মেয়েটি যাকে চিঠি লিখেছিল । মাদল হাসান
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১১:২৫ পূর্বাহ্ণ, | ১৬৫০ বার পঠিত
আজ শুক্রবার। মেহরাবকে আজ শান্ত-মারিয়ম-এ যেতে হবেনা। না। সে শান্ত-মারিয়ম-এর কোনো ছাত্র নয়। তবে একসময় ছিল। অনার্স-মাস্টার্স দু’টোতেই ফার্স্টক্লাশ পেয়ে এবং উত্তরা এগারো নম্বর সেক্টরে বাড়ি থাকবার কারণে সহজেই সে এই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হ’তে পেরেছে। সে একইসঙ্গে ফ্যাশন ডিজাইনে-এর ছাত্র এবং শিক্ষক। এখন সে বুটিক নিয়ে কাজ করছে। নিয়মিত আজিজ মার্কেটে যাতায়াত কওে এবং ফ্যাশন হাউজ করতে চায় এমনদের সঙ্গে যোগাযোগটা বজায় রাখে। সে বেশ কয়েকটা ফ্যাশন শো-র সর্বকনিষ্ঠ বিচারকও ছিল। কথায় বলে, বেশি মাছ দেখলে বক কানা হয়। তাঁরও সেই দশা। সারাক্ষণ ফ্যাশন শো, ফ্যাশন শো, রানওয়ে, ফ্যাশন পত্রিকা এবং সেসবের প্রধান উপজীব্য নানা ঢঙের নারীদের দেখতে দেখতে সে এখন নারীদেও প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছে। যেনবা সে যা চায়, তা কারো মধ্যেই নেই। তাঁর ভাবনা হয়, ‘মানসী’কাব্য লেখার অব্যবহিত পূর্বে রবীন্দ্রনাথেরও এমন দশা হয়েছিল কিনা? কিংবা অগ্যস্ত মুণিও কি এমন এক হতবিহ্বল অবস্থাতেই সর্বপ্রাণীর শ্রেষ্ঠ অঙ্গেও সমবায়ে এক নারীকে কল্পনা ক’রে অন্যের ঔরশে লোপামুদ্রাকে জন্ম দিয়ে পওে তাঁর পাণিপ্রার্থী হয়েছিলেন? হ’লেও হ’তে পারে। তবে মেহরাব হোসেন চায় এমন কাউকে, যে তাঁকেই আগে প্রস্তাব দেবে। তাঁর পিছে ঘুর ঘুর করবে। তাঁকে চিঠি লিখবে। কেননা, তখন এমন সময়, যখন বাজারে মোবাইল আসেনি।
প্রতিনিয়তই মেহরাবের মনে হ’তে থাকে, তাঁকে কেউ চিঠি লিখবে। শান্ত-মারিয়মের নারী-কলিগরা নানারকম কেয়ারলেস হুইসপারিং করে। ছাত্রীরাও কম যায়না। অন্যরা দেধারছে ডেটিং করছে, কিন্তু তাঁর বেলায় সবারই যেন বিয়ের ভাবনাই প্রধান। বেশ কয়েকবার সে-ও কাউকে কাউকে নিয়ে কুপারসে আড্ডা দিয়েছে। কিন্তু কারো সঙ্গেই শেষ পর্যন্ত প্রেমে গড়ায় নি। যেন বা প্রেম নয়। প্রেম প্রেম ভাব। আর মেহরাবের খালি মনে হ’তে থাকে, এই বুঝি নীল খামে-ভরা চিঠি আসবে। বাড়িতে ছোটো বোন, বড় ভাইয়ের চিঠি আসে। মা-বাবার নামেও চিঠি আসে। সে চিঠি যাঁরই হোক। চিঠি তো চিঠিই। সব চিঠিই তো আসলে প্রেমের চিঠি। আর প্রেম মানেই তো গুরুত্ব দান। যে যাঁর কাছে চিঠি লেখে, সে-তো তাঁকে গুরুত্বই দেয়। তাই মেহরাব নিজেকে গুরুত্বহীন ভাবতে থাকে। চাকরির ইন্টারভিউ কার্ড এবং অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার ছাড়া আজ পর্যন্ত কোনো চিঠিই সে পায় নি কারো কাছ থেকে। তাই আজ জুমার নামাজ শেষে রিকশা চেপে রওনা দিলো হাউজ-বিল্ডিং-এর দিখে। মাস্কট-প্লাজার পিছনে, কাবাব ঘরের পাশে, ‘হৃদিকুঞ্জ’-নামে একটি ছোট্ট বই ও স্টেশনারি দোকান। মেহরাব মুচকি হেসে দোকানিকে বলে, খাম দেন তো। এই দোকানির নাম হৃদয়। তাঁর বোনের নাম হৃদি। সেই থেকে দোকানের নাম ‘হৃদিকুঞ্জ’। তাঁরা থাকে আসকোনার দিকে। লোকটার সঙ্গে মেহরাবের হাসি-বিনিময়ের সখ্য গড়ে উঠেছে। হৃদয় মেহরাবকে ‘স্যার, স্যার’ ব’লে ব্যাপক ভক্তি দেয়। মেহরাবও মাঝে-মধ্যে কলম, মার্কার পেন, ডায়েরি এটা-সেটা নেয়। আজ খাম চাওয়ায় হাসিমুখেই হৃদয় হলুদ খাম বের করে। মেটে রঙের খামও দেখায়। মেহরাব মুচকি হাসি বজায় রেখেই বলে, ‘নীল খাম নাই?’ ‘নীল খাম?’ আচমকা মনটা খারাপ ক’রে ফের মুচকি হেসে হৃদয় বলে, ‘আছে তো স্যার, অবশ্যই আছে’। খাম দেখাতে দেখাতে হৃদয় ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে এবং ‘স্যালারি কত পান’- এর মতো ভয়ঙ্কর ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতেও তাঁর দ্বিধা হয়না। মেহরাব কোনো উত্তর না-দিয় বলে,‘ দ্যান, দশটা খাম দ্যান, কত’? ‘বেশি না স্যার, বিশ টাকা’ – ব’লে হৃদয় দিলখোলা ব্যাক্কলের হাসি মারে। মেহরাব খাম নিয়ে পাশেই দাঁড়ানো রিকশায় উঠে বলে, ‘এগারো নম্বরে চলো’। রিকশা নানা বিপণিবিতান, রেস্টুরেন্ট, কম্যুনিটি সেন্টার, মাইলস্টোন স্কুল পাশ-কাটিয়ে চৌরাস্তার দিকে সোজা পশ্চিমে এগিয়ে যেতে থাকে।
দুই
চিঠিটা মেহরাব গতকাল রাতেই লিখেছিল।তবু আজ আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে এইমাত্র নিয়ে-আসা নীলখামে ভরে এবং ভালোভাবে আইকা-গাম লাগায়। তারপর ড্রয়ার থেকে আগেই কিনে-রাখা স্ট্যাম্প ছিঁড়ে কিছুক্ষণ সারি সারি দুই টাকার স্ট্যাম্পের ডট-চিহ্নের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাঁর মনে হ’তে থাকে, তাঁর জীবনও এই ডট-চিহ্নগুলির মতোই। সবদিক দিয়েই পূর্ণতা আছে। কিন্তু একটু পরপরই ডটের শূন্যতা। সে আবার আইকা-গাম দিয়ে অনেক মজবুতভাবে নীলখামে স্ট্যাম্প লাগায়। তারপর বাদবাকি নীলখাম ও স্ট্যাম্পগুলি ড্রয়ারে রেখে তালা লাগায়। তারপর নীলখামের চিঠিটা শর্ট-পাঞ্জাবির পকেটে ফেলে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে। বাসার মোড়েই রিকশা। মেহরাব রিকশাঅলাকে বলে, ‘পোস্টঅফিসে চলো’। রিকশাঅলা মাঝেমধ্যেই রিকশায় ওঠানোর অধিকার ফলায়, বলে, ‘স্যার, আইজ তো শুক্রবার, পোস্টঅফিস বন্ধ’। মেহরাব বিরক্ত হয়ে বলে, ‘তোমাকে যা বলেছি, তুমি তাই করো’। রিকশাঅলা রিকশা টানে ঠিকই, কিন্তু কৌতুহল জাগে। সে-ও লোকাল-লোক। চৌদ্দ নম্বও খালপারের ফিছনের গ্রামেই তাঁর বাড়ি। সে পোস্টঅফিসের সামনে মেহরাবকে নামিয়ে-দিয়ে বলে, ‘স্যার, আমি কি যামুগা, না থাকমু?’ মেহরাব বলে,‘ না, দাঁড়াও, আমি এখনই আসছি’। রিকশাঅলা রুস্তম, দেখতে না-চেয়েও কৌতুহলবশত দেখে ফ্যালে যে, মেহরাব একটি নীলখাম পোস্টবক্সে ফেললো। রুস্তম ভাবে, চিঠির খামই তো আছে, নীলখামে চিঠি দেয়ার কী দরকার?
মেহরাবের মনে হচ্ছে, সে যেন ঘুমের ভিতর স্বপ্ন দেখে চলেছে। এমন কি বাকি জীবন তাঁকে সেই অন্তহীন স্বপ্নযাত্রী হয়েই থাকতে হবে। হে পাঠক, আপনিও সেই সুখস্বপ্নযাত্রী হোন। মেহরাবের স্বপ্ন যেন কোনোদিনও ভেঙে না-যায়।
পরদিন রুস্তমকে তাদের গ্রামের এক আত্মীয়া একটি চিঠি পোস্টবক্সে ফেলার দায়িত্ব দেয়। সেই খামটিও ছিল নীল রঙের। মহিলার নাম নীলুফা। সে বার-বার-ক’রে রুস্তমকে বলে, ‘দুই টাকার একটা স্ট্যাম্প লাগায়া দিও। আমার কাছ এখন ভাংতি নাই। পরে রিশকায় উঠলে পুশায়া দিমু নি’। নীলখাম দেখে রুস্তমের কৌতুহল তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। সে পোস্টমাস্টারকে জিজ্ঞেস করে, ‘মাস্টারসাব, সরকারি খাম থাকতে নীলখাম ক্যান’? পোস্টমাস্টার বিরক্ত হয়ে ধমক দিয়ে বলে, ‘দ্যাখ, আমি খুব ব্যস্ত, তুই চিঠি পোস্ট ক’রে বিদায় হ’। তারপর একটানা সীল মারতে থাকে। কিন্তু সীল মারতে মারতেই পোস্টমাস্টারের মনেও নীলখাম, নীলখাম শব্দটা মশা-মাছির মতো ভনভন করতে থাকে। তাঁরও তীব্র কৌতুহল জাগে। সে কোথায় যেন শুনেছে, নীলখামে প্রেমের চিঠি দেয়া হয়।
তিন
মেহরাব তখন শান্ত-মারিয়মে ক্লাশ নিচ্ছিলো। ফ্যাশন-শো-ও নানারকম ব্লকিং; নানা ফ্রেম; ফিগারের সঙ্গে পোশাকের সামঞ্জস্য ইত্যাদি নিয়ে এ্যারিস্টটলের আর্স-পোয়েটিকার সঙ্গে মিলিয়ে নানা কথা বলছিল। ঠিক তখন তাদের বাসায়, বাসার গেটম্যান-কাম-কাজের ছেলে তরিক বাসার নীল রঙের পোস্টবক্স খুলে একটা নীলখামের চিঠি পেল। প্রাপক, মেহরাব হোসেন লেখা। যেহেতু মেহরাব তখন বাসায় নেই, তাই তরিক তারস্বরে চিৎকার ক’রে বললো, ‘খালাম্মা, মেহরাব ভাইয়ের চিঠি আইছে’।তরিকের চিৎকার শুনে সুরাইয়া চমকে উঠলো। মেহরাবের চিঠি? জীবনে এই প্রথম মেহরাবের চিঠি এলো। ‘দেখি, নিয়ে আয় তো’- ব’লে সুরাইয়া এগিয়ে গিয়ে তরিকের হাত থেকে তড়িৎবেগে নীলখামের চিঠিটা কেড়ে নিলো। সুরাইয়া অতটা শিক্ষিত না-হ’লেও জানে যে, কারো চিঠি খুলে পড়তে নেই। কিন্তু কৌতুহল জাগলো প্রেরকের নাম দেখে। প্রেরক, অনামিকা অন্তরা। ভাবলো, তাহলে কি এতদিনে ছেলেটার সঙ্গে কারো সম্পর্ক হলো? নারীরা তো সংসারে আসার আগে এভাবেই জানান দিয়ে আসে। সুরাইয়া চিঠিটা মেহরাবের টিবিলে পেপার-ওয়েট দিয়ে চমৎকারভাবে চাপা দিযে রাখলো। কাউকে কিছুই বললো না। চাপা উত্তেজনা নিয়ে মেহরাব-মীম-মমিনের বাবার আশেপাশে ঘুর ঘুর করলো কিছুক্ষণ, কিন্তু কিছুই বলতে পারলো না। দেখি, কী হয়? গবেমাত্র তো একটি চিঠি এসেছে। যদি একই নামে আরো চিঠি আসে, তাহলে খুলে দেখবে কিংবা মেহরাবের বাবাকে জানাবে।
তারপর থেকে প্রতি সপ্তাহে মেহরাবের নামে দু’তিনটি ক’রে চিঠি আসতে থাকেলো। প্রতিবারই তরিকের তারস্বরে চিৎকার এবং সুরাইয়ার চমকে ওঠা। কিন্তু মা-ও ছেলেকে কিছু বলেনা, ছেলেও মা-কে কিছু বলেনা। সুরাইয়াও পরিবারের কারো সঙ্গে ব্যাপারটা শেয়ার করতে পারছে না। এদিকে মীমেরও বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে। সুরাইয়ার ভাবনার শেষ নেই। বড় ছেলৈ ব্যবসায় করে। তাঁকেই আগে বিয়ে করাবে , নাকি মেয়ে বিদেয় করবে, নাকি মেহরাবের সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে খোলাখুলি আলাপ করবে? নানা ভাবনায় সুরাইয়া শুকিয়ে যেতে লাগলো। এদিকে চিঠি আসছে তো আসছেই। যেনবা সারা-জীবনের চিঠি-প্রাপ্তির ভুবুক্ষু মরুভূমি চিঠি-বৃষ্টিতে সরস হয়ে উঠলো।
চার
আজ হঠাৎ কিছু ছাত্র-ছাত্রী মেহরাবের কাছে তাঁর প্রমোশন উপলক্ষে কুপারসে খাওয়রি আবদার করলো। মেহরাব আজ সহকারী অধ্যাপক হয়েছে। প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক হওয়ায় তাঁর ব্যক্তিত্বে কেমন-যেন একটা ভারিক্কি চলে এসেছে। সে ভাবলো, এভাবে ছেলেমানুষী করা কি ঠিক হ’লো? এ-শুধু নিজের সঙ্গে নিজের নিঃসঙ্গালাপ। কাউকে কিছু বুঝতে না-দিয়ে সে উপস্থিত সবার উদ্দেশ্যে বললো, ‘চলো, তোমাদের সবাইকে আজ কুপারসে লাঞ্চ করাবো’। তাঁরা বেশ কয়েকটা রিকশায় রওনা হ’লো। মেহরাব খেয়াল করেও কিছু বুঝতে পারলো না। কিন্তু দেখলো একটি মেয়েই বার বার তাদের মধ্যমণি হয়ে উঠছে। বন্ধু-বান্ধব তাঁকে ঘিরে রেখেছে। কী ব্যাপাওে যেন সাহস যোগাচ্ছে। মেহরাবের শ্রেণী-চেতনা প্রবল। সে তরুণ-তরুণীদেও পাত্তা না-দিয়ে মুখ ফিরিয়ে মুন্নী ম্যাডামের সঙ্গে কলিগ্যাল কথাবার্তায় মনোনিবেশ করলো। মুন্নী বিবাহিতা। মস্করার সুরেই সিরিয়াসলি বললো,‘ স্যার, এবার বিয়ে করেন’।
– ‘ বিয়ে তো করবোই কিন্তু’
– ‘ কোনো কিন্তু না স্যার, আমার হাতে ভালো পাত্রী আছে। আপনার তো সবই ঠিক’।
– সবই তো ঠিক। কিন্তু পাত্রীর ব্যাপারেই ঠিক নেই’।
– ‘আপনি চাইলে আপনার ফ্যামিলির সঙ্গে আমি আলাপ করতে পারি।’
–‘ না, না। আমার বড় ভাই এখনো বিয়ে করে নি। ছোটো বোনও আছে।’
–‘ অসুবিধা কী? আকথ হয়ে থাকলো। পরে উঠিয়ে নেবেন’।
–‘ ঠিকাছে। আমি পরে আপনাকে জানাবো। আজ উঠি। আপনি ওদের নিয়ে আসেন। এ্যাই, তোমরা লাঞ্চ করো। আমার একটা জরুরি কাজ আছে।’
এই ব’লে মেহরাব বিল পরিশোধ ক’রে কুপারস থেকে বেরিয়ে আসে। তারপর নিজের অজান্তেই দুপুরের রোদে হাঁটতে শুরু করে এবং হাঁটতে হাঁটতে নিজের অজান্তেই বাসায় চলে আসে এবং বিছানায় গা এলিয়ে দেয় এবং ঘুমিয়ে পড়ে।
পাঁচ
আজ শুক্রবার। মেয়েটি সেজেগুঁজে সকাল-সকাল বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। এগারো নম্বও সেক্টও শান্ত-মারিয়মের পাশেই। চৌরাস্তার আরেকটু উত্তরে। বাসার নাম ‘রূপান্তে’। ঠিকানাটা আগে থেকেই চেনা। তরিক তখন আড্ডা দিচ্ছিলো পাশের কনফেকশনারির কর্মচারী দিলুর সঙ্গে। গেট খোলাই ছিল। মেয়েটি অতর্কিতে ঢুকে যায়। তারপর সোজা দোতলা। কেননা, বাড়িঅলারা দোতলাতেই থাকে। দুরুদুরু বুকের দূরত্ব ঘুচিয়ে কলিংবেল টিপে ধরে। মাত্র একবার। তারপর প্রচ- প্রতীক্ষা। কেননা, এখন এ-যুগে কোথাও যেন করাঘাত নেই। তবু দরজা খুলে যায়। সুরাইয়ার মুখোমুখি।
–‘ স্লামালিকুম, আসবো?’
–‘ হ্যাঁ, এসো। কে তুমি?’
– ‘মেহরাব স্যার নেই?’ কেননা, এ-যুগের মানুষ প্রশ্নের উত্তর না-দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ক’রে উত্তর চায়। কেননা, এটা তো উত্তরার কাহিনি।
– ‘আছে, তুমি কে?’
– ‘আমি উনার ছাত্রী’।
– ‘এ্যাই, মেহরাব, এদিকে আয়, তোর ছাত্রী এসেছে।’
কথাটা শুনে মেহরাব পাশের ঘরে চমকে ওঠে। আমার ছাত্রী? আমার ছাত্রী বাসায় আসবে কেন? মেহরাব ড্রয়িং রুমে আসে।
–চিনতে পেরেছেন? গতকাল কুপারসে’
–‘ হ্যাঁ, চেনা-চেনা লাগছে’।
সুরাইয়া তার আগেই কখন সুরুৎ ক’রে চলে গেছে তা শুধু মেয়েটিই খেয়াল করেছে।
– ‘তুমি কি ফ্যাশন-ডিজাইনে?’
–‘ না, আমি উংরেজিতে, মাস্টার্সে।’
–‘কী ব্যাপার?’
ততক্ষণে সুরাইয়া সোরগোলসহ আবার হাজির।
–‘ এ্যাই মেয়ে তোমার নাম কী?’ সুরাইয়ার উদ্বিগ্ন প্রশ্ন।
–‘ জ্বি, আমার নাম অনামিকা অন্তরা’।
মেহরাব স্তব্ধ হয়ে সোফায় ব’সে পড়ে। তখন সুরাইয়া অনামিকার হাত ধ’রে ড্রয়িং-রুম থেকে বেডরুমে চলে যাচ্ছে। অথচ মেহরাবের কিছুই করার নেই।
– ‘এ্যাই মেয়ে, তোমার বাবা কে?’
–‘ আমার আব্বু উত্তরা পোস্টঅফিসের পোস্ট-মাস্টার’।
এখন সুরাইয়া ও অনামিকাকে অনেক অর্থময় আলাপ-আলোচনা করতে হবে। এদিকে মেহরাবের মনে হচ্ছে, সে যেন ঘুমের ভিতর স্বপ্ন দেখে চলেছে। এমন কি বাকি জীবন তাঁকে সেই অন্তহীন স্বপ্নযাত্রী হয়েই থাকতে হবে। হে পাঠক, আপনিও সেই সুখস্বপ্নযাত্রী হোন। মেহরাবের স্বপ্ন যেন কোনোদিনও ভেঙে না-যায়।