চতুষ্কোণ । মঈনুস সুলতান
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ ডিসেম্বর ২০১৬, ৯:৫৫ অপরাহ্ণ, | ২০৫৭ বার পঠিত
ঘরে ফেরা
কীভাবে ফিরি বলো —
সমুদ্রের রূপালি-নীল আর্শি
ছায়া ফেলে মেঘের আরশ,
বসে থাকি ছাতাতলে … ছুঁয়ে যায় বাউরি বিভাস
সৈকতে ঝিনুক খোঁজে পরিযায়ী সারস,
জলের গৌরবে হাসে স্নানের বালিয়াড়ি নিবাস —
হরেক অন্তর্জালে আহত আত্মা যে পথ হারালো;
তারপর দেখো ভেবে —
মেহগিনির স্মৃতিমেঘে গড়ে উঠছে
আমার বিনম্র ইমারত,
চন্দন কাঠের কুরসিতে মেধা ও মেহনতের দাসখত,
আঙিনায় নিশিন্দা বৃক্ষের সজীব তরবারি —
দালানের দ্বিতলের কাজ এখনো হয়নি সম্পন্ন,
ছাদে টাঙায়ে কুয়াশার কুহক-মশারি
পারস্য ফরাস আর মর্মরের মোখতসর অন্ন;
কীভাবে ফিরি বলো —
দোলাচলের আখ নিংড়ে
সংসারের শর্করা সরনীতে সন্ধ্যা যে হলো;
সাপের খোলসের মতো অতঃপর খুলে ফেলে
গৃহে ফেরার মসলিন খোয়াব,
অবগাহনে মাতি … অন্তরে আফ্রিকার অতলান্ত আঁব
তুলটে তিতমধুর নওল আখর — আঁকি সময়ের স্মৃতিরঙ্গ,
মননের মেহরাবে দাঁড়িয়ে শুনি
বাজায় মোসাফির … মৃদু স্বরে মৃদঙ্গ।
হংসধ্বনির রঙিন তান
বৃক্ষের কাণ্ড কুঁদে বানানো যেতে পারে
ভারী বজরা, সিন্দুকের মতো কফিন
কিংবা ঝর্ণানুড়িময় রোদে ঈষৎ রূপালি মানবী,
নৌকার গলুইতে আঁকা গৌতম প্রতীকে জমে যে জল
অরুণিম ঊষার দিকে উড়ে-যাওয়া কাকাতুয়া,
আলোর দোলাচলে হয়ে যেতে পারে ছবি।
ঝর্ণা-সজল ধারাপ্রতিমায় গড়ানো দ্যুতিময় নুড়ি
পাড়ে ফ্লেমিং রেডের জেওরে সে অনুপম,
নহরে পাপড়ির লোহিত প্রতিবিম্ব
তরুতে মিশে যায় মানবী,
বাস্তবের সাথে খোয়াবের তারতম্য খুবই কম।
গাছের খোড়লে বাস করে অন্ধ কাকাতুয়া
আমার সামনে এসে দাঁড়ায় যে সচল তরুবর
আকাশ-করুণ শিশিরে তার পালক ধোয়া,
হৎপিণ্ড চিরে পাঁজরের কড়িবর্গায়
তৈরি করি একটি ঘর।
অভ্রের জাফরিতে বোনা সে খোয়াবমঞ্জিল,
কিসের সুর যেন ঘুরে ফেরে
অলীক প্রসূনের আবীর ছড়ানো পাপড়িতে
শূন্যতা বাস করে হালফিল।
মননের ঘোর অমাবস্যায় এ তরু ঝর্ণা হয়
ঝুরে ঝুরে বাজায় হংসধ্বনির রঙিন তান,
গৃহহীন মানব বর্ণের বিধূর মহলে
হয়েছিল ক্ষণিকের মেহমান।
পোষা ক্যানোরি
পিঞ্জিরাটি ফেলে দিও না —
বলি হে — বরং ভাঙা শিকগুলো করো মেরামত,
বয়স হয়েছে তো কি
সময়ের কাছে দাওনি তো দাসখত।
বলা তো যায় না — আবার কখন আসে
আরামের ঋতু কুয়াশাচ্ছন্ন শীত,
রোদে শুকিয়ে ভাঁজ করে রাখো
পশমের তুলতুলে কম্বল,
মজে-যাওয়া দিঘিতে হয়তো ফুটবে
আকাশরঙিন শতদল।
ফেলে দিও না বহু বছরের জমানো পুস্তক —
অস্ত্রোপচারে ফিরে পেতে পারো চোখের জ্যোতি
মোমের আলোয় আবারও হয়তো পড়বে
পদাবলির পরাক্রান্ত স্তবক।
বলি হে — যত্নে রাখো পিঞ্জিরাটি
কেটে যাক দীর্ঘ দিবস তারাজ্বলা শর্বরী,
আবার হয়তো ঝিনুকের বাটিতে আধার খুঁটে খাবে
তোমার পোষা ক্যানোরি।
চার্চে সান্দ্রা মরালেস
হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটে গেরিলা — ঘাসবনে গিরগিটি
গ্রাসহপারের ওড়াওড়িতে ছড়ায় বর্ণ অশেষ,
বাহারী দিনযাপনে আসে কোকো পানের বার্তা
গির্জায় সলো গাইবে আজ সান্দ্রা মরালেস;
গথিক কেতার সাদা দালানে জমবে কন্সার্ট
আফ্রো-ক্যারিবিয়ান সুরবাহার,
লিমোজিন হাঁকিয়ে চলে আসি চার্চে
বজায় রেখে কূটনৈতিক শিষ্টাচার;
বাটিকের কাফতান পরে দাঁড়িয়ে ছিল
আনমনা সে — বেদির সিঁড়িতে,
জ্বলে মোমবাতি কাচ-ঝলসানো জানালায়
ক্রুশবৃক্ষের তলায় বুদ্ধ যাজক বসে মেহগিনির পিঁড়িতে;
জননী মরিয়মের শরীরে জড়িয়ে মাকড়শার জাল,
লিম্বা গোত্রের তিন কাফ্রি ঢোলকে তোলে তাল;
সুরস্থাপত্যের মরমরঙিন দোলাচলে আমি নাজেহাল;
গাইছে সান্দ্রা আজ মন্দ্র স্বরে জ্যাজ ও ব্লুজ
তারপরে কান্ট্রি মিউজিক,
সমজদারী মন আমার উন্নাসিক
জড়োয়ার রূপালি-নীল স্ফটিকে ঠোকর খায়
আলোর জাফরানী সংঘাত,
গথিক গম্বুজে
মনের মর্মান্তিক মুজরায় বাজে প্রতিধ্বনির অভিঘাত।