পিঙ্ক ফ্লয়েড ইন্সাইড আউট :: পর্ব ২। শফিউল জয়
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ মে ২০১৭, ১০:২৫ পূর্বাহ্ণ, | ৩৪৭০ বার পঠিত
টাউন ম্যাগাজিনে আমাদের পারফর্মেন্সের বিবরণে উল্লেখ করা হয়, ‘কানের পর্দা চোখের মণি চূর্ণবিচূর্ণকারী’ হিশাবে এবং আইটির অনুষ্ঠানটাইনা কী অদ্ভুতুড়ে ফিল দেয়ার জন্যে শিহরণজাগানিয়া শব্দঅভিজ্ঞতা। এসব বের হওয়ার সাথে সাথেই মানুষজনের নামও বের হওয়া শুরু হয়। ইভেন্টটা অনেক মানুষ আর সেলেব্রিটিকে একত্র করসিলো। পল ম্যাকার্টনি, পিটার ব্র্যক, মিকেলেঞ্জেলো অ্যান্টনিওনি, মনিকা ভিটি। সফট মেশিনও পারফর্ম করে এবং তাদের পারফর্মেন্সের একপর্যায়ে গর্জনমুখর একটা বাইক আইসা ঢুইকা পড়ে স্টেইজে। অ্যামেরিকান গাড়িতে আঁকা পপ আর্ট, ভাগ্যগণনাকারী প্রকোষ্ঠ, অল্টারনেটিভ ফিল্ম শো— কী না ছিল এই আয়োজনে! আমাদের জন্যে সেই সময়কার তুলনায় সবচেয়ে বেশি শ্রোতা ছিল এই ইভেন্টটায়
আন্ডারগ্রাউন্ডযাত্রা :: দ্বিতীয় অধ্যায়
গ্রীষ্মের ছুটির পরে পিঙ্ক ফ্লয়েড সাউন্ডের সদস্যরা যখন লন্ডনে ফিরে আসে, পিটার জেনার তখনও আশায় আশায় বইসা আছে। স্ট্যানহোপ গার্ডেনে আইসা একদিন বলল, ‘তোমাদেরকে লেবেলে নিতে খুবই ভাল্লাগবে’। রজারের সোজাসাপ্টা উত্তর : কোন লেবেল-টেবেল না, আমাদের দরকার একজন ম্যানেজারের।
পিটারের আগ্রহ দেইখা ব্যান্ড নিয়ে আকাশকুসুম পরিকল্পনা আর চাওয়াপাওয়াগুলা মুহূর্তের মধ্যে মাথায় চইড়া বসে। যদিও ওর লাইগা থাকা নিয়ে আমরা কিছুটা বিস্মিত ছিলাম, কিন্তু যে যেভাবেই হোক সুযোগটাকে কাজে লাগানোর ইচ্ছায় রাজি হয়া যাই তৎক্ষণাৎ। পিটারের সঙ্গী অ্যান্ড্রু হইলো ব্যান্ড ম্যানেজার। অ্যান্ড্রুকে আমি না কী বলসিলাম- ‘কেউই আমাদের ম্যানেজার হইতে চায় না, সম্ভবত তুমিও…’ ওদের জয়েন করার মধ্য দিয়া নিয়মিত পয়সার বিনিময়ে কাজ, আশাভরসা আর ভালো কিছু সরঞ্জামের নিশ্চয়তাটা পাকাপোক্ত হয় অবশেষে।
ওয়েস্টমিনিস্টারের স্কুললাইফ থেকেই পিটার আর অ্যান্ড্রু একজন আরেকজনকে চিনত। ওদের দুইজনের বাবাই ভিকারস। ফাইনাল ইয়ারে উঠার আগেই অ্যান্ড্রুর বাবা লন্ডন থেকে চইলা আসে যাতে তার ছেলে ভালো একটা ক্রিশ্চান হোমে কিছু করতে পারে । তার ফলাফল হইতেছে অ্যান্ড্রুর সাথে পিটারের সেইন্ট জর্জ ভিকারেজের সাক্ষাৎ। পিটার অ্যান্ড্রুর থেকে এক বছর বড় হওয়ার কারণে স্কুলে কেউ কাউকে ভালোভাবে চিনত না। কিন্তু একই হাউজে থাকায় সমমনা চিন্তাভাবনার আদানপ্রদান ঘটছিল কিছুটা হইলেও। দুঃখের সাথে জানাইতেছি, সেই অপবিত্র মিত্রতা থেকে ব্যান্ড কোন ঐশ্বরিক পথ পাইছিল বলে আমার মনে হয় না। যাই হোক, অ্যান্ড্রুর মতে প্যাস্টরাল কেয়ারটা মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির জন্যে ভালো জিনিশ। ওর কথায় : ভিকারেজে প্রতি মুহূর্তে যে কোন কিছু বা যে কারো জন্যে প্রস্তুত থাকা ছাড়া রাস্তা নাই।
শরৎ আগে অক্সব্রিজ পরীক্ষার মাঝামাঝিতে অ্যান্ড্রু আর পিটার যাযকীয় কানেকশনে (এপিস্কপালিয়ান) স্টেইটসে যাওয়ার সুযোগ পায়, আর সাথে সাথে ইলিনয়ের পিকিং এ হুইস্কি পরিশোধনকারীর কাজ নেয় ছয় মাসের জন্য। ইলিনয়ের জায়গাটা উইকেন্ডে ওদের সহজেই শিকাগো শহরে যাওয়ার ব্যবস্থাটা করে দিছিল। এই সুবর্ণ সুযোগে ওরা প্রচুর ইলেক্ট্রিক ব্লুস, জ্যাজ আর গস্পেল মিউজিক শোনার কাজটাও সাইরা ফ্যালে নির্বিঘ্নে।
পরবর্তীতে পিটার ক্যাম্ব্রিজ আর অ্যান্ড্রু অক্সফোর্ডে পড়ার সময়েও পারস্পারিক যোগাযোগটা অক্ষুণ্ণ রাখসিল। পিটার যখন দেখাশোনার দায়িত্বটা নেয়, ও অ্যান্ড্রুকে সাহায্যের জন্যে ডাক দেয়। অবশ্য ডাকার আরেকটা কারণ ছিল— টাকা। এডুকেশন ট্রেনিং এর একটা কোম্পানিতে কাজ করত অ্যান্ড্রু। থার্মোডিন্যামিক্সের একটা যন্ত্রের প্রোগ্রাম করার পর (এটা নিয়ে আমার জ্ঞান খুবই ঝাপসা) অ্যান্ড্রু লোন আউট সিস্টেমে বিইএ এয়ারলাইন্সে কর্মীদের মোটিভেইট করার কাজে যোগ দেয়। মজার ব্যাপার হইতেছে, প্রত্যেকটা কোম্পানিই মনে করত অ্যান্ড্রু হয়তো অন্য কোন কোম্পানিতে কিছু করতেছে, কিন্তু আসলে সে থাকতো বিছানায়। কিংবা রিজলা পেপার দিয়ে অরিগ্যামি বানাইতো। এয়ারলাইন স্টাফ কিংবা অ্যান্ড্রু কেউই তেমন মোটিভেইটেড হইছিল বলে মনে হয় না। ফলে পিটারের আহ্বানটা একদিক থেকে ছিল আকর্ষণীয় প্রস্তাব।
পিটারের বর্ণনায়, ‘ সঙ্গী হিশেবে আমরা দুইজনে ভালো, একসাথে অনেক মিউজিক দেখসি। মনে হইলো, ‘ব্যান্ডটার দায়িত্ব নিলে ক্যামন হয়’’। অ্যান্ড্রু তখন চাকরী ছাইড়া বেকার , এবং ওর আশঙ্কা ছিল ভাদাইম্যা থাকাটা অভ্যাসই হয়া যায় নাকী। ফলে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া টাকা থেকে ব্ল্যাকহিল ফার্মের নাম অনুসারে ব্ল্যাকহিল এন্টারপ্রাইজ প্রতিষ্ঠা করে। এসব করার পর যা বাকী থাকে, সেটা খরচ করসিল তাঁদের বন্য জীবন আর পিঙ্ক ফ্লয়েড সাউন্ডের পেছনে।
গিগ করে এর আগে যা টাকা পাইছিলাম তার সব চলে গেছিল গিয়ারগুলো আপগ্রেইড করতে করতে। রজার একটা রিকেনব্যাকার বেজ কিনলো, আমিও জোড়াতালি দেয়া ড্রাম কিট বদলায়া প্রিমিয়ার ড্রাম কিট কিনি। ক্রিস ডেনিস তার পিএ নিয়ে চইলা যাওয়ার পর ভেন্যুগুলা যে রকম সাউন্ড সিস্টেম দিত সেগুলো নিয়ে শো করতেই বাধ্য থাকতাম। কিছু কিছু এত্ত খারাপ যে রেলস্টেশনের মাইক হাতে ঘোষকও সেটাকে বাজে সাউন্ড বলবে। চ্যারিং ক্রস রোড থেকে সেলমার পিএ সিস্টেম, গিটার অ্যাম্প আর একটা নতুন বেইজ গিটার কিনা দিয়া ব্ল্যাকহিল সবার অবস্থার উন্নতি করল অবশেষে।
পিটার ডিএনএ চালায়া যাওয়ার সাথে সাথে লেকচার দেয়া আর পিঙ্ক ফ্লয়েড সাউন্ড দেখাশোনার পরিকল্পনা করল, আর অ্যান্ড্রু শুধু আমাদেরকে নিয়েই ব্যস্ত হয়া পড়ে। কিন্তু পিটার যখন বুঝতে পারে ডিএনএ সুবিধা করতে পারবে না, অয় ও পিঙ্ক ফ্লয়েড সাউন্ডের উপর ভালোভাবে নজর দেয়া শুরু করে। ছুটা কাজের দিকে ওর ঝোঁক ব্যাপক, এবং যে কোন কাজ হাসিল করার একজন দক্ষ কূটনীতিক বলা যায় তারে। আণ্ডারগ্রাউন্ডে ওর লাইনঘাটও ভালো, নিজেরে ও দাবি করত এওয়ান বাকোয়াজ বইলা। অন্যদিকে অ্যান্ড্রু একটু শিথিল, খাবারের প্রতি ঝোঁকের কারণে যে কোন কিছু করতে পারতো। একবার একটা ভালো রাত কাটানোর পর স্ক্যাণ্ডিনেভিয়ান ট্যুরের সব টাকা সে গাপ করে দেয়। এই মিথ অস্বীকার করে সে দাবি করছিল- কিছু ভাংতি বের করতে গিয়া নাকী সব টাকা ড্রেইনে পড়ে গেছে। কিন্তু দাবিটা রজার ভিত্তিহীন বইলা উড়ায়া দেয়।
কাহিনী হইলো, ইলিনয়ে শিকাগো মিউজিকের খোঁজপাত্তা নিয়ে ধারণা রাখা ছাড়া দুইজনের মিউজিক ব্যবসা সম্পর্কে কিছুই জানতো না। আমরা তো আরও অবলা। ফলে তাঁদের যে কানেকশন, সেটা দিয়ে আরও ভালো লাইনঘাট বানানো এবং রেকর্ড কোম্পানিগুলার সাথে একটা আলোচনার আশা করতেছিলাম। আমরা অবশ্য রেকর্ড কোম্পানির সাথে কথা বলার রিস্কে যাই নাই। কারণ দেখা যাইতো রেকর্ড বের করার লোভে একেবারে পানির দামে রাজি হয়া গেছি। ফলে ওইটা পিটার অ্যান্ড্রুর কান্ধেই চাপায়া দেই।
কাজের সুযোগ আর ইন্সট্রুমেন্ট কিনে দেয়া ছাড়া জেনার-কিং আমাদের লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড সিনের সাথেও পরিচয় করায়া দেয়। লন্ডন ফ্রি স্কুল নামের প্রতিষ্ঠিত ধারার বিকল্প শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে কাজ করার কারণে পিটারের এইদিকটায় জানাশোনা ছিল ভালো। বইলা রাখা ভালো, ১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ড কিছু স্মরণীয় পরিবর্তন হওয়া শুরু করে। হ্যারল্ড উইলসনের লেবার সরকার তখন অবসিনিটি, ডিভোর্স, গর্ভপাত আর সমকামিতা নিয়ে আইন পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাইতেছিল। পিলও খুব সহজলভ্য হয়া ওঠে। জার্মেইন গ্রিয়ার এবং ক্যারোলিন কুনের (বিশ্বের প্রথম ফোনলাইন ড্রাগ এবং লিগ্যাল অ্যাডভাইজ সুবিধা দেয়া রিলিজের প্রতিষ্ঠাতা) মতো নারীদের সমতা, সমানাধিকার নিশ্চিত হওয়ার মাধ্যমে নারীমুক্তি খালি তত্ত্বকথায় মধ্যে আবদ্ধ না থাইকা ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হাওয়ায় মুখ দেখতে পায় শেষমেশ।
ওই সময়কার সাংস্কৃতিক পরিবর্তনও লক্ষণীয় ছিল। বিটলেস যাত্রার মধ্যে দিয়ে ব্রিটিশ ব্যান্ডগুলা ইন্টারন্যাশনাল মিউজিক সিনে প্রভাবশালী হয়া ওঠে এবং অ্যামেরিকান বিশাল বাজার তাদেরকে আপন কইরা নেয়। টনি ব্লেয়ারের ‘কুল ব্রিটানিয়া’ আদতে এটাকেই বলে সসম্ভবত। ইংলিশ ফ্যাশন, মডেলস, ফটোগ্রাফারদের বিকাশমান প্রতিপত্তির ভেতর দিয়া ম্যারি ক্যুয়ান্ট, ওজি ক্লার্ক , কার্ন্যাবি স্ট্রিট, বিবা, টুইগি, জিন শ্রিম্পটন, বেইলি ডনোভানের মতো নামগুলাও অগ্রযাত্রায় সামিল হইছিল। এমন কী ছেষট্টি সালে ইংলিশদের ফুটবল বিশ্বকাপ জয়ের ব্যাপারটাও সামগ্রিক পরিবর্তনে অবদান রাখে।
এসব বাদ দিয়া শিক্ষাক্ষেত্রও পিছায়া ছিল না কোন অংশে, হাতে হাত ধইরাই আগাইতেছিল। আর্ট স্কুলগুলা শুধু গ্রেইট ডিজাইনার আর ফটোগ্রাফার না- রে ডেভিস, কেইথ রিচার্ড, জন লেনন আর পিটার টাউনশেন্ডের মতো একঝাঁক প্রতিভাবান রক মিউজিশিয়ান প্রজন্মের জন্ম দেয়ার ভূমিকা পালন করসিল দুর্দান্তভাবে। ছাত্রদের গ্র্যান্ট বাড়ায়া দেয়ার ফলে টাকার জন্যে ভয়ংকর বেগার খাটার পরিমাণটা কইমা যায় এবং ক্যারিয়ারের নিয়ে দুশ্চিন্তার চাপটাও লঘু হয়া ওঠে। জবের প্রাচুর্যতার ফলে ইচ্ছামতো ক্যারিয়ার বাইছা নেয়ার সুযোগটা পাইতো সবাই। কিছুদিনের জন্যে ড্রপ আউট হয়া আবার ফিরা আসার ঘটনাটাও প্রাত্যহিক জীবনের অংশ হয়া ওঠে। ইনফ্যাক্ট, আমরা ট্যুমরোস ওয়ার্ল্ড দেইখা দেইখা ভাবতাম, রবোটটা যখন সব কাজ কইরা দিবে তখন কী করবো আমাদের অবসরে।
এমন টালমাটাল সময়ে একটা দলই তখনকার নব্য, সাহসী মধ্যবিত্তের কাতারে সামিল হওয়ার রাস্তায় হাঁটে নাই। সিক্সটিজের বিকল্প ধারার ভেতরে মূলধারার রাজনীতিকে উপেক্ষা করার একটা প্রবণতা ছিল । ফলে তেরো বছর পর সিক্সটিজের বিকল্প ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন মুখচোরা অন্য দলটা যখন আশির দশকে পূর্ণোদ্যমে ফিরা আইসা দেশের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে তুলে নেয় এবং হেলথ সার্ভিস, শিক্ষা, লাইব্রেরি এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক সংগঠনের বারোটা বাজায়া দেয় — ততক্ষণে বুঝতে অনেক দেরি হয়া গেছে।
ষাটের বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনে একটা বড় ধরণের আলোড়ন তৈরি হয় পঁয়ষট্টি সালে অ্যালবার্ট হলে অ্যালেন গিন্সবার্গ, লরেন্স ফার্লিংহেটি আর গ্রেগরি কর্সোর কবিতাপাঠের আয়োজনের মাধ্যমে। আয়োজকরা ধারণা করছিল কয়েকশো লোক হবে, কিন্তু দ্যাখা গেলো লোক আসছে সাড়ে সাত হাজার। তখনকার উঠতি বুদ্ধিজীবীদের আনাগোনা শুরু হয় ইন্ডিকা বুকশপকে কেন্দ্র কইরা। পিটার জেনার আর অ্যান্ড্রু কিঙের বাচ্চাকালের বন্ধু, জেন অ্যাশারের ভাই পিটার ইন্ডিকা বুকশপের জন্যে দোনামনা কইরা টাকা ঢালছিল কিছু। ইন্ডিকার প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে একজন হলো রিকের বন্ধু জন ডানবার এবং লেখক, সাংবাদিক মাইলস। সাউদাম্পটন রো’তে যাওয়ার আগে বুকশপটার সাথে একটা আর্ট গ্যালারি ছিল সেইন্ট জেমসের ম্যাসন ইয়ার্ডে। জায়গাটাকে বলা যায় নিরীক্ষাধর্মী সাহিত্যের তীর্থস্থান, অ্যামেরিকা থেকে নানা ধরণের কবি সাহিত্যিকের চিন্তাভাবনা এবং আদানপ্রদানের মাধ্যমে নিরীক্ষাকে উৎসাহিত করা হইতো। ইন্ডিকা নামটার উৎপত্তি উদ্ভিদবিদ্যার ‘ক্যানাবিস ইন্ডিকা’ থেকে, কিন্তু প্রচলিত ভার্সনে সবাই জানতো ইন্ডিকেশন থেকে ‘ইন্ডিকা’ নামটা আসছে। বেটার বুক্স নামের আরেকটা বুকশপে কবিতা পড়ার জন্যে অ্যান্ডি ওয়্যারহোল সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে আসছিল। এদের মধ্যে কেইট হেলিযারও ছিল। ওয়্যারহোলের কাউচ ফিল্মের স্টার হেলিযারই সর্বপ্রথম ইউকেতে ভেলভেট আন্ডারগ্রাউন্ডের টেইপ নিয়ে আসে।
দুইটা জায়গাই আমাদের ফাগস এবং মাদারস অফ ইনভেনশন — এর মতো অ্যাভান্ড-গার্দ অ্যামেরিকান রক মিউজিকের সাথে সংযোগ করায়া দেয়, যেটা অন্য কোনভাবে সম্ভব হইতো না। অনেক ব্যান্ডের ক্ষেত্রে এমন হইতো যে নামটা খুবই বিচিত্র, মনে করতাম হয়তো বিকল্পধারার কিছু হবে — কিন্তু শোনার পর দেখতাম খুবই গতানুগতিক। আবার কান্ট্রি জো, দ্যা ফিশ, বিগ ব্রাদার বা হোল্ডিং কোম্পানির মতো কিছু দলের মিউজিক শুনে মাঝেমাঝে তব্দা খায়া যাইতাম। কারণ মিউজিকের দিক থেকে এরা অ্যামেরিকান কান্ট্রি বা ব্লুজ মিউজিক প্রভাবিত, কিন্তু লিরিক্যাল কন্টেন্টে আপাদমস্তক আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যান্ড।
ইন্ডিকা বুকশপের সাথে যুক্ত অনেক লোকজন লন্ডন ফ্রি স্কুলে সহায়তা করতো। নটিংহিলে শিক্ষাব্যবস্থাকে কিছুটা চ্যালেঞ্জ জানায়াই ফ্রি স্কুলের সূচনা, যার উদ্যোক্তাদের মধ্যে অন্যতম পিটার জেনার। ন্যুইয়র্ক ফ্রি ইউনিভার্সিটির চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডের অন্যতম সঞ্চালক জন হপকিন্স (যাকে সবাই হপি হিশেবেই চিনে) এরকম স্কুলের সূচনা করেন। হপি ছিল সাচ্ছন্দ্য ক্যারিয়ার ছেড়ে আসা স্বেচ্ছা ‘ড্রপআউটদের’ মধ্যে একজন, যে ১৯৬০ সালে হ্যারওয়েল অ্যাটোমিক রিসার্চ এশটাব্লিশ্মেন্টের চাকরি ছেড়ে ফ্রিল্যান্স ফটোজার্নালিস্টের পেশা বেছে নিছিল)।
পিটারের ভাষ্যে : ‘দ্যা লন্ডন ফ্রি স্কুল জনসাধারণের জন্যে একটা বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থার প্রস্তাবনা। যদিও এটাকে মূলত ধৃষ্টতাপূর্ণ মধ্যবিত্ত প্রক্রিয়াই বলা চলে। আমরা সবাই প্রিভিলেজড ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসছিলাম, যারা সবাই সুশিক্ষিত- কিন্তু নিজেদের শিক্ষা নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলাম না। চোখে একপ্রকারের ঠুলি পরায়াই আমাদের শিক্ষা সম্পন্ন হইছিল’। মানুষজন যে শিক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, ফ্রি স্কুলের চিন্তা তার বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদের মতো। অন্যদেরকে শিখায়াও শিক্ষকদেরও অনেককিছু শেখার থাকে— এটা তুলে ধরার চেষ্টা করা হইতো। ফ্রি স্কুল চলে এক বছর, তারপর এর প্রিন্সিপালরা সবাই জার্নালিজম আর ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট নিয়া ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সেই সময়ের এলএফএস এবং সাইকাডেলিক মুভমেন্ট নটিংহ্যামের মাল্টিকালচারালিজমকে উৎসাহিত করছে কিছুটা। যুদ্ধোত্তর ইংল্যান্ডের একঘেয়ে অবস্থা নিয়ে কেউ সরব না হওয়াটা নিয়ে খেদ প্রকাশ করে পিটারের বক্তব্য: ‘ব্যাপারটা শোচনীয় আর সাইকাডেলিয়া তার বিপরীতে রঙিন এক জগত’।
নটিংহিলের ট্যাভিস্টকের এক পুরানা বাড়ির অন্দরে (ভাইঙা ফ্যালা হইছে এখন) লন্ডন ফ্রি স্কুলের জমায়েত অনুষ্ঠিত হইতো সাধারণত। বাড়ির মালিক রাউনি ল্যাসলেট নটিংহিল কার্নিভ্যালের প্রতিষ্ঠাতা। ফ্রি স্কুলকে টিকায়া রাখার জন্যে একদিকে টাকার দরকার, আবার সবাইকে খবর দিয়ে জানাইতেও হবে আন্ডারগ্রাউন্ডের নতুন ঠিকানাটা। পিটার আর অ্যান্ড্রু বুদ্ধি বের করলো- দুই উপায়ে পয়সা সংগ্রহ করা যায়। এক তাসের গ্যাদারিং, অথবা নাচ। কিন্তু প্রথমটা এরকম কাজের জন্যে ঠিক যুতসই না, ফলে পিঙ্ক ফ্লয়েড সাউন্ডের নাম দিয়া লোকাল চার্চ হলে (এটাও আর নাই এখন) একটা পপ ড্যান্সের আয়োজন করা হইলো। আমরা মার্ক্যি ক্লাবের জন্যে সিডের দেয়া নামটাই রাইখা দিলাম।
ব্যান্ডের ম্যানেজার যে চার্চহলে নিয়া গিয়া বাজাইতে বলবো — এইটা চিন্তায়ও আনি নাই কেউ। কিন্তু দ্যাখা গেল এটাই চরম একটা ভেন্যু, কারণ লন্ডন ডব্লিউ১১ নিজেরে ইতিমধ্যে বিকল্পধারার হাব হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হইতেছিল। সস্তা বাড়িভাড়া, মাল্টিকালচারাল বাসাবাড়ি, অবৈধ ড্রাগস, লন্ডন ফ্রি স্কুলের কার্যক্রম — সব মিলায়া সবার কাছে নটিং হিল তখন আকর্ষণীয় জায়গা। ড্রাগের ব্যাপারটা ডিল করার জন্যে পুলিশ বাড়াবাড়ি করতো অনেক। র্যাডিকাল বুদ্ধিজীবীদের জন্যে এধরণের কাণ্ডকারখানাকে অভাবনীয়ই বলা চলে : যেহেতু-কেননা এর আগে মধ্যবিত্তরা কখনো আইনের অন্ধকার দিক নিয়া সজাগ হওয়ার দরকার মনে করে নাই নিজেদের।
উঁচা সিলিং, কাঠের ফ্লোর আর ডায়াসে সাজানো অল সেইন্টস হলকে দেইখা অন্য কোন চার্চের মতোই মনে হওয়া স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু এমন একটা ইভেন্টের পর পুরা আমেজটাই বদলে যায় চোখের সামনে থেকে। শ্রোতারা যারা আসছিল তারাও আরএনবি কিংবা টপ অফ দ্যা পপ শোনা পাব্লিক না। ছাত্র থেকে ড্রপআউট আর কিম্ভুত লোকাল হিপিরা সব একত্র হয়া ফ্লোরে বইসা কিংবা ঘুরাঘুরি কইরা হাত নাড়াইতো আর গান শুনত। কেউ কেউ অবশ্য কোন পূর্ব ধারণা বা কোন প্রত্যাশা ছাড়াই আসতো। বেশিরভাগ শ্রোতাকেই দ্যাখা যাইতো ক্যেমিক্যালি অল্টার্ড স্টেইটে গিয়া মামুলি একটা কাজকে খুব গুরুত্বের সাথে করতেছে। কিন্তু তাদের সমালোচনাহীন পজিটিভ সাড়ার প্রভাব আমাদের উপর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। ফলে মুখস্ত কোন কিছু বাজানো বাদ দিয়ে দীর্ঘ ইম্প্রোভাইজেশনের উপর জোর দেয়ার উৎসাহ পায়া যাই আস্তে আস্তে।
দ্যাখা গেলো, অল সেইন্টের শো’গুলাতে লাইট শো খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় আবির্ভূত হইছে। ইভেন্টগুলাকে ধরে নেয়া হইতো একেকটা ‘ঘটনা’ হিশাবে এবং যে কেউ যেইভাবে খুশি অংশগ্রহণ করতে পারতো। জোয়েল এবং টনি ব্রাউন নামের এক অ্যামেরিকান কাপল কিছু স্লাইড প্রোজেক্ট করছিল কয়েকদিন, সেটাতে অভিভূত হয়া তারা চলে যাওয়ার পর অ্যান্ড্রু, পিটার আর তার স্ত্রী একই ধরণের কিছু বানানোর চেষ্টায় মগ্ন হয়। বাজেট আর থিয়েটার লাইটিং এর অদক্ষতার কথা চিন্তা কইরা ওরা পেশাদার লাইটিং কোম্পানির কাছে গেছিল না, তার বদলে লোকাল ইলেক্ট্রিক্যাল স্টোরে গিয়া কিছু ঘরোয়া স্পটলাইট, সাধারণ সুইচ, জেল, ড্রয়িং পিন নিয়া ফেরত আসে। তক্তার উপরে লাইটিং ইন্সট্রুমেন্টগুলা ঝুলায়া বিদ্যুতের সাথে সংযোগ দেয়া হয় কাজ চালানোর জন্যে, আর সুইচ অন-অফ করা হইতো হাত দিয়া। এগুলা খুবই ঠ্যাকায় পড়া জিনিশপত্র বলে মনে হইতে পারে, কিন্তু তখনকার জন্যে ছিল মোটামুটি বৈপ্লবিক। কারণ অন্য কোন ব্যান্ডের মধ্যে এই ধরণের স্টেইজ ইল্যুমিনেশনের বালাই দ্যাখা যায় নাই।
বাইশ অক্টোবর ১৯৬৬ সালের মেলোডি মেকারের রিপোর্ট থেকে পিঙ্ক ফ্লয়েড সাউন্ডের সেই সময়ের টিপিক্যাল পারফর্মেন্সের একটা চিত্র পাওয়া যায় : ‘স্লাইডগুলা ছিল অসাধারণ। রঙিন, ভয়ার্ত, উদ্ভট, সুন্দর — সব বিশেষণই অল সেইন্টস হলের শীতল বাস্তবতার কাছে নস্যি। ‘লুই লুই’ গানের সাইক্যাডেলিক ভার্সন হয়তো আসবে না। কিন্তু পুরানা আরএনবি ধারা থেকে বের হয়ে যদি তাদের ইলেকট্রনিক দক্ষতা, সুরেলা আর লিরিক্যাল গানের সমন্বয় করতে পারে — তাহলে অদূর ভবিষ্যতে ভালো কিছু করা এদের পক্ষে সম্ভব’।
স্টেজে উঠে আমরা সাধারণত আরএনবি আর সিডের কিছু গান বাজাইতাম, যেগুলা পরবর্তীতে প্রথম অ্যালবামের ভিত্তিটা কইরা দেয়। আরএনবি ঘরানায় দীর্ঘসময় ধরে বড় করে বাজানো হইতো অনেককিছু। বু ডিডলির ‘ক্যান্ট জাজ অ্যা বুক’ অথবা সিডের প্রিয় চাক বেরির গান ‘মোটিভেটিং’ এর পরেই সরাসরি ‘ইন্টারস্টেলার ওভারড্রাইভ’— বাজানো শুরু করে দিতাম। এই গানটা দিয়াই সচরাচর শো’গুলার ওপেনিং করা হইতো।
একাধারে গিগ করার ফলে আমরা একটা নিয়মিত শ্রোতার দল পাওয়া শুরু করি, যেটা নিজেদের ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ পরিচয়টাকে ক্রমশ পাকাপোক্ত করে দেয়। কিন্তু আমার মতে, আমাদের মধ্যে কেউই আন্ডারগ্রাউন্ড মুভমেন্টের তাৎপর্যটা তখনো উপলব্ধি করি নাই। আন্ডারগ্রাউন্ডের উদ্দেশ্যের প্রতি সমর্থন পোষণ করতাম, কিন্তু নিজেদেরকে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী বলে দাবি করতাম বলে মনে পড়ে না। হপি, রাউনি ল্যাসলেট আর ব্ল্যাক অ্যাক্টিভিস্ট মাইকেল এক্সের মতো নানা ধরণের মানুষের সঙ্গ উপভোগ করতাম, তবে প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মিউজিক বিজনেস আর নতুন একটা পিএ সিস্টেম করা। মাগনা নিউজপেপারের আদর্শের প্রতি কারোরই তেমন উৎসাহ থাকার কথা না।
যাই হোক, এরপরে অল সেইন্টস হলের টাকা দিয়া ফ্রি স্কুল পত্রিকা বের করা শুরু করে। ইন্টারন্যাশনাল টাইমস নামের পত্রিকাটা লন্ডনের নানা খবরাখবরের সামগ্রিক একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করতো। এর মডেল ছিল ন্যু-ইয়র্ক ভিলেজ ভয়েস, যেইখানে আর্ট রিভিউ, অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপানো হইতো এবং মূলত উদারনৈতিকতাবাদী আর র্যাডিক্যালদের মুখপাত্র নিজেদের পরিচয়টা দাড়া করাইছিল। প্রথম সংখ্যাটার দাম এক শিলং নির্ধারণ করে প্রায় পনেরো হাজার কপি ছাপায়া অল্টারনেটিভ আউটলেটে বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়। এরজন্যে আইটি একটা শুরুয়াদি পার্টির আয়োজন করে চক ফার্মের রাউন্ডহাউজে। সময়টা নির্ধারিত হয় ঠাণ্ডা কোন এক অক্টোবরের রাতে।
রাউন্ডহাউজটা মূলত নির্মাণ করা হইছিল স্টিম ইঞ্জিনের পরিদর্শন ইয়ার্ড হিশাবে, ১৮৪০ সালে। কিন্তু ইয়ার্ড আর এর টার্নটেবল পনেরো বছরের মধ্যেই বাতিল হয়া যায় ইঞ্জিনের আয়তন বড় হয়া যাওয়ার কারণে। ডিস্টিলার গিলবি এটাকে ওয়্যারহাউজ হিশাবেও ব্যবহার করসে, কিন্তু ১৯৬০ সালের পর থেকে জায়গাটার ভগ্নদশা। লঞ্চিং পার্টির জন্যে আমাদের তখনকার রোড ক্রু এক শিল্পী ভাড়া কইরা ট্রান্সিট ভ্যানের পেছনটা বিশাল বিশাল জেলিফিশের আকৃতি জিনিশ দিয়া ভরায়া ফ্যালে।। কিন্তু তাতে সামগ্রিক সাজসজ্জার কোন উন্নতি হইসিল বলে মনে পড়ে না। স্টেইজ বইলা কিছু করা হয় নাই, একটা পুরানা মালগাড়িমতন বস্তুকে প্ল্যাটফর্ম বানাইয়া কাজ চালানো হইলো। আমাদের ইন্সট্রুমেন্ট, অ্যাম্পস আর লাইট শোয়ের জন্যে বরাদ্দ একটা ১৩-অ্যাম্প লিড, যেইটা দিয়া একটা পুরানা রান্নাঘর হইতো টাইনা টুইনা চালানো সম্ভব। ফলে আলোকসজ্জা ছিল ভুতুড়ে, টর্চ আর মোমবাতি দিয়া ঠেকার কাজ চালানো ছাড়া উপায় ছিল না। ফলত পাওয়ার সাপ্লাই চইলা যাওয়ার অবশ্যম্ভাবী ব্রেইকগুলা অনুষ্ঠানের নানা অংশের বিরতি ধরে কাজ চালাইছিলাম।
রাউন্ডহাউজের আলোকসজ্জাও ছিল সংক্ষিপ্ত। অ্যান্ড্রু আর পিটারের হাতে বানানো জিনিশপত্র দিয়েই আলোকসজ্জার পার্ট চুকাইসিলাম। যে প্রজেক্টর ব্যবহার করসিলাম সেটা সাধারণত বাসাবাড়িতে গ্রীষ্মের ছুটির স্ন্যাপ দ্যাখার জন্যে ব্যবহার করা হইতো — তেল, পানি, কালি আর কেমিক্যাল তাপ দিয়ে স্লাইডগুলা দেখানোর ব্যবস্থা আর কী। খেয়াল রাখতে হইতো যাতে বেশি তাপ না দেয়া হয়, আর তা না তাইলে গ্লাসে ফাটল ধরবে, কালি ছড়াইয়া যাবে এবং আগুন ধরার সম্ভাবনাও কম বলা চলে না। এসবের কারণে আমাদের টেকনিশিয়াদের হাতের ফোস্কা দেইখা সহজেই আলাদা করে ফ্যালা যাইতো তাদের।
আইটি লঞ্চের অনুষ্ঠানটাকে সাফল্যই বলা চলে। টাউন ম্যাগাজিনে আমাদের পারফর্মেন্সের বিবরণে উল্লেখ করা হয়, ‘কানের পর্দা চোখের মণি চূর্ণবিচূর্ণকারী’ হিশাবে এবং আইটির অনুষ্ঠানটাইনা কী অদ্ভুতুড়ে ফিল দেয়ার জন্যে শিহরণজাগানিয়া শব্দঅভিজ্ঞতা। এসব বের হওয়ার সাথে সাথেই মানুষজনের নামও বের হওয়া শুরু হয়। ইভেন্টটা অনেক মানুষ আর সেলেব্রিটিকে একত্র করসিলো। পল ম্যাকার্টনি, পিটার ব্র্যক, মিকেলেঞ্জেলো অ্যান্টনিওনি, মনিকা ভিটি। সফট মেশিনও পারফর্ম করে এবং তাদের পারফর্মেন্সের একপর্যায়ে গর্জনমুখর একটা বাইক আইসা ঢুইকা পড়ে স্টেইজে। অ্যামেরিকান গাড়িতে আঁকা পপ আর্ট, ভাগ্যগণনাকারী প্রকোষ্ঠ, অল্টারনেটিভ ফিল্ম শো— কী না ছিল এই আয়োজনে! আমাদের জন্যে সেই সময়কার তুলনায় সবচেয়ে বেশি শ্রোতা ছিল এই ইভেন্টটায়।
এই অনুষ্ঠানের পর আমরা শ্রোতাদের সাথে বেশ ভালো সময় ব্যয় করি তাদের অভিজ্ঞতা কেমন হইলো তা জানার জন্যে, কিন্তু এটাই শেষবারের মতো জানার চেষ্টা করা। কারণ এরপর থেকেই আমরা নিজেরা নিজেরা ব্যান্ড ড্রেসিং রুমের কালচারের ঢুইকা যাই। মনে পড়ে ওই সময় আমরা যথেষ্ট সময় ব্যয় করতাম চুল বাকা করা, ব্যাকব্রাশ করা, হেভি মেইকাপ দেয়াদিয়ি নিয়া। আমাদের চিন্তাভাবনার বড় অংশ দখল কইরা রাখছিল পপস্টারদের দেখতে কেমন হওয়া উচিত এই ব্যাপারটা। দ্যাখা যাইতো, ওয়ারড্রবের বাজেটে সামগ্রিক বাজেটের একটা বড় অংশ পাচার হয়া যাইতো। অবশ্য বছরখানেক পর থেকে ক্যাজুয়াল টি-শার্ট পরাটাই চল হয়া ওঠে, আর বাজেট কমানোর ব্যাপারটাও মাথায় ছিল। কিন্তু তখনকার জন্যে সাটিন শার্ট, ভেলভেট লুন প্যান্ট, স্কার্ফ, হাই হিল্ড গহিল বুটস পরা ছিল একপ্রকারের ফরজ।
অক্টোবরের শেষে পিটার আর অ্যান্ড্রুর সাথে চুক্তিটা আনুষ্ঠানিক করে ফেলি ব্ল্যাকহিল এন্টারপ্রাইজের অংশীদার হয়া। আমরা ছয়জনের পারহেড অংশীদারি এক ষষ্ঠাংশ করে, অর্থাৎ ব্ল্যাকহিল এন্টারপ্রাইজের যে-কোন লাভ লোকসানের সাথে আমাদেরকে জড়ায়া নিলাম। অ্যান্ড্রু এবং পিটার তো ব্ল্যাকহিল নিয়া দূরদর্শী এন্টারটেইনমেন্ট সাম্রাজ্যের স্বপ্নে বিভোর তখন। পিটারের ভাষ্যমতে চুক্তিটা খুবই সময়োপযোগী ‘একেবারে আসল হিপিদের মতো’ আর অ্যান্ড্রুর মতে ‘একটা কোমল ভাবনা’।
আক্ষরিক অর্থেই ব্ল্যাকহিল দোকান দিয়ে বসে- বেইজওয়াটারের ৩২ আলেকজান্ডার স্ট্রিটের একটা জায়গায় উপরে ফ্ল্যাট আর নিচে একটা ফ্রন্টশপ। অ্যান্ড্রুর গার্লফ্রেন্ড ওয়েন্ডির লিজ নেয়া ছিল জায়গাটা, যেটা পরে স্টিফ রেকর্ডের অরিজিনাল হেডকোয়ার্টার হয়া আত্মপ্রকাশ করে। রজার, রিক, সিড আর অ্যান্ড্রু সবাই উপরের ওই ফ্ল্যাটে থাকছে কোন না কোন সময়। আমাদের আদি লাইটিং ম্যান জো গ্যানোনও থাকছে ওইখানে। জো গ্যানোন পরবর্তীতে একজন সফল ইউএসবেইজড পরিচালক, প্রযোজক এবং লাইটিং ডিরেক্টর হিশাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। অ্যালিস কুপারের সাথে ওর জুটি তো প্রবাদপ্রতিম। খুব দ্রুতই জায়গাটা মুখর হয়া গেল। এটা ব্যান্ডের বসার জায়গা আর স্টোরেজ হিশাবে ব্যবহার করা হইতো, বাকিটা অফিস। পুরা এলোমেলোভাবটা লাইনে আইসা পড়ে যখন জুন চাইল্ড আমাদের সেক্রেটারি, অ্যাসিস্ট্যান্ট রোড ম্যানেজার, ড্রাইভার আর পিএ হয়ে যোগ দেয়। সে ছিল দলের অমূল্য সদস্য ওর বদৌলতেই প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক রুপটাকে স্পষ্ট হয়া ওঠে। ও পরে ব্ল্যাকহিল আর্টিস্টের আরেক সদস্য মার্ক বোলানকে বিয়ে করে।
সফট মেশিনের রবার্ট ওয়েট ব্ল্যাকহিলের দিনগুলাকে মনে করসে এইভাবে, ‘ওরা আগাগোড়া একদল চমৎকার মানুষ। খুবই আন্তরিক, এমন কী ম্যানেজারের কাঠিন্যের ব্যাপারটাও তাদের মধ্যে ওইভাবে লক্ষণীয় বলা যায় না। যাদের জন্যে কাজ করতো, তাদের দেখভাল করতো খুব। আমাদের ভাগ্য অতোটা ভালো ছিল না’। যেহেতু আমরা ট্রেডিশনাল পপ মিউজিকের বাইরে কিছু করতে চাচ্ছিলাম, তাই সফট মেশিনের মতো গুটিকিয়েক ব্যাণ্ডের সাথেই পরিচয় সীমাবদ্ধ থাকা স্বাভাবিক। পৌইস গার্ডেন কিংবা রাউন্ডহাউজের ঘটনাগুলা ঠিক ট্রেডিশনাল বলা চলে না ‘প্রাপ্য দেয়ার জন্যে’।
অ্যান্ড্রু আর পিটারের সাংগঠনিক অদক্ষতার কথা বাদ দিলে এটা স্বীকার করতেই হবে যে নতুন ব্যান্ড আবিষ্কার করাতে ছিল তাদের অসাধারণ দখল। একমাত্র পিঙ্ক ফ্লয়েডকেই তারা শুধু তুইলা নিয়া আসে নাই, এডগ্যার ব্রাউটন, রয় হার্পার, মার্ক বোলান অ্যান্ড টায়রানোসোরাস রেক্স এবং স্ল্যাপ হ্যাপি, থার্ড এয়ার ব্যান্ডকেও তারা পরিচয় করায়া দিছে সবার কাছে।
ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক প্রোমোটার ক্রিস্টফার হান্টের সাথে ওদের কানেকশনই বইলা দেয় ওরা কীভাবে আমাদের জন্যে ভালো বার্তা নিয়ে আসছিল। গৎবাঁধা ক্লাব আর ভেন্যুর যে চক্র, সেটা বাদ দিয়া পিটার আর অ্যান্ড্রু চেষ্টা করতেসিল নতুন কোন জায়গায় ওদের অল্টারনেটিভ ব্যান্ডগুলাকে প্রমোট করার। পিটারের স্ত্রী সুমি তখন ক্রিস্টফারের সেক্রেটারি। ও কমনওয়েলথ ইন্সটিট্যুটের মতো নয়নাভিরাম জায়গায় একটা শো’য়ের ব্যবস্থা করসিল যেখানে মূলত রবিশংকরের মত অন্যান্য ভিনদেশি শিল্পীদের অনুষ্ঠান আয়োজন করার চল শুরু হইসিল কিছুদিন ধরে। সেক্ষেত্রে আমাদের দরকার একজন ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক প্রোমোটার যে আমাদের জন্যে সুপারিশ করবে, কারণ তা না হইলে কর্তৃপক্ষ ভাবতে বাধ্য যে আমরা আইসা একটা দাঙ্গা লাগায়া দিবো। আমি নিশ্চিত তারা এখনো মনে করে ‘রক’ মিউজিক হইতেসে ড্রেইনপাইপ ট্রাউজার, টেডি বয়েজ আর বিল হ্যালের সাথে সম্পৃক্ত কিছু একটা।
এই শো’টা করা আরেকজনের খাতিরে সহজ হইসিলো, যার নাম না বললেই না — জোনাথান ফেনবি। জোনাথান ফেনবি পিঙ্ক ফ্লয়েডের প্রথম প্রেস রিলিজটাও লিখে দেয় পরে। তৎকালীন রয়টার্সে কাজ করার সুবাদে ও জানতো প্রেস কোনটা পছন্দ করবে আর কোনটা করবে না। পরবর্তীতে ও অবজার্ভার এবং সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের সম্পাদক হইসিলো। লেখক হিশাবেও ছিল সুপরিচিত। জোনাথানের মাধ্যমে আমরা বেশ ভালো কিছু প্রেস কাভারেজ পাইতে সক্ষম হই। সর্বপ্রথমটা বের হয় ফিন্যানশিয়াল টাইমসে, ১৯৬৬ সালে। হান্টার ডেভিসের কলামে অ্যান্ড্রু আর রজারকে উদ্ধৃত করে লেখাটায় বলা হয়—’ তুমি যদি এলএসডি নাও, তাহলে তোমার অভিজ্ঞতা কী হবে সেটা সম্পূর্ণ নির্ভর করে তুমি কে তার উপরে। আমাদের মিউজিক তোমাকে তীব্র আর্তনাদ কিংবা তীব্র সুখানুভূতি দিতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরেরটা হয়। আমাদের শ্রোতারা নাচে না, তারা হা হয়ে গ্রুভের ভেতর বিকীর্ণ হয়া যায়।’ এটা শুনে হান্টার ডেভিসের উত্তর সংক্ষিপ্ত, ‘হুম’। হান্টার পরে ১৯৬৮ সালে বিটলসেরর জীবনী লেখে নাম কামায় এবং একজন সফল পপ অবজার্ভার হিশাবে আত্মপ্রকাশ করে।
আমরা এই সময়ে টানা ওয়ান-অফ অ্যাপিয়ারেন্স করা শুরু করি। গিগ বলতে যা বুঝায় এগুলাকে তা বলা যায় না, বরং ব্যক্তিগত ইভেন্টই ছিল বেশি । মৌখিক আমন্ত্রণেই আমরা ব্লেচলি, ক্যান্টাব্যারি, লন্ডনের নানা জায়গায়, হর্ন্সে আর্ট কলেজ আর অল সেইন্টসের মতো ভেন্যুতে পারফর্ম করা হয় কিছু এই সময়। রাউন্ডহাউজের কয়েকটা ফলো আপ ইভেন্ট হয় ‘সাইকোডেলফিয়া বনাম ইয়ান স্মিথ’ নাম দিয়া, যেইখানে ঘোষণা দেয়া হইছিল, ‘সর্ব রকমের পাগলামি আমন্ত্রিত। যার যা মজমাদার জিনিশপত্র আছে নিয়া হাজির হয়া পড়ো।’ কিন্তু এইসবের কোনটাই আইটি লঞ্চিং-এর ওই আমেজটার মতো কিছু হয় নাই।
অন্যান্য ভেন্যুগুলাতে বাজাইয়া যে খুব আনন্দের অভিজ্ঞতার ত ভেতর দিয়া গেছি তা বলা যায় না। একবার এক ক্যাথোলিক ইয়ুথ ক্লাবে বাজানোর পর তারা টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানায়, কারণ আমরা না কী যা বাজাইছি তাকে কোনক্রমেই মিউজিক বলা যায় না। অ্যান্ড্রু এবং পিটার স্মল ক্লেইমস কোর্ট গিয়া নালিশ করলে অবিশ্বাস্যভাবে হাইরা যাই এবং ক্লাব ম্যানেজারের সাথে একমত হয়ে ম্যাজিস্ট্রেইট বলছিল আমাদেরটা না কী আসলেই মিউজিক হয় না। অ্যালবার্ট হলের অক্সফ্যাম বেনিফিটের এক শো’তে আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলা হইসিল, ‘ইয়ার্কি করো মিয়ারা?’ উপরে ওই শোতে পিটার কুক, ডুডলে মুর, ক্রিস ফার্লো আর অ্যালান প্রাইস সেট বাজায় এবং প্রায় হাজার পাঁচেক মানুষ সমাবেত ছিল সেইখানে। অ্যালান প্রাইস আমাদের দিকে তাকাইয়া অট্টহাসি দিয়া হ্যামন্ড অর্গানের রিভার্বে মৃদু টোকা দিয়া বলসিলো — ‘এটাই সাইকাডেলিক মিউজিক’। ওই সময়ে খুব মর্মাহত হয়া পড়ি, কারণ শ্রোতার সারিতে আমাদের মা’রাও ছিল। এবং কোন মাত্রার ক্রোধই যথেষ্ট মনে হয় নাই সেই মুহূর্তে।
ডিসেম্বরে আমরা আবার মার্ক্যি ক্লাবে ফিরা আসি, কিন্তু ততদিনে একধরণের অস্বস্তিকর সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে ক্লাব আর শ্রোতাদের সাথে। ম্যানেজার জন গী’র জ্যাজ ব্যাকগ্রাউনন্ডের কারণে সে খুব সন্তুষ্ট ছিল না ক্লাব যে ধরণের মিউজিক হোস্ট করতেছিল সেসব নিয়ে। দুই একটা বদখত ব্যান্ডের সাথে বাজে অভিজ্ঞতার পর তার অপছন্দের তালিকায় জুয়াড়ি আর ব্যান্ডের মধ্যে কোন তফাৎ সে করে নাই। আমাদের আজব সাউন্ড আর হাস্যকর লাইট আর অ্যামেচার মিউজিশিয়ানশিপও তার ভালো লাগার কোন সঙ্গত কারণ দাড়া করাইতে পারে নাই নিশ্চিতভাবেই।
কিন্তু তার থেকেও দুঃখের বিষয় হচ্ছে, মার্ক্যি এর শ্রোতারাও এই ধরণের মনোভাব লালন করতো। ১৯৫৮ সালে জ্যাজ ক্লাব হিশাবে এটা খোলা হয়, কিন্তু ধীরে ধীরে ক্লাবটা ব্রিটিশ আরএনবি’র সহায়ক হিশাবে কাজ করছে। পছন্দ না করলেও জ্যাজপ্রেমীরা যে আরএনবিকে খুব ভালো চোখ দেখতো তা না, কারণ এদের অনেকেই সেসন প্লেয়ার হিশাবে জীবিকা অর্জন করতো এবং আস্তে আস্তে সেটা কমে আসে শুরু করে। তারপরেও ক্লাবটা ব্রিটিশ আরএনবির কেন্দ্রবিন্দু ছিল। যদিও কিছুদিন আমরা বাজাইসিলাম এখানে, কিন্তু শেষপর্যন্ত মুখোমুখি দাঁড়ায়া পড়তে হইলো।
মার্ক্যিকে বলা যায় একটা খাঁটি মিউজিক ক্লাব। কমদামি সুগন্ধীর গন্ধে ছোট্ট ড্রেসিং রুমটা সবসময় ভুরভুর করতো। আর একটা সফল রাত্রের শেষে স্টুডেন্ট পার্টির মতো উত্তেজনা বিরাজ করতো চারদিকে। এটা ছাড়া এইখানে বসার জন্যে পেছনের বারই ভালো বলা যায়, যেইখানে আগতদের জন্যে প্ল্যাস্টিকের বোতলে সারি সারি মদিরার বোতল সাজায়া রাখা ছিল। মনে হইতে পারতো কেউ চুবচুবা ভিজা যাবে কিন্তু স্টেইজের ওইখান থেকে সরে না আসলে ধাক্কাধাক্কিতে চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
সৌভাগ্যক্রমে একটা ক্লাব ছিল যেটা হয়তো সৃষ্টিই হইসিলো আমাদের জন্যে। ইউএফও- সংক্ষেপে উচ্চারণ করা হইতো ‘ইউ-ফো’— আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্রিক আউট। ইন্ডিকা যদি আন্ডারগ্রাউন্ডের হাই স্ট্রিট শপ হয়া থাকে, লন্ডন ফ্রি স্কুল যদি শিক্ষাব্যবস্থা, আইটি ফ্লিট স্ট্রিট-তাহলে ইউএফও বলা যায় এর প্লেগ্রাউন্ড। জো বয়ড আর জন হপকিন্স এই ক্লাবের যাত্রা শুরু করে। জো ছিল হার্ভার্ড গ্র্যাজুয়েট মিউজিক ফ্রিক যে কী না ব্লুজ অ্যান্ড গসপেল ক্যারাভানের সাথে ১৯৬৪ সালে প্রথম ইংল্যান্ডে আসে ট্যুর ম্যানেজার হিশাবে। হপি ক্যারাভানের ছবি তুলতে গেলে ওদের দুইজনের দেখা হ্য। জো যখন পরবর্তীতে ইলেক্ট্রা রেকর্ডসের এ&আর হিশাবে ব্যাক করে, লন্ডনের আন্ডারগ্রাউন্ড মুভমেন্টের অগ্রগতি দেইখা সে খুব খুশি হয়া যায়।
১৯৬৫’র শরতে সে লন্ডনে ফিরে আসার সাথে সাথেই লন্ডন ফ্রি স্কুলের প্রথম মিটিঙে যোগ দেয় এবং একবছরের মধ্যেই একটা নাইটক্লাব খোলার পরিকল্পনা করে। টটেনহ্যামের ব্লার্নি ক্লাবের একটা আইরিশ ড্যান্স হলকে ভেন্যু সিলেক্ট করা হয়। ড্যান্সহলটা পরী, ফুল, লতাপাতা দিয়া সজ্জিত অবস্থায় পাওয়া গেছিল। পুলিশ স্টেশনের অদূরেই ক্লাবটা আর এর নিচে দুইটা সিনেমা হল — তার মানে দাঁড়াচ্ছে রাত দশটার আগে শো শুরু করা যাবে না সিনেমা শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত। ছেষট্টির তেইশ ডিসেম্বর ইউএফও উদ্বোধন করা হয় এবং উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আমরাই বাজাইছিলাম। তারপর প্রতি শুক্রবার সকাল আটটা পর্যন্ত ক্লাবে বাজানো শুরু কইরা দেই।
ইউএফও আমাদের ক্যারিয়ারে আরেকটা নতুন মাত্রা যোগ করে। যদিও এটা প্রতিষ্ঠিত কোন ক্লাব না তখন, কিন্তু লন্ডনের পশ্চিম অংশে থাকার কারণে লোকজনের সমাবেশ হইতো যারা আমাদের পছন্দ করতো এবং তারা জানতো আমাদের কাছে কী প্রত্যাশা করা যায়। অনেক লোকের সামনে বাজানোয় অভ্যস্ত ছিলাম আমরা আগে থেকেই এবং প্রতি সপ্তাহের এই দিনটায় তাই বাজানোর জন্যে অপেক্ষা করতাম। যে ভয়টা নিয়ে এতদিন লন্ডনের বিভিন্ন জায়গায় ঘুইরা বেড়াইছি সেই ভয়টা আর কাজ করতো না, কারণ জানতাম শ্রোতার একটা দল আছে এইখানে। প্রায়ই ব্যান্ড রুম থেকে বের হয়ে মানুষজনদের দেখতে বের হইতাম — সফট মেশিন প্রায়ই আসতো, থিয়েটার গ্রুপও আস্তো, কবিতা আবৃত্ত, পার্ফর্মেন্স আর্টও চলতো। মানুষজনের শুভকামনা পাইতাম যেটা অন্য জায়গায় খুব মিস করতাম। ইউএফও ছিল সেগুলার জন্যে একেবারে অভিযানের খাঁটি জায়গা।
ইউএফও নিয়ে জুন চাইল্ডের ভাষায় বলতে গেলে, ‘পুরো বাতাবরণের জন্যে লোকজন জায়গাটাকে ভালোবাসতো। অন্ধকারময়, একটা দীর্ঘ চিলেকোঠার মতো। ছোট্ট একটা স্টেইজ এবং সম্ভবত এসি৩০ স্পিকার, আর লাইটিঙের জিনিশপত্তর।’ লাইটিং এর জিনিশপত্র ডেকোরেটরের স্ক্যাফোল্ডিং টাওয়ারের মধ্যে সেট করা ছিল।
গ্রুপি উপন্যাসের লেখক জেনি ফ্যাবিয়ানের বয়ানে (আমাদের হাল্কা উপস্থিতি আছে উপন্যাসটায়, যদিও ছদ্মবেশে), ইউএফওর একটা টিপিক্যাল রাতের বর্ণনা, ‘সবচেয়ে ভালো জিনিশ ছিল যখন শুক্রবারে আমরা পুরানা দিনের ফিল্ম স্টারের সাজে এসিড নিয়ে পিঙ্ক ফ্লয়েডের শো শুনতে যাইতাম। হাতে হাওয়াই মিঠাই নিয়ে একই রকমের মানুষদের সাথে ঘুইরা বেড়ানোর মজাই আলাদা। ওরা ছিল এসিড কনশাসনেসের প্রথম নির্ভেজাল সাউন্ড। আমি সোজা ফ্লোরে শুয়ে পড়তাম, আর ওরা গার্গয়েলের বেশ নিয়ে স্টেইজে উঠে দুনিয়ার বাইরের কিছু একটা বাজাইতো। যে রঙগুলা ওদের উপরে ফাইটা পড়ত, আমরাও সেই রঙে চূর্ণ হয়া যাইতাম। শরীর আর আত্মার সম্পূর্ণ সমর্পণ হইতো এরকম অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়া’।
আমাদের মতো ইউএফও’ও নিজস্ব লাইট শো রাখতো (ব্যান্ড হিশাবে শুধু আমাদেরই ছিল)। রবার্টের বয়ানে ইউএফও’র লাইটিং ম্যান মার্ক বয়াল না কী লাইটের কাজ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে গিয়ে নানারঙের এসিডে নিজেকে জ্বালায়া দিতো। ওকে দ্যাখা যাইতো চোখে গগলস দিয়া হাই হয়ে কাজ করতেছে। জ্যাক ব্র্যাসেলিন নামের পঞ্চাশ বছর বয়সী একজন লোক আবহওয়া খারাপ থাকলে এক কোণায় গিয়া নিজের মতো লাইটিং শো করতো। ও নিজে একটা ন্যুডিস্ট কলোনি চালাইতো মূলত। রবার্টের মতে, লাইট শো’টা এক ধরণের নাম-পরিচয়হীনতায় সাহায্য করতে, যাতে করে জ্যাকের ব্যান্ডকেও শ্রোতাদের মতো বিষাদঘূর্ণিময় মনে হয়। কিন্তু আমরা লাইট ব্যবহারে আগ্রহী ছিলাম মূলত নিজেদের আলোকিত করার জন্যেই।
টাউন ম্যাগাজিনে আন্ডারগ্রাউন্ড নিয়ে লেখায় ইউএফও’র আমেজটা বেশ ভালোভাবে ফুটে উঠছে, ‘পিঙ্ক ফ্লয়েডকে বলা যায় আন্ডারগ্রাউন্ডের হাউজ অর্কেস্ট্রা। ওদের সাউন্ড যতোটা না রোলিং স্টোন্সের মতো, তার থেকে অনেক বেশি থেলোনিয়াস মঙ্কের কাছাকাছি। প্রজেক্টএড স্লাইডগুলা থেকে তরলমনা রঙ মিউজিশিয়ান আর শ্রোতাকে একটা সম্মোহিত আর প্রমত্ত আবেশে নিয়ে যায়। মধুচক্র, গ্যালাক্সি আর কম্পিত ছটা মিউজিক দীর্ঘ হওয়ার সাথে সাথে তাদের চারপাশে পাক খেয়ে নেচে ওঠে।’
আমাদেরকে হয়তো হাউজ অর্কেস্ট্রা খেতাবে ভূষিত করা হয়, কিন্তু সাইকাডেলিক এক্সপেরিয়েন্স শেয়ার করা এতটা সহজ হয়ে ওঠে নাই সবার জন্যে। সবসময় ইউএফও’র ড্রেসিং রুমের লুপে আটকা পইড়া থাকতাম, এসিডের ফুসরত কেল্লা ফতে। ব্যান্ড হিশাবে রিহার্সিং, গিগের জন্যে ঘুরাঘুরি, গোছগাছ আর বাসায় ফেরাতেই সব সময় কাইটা যাইতো। সাইকাডেলিয়া ছিল চারপাশের আবহে, কিন্তু আমাদের মধ্যে তা অনুপস্থিত ছিল। হয়তো ইন্ডিকাতে গিয়ে বই কিনতাম, কিন্তু দাঁড়ানোর অবসরটা পাইতাম না। আইটি পত্রিকা পড়ে জেনে নিতাম ব্যান্ড নিয়ে কোথাও কেউ কোন রিভিয়্যু লিখসে না কী। সিড ছিল আমাদের মধ্যে সাইকাডেলিয়া নিয়ে সবচেয়ে বেশি উৎসাহী, এবং তখন কিছু দার্শনিক আর মরমী ব্যাপার অনুসন্ধানে মত্ত ওর বন্ধুদের নিয়া। যদিও উৎসাহের কমতি ছিল না, কিন্তু আমার মনে হয় না যদি আমরা যদি চাইতাম ও পুরা আন্ডারগ্রাউন্ড সিনের মধ্যে সম্পূর্ণ ডুইবা যাক- তাহলে কোন আগ্রহ দেখাইতো ।
বাইরের দুনিয়া তখন সাইকাডেলিয়া নিয়া জানতে পারতেছে রাউন্ডহাউজের নতুন বছরের মেলোডি মেইকারের ‘সাইকাডেলিকাম্যানিয়া’র অ্যাড দেখে, ‘WHAT IS A FREAK OUT? যখন অনেকগুলা মানুষ মিউজিক, নাচ, আলোর উদ্দাম আর ইলেক্ট্রিক সাউন্ডের মাধ্যমে একত্রীত হয়া নিজেদেরকে মননশীলভাবে প্রকাশ করতেছে। অংশগ্রহণকারীরা ইতিমধ্যেই আমাদের জাতীয় দাসত্ব থেকে মুক্ত। যেমন খুশি তেমন সাজোতে নিজেদের সাজায়া যেইভাবে খুশি নিজেদেরকে অবমুক্ত করতেসে। এর সবই হচ্ছে’।
এইরকম কোন একটা সময়ে আমার মিউজিক্যাল উপলব্ধিতে একটা বাকপরিবর্তন ঘইটা গেল। এক রাতে ক্রিম ব্যান্ড আসছিল পলিতে বাজানোর জন্যে। আমরা তখনো মাঝেমাঝে পলিতে বাজাই, কিন্তু ওই রাতে জুয়াড়িকে টাকা দিয়ে ঢুকতে হইছিল এই গিগের জন্যে। কার্টেন সরে যাওয়ার পরের দৃশ্যটা আমার স্পষ্ট মনে আছে। ক্রিমের রোড ম্যানেজার তখনো স্টেইজের উপরে- জিঞ্জার বেকারের ডাবল বেইজ ঠিকঠাক করার চেষ্টা করতেছে। জিঞ্জার এই ডাবল বেইজের জন্যে বিখ্যাত ছিল এবং সেটা প্রমাণস্বরূপ মার্বেল ফ্লোরের কিছু জায়গায় দ্যাখা যাইতেছিল নষ্ট হয়ে গেছে। সেই মুহূর্তেই মনে হইল আমারও ডাবল বেইজ দরকার এবং পরের দিন সোজা দোকানে গেলাম সেটা কেনার জন্যে।
আমরা হয়তো তখনো সাইকডেলিয়ার তরুন তুর্কি, কিন্তু ওদের হার্ডওয়্যার ডিসপ্লে আর ব্যান্ড দেখে তখন থ মাইরা গেসিলাম। আমি তড়িঘড়ি করে শ্যাম্পেইন স্পার্কল লুডউইগ ড্রাম কিটের দিকে চোখ দিলাম, বাকিরা মার্শাল অ্যামপ্লিফায়ার স্তুপের দিকে। জ্যাক ব্রুস, এরিক ক্ল্যাপটনের ‘এনএসইউ’ ওপেনিং এর সাথে সাথে এইসব আমাদের চোখের সামনে এক বিশাল মোহ নিয়া হাজির হইসিলো। পর্দার উঠার সাথে সাথে আবার পর্দা নাইমা গেল টেকনিক্যাল সমস্যা সমাধানের জন্যে — এইটা দেখেও আমরা হা হয়ে গেসিলাম। সবচেয়ে চমকায়া গেলাম জিমি হেনরিক্স যখন কয়েকটা গানের সাথে বাজাইতে উইঠা আসে স্টেইজে। তাজ্জব হবার কিছুই বাকী ছিল না সেদিন।
সেই রাত্রেই আমি বুঝতে পারলাম যা করতেসি খুব ঠিকঠাকমতোই সেটা করতে চাই। পুরা ব্যাপারতার শক্তি আমাকে সম্মোহিত করসিলো। বিটলসের মতো জ্যাকেট আর ট্যাব-কলার শার্টের দরকার নাই, সামনে একটা সুদর্শন ভোকালেরও খাড়া করার দরকার নাই। বুঝতে পারলাম ভার্স-কোরাস-ভার্স-কোরাস- সলো- কোরাস— এন্ড স্ট্রাকচারেরও দরকার নাই, এবং ড্রামারও শুধু পেছনে ছোট্ট জায়গায় নিয়ে বইসা থাকা অসহায় কেউ না। সে একেবারে সামনের মানুষটাই।
এই জিনিশটাই আমাদের মূল পরিকল্পনাকে অনেকদূর আগায়া নিয়া যায় — আরও বেশি কাজ করার আকাঙ্ক্ষা, নতুন যন্ত্রপাতি কেনা আর একটা রেকর্ড চুক্তি করা। এবং টাইমিং আর ভাগ্য একসাথে কাজ করা শুরু করে দেয় ছেষট্টি সালের শেষের দিকে। সিডের গান লেখার স্বতন্ত্র স্টাইল আর আমাদের ইম্প্রভাইজেশন মিলে একটা ধারা আমরা দাড়া করাইতে সক্ষম হইছিলাম। যদিও একটু রাফ, কিন্তু রেকর্ড কোম্পানির কাছে নিজেদের উপস্থাপন করার মতো যথেষ্ট মালমশলা আমাদের হাতে ছিল নিঃসন্দেহে।
ঘটনাপ্রবাহ এরপর খুব দ্রুত আগাইতে শুরু করে। পিটার জেনারের সাথে আমাদের বিক্ষিপ্ত চুক্তি শরতের মধ্যেই একটা পূর্ণ রূপ পায় এবং শীতে সেটা পিটারের ভাষায়- ‘রকেটের গতিতে চলা শুরু করে’। এই পালাবদলের সময়ে রেকর্ড কোম্পানি প্রকাশক আর এজেন্টরা বেশ আগ্রহ দ্যাখানো শুরু করে। মেলোডি মেকার একটা ফিচার ল্যাখে সকল কার্যক্রম নিয়া, হার্পার অ্যান্ড কুইন্সের অ্যান্টেনা হ্যাচকা টান দিয়া আগায়া নেয় তারপর। পিটারের একটা সময় মনে পড়ে যখন তার মনে হইসিল খুব দ্রুতই কিছু একটা হতে যাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছিল, ‘শিট আসলেই কিছু হইতে যাইতেছে’। অবিশ্বাস্য। লিন্ডি অ্যামেরিকা থেকে ইংল্যান্ডে আইসা আমাদের একটা ইভেন্টে পারফর্ম করতে দেইখা অবাক হয়া যায় — কীভাবে একটা স্টুডেন্ট কাভার ব্যান্ড থেকে রূপান্তরিত হয়া আমরা সাইকাডেলিকের ফ্রন্টিয়ারগ্রুপ হয়ে গেছি। অ্যান্ড্রুর ভাষায় — ‘আমরা ঠিক এটা বুঝতে পারি নাই, কিন্তু ঢেউ তীরে আইসা আছড়ে পড়ছে। আর পিঙ্ক ফ্লয়েড সেই ঢেউয়ের একেবারে আগায়’। তার মতে আমরা কী বাজাইতে পারি আর কী বাজাই তার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সঠিক স্থানে সঠিক সময়ের সম্মিলন।
ইউএফও চালানোর পাশাপাশি জো বয়েড তখনো ইলেক্ট্রাতে এঅ্যান্ডআর আর প্রোডাকশনের কাজ করতেসিল এবং ওর বস জ্যাক হলজম্যান আমাদের একশো আটাত্তর শতাংশের একটা প্রস্তাবনা দেয়। আমরা ওদের সাথে যাই নাই কারণ ইলেক্ট্রা তখনও একটা ফোক লেবেল মাত্র, যদিও ওরা ততদিনে দ্যা ডোরসের সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পথে। আমাদের তখন দরকার একটা প্রপার কোম্পানি। জো তখনো খুব বেপরোয়াভাবে চাইতেছিল আমরা যাতে ওর সাথে যাই। পলিডোর একটা ভালো প্রস্তাব দেয় যেখানে জো’র ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রযোজক হিশাবে কাজ করার সুযোগও ছিল। চুক্তি আগায়া আসতে আসতে জো শেষমেশ নিজের একটা কোম্পানি খুইলা বসলো উইচসিজন প্রডাকশন নামের।
সাতষট্টি সালের জানুয়ারি মাসে একটা রেকর্ডিং সেশনের আয়োজন করা হয় ওল্ড চার্চ স্ট্রিটের সাউন্ড টেকনিকে। জো প্রযোজক আর স্টুডিওর মালিক জন উড সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার। মনো রিপ্রডাকশনের জন্যে ‘আর্নল লেইন’ আর ‘ইন্টারস্টেলার ওভারড্রাইভ’- এর মতো গানগুলা ফোর ট্র্যাক টেইপ মেশিনে করা হয়। বেইজ আর ড্রামস করা হয় এক ট্র্যাকে, গিটার আর ট্রেম্বলি ফারফিসা ডুও কিবোর্ড আর দুইটা ট্র্যাকে। ড্রাম রিপিটের মতো ইফেক্টগুলা করা হয় এই তিনটা ট্র্যাকের উপর আরেকটা ট্র্যাক ঠুইকা। আর ভোকাল আর গিটারসলো ওভারডাব হিশাবে যোগ করা হয়। ফাইনাল মিক্সারটার মাস্টারিং কইরা হইসিল একটা মনো টেইপে।
পেশাদার স্টুডিওতে সাউন্ড সবসময়ই অসাধারণ শোনায়। ওয়েস্ট হ্যাম্পস্টেডের স্টুডিওতে যখন ড্রামসে আর ভোকালে একো দিয়ে ঠিকঠাক মিক্স করে নিজেদের শুনসিলাম, সেটা অসাধারণ শুনাইছিলো। সাউন্ড টেকনিক এর থেকেও তুলনামূলক ভালো স্টুডিও। স্টুডিওগুলা তখন ট্যানয় রেড স্পিকার নিয়া খুব ভাব দেখাইতো। ওয়ালনাট ফার্নিশের সেই পাঁচফিটের স্পিকারগুলার বেইজপাঞ্চ ছিল অসাধারণ। ‘আর্নল্ড লেইন’ এবং অন্য গানগুলা শুইনা তখন আর মনে হইছিল না যে আমি খুব খারাপ বাজাইছি। আমাদের অপক্বতা নিয়ে বিন্দুমাত্র লজ্জিত ছিলাম না। একেবারে পেশাদার শুনাইতেসিল, যদিও খুব তাড়াতাড়ি রেকর্ড করা হইসে। সীমিত ট্র্যাকের ভেতর থিকা খুব তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিতে হয় যে কোন ইন্সট্রুমেন্ট কোন ট্র্যাকের মধ্যে যাবে এবং তারপর মিক্স করা হয়। কিন্তু তারপরেও মনে হয় নাই মিউজিক খুব খারাপ কিছু হইসে।
‘ক্যান্ডি অ্যান্ড অ্যা ক্যারান্ট বান’ এর নাম তখন ‘লেটস রোল অ্যানাদার ওয়ান’। ‘I’m high, don’t try to spoil my fun’— লিরিকে এই লাইনগুলাও ছিল তখন। যেহেতু খুব কন্সারভেটিভ একটা রেকর্ড ইন্ডাস্ট্রিতে আমাদের গানটা দেয়া হবে, তাই ভিন্ন একটা সেটের লিরিক সেখানে বসায়া দেয়া হয় এর পরিবর্তে।
কোন এক কারণে আমাদের মনে হইলো আর্নল লেইনের একটা প্রমোশনাল ফিল্ম দরকার। টপ অফ দ্যা পপসে খুব কম গানেরই ফিল্মিং করা হইতো, বিশেষ করে করা হইতো যখন অ্যামেরিকান কোন অ্যাক্ট ইংল্যান্ডে কোন গতি করতে পারতেছে না এমন হইলে। কিন্তু আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করসিলাম মাল্টিমিডিয়া ব্যান্ড হিশাবে। জুন চাইল্ডের পরিচিত ডিরেক্টর ডেরেক নাইসকে কমিশন দেয়া হইলো ফিল্মটা বানানোর খাতিরে এবং আমরাও সাসেক্সের সৈকতের দিকে যাত্রা শুরু করলাম কাজ শুরু করার জন্যে।
সাসেক্স বাছাই করার কারণ ছিল আমার প্যারেন্টস ওইখানে থাকতো আর তারা বাড়িতে ছিল না। থাকার ঝামেলাটা এইভাবে মিটা যায় এবং শীতের মধ্যেও ইংলিশ সমুদ্রপারের সেটিংটা সহজেই হয়া গেলো। যদিও আজকের দিনের মাপকাঠিতে খুব সুবিধার কিছু না এবং হার্ড ডেইজ নাইট থেকে ধার করা আইডিয়া নিয়েই ভিডিওটা করা, তারপরেও শাদাকালো ফিল্মটা বেশ সরস বলা যলে। চারজন বাদে পাঁচ নাম্বার ব্যান্ড মেম্বার হিশাবে একটা ডামি ব্যবহার করা হইসিলো। পুরা শটটা একটা ধূসর দিনে শেষ করা হয় এবং পুলিশের উৎপাত বাঁধাহীন আনন্দের বারোটা প্রায় বারোটা বাজায়া দিসিলো। মিস্টার কেইথ রিচার্ডস নামের আরেক স্থানীয় অধিবাসী আর তার বন্ধুদের ঝামেলার কারণে প্রায় ধরা খাইতে নিছিলাম। পুলিশ আইসা জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলে চেহারার মধ্যে সর্বোচ্চরকমের মধ্যবিত্ত নির্দোষ অভিব্যক্তি ধইরা রাইখা এমন একটা ভাব করলাম যে আমরা কিছুই দেখি নাই এবং কিছু দেখলেই গিয়া জানাবো। ভাগ্য ভালো পুলিশ আমাদের গাড়ি চেক করে নাই।
সবকিছু ঠিকঠাকমতোই চলতেসিল। পলিডোর থেকে প্রস্তাব, প্রয়োজক, রেকর্ডিং, এমন কী প্রোমো পর্যন্ত। যাই হোক, যেমনটা মিউজিক ব্যবসায় হয়, কেউ না কেউ একজন বের হয়ে আসে লাইফবোট থেকে। আর এক্ষেত্রে ছিল জো বয়েড, কারণ ব্রায়ান মরিসনের অনুপ্রবেশ। ব্রায়ানের নিজে ছিল একটা বুকিং এজেন্সির মালিক, যদিও সে কখনো আমাদের তখনো দেখে নাই বা শুনে নাই পারফর্ম করতে কিন্তু পিঙ্ক ফ্লয়েড নিয়া কাভারেজ আর ফিডব্যাক তার চোখে পড়ছে। ও আর্কিটেকচারাল অ্যাসোসিয়েশনের একটা গিগে আমাদের ভাড়া করে নিয়ে যায়। সে নিজে থেকে এই নতুন নতুন ব্যান্ডকে দেখতে চাইতেসিল এবং আর্নল্ড লেইনের রিহার্সেলে সে উদয় হয় একদিন হুট করে। আমাদের পারফর্মেন্স দেখে সে তৎক্ষণাৎ ডুইবা যায় এবং পলিডোরের সাথে চুক্তি নিয়া নানারকম প্রশ্ন করা শুরু করে। তারপর বলে, এর থেকে ভালো চুক্তি করা সম্ভব। ব্রায়ানের সাথে ইএমআইএর ভালো খাতির ছিল, ফলে সাউন্ড টেকনিকের রেকর্ডিং এর পয়সা সে দিয়ে ডেমো টেপগুলা নিয়া যায় ইএমআই এক্সিকিউটিভের কাছে। সেই এক্সিকিউটিভও আমাদের সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানতো না, খালি জানত বেশ চলতেছে আমাদের নামটা। কিন্তু ব্রায়ান কথা দিয়া পটায়া ফ্যালে, ফলে তারা চুক্তি করতে রাজি হয়।
জোয়ের জন্যে দুর্লঙ্ঘ ঝামেলাটা ছিল ইএমআই এর সাথে চুক্তি হইলে বাইরের স্টুডিও অথবা প্রযোজক নিয়োগ করা যাইতো না। আর অ্যাবে রোড তাদেরই। তারা চাইতো বিটলসের ইঞ্জিনিয়ার নর্ম্যান স্মিথ যাতে আমাদের প্রযোজক হয়। এই প্রস্তাবই দেয়া হয় এবং আমরা নীরবে সেটা মাইনা নেই। এর কারণ ইএমআই এর সাথে চুক্তি পলিডোরের থেকে অনেক ভালো ছিল এবং বিটলসের কল্যাণে ইএমআই তখন বিখ্যাত। ফলে ইএমআই এ যাবো কী যাবো না এই প্রশ্নই ছিল না। ডেকার সাথে সাথে তারাই ছিল তখন সবচেয়ে প্রভাবশালী কোম্পানি। পিটারও ইএমআই-এ তার কলিগের সাথে বেশ জমায়া নেয় এবং তারা পাঁচ হাজার পাউন্ডের অগ্রিম প্রস্তাব পেশ করে। অ্যান্ড্রুর ভাষায়- ‘বালের ডিল, কিন্তু বিটলসের ডিলের থেকে হাজারগুণে ভালো’ এবং স্টুডিওর খরচের থেকেও উত্তম।
পিটার জেনারকে দায়িত্ব দেয়া হইলো জো’কে এই অপ্রীতিকর খবরটা পৌঁছায়া দেয়ার জন্যে। আজ পর্যন্ত পিটার এই ঘটনার জন্যে অনুতপ্ত বোধ করে। অ্যান্ড্রুর ভাষ্যে, ‘যেতাড়াহুড়া করে আমি আর পিটার জো’য়ের সামনে থেকে আইসা পড়ছিলাম সেটা লজ্জাজনক।’ কিন্তু ওই সময় কোম্পানির সাথে চুক্তি কইরা নিজের প্রযোজক আনার কোন ব্যবস্থা ছিল না। ফলে আমরা তখন ইএমআই রেকর্ডিং আর্টিস্ট এবং নিজেদের রেকর্ড নিয়াই চুক্তি করতে হাজির হইসি যেটা অন্য কেউ করে না।
এই চুক্তি সাইন করার পরেই লিডসে কুইন্স হলের ট্রামের ডিপোতে একটা গিগ করি উত্তরের পাঁচ হাজার মানুষের উপস্থিতিতে। ক্রিম আর স্মল ফেইসেসের অনেক কথা শুনসি এই ভেন্যু নিয়া, তাই নিজের চোখে দ্যাখার ইচ্ছা ছিল জিনিশটা কী, যেটা নিয়ে ডেইলি এক্সপ্রেস এতকিছু বলসে।
উত্তরের দিকে যাওয়াটা শেষমেশ ঢিলেমিতে গিয়া গড়ায়। আমরা বিকালের শুরুতেই লন্ডন থেকে রওনা দেই, কারণ জানতাম না লিডস কই। অ্যান্ড্রু কিং এর পুরাতন রেনল্টই ছিল ট্রান্সপোর্টের ভরসা। পরদিন সকালে আমরা যখন ফিরা আসি তখন কলেজে গিয়া রেজিস্ট্রার সাইন করার শক্তিও ছিল না (কুইন্স হলে গিয়া আমি স্টেইজ নাম নিয়া পরীক্ষা করা শুরু করি। ভাবসিলাম নোক ম্যাসন নামটা বেশ ভালো একটা ভিন্নতা আনবে এবং এটা লোকাল পেপারকেও বলি। জায়গামত ছবির নিচে আমার নাম নোক ম্যাসন হিশাবেই ছাপা হয়। এই জিনিশটা আর দ্বিতীয়বার চেষ্টা করি নাই)।
এই গিগটার পরেই বুঝতে পারছিলাম কোর্স ওয়ার্ক আর ব্যান্ড লাইফ একসাথে চালায়া যাওয়া সম্ভব না। তখনও আমি আপাতদৃষ্টিতে আর্কিটেকচার পইড়া যাইতেছি, কিন্তু সব সময় ব্যয় করতেসি রিহার্সেল করতে করতে, কিংবা রাস্তায় অথবা পারফর্ম করতে করতে। যদিও জন কর্প আমার সব ক্লাস ওয়ার্ক করে দিতেসিল, তারপরেও পিছায়া যাইতেছিলাম। ডিগ্রি তো শুধু রেজিট্রার অফিসে সাইন কইরাই দিয়ে দেয় না। জনের মতে আর্কিটেকচারে আমার কখনোই আগ্রহ ছিল না। জনের মাতে- এই জিনিশটা আর্কিটেক্টদের হাতেই ছাইড়া দেয়া উচিত। কিন্তু তারপরেও ও সাহায্য করতো।
আমার টিউটর জো মায়োর কাছে আমি চিকৃতজ্ঞ, কারণ সে আমাকে পরামর্শ দেয় এক বছরের ছুটি নেয়ার জন্যে এবং এই বলে আশ্বস্ত করসিল, আমি যদি চাই তাহলে এক বছর পর আবার যোগ দিতে পারবো। সে ঠিক প্রকাশ করসিল না, তবে আমার মনে হয় তার ধারণা ছিল আমার ভাগ্যে একজন মিডিওকার আর্কিটেক্ট হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নাই। সে হয়তো মনে করসিলো অন্য একটা জীবন বাইছা নিলে একটা ভালো ক্যারিয়ার করা সম্ভব। স্কুলের হেড এতোটা সাহায্য করে নাই, ফলে কড়া ভাষায় চিঠি লেইখা না করসিল প্রমিজিং এই ক্যারিয়ার যাতে না ছাইড়া যাই। ফলে সেই চিঠিটা বাপ-মাকে আর দেখানো হয় নাই। এরপরই কলেজ ছাইড়া দেই এই আশায় যে কোনদিন হয়তো ব্যাক করবো, কিন্তু সেই ব্যাক করা আজ পর্যন্ত হয়া ওঠে নাই।
ব্যান্ডের মধ্যে আমিই সবার শেষে টের পাইসিলাম সামনের দিনে বিপদ আছে। রজার খুব উদ্বিগ্ন ছিল রবিনসন আর ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডের ডিজাইনিং এর চাকরিটা ছাড়া নিয়া। এই চাকরীটার জন্যে মনে হয় ওর কিছু গোপন তথ্যবিষয়ক চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে হইসিল। এটা ভাবতে ভালো লাগে ওই ডিজাইনগুলা এখনো আমাদের অসৎ পয়সাপাতির সুরক্ষা দিতেছে। রিক মেলা আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিসে যে ও মিউজিকই করবে আর সিডও এইদিকে ক্যাম্বারওয়েল আর্ট কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিছে।
নতুন যেসব ব্যান্ডের সাথে ইএমআই চুক্তিহইতো, সেই ব্যান্ডগুলা নিয়ে ইএমআই’র একটা নির্দিষ্ট ভাবনা ছিল। ফলে ইএমআই এর প্রেস ডিপার্টমেন্টের বাইরে কিছু করার এখতিয়ার কারো ছিল না। তারা একটা ব্যান্ড পাইছে ‘সাইকাডেলিক ট্যাগের’ এবং যদিও আমরা যে-কোন ধরণের ড্রাগের কানেকশন অস্বীকার করার ক্ষমতা রাখতাম চিপাচুপা দিয়া, কিন্তু তারপরেও যে মুভমেন্টটা আমাদেরকে ফোকাসে নিয়া আসছে সেটা নিয়া লুকোচুরি খেলার সুযোগ ছিল না। যে সব লাইট টেকনিক ব্যবহার করি, সেগুলাকে ফ্যামিলি এন্টারটেইনমেন্টের মতো নিরীহ ব্যাপারই বলা যায়! কিন্তু মুভমেন্টের অনেকেই দুনিয়াকে দেইখা নেয়ার ঐশ্বরিক ইচ্ছা পোষণ করতো। ফলে মানুষজন আতংকে থাকতো এই ভাইবা যে, হিপিরা হয়তো খাবার পানিসাপ্লাইয়ের ট্যাঙ্কে এলএসডি মিশায়া দিবে। অনেক সাক্ষাৎকারে এমনও ভাব ধরছি যে ‘সাইকাডেলিক’ বলতে কি বোঝায় তাও জানি না। এক সাক্ষাৎকারে বাধ্য হয়া বলতে হইসিল, এমন দুঃস্বপ্নের মধ্যে থাকার কোন কারণ নাই। আর মেলোডি মেইকারের সাক্ষাৎকারে বলসিলাম, ‘সাইকাডেলিক শব্দটা ব্যবহার করার আগে সবার সাবধান হওয়া উচিত। আমরা কখনোই দাবি করি নাই যে আমরা সাইকাডেলিক গ্রুপ কিংবা সাইকাডেলিক পপ মিউজিক করি। লোকজনই এই খেতাব দিছে এবং লন্ডনে উদ্ভট কিছু হইলেই আমাদের নাম সেটার সাথে জড়ানোর চেষ্টা করা হয়।’ রজার আরও বলসিল, ‘সম্ভবত আমাদের অনেক ইকুইপমেন্টস আর লাইটিং আছে বিধায় এসব করা হয়া থাকে। কারণ প্রমোটাররা আমাদের ভাড়া করলে তাদের লাইটিং এর খরচটা বাইচা যায়।’
আরেকটা কাজ করতে হইসিল ইএমআই’এর সাথে চুক্তি করার পর— যেটাকে বলে আর্টিস্ট টেস্ট। ত্রিশ মিনিটের একটা পরীক্ষার মতো। কিন্তু চুক্তি যেহেতু হয়াই গেছে, তাই এর আর মানে ছিল না কোন। পরবর্তী কাজটা বলতে ওদেরকে একটা সিঙ্গেল দেয়া যেটা আগেই করা হয়ে গেছিল। এগারো মার্চে ‘আর্নল্ড লেইন’ রিলিজ করা হয়। নতুন করে রেকর্ডিং চেষ্টা করেও তেমন লাভ হয় নাই। হিশাব করে বললে পিটার জেনার আর অ্যান্ড্রু কিঙের সাথে একসাথে কাজ করার অর্থাৎ গ্রীষ্মের ছুটির ঠিক ছয় মাস পরে আমরা পাকাপোক্তভাবে রেকর্ডিং আর্টিস্ট হইলাম।
ইএমআই’ সাথে চুক্তি হওয়ার মাসখানেক পরে ফুল স্কেইল রেকর্ড কোম্পানি আর্টিস্ট হিশাবে বিবেচনা করে আমাদের জন্যে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনেক নামকরা লোকজন জড়ো হয় এতে। এদের মধ্যে ছিল বিচর স্টিভেন্স । স্টিভেন্সই মূলত আমাদের চুক্তিটা করায় ( এবং তার কিছু পরেই ও ইএমআই ছাইড়া চইলা যায়, আমাদের কোন দোষ নাই)। ম্যানচেস্টারের কর্পোরেট হেডকোয়ার্টারের এক বড় স্টেইজে লাইটশো সহ আমরা ‘আর্নল্ড লেইন’ গাই। সবাই শ্যাম্পেন খাইতেসিল, কেউ কেউ কেমিক্যালও আনছিল এখনো মনে আছে চেয়ারম্যান স্যার জোসেফ লকউডের কথা। তার বয়স তখন প্রায় ষাট, কিন্তু বয়স দিয়া তাকে বিবেচনা করা ভুল হবে। মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির অবিচল মানুষগুলার একজন। লোকটা তার যুগের থেকে অনেকনেক আগানো ছিল।
সিগ্নেচার অনুষ্ঠানের পর একটা ফটোগ্রাফির ব্যবস্থা করা হইলো নিয়ম অনুসারে, যাতে করে পরে কেউ না বলতে পারে সিগ্নেচারগুলা ফেইক। আমরা তখন উতলা হয়া আছি সামনের দিনগুলার জন্যে। মনে হইতেছিল এমন একটা জায়গায় গিয়া দাঁড়াইছি যেটাকে কয়েকমাস আগেও ফ্যান্টাসির চেয়ে বেশি কিছু মনে হয় নাই। তাই যখন ছবি তোলার জন্যে পোজ দিতে বলা হইছিল আমাদের, আনন্দে আটখানা হয়া তিড়িং বিড়িং কইরা নাচতে নাচতে নির্লজ্জের মতো পোজ দিয়া উইড়া গেলাম ক্যামেরার সামনে।