শব্দরা কালো কাক, কেবলই বিষণ্ন উড়ে যায় । রোমেল রহমান
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১২:১৮ পূর্বাহ্ণ, | ১৮১৩ বার পঠিত
লম্বা লম্বা জরির ফিতার মতন বৃষ্টি। কিংবা কনকনে শীত। আগুন তাপাতে বসে থাকি আগুনের পাশে। কিংবা ছ্যারাব্যারা গরম, যখন ঘামে ক্লান্তিতে অসহ্য হয়ে ওঠে পরাণের কার্নিশে কাঁপতে থাকা একখানা পংতির আশ্বাস। এরকম হয়। আসলে এরকম হতে হয়। বুকের রেহাল খুলে বসে আছি কিন্তু কার্পাসের মতন একটিও শব্দ নামে না। শব্দরা সময়ে সময়ে মশকরা করে, আমোদ নেয়। আসলে তাদেরও আমোদ নিতে বাঞ্চা হয়। হওয়াই উচিৎ! নইলে যখন ঝরনার মতো নামে কিংবা বালিকার অভিমানের মতন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বিস্ফারিত হয় সেই সব মুহূর্ত গুলোর সাথে লেজ হয়ে এরকমও মুহূর্তও আসে যখন শব্দরা গোমরাহ হয়ে ঝুলে থাকে বাদুরের মতো। আমরা কেবল দেখি। বুঝি সে আছে। সে উড়েও যেতে পারে আবার ফল ভক্ষণ শেষে তার মৃত্যুও হতেই পারে।
শব্দরা ধরা পড়বার পর তার প্রকৃত মৃত্যু বা জীবনের সূচনা হয়। প্রতিবেশী শব্দের সঙ্গে জড়িয়ে বা সংঘাত ঘটিয়ে কিংবা সম্প্রীতিতে বেঁধে তার জন্ম মৃত্যু নির্ণীত হয়। যা আমার কাছে সৌন্দর্য তা অন্যের কাছে বিরক্তিকর হয়ে উঠতেই পারে। আসলে ওঠাটাই স্বাভাবিক। পাঠক আর লেখক কখনোই এক ঘরের জীব নন, বারান্দা হয়তো এক, তারা আলাদা; তাদের আলাদা থাকাটাই প্রয়োজন। লেখকের পাঠ আর পাঠকের পাঠ ভিন্ন যেরকম।
লেখক যতো শব্দ সারাটা জীবন ভরে খাতার পাতায় লেখে তারচেয়ে কয়েকগুণ উবে যেতে দেয়। সেইসব শব্দরা গাঁথা হয়, বোনা হয় তার করোটির সুড়ঙ্গ দেয়ালে। যেন এইসব নির্মম খেলা তার। পাশবিক আনন্দ হয়তো। তবু তাদেরকে উবে যেতে দিতে হয়। হয়তো শ্রেষ্ঠ পংতি কিংবা বিস্ফোরক শব্দ তবু তাকে ছেড়ে দেয়ার নেশা করুণা নয় বরং ব্লেড দিয়ে চেরা নরম নরম রক্তের আনন্দ। কেননা লেখক তো সেটা রচনা কয়ারা তৃপ্তি পান গোপন অনুরণনে পরাণের আন্ধার গুহায়। সে আনন্দ মুদ্রিত প্রকাশিত লেখার হাততালি আর বিক্রির থেকেও এক সূক্ষ্ম বেদনাঘন সুখ, যা কেবল লেখক একাই পান করতে পারেন অদৃশ্য সঙ্ঘরামের পৈঠায় বসে। শব্দকে উবে যেতে দিতেই হয়; কেননা দুর্বল আপাত সরল কিংবা সস্তা বা যেটা শেষমেশ লেখা হয়ে ওঠে সেই শব্দ গুলোকে আসবার পথ করে দেবার জন্যই। আসলে প্রকাশিত লেখার পেছনে অপ্রকাশিত বেদনারা কেবলই লেখকের সঙ্গি হয়ে থাকে। বাকিটা পাঠক লুফে নেয়। লেখকের নিজস্ব বলে শেষমেষ কিছুই থাকে না শূন্যতা ছাড়া। শব্দ তাকে অবলম্বন করতে হয় পৌঁছাবার নেশায়, আর পৌঁছে যাবার পর সাঁকোটা পেছনেই পড়ে থাক, তখন নতুন শব্দের ডানায় ভর করে তার আবার উড়ে যাওয়া।
কেবলই তাকিয়ে তাকিয়ে বিহ্বল দেখা, কালো কালো হরফের মত কাক নেমে আসা যেন, সন্ধ্যার ডালে বিষণ্ণ বিবশ ক্লান্তির পাতায়। সমগ্র ডানায় তার পর্যটনের ক্লান্তি। নরম সুখের মতো পালকে হঠাৎ খুঁজে পাওয়ার আনন্দ। আর ঝিঁঝিঁর ঘুমের মতো জেগে থাকবার এক নেশা। দলে দলে ভরে ওঠে অংকিত সফেদ পাতায়। ফলে নির্মাতার মৃত্যু হয়। হারাবার বেদনা নিয়েই তার ঘুমুতে যেতে হয়। নির্মিত শব্দের কোলাহল থেকে সে ফিরে যাবে কি করে পূর্বের তৃষিত প্রান্তরে এক হারিয়ে হাওয়া দিকভুলো মানুষের অস্থিরতায়…
কবির দক্ষতা বা সীমাবদ্ধতা ঐ শব্দ গ্রেফতার করাতেই। শব্দ নিংড়ে তাকে বাঁচতে হয়। শব্দই তার আশ্রয়। যেরকম শিশুরা ফিরে আসে শেষমেশ বিশ্বস্ত ক্রোড়ে তেমন এক ফেরা, নাকি পৃথিবীকে ফিরিয়ে দেয়া বেঁচে থাকার পিপাসায়। কিংবা সে কি তার অন্তর্গত প্রকৃত উচ্চারণ শব্দে জানান দিতে চায় শেষমেশ? হয়তো চায় কিংবা চা না! এখানে ‘হয়তো’ শব্দটা গুরুত্বপূর্ণ, কেননা ‘নিশ্চয়তা’ শব্দের মধ্য দিয়ে আমরা যেখানে পৌঁছাই, সেটাই শেষ নয়। মানুষকে অস্বীকার করবার উপায় নেই; আসলে মানুষকে অস্বীকার করা মানে শব্দকে অস্বীকার করা, শব্দ মানুষে মানুষে ভীষণ ভিন্ন উস্কানি দেয়। তাই ‘আপাত নিশ্চয়তা’ থাকতে পারলেও ‘নিশ্চিত বা নির্ঘাত নিশ্চয়তা’ আছে কিনা ভাবা দরকার। কেননা পুরো ব্যাপারটাই একটা দখলদারিত্বের লড়াই। চিন্তার দখলপনা। যা হাওয়া জলের সঙ্গদোষে ছড়ায়। ঘেরাটোপ এঁকে দেয় চরাচরে, অধিক শক্তিশালী হলে, সেই চিন্তারা আধিপত্য নেয় সীমানা ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে। আর সে পৌঁছায় শব্দে সওয়ার হয়ে, এক ধ্যানী দস্যু বা প্রেমির লেবাস নিয়ে। শব্দ তবে কি ভেকবাজি? মূলকে সে বয়ে নেয় বর্ণের আবডালে, আর শব্দের আবডালে বাস করে কবির হৃদয়। সেই ছাদনা তলায় বসেই তার পোহাতে হয় ‘পার্থিব’ নামক একটা সময়কাল। যেখানে চেতনে বা অচেতনে তাকে ফাঁদ পেতে বসে থাকতে হয়, কিংবা সে নিজেই হয়তো ফাঁদ; তাকে দিয়ে ধরানো হচ্ছে তামাম শব্দের ঝাঁক যার মধ্যে আছে সেই স্বর্ণবোয়াল। ঋষিদের জামানার থেকে আজ পর্যন্ত তামাম শব্দকর্মীদের বয়ানও ছোঁয়াছুঁয়ি খেলে, একাকার হয়ে আসে আজ এবং আগামীকাল। একটা সিঁড়ির সীমানা পেরলেই বেদনার মিল খুঁজে পাওয়া যায়, তখন কি ঘরানায় নিবন্ধন?
গদ্যের শব্দ আর কবিতার শব্দরা আলাদা। গদ্যে প্রকাশিত আর কবিতায় অবগুণ্ঠিত। শব্দ বহুরুপা। শ্লোগানে সে বিস্ফোরক, স্ত্রোত্রে সে ধ্যান, সুরের হাত ধরে আবার অন্য!
আমরা কে কি হতে চেয়েছিলাম সেটা স্থির হয়ে যায় তখনই যখন আমরা সবাই শব্দের গুপ্তগন্ধে উন্মাতালা কিশোরের মতন ব্যথার্ত এক জীবন পোহাই। যেখানে শব্দ জড় করতে করতে একটার পর একটা প্রতিমা নির্মাণের প্রলোভন আমাকে বা আমাদেরকে অব্যাহতি দিতে নারাজ। কিংবা যখন নিস্তার পেয়েছি মনে হল তখনও জানি প্রকৃত আদল আঁকা হয় নাই! সেই ফাঁকি কিংবা অদক্ষতার গোপন সংবেদ চাপা রেখেই একদিন শব্দময়তার এই সঙ্ঘরামে নীরবতা নামে কিংবা ছেঁদ তৈরি হয়। আসলে শব্দ থেকে শুরু শব্দে শেষ নাকি নৈশব্দে আরেক শুরু সেইসব জানতে পৌঁছাতে হয়। লাখেরাজে দিতে হয় জীবন। নিজেকে পৌঁছে দেয়ার আকুলতা, আমি যা জেনেছি, যা অনুভব করি কিংবা আমার অবচেতনে যা নির্মাণ হয়, কিংবা আমি যা জানাতে উদগ্রীব, তা আমি প্রেরণ করি শব্দের ডানায়। তাকে আমি নির্মাণ করি শব্দের কাঠামোয়। আর শব্দ হচ্ছে সেই কুহকী মৈত্রী যা পাঠক মাত্র বিচিত্র রসের বিভিন্ন রঙের ফুলকি ফোঁটায়। সেই অসামান্য বায়েস্কোপের নির্মাতা হওয়ার আছে এক প্রলোভন, আছে সেই দক্ষতা থাকার এক ঈর্ষনীয় সুখ।
আসলে একটা মিথ্যার মতন সুন্দর শব্দকারের জীবন। সে জানে, তবু তাকে না জানার ভান করে কাটাতে হয় শব্দ শিকারের উন্মাদ নেশায়। শব্দে কবি বাঁচে। বাঁচায় পাঠককে তার অন্তর্গত পিপাসার থেকে কিংবা তাদেরকে বাঁচানোর মধ্যে দিয়ে নিজেকে জীবিত করাই তার নিজস্ব তাগাদা। কেউ তাকে হুকুম দেয় নি কিংবা হাতে তুলে দেয়নি ফরমান। তবু ভেতরের ফেঁপে ওঠা ঢেউ ফণা তোলে আঙুলের ডগায় ডগায়। শব্দ বাহন মাত্র।
আসলে এ এক তান্ত্রিকতা! ফাঁদ পেতে শব্দ ধরারা কৌশল।
বিলীয়মান বিকেলের দিকে তাকিয়ে কিংবা রৌদ্রে পিঠ ঠেকিয়ে লেখক আসলে সমস্ত সময়টাই শব্দ শিকার করেন। তাকে বেঁচে থাকার জন্যই এটা করতে হয়। তার নীরবতা শিকারেরই অবচেতন ষড়যন্ত্র! শব্দের রক্তাক্ত মরাল নিয়েই তার কারবার। তার পিপাসা শব্দের রস গন্ধ মাংস রঙ মজ্জার নেশা। তার করোটির ভেতর শব্দরা ওড়াউড়ি করে। টের পাওয়া যায় তার ডানার গন্ধ, চিবুকের গুঞ্জন। উল্ললিত করে রক্তে তার আবর্তনের মাদক। চৈতন্যের সকল নিশানা তাক করে থাকে তার অস্তিত্বের দিকে, ট্রাম লাইন সুপ্রিয় লাগে; নিকটে কেউ নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়লো তবু বাঁচাতে বাঞ্চা হয় না। কেবলই তাকিয়ে তাকিয়ে বিহ্বল দেখা, কালো কালো হরফের মত কাক নেমে আসা যেন, সন্ধ্যার ডালে বিষণ্ণ বিবশ ক্লান্তির পাতায়। সমগ্র ডানায় তার পর্যটনের ক্লান্তি। নরম সুখের মতো পালকে হঠাৎ খুঁজে পাওয়ার আনন্দ। আর ঝিঁঝিঁর ঘুমের মতো জেগে থাকবার এক নেশা। দলে দলে ভরে ওঠে অংকিত সফেদ পাতায়। ফলে নির্মাতার মৃত্যু হয়। হারাবার বেদনা নিয়েই তার ঘুমুতে যেতে হয়। নির্মিত শব্দের কোলাহল থেকে সে ফিরে যাবে কি করে পূর্বের তৃষিত প্রান্তরে এক হারিয়ে হাওয়া দিকভুলো মানুষের অস্থিরতায়? প্রশান্ত ঘুমের ঘরে তাই লিলিথের মতো তার অভিলাষী তালাশ! সেই ঘুম ভেঙে নাকি ঘোর ভেঙে জানালায় তাকালেই দেখা যায়, আকাশে কেবল ফোটা বিবশ রুপোলী সাদা। সেইখানে পাতাদের নরম ঝুমঝুমি হয়তো জানান দেয় পৃথিবীতে কবিদের মৃত্যু হলেও কবিতার মৃত্যু হবে না। প্রহরি লোকটা তাকিয়ে থাকতে থাকতে কুকুরের গলা জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেছে কাল রাতে। তাই স্নান সেরে ফেরা নারীর ত্বকের মতো এই ভোরে যখন কয়েকটা কাক জেগে ওঠে; শব্দ করে, একেএকে শূন্যতার ডাল থেকে উড়ে যায় বিস্তীর্ণ শূন্যতার বুকে। আশ্রয় খুঁজতে খুঁজতে তার ডানার শব্দরা ঝরে পড়ে পৃথিবীর পথে। কবির করোটিতে তখন বিচ্ছেদের যন্ত্রণা। বিষণ্ণতার আলস্য। অপেক্ষার মতো পথ চাওয়া। নীল মাছি শব্দের গুঞ্জন।