দ্য ফাউন্টেন – জ্ঞানবৃক্ষে বন্দী জীবন-সন্ধি । আরিফ মাহমুদ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ এপ্রিল ২০১৭, ১১:৩২ অপরাহ্ণ, | ২৯২১ বার পঠিত
একটা বৃত্ত-বিম্ব মেঘ হয়ে মহাশূন্যে কাঁচন হলদেবর্ণে ভেসে যাচ্ছে । ওই বৃত্তে বন্দী ‘জীবনবৃক্ষ’ । জীবনবৃক্ষে বন্দী অমরত্বের সন্ধান । কিন্তু ‘ইযি’ বলেছিল, মায়ানরা বিশ্বাস করতো আকাশে জ্বলে উঠা স্বর্ণরূপ ধারণ করা ‘সিবাবা’ (মৃতপ্রায় নক্ষত্র) কিছুদিন পরই বিস্ফোরিত হবে, সেখানে জন্ম হবে নতুন নক্ষত্রের । একটির পরিত্রাণ হবে অন্যটির অবস্থান ।
ফাউন্টেনের বিশ্লেষণ নিছক গল্পসর্বস্ব নয়, অভিজ্ঞতাও । তিনটি সময়ের পরিক্রমায় জন্ম, মৃত্যু, পুনর্জন্ম ও ভালোবাসার এ আখ্যান বিস্তৃত হয়েছে সহস্র বছরে! নন-লিনিয়ার কাহিনীধারায় বিন্যস্ত এ ছবির অবস্থান কখনো ষোড়শ শতাব্দীর অতীতে— মায়ান সভ্যতার অন্ধকার কোন এক জঙ্গলে । কখনো একবিংশ শতাব্দীর এই বর্তমানে । আবার কখনো পাঁচশ বছর পরের ভবিষ্যতে, যেখানে মহাশূন্যে সৃষ্ট হয়েছে ইন্দ্রজাল-বিম্বের মতো বেষ্টিত জীবমন্ডল । বর্তমানের ‘টম’ একমাত্র ‘বাস্তব’ চরিত্র যাকে কেন্দ্র করে গল্পের আবর্তন অতীত ও ভবিষ্যতে । টমের অবশিষ্ট দুই সত্তা যথাক্রমে ‘টমাস’ ও ‘টমি’ মূলত ইযির উপন্যাসের নায়ক । যে উপন্যাসের শেষ অধ্যায় অলিখিত হয়ে আছে, যা সম্পূর্ণ করার প্রতিশ্রুতি টম ইযিকে দিয়েছে । আমরা দেখি তিন গল্পের এক যোগসূত্রে ভিন্নরূপে টম তার ভালোবাসা ইযিকে বাঁচানোর প্রাণান্তর চেষ্টা করছে ।
বর্তমানে সে একজন চিকিৎসক যে জীবনের অন্তর্লীন সত্যকে অগ্রাহ্য করে ব্রেইন টিউমারে আক্রান্ত স্ত্রী ইযিকে সুস্থ করে তুলতে দিবারাত্র ল্যাবে গবেষণারত । ষোড়শ শতাব্দীতে সে স্পেনের রানী ‘ইসাবেল’কে কথা দিয়েছে মায়ান পৌরাণিকে বর্ণিত গুপ্ত পিরামিডের সন্ধান দিবে । সন্ধান দিবে অমরত্ব লাভের গুপ্ত জীবনবৃক্ষের । ভবিষ্যতে ইযি রূপান্তরিত হয় ‘বৃক্ষে’ । এবারও টমি তার প্রতিজ্ঞায় অনড় । আশায় জর্জরিত দীর্ঘ স্মৃতি চিহ্নের ঠাঁই হয়েছে তার বাহুদ্বয়ে । নেপথ্যে, মৃদুস্বরে পুনরায় ফিরে আসে, ভেসে আসে একই স্বর ‘শেষ করো’ ।
ম্যাথু লিবাটিকের চিত্রধারণ যেন কুব্রিকীও স্পর্শে রঞ্জিত! মহাশূন্য যেন এক ক্যানভাস আর তাতে বিচ্ছুরিত হয়েছে কনফিডেন্ট ব্রাশস্ট্রোকস! ছবির এক পর্যায়ে দেখা যায় একটি ‘হাই-অ্যাঙ্গেল শটে’ জীবনবৃক্ষের বিম্ব বৃত্তাকারে ঘুরছে, তদরূপ পরের দৃশ্যেই হাসপাতালে চিন্তিত টমকে দেখা যায় মাথায় হাত রেখে বৃত্ত ধরে হাঁটতে । ‘অমরত্বের ভাবনা’ দৃশ্যদ্বয়কে অভিন্ন করে দেয় । আবার আপাত নিস্ফল গবেষণায় বিরক্ত টম যখন ইযিকে দেখতে হাসপাতালে প্রবেশ করে, সোডিয়াম আলোতে চেহারায় পড়া আলো-আঁধারের পরিবর্তন ‘ক্লোজ আপ’ শটে তার মনের অস্থিরতাকে প্রকাশ করে । ফ্রেমের এমন কম্পোজিশন দর্শকের দৃষ্টিকে আরও আকৃষ্ট করতে থাকে ।
এক সাক্ষাৎকারে পড়েছিলাম কোন এক অনিশ্চিত কারণে অ্যারোনফস্কি অধিকাংশ ছবিতে ‘অন্ধকারময় বিষয়’ বেছে নেন । বেশিরভাগ ছবিতেই তিনি ফলাফল নির্ধারণের পথে হাঁটেন না বরং ব্যাখ্যার পথ উন্মুক্ত করে দেন । তার কথা মতেই, ছবিটি অনেকটা রুবিক কিউবের মতো । এর সমাধানের পথ অনেক হতে পারে কিন্তু পরিণতি কেবল একটাই । পুরো ছবিতে অ্যারোনফস্কি গদ্য বর্ণনার বদলে আলোকচিত্রের অন্ত্যমিলে কাব্যিক ভাষা ও দৃষ্টিনন্দন উপমা দিতে চেয়েছেন । যথার্থ আবহ সংগীতের ব্যবহার যেন সেই ভাষাকেই ত্বরান্বিত করেছে । দেখিয়েছেন বিমূর্ত জগতের সাথে মূর্তের সংযোগ । পরিচালক তার কেন্দ্রীয় দুই চরিত্রে দিয়েছেন অনুভূতির গভীরতা । হিউ জ্যাকম্যান ও রাচেল ভাইজ তাতে ব্যক্তি ও যুগ্ম বলয়ে কেবল দ্যুতিই ছড়িয়েছেন । রাচেলের অভিব্যক্তি ও নমনীয়তা আমাদের সহজেই টেনে নেয় ‘ইযি’ চরিত্রের গভীরে । যন্ত্রণা, হতাশা, একাগ্রতা বা অন্তরঙ্গতা– অনুভূতির প্রায় সব আকৃতিতে জ্যাকম্যানকে পাওয়া যায় যথার্থরূপে ।
গবেষণার রুমে ব্যস্ত টম । দরজায় দাঁড়িয়ে ইযি । তুষারপাতের আজ প্রথম দিন । ইযির আবদার, চলো একসাথে হেঁটে বেড়াই । কাজের অজুহাতে টমের উপেক্ষা । ইযির প্রস্থান ।
সৃষ্টির প্রারম্ভেই মানব জাতি জীবনবৃক্ষের পরিবর্তে জ্ঞানবৃক্ষ আস্বাদন করলো । সময়ের পরম্পরায় মানুষের জ্ঞানের পরিধি বাড়লো । জ্ঞানকে ব্যবহার করলো ব্যস্ততায়, বেঁচে থাকার নিত্যনতুন আবিষ্কারে । ভুলে গেল বাঁচতে, ভালোবাসতে! পরিণামে মৃত্যু হলো বিয়োগ! হলো কষ্ট! এই বৈপরীত্যে, জ্ঞানে বিকশিত যখন ভালোবাসা, মৃত্যুও তখন বশীভূত!
ইযির প্রস্থানে টম এবার ভুল করেনি । শুভ্র তুষারপাতে ইযির পথ ধরে দৌড়ে যাচ্ছে, মৃত বৃক্ষ বেয়ে বিম্ব পেরিয়ে সিবাবার ধ্বংসস্তুপে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, মায়ানদের পরাজিত করে জীবনবৃক্ষের স্পর্শে এগিয়ে যাচ্ছে ।
পরিচালনাঃ ড্যারেন অ্যারোনফস্কি । গল্পঃ ড্যারেন অ্যারোনফস্কি, অ্যারি হান্ডেল । চিত্রনাট্যঃ ড্যারেন অ্যারোনফস্কি । প্রযোজনাঃ আরনন মিলচ্যান, ইয়াইন স্মিথ, এরিক ওয়াটসন । চিত্রগ্রহণঃ ম্যাথু লিবাটিক । সম্পাদনাঃ জে রবিনোউইতয । শিল্প নির্দেশনাঃ জেমস চিনলোন্ড । ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট নকশাঃ ড্যান স্ক্রেকার, জেরেমি ডাওসন । সঙ্গীতঃ ক্লিন্ট ম্যানসেল । অভিনয়ঃ হিউ জ্যাকম্যান, রাচেল ভাইজ, এলেন বুরস্টিন । জনরাঃ ড্রামা, রোমান্স, সাই-ফাই । মুক্তিঃ ২০০৬ । দেশঃ যুক্তরাষ্ট্র । ভাষাঃ ইংরেজি । রঙঃ রঙিন । দৈর্ঘ্যঃ ৯৬ মিনিট ।