কবির আত্মস্বীকার । জফির সেতু
প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ জানুয়ারি ২০১৭, ৬:৫৭ অপরাহ্ণ, | ২০১১ বার পঠিত
কবিতার প্রত্নচেতনা কবির আত্মবোধ। যে-বিষয় নিয়েই কবিতা লিখুন না-কেন কবিতায় কবির নিজের একটা অবস্থান থাকেই। সেই অর্থে আমি কবিতাকে সবসময়ই কবির এক ধরনের শরীরীচেতনা বলেই মানি। অর্থাৎ, কবিতা জীবনচেতনারই একটা অংশ। যেহেতু জীবনের মূল অস্তিত্ব শরীরীই। শরীরকে ঘিরেই মানুষী অস্তিত্ব বা সত্তা গড়ে ওঠে। জীবনানন্দের বহু বিখ্যাত উক্তিটি কবিতার ক্ষেত্রে বেদবাক্যতুল্য । তাঁর মতে, কবিতা ও জীবন একই জিনিসের দুইরকম উৎসারণ। এর অর্থ দাঁড়ায়, জীবন ও কবিতা আসলে একই প্রতœউপাদান থেকে উদ্ভুত ও লীলায়িত। এখন ভাবনার বিষয় হতে পারে এই মূল উপাদানটা আসলে কী। জীবনের রহস্যটা ওইখানে, কবিতারও। তাই গোটা সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার সঙ্গে কবিতা ও জীবন এককার হয়ে ওঠে। সৃষ্টিজগতের প্রতিটি বস্তুর সঙ্গে মানবঅস্তিত্বের যে-একাত্মতা, কবিতার প্রতিও মানুষের সমান দাবিকে কেউই উড়িয়ে দিতে পারে না। কবি যে-ভাষারই হোন না-কেন তার কবিতা মানব-অস্তিত্বের দ্যোতক হয়ে ওঠে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, কবির আত্মবোধই কবির অস্তিত্ব। কবিতাকে তাই কবির জীবন থেকে আলাদা করা যায় না। নৈর্ব্যক্তিক ধারার অনেকেই হয়ত এমনটা মানতে চাইবেন না। কিন্তু এটাও ঠিক যে, কবিতায় আত্মনিরপেক্ষতা বলে কিছু নেই। কবিতায় কেন, কোনো শিল্পেই নেই। যদি এমন হয় এটা বিশেষ সত্তা থেকে সৃষ্টি। শিল্পে ‘মাইমিসিস’ বলে যে-ধারণা, এটা শুধু বস্তুর বর্হিসত্তার নয়, শিল্পীর অর্ন্তসত্তারও। সে-অর্থে কবি কবিতায় তার সত্তাকেই শব্দে শব্দে সাকার করে তোলেন। এলিয়ট যেমন বলেছিলেন, কোনো কবিতাই মৌলিক কবিতা নয়। পূর্ববর্তী কবি অর্থাৎ বৃহৎ ঐতিহ্যের কাছে কবিকে আজীবন সমর্পিত হতেই হয়। শিল্পীর ক্রমবিকাশ এক অর্থে তাই আত্মবলিদান, ব্যক্তিত্বের ক্রমবিকাশ। এখানে কবিতার প্রশ্নে নৈর্ব্যক্তিক অনুশীলনের প্রসঙ্গ আসলেও আমাদের মানতে বাধা নেই, অন্তত এলিয়টের মতে, কবিতা কবির ব্যক্তিত্বের স্বকীয়তার বিষয় নয়, বরং তা থেকে কবির নিজেকে মুক্ত করার প্রয়াস। যে-কোনো শিল্পের ব্যাপারে ওই একই কথা বলা যায়। কবির আত্মবোধকে এখানে অস্বীকার করার কথাও আসছে না। কবিতায় যে-আবেগের সংরাগ থাকে, যে-অভিজ্ঞানের আলো থাকে, সেটি নিঃসন্দেহে মানবিক বোধ, এবং বলাবাহুল্য জিনিসটা আত্মগত। সেই আত্মগত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাই উৎসারিত হয় কবিতার শব্দে ও ধ্বনিতে। অবশ্য প্রশ্ন থেকে যেতে পারে, এই উৎসারণটার প্রকৃতি ও ধরনধারণটা কেমন? যেমনটাই হোক তা কবির ভেতরগত চেতনার নির্মাণ বই নয়।
২
কবির আত্মবোধ ও আত্মস্বীকার এক জিনিস নয়। আত্মবোধকে চেতনার অংশ হিসেবে মেনে নিতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু আত্মস্বীকার অন্য জিনিস। প্রাচ্য-প্রতীচ্যে কনফেশনাল সাহিত্যধারা বলতে একটা ধারাই আছে। এর সঙ্গে ধর্মীয়বোধের একটা সম্পর্কও রয়েছে। শুরুটা খ্রিষ্টীয় ধর্মাচার থেকে। ধর্মের সঙ্গে গলাগলি করে কবিতার বিকাশপথের কথা কারও অজানা নয়। ধর্মের আধিভৌতিক অনুভব থেকে কবিও মুক্ত নন। ভালো ও মন্দের ধারণা বা অন্যকিছুর নৈতিক যে-ভিত্তি ধর্মীয় ধারণা থেকে, মধ্যযুগের কবি থেকে শুরু করে আধুনিক একজন কবিকেও সে-রক্তরঞ্জিত পথে হাঁটতে দেখি। অনেক মানবিক বিষয়ও ধর্মের চোখে অনৈতিক বলে অনুশোচনা বা অনুতাপ কবিতায় প্রাসঙ্গিক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
জীবনানন্দ দাশ যখন নির্দ্বিধায় বলেন, ‘পৃথিবীতে চলছে শুয়োরের উৎসব’, তখন আমরা বুঝি ওই উৎসবে জীবননান্দও শামিল। কিন্তু ওইরূপ উৎসব তার বাঞ্ছিত না, কোনো মানুষেরই বাঞ্ছিত হতে পারে না। কিন্তু এর স্বীকারের দায় অবশ্যই মানুষের আছে। কবির তো বটেই। এটাকেই আমি কবির আত্মস্বীকার বলতে চাই।
বর্তমানকালে কবিতা ধর্মচেতনা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে, বলতে গেলে নেইও এবং বর্তমানের কবি ঈশ্বরের কাছে নয়, নিজের কাছে দায়বদ্ধ বলেই তার গ্লানিবোধও অন্যরকম। তাই ঠিক ওই অর্থে কনফেশনাল সাহিত্য বলতে যা বোঝায়, সেদিকে না-গিয়ে আজকের কবিদের স্বীকারোক্তিমূলক কবিতার একটা নতুন মাত্রা পেতে দেখি। বিষয়টাকে পাপবোধের সঙ্গে না-গুলিয়ে কবির অবচেতন ধর্মবোধ ও সংস্কারের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়াই ভালো। এছাড়া কবি একটি সমাজের সভ্যও, এমনকি একটি রাষ্ট্রের। সুতরাং সমাজ-রাষ্ট্রের বিকৃতি, স্থূলতা ও অন্যায় কবিকে বিদ্ধ করতে পারে। পারে নিজেকে নিজের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে। কবির অবদমিত ব্যক্তিসত্তাও এক্ষেত্রে বিদ্রোহী হয়ে উঠতে পারে। কবি হয়ে উঠতে পারেন কুণ্ঠাহীন। মানুষ হিসেবে কবির যে-ঊনতা তা তিনি প্রকাশ করতেই পারেন। মানুষ নীচ ঘৃণ্য অধম ইত্যাদি হতেই পারে, কিন্তু তাও ঠিক যে, এসবকে ছাপিয়ে তার মানবিক সত্তাটাই প্রধান হয়ে উঠতে চায়। আমার মনে হয় কবির আত্মস্বীকারে মাহাত্ম্য এখানেই।
সব কিছুর ওপরে মানুষী-বোধ। কবি তার আত্মপ্রতিকৃতি নির্মাণ করে জীবনের মুখোমুখিই দাঁড়াতে চায়। অতীত আর বর্তমানের বিবমিষাকে কবি আত্মউন্মোচনের মাধ্যমে কবিতায় স্থানান্তরিত করে সত্তার কাছে সহনশীন হয়ে ওঠেন। বোদলেয়ারের ক্লেদজ কুসুম জীবনেরই অন্য রূপ, কিংবা গিন্সবার্গের উদোম পঙ্ক্তিমালা। জীবনানন্দ দাশ যখন নির্দ্বিধায় বলেন, ‘পৃথিবীতে চলছে শুয়োরের উৎসব’, তখন আমরা বুঝি ওই উৎসবে জীবননান্দও শামিল। কিন্তু ওইরূপ উৎসব তার বাঞ্ছিত না, কোনো মানুষেরই বাঞ্ছিত হতে পারে না। কিন্তু এর স্বীকারের দায় অবশ্যই মানুষের আছে। কবির তো বটেই। এটাকেই আমি কবির আত্মস্বীকার বলতে চাই। যদিও এধরনের আত্মস্বীকারকে কেউ কেউ অস্বাভাবিকতা ও অসুস্থতা বলে চিহ্নিত করতে চান। অনেকে বলেন বিকার। সেটা বিবেচনা করলে কবিমাত্রই কিঞ্চিৎ অসুস্থ বলে মানতে আমি দ্বিধান্বিত নই। তাই আত্মচেতনার শরীরী প্রকাশ হিসেবে যে-আত্মহননেচ্ছা, সেটাও আত্মস্বীকারের অংশ হয়ে ওঠে। সত্তার অবদমনই স্বেচ্ছামৃত্যুচেতনা হয়ে নিজের কাছে ধরা দেয় বলে পৃথিবীর সকল কবির কবিতা মৃত্যুর তরঙ্গে তরঙ্গিত। সনাতন এই মৃত্যুবোধও এক ধরনের আত্ম-স্বীকারোক্তি। ‘আমি কখনো পূর্ণ নই, আমিত্ব অর্জনের চেষ্টাই আমার সাধনা’ —আন্দ্রে জিদের এমন বক্তব্যই সারবান কবিতার আত্মস্বীকার। মহৎ কবিতা এই আত্মস্বীকারকে অবজ্ঞা করতে পারে না।