পাথর যখন কথা কয় :: পর্ব ১ । আসিফ আযহার
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ মে ২০১৭, ১১:৪৮ অপরাহ্ণ, | ২৯১১ বার পঠিত
তখন ১৭৯৯ সাল!
মিসরের ‘রোজেটা’ বা রশীদ নামের জায়গায় তাবু গেড়েছে সম্রাট নেপোলিয়নের সৈন্যরা। এখানে পরিখা খনন করতে যেয়ে তারা হঠাৎ পেয়ে যায় কালো ব্যাসল্টের এক প্রকান্ড পাথর! পাথরের মসৃন পাশে বিভিন্ন প্রাচীন লিপি আঁকা।
সৈন্যবাহিনীর প্রকৌশলী বোর্সাদ ইতোমধ্যে প্রাচীন মিশরের দুর্বোধ্য লিপির ব্যাপারে খুবই কৌতুহলী হয়ে উঠেছিলেন। তাই পাথরের গায়ে আঁকা লিপিগুলোর অর্থ উদ্ধারে তিনি উঠেপড়ে লেগে গেলেন। কিন্তু কাজটা খুব সহজ ছিল না। তিনি দেখলেন পাথরের গাঁয়ে তিনটি ধাপে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় লেখা হয়েছে। প্রথম ধাপে মিসরের সেই পুরনো ছবি আঁকা হায়ারোগ্লিফিক লিপি। দ্বিতীয় ধাপে ছিল পরবর্তীকালের ডেমোটিক লিপি এবং শেষ ধাপে মিসরে টলেমিদের শাসনের সময়কার গ্রিক লিপি। রোজেটায় পাওয়া গিয়েছিল বলে পাথরটির নাম হয়ে যায় রোজেটা পাথর।
বোর্সাদ পাথরটি পাঠিয়ে দেন স্বয়ং নেপোলিয়নের কাছে। নেপোলিয়ন ব্যাপারটিকে গুরুত্বের সাথে নিলেন। তিনি পাথরটির অনেকগুলো নিখুঁত ছবি করিয়ে সেগুলো পাঠিয়ে দেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভাষা পন্ডিতদের কাছে। শেষ দুই ধাপের অর্থ পাওয়া গেলেও প্রথম ধাপটির অর্থ উদ্ধার করা খুবই মুশকিল ছিল। অবশেষে দীর্ঘ চৌদ্দ বছর গবেষণার পর ফ্রান্সের বহু ভাষাবিদ জ্যাঁ ফ্রাঁসোয়া শ্যাম্পোলিয়র সাধনা সফল হল। শেষ দুই ধাপের সাথে মিলিয়ে তিনি প্রথম ধাপটির ভাষা ফোটাতে সফল হলেন। কথা বলে উঠল রোজেটা পাথর।
রোজেটা পাথরের সূত্র ধরেই প্রাচীন মিসরের হায়ারোগ্লিফিক লিপির পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়। আজ থেকে প্রায় সাত হাজার বছর আগে মিসরে এ লিপিতে লেখা শুরু হয়। রোজেটা পাথর লেখা হয়েছে অনেক পরে ১৯৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। পঞ্চম টলেমি এতে হায়ারোগ্লিফিক ও ডেমোটিক লিপির পাশাপাশি গ্রিক ভাষাও ব্যবহার করেছিলেন। এতে লাভ হয়েছে পন্ডিতদের। গ্রিক ও ডেমোটিক লিপির সূত্র ধরেই প্রাচীন হায়ারোগ্লিফিক লিপির রহস্যের জট খোলা সম্ভব হয়। ফলে পৃথিবীবাসীর সামনে ভেসে ওঠে প্রাচীন মিসরের অনেক অজানা ইতিহাস। ‘হায়ারোগ্লিফিক’ নামটি গ্রিকদের দেওয়া। এর অর্থ হলো পবিত্র লিপি। এ পদ্ধতিতে ছোট ছোট প্র্রতীক চিহ্ন দিয়ে লেখা হত। মিসরীয়রা এ পদ্ধতিতে লেখার জন্য ৭৫০ টি চিহ্ন ব্যবহার করত। কাঠ, পাথর এবং প্যাপিরাসে এ পদ্ধতিতে লেখা হত। আমাদের হাতে যেসব হায়ারোগ্লিফিক লেখা রয়েছে তার অন্যতম উৎস হলো পিরামিডের ভেতর পাওয়া প্যাপিরাসের রোল। হায়ারোগ্লিফিক লিপির সূত্র ধরেই আমাদের সামনে ভেসে ওঠে প্রাচীন মিসরের অনেক অজানা ইতিহাস।
৫০০০ থেকে ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ সময়কে মিসরের ইতিহাসে বলা হয় প্রাক রাজবংশীয় যুগ। এ সময় মিসর কতকগুলো ছোট ছোট নগররাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। এগুলোকে বলা হত ‘নোম’। ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মেনেস নামে এক রাজা সমগ্র মিসরকে একক রাষ্ট্রের অধীনে নিয়ে আসেন। দক্ষিণ মিসরের মেম্ফিস হয় রাজধানী। এভাবে মিসরে রাজবংশীয় যুগের সূচনা ঘটে। মিসরের রাজাদের উপাধী ছিল ফারাও। মোট ৩০টি রাজবংশ মিসর শাসন করেছে।
১৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পশ্চিম এশিয়ার যাযাবর জাতি হাইকসসরা মিসর দখল করে নেয়। তাদের হাতে ছিল ব্রোঞ্জের তৈরি বল্লম। এক সময় মিসরীয়রাও ব্রোঞ্জের বল্লম তৈরির পদ্ধতি শিখে ফেলল। এ অস্ত্র দিয়েই তারা বিদেশীদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়। ১৫৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিসরীয়রা আহমোসের নেতৃত্বে হাইকসসদের বিতাড়িত করে।
আহমোসের সময় থেকে মিসরে শুরু হয় মধ্য সাম্রাজ্য যুগ। এ সময় থেকে মিসরীয় সাম্রাজ্যের ব্যাপক বিস্তার ঘটতে শুরু করে। এমনকি পশ্চিম এশীয় আর্য ও সেমেটিকদের অঞ্চলেও মিসরীয় প্রাধান্য বিস্তৃত হয়। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে তখন আর্য ও সেমেটিক ভাষাভাষী বিভিন্ন জাতির ছড়াছড়ি। এবার সেদিকেই দৃষ্টিপাত করা যাক।
ইতিহাসের প্রসঙ্গ আসলেই এশিয়া মাইনরের উত্তরের একটি অঞ্চল আমাদের দৃষ্টি কাড়ে। আজকের জর্জিয়া ও ককেশাস যে অঞ্চলে অবস্থিত সেই অঞ্চল জুড়ে সুদূর অতীতে ছিল এক বিশাল তৃণভূমি। তৃণভূমির আকর্ষণে সেখানে সুদূর অতীতকাল থেকেই ছিল মেষপালক জনগোষ্ঠির বসবাস। ভাষার দিক থেকে তারা ছিল দুটি অংশে বিভক্ত। দক্ষিণ দিকের জনগোষ্ঠি ছিল সেমেটিক ভাষাভাষী। আর উত্তরের জনগোষ্ঠি ছিল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষী। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাকে আর্য ভাষা বলা হয়। এই আর্যভাষীরা ছড়িয়ে পড়েছিল পৃথিবীর বিভিন্ন দিকে। তাদের একটি অংশ মধ্যপ্রাচ্যেও গড়ে তোলেছিল বসতি। এদের মধ্যে অন্যতম হল হিট্টীয়রা।
২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে হিট্টীয়রা ককেশাস থেকে চলে আসে তুরস্কে। ১৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে তারা তুরস্কে গড়ে তোলে হিট্টাইট নগরী। লোহার ব্যবহারের প্রচলন ঘটায় এরাই। লেখার কায়দা তারা শিখেছিল মেসোপটেমীয়দের কাছ থেকে। ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পরে অন্য ইন্দো ইউরোপীয় ভাষাভাষী গোষ্ঠীর আক্রমণে পতন ঘটে হিট্টাইট রাষ্ট্রের।
সিরিয়ার উত্তরে আর্যদের আরেকটি গোষ্ঠী ছিল মিতানীয়রা। ঐতিহাসিক টয়েনবির মতে মিসর দখলকারী হাইকসসরাও ছিল আর্য। পারস্য সভ্যতাও গড়ে তোলেছিল আর্যদের একটি শাখা। সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য একসময় এদের অধীনে চলে গিয়েছিল।
অন্যদিকে সেমেটিক ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী যে সব অঞ্চলে বসতি গড়ে তোলেছিল তার মধ্যে অন্যতম হল-
মেসোপটেমিয়া: মেসোপটেমিয়া শব্দের অর্থ হল দুই নদীর মধ্যবর্তী জায়গা। মেসোপটেমিয়ার বর্তমান অবস্থান ইরাকে। দজলা ও ফোরাত নদীর মধ্যবর্তী হওয়ায় গ্রিক ভাষায় অঞ্চলটির নাম হয়েছে মেসোপটেমিয়া। এ অঞ্চলে কয়েকটি সভ্যতা বিকাশ লাভ করেছিল। সর্বপ্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতা সেমেটিক ভাষাভাষী ছিলনা। তবে পরবর্তী ব্যাবিলনীয় ও অ্যাসিরিয় সভ্যতা সেমেটিক ভাষাভাষী হলেও সুমেরীয় সংস্কৃতির উত্তরসূরী ছিল। তাই ইতিহাসবিদরা সুমেরীয়, ব্যাবিলনীয়, অ্যাসিরিয় ও ক্যালদীয় সভ্যতাকে মেসোপটেমীয় সভ্যতা বলে সাধারণ নামকরণ করেছেন। সেমেটিক ব্যাবিলনীয়রাই প্রথম সমগ্র মেসোপটেমিয়ায় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। ১৭৫০ সালের মধ্যে সমগ্র মেসোপটেমিয়া ব্যাবিলনের অধীনে এসে যায়।
ফিনিশিয়া: ভূমধ্যসাগরের তীরে আজকের লেবাননে গড়ে উঠেছিল সেমেটিক ভাষাভাষী ফিনিশীয়দের রাষ্ট্র। জাহাজ নির্মাণ ও সমুদ্র বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইতিহাসে তাদের জুড়ি মেলা ভার। টায়ার ও সিডন ছিল তাদের বিখ্যাত বাণিজ্য বন্দর। ওল্ড টেস্টামেন্টে এ দু’টি শহরের অধিবাসীদের কথা এসেছে। ইঞ্জিলে নবী যিসাসের এ দু’টি শহর সফরের কথা উল্লিখিত হয়েছে (ইঞ্জিল: মথি ১৫:২১)। আলেকজান্ডার টায়ার বন্দর ধ্বংসের পরে আলেকজান্দ্রিয়া সমুদ্র বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। সভ্যতার ইতিহাসে ফিনিশীয়দের সবচেয়ে বড় অবদান হল বর্ণমালার উদ্ভাবন। তাদের ১২টি ব্যঞ্জনবর্ণ থেকে সূচনা হয় আধুনিক বর্ণমালার। আমরা ইংরেজি ভাষায় যে ল্যাটিন বর্ণমালা ব্যবহার করি তা এসেছে ফিনিশীয় বর্ণমালা থেকে। ফিনিশীয় বর্ণমালার সাথে গ্রিকরা স্বরবর্ণ যুক্ত সম্পূর্ণ বর্ণমালা তৈরী করেছিল। আফ্রিকার উপকূলে ফিনিশীয়দের প্রতিষ্ঠিত দু’টি শহরের একটি ছিল কার্থেজ। এর অবস্থান ছিল সম্ভবত আজকের তিউনিসিয়ায়। এই কার্থেজিয়ানরা পরবর্তীতে রোমানদের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্ধী রূপে পরিণত হয়েছিল।
ইরাম: আজকের সিরিয়ার তৎকালীন নাম ছিল ইরাম। ওল্ড টেস্টামেন্টের বর্ণনা অনুসারে নোয়ার পুত্র শামের এক ছেলের নাম ছিল ইরাম (ওল্ড টেস্টামেন্ট:তাওরাত-১ম খন্ড:১০:২২)। ইরামের বংশধরদের বলা হয় ইরামীয় এবং তাদের দেশের নাম ইরাম। তাদের রাজধানী ছিল দামেস্ক। ফিনিশীয়দের মত তাদের ভাষাও ছিল সেমেটিক ভাষা। সুমেরীয় কিউনিফর্ম লিপির বদলে তারা ফিনিশীয়দের বর্ণমালা ব্যবহার করত। ফলে লেখার ক্ষেত্রে তাদের ভাষার ব্যবহার ছিল সুবিধাজনক। এ কারণে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে এ ভাষায় লেখার প্রচলন ঘটে। ব্যাবিলনীয় ও অ্যাসিরীয়দের মধ্যে এ ভাষার ব্যবহার জনপ্রিয় ছিল। এ ভাষার নাম ছিল আরামীয় ভাষা। মেসোপটেমিয়ার ক্যালদীয় সম্রাট নেবুচাদনেজারের সময়েও ব্যাবিলনে আরামীয় ভাষা প্রচলিত ছিল। এর পরবর্তী পারস্য সাম্রাজ্যের সরকারি ভাষা ছিল এটি। এমনকি প্রাচীন হিব্র“ ভাষার ওপরেও প্রাধান্য বিস্তার করেছিল এ ভাষা। ওল্ড টেস্টামেন্টের দানিয়েল ও ইষ্রার পুস্তকের একাংশ লেখা হয়েছিল এ ভাষায়। যিসাসের সময়েও নাকি বনি-ইসরাইলরা এ ভাষায় কথা বলত (ইঞ্জিল: ইউহোন্না ২০:১৬)। হযরত ইসহাক ও ইয়াকুবের স্ত্রীরা ছিলেন ইরামীয় (ওল্ড টেস্টামেন্ট:তাওরাত-১ম খন্ড:২৪ ও ২৮)।
এবারে ফেরা যাক আবারও মিসরের প্রসঙ্গে। আহমোজ যে রাজবংশের পত্তণ করেন তাকে বলা হয় অষ্টাদশ রাজবংশ। এ রাজবংশের সময়েই মিসরীয় সভ্যতা সর্বাধিক সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। ফারাও তৃতীয় থাতমোসের সময়ে (১৪৭৯-১৪৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) মিসরীয় সাম্রাজ্যের সীমানা এশিয়ায় প্রবেশ করে পৌছে যায় মেসোপটেমিয়ার সীমানা পর্যন্ত। মেসোপটেমিয়ার ব্যাবিলনীয় সভ্যতার তখন চলছে পড়ন্ত দশা। ব্যাবিলনীয় সম্রাট হাম্বুরাব্বির সময়কালের (১৭৯২-১৭৫০ খ্রি.পূ.) পরবর্তীতে মেসোপটেমিয়ায় অন্ধকার যুগ শুরু হয়। ফলে সে অঞ্চলে মিসরের কোন শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ছিল না। তৃতীয় আমেনহোতেপের (১৪১১-১৩৭৫ খ্রি.পূ.) সময়ে মিসরীয় সাম্রাজ্য সমৃদ্ধির একেবারে শীর্ষে পৌছায়। তাঁর পরেই শুরু হয় পতনের ধারা। ১৩৭৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিংহাসনে বসেন চতুর্থ আমেনহোতেপ। এই চতুর্থ আমেনহোতেপ চিরায়ত মিসরীয় ধর্ম বর্জন করে একেশ্বরবাদ গ্রহণের কারণে ইতিহাসের সর্বাধিক আলোচিত ব্যক্তিত্বের একজনে পরিণত হয়েছেন। ধর্ম বদলের পরে নামও বদলে তিনি হয়েছিলেন আখেন আতেন। সাধারণত তিনি ইখনাটন নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন অষ্টাদশ রাজবংশের দশম ফারাও। ইখনাটনের ধর্ম বিপ্লব ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়।
তৃতীয় আমেনহোতেপের সময়ে হিট্টিয়, ব্যাবিলনীয় ও মিতানীয় রাজারা তাদের রাজ্য রক্ষার জন্য ফারাওদের সাথে সদ্ভাব রাখার একটা পথ বের করল। রাজ পরিবারের মেয়েদের তারা ফারাওদের অন্তঃপুরে পাঠিয়ে দিল। এ ঘটনার সূত্রে তৃতীয় আমেনহোতেপ মিতানির রাজা দশরথের মেয়ে তিয়েকে বিয়ে করেন। এই তিয়ের গর্ভজাত সন্তান হলেন ইখনাটন। মিতানীয়রা ছিল মিসরীয়দের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ভিন্নধর্মী আর্যগোষ্ঠী। তাই পিতা-মাতার আলাদা ভাষা-ধর্ম ও জাতীয়তা ইখনাটনের ভাবনায় নতুন দিগন্ত সৃষ্টি করে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
তবে তাঁর ধর্ম বিপ্লব সফল হয়নি। তাঁর পুত্র তুতেনখামেনের বাল্য বয়সে মৃত্যুর পরে আবারও পুরনো ধর্ম ফিরে আসে। অষ্টাদশ রাজবংশের শেষ পুরুষ তুতেনখামেন। তাঁকে নিয়ে যে রহস্য তৈরী হয়েছিল তা মাত্র কয়েক বছর আগে ২০০৮ সালে ভেদ করা সম্ভব হয়েছে।
দ্বিতীয় রামেসেসের সময়ে (১২৯২-১২২৫ খ্রি.পূ.) সাম্রাজ্যের হারানো গৌরব উদ্ধারের চেষ্টা চলে। তাঁর সময়েই মুসার আবির্ভাব ঘটেছিল। তৃতীয় রামেসেসের (১১৯৮-১১৬৭ খ্রি.পূ.) সময়ে মিসরীয় সাম্রাজ্য আরও দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে। এক সময়ে নুবিয়া আর লিবিয়ার সম্রাটরা মিসরের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে।
এক সময় মেসোপটেমিয়ায়ও অন্ধকার কেটে গিয়ে গড়ে ওঠে সেখানকার তৃতীয় সভ্যতা অ্যাসিরিয় সভ্যতা। ওল্ড টেস্টামেন্টের সূত্র থেকে জানা যায় অ্যাসিরিয় সম্রাটরাও মিসরের ওপর আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। অ্যাসিরিয়দের পতনের পরে মেসোপটেমিয়ায় গড়ে ওঠে ৪র্থ ও শেষ সভ্যতা ক্যালদীয় সভ্যতা। ক্যালদীয় সম্রাট নেবুচাদনেজার (৬০৪-৫৬১ খ্রি.পূ.) মিসর দখল করতে পারেন নি। তবে মিসরীয়দের হাত থেকে ইরাম (সিরিয়া) দখল করে তাদের তাড়িয়ে দেন।
৫৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আর্যদের অন্যতম শাখা পারসীয়রা পূর্ব দিক থেকে এসে ক্যালদীয় সাম্রাজ্য দখল করে নিল। মিসরও বাদ গেলনা। গ্রীক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাসের গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায় থেকে আমরা জানতে পারি যে, ৫২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পারস্য সম্রাট সাইরাস পুত্র ক্যাম্বিসেস মিসর দখল করে ব্যাপক লুন্ঠন ও ধ্বংসযজ্ঞ চালান। এরপর তিনি মিসরের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন।
এক সময় পারস্য সাম্রাজ্যও পদানত হয় সেসিডোনীয় বীর আলেকজান্ডারের কাছে। ৩৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি পারস্য সাম্রাজ্য দখলের পথে মিসরও দখল করে নেন। এর পরবর্তী ৩০০ বছর মিসরে চলে মেসিডোনীয়দের শাসন। খ্রিস্টপূর্ব ৩০ সালে রোমান সম্রাট অগাস্টাস সিজারের কাছে মিসর তার স্বতন্ত্র সত্ত্বা সম্পূর্ণভাবে হারায়। মিসর পরিণত হয় রোমান প্রদেশে। আরও বহুদিন পর মিসর চলে যায় ইসলামী খিলাফতের অধীনে।
মিসরীয় সভ্যতার ইতিহাস মূলত শোষণ, অত্যাচার ও বিকৃত বিলাসীতার এক কুৎসিত কদাকার ইতিহাস। অন্যান্য সভ্যতার মতই এখানেও সমাজের ওপর তলায় বিপুল ঐশ্বর্য্যের বন্যা আর নিচের তলায় হাহাকার আর কান্না। উৎপাদন প্রণালী ছিল সামন্ততন্ত্রী ধরণের। মিসর ছিল কৃষি জমিতে পরিপূর্ণ। ফারাও দেশের সমস্ত জমির মালিক। ফারাওয়ের অনুগত সামন্তদের হাতে থাকত বড় বড় জমিদারী। ভূমিদাস আর দাসরা এই সব জমিতে কাজ করত। ভূমিদাস ছাড়াও মুক্ত কৃষক মিসরে ছিল। উৎপন্ন ফসলের এক পঞ্চমাংশ তারা রাজকীয় শস্যাগারে কর হিসেবে জমা দিত।
এসবের পাশাপাশি ছিল ধর্ম ব্যবসায়ী মন্দির আর পুরোহিতদের সম্পত্তি। অত্যন্ত কুৎসিত এক ধর্ম এরা প্রচার করত যেখানে দৈববলে রাজা ও পুরোহিত শোষণের অধিকার পেয়ে যেত। পিরামিড ছিল এই বিকৃত ধর্মবিশ্বাসের ফসল। এগুলো ছিল ফারাওদের সমাধি। ফারাওরা বিশ্বাস করত লাম্পট্য ও বিলাসিতা চালিয়ে যাওয়ার জন্য তারা আবার দেহ নিয়ে জেগে ওঠবে দেবতা ওসিরিসের রাজ্যে। তাই তাদের দেহকে নষ্ট হতে দেয়া চলেনা। তাই মমিকরণের মাধ্যমে দেহ সংরক্ষণের শেষে তাদেরকে লাম্পট্য ও বিলাসিতার বিপুল উপকরণসহ সমাহিত করা হত দুর্ভেদ্য পিরামিডের নিরাপদ অভ্যন্তরে।
একেকটি পিরামিড নির্মাণের সময় দেশের অর্থনীতিতে টান পড়ত। খুফুর পিরামিড নির্মাণের সময় ১ লক্ষ দাস ও শ্রমিক ২০ বছর ধরে কাজ করেছিল। অসংখ্য দাস ও শ্রমিক মারা যেত এ কাজে। এ কাজের জন্য সারা দেশ থেকে অসংখ্য দাস ধরে এনে শেকল পরিয়ে কাজে লাগানো হত। এভাবেই শোষণ ও অত্যাচারের শেকলে বাধা পড়েছিল অসংখ্য মানুষের জীবন। লম্পট রাজার কাল্পনিক জগতের বিকৃত লালসা পূরণের জন্য কী অমানুষিক আয়োজন। প্রতিটি পিরামিডের পাথরের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে অবিচার ও শোষণের এক করুণ ইতিহাস। শোষণ, অবিচার ও অন্যায়ের কলংক মাথায় নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে এসব পিরামিড। তাই পিরামিড সভ্যতার এক কুৎসিত নিদর্শন।
শোষণের এই নারকীয় ব্যবস্থাকে চালু রাখার জন্য জনগণের সামনে রাজতন্ত্রের দৈব সাহায্য প্রচারের কাজে নেমেছিলেন পরজীবী ভাড়াটে ধর্ম ব্যবসায়ী পুরোহিত সম্প্রদায়। দেশজুড়ে স্থাপিত অসংখ্য মন্দিরে তারা কাল্পনিক দেবতাদের শক্তি ও মাহাত্মের কথা প্রচার করতেন, যারা নাকি রাজাকে পাঠিয়েছেন শাসন ও শোষণের জন্য।
সেই সময়কার সমাজ ব্যবস্থায় শোষক দাস মালিক শ্রেণি ও রাষ্ট্রশক্তি তাদের শোষণ ও নিপীড়নকে বৈধ প্রতিপন্ন করার জন্য ধর্মকে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করত। সে সময়কার নৈতিকতা ও আইনে ধর্মের প্রভাব সুস্পষ্টভাবে দেখা যায়। ধর্ম ও দেবতারা ছিল সামাজিক জীবনের বিধায়ক। তবে এসব দেবতাদের রাজশক্তি ও শোষক গোষ্ঠীর পক্ষে দালালীটা ছিল খুবই স্থূল আর নগ্ন।
এসব দেবতারা যেন ব্যস্তই থাকতেন রাজশক্তির মনোবাঞ্চা পূরণের কাজে। রাজারা নাকি দেবতারই মনোনীত ব্যক্তি। আবার কখনও মানুষ আর দেবতায় হয়ে যেত একাকার। এই মানুষ হলেন রাজারা । দেবতাদের মন্দির বানাতে অর্থ দিতেন রাজারা। যে অর্থের মালিক তারা হতেন দাসদের পাজরভাঙ্গা শ্রমে। আর এসব মন্দিরের কর্তা হতেন রাজাদের ভাড়াটে ধর্মীয় পুরোহিতরা।
মন্দিরে বসে তারা দিবানিশি প্রচার করতেন ক্ষমতাধর দেবতাদের শক্তিমত্তা আর দাপটের কথা। যাদের মনোনীত ব্যক্তি স্বয়ং রাজা। দেবতাদের শক্তিকে মানুষ ভয় করত। পুরোহিতরা প্রচার করত দাস ও প্রজাদের রাজভক্তি কমে যাওয়াতেই দেবতাদের অভিশাপে তাদের ওপর নেমে আসে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। তাই শোষিত মানুষ দেবতাদের অভিশাপকে প্রচন্ড ভয় করত। দেবতাদের অভিশাপের ভয়ে তারা জবুথবু হয়ে থাকত। আর রাজরাজড়াদের সামনে মাথা টুকত। যারা হলেন দেবতার জাত। নীরবে দেবসন্তানদের শোষণ ও অত্যাচারকে সহ্য করে যেত। মুখ বুজে মেনে নিত অশুভ পরিণতির ভয়ে।
প্রাচীন মিসরের রাজারা নিজেদের বড় বড় দেবতাদের বংশধর, মনোনীত ব্যক্তি কিংবা ছোট দেবতা বা অবতার হিসেবে উপস্থাপন করত। প্রাচীন মিসরে সূর্যকে সবচেয়ে বড় দেবতা মনে করা হত। এর নাম ছিল ‘আমন রে’। ফারাওরা নিজেদের এই সূর্যদেবতার বংশধর বলে দাবি করত। খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতকে মিসরের রাজধানী থিবিসে অবস্থিত প্রধান দেবতা আমন-রে-এর মন্দিরের মালিকানায় ছিল ১,০৭,০০০ দাস, ৮৮টি সমুদ্রগামী জাহাজ, ৫৩টি নৌবন্দর, ৫০,০০০ গবাদীপশু, সমস্ত মিশরের মোট আবাদী জমির এক সপ্তমাংশ এবং মিসর ও সিরিয়া অঞ্চলের ১৬৯ টি শহরের রাজত্ব। এ সবই লাগত পুরোহিতকুলের ভোগে। পুরনো প্যাপিরাস থেকে এসব তথ্য পাওয়া যায়। এসব তথ্য থেকে বুঝতে কষ্ট হয়না আমন দেবতা কীভাবে মিসরের শোষিত মানুষের ঘাড়ে অভিশাপ হয়ে চেপেছিলেন। সূর্যের আলো ছাড়া ফসল ফলেনা, জীবন বাঁচেনা। তাই সূর্যদেব আমন দেবতার নামে তার প্রতিনিধি ও উপাসক পুরোহিতকুল শোষিত মানুষের ঘাড়ে কাঠাল ভেঙ্গে খেয়েছে। দেবতার নামে মানুষকে বানিয়েছে ক্রীতদাস। কৃষকের ঘাড়ে চাপিয়েছে করের বোঝা।