কবিতাবই নিয়ে এই মেলায় ইমরুল হাসান
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১০:১৫ পূর্বাহ্ণ, | ১৫৭০ বার পঠিত
সুবর্ণ বাগচী : ইমরুল হাসানের নতুন কবিতাবই প্রকাশিত হয়েছে। ‘টেস্ট এনভায়রনমেন্ট’ শীর্ষক জাঁকজমকবাহুল্যহীন প্রচ্ছদে স্লিম শরীরের বইটি নিঃসন্দেহে নজরকাড়া। পাঠক-দর্শকদের মধ্যে যারা ডামাডোলের বাইরে একটু উল্টোস্রোতা পাঠোপকরণ খুঁজে বেড়ান হামেশা, তারা হাসানের এই সাম্প্রতিক কাজটির কদর করবেন নিশ্চয়।
এবারকার মেলায় এই বই প্রকাশিত হয়েছে বললে অবশ্য তথ্য তছরুপের দায় কিছু বর্তাবে এই রিপোর্টারের গর্দানে। সেহেতু বলে নেয়া ভালো যে একুশে মেলায় নয়, মেলার বাইরে একেবারে একেলা একেলা, ডিসেম্বর ২০১৬ সনে এটি রিলিজ্ হয়েছিল। পুরনো হয়ে গেছে সেই বিবেচনায় অবশ্য। বই-প্রিমিয়ারে একটু অপেক্ষা করলেই কিন্তু মহান বইমেলার প্রচারহিস্যাদার হতে পারত বইটি, রিপোর্টারের সঙ্গে আলাপকালে আক্ষেপ করছিলেন জনৈক বইক্রেতা।
কাজেই, কিছুটা ‘লিবারাল’ হওয়া আবশ্যক বইধৃত কবিতাগুলো গ্র্যাব্ করতে যেয়ে। কেবল প্রকাশকালের হিসাব মোতাবেক এইটেকে ‘একুশে মেলা’ মাসের বইয়ের স্বীকৃতি দিতে যেয়েই যে ‘মৃদু উদারতা’ রিকোয়ার্ড, তা নয়; এর অন্তর্গত কবিতাগুলোর ধরনধারণও প্রথানুগত কবিতাধারার সঙ্গে অভ্যস্ত পাঠকের কাছে একটু দলছুট ঠেকতে পারে, সেজন্যেও যথেষ্ট গ্রহিষ্ণু ও উদার হওয়া দরকার। এর বাইরে ডেমোক্র্যাট, সোশ্যালিস্ট, কনজার্ভেটিভ, ন্যাশন্যালিস্ট সহ সর্বস্তরের লিগ-ফ্যুটবলার আর ক্লাব-ক্রিকেটার পাঠকের কাছে বইটি সমাদৃত হবার জোর সম্ভাবনা আছে। অ্যাকাডেমির খানবাহিনী কিংবা আইনশৃঙ্খলারক্ষীদের কাছে যেয়ে এইটা খারিজ হবে না তারিফ পাবে তা অবশ্য বলা যাচ্ছে না।
সাকুল্যে দুইফর্মা, মানে থার্টিটু পৃষ্ঠা, ক্র্যাপবোর্ড মলাটের বই ‘টেস্ট এনভায়রনমেন্ট’ প্রকাশ করেছে ‘প্রিন্ট পোয়েট্রি’ শিরোনামে এক নবাগত প্রতিষ্ঠান। বইটা ছাপা হয়েছে, এবং ব্যুকলঞ্চ সিরিমোনি সহ অন্যান্য বিলি-বিপণন হচ্ছে, ‘বাংলাসাহিত্যের রাজধানী’ হিশেবে নামজাদা ঢাকা থেকে। বইয়ের দাম বাংলাদেশী মুদ্রায় পঞ্চাশ (অঙ্কে ৫০.০০) টাকা। অ্যাজেন্ট, হোলসেলার বা রিটেইলার এবং এমনকি সরাসরি রিডার কাউরেই বইগাত্রে-ধার্যকৃত মূল্যের উপর কোনোপ্রকার ছাড় বা রেয়াত দেয়া হচ্ছে না বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। সূত্র গোপনীয় ও নির্ভরযোগ্য। বইমূল্য অর্ধশত, নো কমিশন।
বইটি ‘প্রিন্ট পোয়েট্রি’ প্রকাশ করলেও মহান বইমেলায় তাদের কোনো স্টল বা টেবিল বা দাঁড়ানোর গাছতল নাই। লিগ্যালি তা থাকবার কথাও নয়। কেননা এইটাই ‘প্রিন্ট পোয়েট্রি’ লঞ্চড পয়লা প্রোডাকশন। আর খানযুগে স্টল বরাদ্দদানের বিধিবিধান-শর্তাবলি পুরাকালের তুলনায় ঢের কড়াকড়ি বেড়েছে। অ্যাট-লিস্ট খানপঞ্চাশেক ছাপানো বইয়ের আইটেম ছাড়াও অন্যান্য বহুবিধ ‘প্রান্তিক যোগ্যতা’ লাগে মেলায় স্টল/ভূমিতল পেতে গেলে। এই রিপোর্টারের সঙ্গে কথা হচ্ছিল ব্যুকস্টলে ডেইলি ওয়েইজেস্ বেইসিসে কর্মরত জনৈক তরুণ কবি কাম্ বিক্রয়বালকের। স্টলের ম্যারাপ তক্তায় পেরেক ঠুকে ঠিকঠাক করবার ফাঁকে অ্যানোনিমাস্ পরিচয়ের প্রাকশর্তে রাজি হওয়াতে বেশকিছু কথাবার্তা চালানো সম্ভব হলো। কথা হচ্ছিল যে, এখন প্রকাশনাজগতে মধ্যস্বত্বভোগের বিকাশ উল্লসিত হবার মতো উচ্চতায় যেয়ে ঠেকেছে। এই শিল্পের পরানভোমর যে লেখক, এই ইন্ডাস্ট্রির নিউক্লিয়াস ও ফ্যুয়েল যে লেখক, একটা পাইপয়সা লাভের গুড় বেচারা লেখকের জেবে যেতে দেখা যায় যদি তো সেইটা কিংবদন্তিতুল্য উদাহরণ। অথচ লেখক রঙচঙা পাব্লিশার কর্তৃক মহানন্দে প্রতারিত হতেছেন পৌনঃপুনিক, প্রতিবাদের কোনো পুকার নাই মুখে।
এমতাবস্থায় ‘প্রিন্ট পোয়েট্রি’ কিসিমের প্রকাশোদ্যোগ অত্যন্ত সাধু। হুদা পাব্লিশারের দ্বারস্থ হয়ে স্ট্যামিনা না-খুইয়ে এইভাবে ইনফর্ম্যাল প্রকাশরাস্তায় যাওয়া আজ কবিসাহিত্যিকদের জন্য অনেক বেশি ডিগ্নিটির। এ-ধরনের প্রকাশব্যবস্থাকেই ইংরেজিতে ভ্যানিটি প্রিন্টিং প্রেস্ বলে বোধহয়। ইংরেজি লিট্রেচারের রথী-মহারথীদের বইপত্র উল্লেখযোগ্য পর্যায় পর্যন্ত এই কায়দায় প্রকাশিত হয়ে থাকে। লেখকপ্রাচুর্যের এই দেশে তরুণ সাহিত্যিকেরা যত বেশি এই রাস্তায় এগোবেন, প্রকাশকগোত্রের বেপারিদের লেখকঠকানো দৌরাত্ম্য তত দ্রুত সহনীয় মাত্রায় আসতে থাকবে বলে সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগীরা আশা রাখছেন।
কবি, গল্পলেখক, সমালোচক ও অনুবাদক ইমরুল হাসানের কাগজমাধ্যমে মুদ্রিত প্রকাশনা আছে বেশকিছু। কবিতাবই সবগুলোই, গল্পবই আছে একটা। ‘কালিকাপ্রসাদে গেলে আমি যা যা দেখতে পাবো’, ‘অশ্বত্থ বটের কাছে এসে’, ‘তোমার কথাগুলি আমি অনুবাদ করে দিতে চাই’, ‘রাঙামাটি’, ‘স্বপ্নের ভিতর’ এবং ‘বসন্ত ১৪১৯’ তার কবিতাবই; সাম্প্রতিক ও সর্বশেষ কবিতাবই এই ‘টেস্ট এনভায়রনমেন্ট’ এখন পর্যন্ত। গল্পবই ‘পুরির গল্প’ প্রকাশিত হয়েছে গেল-বছর। নতুন কবিতাবই প্রিমিয়ারের প্রাক্কালে ফেসবুকে এক বার্তায় লেখক জানাচ্ছেন,
নিজের বই ছাপানির কথা মনে হইলে সবসময়ই মনে হইতো (এখনো হয়) যে বন্ধুবান্ধবদেরকে (ফ্রেন্ড আসলে তখনো চালু হয় নাই আর দোস্তও এনাফ ‘বাংলা’ মনে হইতো না) আমার কবিতাগুলি পড়াইতে চাই। এই বন্ধুবান্ধব/ফ্রেন্ড/দোস্ত তো আসলে ইম্যাজিনড একটা ব্যাপারই। ইন-রিয়্যালিটি, তেমনকিছু থাকা নিয়া সন্দেহের ভিতরই থাকি। … মানে, কিছু মানুষজন ছিলেন, যাদের সাথে আমার কবিতা রিলেট করতো বইলা ভাবতে পারতাম আমি। এখন এইরকম হোপফুল হওয়ার কোনো কারণ নাই! বেশ ডিস্ট্যান্ট একটা রিয়্যালিটিই মনেহয়। কিন্তু এর এগেনেস্টে না-জানা কোনো অডিয়েন্সের কথাও ভাবতে পারি নাই। তারপরও ডিস্ট্যান্টলি কানেক্ট করেন হয়তো কেউ কেউ। লিখতে থাকলে কিছু মানুষ তো আবিষ্কার করতে চাইতেই পারেন। খুশি লাগে কেউ যখন বলেন কবিতার জন্যই মানুষ হিসাবে আমারে পছন্দ করা যায়। অবাকও লাগে।
এইভাবে লেখকের বইপ্রকাশনেপথ্য অভিপ্রায় এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটা মাপা ‘আত্মস্বীকারোক্তি’ রিসেন্ট বাংলাদেশজ কাব্যঢক্কানিনাদী রিয়্যালিটির পার্সপেক্টিভ থেকে দেখতে গেলে বেশ বিরলদৃশ্যই বলতে হবে। এবং পাঠকপ্রান্তে এ এক স্বস্তিকর উপরি পাওনাও অবশ্য।
বইটা পাবার জন্য ‘জনান্তিক’ নামের বইদোকানে পাঠক ঢুঁ মেরে দেখতে পারেন। দোকানটা ঢাকার শাহবাগ অ্যারিয়ায় আজিজ স্যুপার মার্কেটের নিচতলায় অবস্থিত। কয়েকটা আরও অপশন আছে অবশ্য বইটা অ্যাভেইল করার, সোশ্যাল সংযোগমিডিয়ায় ‘প্রিন্ট পোয়েট্রি’ কর্তৃক অবমুক্ত-করা পাতায় এইসব তথ্য সুলভ। এক হচ্ছে, কেউ চাইলে বিক্যাশ করার মাধ্যমে সরাসরি নিজের ডেরায় বই পেতে পারবেন; এবং দুই, লেখকের কাছে মাগ্না বইপ্রার্থী হয়ে যে-কেউ পেয়েও যেতে পারেন একখণ্ড বই। প্রথমোক্ত ক্ষেত্রে ০১৫৫৩-৫১৯-৭২৩ নাম্বারে ৭০ টাকা (বইয়ের দাম পঞ্চাশ টাকা প্লাস্ ক্যুরিয়ার খর্চা বাবদ কুড়ি টাকা; মানে, ৫০+২০=৭০ টাকা) বিক্যাশ করা লাগবে। সেক্ষেত্রে একই নাম্বারে ক্রেতার অ্যাড্রেসটা এসএমএস করা লাগবে, কিংবা https://www.facebook.com/printpoetry/?fref=ts লিঙ্কের সাইটেও অ্যাড্রেসটা জানায়ে রেখে ক্রেতা মোটামুটি বিঘ্নহীন বই পেয়ে যাবেন ঘরে বসে। এবং একই ঠিকানায় একজোড়া কাব্য খরিদ করলেও ক্যুরিয়ারখর্চা বাড়বে না, খালি এক্সট্রা বইটার হাদিয়া বাবদ অধিক পঞ্চাশ অর্থাৎ সর্বমোট একশকুড়ি (৫০+৫০+২০=১২০.০০) টাকা পাঠাতে হবে। এর বেশি কিনতে চাইলে ক্যুরিয়ারচার্জ কন্সাইনমেন্টের কিলোপ্রতি হিসাবে পরিমাণমতো বাড়বে এবং দ্বিপাক্ষিক আলোচনাসাপেক্ষে এক্সপেন্সেস্ নেগোশিয়েইট করে নেয়া যাবে। দ্বিতীয়োক্ত বইপ্রাপ্তিযোগের ক্ষেত্রে লেখকের মিজাজমর্জি এবং বইপ্রতুলতা দুইয়েরই সমানুপাতিক আনুকূল্য অত্যাবশ্যক বলা বাহুল্য। তবে প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট সম্পর্কটা আখেরে অ্যাভোয়েড করাটাই ডিগ্নিটিওয়ালা পাঠকের পক্ষে শ্রেয়তর। অত্যল্প হাদিয়াই তো! প্রকাশিত বইয়ের মোট ছাপাসংখ্যা সাকুল্যে দুইশ’, প্রকাশক ও লেখক দুনো তরফে এক শ্বেতবার্তায় এই তথ্য জ্ঞাপিত। অতএব স্টক অতি লিমিটেড।
বইটির বিক্রিবাট্টা ভালো হোক। পাঠকের সংবেদনায় সাড়া জাগুক। বইপ্রকাশের ব্যবসায় লেখকের প্রকৃত মর্যাদা আসুক।
টেস্ট এনভায়রনমেন্ট ।। ইমরুল হাসান ।। প্রিন্ট পোয়েট্রি ।। ঢাকা, ডিসেম্বর ২০১৬