পিঙ্ক ফ্লয়েড ইন্সাইড আউট :: পর্ব ৩। শফিউল জয়
প্রকাশিত হয়েছে : 03 June 2017, 10:04 am, | ৩২৭১ বার পঠিত

তৃতীয় অধ্যায় — হৈ হৈ রৈ রৈ
ইএমআই এর সাথে চুক্তি করার পর প্রধান লক্ষ্য দাঁড়াইল সিরিয়াস্লি কাজটাজ শুরু করে দেয়া । অন্যান্য ব্যান্ড যেমন চুক্তির সাথে সাথে টাকা পায়া যাইতো, আমাদের সাথে তেমনটা হয় নাই। উপরন্তু ডিপোজিটও কিছু ছিল না। এই সময়ে রাস্তায় রাস্তায়ও সময় কাটাই নাই, ক্লাবেও বাজাই না বছরখানেক হইছে। ছেষট্টি সালের শরতে অল্প কিছু শ্রোতার সামনে কয়েকটা সুবিধাজনক ভেন্যুতে বাজাইছিলাম শুধু। বলতে গেলে সাইকাডেলিক ভিলেজের আড়ালে ঘাপটি মাইরা বইসা থাকা অচেনা সভ্যতা নিয়া অন্ধকারে পইড়া আছি আমরা।
এখনকার মতো ওই সময়েও নতুন ব্যান্ডের জন্যে যাতায়াতের ঝামেলাটা ছিল বিশাল একটা ক্যারফা। বাপ-মায়ের গাড়ি নিয়া যাওয়াটা মাঝে মাঝে সম্ভব হইলেই ড্রাম কিট আর ব্যান্ড মেম্বারে ভরা গাড়ির বারোটা বাজতে দুই মিনিটও লাগতো না। সবচেয়ে বড় কোম্পানি হিশাবে ওরা আমাদের একটা ভ্যান দিছিল, কিন্তু স্টুডেন্ট গ্র্যান্টের টাকা দিয়া যে একটা গিটার অথবা বেজ ড্রাম কিনবো সেই অবস্থাও ছিল না। তারপরেও নানাজ জায়গা থেকে ধার কইরা টানটুন দিয়া জোড়াতালি দেয়া যন্ত্রপাতির সদাবাড়ন্ত বহর নিয়া একটা সন্তোষজনক শো কইরা বাড়ি ফিরার প্যানাটা চালায়া যাইতেছিলাম।
রেকর্ডের চুক্তিটা করার আগে আমাদের তখনকার ট্রান্সপোর্ট বেডফোর্ড ভ্যানের সীমাবদ্ধতার জন্যে লন্ডনের বাইরের শো’গুলাতে সেভাবে যাওয়া হইতো না। বিশ কুইড দিয়া এই ভ্যানটা কিনছিলাম টি স্টেইট আমলে। যে লোকটা ভ্যানটা বেচছিল সে বিশ্বাসই করতে পারতেছিল না আসলেই জিনিশটা বিক্রি হইছে, কারণ আর কিছুদিন পরেই এটারে ভাগাড়ে ফেইলা দিতে হইতো। বেডফোর্ডটার গতি ছিল অস্বাভাবিক শ্লথ, আমার অস্টিন চামিও হয়তো এটার থেকে দ্রুত যাইতে পারতো। গাড়িটার গতি একমাত্র এরে নিয়ে ঘোরার অনিশ্চয়তাকেই রেসে পেছনে ফেলতে পারতো মেবি।
এরমধ্যে ভয়াবহ এক বিপদে পড়ি জিনিশপত্র সব হারায়া ফেইলা। রিক এক্সট্রা কিছু টাকা কামানোর জন্যে শো’য়ের পর যন্ত্রপাতি গাড়ি থেকে নামায়া ব্ল্যাকহিল অফিসে রাইখা আসতো সাধারণত। একবার এক মধ্যরাতের শো’তে কোন এক কারণে ও জিনিশপত্র না নামায়া রিজেন্ট পার্কের কাছে গাড়িতেই রাইখা আসছিল। সকালবেলা গিয়া দেখি সব দামি মালপত্র হাওয়া। ওইসময় ম্যানেজমেন্টের কোন ফান্ডও নাই, এমন কোন দাতব্য প্রতিষ্ঠানের আগায়া আসার কোন চান্স নাই যে দয়া কইরা কিছু টাকা দান করবে। ফলে শেষ পর্যন্ত মা তার অফুরন্ত ধারের খনি থেকে আমাদের দুইশো পাউন্ড ধার দিয়ে দরকারি জিনিশগুলা কেনার ব্যবস্থা কইরা দেয়। রিক প্রায়ই এই ঘটনায় অনুতপ্ত বোধ করতো, কিন্তু কোন প্রকারের ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা মুখেও আনতো বলে মনে পড়ে না। ইএমআই এর সাথে ডিলের পর ওদের পক্ষ থেকে একটা ফোর্ডের গাড়ি দেয় চলাচলের জন্যে, যেটা শুধু যাতায়াত না— ব্যান্ডের এক ধরণের স্ট্যাটাস সিম্বলের নিদর্শন হয়া কাজ করতো। পঁয়ষট্টি সালের এই ট্র্যানজিটটা নিয়া এত কাড়াকাড়ি যে সব চোরই তক্কে তক্কে থাকতো কোন সুযোগে কোন ব্যান্ডের জিনিশপত্র নামায়া গাড়িটা চুরি কইরা লাপাত্তা হওয়া যায়। এই ট্রানজিটের স্পেসিফিকেশন বলা যায় তুলনাহীন। রোডি, লাইটিং ম্যান সহ প্রয়োজনীয় জিনিশপত্র সবই আইটা যাইতো এইটার ভিতরে। এররকম একটা ভ্যান থাকার সুবিধাটা তখন হাড়ে হাড়ে টের পাইতেছিলাম, কারণ এজেন্ট ব্রায়ান মরিসনের মাধ্যমে প্রচুর কাজ হাতে আসা শুরু করছে সময়টায়। ওর সাথে প্রথম দ্যাখা হয় আর্নল্ড লেইনের রিহার্সেলের সময়। অ্যান্ড্রু আর পিটার একদিন আইসা জানাইলো মিউজিক কোম্পানির এক রাঘববোয়াল আসবে দ্যাখা করতে আমাদের সাথে, এবং আমরাও খুব উত্তেজিত হয়া অপেক্ষা করতে লাগলাম। কোন এক সময়ে স্টুডিওর দরজা খুইলা ব্রায়ান মরিসন উদয় হইলো, সাথে দুই সহকারী। তিনজনকে দেইখাই মনে হইলো এরা লন্ডনের আন্ডারগ্রাউন্ডের না, আন্ডারওয়ার্ল্ডের কেউ হবে। লুন প্যান্ট কিংবা কাফটান্স না, ইটালিয়ান সুইট আর ভেলভেট কলারের ক্যামেল হেয়ার কোট পইরা আসছিল তারা, ফলে এরকম ভাবা দোষের কিছু ছিল না। কিন্তু ঢুইকা আমাদের দেইখা যে তারা খুব ইম্প্রেসড হয় নাই, তা সহজেই বুঝা যাইতেছিল।
অ্যান্ড্রু আর পিটার বেশ কয়েকটা এজেন্সির সাথে কথা বলসিল কাউকে চূড়ান্ত করার আগে। এরমমধ্যে ডেনমার্ক স্ট্রিটের বিখ্যাত নোয়েল গে এজেন্সিও ছিল। এই এজেন্সিতে বুকাররা সব মর্নিং স্যুট পইরা ঘুইরা বেড়াইত। ওরা পনেরো পার্সেন্ট শেয়ার চাইছিল, আর ব্রায়ান চাইছিল দশ পার্সেন্ট। ফলে ওরেই কাজটা দেয়া হয়।
ব্রায়ানের পোশাক আশাকের বাহার দেইখা ওরে লাগতো মটর ডিলারের মতো, যদিও সে ছিল সেন্ট্রাল স্কুল অফ আর্টের ছাত্র। ওর অফিস প্রিটি থিংসের সাথেই ম্যানেজমেন্টগিরির যাত্রা শুরু করে, যার মধ্যে ফিল মে আর রোলিং স্টোন্সের ডিক টায়লরও ছিল। এরা দুইজনেও আর্ট কলেজের ছাত্র। পরে দলটা প্রকাশনা আর এজেন্সি ওয়ার্কও খুইলা বসে। আমরা যখন যোগ দেই ততদিনে আরও বেশ কিছু ভালো ভালো আর্টিস্ট ওদের সাথে চুক্তি করছে। এর মধ্যে অ্যায়ন্সলে ডানবার রিট্যালিয়েশন, হার্বি গইন্স আর নাইটমেয়ার উল্লেখযোগ্য। পরে ওরা ব্ল্যাকহিলের সব আর্টিস্টদের সাথেও সম্পর্ক কইরা ফ্যালে।
১৪২ চ্যারিং রোডে ব্রায়ানের গোছানো অফিসের নিচে একটা অল-ডে ড্রিংকিং ক্লাব ছিল। এই অফিসটার সাপ্তাহিক ভাড়া গুণতে হইতো আট পাউন্ড। প্রিটি থিংসের জন্যে বাইরের দেয়ালের গ্র্যাফিতিতে অমর ভালোবাসার বয়ান আর ভেতরে মানুষজনের হইহুল্লা জমায়েত— এই হইলো ওর অফিসের বৈশিষ্ট্য। প্রায়ই শোনা যাইতো ও ভেতর থেকে ইন্টারকমে সেক্রেটারির সাথে চিল্লাপাল্লা করতেছে। সত্য বলতে, সবাই-ই চিল্লাইতো; নয় ফোনে, না হয় সামনাসামনি। ব্ল্যাকহিলের অফিসের পুরা বিপরীত আবহাওয়া বলা যায় এরে। ম্যানেজমেন্ট ব্যবসা ছাড়াও ব্রায়ান কয়েকটা ভেন্যুর সোল এজেন্ট হিশাবেও কাজ করতো। ম্যানেজমেন্টের কাজ করতে গিয়া ও বুঝতে পারলো- এর সাথে যদি বুকিং এর কাজটাও করা যায় তাহলে আরও লাভ। কিন্তু ওর বহুল অভিজ্ঞতাও মাঝেমাঝে ভ্যাজাল থেকে মুক্তি দিতে পারতো না। একবার এক বন্ধুকে সাহায্য করতে গিয়া আরেক এজেন্সির রিপ্রেজেন্টিটিভ হয়া কাজ করসিল কমিশন ভাগাভাগি কইরা। আরেকবার একটা ক্লাবে ও গেছে ক্লাব ম্যানেজারের সাথে মিটিং করতে, সাথে আরেক বুকিং এজেন্সির দুই ভাই। কথাপ্রসঙ্গে দুই ভাইয়ের একজন উইঠা গেল কাজের বাহানায়। পরবর্তী মুহূর্তেই শোনা গেল কে জানি সিড়ি দিয়া গড়ায়া পড়তেছে। যেই ভাই বইসা গেল সেও কী জানি বাহানা দিয়া উইঠা গেল — তবে কারণ ওই একই-ক্লাব ম্যানেজারকে চড়ঘুষি দেয়া। এইসব দেইখা আস্তে কইরা কাইটা পড়া ছাড়া ওর উপায় ছিল না। কারণ যে মানুষ তার ক্লায়েন্টদের ক্ল্যারেট দিয়া আপ্যায়ন করতো, তার ঘুষিলাত্থিতে পোষানোর কথা না। পরে জানতে পারছি ওই ভাইদের সারনেইম ছিল ক্রে।
.অ্যান্ড্রুও যে মাঝে মাঝে এরকম পরিস্থিতির স্বীকার হয় নাই তা বলা যায় না। এক এজেন্সি তো রবার্ট স্টিগউড নামের এক প্রোমোটারকে জানলা দিয়া ছুইড়া ফেইলা দিছিল কথাকাটাকাটির এক পর্যায়ে। এই এজেন্সির একজন চাকরি করতো যে গিটারিস্টদের আঙুল টুকরা করতো চুক্তি করতে রাজি না হইলে। এরকম ভয়ংকর কিছু ফেইস করে নাই অ্যান্ড্রু, তবে রয়াল অ্যালবার্ট কলেজ অফ আর্টের এক শো’য়ের টাকা কালেক্ট করতে গিয়া দ্যাখে ওই গিগের পয়সায় ক্রিসমাস পার্টির মতো পার্টি করতেছে আয়োজকরা। অধিকাংশই দেখতে গ্যাংস্টারের মতো। তো অ্যান্ড্রু গিয়া বলল গিগের টাকার জন্যে আসছে সে। জবাবে একজন বলল, ‘ওহ। এই পোলা আসছে আমাদের টাকায় ভাগ বসাইতে’। সবার চোখ তখন অ্যান্ড্রুর দিকে। কয়েক মিনিটের নীরবতার শেষে রুমের মধ্যে হাসির রোল পইড়া গেল। দরজায় দাঁড়ানো লোকটা পিছনের পকেট হাতড়াইয়া বিশাল এক বাণ্ডিলের থেকে টাকাগুলা বের করছিল তারপর। আর অ্যান্ড্রু উল্টা ঘুরার সাথে সাথেই আবার পার্টি শুরু।
ব্রায়ানের সাথে সাউন্ড টেকনিক স্টুডিওতে যে দুইজন আসছিল তাদের নাম টনি হাওয়ার্ড আর স্টিভ। টনি মিউজিক জার্নালিস্ট হওয়ার আশায় ন্যু মিউজিক্যাল এক্সপ্রেসে অফিস বয় হিশাবে কাজ শুরু করসে, তারপর প্রিটি থিংসের ফিল মে’র মাধ্যমে ব্রায়ানের সাথে পরিচয়। ওই সময়ে টনি নাইটক্লাবের ক্র্যুপিয়ার আর হল কলার হিশাবে কাজ করতো এবং পরে ব্রায়ানের এজেন্সিতে যোগ দেয়।
প্রথমে ভাবসিলাম বিচ বয়েজের মতো কিছু একটা করবো। বিচ বয়জের ব্রায়ান উইলসন না কী বেসিক্যালি ঘরেই সবকিছু চালাইতো, যেহেতু লাইভ করতে পারতো না। এরপর ভাবলাম, একজন নতুন গিটারিস্ট নিয়া সিডের প্রেশারটা কমাই। প্রথমেই জেফ বেকের নাম মাথায় আসছিল। আমার ধারণা, জেফ বেক আসলে নিরীক্ষামূলক কিছু একটা হওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু ঝামেলা হইলো আমাদের কারোরই সেই সাহসটা ছিল না ওরে যে ফোনটা দিয়া প্রস্তাবটা দিবো। অবশ্য রজার এর প্রায় পঁচিশ বছর পর কাজটা করসিলো।
অন্যদিকে স্টিভ অ্যাকাউন্টেন্টের ট্রেনিং নেয়ার পর এক পেট ফুড কোম্পানিতে সেলসম্যান হিশাবে যোগ দিছিল। ওর মালিকপক্ষ ওরে কাজ থেকে ছাটাই করে দেয় যখন তারা বুঝতে পারলো প্রত্যেক উইকেন্ডে ও কোম্পানির গাড়ি নিয়া রেসিঙে যাইতো আর ওর কাজ আরেকজনকে দিয়া করাইতো যাতে কইরা ইআই নামের এক ক্লাবে সময় দিতে পারে। অন্য একটা এজেন্সিতে ওর তিন মাসের অভিজ্ঞতার কারণে ব্রায়ানের ধইরা নিলো এই কাজে স্টিভ উপযুক্ত। ওর কারণে আমরা বেশ ভালো শো পাইতেছিলাম। যদিও আমরা যে ধরণের মিউজিক করতাম আর আমাদের শ্রোতারা যেমন হইত সাধারণত, তার সাথে এইসব শো’য়ের কোন সাদৃশ্য ছিল বলে মনে পড়ে না। এটা সবচেয়ে খাটত টপ র্যাঙ্ক এর বলরুম চেইনের ক্ষেত্রে। কারণ ওইখানের শ্রোতারা শুধু নাচতে কিংবা টপ অফ দ্যা পপের টপলিস্টে যারা থাকতো তাদের দেখতে আসতো। মর তো মর, টপ র্যাংকে আসার জন্যে ড্রেসকোড ছিল জ্যাকেট আর টাই, কোন ধরণের বড় চুল বা জিন্সের অনুমতি ছিল না যাতে করে কোন বিপত্তি না ঘটে। বারে গিয়া যে দুই এক পেগ মাইরা আসবো সেইটা বহু দূর কি বাত, কারো সাথে কথাই বলতে পারতাম না। আর আমাদের আসল শ্রোতাদের ছোট্ট দলটা কখনো দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকতে পারতো না।
টপ র্যাংকের শ্রোতাদের জন্যে পিঙ্ক ফ্লয়েড ছিল বিশাল একটা বিড়ম্বনার নাম। সি এমিলি প্লের রিলিজের আগে টিভিতে আমাদের কোন অস্তিত্ব না থাকার কারণে ওইখানের সবার কাছে আমরা ছিলাম এলিয়েনের মতো। একমাত্র আর্নল্ড লেইন গানটা টপ টোয়েন্টিতে ঢুকতে পারছিল কষ্ট কইরা, পিঙ্ক ফ্লয়েডের বাকী গানগুলার সাথে যেটার মিল খুব সামান্যই। রেডিওতেও শো পাইতাম না, টিভিতে তো নাই-ই। এক প্রোমটার আইসা বলসিল, ‘ কী লজ্জার ব্যাপার! কিছু ভালো গানও তো লিখতে পারো’…
আমাদের অদ্ভুতুড়ে আর ভয়ার্ত আবহের গানগুলা শুইনা শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়া হইতো বিচিত্র রকমের। কারো কারো চেহারায় ফুইটা উঠত চরম অনাগ্রহ, কেউ হয়া যাইতো প্রচণ্ড মারমুখী। পান্টাররাও যে খুব সাহায্য করতো তাও না। এজেন্ট না থাকলে অগ্রিম চেকে টাকা পাইতাম কী না তাতেও সন্দেহ আছে। সৌভাগ্যবশত ভালোসংখ্যক ভেন্যু ছিল। এক ভেন্যুতে বাজায়া পরবর্তীতে আবার একই ভেন্যুতে বাজাইছি এমন কোন ঘটনার ইয়াদ পড়ে না। অবস্থা এমন গিয়া দাঁড়াইল যে সাতষট্টি সালে একদল সহানুভূতিশীল ছাত্রদের উপরেও ভরসা করতে পারতেছিলাম না। প্রাদেশিক বিশ্ববিদ্যালয় কম থাকার কারণে কোন বিশ্ববিদ্যালয় সার্কিটও ছিল না, আবার একটা গিগ আয়োজন করার ঝক্কিঝামেলাও ছিল প্রচুর। ফলে আবার ঘুইরাফিরা সেই ক্লাব আর বলরুমের শো’গুলাতেই ফিরা যাইতে হইলো।
এক নজর চোখ বুলায়া নিলে দ্যাখা যায় ছেষট্টি সালের শেষের দিকের বিশটা গিগ থেকে আমরা সাতষট্টিতে হুট করে প্রায় দুইশো গিগে বাজাইছি। এরমধ্যে প্রথম অ্যামেরিকা ট্যুর, টিভি প্রোমোশনের জন্যে ইউরোপ ট্যুর আর তিনটা সিঙ্গেল আর অ্যালবাম রেকর্ড করার সময়টা অন্তর্ভুক্ত না।
কয়েকটা গিগ অবশ্য স্মরণীয় হইছিল এর মধ্যে। তবে সাতষট্টি সালে স্কটল্যান্ডের উত্তরের দিককার শো’গুলা তেমন সাড়া জাগাইতে পারে নাই। বলা যায় এই স্যাসেন্যাক ইনভ্যাশনকে একপ্রকারের বর্জন করসিল তারা। আর তিনটা শো’তে আমাদের বিল আর লোকাল এক ফ্রুটকেক প্রতিযোগিতার বিলিং ছিল সমান সমান। সাধারণত গান শোনার পর লোকজন বলত, ‘গান গাইতে পারো? আমরা তো বাথরুমেও এর থেকে ভালো গান গাই।’
এসবের থেকে বাড়ির আসেপাশে আমরা ভালো সাড়া পাইতেছিলাম সময়টায়। সেই সময় ক্যালিফোর্নিয়া বলরুমকে বলা যায় পাব্লিকের বিরক্তি প্রকাশ করার আদর্শ জায়গা। কারণ ওইখানে বাজাইলে স্টেইজের উপর ব্যালকনি থেকে মানুষ তাদের পানীয় আমাদের মাথায় ঢাইলা প্রতিবাদ জানাইতো সরাসরি। রজার পরে দার্শনিকের মতো ভাইবা বের করসিলো, ‘তারা অতোটা অপছন্দ করতো না আসলে। অ্যাট লিস্ট গ্লাস তো ছুইড়া মারে নাই’। ইলিং এর ফেদার্স ক্লাবে অবশ্য রজারের কপালে একজন তামার পয়সা ছুইড়া মারসিল। এই জিনিশটা বিশেষভাবে মনে আছে কারণ রজার ওই শো’য়ের পুরা সময়টা চুদির ভাইটাকে খুইজা বের করার চেষ্টায় লাইগা ছিল। ভাগ্য ভালো খুইজা পায় নাই, কারণ আমি নিশ্চিত ওই লোক একা আসে নাই, বন্ধুবান্ধব সহই আসছিল অনুষ্ঠানে। আর এমন না যে রজারের উপরেই খাপ্পা হয়া ওরে টার্গেট করসিল, বরং হাতের নাগালে যারে পাইছে তারেই টার্গেট বানানা হইছিল আর কী।
স্কট ফোর্টনাইটের সময় আইল অফ ম্যানে ছুটি কাটাইতে আসা গ্লাসওয়েজিয়ানদের ওইখানে আরেকটা অবিস্মরণীয় শো করসিলাম। ওই ভেন্যুর স্টেইজটা ফ্লোর থেকে এত উচায় বানানো যে, যে কোন বেড়ধক লম্বা মানুষের পক্ষেও পারফর্মারদের হাত-পা ধইরা নিচে টাইনা নিয়া আসা সম্ভব হয়া উঠত না। প্রোমোটার উপদেশ দিছিল, নিচে যাই হোক না কেন শো যাতে আমরা চালায়া যাই, আর নিজেদের লাইট শো’য়ের কথা যাতে মাথায় না আনি— ভেন্যুর লাইট শো’ই থাকবে। ওর উপদেশটা গুরুত্বের সাথে নেয়া দরকার ছিল আগেই। কারণ ড্রামে পিছনে বইসাই আগের পারফর্মারদের ড্রামারের রক্ত চোখে পড়ল। বুঝাই যাইতেছে বেচারা একেবারে ডিরেক্ট হিটের শিকার।
বাজানো শুরু করার সাথেই সাথেই যথারীতি লাইট বন্ধ করে আমাদের লাইট শো শুরু করে দিলাম। দর্শকর’ অভিভূত। প্রথমে ভাবলাম আমাদের বাজনা আর লাইট শো’তে দর্শকরা বিস্ময়ে থ মাইরা এমন ভূতুড়ে গুঞ্জন শুরু করছে, কিন্তু কয়েক মুহূর্ত লাগলো এই ভুল ভাঙতে। অন্ধকার আসলে তাদের হাতে সুযোগ তুইলা দিছিল নিজেদের ভেতরে আক্রোশে ফাইটা পড়ার জন্যে। প্রমোটারের উপদেশ স্মরণ কইরা সাথে সাথে আমরা সাইকাডেলিক মিউজিকের তওফা দিয়া সেটা বরণ করে নিলাম। বন্ধু রন গেসিন যেভাবে বলত,’ পরের নাচটা হবে মারামারি’।
কোন এক বিচিত্র কারণে, এই অভিজ্ঞতাগুলা ব্যান্ডের উদ্যম একেবারেই পোতায়া দিতে পারে নাই। বরং আগুনের ভেতরে পড়া প্ল্যাটুনের মতো এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা আর দুর্ব্যবহারের অবিরল ধারা সবার স্পিরিট আরও বাড়ায়া দিছিল। এমন কী গিগ শেষে বাড়ি ফেরার সময় এইসব নিয়া হাসাহাসি করতাম আর নিজেদের সান্ত্বনা দিতাম এই বলে যে, পরের গিগ ভালো হইতে বাধ্য।
এই বলরুমগুলাতে প্রতিনিয়ত এক ধরণের টেকনিক্যাল ঝামেলার সম্মুখীন হইতাম। প্যালাডিয়ামের স্যাটারডে নাইট ঠিক করলো ওদের পুরা ব্যাপারগুলা আকর্ষণীয় করার জন্যে রিভলভিং স্টেইজ বসাবে। কিন্তু আস্তে আস্তে লাইটের জিনিশপত্র আর ইকুইপমেন্ট বাড়তে শুরু করার কারণে স্টেইজ ঘুরা শুরু করলে একেবারে যা তা অবস্থা হয়া যাইতো। স্পিকার লিডগুলা শেষপ্রান্ত পর্যন্ত ছড়ায়া থাকার কারণে ইকুইপমেন্টের থরথর কম্পমান টাওয়ার মেঝেতে পড় পড় অবস্থায় চইলা যাইত। লাস্ট ডেইজ অফ পম্পেইয়ে র সময় রোড ক্রু তো গড়াগড়ি খাওয়া স্পিকারগুলায় ইলেক্ট্রিক সংযোগ দেয়ার জন্যে হামাগুড়ি দিতো নিয়মিত। পুরা স্টেইজ বাইকা যাওয়ার কারণে আমাদের এমন একটা নড়চড়ছাড়া অবস্থায় দাড়ায়া থাকতে হইতো যে দেইখা এমন লাগা অস্বাভাবিক ছিল না স্টার ট্রেকের ক্রুরা ক্লিংগন ওয়ারশিপ থেকে ডিরেক্ট হিট হইতেছে।
এরই মধ্যে আমাদের রোড ক্রুয়ের ঝামেলাটার নিষ্পত্তি হয়া গেছে, যদিও রোডির ক্ষেত্রে অন্য ব্যান্ড দিয়াই চালায়া নেয়ার চেষ্টা করতাম। ভাবসিলাম ক্রিমের রোডির মতো পেশা থেকে কেউ যদি আসে তাহলে ব্যাপারটা হবে চরম, কিন্তু কারো কাছে থেকে পরামর্শ নেয়া হয় নাই। ক্রিমের রোডির কথা বললাম কারণ ও আমাদেরও রোডি হয়া কাজ করছে। লোকটা ক্রিম ছাড়ছিল হ্যাংওভারের কারণে এক গিগে যাইতে পারার ব্যর্থতা নিয়া। পরে ও আর ওর সহযোগীরা জাস্ট চাবিটা কোনোমতে ম্যানেজারের লেটার বক্সে দিয়া চম্পট দিছিল রাত্রিবেলা, আগেপিছে সবার বিপদ না ভাইবা। আমাদের ক্ষেত্রে ওর কুকর্ম ছিল মাইলের হিশাব আর বিলের হিশাবের আকাশপাতাল ফারাক উপস্থাপন করা। ওর লন্ডন থেকে ব্রাইটনের তেলের বিল দেইখা ভাবা স্বাভাবিক যে, ব্রাইটন সম্ভবত বলকানের কাছাকাছি কোন অঞ্চলে। ফলে বিদায় করে দেয়া ছাড়া কী করতে পারতাম আমরা। এর পরের রোডি তুলনামূলক সফল, তবে যখন বুঝলাম আমাদের ডব্লিউইএম স্পিকার নিয়া ঝামেলা হইতেছে তখন পুরা ঘটনাটা খোলাসা হইলে তারেও বাদ দিতে বাধ্য হইছিলাম। আমাদের সাথে ডব্লিউএম স্পিকারের একটা স্পনসরশিপের চুক্তি হইছিল, কিন্তু আমরা বা চার্লি ওয়াটকিন্স কোনভাবেই বুঝতে পারতেছলাম না এত ঘনঘন স্পিকার নষ্ট হইতেছিল কেন। পরে বুঝলাম ওই রোডি পুরানা স্পিকার দিয়া নতুন স্পিকারগুলারে ক্রমাগত রিপ্লেইস করা যাইতেছিল। সাউন্ডের চমকের পেছনে এই হইলো কারণ।
ক্রুদের এমন শোচনীয় অবস্থার কারণে ব্ল্যাকহিলের ব্যান্ড, ম্যানেজমেন্ট, সহকারী- সবাইকেই কাজে হাত লাগাইতে হইতো। ক্রুদের হয়তো সন্ধ্যায় নরফোকের জন্যে একই ভেন্যুতে দুইটা ইভেন্টের কাজ করে আবার লন্ডনে এসে ইউএফওতে রাত দুইটার শো’ এর জন্যে সব নামাইতে হইত। আস্তে আস্তে রোড ক্রুরাও নিজেদের কাজকে গোছায়া নিতেছিল, বিশেষ করে পিটার উইলসনের আগমনের পর থেকে। পিটার পেশায় থিয়েটারের অভিজ্ঞ আলোকসজ্জা বিশেষজ্ঞ। অ্যালডারম্যাস্টন মার্চে অংশগ্রহণ করার জন্যে ওকে আউন্ডেল স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয়। তারপর স্থানীয়, প্রাদেশিক এবং শেষে ওয়েস্ট এন্ড থিয়েটার ওয়ার্কে যোগ দেয়। গার্লফ্রেন্ডের সাথে ওর একটা ফ্ল্যাট ছিল অ্যার্লহ্যাম স্ট্রিটে, যেইখানে সিড থাকতো। ওর গার্লফ্রেন্ড সুজি ক্যামব্রিজে থাকসে কিছুদিন, তাই চেনাজানা মিউচুয়াল কিছু বন্ধুও ছিল।
অল সেইন্টস চার্চ গিগগুলার সময় পিটার উইলসন প্রায়ই আসতো আমাদেরকে দেখতে। জো গ্যানোন যেহেতু লাইটিঙের দায়িত্বে ছিল, তাই পিটার রোড ম্যানেজারের কাজে লাইগা যায়। যাই হোক, একটা বিশেষ রকমের ঝামেলা ছিল ওর— পিটারের কোন ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না। ফলে রিক গাড়ি চালাইতো, আর পিটার ইকুইপমেন্টগুলা দেখত। ও তারপর সাউন্ডে আসে। জো চলে যাওয়ার পরে লাইটিঙের দায়িত্বেও নেয় সুজি আর ও।
পিটার উইলসন পিটার আর অ্যান্ড্রুর লাইটিঙের আয়োজনটা একেবারে নিজের কান্ধে তুইলা নেয়। আগে ওরা দুইজন মিলা যা করতো সেটা পিটারের প্রফেশনাল বিচারের কাছে ভুগিচুগি দিয়া কাজ চালানো ছাড়া কিছু না। তারপরেও ভালোই চলছে। কিন্তু এক কলেজ গিগে দুই তার জোড়া লাইগা লাইটিং এর তার দিয়া ৪৪০ ভোল্টে পাস কইরা আগুন ধইরা গেছিল। পিটার আরও অ্যাডভান্সড সিস্টেম দাড়া করায় ১০০০ডব্লিউ র্যাঙ্ক অ্যাল্ডিস প্রজেক্টর দিয়া, এবং নানাভাবে লাইট নিয়া কারসাজি শুরু করে পোলারাইজার, ল্যাটেক্সের মেমব্রেইন দিয়া। এত খুব দৃষ্টিআকর্ষণীয় কিন্তু নমনীয় রঙ তৈরি হইতো। তো পিটার একদিন উপলব্ধি করল সবচেয়ে ভালো পোলারাইজড স্ট্রেস প্যাটার্ন তৈরি করা যায় কন্ডম দিয়া। একবার এই কারণে আমাদের ভ্যান আর রোড ক্রুদের পুলিশ আটকাইছিল। পুলিশ অবাক হয়া খেয়াল করল সামনের সিটে বইসা বইসা ক্রু জন মার্শ কন্ডম কাটতেছে একের পর এক। ‘চিন্তা কইরো না’— পিটার জবাব দিছিল, ‘ও আমাদের রোড ক্রু, মাথায় ছিট আছে সামান্য’।
লাইট নিয়া আরেকটা কারসাজি করতাম একটা দীর্ঘ লেন্সের সামনে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি আয়না বসায়া, এর কারণে আয়নাটা কাঁপতে কাঁপতে লিস্যাজো প্যাটার্ন তৈরি করতো। গেটের মধ্যে কাটারি আর রঙিন চাকা বসায়া চাকার ঘুরান্তিতে রঙের দেখে পোকার কিলবিলের মতো লাগতো । মুভি লাইটের উজ্জ্বল ব্যবহার ছিল পিটারের আবিষ্কারের মধ্যে অন্যতম। এই লাইটের সামনে একটা রঙিন গ্লাস হুইলকে ঘুরানো হইতো মোটর দিয়া। এই যন্ত্রটা রাখা হইতো দুই বাই থ্রি ফিট একটা বক্সের মধ্যে, এবং তারপর ব্যান্ড কিংবা বড় রাবার ফিটের উপর তাক করানো হইত। বিশেষজ্ঞ না থাকার কারণে পিটার সাধারণ সরকারী উদ্বৃত্ত দোকান মিলিট্যারি কোয়ালিটির ক্যাবল আর কানেক্টরগুলা জিনিশগুলা কিনা নিয়া আসতো। খুব ভালো কাজে দিছিল এইসব।
পিটারের এই কৌশলগুলার ফলাফল ছিল চরম। টু হুইলসের মাধ্যমে সম্ভাবনা দিগুণ না, বর্গের হিশাবে বাইড়া যায়। এটা দিয়া আমরা যে রঙিন জগত তৈরি করতাম সেটা এক বিশাল অনুভব— ‘রুপালী বেগুনি ধাতব রঙ। নিকের হাত হয়তো স্ক্রিনের পেছনে রঙধনুর মধ্যে বিলীন হয়া যাইতো।’ কিন্তু বিষম গরম, ঝাঁকি আর দুরন্ত ঘূর্ণনরঙ প্রায়ই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চইলা গিয়া শব্দ কইরা ছড়ায়া পড়ত এবং দ্যাখা যাইত গ্লাসের টুকরাগুলা ব্যান্ডের খুব কাছাকাছি আইসা ছিটকা পড়ছে। এর জন্যে এক্সট্রা গ্লাস আর প্রাথমিক চিকিৎসার বাক্সও সাথে রাখা ফরজ হয়া দাড়াইছিল। মানবজাতির প্রতি এরকম শত্রুতাপূর্ণ মনোভাবের কারণে রজার আর আমি এই যন্ত্রপাতির নাম দিছিলাম ‘দ্যা ডালেক্স’। আলোকসজ্জা আমাদের শো’য়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ আর সেই সুরে মেলোডি মেইকারে বলসিলাম, ‘লাইটিং ম্যান আক্ষরিক অর্থেই আমাদের ব্যান্ডের সদস্য’, যদিও রয়্যালটি শেয়ারের জায়গাটা সাবধানে পাশ কাটায়া গেছিলাম।
রাস্তার খরচ কোনভাবে চালায়া নেয়া হইতো তখন। অ্যালকোহল কিনতে গেলে রাস্তার পাশের লাইসেন্স ছাড়া দোকান থেকে কিনতাম যাতে বারের থেকে খরচ কিছুটা বাঁচে। দূরের শো হইলে হোটেলে থাকার থিকা লং ড্রাইভে বাসায়ই আইসা পড়তাম, এই জায়গায় অন্যান্য ব্যান্ডের মতো সেই জান্তব জীবনটা কাটানো হয় নাই। ব্রায়ান মরিসনের এজেন্সিরে ধন্যবাদ, কারণ ওর বদৌলতেই উপলব্ধি করলাম এক জীবন ভ্যানে ভ্যানেই শেষ হয়া যাতেছে। এর মধ্যে বাড়তি পাওনা ছিল রাস্তাঘাটে পেট্রল শেষ হয়া যাওয়ার আতঙ্ক।
কাজটাজ বাইড়া যাওয়ার পরেও টাকাপয়সা খরচ করতে হইতো খুব সাবধানে কারণ আমরা তখন প্রতিনিয়ত নিজেদের ইন্সট্রুমেন্ট আপগ্রেড করতেছি। প্রস্তাব করা হয় সপ্তাহে ত্রিশ পাউন্ড পাবো আমরা, কিন্তু সাত পাউন্ডের বেশি পাইতাম না কখনো। ফলে এই ইনকামের গ্যাটিস দেয়ার জন্যে অন্যান্য রাস্তাও দেখতে হইতো। একবার ফেরি ক্রস করার সময় জন মার্শ অফার কইরা বসলো রজার যদি ওরে বিশ পাউন্ড দেয়, তাহলে ও পুরা ফেরিতে হামাগুড়ি দিয়া কুত্তার মতো ঘেউ ঘেউ কইরা ঘুরতে রাজি । রজারের বিবেচনায় এটা অসাধারণ একটা প্রস্তাব হইলেও ফেরির যাত্রীদের কাছে ছিল বিপত্তিকর। দরকষাকষি কইরা আরেকটা প্রস্তাব পেশ কইরা বসে জন। ও যদি মাঝ-চ্যানেলে ফেরি থেকে লাফ দিয়া নাইমা ইংল্যান্ড ব্যাক করে তাহলে রজারের বাড়ি ওর নামে লিখা দিতে হবে। রজারের যেহেতু বাজি ধরার নেশা ছিল, তাই পুরা ব্যাপারটা মনপুত হয়। আর ও জানতো জন জীবনেও এই কাজ করবে না। আর তাছাড়া জন না থাকলে পুরা ট্রিপটা যে লাইট ছাড়া কাটাইতে হবে, তাই সেইদিন যুক্তিরই জয় হইছিল।
‘এরকম সীমাহীন যাত্রাগুলার মধ্যে আমরা চেষ্টা করতাম ইউএফওতে বাজানোর জন্যে, যদিও সাতষট্টির পর মাসে একদিনের বেশি বাজানো সম্ভব হইতো না। যাই হোক, এর পরে দুইটা দিনে আমরা আমাদের আসল শ্রোতাদের সামনে বাজানোর সুযোগ পাইছিলাম। একটা হচ্ছে এপ্রিলের রাতব্যাপী ‘১৪ আওআর টেকনিক্যাল ড্রিম’। এই শো’য়ে সফট মেশিনের আর্থর ব্রাউন আর অ্যালেক্স হার্ভে আসছিল। হপি পুরা জিনিশটা অ্যারেঞ্জ করছিল পুলিশ রেইডের পর আইটি ম্যাগাজিনের ফান্ড কালেকশনের জন্যে। অনেকের জন্যে এই শো’টা সাইকাডেলিক ইভেন্টের উচ্চতম বহিঃপ্রকাশ। পিটার জেনারের ভাষ্যে, ‘এটা সামগ্রিকতার একটা প্রতীক’। অ্যামেচার সাইকাডেলিয়ার শিখর, মুকুট পরানোর অনুষ্ঠান, পুরা গ্যাং এর সর্বশেষ বড় ঘটনা। পিঙ্ক ফ্লয়েড যখন সন্ধ্যার দিকে সেই ধ্বংসস্তূপন্যায় স্টেইজে আইসা দাঁড়ায়, তখন চারদিকে আলো ঠিকরে পড়তেছে। আর লোকজন স্ক্যাফোলিন্ডং টাওয়ার বায়া উপরে উঠতেছিল ওদের দ্যাখার জন্যে। সবাই এসিড ট্রিপে, যদিও ব্যান্ডের কেউ না। অবশ্য সিড হইতে পারে। অসাধারণ গিগ। একমাত্র উপরওয়ালা সাক্ষী সাউন্ড কেমন ছিল।’
কিন্তু অনেকেই পুরা ব্যাপারটার মধ্যে ব্যবসায়িক ধান্দা আঁচ করে বসে, কারণ এটারে আন্ডারগ্রাউন্ড মুভমেন্টের অনুষ্ঠানের থেকে রক কনসার্ট বলাই যুক্তিযুক্ত। মাইলস তখন স্টেইজের সাইডে দাড়ায়া, যে বিখ্যাত নিজেদের প্রোটো পাঙ্ক অভিব্যক্তির খাতিরে অডিয়েন্সদের উপরে পেশাব কইরা দেয়ার জন্যে। ওরা না কী সেল আউট সেল আউট বইলা চিল্লাইতেছিল। আমার ঘটনাটা মাথায় নাই, কিন্তু পুরা শো’টা আসলেই সেল আউট ছিল। আমাদেরকে ইউএফও’র যে শ্রোতারা ভালোবাসতো তারাও দশ ফুট স্টেইজ আর পুরা ঘটনাটা দেইখা খুব খুশি হইতে পারছিল না।
আমাদের দিক থেকে টেকনিকালার ড্রিমটা লজিস্টিক দুঃস্বপ্নের মতো হাজির হইছিল। ওই রাত্রেই আমরা হল্যান্ডে শো কইরা এক ডাচম্যানের গাড়িতে বিদ্যুৎবেগে ছুইটা এয়ারপোর্টে গেছিলাম লাস্ট ফ্লাইট ধরতে, তারপর দৌড়াতে দৌড়াইতে নর্থ লন্ডনে যাতে শো’টায় অংশগ্রহণ করতে পারি। এই আসা যাওয়ার ভেতরে সাইকাডেলিক ভালোবাসা উপভোগ করা অনেক দূরের কথা। সিড তখন চারপাশ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন। এসিড ট্রিপের না কী স্নায়ুঘটিত সমস্যার জন্যে-সেটা এখনো জানি না।
এর তুলনায় এক পাক্ষিক পরে ‘গেইমস ফর মে’ শো’টাকে বলা যায় আমার জীবনে বাজানো শ্রেষ্ঠ শো’গুলার মধ্যে একটা। কারণ এই কনসার্টে এমন কিছু উপাদান উপস্থিত ছিল যেটা আমাদের পরবর্তী ত্রিশ বছরের অংশ হয়া যায়। পিটার আর অ্যান্ড্রু ক্রিস্টফার হান্টের মাধ্যমে কুইন এলিজাবেথ হলে অনুষ্ঠানটার আয়োজন করে। এই ক্রিস্টফার হান্টের মাধ্যমেই এর আগে কমনওয়েলথ ইন্সটিট্যুটে বাজাইছিলাম আমরা এবং এই শো’তেও ক্রিস্টফারের ক্ল্যাসিকাল মিউজিকের দখল অমূল্য বলে বিবেচিত হয়। কারণ ওর বদৌলতেই অনুষ্ঠানটা আয়োজন করা সম্ভব হইছিল। দুই ঘন্টার অনুষ্ঠানটার জন্যে প্র্যাক্টিসের সময় কম থাকলেও আমরা এটাকে মাল্টিমিডিয়া শো হিশাবে পোষায়া দিছিলাম। আমাদের অন্যান্য গিগের মতো এইখানে আর কেউ বাজাইতে আসে নাই আগে পরে, তাই দর্শকদের নিয়ন্ত্রণে নেয়া তুলোনামূলকভাবে সহজভাবেই হয়া যায়। দর্শকরা বসলো এবং এরকম একটা রক কন্সার্টে নাচানাচির থেকে তারা শুনে আর দেখেই কাটায়া দেয়ার পরিকল্পনা নিয়ে আসছিল মেবি। শো’টার বড় একটা অংশ দখল কইরা রাখছিল ইম্প্রোভাইজেশন। সি এমিলি প্লে র প্রিমিয়ারও হইছিল একটা। এইখানে বলে নেয়া ভালো, সবাই সিডকে স্মরণে রাখছে তার অতুলনীয় লিরিকের জন্যে, কিন্তু তার ইম্প্রোভাইজড রক মিউজিকের ভাবনাও একই রকম কৃতিত্বের দাবিদার।
এইখানে আমরা কিছু এক্সট্রা লাইট নিয়ে আসছিলাম, সাথে কিছু ঘরোয়া স্লাইড প্রোজেক্টর এবং এগুলা একেবারে স্টলের মাঝখানে প্রোজেক্টরগুলা বসাইতে হইছিল আলোর জন্যে। সেই কারণে কিছু যান্ত্রিক এবং আইনগত ঝক্কিও ম্যানেজ করতে হয়, কারণ লাইটিং আর সাউন্ড তো স্টেইজের পাশ থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা হইত। তার কয়েকবছর পর থেকেই অবশ্য সাউন্ড আর লাইটিং ডেস্ক অডিটরিয়ামের মাঝখানে বসানোর রেওয়াজ শুরু হয়।
আইটি পত্রিকার মতে, ‘শো’টাকে বলা যায় বিংশ শতাব্দীর খাঁটি চেম্বার মিউজিক। উপস্থাপনের পরিচ্ছনতার কারণে মিশ্র মিডিয়ার তুলনামূলক কম ব্যবহার ছিল বুদ্ধিমানের কাজ’। এটা একটা লজ্জার বিষয় যে আমরা এই অভ্যর্থনাটা ভালোভাবে গ্রহণ না করতে পাইরা একই রকমের কাজ পরবর্তী বছরে করে গেছি।
অ্যাজিমাথ কোঅর্ডিনেটর নামের একটা ডিভাইস আমরা প্রথম ‘গেইমস ফর মে’ শো’তে নিয়া আসি, যেটা রিক পরিচালনা করতো। জিনিশটা অ্যাবে রোডের টেকনিক্যাল এঞ্জিনিয়ার বার্নার্ড স্পেইটের কমিশন করা। দুইটা চ্যানেল ছিল এটাতে জয়স্টিকসহ, একটা ফারফিসা অর্গ্যানের জন্যে, আরেকটা সাউন্ড এফেক্টের জন্তে। জয়স্টিক খাড়া করে রাখলে সাউন্ডটা হইত কেন্দ্রকে আবর্তন কইরা, আর কোনাকুনিভাবে ঘুরাইলে স্পিকার থেকে হলের সব জায়গায় সমানভাবে সাউন্ড পৌছায়া যাইত। রিক ইচ্ছা করলে ওর কীবোর্ডের সাউন্ড একধরণের ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে অডিটরিয়ামে ছড়ায়া দিতো, আর তা না হলে রিভক্স টেইপ রেকর্ডার দিয়া একপাশ থেকে আরেকপাশে ছড়ায়া দিতো। আমরা কেউ মনে করতে পারি নাই এই যন্ত্রণটার নাম কে দিছিল, তবে অক্সফোর্ড ইংলিশ অভিধান অনুসারে অ্যাজিমাথ মানে ‘‘the arc of the heavens extending from the zenith to the horizon, which cuts it at right angles’। বেশ ভালোই মিলা গেছে, আমার মতে।
অবশ্য এই শো’য়ের পরে কুইন এলিজাবেথ হল থেকে আমাদেরকে ব্যান করে দেয়া হয় চিরদিনের জন্যে। কারণটা এই না যে আমাদের উত্তেজিত ফ্যানরা সিট ছিঁড়ে ফেলছিল। ওরা ব্যান করসিল কারণ আমাদের এক রোড ক্রু পুরা অ্যাডমিরাল অফ দ্যা ফ্লিটের ড্রেস পরে শো’য়ে হাজির হইছিল। হল কর্তৃপক্ষে কাছে এইটাকে বড় রকমের নিরাপত্তা ঝুঁকি হিশাবে বিবেচনা না কইরা রাস্তা ছিল না।
এই ধরণের আচরণকে, বলতে বাধ্য হইতেছি, বলা যায় ভেন্যু ম্যানেজমেন্টের সাথে রক ব্যান্ডগুলার একপ্রকারের সাধারণ শত্রুতা আর অসম্মানের নজির। নিরাপত্তা আর আলোকসজ্জার ক্ষেত্রে তারা এমন এমন সব আইনকানুন চাপায়া দিতো যে দেইখাই বুঝা যাইতো এসব ব্যাপারে তাদের কোন সমর্থন নাই। সবচেয়ে বিরক্তিকর ব্যাপার হইলো, অন্যান্য পারফর্মারদের থেকে রক পারফর্মারদের জন্যে ভেন্যুগুলা আলোকসজ্জার জন্যে বেশি লাইট বরাদ্দ রাখতো। আমাদের জন্যে ব্যাপারটা বিধ্বংসী হয়া দাঁড়ায়, কারণ লাইট শো ছাড়া আমরা অপূর্ণ। সবসময় একটা এয়ার রাইফেল রাইখা নিশ্চিত করতে হইতো যে আমাদের পছন্দমতো লাইটিং হইতেছে। দেখতে দেখতে স্বাভাবিকভাবেই সব বড় ভেন্যু থেকে আস্তে আস্তে ব্যান খায়া গেলাম। অ্যান্ড্রু কিং এর ভাষ্যে, ‘ব্যান না করলেও তো তুমি বইলা বেড়াইতা যে আমাদের না কী ব্যান করা হইছে। আমার ধারণা সব আর্টিস্টই কিছুদিনের জন্যে হইলেও অ্যালবার্ট হল থেকে ‘আজীবন বহিষ্কৃত’ হইছে… ‘
‘আর্নল্ড লেইন’-ও ব্যান করা হইছিল রেডিও লন্ডন, রেডিও ক্যারোলাইন আর বিবিসি থেকে। তাই গান প্রচার করাটা ঝামেলাপূর্ণ হয়া যায় কারণ রেডিও স্টেশন খুব বেশি ছিল না সংখ্যায়। ব্যানের কারণ অদ্ভুত, এই লিরিক না কী ‘সেক্সুয়াল পারভার্শন’-এর ইঙ্গিত দেয়। অবশ্য তার খুব বেশিদিন পরে না যখন তারা ল্যু রিডের ‘ওয়াক অন দ্যা ওয়াইল্ড সাইড’— এ যৌনতার কিছু খুইজা পায় নাই। একবিংশ শতাব্দীতে আইসা এটা খুব অ্যাবসার্ড যে এসব নিয়া এত অচ্ছুৎ ভাবধারা তখনও বহাল। সেন্সরশিপের জায়গাটা কারণ ছাড়া টাইট রাখার কোন মানে নাই। ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত লর্ড চেম্বারলেইন লন্ডনের থিয়েটারগুলা নিয়ন্ত্রণ করতো। আর আমাদের তো চুহাত্তর সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ বোর্ড অফ ফিল্ম সেন্সর থেকে ছাড়পত্র নিতে হইতো লাইভ শো’য়ের ফিল্মগুলার জন্যে।
যে-কোন ভাবেই রেডিওতে বাজাইতে পারা বেশ কঠিন একটা ব্যাপার ষাটের দশকে, কারণ সম্প্রচারের সময় অত্যন্ত কম। মিউজিশিয়ান ইউনিয়ন একটা চুক্তি করসিল বিবিসির সাথে, যে কারণে রেডিওতে রেকর্ড বাজানোর থেকে রেডিও অর্কেস্ট্রাতে চাকরি করা মিউজিশিয়ানরা বেশি সুযোগ পাবে লাইভের। যতদিন পর্যন্ত তারা বিলাপ করার সাথে সাথে ট্রাম্পেট সলো বাজাইতো ততদিন ঠিকই ছিল, কিন্তু যখন তারা ‘পার্পল হেইজ’ নতুন কইরা তৈরির চেষ্টা শুরু করলো, সেটার ফল দাঁড়াইল কানবিধ্বংসী।
এইসব প্রতিবন্ধকতা কাটানোর জন্যে একটা উপায়ই খোলা থাকতো টপ টোয়েন্টিতে পৌঁছানোর— অ্যালবাম বিক্রির একটা হাইপ তৈরি করা। ইলেক্ট্রনিক পয়েন্টের হিশাবের আগের যুগে পুরা ব্যবস্থাটা ছিল একেবারে সিম্পল। সবাই যেহেতু অবিক্রিত এ্যালবাম ফেরত দিয়া দিতো, তাই লোকজন ধইরা নানা দোকানে পাঠায়া একের পর এক অ্যালবাম কিনলেই কেল্লা ফতে। তবে সাবধানের মাইর নাই- হুট কইরা গাড়ির পেছন থেকে অ্যালবামের ঢল বের হয়া আসলেই ধরা। কোন এক বিশেষজ্ঞকে একশো পাউন্ড ধরায়া দিলেই সে গাড়ির পেছনে চকলেট আর ফুল নিয়া দোকানে দোকানে গিয়া সব কিনে নিয়া আসত সেলসগার্লদের পটায়া।
আর্নল্ড লেইন রিলিজ করি সাতষট্টির মার্চে আর গানটা ক্যামনে জানি টপ টোয়েন্টিতে স্থান কইরা নেয়। সি এমিলি প্লের আমরা চেষ্টা করসিলাম অ্যাবে রোডে রেকর্ড করার জন্যে, কিন্তু কোন এক কারণে সেইখানে হইতেছিল না। ফলে আমরা আবার সাউন্ড টেকনিকের ম্যাজিক ফর্মুলায় ফিরা গেলাম। জোয়ের খুশি তখন কে দ্যাখে!
‘এমিলি’ বের হওয়ার পর আর্নল্ড লেইনের ব্যানের কারণে একপ্রকারের লাভ হইছিল। ওরা লজ্জা পাইতেছিল যে এমন নতুন আর্স্টিস্টদের তারা গ্রহণ করতে পারতেছে না এই ভাইবা। সব রেডিও স্টেশন একইসাথে গানটা বাজানোর জন্যে দুই সপ্তাহের মধ্যে আমরা সতেরোতে উইঠা আসি। আর এই টপ টোয়েন্টির মারফত টপ অফ দ্যা পপেও হাজির হইতে পারসিলাম। আর অনেক মানুষ টপ অফ দ্যা পপ দ্যাখার কারণে বেশ ভালো একটা প্রচার হয়া যায় এর মাধ্যমে। টেলিভিশনের দর্শকরা সবাই দেখতেছিল আমাদের, তাই লাইভ ব্যান্ড হিশাবে টাকা কামানোর পথটাও প্রশস্ত হয়া ওঠে। ‘টিভিতে দেখসি’— এটার মূল্য কমসেকম একশো কুইড।
শোয়ের সেই দিনটার বেশিরভাগ সময় কাটাইসিলাম বিবিসির লাইম গ্রুভে মেইক আপ, ঝিকমিকা জামাকাপড়, চুল ধোয়া আর কাটতে কাটতে। রোড ক্রুরা যখন বুঝতে পারলো ভেতরের লোকজন জানে না কে কে ব্যান্ডের সদস্য, তখন তারাও ভিতরে গিয়া চুলদাড়ি কাটায়া নিলো। বলতে দ্বিধা নাই, চেহারা থেকে নুরানি আভা বের হওয়া রোড ক্রু আমি আর কোথাও দেখি নাই সেই রাত্রের মতো।
যাই হোক, শো’টা আমার কাছে ছিল পুরাদস্তুর একটা এন্টিক্লাইমেক্স। মাইমিং জিনিশটাই ভোতা লাগতো, আর সেদিনেরটার তো কথাই নাই। আর ড্রামারদের পক্ষে মাইম করার চেয়ে বোরিং কাজ আর নাই। সাউন্ড যাতে কম আসে এর জন্যে ড্রামের স্কিনে জোরে বাড়ি দেয়ার উপায় ছিল না, অথবা হাল্কা কইরা পাশে বাড়ি দিতাম— কিন্তু যে- কোন মূল্যেই দুইটাই বিড়ম্বনার। পরে যখন এমন হইছে, দ্যাখা গেছে প্লাস্টিকের সিম্বলস আর প্যাড ইউজ করসি। আর বাজানোর সকল রকমের উত্তেজনা প্রদর্শন করতে হইতো প্রকৃতপ্রস্তাবে কিছু না কইরাই। শো’য়ের সাথে তুলনা করলে এর থেকে আত্নবিধ্বংসী কাজ আর কিচ্ছু নাই। টেলিভিশনে বাজানোর পর ভাবসিলাম পুরা দুনিয়াটাই চেইঞ্জ হয়া যাবে, কারণ আমরা তো এখন আসল পপ-স্টার। কিন্তু কিছুই হইছিল না। দুনিয়া আগের মতোই চলতে লাগলো, এবং আমরা আরেক ভয়াবহ ভেন্যুতে বাজাইতে গেলাম যেখানে লোকজন আমাদের আগের মতোই অপছন্দ করতো। কিন্তু কমসেকম তারা তো আমাদের টিভিতে দেখছে— এই হইলো সান্ত্বনা।
‘পরবর্তী সপ্তাহে আমরা সতেরো থেকে পাঁচে উইঠা গেলাম, ফলে আবার বাজানোর ডাক পড়ল। একইভাবে। এর পরেও তৃতীয়বারের মতো হইতো ডাক পড়ত, কিন্তু সিড একেবারে বাইকা বসলো না যাওয়ার জন্যে বিপদের কথা চিন্তা কইরা। তবে যুক্তিটা দাড়া করাইলো, ‘জন লেননের যদি টপ অফ দ্যা পপে না যাইতে হয়, তাইলে আমরাই বা যাবো ক্যান?’
আমরা জানতাম, এক নাম্বারে পৌঁছানোর কোন সম্ভাবনাই নাই এই গানের। আমাদের সাথে সাথে প্রকল হারুমের ‘অ্যা য়োআইট শেইড অফ পেইল’ বের হইছে ঠিক একই সময়ে, এবং সেটাই যে এক নাম্বারে যাবে নিশ্চিত সবাই। প্রতি সপ্তাহে আমরা দুরুদুরু বুকে আশা করতাম যে সবাই হয়তো ‘য়োয়াইট শেইড’ এর কপি কিনা ফেলছে, তাই চান্স এখনো আছে আমাদের। কিন্তু লোকজনের হয়তো শর্ট টার্ম মেমোরির প্রবলেম ছিল অথবা তারা একই সিডি দুই কপি করে কিনছিল, কারণ এক নাম্বারে কোন নড়চড় আর লক্ষ্য করা গেল না। (হারুমের গ্যারি ব্রুকার মেলোডি মেইকারের জন্যে রিভিউ করতো, আমাদের এমিলি শুইনা সে সাথে সাথে বলসিল, ‘এইটা পিঙ্ক ফ্লয়েড। ওদের হরিবিল অর্গ্যান সাউন্ড শুইনাই বুঝা যায়’।)
সিড ছাড়া আমাদের সবারই বাণিজ্যিকভাবে সফলতার আকাঙ্ক্ষাটা আকৃষ্ট করতেছিল আস্তে আস্তে। পিঙ্ক ফ্লয়েডের তখনকার ইএমআই প্রযোজক নর্ম্যান স্মিথে একটা ঘটনা প্রায়ই বলে। আর্নল্ড লেইনের পর আমরা না কী যখনই নতুন কোন সিঙ্গেল, বিশেষ করে সি এমিলি প্লে’র রিলিজের আলাপ করতাম, সিড ভাব দেখাইত সিঙ্গেল একটা বদখত জিনিশ। খুবই বিরক্ত হইতো। যদিও ওর ক্যাচি মিউজিক্যাল আইডিয়া নিয়া ঝামেলা ছিল না , কিন্তু কোন কিছুর ‘বাণিজ্যিক’ দিকটা সে তীব্রভাবে অপছন্দ করতো।
ইএমআই থেকে নর্ম্যান স্মিথকে সাউন্ড টেকনিকে পাঠানো হইসিল সি এমিলি প্লের রেকর্ডিং এর তদারকি আর আমাদের প্রথম অ্যালবামের দ্যা পাইপার অ্যাট দ্যা গেইট অফ দ্যা ডনের প্রযোজনার জন্যে। এই অ্যালবামটার কাজ শুরু হয় সাতষট্টি সালে, অ্যাবে রোড স্টুডিওতে। স্মিথ নিজে চাইতো ‘বিখ্যাত জ্যাজ মিউজিশিয়ান’ হইতে। দ্যা টাইমস পত্রিকায় ইএমআই এর শিক্ষানবিস এঞ্জিনিয়ারের জবের অ্যাড দেইখা আবেদন করসিল। সেই চাকরীর জন্যে বয়সসীমা ধরা হইছিল সর্বোচ্চ আটাশ বছর, আর ও তখন মধ্যতিরিশে। কিন্তু বিস্ময়কর কোন কারণে একশো জন আবেদনপ্রার্থীর সাথে সাথে ওকে সাক্ষাৎকারের জন্যে ডাকা হয়। সদ্য উঠন্ত ক্লিফ রিচার্ড সম্পর্কে ওর অভিমত জানতে চাওয়া হইছিল ভাইভায়, ও তখন ক্লিফ নিয়া সে ভালো কিছু বলসিল না। কিন্তু তারপরেও, নর্ম্যানের সাথে সবাই বিস্ময়করভাবে সহমত প্রকাশ করছিল ভাইভার লোকজন। এবং এরপরেই ও চারজনের একজন হিশাবে চাকরিটা পায়।
কাজে যোগ দেয়ার পরে ওকে ঘর মুছা থেকে শুরু করে সিগারেট আনা, ছুটছাট কাজ সবই করতে হইছে। অবশ্য মাঝে মাঝে এঞ্জিনিয়াররা ওকে বলতো দুই একটা বাটন চাপ দিতে। তারপর একদিন ‘আজব হেয়ারকাটের চারটা পোলা’ আসলো একদিন। বিটলস। অ্যাবে রোডে বিটল আসার পর ওদের প্রাথমিক পরীক্ষা রেকর্ড করার জন্যে নর্ম্যানকে নিয়োগ দেয়া হয়। এরপর ও ভাবসিলো, ‘ভদ্রভাবে বললে, আমার দেইখা লাগে নাই ওদের নিয়া কোন আশা ভরসা আছে’। বিটলসের চিন্তা ছিল ভিন্ন এবং নর্ম্যান ওদের রাবার সৌল অ্যালবাম পর্যন্ত রেকর্ড করসি পরে।
ওর বরাবর ইচ্ছা ছিল প্রযোজক হওয়ার। আর জর্জ মার্টিন এআইআর স্টুডিওর জন্যে ইএমআই ছাড়ার পর ওকে প্রস্তাব দেয়া হয় পার্লোফোন লেবেলের দায়িত্ব নেয়ার। ও একটা চিঠি পায় সেইসময় ব্রায়ান মরিসনের কাছে থেকে যে, পিঙ্ক ফ্লইয়েড নামের একটা ব্যান্ডের সাথে কাজ করতে রাজি কী না। ও আর বিচার স্টিভেনের তখনও একজন আরেকজনকে দ্যাখে নাই, কিন্তু জারিজুরি বিস্তৃতির একটা চাপা প্রতিযোগিতা কাজ করা শুরু করসিলো দুইজনের মধ্যে। দুইজনের চাইতেছিল ওদের হাত দিয়েই যাতে লেবেলটায় যোগ দেই। নর্ম্যানের মতে এই অপরিচিত দলটাকে নিয়া মুলামুলির ব্যাপারটা বেশ দ্যাখার মতোই ছিল বলা যায়, আর অগ্রিম পাঁচ হাজার পাউন্ডের প্রস্তাবটাও লোভনীয় বটে! সাইন করার পর ওরা নর্ম্যানকে ঘোষণা দেয় ওর চাকরি এখন হুমকির মুখে পড়ে গেছে।
আমার ধারণা ও আমাদেরকে জর্জ মাটিনের সাথে কাজ করার কথাই ভাইবা রাখসিল। আমাদের মতো ও’ও আগ্রহী স্টুডিওর সব সুযোগ সুবিধা পাওয়ার জন্যে। ওর ব্যবহারও ভালো আর নিজেও একজন দক্ষ মিউজিশিয়ান। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হইতেছে, ও কাজ শেখাইতে আগ্রহী ছিল, প্রযোজনার কাজে ধোঁয়াশা তুইলা বাঁধা দেয়ার মনোভাব রাখতো না একেবারেই।
আমাদের রেকর্ডিং এর জন্যে পিটার বৌন নর্ম্যানের সহকারী হয়া যোগ দেয়। পিটার ইএমআই এর অভিজ্ঞ হাউজ এঞ্জিনিয়ার, বহুবছর কাজের অভিজ্ঞতা আছে ওর। এক সেশনে পিটার আর অ্যান্ড্রু নতুন কমরেডকে চমকায়া দেয়ার জন্যে নতুন কোন গান খুজতেছিল রেকর্ড কইরা যাতে তাক লাগায়া দিতে পারে। আফসোসের বিষয়, আগের দিনে ওরা লেইট সেশনে ব্যস্ত থাকার কারণে পিটার বৌন কনসোলের ভেতরেই ঘুমায়া পড়ে এবং কিছুক্ষণ পরেই নিজের স্যুটে চইলা যায়।
স্টুডিও অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে আমরা প্রচণ্ড সৌভাগ্যবান ছিলাম যে নর্ম্যানের মতো কাউকে পাইছিলাম আমাদের তদবিরে। তখনকার দিনে মিক্সিং ডেস্কের আশেপাশে কোন মিউজিশিয়ান থাকার কথা কল্পনাই করা যাইতো না, আর সেশন প্লেয়ারদেরও ভাড়া কইরা নিয়া আসা হইতো স্টুডিওর সময় বাঁচানোর জন্যে। কিন্তু বিটলসই পুরা ব্যাপারটা চেইঞ্জ করতে দিতেছিল, ওদের ক্রমাগত সাফল্যের কারণে রেকর্ড কোম্পানিগুলা নাক গলানো কমায়া দিতেছিল আস্তে আস্তে। সত্যি কথা বলতে, বিটলসের কাছে আমরা আর্টিস্টরা খুব কৃতজ্ঞ এই কারণে যে পপুলার মিউজিক সৃষ্টির দায়িত্বকে তারা শিল্পের কাঁধে উঠায়া দিতে পারসিলো।
প্রথম দিন থেকেই নর্ম্যানের উৎসাহ ছিল পুরা প্রোডাকশন প্রসেসে আমরা যাতে সম্পৃক্ত থাকি। রেকর্ডিং এর সায়েন্স অ্যান্ড টেকনলজি নিয়া আমাদের উৎসাহ সহজেই ওর চোখে পড়সিলো। নর্ম্যানের ভাষায়, ‘বেশিরভাগ ব্যান্ডই তো মার্সে সাউন্ড ব্যান্ডওয়াগনের অংশ হইতে মুখায়া থাকতো।’
ওই সময়ে অ্যাবে রোড স্টুডিওকে (অফিশিয়ালি ইএমআই স্টুডিও) বর্ণনা করা যায় রক্ষণশীলতা আর প্রাগ্রসরতার একটা বিচিত্র মিশ্রণ হিশাবে। কোম্পানির একটা বিশাল এঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ নিজেদের রেকর্ডিং মেশিন, মিক্সিং ডেস্ক আর আউটবোর্ড গিয়ার নিজেরাই বানায়া নিতো। রেকর্ডিং হইতো ১/৪ মনো অথবা স্টেরিওটেপে, ফৌরট্র্যাক মেশিনে। সম্পাদনের কাজে ম্যাগ্নেটিজমের জন্যে সাউন্ড যাতে নষ্ট না হয় তাই ট্রেইনিরা ছোট্ট ব্র্যাস সিজর ব্যবহার করতো ঝামেলা এড়ানোর জন্যে। পুরা বিল্ডিংটাকে সবুজ রঙ দিয়া আচ্ছাদিত করা হইসিল যেটা দেখলেই লুব্যাংকার কেজিবি হেডকোয়ার্টারের কথা মাথায় আসতো।
বিবিসির মতো এই টাইপ প্রতিষ্ঠানগুলার আরেকটা বড় কৃতিত্ব একঝাঁক ভালো প্রকৌশলী তৈরি করা। ক্রমেই তারা যে-কোন ধরণের বাদ্য আর এন্সেম্বল রেকর্ড করায় দক্ষ হয়া ওঠে এবং রক মিউজিক থেকে শুরু কইরা হার্বার্ট ভন কারাজানের আশি পিস অর্কেস্ট্রাতেও দখল আইসা পড়ে। যদিও ক্ল্যাসিক্যাল আর পপের একটা বড় ভেদ খাড়ায়া ছিল তখনো এবং পপ রিলিজের কারণেই ক্ল্যাসিক্যাল মালমশলাগুলা রিলিজ করা সম্ভব হইতো। স্যার জোসেফ লকউড এই ভেদটা ভাইঙ্গা দেয়ার কারণে বড় কৃতিত্বের দাবিদার। আরেকটু খোলাসা কইরা বললে, সে ইএমআই তে যোগ দেয়ার দুই বছর আগে বোর্ড সিদ্ধান্তে আসছিল যে লং প্লেয়িং রেকর্ডের কোন ভবিষ্যৎ নাই আর।
অ্যাবে রোড স্টুডিওর আরেকটা দিক না বললেই না। যেহেতু তখনো ইলেক্ট্রনিক ইফেক্ট মেশিন আবিষ্কৃত হয় নাই, এই বিশাল সাম্রাজ্যটা স্টুডিওতে বহু রকমের যন্ত্রপাতির মালিক ছিল। বেল পিয়ানো, হ্যামন্ড অর্গান, ক্ল্যাভিনেটস, ট্যিম্প্যানি, গংস, ট্রায়াঙ্গলস, চাইনিজ ব্লিক, টেম্পল বেল, উইড মেশিন— কী না ব্যবহার করা হইতো (এই জিনিশপত্রগুলার ব্যবহার পাইপার আর সসারফুল অফ সিক্রেটে বেশ ভালোরকমেই ব্যবহার করা হইছে, এবং আমি নিশ্চিত— বিটলসের অনেক রেকর্ডিং এর ক্ষেত্রেও)। টাইল লাইন, একো চেম্বার ছাড়া চেম্বার একটা বিশাল সাউন্ড ইফেক্ট লাইব্রেরিও ছিল সেখানে।
যতদূর স্মরণে আছে, প্রথম অ্যালবামের রেকর্ডিং বেশ মসৃণভাবেই শেষ কইরা ফেলছিলাম আমরা। সবারই এক ধরণের উত্তেজনা কাজ করতেছিল তখন ভেতরে ভেতরে আর সিডও সন্তুষ্ট ছিল বলা যায়। যদিও নর্ম্যান সেটার সাথে দ্বিমত পোষণ করে। নর্ম্যানের মতে ‘রেকর্ডিংটা আমার জন্যে মোটেও সুখকর ছিল না। সবসময় ভাবতাম শীতল কিছু একটা চলতেছে কোথাও। সিডকে যা বলতাম সেটা নিয়া খেয়াল রাখতে হইতো খুব। ওর ঠিকঠিকানা ছিল না কোন। হয়তো দ্যাখা গেছে একটা ভোকাল ট্র্যাক নামাইছে, ওকে গিয়া বলতেছি,’’ ওকে সিড। ভালো ছিল, কিন্তু আরেকটু এটা সেটা ব্লা ব্লা…। সচরাচর সিডের উত্তর, ‘হুম্ম’। ফলে আবারও রেকর্ডিং শুরু করতাম, কিন্তু সিড একইভাবে গায়া যাইতো। আমি নিশ্চিত একশোবারও যদি টেইক নেয়া হইতো ও একইভাবে গায়া যাইতো। এই মানুষটা ভেতরে অন্যরকমের একটা জেদ কাজ করতো।’ আমরা এক দুইদিনেই গান রেকর্ড কইরা ফেলতাম। কারণ সেশনগুলার টাইম নিয়া টানাটানি ছিল— তিন ঘণ্টার; সকাল। বিকাল। সন্দ্যা। আর ফাঁকে ফাঁকে লাঞ্চ আর টিব্রেইক। এগুলা শেষ কইরাই সপ্তাহের অন্য দিনগুলায় গিগের জন্যে বের হয়া পড়তাম। রেকর্ডিং এর কাজটা সহজ হইছিল কারণ আমাদের লাইভ সেটাপেই যেহেতু ছিল। সেজন্যে এখন অ্যালবামটা শুনলে ইউএফও আর রাউন্ডহাউজের স্মৃতি ভাইসা উঠে। যদিও তিন মিনিটের বেশি বাজানোর সুযোগ ছিল না, আর সলোগুলাও বিরচিত।
যাই হোক, ক্যালিফোর্নিয়া বলরুমের বালের শ্রোতাদের কাছে থেকে ফালতু রেস্পন্সের কারণে অ্যালবামের সেট লিস্টের কিছু চখাম গান বাদ দেয়ার উপদেশ দেয়া হইছিল। এই গানগুলার বিকল্প পাওয়া তেমন কঠিন হয়া দাঁড়ায় নাই। অ্যান্ড্রু বলে, ‘সিডের তখন গানের জোয়ার চলতেছিল। একের পর এক গান লাভার মতো বের হয়ে আসতেছিল ওর ভেতর থেকে। কেউ কেউ এই প্রবাহের সাথে খাপ খাওয়াইয়া নিতে পারে, কেউ পারে না’।’ ইন্টারস্টেলার ওভারড্রাইভ’ এমন একটা গান, যদিও গিগে যা বাজাইতাম সেটা রেকর্ডিং এ বাজাই নাই। সিডের রিফের উপর ভিত্তি কইরা, মূল স্ট্রাকচারটা ঠিক রাইখা নানাভাবে বাজাইতাম। স্টুডিও রেকর্ডিং এ দশ মিনিটের কিছু কম হইলেও লাইভে কমপক্ষে বিশ মিনিট বাজাইতাম। এই ধরণের গানগুলাকেই একটু গতানুগতিক ধারায় অ্যালবামের জন্যে নতুন কইরা তৈরি করতে হইছিল টাইম লেন্থ মিল রাইখা। ঝামেলা ছিল এই গানগুলা লাইভে বাজানোর বেলায় খারাপ ভালো দুই ধরণের সাড়াই পাইছি, বিশেষ কইরা ইম্প্রোভাইজেশনের জায়গাটায়। তবে রেকর্ডিং এ সেইটা ছিল না, একই জিনিশ বারবার শুনতে হইতো। দুইটা অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন দুইটা জন্তুর মতো।
অপরপক্ষে, আমাদের তুলনামূলক সাধাসিধা গানগুলায় নর্ম্যান তার প্রডাকশন কারিকুরি দেখাইতে সক্ষম হইছিল। নানারকমের সন্নিবেশ, হার্মনি আর ইফেক্ট দিয়া সে নতুন এক মাত্রা যোগ করসিলো বাইরে থেকে। অ্যাবে রোডের চৌহদ্দিতে যা যা করা সম্ভব, তার সবই বাতলায়া দ্যাখার চেষ্টা করসিলো সে। খুব দ্রুতই বুঝতে পারলাম বাইরের জিনিশপত্র ব্যবহার করার অসীম এক সুযোগ সামনে হাজির হইছে— তাই সাথে সাথে ‘অ্যাস্ট্রনমি ডমিনির’ সাথে রেডিও ভয়েস কাটিং, ‘বাইক’ গানটার আউট্রোতে ঘড়ির শব্দ— এরকম জিনিশপত্র বসানো শুরু করলাম। যদিও এইসবের কোনকিছুই তেমন ইউনিক ছিল না, বলতে গেলে আমাদের আগে অনেকেই করতেছিল এইসব। কিন্তু তারপরেও কিছুটা নতুনত্ব তো ছিলই, যেটা পরবর্তীতে আমাদের মননশীলতার অন্যতম উপাদান হিশাবে প্রকাশ লাভ করে।
নর্ম্যান বিটলসের সাথে কাজ করার কারণে আমরা যে একটা পর্যায়ে গিয়ে ওদের বদৌলতে কিছু অনুরাগী পাবো, এটা আগে থেকেই আন্দাজ করছিলাম। সবকিছু বাদ দিলেও, যে পরিমাণ জিনিশপত্র ব্যবহার করতেছিলাম অ্যাবে রোডের, বলা চলে স্টুডিওই মোটামুটি আমাদের বাসাবাড়ি হয়ে গেল। যখন বুঝতে পারলাম আরও বেশিক্ষণ স্টুডিওতে থাকা দরকার, তখন আমাদের পার্সেন্টেজের হিশাবের আট শতাংশ থেকে পাঁচ শতাংশে নামায়া নিয়া আসি যাতে করে অফুরন্ত সময় পাই স্টুডিওতে কাজ করার।
আমরা কাজ করতাম দুই নাম্বার স্টুডিওতে, যেইখানে বিটলস লাভ্লি রিটা রেকর্ডিং এ ব্যস্ত ছিল। ওদের অসাধারণ সাউন্ড বিস্ময়কর রকমের পেশাদারিত্বের বিপরীতে আমরা ভয়ংকর বাজে লাইভ শো’য়ের অভিজ্ঞতায় ডুইবা আছি। তারপরেও কত কষ্ট কইরা যে নিজদের মনোবল চাঙ্গা রাখসিলাম সেটা এখন বিশ্বাস হইতে চায় না। আমাদের না ছিল অভিজ্ঞতা, না কোন টেকনিক্যাল জ্ঞানগরিমা। তখনকার অবস্থায় দুই ব্যান্ডকে তুলনা করলে হাস্যকর লাগে সব। আমরা কন্ট্রোল রুমের পিছনে চুপচাপ বইসা থাইকা ওদের মিক্সিং এর কাজ দেখতাম যতক্ষণ না একটা ভালোমতন সময় পার না করতে পারসি। বিটলস স্টুডিওতে আসলে একটা সাজ সাজ রব পইড়া যাইতো চারিদিকে। পাইপার রিলিজড হয় সাতষট্টিতে। পিটার জেনার নর্ম্যানের কাজে যারপরনাই কৃতজ্ঞ ছিল। ওর ভাষায়, ‘নর্ম্যান এক কথায় অবিশ্বাস্য। পিঙ্ক ফ্লয়েডের মিউজিক্যালিটি বিন্দুমাত্র নষ্ট না কইরা, সিডের লিরিকের মেজাজ সম্পূর্ণ বজায় রাইখা তিন মিনিটের মধ্যে যতোটা সম্ভব ততটাই সে ঢাইলা দিছিল। একদিকে কমার্শিয়াল, আরেকদিকে ফ্লয়েডের মিউজিকের চাপ।’ যাই হোক, পিটার এখনো অ্যালবামের বিক্রিবাট্টা নিয়া কিছু জানে না। ওর সব ধ্যানধারণা সিঙ্গেল নিয়াই ঘুরত। কিন্তু দ্যাখা গেলো, অ্যালবাম বের হওয়ার পর আন্ডারগ্রাউন্ড মুভমেন্টের খাতিরেও বাণিজ্যিকভাবে তেমন সফলতার মুখ আমরা দেখতে পারলাম না।
ব্যবসায়িক সম্প্রদায় তখন সাইকাডেলিয়ার নতুন নতুন চাহিদা বুঝা শুরু করতেসে, আর সব পপ শো, নাচাগানার দর ধীরে ধীরে একপ্রকারের নিম্নমুখী। এপ্রিলের মাঝামাঝি পিটার, অ্যান্ড্রু আর আমরা একপ্রকারের বাধ্য হইয়াই সেসব নিয়া একটা ধাপ্পাদার বিজ্ঞাপন তৈরি করি ‘Freak Out-Schmeak Out’ নামের— উদ্দেশ্য— ওইসব নিয়া ফাজলামি। কিন্তু কিছু ব্যান্ড প্রোমোটার, জানি না তারপরেও ফাজলামিটা ধরতে না পাইরা একই ধরণের বিজ্ঞাপন তৈরি কইরা যাইতেছিল। একটা উদাহরণ, ‘টার্ন আপ, শেল আউট, গেট লস্ট’। এটা বানানো হইছিল এলএসডি গুরু টিমোথি লেয়ারি’র ‘টার্ন অন, টিউন ইন, ড্রপ আউট’ এর কাছে থেকে। সবাই যার যার মতো আখের গোছাইতে ব্যস্ত হয়া পড়ছিল যাতে করে দুই এক পয়সা কামানো যায়।
এই পর্যায়ে আইসা আন্ডারগ্রাউন্ডের হর্তাকর্তারাও বেশ প্রতিরোধের মুখে পড়ে। । প্রতিষ্ঠানপন্থীদের কাছে থেকে আইটি ম্যাগাজিনের বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ দাড়া করানো হইছিল এবং গাঁজার কারণে হপিকে ছয় মাসের জেইলও খাটতে হয়। ওর মামলার কারণে পরে চারদিকে হইচই পইড়া যায় একেবারে। ইউএফও’র ক্রাউডেও একপ্রকারের বদল ঘটছে ইতিমধ্যে। আগে যেখানে মানুষজন আসতো অংশগ্রহণ করার জন্যে পুরা ঘটনাটায়, সেখানে মানুষজন আসা শুরু করসিলো নানারকম ঘটনা দ্যাখার জন্যে-নিঃসন্দেহে বিশাল একটা বদলি বলা যায় একে।
আরেকটা ঝামেলা খাড়া হয় যখন ট্যাবলয়েড প্রেস কাউন্টার কালচার নিয়া নানাভাবে মানুষকে উস্কানি দেয়া শুরু করলো। বছরের শুরু দিকে নিউজ অব দ্যা ওয়ার্ল্ডের একটা রিপোর্টে দাবি করা হয় ইউএফও তে না কী যা খুশি তাই চলতেছে, ফলে ক্লাবটা ঝামেলার মুখে পইড়া যায়। পিঙ্ক ফ্লয়েডের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়ায়া যায় এর সাথে সাথে আর হুট করে পুরা ব্যাপারটা আলোচনায় আসা শুরু করে শুধু সেক্স, ড্রাগস আর রক্যানরোল হিশাবেই। সবচেয়ে অপ্রীতিকর হইতেছে আমি নিজে কখনো এইসব সুখকর বিষয়ের ভিতর দিয়া যাইতে পারি নাই যেগুলা লিখা হইতেছিল নানা জায়গায়। যদি বলি আর্টিকেলটা গুরুত্বপূর্ণ কিছুই সামনে নিয়ে আসতে পারসিলো না তাহলে অত্যুক্তি হবে না বিন্দুমাত্র, এবং ভুল করে ছাপাইসিলো আমরা না কী নিজেদের কে ‘সামাজিক বিপথগামী’ হিশাবে দাবি করসি। ‘বিপথগামী’ শব্দটার চল ট্যাব্লয়েড পত্রিকাতেই সবচেয়ে বেশি দ্যাখা যাইতো। এই রিপোর্টারটা আমাদের কোন এক পোস্টারে শব্দযুগল দেইখা একেবারে ট্যাগ লাইনে এটাকেই নিয়া আসছিল। অথচ তারা বুঝেই নাই এটা ছিল আমাদের সাথে বাজাইতো আরেকটা ব্যান্ডের নাম। এইসবের পরে লয়্যারদের সাথে আলোচনা কইরা একটা মিটিং ডাকা হয়। আমাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলা স্বীকার কইরা ক্ষমাপ্রার্থনা করতে রাজি হই।
প্রেস কিন্তু আসল ঘটনাটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা কইরা গেছিলো। আমাদের ফ্রন্টম্যান, গিটারিস্ট এবং ভোকাল সিড ব্যারেটের অবস্থা দিনকে দিন শোচনীয় পর্যায়ে যাইতেছে সময়টায়। জিনিশটা যে আমাদের মাথায় ছিল না তা না। আমরা জানতাম সিড ভালো খারাপ দুই রকমের ভেতর দিয়াই যাইতেছে। কিন্তু আস্তে আস্তে খারাপের পরিমাণটা অধিকতর প্রকাশ পাওয়া শুরু করে। ভাবলাম ও হয়তো ওই দশা থেকে বের হয়া আসবে, কিন্তু আসেপাশের লোকজন বুঝতে পারসিল প্রকৃতপক্ষে ঘটনা কোন দিকে মোড় নিতেছে। জুন চাইল্ডের কথায়, ‘সিড প্রচুর এলএসডি নিতো। অনেক মানুষই নিতো এবং প্রতিদিনের জীবনে সেটা তেমন কোন প্রভাব ফেলত না। কিন্তু তুমি যদি দিনে দুই তিনবার করে একই কাজ করো, তাহলে ঝামেলা তো অবশ্যই আছে…’
সিড ক্রমওয়েল স্ট্রিটের একটা ফ্ল্যাটে থাকে তখন, যেখানে ২৪/৭ ও এসিড নিতো বলে সবার ধারণা। সত্যমিথ্যা জানি না, কারণ আমরা কখনো ভিতরে ঢুকি নাই বাসার- রিহার্সেল বা গিগ টিগ থাকলে ওকে ওইখান থেকে তুইলা নিয়া যাইতাম খালি। ফলে ওর সাথে আর কে কে থাকে সেটা জানা ছিল না। গুজব ছিল এমন যে ওইখানে ভুলেও কেউ ড্রিঙ্ক অফার করলে নেয়া নিষেধ, এমন কী পানিও না— কারণ সবকিছুর ভেতরে ঝামেলা ছিল। এমন দুনিয়ার সাথে রজার, রিক বা আমার পরিচয় ছিল না। আমরা হাল্কা পাতলা বিয়ারেই কাজ চালায়া নিতাম। সিডের চালচলন যে আমাদের পার্ফরমেন্সে প্রভাব ফেলতেসে, সেটা নিয়া সবাই খুব সচেতন ছিলাম।
‘১৪ আওয়ার টেকনিকালার ড্রিম’ শো’য়ের সময়েও সিড আমাদের মতো ক্লান্ত ছিল, কিন্তু ওর লক্ষণগুলা ছিল আরও সিরিয়াস। জুন চাইল্ডের স্পষ্ট মনে আছে, ‘প্রথমে সিডকে খুঁজেই পাইতেছিলাম না। পরে দেখি ও ড্রেসিং রুমে বইসা আছে, একেবারে বিদ্ধস্ত। রজার ওয়াটার্স আর আমার উপর ভর দিয়া স্টেইজর দিকে আসলো। ওর শাদা গিটারটা দুইজনে মিলে কাঁধে চড়ায়া দিলাম; স্টেইজে হাইটা হাইটা উঠল আর ওকে দেইখা শ্রোতারা খুব খুশি। সবাই ওকে ভালবাসত। সবাই যখন বাজানো শুরু করলো সিড তখনোও ঠায় দাঁড়ায়, কাঁধে গিটার নিয়া দুই হাত পাশে ঝুলায়া সেইভাবেই দাঁড়ায়া রইলো।’
এরপরই আমাদের উইন্সডোর জ্যাজ ফেস্টিভ্যালে পারফর্ম করার কথা ছিল, কিন্তু বাধ্য হয়ে বাদ দিতে হইলো। সিড
‘স্নায়বীয় অবসাদে’ ভুগতেছে— এরকম একটা মেসেজ প্রেসে পাঠানো হয়। আমাদের বদলে সেই জায়গায় পল জোন্সকে পাঠানো হইছিল অনুষ্ঠানে। স্টেইজে উইঠা যখন ও চিৎকার কইরা জিজ্ঞাস করসিলো, ‘আত্মার সঙ্গীত শুনতে চাও?’ তখন বিশাল জনতা গর্জনে জবাব দিছিল, ‘না—আ’। বিয়ার ক্যান, বোতলও ছুইড়া মারসিলো পাব্লিক সাথে সাথে। এদিকে আমরা শো ক্যান্সেল করে খুবই বিব্রত অবস্থার মধ্যে পইড়া যাই, রাগ উঠতে থাকে খুব। ম্যানেজমেন্টও চেষ্টা করতেছিল নতুন কোন পরিকল্পনা করার।
অনেক আলোচনার পরেও কোন সমাধানে আসতে পারতেছিলাম না সিডকে নিয়ে, কারণ মাদকাসক্তি নিয়া কীভাবে কাজ করা যায় সেটা নিয়ে জানাশোনা ছিল না। কারো কাছে থেকে যে তথ্য নিবো, তার জো-ও ছিল না। সিডের জন্যে অবশেষে পিটার একটা অ্যাপোয়েন্মেন্ট নেয় প্রখ্যাত সায়কিয়াট্রিস্ট আরডি লেইং এর কাছে। সম্ভবত রজার ওকে নর্থ লন্ডনে সিডকে নিয়া গেছিল কাউন্সিলিং এর জন্যে, কিন্তু সিড পুরা ব্যবস্থাটায় বাইকা বসে। ফলে ল্যাং এর খুব বেশি কিছু করার সুযোগ ছিল না। ল্যাং একটা বেশ চ্যালেঞ্জিং পর্যবেক্ষণ জানাইছিলো আমাদের। সেটা হলো— এটা হইতে পারে যে সিড অবসাদে ভুগতেছে, কিংবা একেবারে হয়তো পাগল হয়া যাইতে পারে। কিন্তু এমন হওয়া অসম্ভব না যে আমরাই আসলে ওর এই অবস্থার জন্যে দায়ী। ওকে হয়তো চাপ সৃষ্টি করতেছি নিজেদের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নের জন্যে এবং সেজন্যে সিডকে প্রেশার দিতেছি ক্রমাগত। হয়তো সিডই আসলে ভারসাম্যহীন কয়েকটা মানুষ দ্বারা আবৃত হয়া বাস করতেছে।
অবস্থা বেগতিক দেইখা রজার সিডের ভাইকে খবর দেয় যে ওর এই অবস্থা, ওরে নিয়া আমরা খুব চিন্তিত। সিডের ভাই লন্ডনে আসতো, সিডের সাথে কথা বলে আমাদের প্রতিবার জানাইতো এইবার ঠিক হয়া যাবে। একই কথা বারবার শুনে প্রতিবার আশা করতাম- ওহ! এইবার তাহলে সিড স্বাভাবিক হবে। কিন্তু কোনভাবেই উন্নতির কোন লক্ষণ দ্যাখা গেলো না।
এরপর সিদ্ধান্ত নিলাম সিডকে ডক্টর স্যাম হাটের সাথে ফরমেন্টেরা দ্বীপে পাঠানো হবে। হ্যাট ওইখানে যাইতেছিল ছুটি কাটানোর জন্যে, নিজের ভবিষ্যৎ ভাইবা রাজি হয়া যায় প্রস্তাবে। হাটকে বলা যায় তখনকার আন্ডারগ্রাউন্ডের ফ্যামিলি ডাক্তার, মিউজিশিয়ান আর মাদকাসক্তদের জন্যে ওর আলাদা মায়া ছিল, ওদের জায়গা থেকে সবকিছু বোঝার চেষ্টা করতো সবসময়। স্যামের মতে, ‘আমি ছিলাম একজন হিপ ডাক্তার। হাসপাতালেও সব ডাক্তারের মতো শাদা কোট পইরা ঘুরতাম না, গোলাপি ইন্ডিয়ান সিল্কের উপর স্লিভলেস, কোট লেন্থের জ্যাকেটিন পরতাম সদাই।’
যাই হোক, আমরা মোটামুটি ক্ষিপ্ত হয়ে অগাস্টের সব শো ক্যান্সেল কইরা দেই সিডের জন্যে। সিড ওর গার্লফ্রেন্ড লিন্ডসে কর্নারের সাথে ফর্মেন্টেরা দ্বীপে চইলা যায়- সাথে রিক আর জুলিয়েট, হাট, তার বউ আর বাচ্চা। রজার আর জুডি আইবিজাতেই থাকার প্ল্যান করে যেটা ফেরিতে কইরা খুব কাছেই। কিন্তু এতকিছুর পরেও কোন উন্নতি লক্ষ্য করা গেলো না, তবে প্রচণ্ড উগ্র হয়ে গেল ক্যান জানি। জুলিয়েটের বরাতে— ‘এক রাত্রে প্রচণ্ড ঝড়ের বেলায় দেখলাম সিডের ভেতরের সব যন্ত্রণা উগরায়া বের হয়ে আসতেছে। প্রকৃতির ঝড় দেখে ও চেষ্টা করতেছিল একা এক দেয়াল বায়া বায়া উপরে উঠে যাওয়ার- যেন ভেতর আর বাহির একাকার হয়া যাইতেছে।’
এদিকে তারপরেও ব্যান্ডের ভবিষ্যৎ নিয়া পরিকল্পনা করে যাইতেছিলাম। মেলোডি মেইকারে দেয়া রজার ওয়াটার্স এক সাক্ষাৎকারে বলসিলো, ‘এই মুহূর্তে অনেক হতাশ। জীবিকার কারণে আমাদের এমন অনেক জায়গায় অনুষ্ঠান করতে হইতেছে যেগুলার মান জঘন্য। আমরা নিজেদের মিউজিক সবাই ভালোবাসি এবং এটাই একমাত্র আমাদেরকে টিকায়া রাখতেসে। আমাদের পক্ষে তো আর ড্যান্সিং ক্লাব আর বলরুমে গিয়া বাজানো সম্ভব না। আমরা চাই সম্পূর্ণ নতুন একটা পরিবেশ এবং খুব ভালো একটা কিছু করতে।’ অনেক দূরবর্তী পরিকল্পনা করতেছিলাম, কিন্তু অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর কোন উপায় দেখতেছিলাম না কোনভাবেই।
সিড দ্বীপ থেকে ফিরা আসার পর আবার কাজের ভেতরে ডুইবা যাই। কিছুটা ঝামেলা কইরাও ইউকে আর হল্যান্ডে কিছু শো’য়ে বাজায়া আসি এবং সিডের নতুন কিছু গান রেকর্ড করি। এবং বেশ তাড়াহুড়া করেই আমাদের প্রথম ইউএস ট্যুরের আয়োজনটা কইরা ফেলি। ছাব্বিশে অক্টোবর বিল গ্রাহামের সানফ্রান্সিস্কোর ফিলমোরের ওপেন করসিলাম, কিন্তু যাত্রাটা মসৃণভাবে শেষ হইসিলো না। অ্যান্ড্রুও খুব দুশ্চিন্তায় ছিল কীভাবে সব সামাল দেয়া যাবে। ওর আশঙ্কা সত্যি ছিল।
আন্ড্রু যখন কাগজপত্র ঠিক করতে আমাদের আগে গিয়া ন্যুইয়র্কে এজেন্টদের সাথে কথাবার্তা চুক্তি করতে যায়, অপরপক্ষ খুব সাবলীল ভঙ্গিতে ড্রয়ার থেকে একটা বন্দুক বের করে অ্যান্ড্রুকে দিছিল ট্যুর চলাকালীন ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের জন্যে। অ্যান্ড্রু একটু অপ্রস্তুত হয়া জিজ্ঞেস করসিলো আসলেই এর দরকার আছে কীনা। উত্তর ছিল, ‘বাছা, দরকার নাই তো দরকার নাই। তুমি না চাইলে আমি এক্ষুনি ড্রয়ারে ঢুকায়া রাখতেছি।’ বলতে দ্বিধা নাই, ইংলিশ ট্যুরের সবচেয়ে কঠিন অবস্থাও এতোটা যাইতো না।
অ্যান্ড্রু তারপর পশ্চিম তীরের দিকে আগাইলো। ওয়ার্ক পারমিট না পাওয়ার কারণে বুঝতে পারলাম ওপেনিং করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। অ্যান্ড্রুর মনে আছে ও লেজেন্ডারি বিল গ্রাহামের অফিসে বইসা বিলের কথা শুনতেছিলো। বিল কোন হ্যাপাওয়ালা রেকর্ড কোম্পানিকে এক্সিকিউটিভকে প্রচণ্ড ঝাড়ি মারতেছিল ফোনে। তারপর বিলের চোখ পড়ে এই অভাগা ব্রিটের দিকে, যে কী না তার ব্যান্ড নিয়া ওপেনিং এ থাকতে পারবে না বলে মিইয়া ছিল। বিল গর্জন কইরা উঠছিলো এই বলে, ‘সব ব্যান্ডই বিল গ্রাহামের জন্যে হাজির হয়’।
পিটার যখন অ্যামেরিকায়, আমরা তখন লন্ডনে বইসা নিয়মিত খোঁজ নিতেসি যে কাগজপত্রের ঝামেলা মিটসে কী না। কারণ ঝামেলা মিটলেই সেই সন্ধ্যায় রওনা দেয়ার প্ল্যান। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লন্ডনের ইউএস দূতাবাসে বইসা কাটায়া দিছি এটা জানার জন্যে যে কখন ভিসা আসবে। পেপারওয়ার্ক তো ছিলই, এটা ছাড়াও লাইনঘাটের সঠিক যোগাযোগ আর আমলাতন্ত্রের জন্যেও ঝামেলা হইতেছিল। ডকুমেন্টস ছাড়াও আরেকটা ঝামেলা হইলো এইখান থেকে ইউএস কেউ গেলে তার বদলে অ্যামেরিকা থেকে আরেকজনকে এইখানে নিয়া আসতে হবে— সমান সমান বিনিময়। আমাদের লেনাদেনায় অপরপক্ষ ছিল স্যাম দ্যা শ্যাম ফারাওস। এখনো নিয়মটা চালু।
বিল গ্রাহাম এইদিকে বলতেছিল মধ্যরাত্রে লন্ডনের অ্যামেরিকান রাষ্ট্রদূতকে ফোন দিয়া ঝামেলা চুকায়া ফেলতে যাতে কাগজপত্রের ঝামেলা আর না হয়। আমাদের বদলে সে ইকে আর টিনা টার্নারকে পাঠাইতে চাইতেছিল। অবশেষে ভিসা আসলো একটা সময় এবং যথারীতি উইন্টারল্যান্ডে গিয়া হাজির হইলাম, শনির দশা সম্পূর্ণ কাটে নাই তখনো। প্লেনে উঠার পর এক কর্মী সিডকে বলসিলো ওর সিগারেট নিভায়া ফেলার জন্যে, সিড যে চাহনি প্লেনের কার্পেটেই নিভাইসিল সেটা ভীতিকর। ভোরের দিকে সানফ্রান্সিসকো গিয়া পৌঁছাইসিলাম। পিঙ্ক ফ্লয়েডকে অভ্যর্থনা জানাইতে ওইখানকার ফ্যান ক্লাব না, স্বয়ং বিল গ্রাহাম আসছিলো। ও তখনো রাগে গজগজ করতেছে পুরা ব্যাপারটা নিয়া। অ্যান্ড্রু কিং এর সাথে দ্যাখা হওয়ার পর পুনর্মিলনীর ফিল পাইসিলাম। উইন্টারল্যান্ডের ভেন্যুতে সে ঘুইরা আসছে ইতিমধ্যে। ওইখানকার বড় স্টেইজ আর শক্তিশালী ৩৫এমএম এর সাথে আমাদের দুর্বল ১কেডব্লিউ অ্যাল্ডিস ইকুইপমেন্ট একেবারে নাজুক। ভেন্যুর লাইটও ইন্ডি স্পেসালিস্ট সেটাপে করা হইতো। অ্যান্ড্রু খুব ভদ্রভাবে বলসিলো দুইটা মিলায়া কিছু একটা করার কথা। কারণ যতখানি চাবাইতে পারবো তার থেকে বেশিই কামরায়া ফেলছিলাম না বুঝে।
.পরবর্তী দিন আমরা পাগলের মতো কিছু জিনিশপত্র জোগাড় করার চেষ্টা করলাম, কারণ গিটার ছাড়া তো কিছুই নিয়া গেছিলাম না। ভাবসিলাম ড্রাম একটা থাকবেই। যেসব কথা বলা হইসিলো আসার আগে আইসা দেখি সেগুলা পুরাই ফাঁপর আর রেকর্ড কোম্পানিও কোন সাহায্য করে নাই। প্রিমিয়ার ড্রাম কোম্পানি স্টেইটসে বিভিন্ন এজেন্ট দিয়া কাজ চালাইতো ইংলিশ ড্রাম কোম্পানি ছিল বিধায়। ওদের লোকাল ডিলার নিজের স্টক খুইলা মোটামুটি অপরিচিত এই ব্যান্ডকে কিছু দেখাইতে চাইতেছিল না, কারণ কেইথ মুন। দ্যা হু’ য়ের ড্রামার কেইথ মুন তখন প্রিমিয়ারের এন্ডোর্সি আর ওর ড্রাম ধ্বংস কইরা দেয়ার ক্ষুধা এদের জানা ছিল ভালোভাবেই। আমার ধারণা আমারে প্রিমিয়ার থেকে যা দিছিল তার সবই বাতিল মাল। কারণ কিটের একেকটা অংশ ছিল একেক রঙের।
ট্যুরটার প্রথম ভালো অভিজ্ঞতা হইলো যখন উইন্টারল্যান্ডে গিয়া শেষমেশ বাজাইলাম। ভেন্যুর অর্গানাইজারদের পেশাদারিত্বের কোন তুলনা চলে না, আর সাথে আরও যারা বাজাইছিলো তারাও পিঙ্ক ফ্লয়েডকে অভিনন্দিত করতেসিলো নানাভাবে। তাদের আগ্রহও দ্যাখার মতো বলা যায়। এই জিনিশটা একাবারে ইউকে’র বিপরীত— ইউকেতে তো সব পারফর্মাররা স্টেইজে একজন আরেকজনকে খায়া ফালাবো এই মানসিকতায় ভুগতো। আমাদেরকে ওইখানে পরিচয় করায়া দেয়া হয়, ‘ইংল্যান্ডের আলোর রাজা’ হিশাবে, যদিও অ্যান্ডুর ভাষায় আলোকসজ্জা ছিল, ‘হাস্যকর। বুদ্ধুর মতো একেবারে। প্রথম সপ্তাহে বাজাইছিলাম বিগ ব্রাদার্স আর দ্যা হোল্ডিং কোম্পানির সাথে। হোল্ডিং কোম্পানি জেনিস জপ্লিনের প্রথম ব্যান্ড। উইকেন্ডে বাজাই রিচি হ্যাভেন্সের সাথে আর উইকেন্ডের পরে এইচপি লাভক্র্যাফটের সাথে। জেনিস সাউদার্ন কমোর্ট কোম্পানির দেয়া তার চিরপরিচিত পশমের কোট পইরা আসছিল। স্টেইজেও ও সাউদার্ন কম্ফোর্টের একটা বোতল নিয়া উঠছিল। এটা পণ্য এন্ডোর্স্মেন্টের প্রথমদিককার কোন নজির ছিল না কী ব্যক্তিগত ইচ্ছা নিশ্চিত না। রজার নিজের বোতল নিয়া গেছিল, আর জনিসকে আগায়া দিছিলে পান করার জন্যে। শো’য়ের পর জোনিস খালি বোতলটা ফেরত দিছিল শুধু।
যাদের সামনে বাজাইছিলাম সেই শ্রোতাদের ইউএফও’র শ্রোতাদের মতোই বলা যায়, বিশেষ করে ক্যালিফোর্নিয়ার সানফ্রানসিসকোতে তো একটা হিপি প্রভাব ছিলই। দুর্ভাগ্য আমাদের যে এত বিরতিহীনভাবে একের পর এক শো করতে বাধ্য ছিলাম, একটু ফুসরত পাইলে আরও ভালো লাগতো। তার থেকেও বড় কথা, এই গুরুত্বপূর্ণ শো’তেও সিড ইন্টারস্টেলার ওভারড্রাইভ বাজানোর সময় গিটার ডিটিউন করতে করতে ছিঁড়া ফেলসিলো।
যাই হোক, সব ক্ষেত্রেই যে এমন দৌড়ের উপরে ছিলাম তাও না। যেমন লসেঞ্জেলেসের শো’টা বেশ ভালোই ছিল। বড় অডিওটরিয়ামে আমরা হেডঅ্যাক্ট ছিলাম না, তবে বাকিগুলাতে বেশ টাইট বাজাইতে হইসে রিহার্সেল কইরা। একটা ক্লাবে হেডলাইনার হিশাবে বাজাইছিলাম এবং পরিসর ছোট হওয়ার কারণে পুরা পরিবেশের নিয়ন্ত্রণটা নিতে পারসিলাম নিজেদের লাইট ইউজ করে। বলতে গেলে অনেকটা ইউএফও’র মতো।
চিতা ক্লাবের শো’য়ের আগে সিডের খেয়াল হইলো ওর ঢেউ খেলানো চুল খুব বেশিই কার্লি হয়া গেছে তাই সিদ্ধান্ত নিলো জেল দিয়া চুল সোজা করবে। তো সেই ভাবা অনুসারে একগাদা জেল দিয়া চুল সোজা করলো। বিশেষ ধরেনর এক সবুজ বুট পইরা সে স্টেইজে উইঠা প্রথম ট্র্যাকের পরেই নিজের গিটার ডিটিউন কইরা ফেললো। এইটা দেইখা রাগে রজার বেজ গিটারে জোরে জোরে হিট করতেছিল একের পর এক এবং শো’য়ের পর ভক্স বেইজটা দুই টুকরা কইরা ফ্যালে। ধার করা গিটার ছিল এইটা। মালিক তো শো’য়ের শেষে আইসা খুশিমনে ভাঙা টুকরাগুলা ব্যাগে ভইরা নিয়া গেছিল। এটা ছাড়া শো’টা ভালোই ছল বলা যায়। শ্রোতাদের সাড়াও আশাজাগানিয়া লাগছিলো।
ব্যান্ডের প্রোমোশন টিভিতেই করা হইছিল কিছুটা। এমটিভির আগে সাধারণত কোন সেলিব্রিটি শো’তে গিয়া হাজির হওয়াই কেতা ছিল প্রোমোশনের। উপস্থাপক হয়তো দ্যাখা যাইতো এককালের গায়ক, ক্যারিয়ার আর বড় করতে চাইতেছে না। প্রোগ্রামের শুরুতে হয়তো নিজে দুই একটা গান গায়া সেইদিনের অতিথি ব্যান্ডকে ডাইকা নিয়া আসতো। এই শো’তে সিডের রেসপন্স ছিল একেবারে জড়ের মতো, কোন নড়চড় নাই। দেইখা লাগা স্বাভাবিক আগ্রহ নাই কোন। ওর ভাবসাবে আঁচ করা এতোটা সহজ ছিল না যে ভেতরে কী ভাবতাছে। তো শো’য়ের জন্যে যে গান ঠিক করা হইছিল সেটার কয়েকবার রিহার্সেলের পরে যখন আসল টেইক নেয়ার পালা, দ্যাখা গেল সিড ঠায় দাঁড়ায়া আছে। ফলে রজার আর রিককেই দায়িত্ব দেয়া হয় ভোকালের কাজের, আর ও কোন একদিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকায়া আছে। এমিলির বিব্রতকর মাইমিং এর পর আমাদের আলাপের একটা অংশ ছিল সেইখানে। অন্য কোন গেস্ট যদি থাকতো, তাহলে দ্যাখা যাইতো মাইক্রোফনের কাছাকাছি থাকলে ক্যামেরা টাইম নিজের দিকে নেয়ার চেষ্টা করতেছে গল্প, জোক কিংবা কোন একটা মন্তব্য কইরা।
প্যাট বুনের আরেকটা শো’তে পিঙ্ক ফ্লয়েডের সাথে সাথে তার কথাবার্তা চালানোর জন্যে বাকী গেস্টদের একটু সাইডে রাইখা দিছিলো। শুধু গেস্টদের না, সবাইকে রাইখা সে সিডের সাথেই কথা বলতেছিল আর কী। তো প্যাট সিডকে হুট কইরা জিজ্ঞাস কইরা বসে সে কী ভালোবাসে। সবাই তো নিঃশ্বাস বন্ধ কইরা বইসা আছি না জানি ও কী উত্তর দেয়! সিড ছোট্ট করে বললো, অ্যামেরিকা’। উত্তর শুইনা উপস্থিত শ্রোতারা খুশিতে ফাইটা পড়লো আর সবার অলক্ষ্যে ভেতর থিকা একটা দীর্ঘ নিশ্বাস বের কইরা নিয়া আসলাম।
টেলিভিশন স্টুডিও ছাড়া সিড ভালোই ছিল সব জায়গায় মোটামুটি। প্রায়ই ভাইসা উঠে চোখের সামনে, ক্যাপিটল রেকর্ডের সাথে চুক্তির পর ভাইন আর হলিউডের এক কোণায় দাঁড়ায়া আছি। সিড ছোট্ট কইরা বললো, ‘লাস ভেগাসে ভাল্লাগতেছে’। পরে হোটেলে গিয়া রজার দেখে সিড সিগারেট ধরায়া হাতে নিয়া চেয়ারের উপরেই ঘুমায়া পড়ছে।
এটাই যথেষ্ট ছিল। অ্যান্ড্রু পিটারকে লন্ডনে ফোন লাগায়া বললো, ‘এইখান থেকে আমাদের নিয়া যাওয়ার ব্যবস্থা করো’। অ্যামেরিকার সব কাজ মোটামুটি শেষ। আমরা ইউএসে থেকে সরাসরি ইউকেতে না গিয়া হল্যান্ডে শো’তে যোগ দেই। এই কাজটা করসিলাম সিডের তৎকালীন মানসিক অবস্থাকে এড়ায়া যাওয়ার জন্যে। ক্যান জানি ধইরা নিছিলাম অতলান্তিকের এইপার অইপার ঘুরার পর হয়তো কিছু একটা মঙ্গল হবে। কিন্তু ক্যান হবে— সেটা বিশ্বাসের ঊর্ধ্বে।
ইংল্যান্ডে আইসা দেখি ব্রায়ান আমাদের জন্যে জিমি হেনরিক্সের ট্যুরের সাথে একটা ডেইট ঠিক করসে। এটা বিশাল সুযোগ বলা যায়, কারণ যে মিউজিশিয়ানদের ভালোবাসি তাদের সাথে বাজানো আর সময় কাটানোর কোন তুলনা নাই। অবশেষে আমরা বুঝতে পারসিলাম অন্যান্য ব্যান্ডের সাথে একটা সাধারণ মিলের জায়গা আছে। রুচি একই, কিন্তু নাইসের মতো একটা ব্যান্ডের সাথে পার্থক্যটা গইড়া দেয় তাদের বিস্ময়কর টেকনিক্যাল দক্ষতা। আর ওদের কীবোর্ড প্লেয়ার তো লা- জাওয়াব।
এই প্যাকেজ ট্যুরটার সবকিছু ছিল একেবারে ঘড়ি ধরে করা। প্রোমোটারের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল জিমি হেন্রিক্সের শ্রোতাদের যাতে পয়সাটা ভালোভাবে উশুল হয়। আমরা যাতে বরাদ্দ আট মিনিট সময়ের এক মিনিটও বেশি না বাজাইতে পারি সেজন্যে স্টেইজের সামনে একজন স্টপওয়াচ ধইরা দাঁড়ায়া থাকতো। অ্যান্ড্রুর মনে আছে, আমাদের বলা হইছিলো- যদি তিরিশ সেকেন্ডও বেশি বাজাই — তাহলেই না কী কঠিনভাবে সাবধান করা হবে। যদি দ্বিতীয়বারের মতো একই কাজ করি, তাইলে ট্যুর থেকেই বাতিল। ফলে ইন্টারস্টেলার ওভারড্রাইভের মতো ট্র্যাকগুলা একেবারে ছোট করে ফেলসিলাম। ওদের হাউজ লাইট জ্বালাইলে আমাদের লাইটের আর কোন অস্তিত্ব থাকতো না। সে ম্যানেজমেন্টকে বলে কয়ে নিজেদের লাইট ব্যবহার করার অনেক চেষ্টা করসিলো, সাথে স্ক্রিন আর প্রজেকশন সাইট। কিন্তু কোনভাবেই তা হয়া ওঠে নাই।
সিড তখনও একপ্রকারের হেলুসিনেশনের ভেতর দিয়া যাইতেছে, মাঝে মাঝে তো থিয়েটারেও যাইতে পারতো না। আমরা আগেই বুঝতে পারসিলাম ওর বাজানোর মতো অবস্থা নাই, তাই নাইসের ডেইভকে বলসিলাম বাজানোর জন্যে আমাদের সাথে। ডেইভের সাথে প্র্যাক্টিস করা হইসিলো খুব কম, আর স্টেইজে ওর উপরে সামান্য লাইট ফ্যালা হইসিল যাতে কেউ বুঝতে না পারে। সেটাই হইসিলো, কেউ আন্দাজই করতে পারে নাই। এই ট্যুরটা বলা যায় কল্পনার রক্যানরোল দুনিয়ার প্রথম প্রবেশ। এই প্রথম টাইট প্যান্টের ঢিলা চরিত্রের পপস্টাররা ততোধিক টাইট প্যান্ট ঢিলা চরিত্রের মেয়েদের সাথে ঘুইরা বেড়াইতেছে। একবার মেয়েরা আমাদের উপরেও ঝাপায়া পড়ছিল। এরপর থেকে শিয়ালের জন্যে আমার খুব মায়া লাগে। কারণ এই খেয়াল কে যে শিকারী আর কে শিকার তা বোঝার উপায় থাকে না। হয়তো মেয়েগুলা মাত্রই স্কুল পাশ কইরা বের হইছে, কিন্তু নানা সাজশয্যায় তাদেরকে হোটেল লবিগুলাতে দ্যাখা যাইতো পরবর্তী কাকে ফাঁদে ফেলবে এই ধান্দায়।
এই ট্যুরে যাতায়াতের জন্যে একটা গাড়ি দেয়া হইসিলো যেটাতে করে হেডলাইনার বাদে সবাই স্কুলআউটিং এর মতো জায়গায় জায়গায় যাইতাম। আমাদের নিজেদের ট্রান্সপোর্ট নিয়া তখনো কিছু বলা যায় না, কারণ কয়েকদিন ধরেই চিন্তা করতেসিলাম নানা সুবিধা ভাইবা নিজেদের ইমেইজ প্রসিদ্ধ করার জন্যে একটা বেন্টলে কিনবো। তারপরেও কেনা হইলো না, আরেক গাড়ির সেইলসম্যানের জয় হইসিলো এবং সেই গাড়ির ব্রেক কোন গ্যারেজে গিয়াই ঠিক করাইতে পারি নাই। রজার এখনো এই গাড়িটার কথা বলে। আমরা আরেকটা গাড়ি ভাড়া করি গডফ্রে ডেভিসের কাছে থেকে। ওরা মিউজিসিয়ানদের গাড়ি ভাড়া দেয় না দেখে অ্যান্ড্রু কিংকে চুক্তিটা করতে হইসিলো। এক সপ্তাহ গাড়ি চালায়া যখন ফেরত দিতে গেলাম তখন ওই কোম্পানি ঠিক করে এরপর থেকে মিউজিক ব্যবসার সাথে জড়িত এমন কাউকেই যাতে গাড়ি ভাড়া না দেয়া হয়— এই নিমিত্তে একটা নিয়ম করার। হেন্রিক্স ট্যুরের সমান্তরালে একটা সিঙ্গেল রিলিজ করসিলাম ‘অ্যাপল অ্যান্ড অরেইঞ্জস’ নামের। এটাও হিট হওয়ার জন্যে করা। এটা ছিল সিডের আরেকটা অদ্ভুতুড়ে সৃষ্টি। অ্যালবামের জন্যে গ্রেইট ট্র্যাক হওয়া সত্ত্বেও সিঙ্গেল হিশাবে খুব সুবিধার কিছু ছিল না। নর্ম্যান স্মিথের জারিজুরি কাজে লাগায়া ওভারডাবড কোরাস আর একোস বসাইছিলাম গানটায়। কোনদিন লাইভে এটা বাজাইছি বলে মনে পড়ে না। ইউএসএর একটা চাপও ছিল গানটা রিলিজের ব্যাপারে, কিন্তু প্রোমোশনের কোন ফুসরত পাইছিলাম না। এই থেকে একটা শিক্ষা পাইছিলাম যে— নিজেরা যা সেটা নিয়াই কাজ করা উচিত। আলগা পার্ট চোদাইতে গেলে কাজের কাজ কিছুই হয় না শেষপর্যন্ত।
সাতষট্টির ডিসেম্বরে অলিম্পিয়াতে শো’য়ের মাধ্যমে এই ট্যুরের সমাপ্তি হয়। সিড তখনো হুঁশে নাই এবং আমরা সবাই নিজেদের ধৈর্যের শেষপ্রান্তে তখন। ক্রমাগত যেটা অস্বীকার করে আসতেছিলাম সেটা ফেইস করা ছাড়া আর উপায় ছিল না। সমস্যাগুলা এড়ায়া যাওয়ার চেষ্টায় ছিলাম। কিন্তু সাফল্যের ব্যাপারটা মাথায় চেপে বসছে এবং সবকিছু এমন দিকে ধাবিত হইতেসিল যে ভাবতে বাধ্য হইতেছিলাম সিডকে ছাড়াই আগায়া যাইতে হবে। কারো জন্যেই ব্যাপারটা সহজ ছিল না— না সিড, না বাকী ব্যান্ড। সে ছিল আমাদের গীতিকার, গায়ক, গিটারিস্ট, এবং সবচেয়ে দুর্বলতার জায়গা- বন্ধু।
প্রথমে ভাবসিলাম বিচ বয়েজের মতো কিছু একটা করবো। বিচ বয়জের ব্রায়ান উইলসন না কী বেসিক্যালি ঘরেই সবকিছু চালাইতো, যেহেতু লাইভ করতে পারতো না। এরপর ভাবলাম, একজন নতুন গিটারিস্ট নিয়া সিডের প্রেশারটা কমাই। প্রথমেই জেফ বেকের নাম মাথায় আসছিল। আমার ধারণা, জেফ বেক আসলে নিরীক্ষামূলক কিছু একটা হওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু ঝামেলা হইলো আমাদের কারোরই সেই সাহসটা ছিল না ওরে যে ফোনটা দিয়া প্রস্তাবটা দিবো। অবশ্য রজার এর প্রায় পঁচিশ বছর পর কাজটা করসিলো।
কিন্তু একজনরে চিনতাম যারে ফোনটা দেয়া যায়। রজার আর সিডের ক্যাম্ব্রিজকালের পুরানা বন্ধু— ডেভিড গিলমৌর।