মনখারাপের নেপথ্যপট- একটি ফিউশন জার্নি । পিয়ালী বসু
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১:৪১ পূর্বাহ্ণ, | ১৪৭৪ বার পঠিত
“She had always wanted words, she loved them; grew up on them. Words gave her clarity, brought reason, shape.”
-Michael Ondaatje, The English Patient
পুজো প্রায় সমাগত ।
এসময়টা ঝুমঝুমে এক মাদকতা গ্রাস করতে থাকে। শব্দের যত কৌশল তুমি শিখিয়েছিলে, সে সবকিছুই আজকাল চামড়ার দস্তানার ভিতর গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে থাকে, অভিমানী’ তারা বড্ড বেশীই, তবুও প্রতি রবিবারে ধুলো ঝেড়ে একবার কথা বলি তাদের সাথে, যদি অভিমান ভাঙে… এই আশায়।
এ শহরে অবশ্য পুজোর কাশফুল গন্ধ নাকে এসে পৌঁছায় না, বরং রোদের রেখাব থেকে চুইয়ে পড়ে মনখারাপ… “Have you ever been to a place, you’re supposed to love, but all you can think about is home ?
বদলাচ্ছে সবকিছুই,… চিরচেনা শহর, তার প্রত্যন্ত গলিঘুঁজি, আশপাশের মানুষজন, পুরনো চেনা অভ্যাস… বদলাচ্ছে সবকিছুই,… এ সময় সত্যিই আজ অচেনা, অজানা… জীবন পাল্টাচ্ছে, বিশ্বায়নের স্পন্দন শ্বাসে।
খুব ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। প্রথম সন্তান বলে আদুরে আহ্লাদে কেটে গিয়েছিলো শৈশবের ঐশ্বরিক সময়টা। ভরা সংসার ছিলো আমাদের, বাবা -মা, ভাই- আমি আর ঠাম্মা। দেশপ্রিয় পার্কের বাড়িটা ঘিরে সেসময়ে অনিবার্য স্পর্শসুখ… আনন্দীকল্যাণের প্রিয়তর সুর।
অনুভবে অনুভবে আমার স্মৃতিপটে ফিরে আসছে সেই দিনগুলি, যখন দুষ্টুমিগুলিকে স্বযত্নে লুকিয়ে রাখতাম লেপের নীচে, ওমে তাতিয়ে আবার বার করতাম পড়ন্ত বিকেলে… “টমবয়’ এ মেয়ের কিছু হবে না, পাড়ার ছেলেদের সাথে ক্রিকেট খেললে জীবন চলে কি ? “এমন কতশত উড়ো কথার খই ফুটছে এদিক সেদিক, আর বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা বছর বারোর মেয়েটির কানে ফিসফিস করছেন বাবা, “তুই ‘ তুই’ই বাবাই, খেলবি, অবশ্যই ক্রিকেট খেলবি, যা মন চাইবে, সব করবি আর মন থেকে যা করবি, তার জন্য আফশোস করবি না ।”
এ শুশ্রূষা মন্ত্র আজীবন সঙ্গে রেখে দিয়েছি, … নিভে যাওয়া আর আলোকিত দিনগুলিতে অন্যতর এক অপেক্ষা সাক্ষী রেখে।
২
আমার ভেসে বেড়াবার আকাশ, আমার দারুচিনি দ্বীপ, আমার নীল আসমানি শাড়িটা আর আমার ভীষণ প্রিয় সেই জার্মান পুতুলটা,… সব শামুকের মতো বুকে বিঁধে আছে আজও, মাঝেসাঝে ফুরসতের দিনরাত্রিগুলিতে সেগুলিকে বাক্স থেকে বার করে উল্টেপাল্টে দেখি… সমস্ত শহর যখন আষাঢ়ের মেঘমল্লারে হিল্লোলিত, সেসময়ে আমি বাস করি, কুয়াশার নির্মোক একাকীত্বের সাথে।
ঝড় উঠলো।
মায়ের ছবিটির সামনে বসা আমি। ধুপের নিভৃত রং আস্তে আস্তে ফিকে হচ্ছে, কথার ভগ্নাংশ ঘিরে ভারাক্রান্ত হচ্ছে মন, গভীরে, আরও গভীরে গেঁথে বসছো তুমি।
চার বছরে ভর্তি হয়েছিলাম স্কুলে। মেঝেতে মাদুর পেতে বসা ক্লাসে আমার প্রথম বন্ধু ছিলে তুমি, শব্দের নির্যাস ছুঁয়ে কি করে তাকে যাপন করতে হয় অন্তরে, সে তো তোমার কাছেই শেখা।
আজকাল সন্ধে হয় নির্ধারিত সময়ের আগেই। বহির্মুখীনতা ছাপিয়ে, মায়াময় বিস্তারে ছেয়ে থাকে মেলাঙ্কলিকারা, আলোছায়া ভ্রূণকল্পকথা কবিতা’ হয়ে ওঠেনা প্রায়শই, তবুও কি আশ্চর্য অবলীলায় দীর্ঘ চিত্রকল্প হয়ে থেকে যাও তুমি, এইসব আকালের দিনেও।
তখন ক্লাস সেভেন।
সাবালিকা হচ্ছি আস্তে আস্তে আমি, অঙ্ক ক্লাসে বইয়ের ভাঁজে চিঠি আদান প্রদান, মাঝে মাঝে আঙুল ছুঁইছুঁই নাতিদীর্ঘ আশ্লেষ… তুমি’ তখন অভ্যাস ‘আমার, প্রেমিক বন্ধু’র চেয়েও বেশী।
খবরটা এসেছিলো অপ্রত্যাশিত ভাবেই ।
ঘটনাটিকে সাম আপ করলে এটুকুই বলা যায়… “It was like the nightmare served totally dipped into day dream..”
আজকাল ব্যথার কারুকার্যের কাছে নতমুখে স্বীকার করে নিই, অকালে ছিড়ে যাওয়া সুতোর প্রকাশ দাগ। সেদিনের পর থেকে, মার্জিনে মার্জিনে ঘেঁষাঘেঁষি হলেও, জন্ম আর মৃত্যুর সংজ্ঞা বদল হয় খুব সহজেই। আজকাল অপ্রাসঙ্গিক হাওয়া দেয়, মাঝ বিকেলে… রিখটার স্কেলে নিম্নগামী উষ্ণতার পরিমাপ মাপতে গিয়ে, শিরদাঁড়ার ভগ্নস্তূপে বেঁধে দিই উড়তে ভুলে যাওয়া একক পাখিটিকে।
সন্ধে হয়।
সংকেত লেখা মাইলস্টোনের পাশে নিভৃত দূরত্বে পড়ে থাকে বন্ধকি সম্পর্কের অকাল প্রয়াত মিথটি। জীবনকে গতের নিয়মে বেঁধে ফেলা যায়না, উপচে পড়া সস্তা হাসাহাসির সাথে মুঠো ভরে তুলে আনতে হয় পরকীয়া দুঃখবোধও। আঙুলের খোলস সাড়া না দিলেও কাগজে ‘মরবিড’ লিখতে হয় আর ভাসাতে হয় শব্দরাজিকে… হলুদ- কমলার দেবীপটে।
তোমাকে চেনা হয়নি আমার। ঘুমপাহাড়ের দেশে তোমার যাত্রাটা হয়েছিলো চুপিসারে, অতর্কিত আচম্বিতে… বুঝে ওঠার আগেই, জানার সংকল্পকে ঢেকে দিয়েছিলো সময়’, ফলে অসমাপ্ত বিভ্রমের মতো আমার শরীর জুড়ে প্রোথিত হয়েছিলো নামহীন এক হাওয়া -অসুখ ।
৩
ফুসফুসে আজ অনিবার্য কার্বন
ছায়ার গভীর থেকে উঠে আসে যে ছায়া
পোস্টম্যানবিহীন এই শহরের ডাকবাক্স
তাকে ‘বিষাদের অলীক পার্বণ’ নাম দিয়ে বিলি করে জমে থাকা মনস্তাপ
গতিশীল জীবনের গীতবিতানে, হৃদয়’ কষ্ট পায় সবচেয়ে বেশী… ঋতুর দ্বিতীয় প্রহরে, নামহীন শহরের দক্ষিণমুখো অবিচুয়ারি ঘেঁষে, ধ্বংস ও কৌতুকের সামনে স্তব্ধ হয় এ হৃদয় ‘ বারবার ।
অথচ, এমন হওয়ার কথা ছিল না, আলো ভাসানের স্নানে যাওয়ার কথা ছিল আমারও, কিন্তু ধারালো সভ্যতার ক্রমিক শুষ্ক স্তম্ভন ঘিরে, যে অন্ধকার ছেয়ে আসে, তাকে প্রতিধ্বনির মধ্যে ডুবিয়ে দিয়ে তৈরি হয়… অভিযোগ ও ইচ্ছের এক অদৃশ্য কোলাজ।
হারিয়ে যাওয়ার যে গল্পটার সাথে আমরা প্রত্যেকেই প্রায় অল্পবিস্তর বাস করে থাকি, সেই গল্পটা… প্রতীয়মান’ হয়ে ওঠার কথা ভাবলেও শেষমেশ, উচ্ছিষ্টের চিহ্নমাত্র হয়ে থেকে যায়।
সকলে বলেন, নৈঃশব্দ্য আমাকে ঘিরে থাকে, গোপন নিঃশ্বাসের মতো… জড়িয়ে থাকে পড়ন্ত রোদে, পুরনো বাক্যে, আজানের শেষ সুরে। আসলে যে শব্দের ভার আমাকে প্রায় বধির করে রেখেছে, সেই শব্দকেই ভালবেসে কোন এক নিরুচ্চার বিকেলে শিখেছিলাম,… ভাষার উড়ান’ তৈরি করা… অথচ দেখো, আজ বিশ্বাস’ লিখতে খরচ করে ফেলি দু-তিন ফর্মা।
বিচ্ছিন্নতাবোধই আদতে শব্দ’ তৈরি করে… তাই কয়েক দশক আগে, তোমার ‘নেই হয়ে যাওয়া’র ঠিক একমাস পর, দৈনন্দিন যাপন থেকে… একটু একটু করে জড়ো করে রেখেছিলাম, পুষে রাখা প্রতিধ্বনি… তখন আমাদের সম্পর্কের ঘনত্ব মাপা হচ্ছিলো রঙচটা সিসমোগ্রাফে। কোনো এক মেঘ-ভাঙা বৃষ্টিতে, তুমিই তো এসে হাত ধরেছিলে। আমায় ঘিরে থাকা দুঃখের বিস্ফার আলোকিত হয়েছিলো সেদিন, “We don’t remember days, we remember moments.”
আজকাল মৃত্যু নামে সূর্যমুখীর অলীক সাজে, দিন শেষের প্রাত্যহিকতায়, আজকাল আর অপেক্ষা করি না বিগ-ব্যাং মুহূর্তের, বরং… অপূর্ণতার সঙ্গে আত্মীয়তা পাতানো জীবনে শব্দই’ একমাত্র রিদমস্কেপ’ হয়ে দেখা দেয়, তুমি আলো ‘হয়ে জ্বলে ওঠো শব্দের স্প্লিন্টারে।
জানলার ঠিক বাইরে অবিশ্বাসের যে ঋজু ছায়াটা দিনরাত দৃশ্যমান হয়, তাকে ছোঁয়ার আগেই, দৃষ্টির অনিবার্য বিভ্রমে, তার মসলীন অবয়বে খুঁজে পাই, হারানো শৈশব কে ।
জীবনের মলাটের ভেতর যে গল্প লেখা হয়, সেখানে আবির্ভাবের ঠিক পাশেই শুয়ে থাকে প্রস্থান’, আর আমরা এই গল্পটাকে ‘দ্য লাস্ট জাজমেন্ট’ নাম দিয়ে… অতিক্রম করি শব্দের আরও এক কবোষ্ণ ঋতুবন্ধ ।