ভার্জিনিয়া উলফের গল্প ‘নিমজ্জন’ । অনুবাদ- এমদাদ রহমান
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২:৪৮ পূর্বাহ্ণ, | ২১৪৫ বার পঠিত
বৃটিশ কথাসাহিত্যিক এবং ফেমিনিস্ট ভার্জিনিয়া উল্ফের জন্ম ১৮৮২ সালে। তাঁকে বিবেচনা করা হয় বিশ শতকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আধুনিকতাবাদী সাহিত্য-ব্যক্তিত্ব হিসেবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে লন্ডনের সাহিত্য সমাজে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখক হিসেবে পরিগণিত হন তিনি। তৎকালীন ব্লুমসবারি গোষ্ঠীরও একজন সম্মানিত সদস্য ছিলেন তিনি। উল্ফ-রচিত সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। লিখেছেন গল্প, উপন্যাস, স্মৃতিকথা, প্রবন্ধ।
মিসেস ডলওয়ে, টু দ্য লাইটহাউস, জেকবস্ রুম, ওরলানডো, দ্য ওয়েভস্ তাঁর প্রখ্যাত উপন্যাস। চরিত্রের অবিরাম বিবৃতি আর উন্মোচনে উপন্যাসগুলো পেয়ে যায় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মাত্রা। উল্ফকে বলা হয় অক্লান্ত পরীক্ষক, পর্যবেক্ষক এবং বহুদর্শী এক রচয়িতা। স্ট্রিম অব কনসাসনেস বা চেতনাপ্রবাহ রীতিতে তিনি রচনা করেন ‘নিজের একটি ঘর’ নামক প্রখ্যাত গ্রন্থটি। এই রীতির শ্রেষ্ঠ ফসল জেমস জয়েসের ইউলিসিস। এই রীতিটিকে বলা হয় কোনো ব্যক্তির চেতনাপ্রসূত অভিজ্ঞতার বিরামহীন বর্ণনা। দীর্ঘদিন বিষণ্নতায় ভোগার ফলে বেঁচে থাকবার তীব্রতা কমে যায় তাঁর। নিজের হাতে তুলে নেন নিজেকে ধ্বংসের দায়িত্ব! ৫৯ বছর বয়সে কোটের পকেটে পাথর ভরে বৃটেনের ওউশি নদীতে ডুবে যান তিনি। জীবনে আর ফেরা হয় না তাঁর। জলের সঙ্গে মিশে যায় বিষণ্ন লেখিকার আত্মা। দিনটি ছিল ১৯৪১ সালের ২৮ মার্চ। অনূদিত গল্পটির মূল শিরোনাম The String Quartet, গল্পটির রচনাকাল ১৯২১ সাল।
হ্যাঁ, ঠিক আছে, এখানেই আমরা আছি, এবং, এখন তুমি যদি দৃষ্টি প্রখর করে বাইরে তাকাও, তাহলে দেখতে পাবে পাতালট্রেন আর ট্রাম আর বাসগুলোকে, দেখতে পাবে ঘোড়ায় টানা চারচাকার গাড়ি, সংখ্যায় তারা কম নয়; এমন কী, আমি খুব সাহস করেই বিশ্বাস করছি যে, সবকিছুই সবকিছুকে দখল করে বসে আছে, ব্যস্তসমস্ত হয়ে আছে, মনে হচ্ছে যেন চরকিতে সুতো বোনা হচ্ছে লন্ডন শহরের এক প্রান্ত থেকে শুরু করে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত, অথবা তারা সবাই সার বেঁধে বসে আছে কোনও এক বেলাভূমিতে। এসব সত্ত্বেও, যা-ই হোক, আমি কিন্তু এখনও সংশয়েই আছি… আমার ভেতরে এখনও নিরবিচ্ছিন্ন সন্দেহ আর অবিশ্বাস…
যদি আসলেই তা সত্যি হয়, তারা ঠিক যেমনটি বলেছিল যে রিজেন্ট স্ট্রিট হচ্ছে উঁচু আর চুক্তিটিও ইতোমধ্যে স্বাক্ষরিত হয়ে গেছে; আর আবহাওয়াও বছরের এই সময়ে ঠিক যেমন কোমল আর ঠাণ্ডা থাকার কথা, আসলে ঠিক তেমন ছিল না, এমনকি নিজেদের থাকার জন্য কোনও ফ্ল্যাটও ভাড়া করা হয়নি, ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্তদের অবস্থা আশঙ্কাজনক, যদি আমি স্মরণ করি আমাকেই যে আমি একেবারেই লিখতে ভুলে গেছি শূন্য ভাঁড়ারঘরের কথা আর আমার হাতের দস্তানাও ফেলে এসেছি ট্রেনে, যদি এগিয়ে যাওয়ার ঝোঁকে এখনই আমার দরকার হয়ে পরে রক্তসম্পর্কের বন্ধন, উষ্ণভাবে গ্রহণ করব সেই হাত যা আমার দিকে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল দ্বিধার সঙ্গে…
‘সাত বছর হলো আমাদের প্রথম সাক্ষাতের।’
‘শেষবার ভেনিসে।’
‘এখন তুমি কোথায় থাকো?’
‘ঠিক আছে, বিকেলের শেষ সময়টা আমার সঙ্গে বেশ মানানসই হবে, যদি এমন হয় যে, তখন কেউ কিছু জানতে চাইব না…
‘আমি তোমাকে রক্তেমাংসে চিনি’।
‘চুপ করো, চুপ! ময়দানে এখন সাময়িক যুদ্ধবিরতি…
যদি মনের ভেতর অভিপ্রায়ের তীরগুলো তীক্ষ্ণভাবে গেঁথে যায়, আর তখনই মানুষের সমাজ কাউকে দিয়ে করতে বাধ্য করায়, তাহলে দেরি না করেই কেউ একজন দ্রুততার সঙ্গে দেগে দেবে তার অস্ত্রটি, আর যদি এই অবস্থাটা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং বাড়তে বাড়তে তা রূপান্তরিত হয়ে যায় বৈদ্যুতিক আলোর দশায়, অনেক ঘটনার মধ্যে যদি বলা হয় একটা কিছু ঘটবেই, তবে সবকিছু ছেড়ে উৎকর্ষ সাধন এবং সংশোধনের প্রয়োজনে জাগিয়ে দিতে পারে মনস্তাপ, দুঃখবোধ, সুখ, দম্ভ এবং আকাঙ্ক্ষা- যদি আমি এই সবগুলো অবস্থাকেই বুঝিয়ে থাকি, আর টুপিগুলো আর চামড়ার গলাবন্ধ আর ভদ্রলোকদের দীর্ঘপুচ্ছ কোট, এবং মুক্তোর তৈরি টাইয়ের কাঁটা, যেগুলো বাইরের খোলসটাকে ঢেকে রাখে- তাহলে তুমি কোনগুলোকে যুক্তিগ্রাহ্য মনে করবে?
কী হবে? প্রতি মিনিটেই এর কারণ সম্পর্কে কিছু বলা কঠিনতর হয়ে পড়বে, সবকিছু সত্ত্বেও, আমি এখানেই বসে রয়েছি এই বিশ্বাসে যে আমি কোনোভাবেই বলব না কেন,
অথবা মনে করাবার চেষ্টা করব শেষবার যখন এটা ঘটেছিল-
‘তুমি কি মিছিলটি দেখেছো?’
‘রাজাকে কী শীতল আর নিস্প্রাণটাই না দেখাচ্ছিল।’
‘না, না, কিন্তু আসলেই কেন এটা হয়েছিল?’‘মাল্মসবারিতে সে একটা বাড়ি কিনেছিল।’
‘কোনও একজনকে খুঁজে পাওয়া যে কী ভাগ্যের?’
এর সম্পূর্ণ বিপরীত দিকটা খেয়াল করলে আমার কাছে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে সে-ই সর্বাপেক্ষা সুন্দর, হোক না সে সৌন্দর্যময়ী; এটাই জঘন্য ব্যাপার, আসলে পুরো ব্যাপারটি হলো ফ্ল্যাটগুলি, টুপিগুলি আর গাঙচিলগুলি, অথবা ব্যাপারটাকে অন্যভাবেও বলা যায় যে এখানে পরিপাটি পোশাক পরে একশ জন লোক বসে আছে, যেন তৈরি করা হয়েছে মানব-প্রাচীর, এমনই পরিপূর্ণ বুনন। বিষয়টা এমন নয় যে আমি খুব অহঙ্কার করছি, আমিও আনুগত্য মেনে নিয়ে বসে আছি এক গিল্টিকরা চেয়ারে, কেবলমাত্র পৃথিবীটাই ঘুরছে কিছু সমাধিস্থ স্মৃতির ওপর, যেভাবে আমরাও অবিরত ঘুরে মরি, যেগুলো কিছু চিহ্ন হয়ে টিকে থাকে সবসময়, যদি না আমি কোনও ভুল করে থাকি, আমরা প্রত্যেকেই সবসময় কোনোকিছু পুনর্বার ফিরে পেতে চাই, পুনর্বার স্মরণ করতে থাকি। অগোচরে খুঁজে ফিরি কিছু একটা, যা হারিয়ে ফেলেছি, আমাদের এই স্নায়বিক অস্থিরতার মূল কারণটা কী হতে পারে? কেন আমরা সবসময় আমাদের আলখাল্লা, দস্তানা ইত্যাদি নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকি? বোতামগুলো খোলা বা লাগানো যে অবস্থাতেই থাকুক, এখন তাকানো যাক ক্যানভাসের বিপরীতে অন্ধকারে ডুবে থাকা প্রৌঢ় মুখটির দিকে, যা এক মুহূর্ত আগেও সুন্দর ছিল এবং রঙিন হয়ে উঠেছিল, এখন সে বাক্শক্তিহীন এবং বিষাদে আক্রান্ত, যেন ছায়ার ধাঁধায় হারিয়ে গেছে। পাশের হল ঘরে তাহলে কি দ্বিতীয় বেহালাটিও বেজে উঠেছে? এখানেই তারা আসছে, চারজন কালো লোক বাদ্যযন্ত্রগুলো বয়ে নিয়ে আসছে, একে একে তারা বসে গেছে আলোকসম্পাতের নিচে হোয়াইট স্কোয়ারের দিকে মুখ ফিরিয়ে। বাদ্য বাজানোর ছড়গুলো পড়ে আছে স্বরলিপি রাখবার জায়গায় এবং এগুলো একসঙ্গে উঠছে একসঙ্গে নামছে। ছড়গুলোর যুগপৎ সম্মেলন আর বাদকদের দেহভঙ্গি একই কোরাসে মিলে মিলে ভারসাম্য তৈরি করছে। একইসঙ্গে তারা চোখ তুলে দেখছে বিপরীতে বসা অন্য বাদকদের মুখ, প্রথম বেহালাটি বাজছে এক, দুই, তিন…
দীপ্তিময়, উন্মত্ত, পল্লবিত, বিস্ফারিত! নাশপাতি গাছটি একেবারে পর্বতের চূড়ায়। ঝরনা
গড়িয়ে নামছে ঝিরঝিরিয়ে, কিন্তু রাউনি’র জলস্রোত কী দ্রুতই না বয়ে যাচ্ছে, জল অগাধ, খরস্রোতা, ধনুকের মতো বাঁকা, স্রোতে উন্মত্ত- সমস্ত প্রতিবন্ধক চুরমার করে বয়ে যায় স্রোতরেখা মুছে দিয়ে, ধাবমান জলরাশি ধুয়ে ফেলে ছোট্ট পতঙ্গদের ছায়া, ডোরাকাটা চিত্রল মাছগুলো হুমড়ি খেয়ে ছুটে চলে স্রোতের টানে, তীব্র বেগে; আর সৃষ্টি হয় বৃত্তাকার জলাবর্ত, -এই জটিল ঘূর্ণিতে ঘুরপাক খাওয়া মাছগুলো চলে যায় খাড়ির দিকে, জল যেখানে গভীর আর প্রশান্ত। তবুও তারা টিকে থাকতে পারে না। তারা লাফ দেয়, দিক্বিদিক ছড়িয়ে পড়ে, মারামারি করে তাদের সাঁতারকাটার ক্ষিপ্র ডানাগুলো দিয়ে আর জলস্রোতের তীব্র মন্থনে হলুদ শিলাখণ্ডগুলি অবিরাম আবর্তিত হয়, তারপর জলঘূর্ণির হাত থেকে মুক্তি…বেপরোয়া ধাবিত হয় গভীরের দিকে, এমনকি কোনও না কোনওভাবে সর্পিল ছন্দে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে নিখুঁতভাবে তারা শূন্যে উড়তে শুরু করে, বিমানের মতো, বাঁক খেয়ে, উপরে আরও উপরে… কী আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য তাদের, যাদের পদক্ষেপগুলো মৃদু আর পৃথিবী ভেদ করে চলে যায়! এমনকি ধীবরবধূরাও, জীবনের ভারে যেন অবনমিত, উফ্ বার্ধক্যপীড়িত বয়স্কা স্ত্রীলোকেরা, কী প্রগাঢ় তোমাদের হাসি আর শরীরের প্রতিটি আন্দোলন আর কৌতুকহাস্য, ফুর্তিবাজদের মতো চলাফেরা- তোমরা যখন হাঁটো, চারপাশ থেকে গুঞ্জরিত হয় সঙ্গীত। আহা!
‘এটা অবশ্যই মোৎসার্টের প্রথম দিককার রচনা…
‘কিন্তু এই সুরটি, তাঁর অন্যান্য সুরগুলোর মতোই জন্ম দেয় গভীর নৈরাশ্য- আমি বলতে চাচ্ছি এর অর্থ হচ্ছে ‘আশা’, আসলে আমি ঠিক কী বোঝাতে চাইছি? এটাই সঙ্গীতের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম বিষয়। আমি নাচতে চাই, হাসতে চাই, খেতে চাই গোলাপরঙা কেক, পান করতে চাই হালকা কিন্তু খুব কড়া আঙুরের মদ অথবা পড়তে চাই খুব অশ্লীল একটি গল্প, আমি যেটাকে উপভোগ করতে পারব। আমি এসব বেশ উপভোগ করতে পারি। বয়স্করা বেড়ে ওঠে অনেকের চেয়ে বেশি অশ্লীলভাবে। হাঃ হাঃ হাঃ! আমি হাসছি, তাতে কী হবে? তুমি কিছুই বলবে না। কিছুই বলবে না বিপরীতে থাকা সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি… শুধু অনুমান করবে আর অনুমান করবে- চুপ করো, স্তব্ধ হও। ইশ্!’
বিষণ্ন নদীটি আমাদের কেবল বয়ে নিয়ে যায়, যখন চাঁদ ভেসে আসে উইলোর ডালপাতার ফাঁক দিয়ে, আমি তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি, আমি শুনি তোমার কণ্ঠস্বর আর আমরা যখন পাতাভর্তি ঝুড়িগুলোর পাশ দিয়ে যাই, পাখিগুলো ঠিক তখনই গান গেয়ে ওঠে। তুমি ফিসফিস করছ কেন? বিষাদ, বিষাদ, আনন্দ, আনন্দ একসঙ্গে জড়িয়ে থাকে, মালার মতো গেঁথে থাকে পরস্পর, চাঁদের আলোর নৈঃশব্দ্যের মতো, তাদের আর ছাড়ানো যায় না, আরো বেশি জড়িয়ে যায়, কষ্টের ভেতর ঘুমিয়ে থাকে, দুঃখের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে- ভাঙনের কী ভয়ানক শব্দ! ভেঙে পড়ে, সবকিছু মড়মড়িয়ে
ভেঙে পড়ে!
নৌকোটি ডুবতে ডুবতে আবার ভেসে উঠছে, কিন্তু এখন সেটা পাতার মতোই পলকা, মৃত মানুষদের ছায়ামূর্তিগুলো ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, তাদের কাছেই আছে আগুনের কুণ্ডলী, এগুলো আমার আত্মায় দ্বিগুণ অনুভূতির জন্ম দেয়, এসবই আমার জন্য চড়া সুরে গান গায়, আমার কষ্টগুলোকে মথিত করে উন্মুক্ত করে ফেলে, বরফজমাট যন্ত্রণাগুলোকে সমবেদনার তাপে গলিয়ে দেয়, ভালোবাসাময় জলপ্লাবনে ভেসে যায় সূর্যহীন পৃথিবী; এটাই সবকিছু নয়, ভঙ্গুর অবস্থা থেকে টেনে তোলে, কিন্তু দক্ষ আর সূক্ষ্মভাবে এফোঁড়-ওফোঁড় সেলাই করে বাহির আর ভেতর যতক্ষণ না নকশাগুলো পূর্ণতা পায়, তাতে বিচ্ছিন্ন আর একা অংশগুলো জুড়ে যায় একত্রে, তারপর আকাশের অনেক উঁচুতে পাখা না নাড়িয়ে ভেসে থাকা আর যন্ত্রণায় ফোঁপানো কান্নার শব্দ, বিশ্রাম, বিষণ্নতা আর আনন্দের জন্য নিমজ্জিত হয়ে যাওয়া।
তাহলে কীসের জন্য এই শোক আর বিলাপ? জানতে পারি কেন? অতৃপ্তি? আমি বলব যে প্রত্যেকেরই টিকে থাকবার কোনো একটা বন্দোবস্ত হয়ে গেছে, হ্যাঁ, বিশ্রামের জন্য শুয়ে আছি গোলাপ-পাপড়ির তৈরি চাদরের নিচে, যেন আমাদের পতন হয়েছে। উফ্, কিন্তু তারা হার মেনে নিয়েছে। গোলাপের একটা পাপড়ি খসে পড়েছিল অনেক উঁচু থেকে ঠিক যেমনটি একটা ছোট্ট প্যারাসুট একটা অদৃশ্য বেলুন থেকে ঘুরপাক খেতে খেতে পড়তে থাকে, যেটা কোনোদিন আমাদের কাছে পৌঁছাবে না-
‘না, না, আমি আসলে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছুই বলছি না, এই অসংলগ্ন স্বপ্নগুলোই হচ্ছে সঙ্গীতের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম দিক। দ্বিতীয় বেহালাটি দেরিতে বেজেছিল, তুমি বলছ?’
‘এইখানে, পিচ্ছিল মেঝেয় পরে আছেন বৃদ্ধ মনরো, সেকেলে আর বাতিকগ্রস্ত, মদ খেয়ে পড়ে আছেন হতভাগ্য মহিলা।’
দৃষ্টিহীন, বার্ধ্যক্যপীড়িত স্ফিংক্স, এই তো পথের ধারে দাঁড়িয়ে আছে, পাথরের মতো স্থির, ডাকছে ইশারায়, লাল লাল মিনিবাসগুলো…
অপূর্ব! কী আশ্চর্য সুরই না তারা বাজাতে পারে! কীভাবে…কীভাবে… কীভাবে!
জিহ্বা যেন সময় মাপনের দোলক। কতো সহজ এই নিরূপণ! আমার পাশে টুপির পালকগুলো উজ্জ্বল আর ভীষণ আরামদায়ক, ঠিক যেন শিশুদের হাতের ঝুমঝুমি। জানলার পর্দার ফাঁক দিয়ে চিনারগাছটাকে দেখা যাচ্ছে, পাতাগুলি তার গাঢ় সবুজ রঙে ঝলকাচ্ছে । কী অদ্ভুত, কী উত্তেজক ব্যাপার!
কীভাবে…কী করে…কেমন করে…চুপ! সেইসব প্রণয়ীরা শুয়ে আছে ঘাসের ওপর!
‘যদি, ম্যাডাম আমার হাতটা একবার ধরতে…’
‘স্যার, আপনার উপর আমার হৃদয়ের অবিচল আস্থা আর তাছাড়া আমরা তো আমাদের শরীরকে ফেলে এসেছি সেই ভোজ উৎসবের ঘরের ভেতর আর এসব হচ্ছে ঘাসের চাপড়ার উপর পতিত আমাদেরই আত্মার ছায়া।’
‘তবে এই সবই হলো আমাদের আত্মার যুগল সম্মিলন।’ প্রতারকরা ঠিক এইভাবেই মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়। মরালটি তটরেখা থেকেই তাকে প্ররোচিত করে আর স্বপ্নের ডানায় ভর করে ঢেউ খেলিয়ে ভেসে ভেসে চলে যায় অগাধ জলের দিকে।
‘আবারো ফিরে আসে।’ সে আমাকে অনুসরণ করতে থাকে আর যেই না আমি ঘুরে দাঁড়িয়েছি বারান্দার বাঁকে, আচমকা সে আমার পেটিকোটের ফিতা ধরে টান মারে। নিঃশব্দে কান্না ছাড়া আমার আর কী করার ছিল? তাকে থামিয়ে দেয়া ছাড়া? তার কজ্বা থেকে রেহাই পাওয়া ছাড়া? আর যখনই সে তার তরবারিটি খাপ থেকে বের করে আনে, আক্রমণের পর্যায়টি রচিত হয় এমনভাবে যেন মৃত্যুর দিকে যাত্রা শুরু হয়েছে, আর আমি ‘উন্মাদ! উন্মাদ! উন্মাদ!’ বলে চিৎকার করি আর সেই রাজপুত্র, ভেড়ার চামড়ায় লিখছিল তার গ্রন্থটি ওপরতলার জানলার খুপরিতে বসে, বেরিয়ে আসে কার্ডিনালদের মতো মখমলের টুপি আর নরম লোমে আবৃত চটিজুতো পায়ে, এক ঝটকায় দেয়াল থেকে খুলে ফেলে দ্বন্দ্বযুদ্ধের হালকা কিন্তু দীর্ঘ তরবারিটি, যা ছিল এস্পানিয়লের রাজার উপঢৌকন আর আমি পালিয়ে যাওয়ার সময় বলাৎকারের চিহ্নগুলোকে গোপন করতে স্কার্টটি ছুঁড়ে মারি তার আলখাল্লার উপর… কিন্তু শোনো, ওই যে তীব্র নাদে তূরী বাজছে!
ভদ্রলোকটি দ্রুত তার জিজ্ঞাসার জবাব দিলেন এবং সে চরম মানসিক ক্ষিপ্রতায় সুতীব্র অনুভূতির শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছানোর জন্য আরোহণীর ধাপগুলো বেয়ে উঠতে লাগল। শব্দগুলোর মর্মার্থ অপরিস্ফুট, যদিও তাদের সাধারণ অর্থ যথেষ্টই আটপৌরে-ভালোবাসা, হাসি, পলায়ন, অনুসরণ, পরম সুখ, সবকিছু ভেসে যায় উল্লাসের কোমল তরঙ্গের ওপর, যতক্ষণ না রূপার বাঁশির শব্দ প্রথমেই নিকট দূরত্ব থেকে, একটু একটু করে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে, যেন কোনো রাজকর্মচারী কপালে হাত তুলে সেলাম করছে ভোরবেলাকে, অথবা অমাঙ্গলিক ইস্তাহারে ঘোষিত হচ্ছে প্রেমিকের নিরুদ্দেশ হওয়ার সংবাদ…সবুজ উদ্যান, জ্যোৎস্না, জল, লেবু, প্রণয়ী আর মাছ গলে গলে একাকার হয়ে যাচ্ছে বর্ণময় আকাশের ভেতর, সঙ্গম ঘটছে তখনই, যখন শিঙাগুলো ট্রাম্পেটের সঙ্গে সঙ্গত করছে আর তাদের সঙ্গে তাল দিচ্ছে ক্ল্যারিয়নগুলো আর সেখানে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে শুভ্র খিলানগুলো, দৃঢ়ভাবে পোতা মর্মর পাথরের থামগুলোর ওপর…তূরীগুলো অবিরাম দ্রিম দ্রিম শব্দে বাজছে। দ্রিম দ্রিম ঢং ঢং…শব্দের সুদৃঢ় বন্ধন। সুরক্ষিত কাঠামো। অগুন্তি শৃঙ্খলিত পদক্ষেপ। বিশৃঙ্খলা আর নৈরাজ্য পৃথিবীকে যেন ঘৃণায় পদদলিত করছে, কিন্তু সেই মহানগরী–আমরা যেখানকার পর্যটক–তার কোথাও পাথরও নেই, নেই কঠিন মর্মর। শুধু ঝুলে আছে অটল অনড় স্থির; না কোনও মুখ, না কোনও পতাকা আমাদের সম্ভাষণ জানাবে; চলে যাও তোমরা তোমাদের আশাকে ধ্বংস করতে, মরুভূমিতে আমার আনন্দ-মাথা হেট করে আছে; প্রগতি এখানে বিবস্ত্র হয়ে গেছে। দালানের থামগুলো নগ্ন; মাঙ্গলিক কোনোকিছুই আর অবশিষ্ট নেই। কঠোর আর রুক্ষ অভিজ্ঞতাগুলো কোথাও কোনও আকারের জন্ম দিতে পারেনি। আমরাই পতন; আর কোনো অধীরতা নেই, কোথাও চলে যাবার দুর্নিবার আকাঙ্খাই শুধু, কাঙ্ক্ষিত রাস্তাটিকে খুঁজে পাওয়া, দালানটিকে চিনে রাখা কোনও চিহ্ন দিয়ে, সম্ভাষণ জানানো আপেল-নারীটিকে, আর যে পরিচারিকা মেয়েটি দরোজা খুলে দেবে, তাকে এই কথাটাই শুধু বলা : আজ নক্ষত্রের রাত।
‘শুভরাত্রি, শুভরাত্রি। তুমি কি এ পথেই যাবে?’
‘হায়! আমি তো চলেই গিয়েছি।’