শব্দকল্পদ্রুম : ধরণী ধুরন্ধর । মাদল হাসান
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১:০৭ পূর্বাহ্ণ, | ১৭৮০ বার পঠিত
‘এক দেশের গালি অন্য দেশের বুলি’- প্রবাদ
বেন ইয়ামিন = বেঞ্জামিন
অ্যাডাম = আদম
বলা হয় শব্দই ব্রহ্ম। ব্রহ্মনাদ থেকেই শব্দের উৎপত্তি। আবার এও বলা হয়, আল্লাহ সৃষ্টির আদিতে ‘কুন’ অর্থাৎ ‘হও’ বলার পরেই সবকিছু হয়ে গিয়েছিল। এ-ব্যাপাওে কবির কল্পনাশক্তিও কম যায়না। বলা হয়, ‘শব্দকল্পদ্রুম’। কবি তাঁর কল্পনা থেকে দ্রুম ক’ রে পেয়ে যান নতুন শব্দ। আর সেই শব্দ সূচনা কওে নতুন ধারণা বা কনসেপ্টের। একটি চলমান সমাজ-ব্যবস্থায় প্রচলিত রীতি-নীতির জন্য যেমন কিছু ধরাবাঁধা শব্দ থাকে; তেমনি নতুন কোনো প্রযুক্তি, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, রাজনৈতিক পালাবদল, কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা, ধর্মবোধ, তত্ত্ব এবং অনুভূতির জন্যও প্রয়োজন পড়ে নতুন শব্দের।
সারা পৃথিবীতে ব্রিটিশ সাম্রারাজ্যের কারণে ইংরেজি ভাষার সেকেন্ড ল্যাংগুয়েজ হওয়ার ঘটনা ঐতিহাসিক সত্য। এই ভাষাটি সহজেই প্রিফিক্স-সাফিক্স এবং নাউন থেকে এ্যাডজেক্টিভ ও ভার্ব করার গুণে উৎপাদনশীল বা সৃষ্টিশীল। এছাড়া বৈজ্ঞানিক নামকরণ ( গ্রিক-ল্যাটিন থেকে ) ও ওষুধের নামকরণেও এই ভাষাটি একরকম একাধিপত্য বজায় রাখে। তুলনামূলকভাবে বাংলা ভাষার তেমন সুযোগ কম।
এখন আমাকে বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার নিয়ে কিছু ক্লিশে কথা বলতে হবে। তারপর কিছু জরুরি ক্লিশে কথাও বলবো।
বাংলা শব্দভাণ্ডারকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। এক. উৎপত্তি অনুসারে বা উৎস অনুসারে। দুই. গঠন অনুসারে। তিন. অর্থানুসারে।
১. উৎস অনুসারে বাংলা শব্দ পাঁচ প্রকার । যথা —
ক. তৎসম শব্দ। যেমন, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র।
খ. অর্ধ-তৎসম শব্দ। যেমন, জোছনা, ছেরাদ্দ।
গ. তদ্ভব শব্দ। যেমন, হাত, দাঁত, কাঁকন, হাঁস।
ঘ. দেশি শব্দ। যেমন, ঢেঁকি, কুলা, ঠ্যাং, টোপর, ঠান্ডা।
ঙ. বিদেশি শব্দ। যেমন, চেয়ার, টেবিল, চা, আনারস, আল্লাহ, খোদা, রাসুল।
২. গঠন অনুসারে বাংলা শব্দ দুই কিসিমের। যথা —
ক. মৌলিক শব্দ। যেমন, মা, গোলাপ, ফুল।
ক. সাধিত শব্দ। যেমন, উপহার, নীলাকাশ, ঢাকাই, চলন্ত, সিংহাসন, মনমাঝি।
৩. অর্থানুসারে বাংলা শব্দ তিন ধরনের। যথা —
ক. যৌগিক শব্দ। যেমন, গায়ক, নায়ক।
খ. রূঢ় বা রূঢ়ি শব্দ। যেমন, বাঁশি, হস্তী, প্রবীণ।
গ. যোগরূঢ় শব্দ। যেমন, পঙ্কজ, জলচর।
ব্যাকরণের নিয়ম অনুযায়ী তৎসম শব্দের সঙ্গে তৎসম শব্দই ব্যবহার করতে হবে। কারণ, এরা জাতপাত এবং কুষ্ঠিবিচার ছাড়া চলেনা। লগ্নও মেনে চলতে চায়। নইলে ভাষা ঝাঁটালগ্নে পড়ে যেতে পারে। যেমন, শবদাহ ( মড়াদাহ নয় )। আবার দেশি শব্দের সঙ্গে দেশি শব্দই ব্যবহার করতে হবে। কারণ, এরা অন্ত্যজ শ্রেণীর হ’লেও আত্মসম্মান বেশ প্রবল। যেমন, মড়াপোড়া ( শবপোড়া নয় )। এর ভিন্নতাকেই প্রচলিত ব্যাকরণে গুরুচ-ালী দোষ বলা হয়। যে-কারণে একটি বাক্য তার যোগ্যতা হারায়। যেমন, উনিশ শতাব্দী কিংবা বিংশ শতক বললে বাক্য তার যোগ্যতা হারায়। বলতে হবে, ঊনবিংশ শতাব্দী কিংবা উনিশ শতক এবং বিংশ শতাব্দী কিংবা বিশ শতক। ফিক্সড ম্যাচ কিংবা পাতানো খেলা ইত্যাদি।
সৃষ্টিশীলতার জন্য বাংলা শব্দভাণ্ডারের সবগুলিই সমান সাহায্য করতে পারেনা। এটি ধ্রুবানিসত্যম। যথাক্রমে বেশি সাহায্য করে সাধিত শব্দ, যৌগিক শব্দ, যোগরূঢ় শব্দ এবং রূঢ় বা রূঢ়ি শব্দ।
সাধিত শব্দ চার প্রকারে সাধন করা যায়। যথা – উপসর্গ, সন্ধি, সমাস এবং প্রত্যয়যোগে।
ক. উপসর্গযোগে — নির + শরীর = নির্শরীর
খ.সন্ধিযোগে — ঘৃণা + আতিথ্য = ঘৃণাতিথ্য
গ. সমাসযোগে — জেদী + দীর্ঘশ্বাস = জেদীর্ঘশ্বাস ( জেদী হবার পরেও যাঁর দীর্ঘশ্বাস আছে, মধ্যপদলোপী বহুব্রীহি )
স্বাভাবিক + বিকার = স্বাভাবিকার ( স্বাভাবিক হবার পরেও যা বিকার, মধ্যপদলোপী বহুব্রীহি )
ঘ. প্রত্যয়যোগে — বৈ +অক = বায়ক ; গৈ + অক = গায়ক ; নৌ + ইক = নাবিক ইত্যাদি।
যৌগিক শব্দে করার তেমন কিছু নেই। কারণ, এই শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ এবং ব্যবহারিক অর্থ একই। কিন্তু এর কিছুটা সম্ভাবনা আছে। সেটা প্রত্যয়সাধিত সম্ভাবনায়। এবং প্রকৃতি তৈরি করে নেবার প্রবণতায়। ‘বায়ক’ -কে আমরা বলতে পারি, বৈতরণী ঘাটের বৈঠা-চালানো মাঝি। রূঢ় বা রূঢ়ি শব্দ এবং যোগরূঢ় শব্দের সম্ভাবনাও ফেলনা নয়। যেমন, ‘পঙ্কজ’ শব্দের সমান্তরালে আমরা ‘অঙ্কজ’ শব্দটিও তৈরি করতে পারি।
উপরের আলোচনায় স্পষ্ট বুঝা যায় যে, সন্দি ও সমাসের মতো অন্য প্রক্রিয়াগুলো অতটা উপযোগী নয়। তবে সীমিত হ’লেও সম্ভাবনা আছে। এই কথাগুলি যুগ্মবৈপরীত্য-কাব্যান্দোলনের গোড়ার কথা। অভেদের দর্শন, জীবন যাপন ও অনুভূতির দোলাচল, দ্বৈত ও অদ্বৈতবাদ এবং দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ ভাবসম্পদসহ যুগ্মবৈপরীত্য বাদে একীভূত হয়েছে। কেননা, বৃহত্তর জীবন-প্রবাহের সঙ্গে দর্শনকেও বিকশিত হতে হয়।
এ-ছোটো প্রবন্ধকে দীর্ঘ করতে চাইনা। তবু বাংলা ক্রিয়াপদ নিয়ে দু’ কথা না-ব’লে পারছিনা। কেননা, একটি ভাষার ভরকেন্দ্র-প্রাণকেন্দ্র এবং পাওয়ার হাউজ বা মাইটোকন্ড্রিয়া হ’লো ক্রিয়াপদ। বাংলা ক্রিয়াপদের সমস্যা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন। আমিও একটি সমস্যা দেখেছি। যেমন, ‘পাবোনা’ না-লিখে ‘পাবনা’ লিখলে কিংবা আনিস বা আসলাম বা বারেক লিখলে ক্রিয়াপদটি নামপদ হয়ে যায়। এছাড়া সবচে বড় সমস্যা হ’লো নামপদ থেকে সরাসরি ক্রিয়াপদ এবং বিশেষণ করার সমস্যা। অথচ ইংরেজিতে নাউন থেকে সরাসরি ভার্বাল নাউন, ভার্ব এবং এ্যাডজেক্টিভ করা যায়। ইংরেজিতে পারটিসিপল এবং জিরান্ড অনেক শক্তিশালী শব্দ-সংগঠন।
মাইকেলীয় ধাতুরূপে এর কিছু সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। যেমন, আস্ফালিয়া, প্রবেশিয়া, সঞ্চিয়া ইত্যাদি। রবীন্দ্র ক্রিয়া-সংকোচনও অবশ্য স্মরণ্য। যেমন, বরণ করিয়া না-লিকে বরি; স্মরণ করিয়া না-লিখে স্মরি ইত্যাদি। এসব বর্তমান ভাষা-প্রকল্পে অতটা অঙ্গীভূত হ’তে না-পারলেও হযতো আবার কখনো আকার পাবে। কেননা, সব যুগেই শব্দে-শব্দে বিয়া হয়। এমনকি বৈরিবিবাহও হয়। শব্দেরা সংসারধর্ম কতদিন পালন করলেন তাই আসলে প্রধান বিবেচ্য।
এবার কিছু কথা বলতে হবে শব্দ ও বাগর্থ নিযে। অভিধানে শব্দ কী অর্থ ধারণ করে এবং বাক্যে বিন্যস্ত হ’লে ( বিশেষত কবিতায় !) এর ঐতিহ্য-অ্যাকসেন্ট ও প্রাবচনিক পরিধি পরিধিসহ কী অর্থপ্রাপ্ত হয়, তা দু’টি ভিন্ন বিষয়। অরণ্যেরোদন এবং বনে ক্রন্দন এককথা নয়। মেনি, ছিঁচকে চোর এবং ছিঁচকে অধ্যাপক এককথা না-হ’লেও প্রসঙ্গেও অবতারণায শিল্পযাত্রা ঘটে, নতুন মাত্রাও পায়। একটি কবিতায় লিখেছিলাম, আজরের বংশ চটকায় কি সীমার-সময় ? এখানে, চটকায় শব্দটির ব্যঞ্জনা তেঁতুল চটকে খাওয়ার মতো কিংবা পুঁইবীজ চটকে হাত রাঙিয়ে নেয়া কিংবা চাটনি চটকানোর মতোই। মূল বিবেচ্য নৃশংসতা নির্মাণ।
এবার আসা যাক, শব্দ কীভাবে তার ঐতিহ্য হারায় সে প্রসঙ্গে। কালের বিবর্তনে শব্দের অর্থ সংকুচিতও হয়, আবার প্রসারিতও হয়। আগে মৃগ শব্দের অর্থ ছিল যে-কোনো পশু। তাই, চন্দ্র ও সূর্য বংশের সম্রাটেরা মৃগয়ায় যেতেন। এখন মৃগ শব্দের অর্থ শুধুই হরিণ। হয়তো সে-কারণেই এ-যুগের পরিবেশবাদি পৃথিবী মৃগয়ায় যান না। আগে অন্ন শব্দের অর্থ ছিল শুধু ভাত আর ভাত। এখন অন্ন শব্দের অর্থ যে-কোনো খাবার। এভাবেই, মৃগ শব্দের অর্থ সংকুচিত হয়ে মারীচী করছে এবং প্রসারিত হয়েছে অন্ন শব্দের খাই-খাই। আগে ধুরন্ধর শব্দের অর্থ ছিল, যে দায়িত্ব নিয়ে ভারবহন করে। আর এখন ধুরন্ধর লোক দায়িত্ব দেখলে পালাই-পালাই করে অবশেষে নিজ-দায়িত্বে পালায়। যেমন, আমি, এইমাত্র এই প্রবন্ধ থেকে পালিয়ে গেলাম!
কিন্তু পালাবি কোথায়, খাইছি তোরে, ধর ইত্যাদি বাংলা সিনেমার নামশব্দ আমাকে আবার ধ’রে ফেললো। বললো, আরো কিছু কথা ব’লে যাও শব্দ নিয়ে। যেমন, একই শব্দের ভিন্নার্থে প্রয়োগ। যেমন, হাত শব্দটি থেকে হয় – হাতের পাঁচ, হাতের কাজ, হাত ভালো, হাত আছে, হাতে রাখা, হাতাহাতি, হাত দিওনা, হাতেহাতে, হাতেনাতে, হাতদেয়া, হাতে তুলে, হাত ঘুওে, হাত গ’লে, হাত চুঁইয়ে, হাত ছুঁয়ে, হাতে ধ’রে, হাত গলিয়ে, হাত বাড়িয়ে ইত্যাদি। কিঞ্চিৎ বাংলা বাক্যজানারাও শব্দগুলি দিয়ে সার্থক বাক্যরচনা ক’রে নিতে পারবেন।
এবার আসা যাক, শব্দের সাম্প্রদায়িকতা প্রসঙ্গে। মানুষতো শেষমেশ সাম্প্রদায়িকই হয়ে যায়। দেশভাগ বড় প্রমাণ। যেমন, জন্ম-জন্মান্তর এবং কেযামত তক বহুল প্রচারিত দু’টি সাম্প্রদায়িক শব্দ। অথচ দু’টি শব্দই পুনরুজ্জীবন ও সেকেন্ডকামিং-কে ধারণ করে। একটি ওভিদের কাব্যের মতো নানা-প্রাণীতে নানারূপে রূপান্তর, অন্যটি মানূষ হিসেবে পুনরুত্থান। অথচ ঝগড়াঝাঁটিটা আসলে বণ্টনের অধিকার নিয়ে। যেমন, জল এবং পানি শব্দ দু’টি। অথচ জলপানি পাবার ক্ষেত্রে কারো কোনো আপত্তি নেই। লেখকেরা লিখেই যেন তাদের জলপানির ব্যবস্থা করতে পারেন এবং এ-দেশের, এ-পৃথিবীর সকল মানুষ মানানসই জলপানি পাক, এই আশাবাদ ব্যক্ত ক’রে আজকের মতো বিদায় নিচ্ছি। ওম ভীম ভূমা।