মেঘমল্লার “রেইনকোট” । ইশরাত বিনতে আফতাব
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ জুন ২০১৭, ১:৪৯ পূর্বাহ্ণ, | ২৫৭৫ বার পঠিত
মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র তাও আবার আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের “রেইনকোট” অবলম্বনে নির্মিত। সব মিলিয়ে পোস্টার দেখার পর থেকে “মেঘমল্লার” দেখার লোভসামলাতে পারছিলাম না। সময় বের করেএকদিন পরেই চলে গেলাম সিনেপ্লেক্সে। আর আমার তাড়াহুড়োটা একদমই বৃথা যায়নি বলা চলে।
সিনেমার শুরুর কিছুক্ষণ পরেইমনে হল পরিচালক জাহিদুর রহিম অঞ্জন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপটে নতুন কিছুসংযোজন করার চেষ্টা করেছেন। মেঘমল্লার’ মূলত ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বর্ষামুখর তিন দিনের কাহিনীই। মফস্বল শহরের সরকারি কলেজের রসায়ন শিক্ষক নূরুল হুদা এর মূল চরিত্র। মধ্যবিত্ত সংসার তার। আছে স্ত্রী আসমা ও পাঁচ বছর বয়সী কন্যা সুধা। আসমার ছোটভাই মিন্টুও থাকে তাদের সংসারে। কাউকে কিছু না বলে মিন্টু একদিন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। এদিকে বিপদে পড়ে যান নূরুল হুদা। পরবর্তীতে তাকে ধরে নিয়ে যায়পাকিস্তানি আর্মি। এরপরে দেখা যায় কিভাবে এতদিনের ভীতু নুরুল হুদা হয়ে ওঠেন সাহসী।কিভাবে নিজের দেশের জন্য যুদ্ধ না করেও হয়ে ওঠেন মুক্তিযোদ্ধা।
আপাতদৃষ্টিতে অনেক ক্ষুদ্র মনে হলেও তাদের প্রত্যেকের অবস্থান থেকে তারাসকলেই মুক্তিযোদ্ধা। মূলত এই ছিল এই ছবির প্রতিপাদ্য বিষয় আর তা প্রকাশ করার কঠিনপরীক্ষায় পরিচালক জাহিদুর রহিম অঞ্জন মোটামুটি ভালোভাবেই উৎরে গেছেন বলা যায়।
গল্পের প্রেক্ষাপট থেকে দেখলেবলতে হয় ৯২ মিনিটের চলচ্চিত্র হিসেবে এর গল্পটি বেশ ছোট ছিল যা এই চলচ্চিত্রেরএকটি মূল সীমাবদ্ধতা হিসেবে ধরা যায়। গল্পের প্রকৃত নাম ছিল “রেইনকোট” যা পরিচালকপরিবর্তন করে রেখেছেন “মেঘমল্লার”। নাম পরিবর্তন সার্থক হলেও এই রেইনকোট যে পুরোগল্পের অন্যতম প্রধান রসদ এবং এই রেইনকোটকে ঘিরেই যে গল্প আবর্তিত হয়েছে সেটা এইছবিতে বোঝা যায়নি। বইতে মূলত এই রেইনকোট একজন মুক্তিযোদ্ধার রেইনকোট এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণছিল। কিন্তু ছবিতে পরিচালক এই রেইনকোটকেমুক্তিযোদ্ধার কাছে প্রয়োজনীয় বলে দাবী করেছেন। সেই ক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকে যায়বর্ষাকালে এতো গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস একজন মুক্তিযোদ্ধা ফেলে যাবে কেন? এছাড়াও শ্যালকেরসাথে দুলাভাইের কোন কথোপকথন অথবা স্বগতোক্তি (যেটা গল্পে ছিল) কোথাও দেখা যায়নি। যেই মানুষটাকে নিয়ে এতো মাথাব্যথা তার সাথে সম্পর্কটা কেমন তা কিছুটা অপরিষ্কার। গল্পের ক্লাইমেক্সের জায়গাটি আরও উত্তেজনাকরঅথবা হৃদয়গ্রাহী হতে পারতো।
ছবির শেষ দৃশ্যে সেলিমের উপর অত্যাচার কিংবাপাকিস্তানি বাহিনীর নিষ্ঠুরতা দেখে শিউরে উঠতে পারিনি। কারিগরি প্রদর্শনী দেখে একজন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে লিখেছিলেন, ‘যে উপন্যাস পড়লে মধ্যবিত্তকে জানতে, বুঝতে ও শুনতে পারা যায়, তাকে ‘অলাতচক্র’ বলে। আর যে ছবি দেখলে মধ্যবিত্তকে জানতে, বুঝতে ও শুনতে পারা যায় তাকেই বলে ‘মেঘমল্লার’। আমার মতে পোড় খাওয়া মধ্যবিত্ত জীবনের যে চালচিত্র তার অনেকটাই ফুটে উঠেছেমেঘমল্লার ছবিতে। তবে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসেরগল্পগুলোতে মূলত মধ্যবিত্ত জীবনের সূক্ষ্ম সূক্ষ্মতর সত্যির খোঁজ পাওয়া যায়। সেইসাদামাটা জীবনের আষ্টেপৃষ্ঠে যেই নানান রঙের অনুভূতিগুলো জড়িয়ে থাকে তার প্রকাশেকিছুটা ব্যর্থ এই ছবি।এই চলচ্চিত্রের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হল প্রকৃতির সাথে একাত্মতা।একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে গল্পের কোন উত্তেজনাময় সময়ে বৃষ্টির শুরু আবারউত্তেজনার অবসান, বৃষ্টিও শেষ। গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বৃষ্টির সাথে এইমেলবন্ধনটি ছিল চমৎকার। ছবির অধিকাংশ শটই নেয়া হয়েছে লং শট, অথবা জানালা থেকে। এরকারণ মূলত পরিচালক গল্পটি বলতে চেয়েছেন তৃতীয় পক্ষ হতে।
কারিগরি দিকের কথা বলতেগেলে বলতে হয় অনেকদিন পর হলে যাওয়ার পর প্রতিটি দৃশ্য দেখে মনে হয়েছে আমি সত্যিইকোন চলচ্চিত্র দেখছি। ক্যামেরা শট, অ্যাঙ্গেল, ফ্রেমিং, সেটিং সব কিছু মিলিয়েযুদ্ধের সময়কার থমথমে পরিস্থিতি বেশ সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন জাহিদুররহিম অঞ্জন। নদীর ঘাটে চিঠি দিতে যাওয়ার পর, সেলিম শেষবার কলেজে যাওয়ার পর কিছুজায়গায় কন্টিনিউটি ব্রেক ছিল। মুক্তিযুদ্ধ যে শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়েই নয়,এই দেশের আনাচে কানাচে হাজারো মানুষ, হাজারো পরিবার মুক্তিযুদ্ধের ক্ষত বয়েবেড়াচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে অনেক ক্ষুদ্র মনে হলেও তাদের প্রত্যেকের অবস্থান থেকে তারাসকলেই মুক্তিযোদ্ধা। মূলত এই ছিল এই ছবির প্রতিপাদ্য বিষয় আর তা প্রকাশ করার কঠিনপরীক্ষায় পরিচালক জাহিদুর রহিম অঞ্জন মোটামুটি ভালোভাবেই উৎরে গেছেন বলা যায়।
যেকোনো দেশের চলচ্চিত্র সেইদেশের ঐতিহ্যের ধারক এবং বাহক। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই কথা কতটুকু সত্য তা আমারজানা নেই। তবে বহুদিন পর একটা চলচ্চিত্র দেখে মনে হল এই দেশে চলচ্চিত্রের নতুনধারা সৃষ্টি হোক আর না হোক নিজের দেশের ঐতিহ্যকে লালন করার মতো ক্ষমতা আমাদেরহয়েছে। খুব শীঘ্রই হয়তো আমাদের সেলুলয়েডের ফিতা আমাদের ঐতিহ্যের চাকায় পরিণত হবে।
মেঘমল্লার’ সিনেমার টেইলর