যেভাবে জীবন: শব্দকে ছুঁয়ে থাকে শব্দরা । তমাল রায়
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২:০২ পূর্বাহ্ণ, | ১৮০৯ বার পঠিত
জলজ শব্দের কথাঃ- ঈপ্সীতা আমার কেউ নয়। হবার কথাও নয়। আসলে এই হওয়া না হওয়ার নির্দিষ্ট কোনো রূপরেখা না বুঝেই আমি হাঁটছিলাম। স্লিপ ওয়াক। আমার পায়ে লাগানো খরগোশের মোজা। আর চোখ লাল। হ্যাঁ,আমার চোখ খোলা থাকলেও আমি ঘুমোচ্ছিলাম। সচরাচর এমনটাই হয় এই সব নিস্তব্ধ যাত্রাপথে। সামনে থাকা দেওয়ালগুলো আমায় দেখে সরে যায়নি। যাবার কথাও না। অগত্যা যা হবার,ধাক্কা লাগলো দেওয়ালে। তবু থেমে যাইনি। আঘাতের স্থলে আহত হয়েও আমার পা নড়ছিলো,যেভাবে কেউ হাঁটে। কানে শব্দের কোনো অভিঘাত না থাকলে,পৃথিবীকে মনে হয় খুব শান্ত,আর আলপনা আঁকা স্বাগত জানানোর পথ। তবু কিছুতেই পেরোনো যাচ্ছিলো না,কিছুই। রক্তপাত হচ্ছিলো হয়তবা। হাত দিয়ে দেওয়াল সরাতে গিয়ে হাত হয়ে গেছিলো চ্যাটচেটে। আর দুর্গন্ধময়। আমার এই জীবনটা তেমনই পূর্বাপর পূতিগন্ধময়। আকাশে হয়ত মেঘ ছিল অথবা ছিল না। আমার কোনো রাজনীতি নেই বলে এগোনোর আগেই মনে হল বাতাস খুব ঠান্ডা আর দ্রুতধাবমান। মনে পড়ল সমুদ্রযাপনের কথা। পা’এ ঠেকছে জল। জলে নুন। আর কি যেন ছায়া করে কি তবে এলবাট্রস এলো আমাকে নিয়ে যেতে…কিছু পর আকাশে উড়তে থাকা মেঘ,ভেসে থাকা অবিষুব দুঃখ কে সাথী করে প্রথমে কিছুটা উঁচুতে,তারপর দুম করে জলে পড়ে যাওয়া। এই মোশন পিকচারের মত জীবনে আমি কেবল দুঃখের হাত ধরে নীচে নামতে লাগলাম। ওপরে উঠে আসতে লাগলো আমার শ্বাসাঘাতজনিত বুদ বুদ। আর লক্ষ্য করলাম আমার মত করে আমিই মাথায় টুপি,হাতে লাঠি,পিঠে রুকস্যাক,আর মাছের লেজের মত জুতো পড়ে সমুদ্রের অনেকটা নীচুতে ভেসে যাচ্ছি। এ হয়ত কোনো পর্যটন যাত্রা,যার আগে পরে সামনে পেছনে কেবল অজস্র সামুদ্রিক ক্ষত চিহ্ন। বস্তুত জীবন যেভাবে আমার সাথে এসে ভাব জমিয়েছে,তাকে গ্রহণ করার সেই মুহুর্তে মনে পড়ল বন্ধু দর্পণের কথা,আমি কাঁদলে সে অন্তত হাসে না। এতটা সময় বধির দুনিয়ায় কাটানোর পর হঠাৎ মনে হল কানে কিছু ভেসে আসছে…বিপ বিপ বিপ…
শব্দের প্রেক্ষিতে আমার বলা কিছু সত্য আর অভিঘাতের কথা বলার আগেই দূর থেকে ভেসে এলো ‘এট টু’। কে বললেন? কে? আর কোনো উত্তর নেই। অগত্যা যা স্বভাব। আলোর উল্টোদিকে হাঁটা,অন্ধকারের মধ্যে মিশে যেতে যেতে আমি তখন দরজা খুঁজছি,বন্ধ জানলা খুঁজছি,আর কিছুতেই পাচ্ছিনা। এর পরের দৃশ্যে আলোকে নিস্পন্দ রেখে শব্দের ভেলায় চড়ব। এনিওয়েজ আপাতত জলের অনেক নীচ থেকে আবার ভেসে আসছে বুদ বুদ। ভাস্কর ভাসছিলো আমার পাশেই। সে বলল প্রতিটি বুদ বুদের বিস্ফোরণ ক্ষমতা নাকি অসীম। অসীম আর সসীম আমার কাছে এক চিরবিস্ময় যেমন রবি ঠাকুর! অরণি কেন জানিনা জলের তরল আচরণের নিন্দে জুড়েছিলো। এই এক সমস্যা বাঙ্গালীকে নিয়ে যেখানেই যাবে নিন্দে আর মন্দ কূটকচালি। আর জলের নীচে মাছেদের কাছাকাছি ঘুরতে ঘুরতে আমি শুনে নিতে চাইছি মাছেদের ভাষা। প্রসঙ্গত বলে নেওয়া ভালো জলে শব্দের বেগ ১৪৩মিটার/সেকেন্ড। মানে এই গতিবেগ থাকলেই তবে মাছেদের মুখ নিসৃত অভিঘাত শব্দ তরঙ্গ হয়ে আমার কানে এসে পৌঁছতো। তারপর না হয় ইন্টারপ্রিটেশন। বলে নেওয়া ভালো আমার মাছ জন্মে প্রেমিকা ছিলো এসটনিশিং ঈপ্সিতা। নামটা শুনে কেমন জানি স্প্যানিশ মনে হল তাই না? ঠিক’ই। স্পেন উপসাগরেই হয়ত আমাদের প্রথম দেখা। অথবা প্রেমও বলা যেতে পারে। কেবল ভেতো বাঙালী তাই প্রেমিকার নাম ঈপ্সিতা করা হল। তো আমাদের যা করার ছিলো সে কথা বলি। জল আর জলজ যা কিছু তাদের অনুভবের বিবর্তনমূলক বস্তুবাদ। এ ছিলো আমাদের গবেষণার বিষয়। জলের বন্ধু জল হয়েছি,মাছের বন্ধু মাছ হতে গিয়ে দেখলাম গায়ে আঁশটে গন্ধ। ঈপ্সীতা কেন জানিনা বলছিলো বমি পাচ্ছে। বমির শব্দ জলে শোনা যায় না। যা যায়,তা আসলে দৃশ্যমান কিছু বমিজ অভিঘাত। জল খুব তরঙ্গায়িত হচ্ছিলো। আমি হাত ধরতে গিয়ে দেখলাম হাত নেই হাঙর। নিজের জীবন বাঁচানো শ্রেয় তাই পালিয়ে আসতে শুরু করি দ্রুত। বলা হয়নি ইতিমধ্যে দুটি তিন শতাধিক বছরের আদিম কাছিমের সাথে দেখা। তারা আমায় ইতিহাস শোনাতে আসছিলো,আমি থামিয়ে দিয়েছি। ইতিহাস মানেই তো বঞ্চনার রঙীণ কাঁহানীয়া। বলেছি রোসো। জলের গান শোনো- আমি একটা পাতার ছবি আঁকি,পাতাটা গাছ হয়ে যায়…মাথা নাড়াচ্ছিলো উপসাগরীয় বহু মাছের দল। সাথ দিয়েছিলো মস জাতীয় বহুজ গাছ। যাদের আদর করে শ্যাওলা বলি।… গাছটাকে ছাতা মনে হয়। উলালা,হুলি হুলি ব্যাং। বলার সাথেই এলো প্রথম প্রেম পত্র। বলাবাহুল্য ঈপ্সিতার নয়। সেতো টেকন ফর গ্রান্টেড। তার কথা না হয় পরে বলা যাবে। টাইটানিকের সেই জাহাজ আর তার শত বছরের শ্যাওলা পড়া দালান বা চিলেকোঠায় উঠে আমি আর সে,সে মানে তাহারা,নাচছিলাম। নাচ এক আদিমতম প্রবৃত্তি। দিবা রাত্রির কাব্য থেকে শ্রীচৈতন্যর হরে কৃষ্ণ সবের মধ্যেই প্রেম ও প্রেমজ খেলা এত মসৃণ,যে আমি অবাক মুগ্ধতায় কেবল হাত পা নাড়ছিলাম। মুশকিল হল কে একটা ডাকনামে ডাকলো। আর ব্যাস। বাঙালির যা স্বভাব। হড়কে গেলাম। এখন জলে সূর্যাস্ত হয়। আর আমি আর্জেন্টাইন ট্যাঙ্গো নাচতে নাচতে বোর হেসের দুর্বোধ্য গপ্পো শোনাই প্রেমিকাদের। ওরা বুঝুক আর না বুঝুক আগ্রহ নিয়ে শোনে। আর,আমি অযাচিত পন্ডিত! সুড়সুড়ি দিই প্রেমিকাদের। বলাবাহুল্য জলে শব্দের বেগ ১৪৩মি/সেকেন্ড। এর কম হলে শোনা যায় না। এর অনেক বেশি হলেও শোনা যায় না। যেমন বোরহেস। যেমন এইসব অকিঞ্চিৎ প্রেমের কাহিনী। বলা হয়নি ঈপ্সিতাকে জল থেকে ওপরে নিয়ে গেছে কারা যেন। সে,আমায় খোঁজে। আর আমি পুরুষ ও প্রবঞ্চক যথারীতি। তাই উঠিনা। এবার আবার কানে এলো কয়েকটা তরুণী মাছ নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে এট টু। আমার কেমন ভয় লাগলো। উঠতে গেলাম জল থেকে। কিন্তু শ্যাওলার দল আমার পা জড়িয়ে ধরেছে। আর আমি আপ্রাণ উঠে আসার চেষ্টায়…
কি জানি কেন মনে পড়ল শব্দ যদি খুব দ্রুত গতিতে চলে তা সুপারসোনিক হয়ে ওঠে। আর শ্রাব্যতা থাকেনা। আর কোনো শব্দ নেই,অথচ কেবল বার বার ভেসে আসছে এট টু…উফফ! তাহলে এ শব্দটিই বা কি করে…বিশ্বাস কর আমি কোনো বিশ্বাসঘাতক ছিলাম না!
সহস্র শৈবাল দাম বাঁধে আসি তারে। তারস্বরে আমি চিৎকার করলাম। এবার ব্যাকল্যাশ! ঈপ্সিতা মজা পাচ্ছে খুউব। ওর কানে কি কিছুই পৌঁছাচ্ছে না আমার এই প্রবল অস্তিত্ব সঙ্কট???
নিশব্দের তর্জনীঃ-
উভচর জীবনের মজা এই,যে আমি জলেরও কুড়োই,ডাঙারও। কিছু সময় এমনও আসে যখন তুমি প্রেমিকার হাত ধরতে চাও,তাকিয়ে দেখবে সে দৃশ্যের ত্রিসীমানায় নেই। আকাশের দিকে তাকালে দেখবে ঘোর কৃষ্ণবর্ণে ছেয়ে গেছে সব। জলে পা রাখবে,দেখ জল শুকিয়ে কাঠ। এই যেমন মিশুয়াকে তাকিয়ে দেখছি আর সে আমায় দেখছে না। ব্যথায় ভরে গেল মন। দেওয়ালগুলোও কখনো সচল হয়ে চাপা দিতে আসে। এমনকি প্রবল ভয়ে আর্ত চীৎকার করতে গিয়ে দেখবে শব্দ বেরুচ্ছে না। তবু,ভরসা আর আত্মবিশ্বাসই পুঁজি…আর মনে পড়ল ‘তোমার শিক্ষক তোমার গতকালের করা ভুল’। আর,ভাবতে ভাবতে কখন যেন রাস্তায়…হঠাৎ ভেসে এলো
‘এট টু’! আপাতত এই ভূখন্ডে দাঁড়িয়ে যে দ্রুতগামী শব্দশৃঙ্খলা আমায় তাড়না দিচ্ছে, তা মূল ও বস্তুগত ভাবে ব্যাঙ্গাত্বক। অরণি বলছিলো চাকার কথা। মনে পড়ে যায় বিবর্তনের ইতিহাস। যাযাবর থেকে গোষ্ঠীবদ্ধতার কথা। আর ন্যায় নীতি সততা বা মরালের ইনফিলট্রেশন। আর কিছু ট্যাবু বা ইনহিবিশনের প্রসঙ্গও কিভাবে যেন এসে পড়েছিলো অজান্তেই। ভাস্কর বলছিলো বিচ্ছিন্নতার কথা। আর তখনই মেঘ করে এলো। আকাশ আবার কালো। প্রবল ঝড়। যে যেদিকে পারলাম আশ্রয় নিতে গিয়ে মনে পড়ল,ফেলে এসেছি তাকে। মিশুয়ার কথা। মিশুয়া জম্মান্ধ নয়। একটা হঠাৎ গাড়ি দুর্ঘটনা,আর থমকে যাওয়া জীবন। থমকায় না আদতেই যদি ইচ্ছে প্রবল তীব্র হয়। মিশুয়া থামতে চায়নি। এত সহজেই কি আর জীবনকে থামিয়ে রাখা যায়। আমাদের সাথেই সেও বেরিয়ে পড়েছিলো,আজ যেমন। এখন খুব লজ্জা লাগছে। আর ঝড় মাথায় নিয়েই বেরুলাম। দেখি মিশুয়া স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। একটুও ভয় পায়নি। একবারও দৌড়ায় নি। এই শ্যামলা আকাশের নীচে মিশুয়াকে বড় সুন্দর লাগছে। জীবন যেভাবে মানুষকে চেনায়,আর কি। আর মিশুয়া বলছে ওর অদ্ভুত দর্শনের কথা। ‘তোমরা যারা সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সুস্থতা নিয়ে এ পৃথিবীতে বাঁচো,তারা এত ভয়ে বাঁচো কেন জানিনা। আমার একটি প্রধান অঙ্গ অক্ষম। কিন্তু ভয় পাইনা দেখ। আমার দুর্ঘটনা আমায় অন্ধ করেনি। বরং চোখ খুলে দিয়েছে। আর,ভয় পাইনা। আর,আমি পালাইনা, আর পালিয়ে কতদূর যাওয়া যায় বল?’
উত্তর দিতে গিয়ে দেখলাম আমার মুখনিসৃত শব্দ প্রকৃতই মিশুয়ার কাছে পৌঁছাচ্ছে না। শব্দের মূলগত বৈশিষ্ট্য এই,যে ৩৩২মিটার/সেকেন্ড বেগে চললেই তা শ্রাব্য হয়ে ওঠে। আমার কন্ঠ নিসৃত শব্দ কি এই মুহুর্তে তার থেকে অনেক কম গতিতে চলছে? অসহায় লাগছে খুব। সততা,ন্যায় নীতি বোধ বা মরাল ঠিক কত বেগে প্রকাশিত হলে তবে তা দৃশ্যমান! শব্দ কি আদৌ দৃশ্যমান হয়ে ওঠে? ভাস্কর আর অরণি কোথায় কোন শেল্টারে জানা নেই। আমি চাকার সাথে বিবর্তিত লজ্জার ইতিহাসের কথাই ভাবছি,ভাবছি ট্যাবু বা হ্যাশ ট্যাগড ইনিহিবিশনের একলাপন,আর বিচ্ছিন্নতার নিরিখে এই প্রথম অস্পষ্ট শব্দদের,ভেঙে যাওয়ায় প্রবল ভয় পেয়ে হাত নাড়ছি তীব্র। কম্পন যদি অতিমাত্রায় হয় তা তৈরি করে স্পন্দন,আর স্পন্দন জুড়ে জুড়েই শব্দ। ক্ষমা চাওয়াকে কি কম্পাঙ্কে প্রকাশ করা যায়? কি করে বলব মিশুয়া ভুলক্রমে সরে এসেছিলাম। আদতে সরতে চাইনি। পালাতেও চাইনি। না’কি এই সব ভন্ডামী আর প্রতারণার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে বসে আছে প্রকৃতি নিজেই! মিশুয়াকি বুঝতে পারছে আমার কথা? এই অনুভবী ভালোবাসা? তাহলে ‘এট টু’ ভেসে আসছে কেন? এট টু বলতেই বা কতটা হার্ৎজ জরুরী ছিলো,হে শ্লেষ,তুমি কি প্রেমের থেকেও মহিমাময় তবে???
পাখীজন্মের অক্ষরযাপনঃ –
বৃষ্টির জল বল বা কাদা,এ সব কিছুর মিলিত উপাখ্যানমালা স্তম্ভিত উপক্রমণিকা। মা যখন গান গাইতেন আপন মনে। আমি পাশটিতে বসে থাকতাম ভিজে বেড়ালের মতই। তখনও আমার মধ্যে পুরুষ সত্ত্বার তেমন নির্বিকল্প প্রকাশ ঘটেনি। যা ভক্তির তাকে ভক্তি করতাম নির্বিবাদে। যা শ্লাঘার তাকে উপভোগ করতাম নিজ মাধুরী মিশিয়ে। দূরে ভো-কাট্টা শুনলে কাটা ঘুঁড়ির পেছনে দৌঁড়তে গিয়ে কত কত দৃশ্যকে উপেক্ষা করে গেছি,কারণ সে জীবন অনেক ফোকাসড। কেবল বিন্দুটুকু দেখা যায়,বৃত্তের বহিরঙ্গে অত মনোনিবেশের প্রয়োজন কি! কৃষ্ণা,কাবেরী গোদাবরী নিয়ে থোড়াই মাথা ঘামাই। আমাদের একটাই নদী। একটাই জীবন। আর একটাই লক্ষ্য বড় হওয়া। সেভাবেই একদিন ঘুড়ি ধরতে গিয়ে দেখা আকাশলীনার সাথে। বিলীন হবার মত আকাশ পেতে নিজেকেও তো প্রস্তুত করতে হয়। এই যেমন আমি মাথায় তেলের বদলে মাখি টুথপেস্ট। দাড়ি কাটতে ব্যবহার করি টিসু পেপার,আর শৌচকার্যে নারকেল তেল। আসলেই গুলিয়ে যাওয়া। জীবনে কিছুদূর যাবার পর দেখ,সব কিছু কেমন গুলিয়ে যাওয়া। কনফিউজড! আর,তবু পায়ের বদলে হাত চলছে,হেটমুন্ড ঊর্ধপদ,চলাটা রয়ে যায়। বাকিটা হাস্যরসময় অপরূপা স্লো-মোশন।
‘এট টু’…আপাতত শান্তির প্রেক্ষাপটে যা কিছু উড়াল। আমি শব্দটাই কি ফিকে হয়ে আসে দ্রুত যখন আমির বিস্তার ঘটে এ মহাশূন্যে। ধরা যাক এক সুউচ্চ পর্বতচূড়া থেকে আমরা ক’জন ঝাঁপ দিয়েছি অনিশ্চিতে। ধরা যাক সেখানে কবিতা আছে অথবা নেই। আর কি প্রবলতম টানে আমরা ঊর্ধমুখী। বাড়ি ফেরার পথে যেভাবে অনিশ্চিত আলসেমিতে হাঁটা,পকেট থেকে হয়ত পড়ে যাচ্ছে খুচরো কাগজের মত সময়।।সেভাবেই কিছুটা ওঠার পর,ভরশূন্য হয়ে গেলাম আমরা। এবার নিশ্চিত ভাসান,অথচ বিসর্জনের বাজনা নেই। আমার থেকে কিছুটা পাশে ভাসছে,আকাশলীনা। তার সমস্ত শরীর জোড়া নীল। বেশি নীলে আমার আবার চোখ ধাঁধিয়ে যায়। উড়ছে ভাস্কর। ভাস্কর আজীবন বলে চলেছে বিচ্ছিন্নতার কথা,নিঃসঙ্গ জীবনের পাশে সে বসিয়ে দিচ্ছে তুলসী গাছ। কিছু পর হয়ত ছোট পিসি এসে প্রদীপ জ্বালবেন। আর হাই তুলতে তুলতে মাথার ওপর হাত তুলে নিজেকেই অভয় দিয়ে সে হারিয়ে যাবে দ্রুত অন্য কোথাও। কিছু দূরে অরণি যৌনতার বিবর্তনকে সাক্ষী মেনেই সেও ভাসছে। আকাশলীনা কিছু বলেনি। সেই একমাত্র,যার মুখ জুড়ে হাসি,তাচ্ছিল্যের? না’কি সৌন্দর্য কখনও ভীতসন্ত্রস্তও করে তোলে? আপাতত এই বিস্তীর্ণ অসীমে আমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে গুণে চলেছি সংখ্যার অবতরণ…ক্রমিক অধোগামিতায় যা স্টপ ওয়াচের নামান্তর মাত্র। আর প্রতিটি ঘড়ির কাঁটা জুড়ে ভাসমান টেবিল। টেবিলে প্লাজমার মত সোমরস,আর মহাশূন্য বারটেন্ডারের মত আমাদের টেবিল থেকে টেবিলের দূরত্বে প্রবেশ করিয়ে দিচ্ছে প্রেম ভালোবাসা,অথবা ঘৃণা। দূরে বেশ দূরে আলোকে দেখছি নদীর মত গভীর,অথচ বহমান,আলো ক্রমে কমে আসছে,নেশা বৃত্তের এ হ্যাং ওভারে কাট টু দ অরিজিনাল,একটা শিশু দৌড়ে আসছে সে কিছু বলছে,কিন্তু কানে আসছে না। সে কিছু ছুঁতে গেলেই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে,আর এসব দৃশ্যে বড়ই অনভ্যস্ত আমি। যেমন গলির মোড়ে ইলেক্ট্রিক ট্রান্সফর্মারে আগুন লাগলে হতচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে, কিংকর্তব্যবিমূঢ়,তেমনই! আলো দপ দপ করে নিভে গেল,হাত পা নাড়ছিনা। অথচ ভেসেই…এভাবেই কি গান ভাসে,তবে কি এফর্টলেস এই ভেসে থাকাই সমাজ! প্রশ্নটা করার আগেই দেখলাম আমি একা,ভাস্কর অরণি আগেই দৃশ্যের বাইরে চলে গেছিল। কেবল আকাশলীনাকেই লক্ষ্য করে আমি এগিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাসমান ছোট মেয়েটির হাতে ফুল দিয়ে বলেছিলাম আকাশলীনাকে পৌঁছে দিতে। সে অন্তত বুঝতো প্রেম। আর,আমি নাবিকের মত,মেঘের মত,প্রেম হয়ে দিক নির্ণয় করতে করতে ঠিক স্পর্শ করতাম আকাশলীনার হাত…সে বুঝতোই এই পৃথিবীর অন্য প্রান্তে এখনও মানুষ ভালোবাসতে জানে,কিন্তু কি হল কে জানে,কেউ কোথাও নেই। আর আমি খুব জোরে আ..কা..শ..লী..না বলে ডাকতে গিয়ে দেখলাম শব্দ স্থির,মনে পড়ল,শব্দের বহমানতা মাধ্যম নির্ভর। শব্দের অভিষেকে শূন্যে অন্তত নৈব চ। এই কি সমাজ? তা এখানে কই? কিন্তু ল্যাব ডুপ কোথা থেকে তাহলে ভেসে আসছে ভেসে আসছে ‘এট টু’…আমি গলির গলি তস্য গলি থেকে রাজপথে আসতে গিয়ে দেখি পথ হারিয়েছি,আর সেই মেয়েটা খুব হাসছে,কেমন সারা শরীর জুড়ে কাঁপুনি শুরু হল। ভয় করছে ভয়। ভয়ই বোধহয় পৃথিবীর আদিমতম অনুভব। নেমে আসছি দ্রুত। কিন্তু কোথায়? আকাশলীনা দেখলাম অনেকটা ওপরে দিব্যি রাজহংসীর মত হাসতে হাসতে উড়ছে,না আমার দিকে তাকায়নি,তাকায় না!
দীর্ঘশ্বাসের তর্জ‘মা’
আমার দিনগুলো সব নিথর নিস্পন্দতা নিয়ে দূর গাঁয়ে বসে যখন দীপাবলির রাতে ঊর্ধমুখ আকাশে,তখনই রেশমের চটি পড়ে,গায়ে অমলতাস মেখে তুমি চলে যেতে। আমি হলফ করেই বলতে পারি,এক জন্ম কেন বহুজন্মেও আমার মত করে কেউ তোমায় দেখেনি। সূর্যাস্ত থেকে কিছুটা লাল এনে তোমায় দেবার পর যেই তুমি গালে মাখলে,আমি তাজমহল,ময়ূরসিংহাসনকেও অস্বীকার করে বললাম,আমার দেখা সেরা নিসর্গ তুমিই। আর তেমন কিছুরই আমার প্রয়োজন ছিল না বলে বুকপকেট থেকে পড়ে যাওয়া পয়সাও আমি কুড়াইনি। অর্থের কাছে নীচু হতে নেই,তোমার থেকেই শেখা। জীবনের কাছেও নীচু হতে নেই,হাঁটু গেড়ে বসতেই পারো। কারণ তা প্রার্থনা। আর,প্রার্থনা দুনিয়ার সব উচ্চ নীচের কাছেই সাম্যের দাবী রাখে। তুমি বলেছিলে বলেই এই প্রবলতম নৈশব্দে একা,ঈশ্বর বা দানবের মতই আমি আকাশের দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে,ভিখিরির সাম্য গানে কেবল যে টিক টিক শব্দ তার তাতে হাত সেঁকে পা বাড়িয়ে দেখি তোমার সমগ্র আঁচলটাই আকাশ,আর তাতে থোকা থোকা জোনাকির জ্বলা আর নেভা কি করে যেন মাথায় একটা আকাশ ঢুকিয়ে আমায় ডাকতে লাগলো। আর নিশিতে পাওয়া পাগলের মত আমি তোমাকেই খুঁজছি মা। কারণ তুমিই আমার মা। আমার শৈশবের প্রথম প্রেমিকা।
সুচেতনা,তোমায় যে কথা বলা হয়নি আগে,সে কথা বলতেই এত দূর প্রস্তাবনা। এই আমি আসলেই এক ভাগ্য বিড়ম্বিত বৃদ্ধ হয়ে খনিজ কুঠুরিতে বন্দী। বলা হয়নি আমার সমস্ত চিঠিও আর তোমার কাছে পৌঁছয় না। পথে ট্রাফিক সিগনাল অনেক,আর বালি হাস হেঁটে যাচ্ছে টিক টিক টিক। অনিয়ন্ত্রিত এই সব হাসেরা কখনও সময় হয়েই হাক্লান্ত ক্লাউনের ভঙ্গিমায় তর্জমা করছে অনুভবের। আমার সেই সব অনুভব,যা টেক্সচার ও কনটেন্টে মৌলিক,কিন্তু আমারই। সেই ভোরবেলাগুলো খুব মনে পড়ে,চোখ খুলতেই ভেসে আসতো আলোর ঝাপ্টা। আর জ্ঞাত অজ্ঞাতর সীমানা ছাড়িয়ে বাইরে বাজছে ভোর।
রাই জাগো রাই জাগো শুক-সারি বলে
কত নিদ্রা যাও গো রাধে শ্যাম নাগরের কোলে…
আর জানো সকালগুলো প্রভাত হয়ে উঠতে মায়ের হাতের অলৌকিক স্পর্শের কি অদ্ভুত তীব্র স্নেহ বিচ্ছুরণ! বাবা অফিস যেত,সাদা ধুতি পাঞ্জাবি। দিদি ইস্কুল। আর আমি সারাটা সকাল জুড়ে কি কারণে জানি ছুটে ছুটে বেড়াতাম ঘর থেকে ঘর। পরে অনেক পরে বুঝি ঘর আসলে চারটে নিস্পন্দ দেওয়াল,দেওয়ালি নেই কোথাও। তাহলে মা কি করে কাটালো অতগুলো বছর ওই চার দেওয়ালের মাঝে! না’কি সেখানেও খুঁজে পাওয়া যায় অনির্বচনীয় কিছু আলোক উচ্চারণ যা মাকড়সার জাল হয়ে ঘরের সিলিং এ ঝুলে,আর সে দিকে তাকিয়েই তেল হলুদ আর শাঁখা সিঁদুরের সহবাস।
নিজের দিকে তাকিয়ে নিজেরই গালে হাত রাখতে যেদিন চমকে উঠি,বুঝি উখিমঠ বল বা লাহুল স্পীতি,পুরোটাই তামাম যুদ্ধক্ষেত্র। কেবল সবুজ খাঁকি উর্দির বিচরণে ঢেকে যাচ্ছে সবুজ শ্যামলীমা। পাহাড়ি বস্তির দরজার বাইরে থাকা,রংবেরঙের ক্যাকটাস ফুলকে ঢেকে দিচ্ছে মিলিটারির পায়ের বুট। আর তীব্র হুইসেলের শব্দ ভেসে আসলে মাথা বাঁচাতে বাঙ্কারে আশ্রয়। বাঁচতে হবে তো বল,নইলে বাকি থাকা যুদ্ধের বিবরণী কি করেই বা লিখবো। চোখের জলগুলো জানো সে কবেই শুকিয়ে কাঠ। কেবল দাগ থেকে গেছে এখনও। আর,ঘুম। একটা নিদাঘ ঘুম দাগ কাটতে কাটতে খুঁড়ে ফেললো মাটি। সুসজ্জিত কফিন এলো। ডালা খুললো,বন্ধ হল। ওপর থেকে ফুল ছড়িয়ে দিলো ভাস্কর,অরণি,আকাশলীনা,মিশুয়া,ঈপ্সীতা,তিনি যিনি কখনও আমায় সহ্য করতেই পারেন নি,সেই বিয়ের পর থেকে,এবার ছোট্ট পুপে আসছে…ওমা পুপে কে কারা যেন সরিয়ে নিলো। আর আমি সিঁধিয়ে যেতে লাগলাম অনেক নীচের সেই খনিজ কুঠুরীতে। নিজের শরীরে হাত রাখতেই চমকে উঠলাম। আমিই তো! মাথার চুল গুলো স্থির তড়িতাগ্রস্ত হয়ে খাড়া,সারা শরীরে বিদ্যুৎ চলছে যেন,আর কোথা থেকে সেপিয়া টোনের মত জল গড়িয়ে পড়ছে চুঁইয়ে চুইয়ে…বৃদ্ধ মাকড়কসার মত আমি স্থির অথচ দৃশ্যের বদল ঘটছে দ্রুত। কখনও মা রান্না করছে হলুদ আর নুনের গন্ধ,গন্ধের কোনো শ্রাব্যতা থাকে? বাবা বই পড়ছে,খোলা পাতাগুলো উড়তে উড়তে ঝরে পড়ছে দ্রুত। দৃশ্যের কি শ্রাব্যতা আছে? মস্ত একটা কেবল কারে করে কারা যেন আসছে,আবার কারা চলে যাচ্ছে,এই যে আসা যাওয়া একে কি শব্দের অনুরণনে ব্যাখ্যা করা যায়? বুড়ো তালগাছটা আমার দাদু। তার গুঁড়িতে ঠোক্কর মারছে কাঠ ঠোকরা। কিন্তু শ্রাব্যতা নেই। আবার কেন জানিনা আকাশ ঘিরেছে জলপাই রঙ। উড়ে আসছে শয়ে শয়ে বোমারু বিমান। শুনেছিলাম ধাতুতে শব্দের বেগ ৫৪৩মি/সেকেন্ড। অথচ এই খনিজ বাঙ্কারে কেবল উষ্ণতাই। আর নি:শব্দ অশ্রুর বহমানতা। এসব অশ্রু কি তোমার দেখা যে কোনো গ্রীক মহাকাব্যের আঙ্গিক মনে পড়ায়? জানিও। অবশ্য কাকেই বা জানাবে,এখন কলঘরে অবিরাম জলের পতন,আর নিঃশ্বাস যা নাকি আজীবন সঙ্গী আমার,সেও লাস্ট লোকাল ধরে চলে যাবে ক্যানিং কিংবা হৃদয়পুর। আবার কেউ জন্মাবে। তার হাতে চকোলেট তুলে দিয়ে আমি অনির্বচনীয় ট্রাফিক কনস্টেবল হয়ে সিগনাল লাল থেকে সবুজ করে বিশ্রাম নেবো,আর তখন হয়ত বৃষ্টি আসবে আবার,অথচ জেনো আমার একার দ্বারাই এত সমস্ত মঙ্গল কাব্য রচিত হয়নি কখনোই। চড়াইপাখিটা ঠোঁটে করে নিয়ে চলেছে কবর স্থানের শুকনো ফুল। কি জানি কেন মনে পড়ল শব্দ যদি খুব দ্রুত গতিতে চলে তা সুপারসোনিক হয়ে ওঠে। আর শ্রাব্যতা থাকেনা। আর কোনো শব্দ নেই,অথচ কেবল বার বার ভেসে আসছে এট টু…উফফ! তাহলে এ শব্দটিই বা কি করে…বিশ্বাস কর আমি কোনো বিশ্বাসঘাতক ছিলাম না!
মা,তুমিও কি শুনতে পাচ্ছো না,আমার শব্দদের। এমন কি এই ‘মা‘ ডাক এরও কি কখনোই কোনো দৃশ্যগ্রাহ্যতাই নেই,তুমি নিশ্চিত! আর ওই যে বেলুন ওড়াতে ওড়াতে যে,শিশুটি উড়ে যাচ্ছে আকাশে,তার ক্রন্দনধ্বনি ও কি দৃষ্টিগ্রাহ্যতার বাইরে? তাহলে এ কেমন আধুনিক সভ্যতা বল! মা,হে শব্দ,অনুরণন এ সমস্ত কোনো কিছুরই কোনো উত্তর নেই আজ কোথাও???
এট টু….