দিয়ে দেবীর পূজার সংকল্প করেন। সব পদ্ম সংগ্রহ হলে রামচন্দ্র সেগুলো নিয়ে পূজায় বসলেন। মহামায়া তাঁর ভক্তের পরীক্ষা নিবেন ঠিক করলেন। এসময় তিনি রামচন্দ্রের একটি পদ্ম লুকিয়ে রাখলেন। পূজার মধ্যে একটি পদ্মের অভাব হওয়ায় শ্রীরামচন্দ্র বিপদে পড়লেন। রামচন্দ্র জানেন পূজা পূর্ণাঙ্গ না হলে দেবী সন্তুষ্ট হবেন না, তাঁর সংকল্পও সিদ্ধ হবে না। ধীর স্থির শ্রীরামচন্দ্র পূজার মধ্যে বসে ঠিক করলেন পূজা তিনি সম্পন্ন করবেন। তাই তিনি তার একটি চোখ মায়ের চরণে নিবেদন করার সিদ্ধান্ত নিলেন। শ্রীরামচন্দ্র পদ্মলোচন নামে অভিহিত ছিলেন। তিনি ধনুর্বাণ হাতে নিয়ে চোখ উৎপাটন করার সময় দেবী মহামায়া আবির্ভূত হলেন এবং তাকে অভীষ্ট বর দিলেন। আর শ্রীরামচন্দ্রের এই আত্মত্যাগে সন্তুষ্ট হয়ে দেবী দুর্গা রাবণ ও মেঘনাদকে ত্যাগ করলেন। এভাবেই প্রচলন হয় শারদীয় দুর্গোৎসবের।
.
হিন্দু পুরাণে আছে ভগবান ব্রহ্মা মহিষাসুর দৈত্যের কিছু ভালো কর্মকান্ডে সন্তুষ্ট হয়ে বর দিতে চেয়েছিলেন, মহিষাসুর অমরত্ব প্রার্থণা করেছিল। ব্রহ্মা সরাসরি অমরত্ব না দিয়ে বলেছিলেন — বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনো পুরুষের হাতে মহিষাসুরের মৃত্যু হবে না। ভগবান ব্রহ্মা, যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছিলেন তার কাছে এরকম বর পেয়ে মহিষাসুুর ধরাকে সড়া জ্ঞান করতে আরম্ভ করলো। সে ধরেই নিয়েছিলো যেহেতু নারীরা যুদ্ধে অপটু তাই সে হবে অপরাজেয় অমর। তার খুব ইচ্ছে হলো স্বর্গ জয় করার। সেজন্য সে স্বর্গ দখল করার জন্য দেবতাদের উপর অত্যাচার শুরু করে দিল। তার অত্যাচারে স্বর্গের দেবতারা অতিষ্ট হয়ে উঠেন। এভাবে মহিষাসুর স্বর্গ থেকে দেবতাদের বিতারণ করা শুরু করে। এরকম পরিস্থিতিতে দেবতারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব এই তিনজনের আহবানে দশভুজা নারীর আবির্ভাব হলো। আর এই দেবীর নামই দুর্গা। দুর্গা আমাদের মা, সন্তানের সুরক্ষাদায়িনী, সব অপশক্তি বিনাশিনী, মুক্তিদায়িনী, আনন্দময়ী। তাঁর দশ হাতে মরণাস্ত্র দিয়ে সুসজ্জিত করা হলো। শিব দিলেন ত্রিশূল, বিষ্ণু দিলেন চক্র, ইন্দ্র দিলেন তীর ধনুক, তরবারি,ঢাল, বিষধর সর্প, তীক্ষ্ম সর্প, শঙ্খ, বিদ্যুৎবাহী বজ্র,পদ্মফুল, কমন্ডুল এবং রুদ্রাক্ষ।
.
দেবী দুর্গা এবং মহিষাসুরের মধ্যে দশদিন ব্যাপী মহাযুদ্ধ হয়েছিল। মহিষাসুরকে পরাস্ত করা রীতিমত অসাধ্য হয়ে উঠেছিল কারণ সে মায়ার খেলা জানত। দুর্গাকে বিভ্রান্ত করার জন্য সে একেক সময় একেক জন্তু জানোয়ারের রূপ ধারণ করতে লাগল। মহিষাসুরের রক্তবীজ থেকে অসুরের জন্ম হতে লাগল। দেবী দুর্গা তখন ভয়ংকর রূপ ধারণ করে রক্তবীজ মাটি স্পর্শ করার আগেই লম্বা জিভ দিয়ে চেটে খেয়ে ফেলেন। আর এভাবেই রক্তবীজ থেকে অসুরের উৎপত্তি বন্ধ করলেন দেবী। যুদ্ধের দশম দিনে অসুর মহিষের রূপ নিল। দেবী দুর্গা তখন হাতের ত্রিশূল দিয়ে মহিষাসুরের বক্ষ্যভেদ করলেন।
.
‘দুর্গা’ এই নামের মধ্যে অনেক অর্থ, অনেক তাৎপর্য লুকানো আছে। “দুর্গা” শব্দের আভিধানিক অর্থ পরমাপ্রকৃতি, শিবপত্নী এবং একটি রাগিনী। “দুর্গা” যখন রাগিনী বিশেষ তখন এর ব্যুৎপত্তি : দুর- গৈ+অ( কর্মবাক্যে)+ আ( স্ত্রী লিঙ্গে)। এটি রাতের দ্বিতীয় -তৃতীয় প্রহরে গাওয়া হয়। এর ঠাট বিলাবল, জাতি ঔড়ব-ঔড়ব, আরোহ ও অবরোহে গা ও নি বর্জিত; বাকি স্বর শুদ্ধ। বাকী স্বর ধ ( মতান্তরে ম) এবং সম্পদী একমতে রে, অন্যমতে সা। এর প্রকৃতি চঞ্চল এবং অঙ্গ পূর্বাঙ্গ। রাগটির যুগপৎ চাঞ্চল্য ও সময়কাল লক্ষ করলে দেখা যায় এর মধ্যে একটি বহমানতা স্রোতস্বিনীর ভাব আছে। আমাদের দেবী দুর্গার প্রকৃত রূপ এখানে ফুটে ওঠে। এই বহমানতায় মনে হয় যে চাঁদের আলোয় নৃত্যপরায়না সে কোনমতেই প্রগলভা নয়। অন্যভাবে বলা যায় “দুর্গা” শব্দের ব্যুৎপত্তি : দুর- গম্ + অ( কর্মবাচ্যে)+ অ+আ (স্ত্রী লিঙ্গে)। এর অর্থ যাকে দুঃখে জানা যায়। আবার বলা যায় — যাঁকে স্মরণ করলে দুঃখ দূরীভূত হয়। আরেকটি অর্থে বলা হয়েছে “দুর্গ” নামক দৈত্যহন্ত্রী বলে তিনি দুর্গা। প্রতীক বা রূপকের আবরণের আড়ালে “দুর্গা” আসলে দুর্গতিই। ঋগ্বেদ (১।৪১।৩) এ আছে : ” বি দুর্গা বি দ্বিষঃ পুরো ঘ্রান্তি রাজান এষাম্। নয়ন্তি দুরিতা ভিরঃ।।” এই দুর্গার মাধ্যমে আমাদের সাধারণ মানুষের শতবিঘ্ন দূরীভূত হয়। দেবীর আরাধনায় আমরা কাঙ্খিত বর পেতে পারি।
.
সত্যযুগে রাজা সুরথ ও বৈশ্য সমাধি প্রথম চিন্ময়ী মায়ের মৃন্ময়ী মূর্তি বানিয়ে পূজা করেছিলেন। এই মূর্তিতে মায়ের দনুজদলনী ও বরাভয়দায়িনী রূপ প্রকট। ত্রেতাযুগে রাবণ চৈত্রমাসে দুর্গাপূজা করতেন। বসন্তকালে পূজিতা হতেন বলে দেবীর নাম ‘বাসন্তী’। বিশ্বকর্মা মায়ের মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মাণ করেন। দ্বাপরে দুর্গা পূজা করেছিলেন গোপকুমারীরা শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে পাওয়ার জন্য। আর এভাবেই দুর্গা ক্রমে ক্রমে লোকায়ত হচ্ছিলেন, মানুষের প্রাণের কাছে আসছিলেন। দ্বাপরযুগে দুর্গা হয়ে গেলেন প্রেমের দেবতা। কলিতে আমরা এই পূজাকে অকালবোধন বলি। আর আমরা জানি এটাই আমাদের আসল দুর্গাপূজা। প্রকৃতপক্ষে শরৎ ঋতুকে কখনই দেবীপূজার ক্ষেত্রে ‘অকাল’ বলা যায় না। কারণ শরৎ বিষুববিন্দুতে যেমন শারদীয়া পূজা হয়,তেমনই অপর এক বিষুববিন্দুতে বসন্তকালে হয় বাসন্তীপূজা। বছরের দুটি বিষুববিন্দুতে এই দুই দেবীপূজা স্মরণ করে দেয় দেবীপূজার মধ্যে জ্যোতিষতত্ত্বের বিশেষ এক লুপ্ত অধ্যায় নিহিত আছে।
.
শরৎকালে বাংলার ঘরে ঘরে পাঁচদিন ব্যাপী পালন হয় দুর্গোৎসব। মানবসভ্যতা ও কৃষ্টির মেলবন্ধনের এক অপরূপ মিলনোৎসব এই পূজা। ঘাসের বুকে শিশিরবিন্দু, উজ্জ্বল সূর্যের কিরণ, শিউলি কাশের দোলায় আমাদের মত প্রকৃতিও দেবীর আরাধনায় মত্ত হয়ে ওঠে। মহালয়ার পিতৃপক্ষের তিলাঞ্জলি তর্পনান্তে হয় দেবীপক্ষের সূচনা। সৌর আশ্বিনের কৃষ্ণপক্ষের নাম ‘মহালয়’। ‘ মহালয়’ শব্দ থেকেই ‘মহালয়া’র উদ্ভব। এই মহালয়ার পরই মা’য়ের আবাহনে দিগদিগন্ত মুখরিত হয়ে ওঠে। ষষ্ঠী তিথিতে দুর্গার বোধন, সপ্তমীতে মূর্তির মাঝে প্রাণ প্রতিষ্ঠা, অষ্টমী ও নবমীতে মহাপূজা এবং দশমীতে দেবীর নিরঞ্জন। এই পূজার বিশেষত্ব হলো সন্ধিপূজা। অষ্টমী ও নবমী তিথির মিলনক্ষণে হয় এই সন্ধিপূজা। এর সময়সীমা আটচল্লিশ মিনিট। অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে রামচন্দ্র রাবণের দশটি মুন্ডু ছিন্ন করেছিলেন, তাই এই সময়ে পূজার মাহাত্ম্য বেশি। শুধু তাই নয় সন্ধিপূজার এই ক্ষণে নিজের আসুরিক প্রবৃত্তি বলি দিয়ে মানুষ হয়ে ওঠে নতুন সূর্যালোকের নিষ্পাপ আলোর মত। এই বলির তাৎপর্য নিজের ভেতরের পশু প্রকৃতিকে দেবীর চরণে নিবেদন করে নতুন মানুষ হওয়া।
.
মায়ের আগমনি মানে সীমার মধ্যে অসীমকে পাওয়ার সাধনা, সুন্দরের সাধনা, আনন্দ ও অমৃত আহরণের সাধনা। বর্তমান সময়ে দেখা যাচ্ছে কিছু মানুষ অন্ধকার টেনে আনছে, আলো বন্ধ করতে চাচ্ছে। যারা অন্ধকারের চর, অসুন্দরের প্রতীক তারাই অসুর। এই অসুররাই বিভিন্ন ভাবে আমাদের ক্ষতি করে চলছে। শুধু তাই নয়, মনের ভেতরেও অসুরের দাপাদাপি আছে। হিংসা, ঈর্ষা, মাৎসর্য, লোভ, মোহ ইত্যাদির রূপ ধরে এই আসুর সত্তা নিয়তই আমাদের অসুখী করে তুলছে। এসব থেকে মুক্তি পেতে আমরা শরণ নেই। অসুরের বিনাশে আসে সুখ, অত্যাচারী বিনষ্ট হলে আসে কল্যাণ, অন্ধকার দূর হলেই আসে আলোর উদ্ভাস। সেই আলোর উদ্ভাস ঘটুক আমাদের সবার জীবনে, প্রাণে।
” প্রণতানাং প্রসীদ ত্বং দেবী বিশার্তিহারিণিত্রৈলোক্যবাসিনামীড্যে লোকানাং বরদা ভব”।
— হে বিশ্বার্তিহারিণি দেবী, আমরা তোমার কাছে প্রণত, তুমি প্রসন্ন হও; ত্রিলোকের সমস্ত অধিবাসীর কল্যাণে তুমি বরদাত্রী রূপে প্রকাশ পাও।।