কার্ল স্যাগান সাক্ষাৎকার : শফিউল জয়
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ জুন ২০১৭, ৩:৩৫ পূর্বাহ্ণ, | ২৬৭৭ বার পঠিত
কার্ল স্যাগান সাক্ষাৎকার : ভবিষ্যতে বিজ্ঞানের থেকেও উৎকৃষ্ট মিথের সম্ভাবনা আছে
সাক্ষাৎকার প্রকাশকাল: ডিসেম্বর ২৫, ১৯৮০: রোলিং স্টোন ম্যাগাজিন
সাক্ষাৎকার নিছেন : জোনাথান কট
টি এস এলিয়টের ‘Little Gidding’ এবং বব ডিল্যানের ‘Mr Tambourine Man’ — এর লাইনগুলোর তর্জমা : নাফিস সবুর
ভূমিকা : কার্ল স্যাগানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু অ্যাজিমভ স্যাগান প্রসঙ্গে বলসিলেন — ‘আমার দুইজনের সাথে পরিচয় আছে, ধীশক্তির দিক থেকে যারা আমাকে ছাড়িয়ে গেছেন’। এদের মধ্যে একজন কার্ল স্যাগান। ব্যক্তিগতভাবে একসময় ‘ফোর হর্সমেন’ — এর চিন্তাভাবনার সাথে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ পরিচয়ের সুবাদে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বজ্ঞানের সাথে সামাজিক সম্পর্কের ব্যাপারগুলোর বৈচিত্র্যময় প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া নিয়ে সচেতন ছিলাম। আর ঝোঁকটা ছিল বিজ্ঞানের দিকেই। সেই সূত্রেই কোন এক সময় পরিচয় স্যাগানের সাথে। পালাবদলের রেষারেষিতে বিজ্ঞানকে বৃহত্তর একটা জায়গা থেকে বোঝার ইচ্ছা এবং সেইসূত্রে ‘ফোর হর্সমেন’ — কে আত্মস্থতার তাগিদটা হারিয়ে ফেললেও কার্ল স্যাগান স্বীয় মানসিক গঠনের পটভূমিতে উপস্থিত বর্তমানকাল অবধি। কেন স্যাগান এখনো উপস্থিত — সেই বোঝাপড়াটার জন্যেই বলা যায় সাক্ষাৎকারটা অনুবাদ করা। সম্ভবত এক প্রকারের মহাজাগতিক সমাচ্ছন্নতাবোধ ব্যাপৃত তার লেখায় — যা বিমূর্ত বিজ্ঞানের জগতকে বাস্তব জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে অন্য কোন বৃহত্তর এবং সংবেদনশীল সম্ভাবনাময় জগতের কথা বলে, যেখানে তুচ্ছতম বস্তুটাও সমহিমায় নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়।
বুদ্ধদেব বসু লিখছিলেন — ‘সন্ধ্যাবেলায় যখন গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে দুর্লভ করুণ শঙ্খের মতো প্রায় পূর্ণ চাঁদটি চোখে পড়ে, তার তার ঝিরিঝিরি আলো সোনালি সুতার মতো ডালেপালেয় জড়িয়ে যায়, তখন মনে করতে পারি না যে আমি ক্ষণকালীন দুঃখসুখভোগী একটা জীব মাত্র; মনে হয় আমার প্রাণের ধারা অতীতের বিচিত্র যুগ-যুগান্তর থেকে যাত্রা ক’রে ভবিষ্যতের নিঃসীম সম্ভাবনার মধ্যে পরিব্যপ্ত; মনে হয় এই চাঁদ-জ্বলা মুহূর্তটিতে আমি যে আছি, এর পিছনে যেন শত শতাব্দীর একটা ইতিহাস আছে।’
স্যাগানপাঠের পরবর্তী অনুভূতিটা কিছুটা এমনই। সাক্ষাৎকারগ্রহণকালে আরও উপস্থিত ছিলেন কসমস স্ক্রিপ্টের সহলেখক এবং কার্ল স্যাগানের স্ত্রী অ্যান ড্র্যুয়ান।
প্রশ্ন : আপনার ‘কসমিক কানেকশন’ বইয়ে আপনি এলিয়ট থেকে উদ্ধৃত করেছেন : “আমাদের অপার প্রভূত পথের দিশা জ্যোতির্ময় পলকে সে থাকে জাগরুক / তার থেকে মামুলি বেচান মানুষ / সকল সমস্ত গহন, অতিক্রমের পর । পুরান সম্ভাবনায় রম্ভে চমক বাঁচায়া ফেরা তার — । প্রথম এইবার নিজের পায়ের ছাপে নিজেরে চেনা…” এখানে ‘চেনা’ শব্দটার উপর গুরুত্ব দিয়ে প্রথমবারের মতো কোন কিছু সম্পর্কে অবগত হওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে প্রশ্ন করতে চাই। যেহেতু ধারণাটা আপনার নানা কাজে ঘুরেফিরে প্রায়ই আসছে।
স্যাগানঃ : প্রায় এক মিলিয়ন বছর আগে কোন শ্যামল তৃণভূমির উপর ছোট্ট কম্যুনিটিতে আমাদের যাত্রা শুরু। সময়টা ছিল পশু শিকার, সন্তান জন্ম দেয়া এবং সমৃদ্ধ সামাজিক, যৌন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জীবন গড়ার। কিন্তু চারপাশ সম্পর্কে তখন প্রায় কিছু জানতাম না। তারপরও চেনার তাগিদটা ছিল, যার জন্যে মিথের উদ্ভব। মিথগুলা জগতের গঠন সম্পর্কে একটা কল্পিত ধারণা দিত, তখনকার ব্যাখ্যাবিশ্লেষণগুলো ছিল যা জানতাম তার উপরে ভিত্তি করেই। আমরা কাহিনী বানাইলাম নানারকম। যেমন ধরেন — বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তি মহাজাগতিক ডিম থেকে, কিংবা মহাজাগতিক দেবদেবীদের মিলনের ফলে অথবা কোন শক্তিশালী সত্তার হুকুমে। তবে সেগুলো নিয়ে সম্পূর্ণ সন্তুষ্টি আমাদের ছিল না। সে কারণে মিথের সীমানা বড় করা শুরু করলাম। একসময় সেই রাস্তা ধরে আগাতে আগাতে আবিষ্কার করলাম — মহাবিশ্বের গঠন এবং নানা বস্তুর উৎপত্তি আসলে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা উপায়ে।
হয়তো সেইসব মিথের বোঝা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছি, এবং বলতে গেলে প্রাচীন মিথগুলা নিয়ে কিছুটা বিব্রতও। তবে আমরা তাদেরকে সম্মান করি। কারণ তাদের চেনার তাগাদাই আজকের আধুনিক, বৈজ্ঞানিক মিথের দিকে ধাবিত করছে। প্রথমবারের মতো এখন জানার সুযোগ আছে কীভাবে মহাবিশ্বের সৃষ্টি, যেটা আগেকার বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি বিষয়ক প্রত্যাশার সম্পূর্ণ বিপরীত। এটা বিশ্বের ইতিহাসের খুব ক্রিটিক্যাল সময়।
প্রশ্ন : অন্বেষণকারী হিশেবে মহাবিশ্বকে নিজের কাছে ব্যাখ্যা করার জন্যেই মানবজাতি অস্তিমান — এলিয়টের উদ্ধৃতিটা এমন ধারণা দেয় বলেই মনে হয়।
কার্ল স্যাগান : একেবারে ঠিক। আমরা এই মহাবিশ্বের প্রতিনিধি। হাইড্রোজেন অ্যাটমকে পনেরো বিলিয়ন বছরের মহাজাগতিক বিবর্তনের সময় দিলে এটা কী করতে পারে, আমরা তার উদাহরণ। চিন্তাটা বিহ্বল করে দেয়। সকল মানুষের উৎপত্তি, কম্যুনিটি, জাতি, মানবপ্রজাতির শুরুয়াদ, আমাদের পূর্বপুরুষ কারা ছিলেন, প্রাণসৃষ্টির রহস্য — এসব দিয়েই ঔৎসুক্যের শুরু। পৃথিবী, সৌরজগৎ, গ্যালাক্সি কই থেকে আসলো — এসব প্রশ্ন তো গভীর তাৎপর্য বহন করে। এগুলা প্রত্যেক সংস্কৃতির ফোকলোর, মিথ, অপবিশ্বাস এবং ধর্মের মূলগত বিষয়। কিন্তু প্রথমবারের মতো আমরা প্রশ্নগুলার উত্তরের দ্বারপ্রান্তে। তার মানে এই না যে চূড়ান্ত উত্তরটা পেয়ে গেছি। অনেক ব্যাপার নিয়েই এখনো রহস্যময়তা, দ্বিধাচ্ছন্নতায় ঘুরপাক খাচ্ছি। এবং আমি মনে করি, সেটাই আমাদের নিয়তি। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সবসময়ই আমাদের বোঝার ক্ষমতার চেয়ে ঐশ্বর্যময় থাকবে।
উদাহরণস্বরূপ জুপিটারের সবচেয়ে বড় চাঁদগুলার একটা ‘ঈও’-র কথা বলা যায়। ‘ঈও’ সতেরো শতাব্দীর আগ পর্যন্ত অনাবিষ্কৃত ছিল। ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত এটা সবার কাছে ছিল আলোকবিন্দু মাত্র। সামান্য কয়েকজন জ্যোতির্বিদ, যাদের কী না বড় টেলিস্কোপের সুবিধা ছিল, তারা ‘ঈও’ — র পৃষ্ঠদেশের ক্ষীণ বর্ণিলতা দেখতে পারতেন। কিন্তু এখন হাজার হাজার ডিটেইল্ড ছবি আছে, যেগুলো কিলোমিটারবিস্তৃত বৈশিষ্ট্যগুলা দেখাতে পারে। ঘটনাটা হচ্ছে একটা দুনিয়া সম্পর্কে অজানা থেকে জ্ঞানের বিশাল ধাপে উন্নীত হওয়া। যাই হোক, সেটা মাত্র একটা দুনিয়া। তারপর আরও বিশটা গ্রহ এবং চাঁদের ছবি আমরা তুলছি। বিশটা নতুন দুনিয়া!
প্রশ্ন : ফ্রয়েড মুহূর্তটা সম্পর্কে বলতে গিয়ে শিশুর প্রথমবারের মতো আয়নার নিজেকে দ্যাখার সাথে তুলনা করছেন।
স্যাগান : রূপকটা চমৎকার। মাত্রই আমরা আয়নাটা আবিষ্কার করসি, এবং নিজেদেরকে দূর থেকে দেখতে পারতেছি।
প্রশ্ন : ‘কসমস’ সিরিজে আপনি বলছেন — বিশ্বজগত যে বোধগম্য সেটা খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতক থেকেই গ্রিস জানতো।
স্যাগান : আমার জানাশোনা বলে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যে দেবদেবীদের কোন খেয়াল বা ইচ্ছার অধীনে না, বরং মানুষের বোধগম্য সাধারণ প্রাকৃতিক সূত্র দ্বারা পরিচালিত — ষষ্ঠ শতাব্দীর আইয়োনিয়াই সর্বপ্রথম ব্যাপারটাকে গ্রহণ করে নিছিল। নিজেকে ধ্বংস করার ভয়াবহ বিপদে আছে এই সভ্যতা।
১৯৬০ সালের পর পৃথিবীর সম্পূর্ণ ছবিটা তোলা হয়, এবং সবাই দেখতে পায়, ছোট্ট একটা বল মহাশূন্যে ভাসতেছে। আমরা উপলব্ধি করলাম : বহুদূরে ভিন্ন আকৃতি, রঙ আর গঠনের এরকম অনেক সাদৃশ্যপূর্ণ বিশ্ব ছিল এবং অনেকগুলার মধ্যে পৃথিবীও একটা। আমার মনে হয়, এই মহাজাগতিক পরিপ্রেক্ষিতের প্রায় পরস্পরবিরোধী এবং একই সাথে শক্তিশালী দুইটা লাভজনক দিক আছে — এক. আরও অনেক পৃথিবীর মতো আমাদের এই পৃথিবী, এবং দুই. এই পৃথিবীর নিয়তি নির্ভর করতেছে আমাদের উপরেই।
প্রশ্নঃ আপনি প্রায়ই রাশান বিজ্ঞানী কে ই শলকভস্কির বক্তব্য উদ্ধৃত করেন : পৃথিবী মানবজাতির দোলনা, কিন্তু কেউ দোলনায় সারাজীবন পার করে দিতে পারে না।
স্যাগান : পৃথিবী বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেলে অন্য কোথাও চলে যেতে হবে- এরকম প্রস্তাবনায় আমার বিন্দুমাত্র সায় নাই। অর্থনৈতিক এবং নৈতিক দিক থেকে এটা খুব অজ্ঞতাপ্রসূত চিন্তা। তথাপি এও সত্য যে, মা-পৃথিবী ছেড়ে গ্যালাক্সির অন্য কোথাও গিয়ে ভাগ্যান্বেষণ মানবপ্রজাতির পরিপক্বতার লক্ষণ। কিন্তু কোনভাবেই পৃথিবীকে ত্যাগ ক’রে না। আমরা যদি নিজেদের বসতবাড়িকেই ঠিক না রাখতে পারি, মহাজগতের অন্বেষণ আমাদের দিয়ে সম্ভব হবে না।
চার বিলিয়ন বছরের ট্রায়াল অ্যান্ড এররের মাধ্যমে প্রাণের উদ্ভব। কিন্তু বায়োলজিক্যাল বিবর্তনের মতো র্যান্ডম এবং প্রচুর জীবের মৃত্যুর বিবেচনায় অপব্যয়ী প্রক্রিয়ার মতো সুযোগ আমাদের নাই। যদি আমরা নিজেদেরকে ধ্বংস করে ফেলি, তাহলে হয়তো গ্রহের বাকি জীবের কাছে সেটা হবে ছোটখাটো একটা ট্র্যাজেডি, কিন্তু আমাদের জন্যে অবশ্যই বড়। ফলে ভুলের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে, সেগুলোকে পাশ কাটায়া যেতে হবে। হোঁচট খেয়ে বলার সুযোগ নাই, ‘ পনেরো হাজার নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড জামানো ভালো কিছু না। আমার ভুল থেকে শিখছি এটা’। নিজেকে ধ্বংস করার ভয়াবহ বিপদে আছে সভ্যতা, অন্তত নিজের প্রজাতিকে ধ্বংস করার। কিন্তু গ্রহের সকল জীবকে ধ্বংস করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না, এমন কী পুরা গ্রহকেও না অবশ্যই। ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষমতার হায়ারার্কি আছে।
প্রশ্ন : এই সময়ে আমরা তো শুধু নিজেদের না, আমাদের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিদীপ্ত কিছু হাইপোথিসিসকেও ধ্বংস করে ফ্যালার জন্যে উঠেপড়ে লাগসি। দিন দিন আরও বেশি মানুষ ন্যুয়র্কের মুখপাত্র লুথার সান্ডারল্যান্ডের ‘ক্রিয়েশনিস্ট’ (বিবর্তনবিরোধী) মতবাদকে গ্রহণ করতেসে। সান্ডারল্যান্ডের মতে — ‘একটা ডানা মানে ডানা, পালক মানে পালক, অক্ষিগোলক মানে অক্ষিগোলক, ঘোড়ার মানে ঘোড়াই এবং মানুষ মানে শুধু মানুষই’।
স্যাগান : প্রাকৃতিক জগতের সৌন্দর্য আর বৈচিত্র্য ব্যাখ্যা করার জন্যে বিবর্তনবাদ আজ পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ মতবাদ। প্রাকৃতিক নির্বাচনের নিয়মে ঘটা বিবর্তনপন্থাকে ভুল প্রমাণ করা কষ্টসাধ্য। বিবর্তনবাদ বিরোধীদের বিবর্তন নিয়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা সম্ভবত সময়ের প্রেক্ষাপটটা নিয়ে। ধরেন, আপনি এক জায়গায় দাঁড়ায়া একটা গাছ দেখলেন ; এইটা কিন্তু অন্য কিছুতে বদলে যাবে না। এটা দেখে সিদ্ধান্তে নিলেন, ‘বিবর্তনবাদ ফালতু’। কিন্তু জিনিশটা যদি একশো মিলিয়ন বছরের প্রেক্ষাপটে হয় তাহলে সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু দেখতে পারবেন। ‘যদি আমি না দেখে থাকি, তাহলে এটার অস্তিত্ব নাই’- আমার ধারণা এমন সহজাত প্রবৃত্তিটা কাজ করার কারণে বিবর্তনবাদ নিয়ে সবাই সন্দেহ করে। স্পেশাল রিলেটিভিটি নিয়ে সন্দেহের কারণটাও অনেকটা এইরকম। স্পেশাল রিলেটিভিটির মতে, কেউ যদি আলোর কাছাকাছি গতিতে ভ্রমণ করে, তাহলে সে দেখবে তার ঘড়ি স্লো হয়ে গেসে এবং সে দূর ভবিষ্যতে ভ্রমণ করতে পারবে। কিংবা কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলে, খুব ক্ষুদ্রের জগতে একটা ডাম্বলশেইপ অণুকে কেউ ইন্টারমিডিয়েট পজিশনে দেখতে পারবে না, হয়তো এই পজিশনে, কিংবা ওই পজিশনে দেখবে। তখন বলবে, ‘আজব তো! আমি তো জীবনেও এমন কোন রুল দেখি নাই যেটা একটা জিনিশকে আমার ইচ্ছামতো কোন ইন্টারমিডিয়ারি পজিশনে নিতে বাঁধা দেয়’।
কমনসেন্সের সীমাবদ্ধতা এখানেই। আমরা যে বিশ্বে বাস করি সেখানে সময়ের স্কেইল হচ্ছে দশকের টাইম স্কেইল, স্পেইস মাপামাপির দৌড় এক মিলিমিটারের এক দশমাংশ থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত, এবং গতির কথা বলতে গেলে সবসময়ই আলোর গতির থেকে কম। কিন্তু একবার মানবঅভিজ্ঞতার সেই প্রাত্যহিক ডোমেইনটা ছেড়ে বের হলেই বুঝতে পারবো প্রকৃতির সূত্রগুলা মানুষের কমন্সেন্সিকাল ধারণার আওতায় চলে না। আমাদের ধারণাগুলা খুব নির্দিষ্ট কিছু অভিজ্ঞতার উপর নির্ভরশীল। এমনকি, আমাদের শরীর যেসকল বস্তু দিয়ে গঠিত, সেসব কোন না কোন এক এক নক্ষত্রের কেন্দ্র থেকে তৈরি হয়ে আসছে।
এসবই কিছু মানুষের অসন্তুষ্টির কারণ। এছাড়া, অবস্থানগত দিক থেকে আমরা যে মহাবিশ্বের চূড়ায় না, এটা অনেকেই মেনে নিতে পারে না।
প্রশ্ন : তারা তো এইপ হওয়ার থেকে চূড়ায় থাকতে বেশি আগ্রহী।
স্যাগান : যদি ভাবতাম দুনিয়াদারির পরম সমন্বয়কারীর কোন বিশেষ উদ্দেশ্য বা স্বার্থ আছে মানুষকে সৃষ্টি করার পেছনে, তাহলে অবশ্যই আমরা বিশেষ কোন তাৎপর্যের অধিকারী হতাম। এরকম হলে তো ভালোই লাগতো। কারণ তাহলে নিজেদেরকে নিয়ে সাবধান থাকার কোন প্রয়োজন ছিল না, আমাদের দেখাশোনার কাজটা শক্তিশালী অন্য কেউ-ই করতো। খুবই প্রলুব্ধকর ভাবনা, কিন্তু সব আশা-ভরসা তো মহাজগতের উপর চাপায়া দিতে পারি না। নতুনকে পরখ করে দ্যাখার সদিচ্ছা থেকে বৈজ্ঞানিক ঐতিহ্যের মাধ্যমে আমরা বোঝার চেষ্টা করতে পারি মহাবিশ্ব আমাদেরকে কী বলার চেষ্টা করতেছে।
ক্রিয়েশনিজমের কথা বলতে গেলে, এটা সত্য যে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন একটা হাইপোথিসিস। আরও সম্ভাবনা আছে, থাকতে পারে। ক্রিয়েশনিস্টরা বলে তারা সুবিচার চায়। অনেকগুলা প্রতিদ্বন্দ্বীমূলক মতবাদের ভেতর থেকে শুধুমাত্র একটা মতবাদই স্কুলগুলাতে পড়ানো হচ্ছে — এটা তারা মানতে পারে না। তাদের সুবিচারের আগ্রকে স্বাগত জানাই, কিন্তু সেই সুবিচারের ইচ্ছার প্রশ্নে প্রথম পরীক্ষাটা হয়ে যাক চার্চে বিবর্তনবাদ পড়ানোর মধ্য দিয়ে। তারা যদি দুশ্চিন্তা করে দুই পক্ষের প্রচারটা সমানভাবে হচ্ছে না, তাহলে বলতে হবে চার্চে, সিনেগগে, মসজিদে তো একমুখী ধারণাই পড়ানো হয়। এইসবের বাইরে আরেকটা জিনিশও যোগ করা যায় — টেলিভিশনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে নিরলসভাবে নিজেদের বিশ্বাস ব্যবস্থাকে প্রচার করাটাও।
প্রশ্ন : আপনার বইগুলায় এবং ‘কসমস’ সিরিজে একটা ব্যাপার লক্ষণীয়। মহাবিশ্বের সকল বস্তুর সাথে পারস্পরিক সম্পৃক্ততা এবং যোগসূত্রের ধারণা দ্বারা আপনি গভীরভাবে আচ্ছন্ন ব’লে মনে হয়।
স্যাগান : প্রস্তাবনাটা প্রকাণ্ড সত্য। যাজকরাও কোন জিনিশ নিয়ে বলতে গেলে অনেকটা এরকম সুরেই বলে। আমাদের শরীরের প্রত্যেকটা অংশের উপাদান নক্ষত্রগুলার কেন্দ্র থেকে আসছে। নক্ষত্রের উপাদান দিয়েই আমরা গঠিত : দাঁতের ক্যালশিয়াম, জিনের কার্বন, চুলের নাইট্রোজেন, চশমার সিলিকন; স-অ-ব। অইসব পরমাণুগুলা শত কোটি বছর আগের শত শত আলোকবর্ষ দূরত্বের কোন নক্ষত্রের সরল পরমাণু থেকে সৃষ্ট।
কী বিস্ময়বিহ্বলতায় আমরা পুরা মহাজগতের সাথে সম্পৃক্ত। নক্ষত্রের মৃত্যুর সময় নির্গত কসমিক রে’র অংশত প্রভাবে যে মিউটেশন হয়, অর্থাৎ জেনেটিক ম্যাটেরিয়ালে পরিবর্তন — সেটাই আজকের ‘আমরা’-র দিকে ধাবিত করসে। প্রাণের উৎপত্তির সূচনা সূর্যের আলট্রাভায়োলেট লাইট আর বজ্রপাত থেকে — সূর্যের মাধ্যমে পৃথিবী উত্তপ্ত হওয়ার কারণে যেটা হইসে আর কী! এই যোগসূত্রগুলা অবিচ্ছেদ্য, শক্তিশালী এবং ভয়ংকর সুন্দর। এমন মহাজাগতিক সংযোগের খোঁজই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। এগুলা জ্যোতিষীর ভেক না, তার থেকেও অনেক অনেক বেশি ঐশ্বর্যময়। এবং এর মধ্যে সত্যের গুণাবলীও আছে।
প্রশ্ন : আমি জানি, আপনি জ্যোতিষীদের সমর্থক না।
স্যাগান : আমার সম্পূর্ণ সমর্থন করতাম, যদি তাদের কাছে কোন ধরণের প্রমাণ থাকতো। তা তো নাই। এটা বর্ণবাদ কিংবা সেক্সিজমের মতো একটা চর্চা : তোমার বারোটা খোপ আছে এবং নির্দিষ্ট কোন গ্রুপের কাউকে যখন সেই অনুসারে বসাও — যেমন কুম্ভ, বৃশ্চিক কিংবা কন্যারাশি, তখনই তার বৈশিষ্ট্যগুলা জেনে যাও। ব্যক্তিগতভাবে কাওকে চেনার প্রচেষ্টার কোন দরকার থাকে না।
প্রশ্ন : গর্ডন র্যাট্রে তার বই ‘দ্যা ন্যাচ্রাল হিস্ট্রি অফ দ্যা মাইন্ড’ বইতে মন এবং মস্তিষ্কের পার্থক্য করসেন, যার সাথে আপনি দ্বিমত পোষণ করেন। র্যাট্রে চেতনার বৈচিত্র্যদশা (অল্টার্ড স্টেইস্টস অফ কনশাসনেস), স্মৃতিবিভ্রম, শৈল্পিক প্রেরণা, কল্পনা, প্রশমন, প্ল্যাসেবো ইফেক্ট, গন্ধ, দৃষ্টিশক্তি, টেলিপ্যাথি, ইচ্ছাশক্তি, ভালোবাসা মতো কিছু উদাহরণ দিয়ে সিদ্ধান্ত টানলেন যে- শুধুমাত্র ব্রেইনের উপর গবেষণা করে উদ্দিষ্ট ব্যাপারগুলো সম্পর্কে নিশ্চিত কোন ব্যাখ্যা দাড়া করানো যায় না।
স্যাগান : কল্পনা নিয়ে বলো! এই প্রস্তাবে তো আমি কল্পনার স্বল্পতা দেখতেসি যে…
ড্রুয়ান : … ম্যাটেরিয়াল রিয়ালিটি দিয়ে এগুলা ব্যাখ্যা করা যায় না।
স্যাগান : ঠিক। ধরা যাক, সে চেতনার বৈচিত্র্যদশার কথা বলতেসে। অ্যালকোহলের মতো সাইক্যাডেলিক ড্রাগ সবসময় চেতনার বৈচিত্র্যদশা তৈরি করে। এটা খুবই সরল অণু : C2H5OH. শরীরে গ্রহণ করো, এবং সাথে সাথে খুব ভিন্ন কিছু ফিল করবা। এটা কী মিস্টিক্যাল, না কী রসায়ন? যে-কোন নতুন চিন্তা যদি কিছুকে চ্যালেঞ্জ না করে, তাহলে সেটার মূল্য নাই।
প্রশ্ন : এর মানে দাঁড়াচ্ছে, আপনি চেতনার বৈচিত্র্যদশায় কী অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন — এই ব্যাপারটার থেকে রসায়নের দিকটাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন বেশি।
ড্রুয়ান : নর্তকীকে নাচের থেকে আলাদা করে দ্যাখা কেন? অভিজ্ঞতাকে অভিজ্ঞতার কারণের বাইরে থেকে দ্যাখার কোন দরকার আছে কী? বিজ্ঞানের আদর্শটাই হচ্ছে বাস্তবতায় বিশ্বাস এবং প্রশ্নের উত্তরের জন্যে প্রকৃতিকে অনুসন্ধান, যাতে আয়নার সামনে দাড়ায়ে মুখ না ফিরায়া নিয়ে সত্যের মুখোমুখি হতে পারি।
প্রশ্ন : ‘দ্যা ড্রাগন্স অফ ইডেন’ — এ আপনি লিখেছেন — ‘মস্তিষ্কের অগণিত ক্রিয়ামূলক প্যাটার্ন থাকার কারণে দুইটা মানুষের এক হওয়া সম্ভব না, এমন কী আইডেন্টিক্যাল যমজ হলেও… মস্তিষ্কের সম্ভাব্য সকল দশার স্বরূপ জানা অসম্ভব ; মানসিক প্যাটার্নেও এমন প্রাচুর্যবৈচিত্র্য আছে যে, হয়তো অনেক জায়গায় পুরা মানব ইতিহাসে মানুষ কখনো প্রবেশই করে নাই বা তার আভাসও পায় নাই’। আপনার কি মনে হয় মানুষ এইসব প্যাটার্নের সাথে কখনো পরিচিত হতে পারবে?
স্যাগান : আচ্ছা, আমি ঠিক জানি না। এরকম অনেক থাকতেও পারে, আবার নাও থাকতে পারে- যে জায়গায় কোন লোক আগামী কয়েক হাজার বছরে প্রবেশ করবে না।
প্রশ্ন : মানুষের কি সেই জায়াগাগুলাতে প্রবেশ করার চেষ্টা করা উচিত?
স্যাগান : গতানুগতিক ধারণাগুলাতে অবিশ্বাস করাটা দরকার — এইটুকু বলতে পারি। কেউ যদি নতুন কোন ধারণায় আগ্রহী হয়, তাহলে এখনো বলা হয় নাই এমন সত্যকে অব্জেক্টিভ জায়গা থেকে দ্যাখার চেষ্টা করতে হবে।
প্রশ্ন : আপনি কসমস- এ যে বিজ্ঞানীদের কথা বলছেন, তারা বিধ্বংসী?
স্যাগান : হ্যাঁ। আলফ্রেড নর্থ হোয়াইটহেডের কথা আছে, ‘ভবিষ্যতের কাজই ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া’। যে-কোন নতুন চিন্তা যদি কিছুকে চ্যালেঞ্জ না করে, তাহলে সেটার মূল্য নাই।
প্রশ্ন : আপনার মতে কি ভবিষ্যৎ ঝুঁকিপূর্ণ হতে যাচ্ছে?
স্যাগান : অবশ্যই। যদিও বর্তমানও ঝুঁকিপূর্ণ। উদাহরণ দেই। আজকে প্রায় দুইশো বা এরকম কাছাকাছি সংখ্যক দেশে যে ধরণের সরকারব্যবস্থা আছে, সেসবের কোনটাই আগামী শতাব্দীর মধ্যভাগের জন্যে উপযুক্ত না। একটাও না। এই অবস্থা থেকে অন্য কিছু ভাবতে হবে। কিন্তু বর্তমান অবস্থাকে প্রশ্ন না করে অন্য অবস্থায় যাওয়া কি সম্ভব? পুরা দুনিয়া অকল্পনীয় গতিতে আগায়া যাচ্ছে। মানুষের অস্তিত্ব নির্ভর করে ওইসব পরিবর্তনের সাথে নিজেদের খাপ খাওয়ায়া নেয়ার মধ্য দিয়া। কিন্তু সরকার সবসময়ই কিছু পরিবর্তন করতে চায় না।
আমার মতে, যেসব জাতি তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবে, তাদের প্র্যাক্টিক্যালি পরীক্ষামূলক কম্যুনিটি আবিষ্কার নিয়ে চিন্তা করা উচিত। মানে এমন সমাজ যেটা একবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগের জন্যে উপযুক্ত। সিক্সটিজের বিকল্প কম্যুনিটি আইডিয়া নিয়ে ভাবা যায়। এটা খুবই স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপার ছিল। অনেক মানুষ বুঝতে পারছিল সোসাইটি এইভাবে চলতে পারে না। ফলে বিকল্প কিছু ভাবসিল তারা। কিন্তু বৃহত্তর সোসাইটি এরকম বিকল্পদের নিয়ে বাটে পড়ে গেসিল। অপেক্ষাকৃত ভালো দুনিয়ার কথা বলাটা তিরস্কার মনে করে অনেকে। এটা বলে, ‘তুমি কিছু করো না ক্যান বাপু?’ আমাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষ বড় ধরণের পরিবর্তন করতে পারি না দেখে যে-কোন প্রণোদনাকেই বাঁধা দেই।
ড্রুয়ান : পরিবর্তনের বিরুদ্ধতা আছে, কিন্তু একবার হয়ে গেলে কোথাও কোন নিস্তার নাই। সমস্যাটা গভীর।
প্রশ্ন : আপনারা চেষ্টা করছেন মানুষজনকে কিছুটা জাগাতে?
স্যাগান : সেগুলা তো অত্যন্ত নৈতিক প্রণোদনা। কিন্তু আমার প্রণোদনাগুলার মধ্যে বিজ্ঞান বোঝাটা আনন্দদায়ক — এই ব্যাপারটা আছে। আনন্দটা ভাগাভাগি করে নেয়া যায়।
প্রশ্ন : অশুভসূচক কিছু করার উদ্দেশ্য তো নাই।
স্যাগান : অনেক ক্ষেত্রেই বিজ্ঞানকে জগতের কাছে যে-কোন যুক্তিপূর্ণ মানুষের জানতে চাওয়া শেষ বিষয় হিশেবে ধরে নেয়া হয়। এমনভাবে তুলে ধরা হয় যেন বিজ্ঞান অসম্ভব দুর্বোধ্য একটা কিছু, যেটা মগজ পচায়া সামাজিক মিথষ্ক্রিয়ার অযোগ্য করে তুলে।
প্রশ্ন : বব ডিল্যান তো ‘স্লৌ ট্রেইন কামিং’ অ্যালবামে বিজ্ঞানীদের তাচ্ছিল্যই করসে বলা যায়।
ড্রুয়ান : কী আর বলবো! ডিল্যানের হিম্মতওয়ালা রুপক আমার পছন্দ ছিল। এবং যে কোন নগ্ন অনুভূতিকে ডিল্যান একেবারে ভণিতা ছাড়া সরাসরি বলে দিতে পারতো। নির্ভীক যাকে বলে। কিন্তু এখন দেখে মনে হচ্ছে ওই জায়গা থেকে সরে আসছে সে, আলোতে চোখ ধাধায়া গেসে। তাই সহজ কোন ব্যাখ্যা খুঁজতেছে।
প্রশ্ন : ‘দ্যা ড্রাগনস অফ ইডেন’ বইতে আপনি সেইন্ট অগাস্টিন অফ হিপোকে উদ্ধৃত করসেন,‘আমি নক্ষত্রমণ্ডলীর স্বপ্ন দেখি না আর’’।
স্যাগান : এটাকে জাস্ট অন্য লাইনের সাথে তুলনা করেন, ‘ চকচকে আকাশের নীচে এক হাত ভরা হিল্লোলে আমার নাইচা বেড়ানোর সাধ ’। লাইনটা অগাস্টিনের সাথে আর ডিল্যানের সাম্প্রতিক পুনরুত্থানের সাথে তুলনা করা হোক।
প্রশ্ন : মানসিক প্যাটার্নের প্রাচুর্যতার কথা মাথায় রেখে আপনি লিখছেন, ‘এই প্রেক্ষাপট থেকে, প্রত্যেকটা মানুষই আসলে বিরল এবং ভিন্ন। ব্যক্তিমানুষের জীবনের এই পবিত্রতা সম্ভাবনাময় এবং নৈতিক ফলাফল’’। এটার সাথে আপনার আরেকটা লেখনীর তুলনা করা যায়, ‘অন্য মানুষ এবং প্রাণীর প্রতি প্রাপ্য সমমর্যাদার ধারণাটা সাড়ে চার বিলিয়ন বছরের বিবর্তনের মহান উত্তরাধিকার থেকে প্রাপ্ত’। উপরোক্ত দুটা লাইনই জগতের সকল সত্তা এবং সৃষ্টির প্রতি বুধিস্ট একটা সেন্স থেকে ভালোবাসার গুরুত্বের কথা তুলে ধরে।
স্যাগান : তুলনাটা শুধুমাত্রই যুক্তিচর্চার প্রসার বৈকি? মানুষজন অবশ্যই তার পরিবার, বন্ধু, আত্মীয়দের ভালোবাসে এবং কম্যুনিটি, ট্রাইবের প্রতি সবারই এক ধরণের মমতা বোধ করে। বর্তমান যুগে নেশন-স্টেইটের ধারণাটা মানুষের পরিচয় শনাক্ত করার নীতি হিশাবে কাজ করতেসে। যদি আমরা আমাদের সাধারণ ঐতিহ্য, জেনেটিক সম্পর্কটা বোঝার চেষ্টা করি, তাহলে সীমারেখা টানার প্রশ্নটা ক্যানো আসতেসে? সকল প্রাণীর প্রতি অবিচ্ছিন্ন ধারায় কেন সবাই এক হয়ে যেতে পারতেসি না? গ্রহের অন্য জীবের প্রতি কি আমাদের সিম্প্যাথি নাই? তারা আমাদের কাজিন। খুবই স্পষ্ট আইডিয়া এটা।
প্রশ্ন : আপনার দৃষ্টিভঙ্গি তো এখনকার সক্রিয় চিন্তাভাবনার থেকে নৈতিকভাবে অনেক ব্যাপক।
স্যাগান : প্রশ্নটা সময়ের দৃষ্টিভঙ্গির। লক্ষ্য করবেন, মানুষের ইতিহাসের বেশিরভাগ সময়ই কাটসে হান্টার-গ্যাদারার সোসাইটিতে। এবং একই ধরণের যে সমাজগুলা এখনো বিদ্যমান, তাদের ভেতরে সহযোগিতামূলক মনোভাবটা এখনো আছে। এরকম সমাজ এখন খুব বেশি নাই আর, তবে আধুনিক জীবনের বিচ্ছিন্নতা কিন্তু তাদের ভেতর দ্যাখা যায় না। আমাদের সামাজিক পরম্পরাকে অস্বীকার করাটা মস্ত বড় ভুল। মানবচরিত্রের বড় একটা দিক হলো সহযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গিটা, আধুনিক সমাজে যে ব্যাপারটাকে উৎসাহিত করা হয় না। অবশ্যই এটার পরিবর্তন দরকার।
প্রশ্ন : বিজ্ঞানের জগতে পার্টিক্যাল ফিজিক্স, অ্যাস্ট্রোফিজিক্স, বায়োফিজিক্স, জিওফিজিক্সের মতো অনেক বিধিবদ্ধ এবং স্পেশালাইজড জায়গা আছে। যারা এসবের কোন একটাতে কাজে নিয়োজিত, তারা কিন্তু তাদের ডোমেইনের বাইরের কিছু নিয়ে জেন্রেল স্টেইটমেন্টের ঝুঁকিটা নিতে চায় না। কিন্তু ‘কসমস’ — এ আপনি গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে বলার হিম্মত দেখাইছেন।
স্যাগান : জিনিশটা তো আনন্দদায়ক। দুইটা প্রায় সম্পর্কহীন ফিল্ডের সীমানায়ই তো আকর্ষণটা। আর সীমানার ব্যাপারটা তো খুব খেয়ালি একটা কিছু। ধরা যাক, জিওলজি থেকে অ্যাস্ট্রনমির কিংবা কেমিস্ট্রি থেকে বায়োলজি অথবা ফিজিক্স থেকে ম্যাথের যে সীমানাগুলো করা হয়, সেগুলা তো মানুষের বানানো। কিন্তু বাস্তব জগতে সব একাকার হয়ে যায়। সবকিছুই একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
ধরা যাক একটা কম্পিউটার আছে, যেটা দেশের সব মানুষের নামের ভিতর দিয়ে গিয়ে একজনের র্যান্ডম নাম নির্বাচন করে, এবং আপনাকে সেই মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। ফলে আপনার কাউকে কল করতে হবে, তারপর যাকে কল করসেন তাকেও অন্য কাউকে কল করতে হবে এবং চলতেই থাকবে। প্রশ্নটা হলো, ওই মানুষটার কাছে পৌঁছানোর জন্যে গড়ে কয়টা কল করতে হবে? মানে বুঝাচ্ছি, যাদের কল করবেন, তাদের মধ্যে কয়জন আপনাকে চিনতে পারবে বলে মনে করেন? মানে ফোন দিয়ে যাকে বলতে পারবেন, ‘ হ্যালো চার্লি, কী অবস্থা! তুমি তো ওমাহাতে থাকো, কিন্তু নর্থ ডাকোটার ফার্গোতে একজন লোকের সাথে আমার কন্ট্যাক্ট করা দরকার। তুমি কি আমার হয়ে ওকে একটু কল করতে পারবা?’ কয়জন মানুষকে আপনি চিনেন যারা আপনার হয়ে ঠিক একইভাবে আরেকটা কল করবে? কয়জন? অনেক কিছু আছে চমকায়া উঠার মতো যেগুলার দিকে চোখ ফিরায়া তাকাইও না।
প্রশ্ন : হয়তো সত্তর আশিজন হবে।
স্যাগান : আচ্ছা, একশো ধরা যাক। ধরা যাক উপরের ঘটনাটা সবার ক্ষেত্রেই সত্য। তার মানে আপনি একশো জন মানুষকে চিনেন এবং সেই একশো জনও আরও একশো জনকে চিনে, যাদের অনেকজনই ইতিমধ্যে আপনার তালিকায় আছে। ফলে একশোজন যদি একশোজনকে কল করে তাহলে সংখ্যাটা দাঁড়ায় দশ হাজার। এরকম মিলিয়ন সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছাইতে হলে তিনজন, একশো মিলিয়নে পৌঁছাইতে হইলে চারজন। এবং দেশে মানুষই আছে মাত্র দুইশো মিলিয়ন।
প্রশ্ন : কিন্তু এই উদাহরণের মোরালটা কী?
স্যাগান : মোরালটা হইলো আমরা সবার সাথে সবাই যে কানেক্টেড— এটা কোন পিকিউলিয়ার বুধিস্ট আইডিয়া না। এটা সত্য।
প্রশ্ন : কিছুদিন আগে ন্যুইয়র্ক টাইমস এ একটা প্রতিবেদন বের হয় যেখানে কোয়ান্টাম থিয়োরির কিছু তাক লাগানো ফলাফলের কথা উল্লেখ করে বলা হইছিল- বিজ্ঞানীরা এমন কিছু খুঁজে পাইছে যেখানে পুরা মহাবিশ্ব, মানে ‘যে সময়ে এটা অস্তিমান, সেটার উৎপত্তি কোন স্বতঃস্ফূর্ত কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের মাধ্যমে— একটা অনস্তিত্ব থেকে আকস্মিক স্পন্দনে যার সূচনা’। কথাটা অনেকটা বুদ্ধের মতো শোনায়, তাই না?
স্যাগান : দ্বিমত পোষণ করছি না। অনেকটা প্রাচ্যের ধর্মগুলার মতোই শোনায়। এবং ব্যাপারটা নিখুঁতভাবে মর্যাদাপূর্ণ সায়েন্টিফিক পেপারের উপর ভিত্তি করেও হতে পারে।
প্রশ্ন : এই ধরণের জল্পনা ধর্মীয় এবং দার্শনিক প্রশ্নের সম্মুখীন করে দেয় কী?
স্যাগান : বিজ্ঞানের সবকিছুই তো তাই করে। আমি মনে করি, সহজাতভাবেই আমরা সবাই বিজ্ঞানী, এবং সে কারণেই আমাদের ধর্মীয় প্রশ্নগুলা আছে। এটা একমাত্র জিনিশ যেখানে অন্য সৃষ্টিগুলার থেকে আমরা যথেষ্ট পারঙ্গম। এমন কী অন্য প্রাণীদের সাথে সঙ্গীতের বেশিরভাগ অভিব্যক্তিতেই আমাদের মিল আছে, কিন্তু বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির বদৌলতেই আমরা সেটার বাস্তব রূপ দিতে পারি। উইপোকার ঘরবাড়ি বা এসব কিছু জিনিশ বাদে, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি ব্যাপারটা সুস্পষ্টভাবেই মানবসক্ষমতা, যেটা গ্রহের অন্য কোন প্রাণীর নাই। অনুভূতির ধারণাটা এককভাবে মানুষের না, অন্যান্য প্রাণীরও অনেক গভীর অনুভূতি আছে। চিন্তা করাটাই মানুষের একক বৈশিষ্ট্য। তাই এতে অবাক হওয়ার কিছু নাই যদি কোন ধর্মীয় আইডিয়ার সাথে বৈজ্ঞানিক সাযুজ্যতা পাওয়া যায়।
প্রশ্ন : কিন্তু আপনি তো বলসেন বিজ্ঞান এখনো একটা মিথ।
স্যাগান : মিথ হচ্ছে এমন একটা প্রয়াস, যেখানে লভ্য সর্বোৎকৃষ্ট তথ্যগুলাকে একত্রীত করে কোন কিছুর উৎপত্তি ব্যাখ্যা করা হয়।
প্রশ্ন : তার মানে ভবিষ্যতে বিজ্ঞানের থেকেও উৎকৃষ্ট মিথের সম্ভাবনা আছে।
স্যাগান : নিশ্চিতভাবেই আছে। এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা কেমন, আমরা এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে পরম কোন সত্যের সন্ধান পেয়ে গেলাম? এতগুলা বছরের কথা চিন্তা করলে এটা উল্লেখযোগ্য একটা কোইন্সিডেন্স হবে। মানবজ্ঞান অনেকটা ধারাবাহিক আসন্নতার মতো। সেখানে আমাদের সকল ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে, এবং এমন অনেক চমকায়া যাওয়ার মতো ধারণা আছে— যেগুলার আভাসও আমাদের কাছে নাই, কিন্তু আগামী দুই-এক শতাব্দীতেই হয়তো ফ্যাক্ট বলে বিবেচিত হবে।
প্রশ্ন : তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন এমন অনেক চিন্তাপদ্ধতি আছে, যেগুলা সম্পর্কে আমরা এখনো সজাগ না।
স্যাগান : অবশ্যই। নানা লেভেল থেকে এই প্রশ্নটার উত্তর হচ্ছে ‘হ্যাঁ’। টি এস এলিয়ট যেমন একটা স্থানকে নতুন করে প্রথমবার চেনার কথা বলছেন। কিন্তু দ্বিতীয় এবং তৃতীয়বারও সেটা হতে পারে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সময়ের একটা ধারাবাহিক পার্থক্য আছে। আমরা পৃথিবী নিয়ে কিছুটা তো সবাই জানি, কিন্তু সবসময় তো তাৎপর্যপূর্ণ কোন জ্ঞান যোগ করতে পারি না সেই জানার সীমানায়।
প্রশ্ন : তারমানে কখনোই নিশ্চয়তা নাই কোন?
স্যাগান : এক্ষেত্রে দুইটা ব্যাপক চিন্তার বিষয় আছে। একটা হচ্ছে, আমরা সব জেনে গেছি— তাই জানার আর কিছু নাই। আরেকটা হচ্ছে, সবকিছু এত জটিল যে কোন কিছু শুরুই করা যাচ্ছে না। আমরা খুব ভাগ্যবান যে এমন একটা মহাবিশ্বে বাস করি, যেখানে প্রকৃতির সূত্র আছে এবং আবিষ্কার করার অনেক কিছুই বিদ্যমান। কিন্তু আবিষ্কার করাটা অসম্ভব কিছু না, ফলে কিছুদূর পর্যন্ত তো বুঝতেই পারি। কিন্তু একই সাথে সেটা এত জটিলও যে, সবকিছু বুঝে ফেলার আশেপাশেও আমরা নাই। অনেক শ্বাসরুদ্ধকর আবিষ্কার এখনো বাকি আছে। এই দুনিয়াটা সবচেয়ে চমৎকার জায়গা।
ড্র্যুয়ান : সম্ভবপর শ্রেষ্ঠ মহাজগৎ।