নারীবাদীদের ভয় পাবেন না । উম্মে ফারহানা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ আগস্ট ২০১৭, ১:০৩ পূর্বাহ্ণ, | ২০৯৫ বার পঠিত
দিনকয়েক আগে বন্ধু নাদিয়া ইসলামের পোস্ট দেখে জানতে পারলাম যে জনৈক নয়ন চ্যাটার্জি ২১ জন নারীবাদীর ছবি দিয়ে একটি ব্লগ প্রকাশ করেছেন যে লেখার বক্তব্য হলো, নারীবাদীরা অত্যন্ত কুশ্রী ও নিতান্ত পুরুষের মনোযোগ পাওয়ার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েই উনারা নারীবাদী হয়েছেন। আমার পরিচিতদের মধ্যে সুপ্রীতি ধর দিদি, উদিসা ইসলাম আপা এবং আমার যমজ বোন উম্মে রায়হানা মুমুর ছবি সেখানে ছিল।অত্যন্ত হাস্যকরভাবে দুইজন নামী অভিনয়শিল্পী, যারা তাঁদের সৌন্দর্যের জন্যও বিখ্যাত, সুবর্ণা মুস্তাফা এবং শমী কায়সারের ছবিও ছিল সেই তালিকায় । আমি লেখাটা পড়ার দরকার মনে করিনি। নাদিয়াও সেই লেখার লিংক না দিয়ে আরো বিশ্ববিখ্যাত ২১ জন নারীবাদীর ছবি দিয়েছিলেন যাদের মধ্যে ছিলেন ম্যাডোনা।
সৌন্দর্যের ধারণা খুব আপেক্ষিক ব্যাপার। আমার জানা দুই সুদর্শন নারীবাদী হলেন বলিউডের অভিনেতা আমির খান এবং ফারহান আখতার। এঁদেরকেও যে কেউ কুৎসিত বলে খারিজ করতে পারেন, এঁদের নারীবাদের সংজ্ঞার সঙ্গে একমত না হয়েও এঁদের কথা উল্লেখ করলাম কেননা আমার ধারণা এঁরা অনেক বেশি পরিচিত, এবং এঁরা পুরুষ।
নারীবাদ সম্পর্কে সবচেয়ে ভ্রান্ত যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা হলো শুধুমাত্র নারীরাই নারীবাদী হন। সমাজের নিয়ম ভেঙে স্বেচ্ছাচারী হবার জন্য আর পুরুষকে নিজের পায়ের কাছে বসিয়ে রাখার ইচ্ছায় নারীবাদ চর্চা করেন। ব্যাপারটা আসলে মোটেই তা নয়, নারীর প্রতি সহিংসতা, বৈষম্য আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলাই একভাবে নারীবাদী অবস্থান, এই প্রাথমিক সংজ্ঞা অনুযায়ী যে পুরুষ নারীকে মৃত স্বামীর সঙ্গে এক চিতায় পুড়িয়ে মারা সমর্থন করেন না, তিনি নারীবাদী, যিনি নারী বিধবা হলে শ্বেতপাথরের থালায় আলো চালের ভাত খেয়ে সাদা শাড়ি পরে সারাজীবন ব্রহ্মচর্য পালন করবে বলে ভাবেন না তিনিও নারীবাদী, যিনি কন্যাসন্তানকে জীবিত কবর দেওয়া বা গর্ভেই মেরে ফেলার পক্ষে নন তিনিও নারীবাদী।
দিনদুই পরে আমাকে ইনবক্সে কয়েকজন সেই লেখার লিংক পাঠালেন, অনেকে জানতে চাইলেন আমি ছবি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছি কি না। আমার বোন আর আমি যমজ হওয়াতে অনেকেই আমাদেরকে ছবি দেখে আলাদা করতে পারেন না।
নয়ন চ্যাটার্জি নামধারী ব্যক্তিও একই ভুল করেছেন, আমার বোনের দুইটি ছবি দিয়েছেন সম্ভবত একটা আমার ছবি ভেবে। এমন একটি লেখায় ছবি ব্যবহারের অনুমতি দেবার প্রশ্নই ওঠে না। যাদের ছবি উনি তথাকথিত অসুন্দরী নারীবাদীদের তালিকায় দিয়েছেন তাঁদের কেউই অনুমতি দেননি। আমাকে অনেকেই বললেন এর বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেওয়া দরকার কেননা অনুমতি ছাড়া ছবি ব্যবহার করা ও অনলাইনে কুৎসা রটানোর চেষ্টা- দুটোই সাইবার ক্রাইমের আওতায় পড়ে, এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
আমি তখন লেখাটা পড়লাম। নারীদের গালিগালাজ করার জন্য তেমন কোন কারণ দরকার পড়ে না। আমরা যারা একটু আধটু লেখালেখি করি, নিজের মতামত প্রকাশের জন্য ফেইসবুক বা কোন না কোন ওয়েব পোর্টালকে বেছে নিয়েছি তাঁদের গাল দেবার জন্য কোটি কোটি পুরুষ মুখিয়ে আছেন। নয়ন চ্যাটার্জি এবং তাঁর সপক্ষে মন্তব্য করা পুরুষেরা এই বিশাল সংখ্যার একাংশ। কোন পরিসংখ্যান ছাড়াই বলা যায়, সংখ্যাটি নেহাত ছোট নয়।
আমি আইনী ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম, কয়েকজনের সঙ্গে কথাও বললাম। সকলেই একবাক্যে যা বললেন তা হলো, ছদ্মনাম ব্যবহার করছেন এমন কাউকে আসামী করে মামলা করা যায় না। রিপোর্ট করে তাঁর পেইজটি বন্ধ করে দেওয়া যেতে পারে বড়োজোর। অনেকে আবার বললেন, এদের এত পাত্তা দেবার কিছু নেই, “কুকুরের কাজ কুকুর করেছে” নীতিতে বিশ্বাসীরা সাধারণত উদারপন্থী, কুকুরের উপযোগী মুগুর ব্যবহার না করলে যে কুকুর আরও অনেককে ভবিষ্যতে কামড়াতে পারে সেকথা আমলে আনেন না।
মজার ব্যাপার হলো, এই নয়ন চ্যাটার্জি নিজের নাম ব্যবহার করে কিছু বলার বা লেখার সাহস পাচ্ছেন না।
ফেমিনিজম বা নারীবাদের প্রসঙ্গ আসলেই যারা মানবতাবাদের কথা বলেন তাঁরাও জানেন না যে নারীবাদ মানবতাবাদের বাইরে নয়, বা মানবতাবাদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। নারীকে মানুষ হিসেবে স্বীকার করা, তাঁর মানবাধিকার নিশ্চিত করার নামই নারীবাদ। প্রতিষ্ঠিত পুরুষতন্ত্রের বিপক্ষে দাঁড়ানো, দাঁড়িয়ে কথা বলা বা কাজ করা, বা একে নৈতিক সমর্থন দেওয়াই নারীবাদীর লক্ষণ। নারীবাদীকে জৈবিকভাবে নারী হতে হবে এমন কোন কথা নেই।
সাহস না পাবার কারণ সহজেই অনুমেয়। প্রথমত, উনার পড়ালেখা কম। নারীবাদ কী ও কেন তা সম্পর্কে উনার স্পষ্ট ধারণা নেই। নারীবাদী আন্দোলনের ইতিহাস উনি জানেন না। দ্বিতীয়ত, যৌক্তিক তর্কে যাবার ইচ্ছাও উনার নেই, উনি কদর্য কিছু কথা লিখে ঘৃণা প্রকাশ করছেন, প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক ঘৃণা, যে ঘৃণার বশবর্তী হয়ে ইউরোপে উইচক্রাফটের নামে নারীদের পুড়িয়ে মারা হতো, যে ঘৃণার কারণে পুরুষের বহুগামিতা বৈধ করে নারীকে একগামী হতে বাধ্য করে ইসলামধর্ম, যে ঘৃণার কারণে দেবী হিসেবে নারীকে পূজা করেও বিধবা স্ত্রীদের সহমরণে যেতে বা আমরণ ব্রহ্মচর্য পালনে বাধ্য করে হিন্দুধর্ম।
এই ঘৃণার মূলে রয়েছে নারীর প্রতি ভীতি ও বিদ্বেষ। নারীর ক্ষমতাকে ভয় করেই তাঁকে অপবিত্র হিসেবে গণ্য করার রীতি তৈরি হয়েছে। নারীর শরীর, নারীর যৌনতা সবকিছুকেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ভয় পায়। এসব কথা শিক্ষিত মানুষ মাত্রেই জানেন। পুনরাবৃত্তির দরকার নেই। বরং নারীবাদের প্রতি ভীতি ও বিদ্বেষের যে চর্চা তৈরি হয়েছে সে বিষয়ে কিছু বলা যাক।
নয়ন চ্যাটার্জি ছদ্মনামের এই ব্যক্তির আগে ফেরদৌসি বিকন নামের এক নারী একই ধরণের কথাবার্তা একটি ওয়েব পোর্টালে লিখছিলেন। তাঁর মতামত হলো, “যে নারী পুরুষের প্রিয় হতে পারে না সে নারীবাদী হয়”। উনি সম্ভবত কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রডিউয়ের নাম শোনেননি। দালাই লামা,বারাক ওবামা কিংবা কুর্ট কুবেইনের নামও উনি জানেন না বলে অনুমান করি। এঁরা সকলেই ফেমিনিস্ট। এঁরা পুরুষের কাছে পাত্তা না পেয়ে ফেমিনিস্ট হননি। বরং প্রতিষ্ঠিত কাঠামোটি বৈষম্যমূলক বলেই এর বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন।
ফেমিনিজম বা নারীবাদের প্রসঙ্গ আসলেই যারা মানবতাবাদের কথা বলেন তাঁরাও জানেন না যে নারীবাদ মানবতাবাদের বাইরে নয়, বা মানবতাবাদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। নারীকে মানুষ হিসেবে স্বীকার করা, তাঁর মানবাধিকার নিশ্চিত করার নামই নারীবাদ। প্রতিষ্ঠিত পুরুষতন্ত্রের বিপক্ষে দাঁড়ানো, দাঁড়িয়ে কথা বলা বা কাজ করা, বা একে নৈতিক সমর্থন দেওয়াই নারীবাদীর লক্ষণ। নারীবাদীকে জৈবিকভাবে নারী হতে হবে এমন কোন কথা নেই।
যেভাবে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো কাজ করে তাতে নারীরাও পুরুষতান্ত্রিক হয়ে ওঠেন, ফেরদৌসি বিকনের মতন। এর বিপরীতে কিছু পুরুষও নিজের মেধা, বুদ্ধিমত্তা, মানবিক অনুভূতি কাজে লাগিয়ে নারীবাদী হয়ে ওঠেন। তাই শারীরিক সৌন্দর্য (পড়ুন যৌন আবেদন) আর পুরুষের কাছে কাম্য হতে পারা বা না পারার সঙ্গে নারীবাদকে গুলিয়ে ফেলা অত্যন্ত হাস্যকর ও মূর্খতার পরিচায়ক।
নারীবাদীদের ভয় পেতে হলে, ঘৃণা করতে হলে যাঁদের কথা বললাম আর ছবি দিলাম এঁদেরকেও আপনার ঘৃণা করতে হবে,ভয় করতে হবে। নয়ন চ্যাটার্জির মতন নিজনামে লিখতে না পারা ভীতু পুরুষতান্ত্রিক পুরুষ আর ফেরদৌসি বিকনের মতন নারীবাদীদের সংগ্রামের ফল ভোগ করা অকৃতজ্ঞ নারীদের প্রতি আমার একটাই অনুরোধ, নারীবাদীদের প্রতি ভয় ও ঘৃণা ত্যাগ করুন, মানবিক মানুষ হোন।