এক গুচ্ছ কবিতা । মিসবাহ উদ্দিন
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ জুন ২০১৭, ১১:৪২ পূর্বাহ্ণ, | ২০৬৪ বার পঠিত
তোমার বোঝায় আমি নাই
বিষাদ
ধীরে ধীরে দর্শক সরে যাওয়ার পর জাদুকর তার পোঁটলা গোছায়। একটা ফুটওভারব্রীজের উপর থেকে আমরা এই দৃশ্য দেখতে থাকি। আমাদের সামনে তখন হাঁপানি রোগে অর্ধেক খেয়ে ফেলা একটা ট্রেন বিড়ালের মতোন চুপচাপ বসে থাকে। জাদুকর পোঁটলা গোছায়। আমরা জাদুকরের ঝোলার ভেতর ঢুকে যাই। আমাদের শরীরগুলো তখন টিয়াপাখি হয়ে আমাদের সাথে কথা বলতে চায়। আমরা সতর্ক হয়ে গন্ধম ফলের কথা সিনা থেকে সিনায় ছড়িয়ে দিতে থাকি। জাদুকর হাসে। আমরা ধমক দেই, জাদুকর ধমক মানে না। আমরা হুমকি দেই, জাদুকর পরোয়া করে না। আমরা চুপ হয়ে যাই, জাদুকর তাতেও দমে না। আমরা অতঃপর জাদুকরের হাসিটুকু তার ঝোলার ভেতর ঢুকিয়ে রাখি। জাদুকর আমাদের হাঁপানি বিষয়ক জ্ঞান দিতে চায়। আমরা সেই জ্ঞান গ্রহণ না করে ট্রেনের হুইসেল কিনতে বিভিন্ন দোকানে যাই। আমাদের পিছু পিছু আমাদের শরীরগুলো আসতে থাকে। আমরা আমাদের শরীরগুলোকে জাদুকরের ভয় দেখাতে থাকি। শরীরগুলো তখন আমাদেরকে চ-বর্গীয় গালিগালাজ করতে থাকে। আমরা তখন ঝোলার ভেতর থেকে জাদুকরের হাসিটুকু বের করে আনি। দোকানি বলে, হুইসেল বিক্রয় হবে না। আমরা দোকানিগুলোকে চ-বর্গীয় গালি দেই ও জাদুকরের ভয় দেখাই। দোকানি আমাদেরকে হুইসেল দেয়। অতঃপর আমরা হুইসেলগুলোকে বিষাদ কী জিনিস তা শেখাতে থাকি।
তমাল একটি ছেলের নাম
শিশিভর্তি রোদ নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তমাল ভাবতে থাকলো আমরা যদি স্মৃতিহীন হতাম, অথবা নিদেনপক্ষে জেলিফিশ! আজকের কোনো নিউজ নাই, সবগুলা ফলোআপ, শুনতে শুনতে আমি লাইটার খুঁজি। ওদিকে আর যাস না? উত্তর না দিয়ে তমাল কবিতা খুঁজে। তোমার বোঝায় আমি নাই, আমার যা কিছু বোঝো তার মাঝে আমি নাই। চুপ ছিলো? তমালের ভাবনা শুনতে শুনতে আমি হরিপদ কবিরাজের কথা ভাবতে থাকি। বুঝলা? অসুখ থাকে কথায়! লাইটার দে, তমাল হাত বাড়ায়। হরিপদ তোর কথা জিগায়। শেষবার যখন গেলাম তখনও হুইসেল ছিলো, এখন আর নাই। নাই? সবগুলা ফলোআপ!
কেলাইডোস্কোপ
তুই নাওডোবানো ঢেউ
তুই চোখপোড়ানো চাঁদ
আমি ভাঙ্গা নায়ের মাঝি
ঠোঁটে গতমৃত্যুর স্বাদ!
বারান্দায় রঙধনু শুকাতে দিয়ে মেয়ে তুমি কার কথা ভাবো?
ভ্যানিটিতে আস্ত একটা পূর্ণিমা লুকিয়ে তুমি হেঁটে যাচ্ছিলে, তোমার ক্লান্ত কাজলে তখন শত শতাব্দীর পথ, আর আমি একটা নাটাইমুক্ত ঘুড়ির সাথে আকাশের সম্বন্ধ ভাবতে ভাবতে তিনটি সোনালি ডানার করুণ চিল…!
তোমাকে বলেছিলাম, দীর্ঘ দীর্ঘতম দুপুরের পরেও স্নিগ্ধ বিকেল আসে – প্রাচীনতম আশাবাদ এই। সুতরাং, এইসব আয়ুখেকো শহরগুলোই শেষ কথা নয়। দেখো, কার্নিশে, সারারাত ধরে ফোঁটা ফোঁটা ভোর জমে আর একটা একলা চড়ুইয়ের তুমুল ছুটোছুটিতেও কী করুণ নিঃসঙ্গতা!
সিসিফাসের পাথর কী, জানো? আমাদের ঘাড়ের উপর আজন্ম চেপে বসা বোঝাটাই সে – পাথর। বিভিন্ন দশা আছে – যেমন একটা ঘুমের ভিতর থাকলে আরেকটা ঘুমের কথা ভুলে যাই বেমালুম। অথচ, যখন ‘কার্তিকের প্রথম শ্যামাপোকার বিষণ্ণতা’ নিয়ে কোনো কোনো বর্ষার রাত জানালার বাইরে ঝুম ঝরতে থাকে তখন কারো কারো ঠোঁটজুড়ে ফুটে থাকে লালনীল নক্ষত্র, নীহারিকা- আর আমরাতো নক্ষত্রের বুকের শীতলতা জানি! তাই, দারুণ আহত আর্ত শিরা-উপশিরায় আমরা আবিষ্কার করতে থাকি এক জীবনানন্দীয় ট্রামলাইন। আমাদের না-দেখা ট্রাম বা বহুকাল আগেকার এক ঘুণেধরা বৈকালিক ট্রেন তখন সমস্ত রাতজুড়ে আমাদের শরীরজুড়ে চলাচল করতে থাকে। তখন আত্মীয়তাহীন দৃশ্যমেঘের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে ভাবতে থাকি, কিছু ফুল আছে, শুকনো হয়ে গেলেও যার ঘ্রাণ থাকে, নাকি আরেকটু তীব্র হয় কে জানে; কবিতারা কই যায়? কার বাড়ি যায়?
হাঁটতে গেলেই হোঁচট খাই, অথচ জুতার ফিতা বাঁধা শিখে গেছি কতকাল হলো! টের পাই, কোথায় যেন কী একটা ধাঁধা হয়ে আছে। অথচ আমরাতো পায়রার ঘুমের বিপরীতে শব্দবাগানে জমে আছি নক্ষত্রবছর! আয়নার ভিতর থাকা ঘাসফড়িঙের দলও চিনে গেছে নিজেদের! অর্থাৎ, আমরাতো বিভিন্ন সাঁকো বরাবর ছুটে আসা রাজহাঁস- ঢেউয়ে ভাসান দেয়া শিখে গেছি অজুতবর্ষ।
পাথরকুচি পাতার মতো একটা শব্দ মরতে মরতে আরো দশটা শব্দের জন্ম দিয়ে যায় এবং আমরা পাথরের মতো নীরব হয়েও কখনোই নৈঃশব্দের সাক্ষাত পাই না। একবার এক চাঁদগলা রাতে একটা ল্যাম্পপোস্ট আমার সাথে অনেকদূর হাঁটতে থাকলে কিছুটা খাতির জমাই, জানতে পারি, এক বিষণ্ণ তারাবন্দী রাতে এক কিশোরী বকুল ফুল হয়ে তার তলায় ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে তার আলো নীল। ফিসফিস করে ল্যাম্পপোস্ট আমাকে জানায়, সোডিয়াম-গলা রাতগুলোতে জীবনানন্দ এইসব পথের কোনো কোনোটাতে ট্রাম খুঁজতে থাকেন।
ফসল
তোমার শব্দখেকো বেদনার পাহাড়জুড়ে এক স্মৃতিতাড়িত চৌবাচ্চা। আমরা যে ডুবতে ডুবতে ভেসে উঠি সে-ও এক পৌরাণিক পদার্থবিদ্যা। শৈশবে লাঠিম খেলেছি, গতি ও ঘূর্ণির। আঙুলের ফাঁক গলে তবুও প্রেতসন্ধ্যা উঁকি দিয়ে যায়। হে মিনার্ভা, জায়া ও জননী আমার, তোমার স্মৃতিতাড়িত চৌবাচ্চার গণিতে উৎরে গিয়েছি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক; তবু তোমার বেদনার পাহাড়জুড়ে আদোনিস ফসল ফলায়।