পার্বতী । হিমাংশু হিমু
প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ মার্চ ২০১৭, ১০:১৫ অপরাহ্ণ, | ২৩৬৬ বার পঠিত
“মন ভেবে পেলাম না কিছুই / এ যে মজার বলিহারি / মন তুমি পুরুষ কি নারী?”
সৃষ্টির কোনোকিছুতেই ভেদাভেদ নেই — এমনকি নারী ও পুরুষ, তার মধ্যেও কোনো পার্থক্য নেই। বাউল বলছে — একমাত্র পুরুষ হলো সে-ই যে শান্ত, নির্লিপ্ত আর যার কোনো গতাগতি নেই। প্রকৃতি হলো গতি, যার মধ্যে সৃষ্টি হয়। তো এইখানে, এই পৃথিবীতে, কোনোকিছুই সৃষ্টিহীন নয়। সবসময়ই সৃষ্টি হচ্ছে, সবসময়ই গতি হচ্ছে। সেজন্যই এই পৃথিবীতে কেউ পুরুষ নয়, সবাই নারী। একমাত্র পুরুষ হলো নির্গুণ, নির্লিপ্ত রাসবিহারী অথবা পরমব্রহ্ম অথবা আলেক সাঁই — তিনিই একমাত্র পুরুষ, বাকি সবাই নারী।
‘বেঙ্গল সংস্কৃতি উৎসব সিলেট ২০১৭’-এর নবম দিনে হাসন রাজা মঞ্চে শিল্পী পার্বতী বাউল কী চমৎকারভাবে তাঁর বাউলকথনে উল্লেখিত এই ব্যাখ্যাটুকু দিলেন।
সুনামগঞ্জের প্রবাদপুরুষ রাধারমণ দত্তের রচনায় বাউলশিল্পী পরিবেশন করলেন, “তাই আমি গৌর বলে ডাকি / গৌরা যদি হইত আমার কুমকুম চন্দন / আমি অঙ্গেতে মাখি / আমি গৌর বলে ডাকি।”
আনন্দময় জগৎ সম্পর্কে শিল্পী বলেন, সেই আনন্দময় জগৎ — যেখানে কোনো আনন্দের শেষ নেই, এর আনন্দ কোনো কারণেও হয় না। কেউ একটা আইসক্রিম দিল, তাতে আমাদের আনন্দ হলো — সেই আনন্দ নয়; আবার কেউ একটা খারাপ কথা বলল, তাতে মনে দুঃখ পেলাম — সেই দুঃখও নয়। এই আনন্দ হলো অহেতুকি আনন্দ। যার কোনো কারণ নেই, অকারণে আনন্দ — সবসময় আনন্দ। সেই আনন্দবাজার হলো বাউলের বাজার। বাউলরা সেখানে বিরাজ করে।
পার্বতী বাউল সম্পর্কে আমার প্রথম জানা হয় কলকাতা বাংলা চ্যানেলের সংগীত বিষয়ক জনপ্রিয় অনুষ্ঠান সা রে গা মা পা র মাধ্যমে। সেই থেকেই এই গুণী শিল্পী সম্পর্কে জানার, গানের পরিবেশনা শুনার প্রবল আকাঙ্ক্ষা ছিল। এক হাতে একতারা চলছে বিরামহীন, কোমরে নাকাড়ার গতিময় ধ্বনি, পায়ে ঘুঙুরের ছন্দময়তা, নৃত্যের তাল ও শৈলী, কণ্ঠে মায়াধরা সুর এবং মাথার চুলের শৈল্পিক বিন্যাস — অন্য কোনো সহযন্ত্রী ছাড়া এক অনবদ্য স্বনির্ভর পরিবেশনা, যা বাউলগানের ধারাকে অন্য এক মাত্রায় নিয়ে যায়।
পার্বতী দাস বাউল (পারিবারিক নাম মৌসুমী পারিয়াল) ভারতের আসাম, কুচবিহারে বেড়ে-ওঠা একজন বাউলশিল্পী, চিত্রশিল্পী, নৃত্যশিল্পী এবং গল্পকার। পিতৃভূমি বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম অঞ্চলের রাউজানের পশ্চিম গুজরার গ্রামের পারিয়ালপাড়ায়। শিশুকাল থেকেই তিনি গান ও নাচের চর্চা করতেন। পরিবারে শাস্ত্রীয় সংগীতের চর্চা ছিল। গুরুকূলে নাচ শিখেছেন। পরবর্তীকালে তিনি শান্তিনিকেতনের কলা বিভাগে ভিজ্যুয়াল আর্ট বিষয়ে পড়ালেখা করেন। এবং থিয়েটারের বিভিন্ন কলাকৌশল নিয়েও চর্চা করেন। তিনি বাউল জীবন ও চর্চা গভীরভাবে অবলোকন করেন যা তাকে উৎসাহিত করে বাউলচর্চা করতে। সনাতন দাস বাউল, তারপর শশাঙ্ক গোঁসাই, এঁরা হচ্ছেন এই গুণী শিল্পীর গুরু।
বাউল ঘরানার গানে ভাবের আদান-প্রদান, প্রগাঢ় ভক্তি, অনাবিল প্রেম ইত্যাদি প্রভূতভাবে লক্ষণীয় — যা নিছকই এক অদৃশ্য মায়ার টানে টেনে নিয়ে যায় শ্রোতাদের। সংগীত যে পরিপূর্ণ সাধনা ও ভক্তির আনাবিল স্থান তা এই শিল্পীর পরিবেশনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রবলভাবে প্রকাশিত।
২০১৭ সনের বেঙ্গল সংস্কৃতি উৎসবে পার্বতী বাউলের পরিবেশনা শুরু হয়েছে যে-গানটি দিয়ে, সেইটা এ-ই — “শ্রী শ্রী গুরুপদ ঘনশ্যাম, আত্রশ্যাম / নিতাই প্রেমানন্দে গৌর হরি হরি বলো / এসো হে শচীরও নন্দন একবার হৃদমাঝারে / উদয় হও হে …”
পরিবেশনা সমাপ্তি হয়েছে যে-গানটি দিয়ে, সেইটা এ-ই — “জয় রাধে রাধে, গোবিন্দ বলো জয় রাধে …”
এই প্রসঙ্গে পার্বতী বাউল বলেন, “এটা কোনো ধর্মীয় সংগীত নয়। কৃষ্ণ হলেন যিনি আকর্ষণ করেন, আর রাধা যিনি আমাদের মন নিচের থেকে উপরে নিয়ে যান। সুতরাং প্রেমিক, প্রিয়তম আর প্রেম একত্র হওয়া — এতে কোনো সম্প্রদায় নেই।”
এই মুহূর্তেও কানে বাজছে এই বাউল শিল্পীর গান; বীরভুমের দ্বিজভূষণের রচনায় — “চিরদিন মনে মনে / চিরদিন মনে মনে ঘরের কোণে / শ্যামের পিরীত রাখ গোপনে / ইশারায় কইবি কথা ঘাটে-মাঠে / রাই লো — ইশারায় কইবি কথা ঘাটে-মাঠে / দেখিস যেন কেউ না জানে, কেউ না বোঝে, কেউ না শোনে …”
অনেক ভাগ্য আমার যে এই-রকম অসামান্য বহুগুণসম্পূর্ণ বাউলশিল্পীর অসাধারণ পরিবেশনা নিবিড়ভাবে অবলোকন ও শুনতে পারার জন্য। এবং অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আয়োজক এবং আয়োজনের সঙ্গে জড়িত সকল কর্তাব্যক্তিবর্গ। স্যালুট বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সবাইকে।