লিপস্টিক আন্ডার মাই বুরখাঃ নারীর দ্বৈত জীবন । ইশরাত বিনতে আফতাব
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১:২৯ পূর্বাহ্ণ, | ২২৫৬ বার পঠিত

নারী স্বাধীনতা বিষয়টা এই উপমহাদেশে সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে ভীষণ উপাদেয়, সেটা সাহিত্য হোক কিংবা সেলুলয়েডের ফিতে। তবে গল্পের ক্ষেত্রে এই উপমহাদেশের সাহিত্যে নারীর মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ের ওপর যেমন জোর দেয়া হয়েছে সিনেমায় সেই উদাহরণ একটু কম। নারীদের নিয়ে সিনেমা হয়েছে, কিন্তু তা অনেকটাই হালকা চলের, পা ডুবালাম কিন্তু পা ভিজলো না-এই রকমের। তবে সেই গণ্ডি থেকে সিনেমা বের হয়ে আসছে এখন অনেকটাই। গত বছরের ‘পার্চড’ সিনেমার পর এই বছরের ‘লিপস্টিক আন্ডার মাই বুরখা’ আবারও সেই গণ্ডির বাইরে এসে গল্প বুনেছে। গল্পতো অনেকরকমই হয়, কিন্তু প্রতিদিন যা আমরা দেখেও দেখি না, বুঝেও বুঝি না, সেই উপেক্ষা করে যাওয়া একলা গল্পগুলোকে খুজে পর্দায় তুলে আনা ভীষণ সাহসের কাজ। টানা ছয় মাস সেন্সর বোর্ডে আটকে থেকে, ২৭টি দৃশ্য বাদ দিয়ে হলেও শেষ পর্যন্ত সেই সাহসী সিনেমা দর্শকের কাছে পৌঁছেছে। ‘লিপস্টিক আন্ডার মাই বুরখা’ এখন পর্যন্ত বলিউডে এ বছরের সবচেয়ে আলোচিত সিনেমাগুলির একটি।
গল্পটি আবর্তিত হয় চারজন নারীর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এবং একান্ত গোপন কিছু গল্প নিয়ে। সবচেয়ে তরুণ বয়সের রিহানা, যার আগাগোড়া বোরখায় জড়ানো থাকলেও মনে মনে নিজেকে খুবই স্টাইলিস্ট এবং রকস্টার মনে করতে ভালোবাসে। দরজা বন্ধ করে তাই মনের সুখে নাচে আর ক্লাস শেষে বোরখা সেলাইয়ের কাজে সাহায্য করে বাবাকে। মাইলি সাইরাসের ভীষণ ভক্ত এই রিহানা ঘরে অভিভাবকের ভয়ে মুখচোরা হয়ে থাকলেও কলেজে নারী অধিকারের বিষয়ে কিন্তু ভীষণ সচেতন। এরপরেই আছে লীলা, যার বিয়ের কথাবার্তা চলছে ঠিকই কিন্তু তাতে তার প্রেমের কিংবা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কোন ব্যাঘাত ঘটছে না। নিজের টাকায় একসময় বড় শহরে বাস করার আকাশকুসুম কল্পনাটা তার কাছে নিতান্তই স্বাভাবিক। নিজের যৌন আকাঙ্খাকে একান্তই নিজের অধিকার বলে ভাবে সে। অন্যদিকে শিরিন, সকলের চোখে আটপৌরে গৃহবধূ হলেও ভেতরে ভেতরে সে একজন চমৎকার সেলসওম্যান। বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করে ভীষণ আত্মবিশ্বাসের সাথে, কিন্তু নিজের শরীরটার উপরে কোন রকম অধিকার নেই তার। সৌদি ফেরত স্বামীর একক আধিপত্য তার ওপর। এমনকি নিজের চাকরির কথাটাও বলার সাহস পায় না সে। আর সবার শেষে আছেন ঊষা বুয়াজি, যিনি ৫৫ বছর বয়সেই নিজের সকল আশা-আকাঙ্খার কথা ভুলে বসেছেন। চটকদার যৌন সম্পর্কে ভরা বই পড়েন তিনি ধর্মীয় বইয়ের আড়ালে। আর তাতেই আবিষ্কার করেন নতুন করে নিজেকে। নিজের ভেতরে সুপ্ত ভালোলাগা কিংবা প্রেমের আবেশ যে এখনও হারিয়ে যায়নি তা খুব ভালো মতই বুঝতে পারেন অল্প বয়সী সাঁতার প্রশিক্ষকের সাথে কথা বলতে গিয়ে। প্রতিটি নারীই একটা পর্যায়ে গিয়ে নিজেদের স্বাধীনতার স্বাদটুকু পেতে চেয়েছেন। লুকিয়ে হোক, কিংবা প্রকাশ্যে। কিন্তু আফসোস, সমাজের চোখ রাঙ্গানি তাদেরকে নিমিষেই মিশিয়ে দিয়েছে।
সিনেমার পরিচালক অলংকৃতা খুব সুক্ষভাবে গল্পের মধ্যে কিছু অর্থপূর্ণ বিষয় রাখতে চেয়েছেন। বলা চলে, সিম্বলিজম আর মেটাফরের জম্পেশ খেলা খেলেছেন তিনি। গল্পের প্রতিটি নারীই ‘হাওয়াই মঞ্জিল’ নামক বাসার বাসিন্দা, কারণ দিন শেষে এরা সবাই হাওয়ার মাঝেই স্বপ্ন দেখে, হাওয়ার মাঝেই ভাসিয়ে দেয়। শুধু তাই নয়, ঊষার যৌন উপন্যাসের চরিত্র আর কর্মকাণ্ডের সুতোতেই তিনি বেঁধেছেন সকল চরিত্রকে। গল্প আগাতে থাকে, ব্যাকগ্রাউন্ডে বর্ণনায় চলতে থাকে সেই রগরগে উপন্যাসের বর্ণনা। এটি যেমন অনেক জায়গায় ব্যঙ্গ প্রকাশ করেছে, অনেক ক্ষেত্রে হাস্যরসের সৃষ্টিও করেছে বটে!
পরিচালকের প্রধান চারটি চরিত্রের মধ্যে দুজন হিন্দু এবং দুজন মুসলিম। মুসলিম হিসেবে শিরিন এবং রিহানা নিজেদের ধর্মীয় ট্যাবু ভাঙতেই সবচেয়ে বেশি সংগ্রামের মধ্যে থাকেন। আর অন্যদিকে ধর্মীয় বিধিনিষেধ না থাকা সত্ত্বেও, আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পরেও লীলা এবং ঊষা দুজনই সমাজের যাঁতাকলে পড়ে নিজেদের চাহিদাগুলো প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন না। ধর্মীয় ট্যাবুর সামনে এই সিনেমা এক বিশাল পদক্ষেপ। ধর্ম একজন মানুষের একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়, কিন্তু কিভাবে অল্প বয়স থেকেই ধর্মের কারণে মেয়েদেরকে পর্দার আড়াল করে ফেলা হচ্ছে তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তার হিসেব নেই। জোরকৃত ধর্মপালনের এমন সুন্দর উপস্থাপন খুব কমই দেখা যায়।
গত বছরের ‘পার্চড’ সিনেমার সাথে তুলনা করলে ‘লিপস্টিক আন্ডার মাই বুরখা’ অনেকটাই পিছিয়ে যাবে বিভিন্ন কারিগরি কারণে। আবার গল্পের কারণে অনেকটাই এগিয়ে থাকবে কারণ ‘পার্চড’ নারী জাতির শোষণকে দৃশ্যায়িত করলেও তার পটভূমি ছিল খুবই নির্দিষ্ট, একটি গোষ্ঠীকে নিয়ে। সুতরাং সিনেমাটি দর্শকদের মনে সহানুভূতি জাগতে পারে, কিন্তু তা স্পর্শ করতে পারে না। অন্যদিকে, “লিপস্টিক আন্ডার মাই বুরখা’র গল্পগুলো একদম আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ভাত-ডালের মত পরিচিত। সিনেমা দেখতে বসলে অধিকাংশ নারীই নিজেকে কোন না কোন ক্ষেত্রে কল্পনা করতে পারবেন। আর এতেই সিনেমাটি সফল হয়েছে শতভাগ। এছাড়াও জীবনের এত গহীন থেকে গল্প ছিনিয়ে আনার মত দুঃসাহসী কাজটি অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য। সিনেমার শেষ দৃশ্যটি ভীষণ চমৎকার। চারজন নারী একই সাথে সিগারেট টানে, সমাজ এবং পরিবারের কাছে ভীষণ পরাজিত, লাঞ্ছিত কজন মানুষ আবার শুরু করে সেই যৌন উপন্যাস পড়া, অল্প অল্প করে একসাথে করে ছিঁড়ে ফেলা সেই উপন্যাসের টুকরোগুলো। এক মাতাল হাসি তাদের গ্রাস করে। বারবার পোড় খাওয়া মানুষগুলোর হাসি ভীষণ একরকম হয়, তেমনই একরাশ বিষাদগ্রস্ত এবং বাঁধনছাড়া অট্টহাসিতে সিনেমা শেষ হয়।
সাধারণত গল্পের যখন কোন একটি প্রধান চরিত্র থাকে না, তখন প্রতিটি চরিত্রের অভিনয় হতে হয় একই রকমের নিপুণ, একটু উনিশ-বিশ পুরো সিনেমাই নষ্ট করে দিতে পারে। সেই উনিশ-বিশের পুলসিরাত খুব সাফল্যের সাথেই পার হয়েছেন প্রতিটি অভিনেতা-অভিনেত্রী। এমনকি পার্শ্ব চরিত্রগুলোও অভিনয় করেছে পাল্লা দিয়ে। ঊষার চরিত্রে অভিনয় করা রত্না পাঠক শাহ এর চরিত্রটি সবচেয়ে বেশি কঠিন ছিল কারণ অন্য চরিত্রদের বয়স অনুযায়ী কর্মকাণ্ড অনেকটাই স্বাভাবিক এবং গ্রহণযোগ্য, কিন্তু রত্নার চরিত্র একেতো সমাজে ভীষণভাবে অগ্রহণযোগ্য, অন্যদিকে যৌনতার এমন বহিঃপ্রকাশ এই বয়সে খুব সহজে দেখা যায় না। এমন একটি কঠিন চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলার জন্য রত্না অবশ্যই প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। তবে গল্পে চরিত্রগুলোর গভীরতা বোঝানোর জন্য যতটুকু খোলামেলা প্রকাশের প্রয়োজন ছিল, সেন্সর বোর্ডের কাঁচির নিচে তা আত্মাহুতি দিতে হয়েছে সেটা ভালোভাবেই ফুটে উঠেছে। এই কারণে গল্পটিও বিভিন্ন জায়গায় কিছুটা খাপছাড়া হয়ে গিয়েছে। এছাড়া গল্পে একটা সূক্ষ্ম অসামঞ্জস্য আছে। দেখানো হয় রিহানা বড় শপিং মল থেকে বুট চুরি করে বোরখার নিচে করে, মেশিনে ধরাও পড়ে কিন্তু বোরখার নিচে থাকায় তাকে সেই মুহূর্তে ছেড়ে দেয়া হয়। দেখানো হয় পরবর্তীতে পুলিশ এসে তাকে এই চুরির জন্য গ্রেফতার করছে। ব্যাপারটি অবশ্যই অযৌক্তিক কারণ যেই শপিং মল এ সিসি ক্যামেরা আছে, তারা মেশিনে ধরা পড়ার পর সিসি ক্যামেরা ফুটেজ চেক না করে কোন ক্রেতাকে ছাড়ার কথা না। এই অংশটি খানিকটা গোঁজামিল দেয়ার মতই মনে হয়েছে। এইটুকু অংশ বাদ দিলে পুরো সিনেমা মোটামুটি খুঁতবিহীন।
‘লিপস্টিক আন্ডার মাই বুরখা’-নামটিও বহু বছর ধরে প্রচলিত নারীদের দ্বৈত জীবনের ঘোষণা করে। ঐ লিপস্টিকটুকুই তার জীবনের একমাত্র রঙ, ভালোবাসা আর প্রকৃত সত্ত্বার বাহক। বোরখাটা সমাজ কিংবা ধর্মের শেকল। এই দুই বিপরীত সত্ত্বার মাঝে সংগ্রাম করে সব নারী সফল হয়ে ওঠে না, দিন শেষে কেউ সর্বস্ব হারায়, কেউ দুই জীবন একসাথে যাপন করে, নিজের জীবনে নিজেই লুকোনো আসামী হয়ে ঘুরে বেড়ায়।