বাউলিয়ানা নিয়ে এই মেলায় মাকসুদুল হক
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ মার্চ ২০১৭, ১০:৩৬ অপরাহ্ণ, | ২৩৭৭ বার পঠিত
সুবর্ণ বাগচী : মিউজিশিয়্যান মাকসুদুল হক প্রণীত প্রবন্ধের বই ‘বাউলিয়ানা’ পাঠকের হাতে তুলে দিয়েছে এইবার অগ্রদূত প্রকাশনী। ইংরেজি ভাষায় লেখা Bauliana: Worshiping the Great God in Man শীর্ষক তিনশতাধিক পৃষ্ঠা সংবলিত উন্নত উৎপাদনমানের বইটি ধবধবা শাদা কাভারে পেপারব্যাক বাইন্ডিং নিয়ে একুশে বইমেলার একেবারে প্রান্তভাগে এসে প্রকাশিত হয়েছে। অগ্রদূত অ্যান্ড কোম্প্যানির পক্ষে বইটি প্রকাশ করেছেন মনি মহম্মদ রুহুল আমিন।
মেলার একেবারে লেজে এসে বইটা আলোর মুখ দেখেছে বলে মেলাস্টলে যেয়ে বইকেনার সুযোগ পাঠকেরা পাচ্ছেন না। তাহলে উপায়? হ্যাঁ, এই বইটা যারা খরিদ করতে চান তারা পার্শ্ববর্তী ব্যুকস্টোরে ডিম্যান্ডনোট দিয়া রাখতে পারেন, বা প্রকাশকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন, অনলাইন অপ্শনে যেয়ে কেতাবক্রয়ের ব্যাপারটা তো ওপেন রইলই, ইভেন মাকসুদুল হক ম্যাকের ফ্যানপেইজে বা তাঁর পার্সোনাল ফেবুপেজে বা ইমেইলবক্সে যেয়ে বইখরিদের ইচ্ছাটা জানান দিয়া রাখতে পারেন। রনি মহালদার নামে একজনের কন্টাক্ট দেয়া হয়েছে প্রকাশক ও লেখকসূত্রে ফেবুদেয়ালগাত্রে, যেখান থেকে জানা যাচ্ছে +880 17 1493 8109 নাম্বারে হ্যালো বলেও বইয়ের প্রাপ্তিপ্রক্রিয়া সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবেন দেশের এবং বহির্দেশের পাঠকেরা।
ব্যান্ডসংগীতের উত্তাল সময়ে যারা বাংলাদেশে বেড়ে উঠেছেন, তারা মাকসুদুল হকের কণ্ঠের এবং গায়কীর এবং তৎপরতার এবং তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর লেলিহান ঐশ্বর্য সম্পর্কে অনবহিত নন নিশ্চয়। মাকসুদ ওর্ফে ম্যাক বাংলাদেশে ব্যান্ডম্যুভমেন্টের সেই সোনালি সময়ের এক প্রতিভাদীপ্ত লড়াকু। প্রবাদপ্রতিম বাংলা ব্যান্ড ‘ফিডব্যাক’-এ লিডভোক্যাল থাকাকালীন ‘বাউলিয়ানা’ শিরোনামে একটা গানসংকলন বেরিয়েছিল মনে পড়বে আমাদের অনেকেরই, সেই অ্যালবাম বাংলা গানে ট্রেন্ডসেটার হতে পেরেছিল বলেই ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ফিডব্যাককালীন ‘বাউলিয়ানা’ ছাড়াও ‘দেহঘড়ি’ আরেকটা ব্যাপক শ্রোতাগ্রাহ্য সংকলন, যেখানে আব্দুর রহমান বয়াতির সঙ্গে একটা গান ঘুরিয়েফিরিয়ে গোটা অ্যালবাম জুড়ে গেয়ে এই শিল্পী এবং তাদের সম্মিলিত দল বাংলা মাতিয়েছিল নব্বইয়ের মাঝামাঝি। লিরিক্স ছিল “মন আমার দেহঘড়ি / সন্ধান করি / কোন মিস্তিরি / বানাইয়াছে” — এই লিরিকের গীতিকার বাংলার এক মহাজন ভাবুক, নাম তাঁর আলাউদ্দীন; ফরহাদ মজহার প্রণীত ও বহুপঠিত ‘বাংলার ভাবান্দোলন’ পড়ে এই গীতমহাজন সম্পর্কে বেশ অবহিত হয়েছি আমরা খানিক বছরের ব্যবধানে যেয়ে; যদিও ফিডব্যাকের সেই অ্যালবামে গীতিকার হিশেবে লেখা হয়েছিল কি না আলাউদ্দীনের নাম, আজ আর ইয়াদ নাই; কিন্তু ফিডব্যাক ফিচারিং সেই দেহঘড়ি গানের শেষে ভনিতাপাদে যেয়ে “রহমান বয়াতি বলছে / ওরে আমার মনবোকা / ফিডব্যাকের কর্মদোষে / হইল না ঘড়ির দেখা” — এই লাইনগুলো স্পষ্টতই ইয়াদ করতে পারি। সিগ্নেচার দিলেন রহমান বয়াতিই। কিন্তু গানটা আদতে কার? খুঁজিয়া আর পরবর্তীকালে দেখি নাই। ফিডব্যাক থেকে বেরিয়ে এসে ম্যাক তথা মাকসুদুল হক গড়ে তোলেন ‘মাকসুদ ও ঢাকা’ ব্যান্ড ছাড়াও ‘গরিমা গানের দল’ নামে একটা গানগ্রুপ, যেখানে একেবারে আখড়ার আমেজ কাজে লাগিয়ে দুর্ধর্ষ একটা অ্যালবাম করেন ‘মাআরেফাতের পতাকা’ নামে।
ম্যাকের বাউলধারণাসংক্রান্ত ওরিয়েন্টেশন এবং প্র্যাক্টিস কতটা ব্যাপক, বর্তমানতায় বাউলাচারের যোগসূত্র কোথায় কীভাবে এসেছে ম্যাকের লেখনীসঞ্জাত, অত্যাধুনিক নগুরে জীবনাচারের মধ্যে থেকেও লোকায়তিক গূঢ় কথার ইশারাগুলো কেমন করে পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে ফিট-ইন করান মাকসুদ, সম্ভাব্য স্ববিরোধ/কন্ট্রোভার্সিগুলো মুকাবিলা করেন কেমন কায়দায়, এইসব পরখিতে গেলে ‘বাউলিয়ানা’ বইটা পার্চেজ করা চাই। ডিরেক্ট বাউলদের আখড়ায়-আশ্রমে যেয়ে ম্যাকের দীর্ঘ দুই-দশকের কায়িক ও মাননিক শ্রমের শস্য ধরে রেখেছে এই বইয়ের রচনাপ্রবাহ।
ওপারের ইন্ডিয়ান-বাংলায় এবং বাংলাদেশের খাঁটি নিখাদ বাংলায় বাউলচর্যা বিষয়ে বিস্তর বইপত্র হামেশা পাঠকের অভিজ্ঞতায় আসে। এই বই সেদিক থেকে ভিন্ন কোথায়? এর যথাযথ উত্তর পেতে গেলে বইটা হাতে নিতে হবে আপনাকে। একটা ব্যাপার শুধু বলে নেয়া যায় আগেভাগে যে, এই বই লিখেছেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি বিগত চার-দশক ব্যেপে ডেভেল্যপ-করা বাংলাদেশের শহুরে সংস্কৃতিতে গেয়ে-বাজিয়ে ক্যারিয়ার গড়েছেন, রকমিউজিকের যাপন ও জীবনাচার অনুশীলন করেছেন, এবং এক-পর্যায়ে এসে আকৃষ্ট হয়েছেন ঐহিক লোকায়ত দর্শন ও কৃত্যসংস্কৃতির প্রতি, নিবিষ্ট মনে এবং মনন বিনিয়োগ করে সেই জীবনের খনন করতে সচেষ্ট হয়েছেন, লিখেছেন গত দেড়-দশক ধরে একটানা খণ্ডে-খণ্ডে এই বইয়ের চ্যাপ্টারগুলো। অতএব, অতিভক্তি ও অযথা উন্নাসিকতার বাইরে এসে এই বইয়ে বাউল টার্মটার সঙ্গে একটা জানাপেহচানা পাঠকের হবে এতে সন্দেহ নাই।
কী আছে এই বইয়ের কন্টেন্ট হিশেবে? একগুচ্ছ উপশিরোনাম নজর করলে ব্যাপারটা ঠাহর করা যাবে, এবং পাঠক নিশ্চয় সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন বইটা তার দরকার কি না। কাজেই, ইন্ডেক্সের চ্যাপ্টারশিরোনামাবলি থেকে গুটিকয় এখানে পরপর টুকে দেয়া যাক : ‘Soul – Complicated Simplicity versus Simplicity Complicated’, ‘Hawadom – the Gust and Mother of all Winds’, ‘Joy Guru – Food, Begging and the curse of Materialism’, ‘True Work, Energy and burning without fuel’, ‘The Baul Guru: Extelligence over Intelligence’, ‘The Baul Trinity – Where wind is a foregone conclusion’, ‘Baul Meditation – From thinking nothing to thinking something’, ‘Messages – From Prophets to Poets and on to the public’, ‘Murshid – From territorial Extelligence to Temporal Trepidations’, ‘Breaking free: Demystifying the ‘home’ in our mind’, ‘Man and Women – Of Sin and Salvation’, ‘Critical Thinkers for Islamic Reform, The Way Forward’ … সংক্ষেপে, এই শিরোনামনিচয় থেকে, একটা আন্দাজ হবে বইয়ের ভিতরকার বিষয়াশয় সম্পর্কে।
এমনিতে বইটা ইংরেজিতে লেখা, যারা ইংরেজি দ্রুতপঠনে অভ্যস্ত নন তাদের জন্য বইটার একটা বাংলা ভার্শন হাজির করার ব্যাপারটা পাব্লিশার নিশ্চয় মাথায় রেখেছেন বা রাখবেন, পাঠ শুরু করলে যে-কেউ অনুসন্ধিৎসার জবাবে বেশ অগ্রসর হতে পারবেন, যে-সন্ধিৎসু মন নিয়ে পাঠক দীর্ঘদিন ধরে বাউলপন্থা বিষয়ক বিস্তর বইপত্র পড়ে চলেছেন সেই সন্ধিৎসা খানিকটা আলোকিত হবে ভিন্নকৌণিক যোগান পেয়ে। এই বইয়ের শুরুতেই একডজন প্রায়শ-উচ্চারিত জিজ্ঞাসা বা ফ্রিক্যুয়েন্টলি-আস্কড-কোয়েশ্চনের জবাব হাজির রয়েছে, এবং শেষ হয়েছে গত দশককাল আগে বাউলভাস্কর্য ভাঙাভাঙি নিয়ে একটা আলোচনার তীক্ষ্ণ সাম্প্রতিকতায়।
বইয়ের পুরোভাগে একটা প্রিফেস পাওয়া যাচ্ছে, এটি লিখেছেন জনৈক ব্যারিস্টার এম.বি.আই মুনশি, সেখান থেকে একপ্যারা : Essentially the book is a deeply personal journey undertaken by Maqsood after his many hard and some might say bitter experiences in life and with his relationship to Bauliana and the teachings of Fakir Lalon Shah and the other Bauls. The book had developed out of Maqsood’s close association with the Bauls and is obviously autobiographical in nature. He had accumulated numerous notes during the periods of teaching and instruction imparted to him by the bards and he has made good use of them in the book. Other than a musical album of the same name, recorded with his former band Feedback, Bauliana can be said to be his scriptural testimony to his personal belief system that is based on a fusion of Buddhist and Islamic precepts that has similarity to the Bauls way of life which he has chosen to adopt. The cause for this attitude appears to be a consequence of his frustration with religious quarrels that now plague our world and the wars that feed on these sectarian and communal squabbles.
বইটার ভিতরে ব্যাপক নয়নমোহন ব্যাপারস্যাপার আছে। একটার কথা বলি। উৎসর্গপত্রে লেখা : dedicated to The Great No – Fakir Lalon Shah / This book is dedicated to no one. অগ্রদূত প্রকাশনীর উৎপাদনমান উন্নত ও অনুসরণীয়। মাকসুদুল হকের পূর্ববর্তী দুটো প্রকাশনা, বাংলায় ‘আমি বাংলাদেশের দালাল বলছি’ গদ্যগ্রন্থ এবং ইংরেজি The Bangladesh Poet of Impropriety কবিতাগ্রন্থ, বেরিয়েছিল গত বছর একই প্রকাশনী থেকে। এবারকার বইটি বিশেষভাবেই মিউজিকপ্রেমী সিটিড্যুয়েলারদের অবশ্যপাঠ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। কতই-না মাণিক্যভরা তাদের প্রান্তর-অরণ্য-জলাজংলার এই দেশ, ম্যাকের সিরিয়াস বয়ান ও বাহাস থেকে এই জিনিশটা আজকের নেটিজেন স্পষ্ট বুঝতে পারবে, একাত্ম হবার একটা রাস্তা পাবে শেকড়ের সঙ্গে, শেকড় সম্পর্কে আরও অনুসন্ধানের প্রাথমিক প্রণোদনাটুকুও পাবে। এবং যারা বাংলার লোকদর্শনের চর্চিত গবেষক, তারা ‘বাউলিয়ানা’ বইয়ের সঙ্গে সংলগ্ন হবেন লিপ্ত হবেন জ্ঞানকাণ্ডের গরজে, এপিস্টেমোলোজিক্যাল অন্বয় সাধনে, ম্যাকের সঙ্গে মুখর হবেন তারা বাউলিয়ানা বিষয়ক ম্যাকপ্রস্তাবিত প্রতর্কে, এইটুকু প্রত্যাশা এই বইয়ের ব্যাপারে একেবারেই মিনিম্যাল। ‘বাউলিয়ানা’ বইয়ের বহুল পাঠ ও বহুকৌণিক পাঠান্তর প্রত্যাশিত।
Bauliana: Worshiping the Great God in Man / The Bauls of Bangladesh and Fakir Lalon Shah ।। Maqsoodul Haque ।। প্রকাশক : মনি মহম্মদ রুহুল আমিন ।। অগ্রদূত প্রকাশনী ।। ঢাকা ।। প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০১৭