সিলেট বিভাগের লিটলম্যাগ । মো. রেজাউল করিম
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ নভেম্বর ২০১৬, ১২:০১ পূর্বাহ্ণ, | ২৮৯৯ বার পঠিত
‘সাহিত্যে কোনো আকস্মিক ঘটনা ঘটে না, এখানে আছে ক্রম-ধারাবাহিকতা…’
—আবদুল মান্নান সৈয়দ
সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার এবং সুনামগঞ্জ — এই চার জেলা নিয়ে সিলেট বিভাগ। সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ব্যক্তির উদ্যোগে ষাট ও সত্তুরের দশকে বেশ কিছু সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হয়। নিজেদের লেখা ছাপার অক্ষরে দেখার উদ্দেশ্যে সাহিত্যমনা কিছু তরুণ একত্রিত হয়ে পত্রিকা প্রকাশ করে গেছে, ব্যাপারটা সবসময় এমন ছিল না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের উদ্দেশ্য ছিল অনেক বিশাল ও মহৎ। যেমন, ১৯৬৫ সালে আব্দুল কাদির মাহমুদের সম্পাদনায় মৌলভীবাজার থেকে প্রকাশিত ‘দিগন্ত’-এর সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করা হয় — “আমাদের এ প্রচেষ্টা মূলত ভাবী সাহিত্যিকদের জন্যই। আজ যারা সাহিত্যকর্মে হাতেখড়ি নিবেন, তাদের মাঝ থেকেই ভবিষ্যতের বহু খ্যাতনামা সাহিত্যিকের অভ্যুদয় হতে পারে। কাজেই তাদেরকে উৎসাহ দান এবং তাদের আত্মবিকাশের পথ সুগম করে দেওয়াই আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য।”
এই দুই দশকে সংস্কৃতিমনা উদ্যমী তরুণ-যুবকরা একত্রিত হয়ে সাহিত্য-সংস্কৃতির বিভিন্ন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করেন। বিশেষ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর। দেশ স্বাধীন হলে স্বপ্নবাজদের স্বপ্ন আর উদ্যম আরো তীব্র হয়। নতুন স্বপ্ন, নতুন সম্ভাবনা আর নতুন নতুন উদ্যোগ। এ-সময় সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয় সিলেটের বিভিন্ন স্থানে। নানা বাধাবিপত্তি পেরিয়ে এদের অনেকগুলো ভালোভাবে টিকেও যায়। সেসব সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান থেকেও বিভিন্ন উপলক্ষ্যে বা কোনোপ্রকার উপলক্ষ্য ছাড়াই প্রকাশিত হয় বেশকিছু সাহিত্যপত্রিকা বা সাহিত্য-সংকলন। যেমন, ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘প্রগতি সংঘ’-এর উদ্যোগে মৌলভীবাজার থেকে নন্দলাল শর্মার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘স্মৃতিলিপি’। ১৯৭১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ‘সমস্বর লেখক ও শিল্পী সংস্থা’-র উদ্যোগে সিলেট থেকে কবি দিলওয়ারের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘সমস্বর’। ১৯৭৯ সালে ‘সিলেট একাডেমি’ মুহম্মদ আসাদ্দর আলীর সম্পাদনায় প্রকাশ করে ‘সিলেট একাডেমি পত্রিকা’।
এইসব সাহিত্যপত্রিকা আর সাহিত্য-সংকলনের পরেই আসে লিটলম্যাগ! ষাটের দশকে শুরু হয়ে সত্তুরের দশকে লিটলম্যাগ ব্যাপারটা ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় খুব জমে ওঠে। সিলেটেও এসে লাগে তার হাওয়া। একটি-দুটি করে লিটলম্যাগ প্রকাশিত হতে শুরু করে সে-সময় সিলেট বিভাগেও। ১৯৭৭ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে সিলেট থেকে প্রকাশিত হয় আবু বকর মোহাম্মদ হানিফের সম্পাদনায় গল্প নিয়ে ‘মাস্তুল’ এবং রফিকুর রহমান লজুর সম্পাদনায় কবিতা নিয়ে ‘ঈষাণ’। ‘মাস্তুল’-এর চারটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। ‘ঈষাণ’-এর প্রথম সংখ্যায় শুধু কবিতা থাকলেও পরের সংখ্যাগুলোতে গল্প-প্রবন্ধও ছিল।
লিটলম্যাগের জন্য সিলেট বিভাগ তার জমজমাট সময়টা কাটিয়েছে আসলে নব্বইয়ের দশকে। নব্বইয়ের দশকে সিলেট বিভাগ থেকে প্রকাশিত লিটলম্যাগগুলোর মধ্য থেকে সব বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় নিয়ে ভালো লিটলম্যাগ যেমন পাওয়া যাবে, তেমনি এদের অনেকগুলোকেই সামগ্রিক বিচারে লিটলম্যাগ বলা যাবে না — এ-রকমও পাওয়া যাবে। কিন্তু, লিটলম্যাগের অনেক বৈশিষ্ট্যই যে সেসব ‘না-পাওয়া’দের মধ্যেও আছে, এটাও কিন্তু মানতে হবে। সীমিত অর্থে তাই সেগুলোকেও লিটলম্যাগ বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। এদের কেউ কেউ হয়তো কিছু ভালো, সৃজনশীল লেখা প্রকাশ করাকে গুরুত্ব দিয়েছিল; কেউবা আবার প্রথাবিরোধী, ব্যতিক্রমী কিছু সৃষ্টি প্রকাশ করতে চেয়েছিল। কিন্তু সবাই ছিল তারুণ্যে দীপ্ত, নতুনত্বে বিশ্বাসী এবং নতুন কিছু করতে আগ্রহী। পঞ্চাশের দশকে বাংলা ভাষায় লিটলম্যাগ চর্চা নিয়ে ‘লোকায়ত’-সম্পাদক আবুল কাশেম ফজলুল হকের বক্তব্যটিকে সিলেট বিভাগের নব্বইয়ের দশকের লিটলম্যাগ চর্চা সম্পর্কে দিব্যি চালিয়ে দেয়া যায়—
‘…কেউ জোর দিয়েছেন প্রতিবাদে, প্রতিরোধে, প্রথাবিরোধিতায়। কেউ জোর দিয়েছেন নতুনত্বে। কেউ জোর দিয়েছেন সৃজনশীলতায়। কেউ কেবল ভাঙতে চেয়েছেন, কেউ গুরুত্ব দিয়েছেন নবসৃষ্টিতে। কারো দৃষ্টি কেবল বর্তমানে, কারো দৃষ্টি ভবিষ্যতের দিকে। গতানুগতিতে অনীহ সকলেই। আমি মনে করি — লিটল ম্যাগাজিনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য তার সৃজনশীলতায় ও নবসৃষ্টির আন্দোলনে।’
সাহিত্যপত্রিকার জীবনদৈর্ঘ্য নিয়ে কাজী নজরুল ইসলামের কৌতূহলউদ্দীপক একটি উক্তি আছে, — ‘এ দেশে সাহিত্যপত্রিকার মৃত্যুর হার বাঙ্গালী শিশুর চেয়েও অধিক!’ লিটলম্যাগের ক্ষেত্রে কাজী সাহেবের এই উক্তিখানা আরো বেশি সত্য। নব্বইয়ের দশক বা তার পরবর্তী সময়ে সিলেটের লিটলম্যাগের একটা বড় অংশই ছিল ক্ষণজীবী। প্রথম বা দ্বিতীয় সংখ্যাটিই ছিল তাদের শেষ সংখ্যা। কিছু লিটলম্যাগ যাত্রা শুরু করে ভাঁজপত্র হিসেবে, কিংবা কয়েক পৃষ্ঠার সীমিত পরিসরে। এদের অনেকগুলিই পরে লেখা এবং প্রকাশনার মানে লিটলম্যাগ হিসেবে উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠে। কিছু লিটলম্যাগ আবার প্রথম সংখ্যা থেকেই পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাদের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়।
নব্বই দশকে সিলেটে লিটলম্যাগের এই উজ্জ্বল সময়ের পেছনে কারণ জানতে চাইলে কবি এবং ‘ঋতি’-সম্পাদক ফজলুলরহমান বাবুল জানান, —
“সৃষ্টিকর্তা জানেন, কি কারণে যেন সে–সময় সিলেটে একসাথে অনেক তরুণ কবি-সাহিত্যিকের আবির্ভাব ঘটে। তাদের কয়েকজন মিলে একেকটা গ্রুপের মতো ছিল — একসাথে বসে আড্ডা দিত, সাহিত্য চর্চা করত, কাগজ বের করত। সকালে আড্ডা দিতে শুরু করে রাত পর্যন্ত আড্ডাই দিত। এই আড্ডাতেই সব হতো — সাহিত্য চর্চা, কাগজ বের করার পরিকল্পনা। কী দিন যে ছিল! তোমাদের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়েও এ–সময় একদল ছেলেমেয়ে ছিল যারা সাহিত্যচর্চা করত।”
শখ করে সাহিত্য না, ‘সাহিত্য করার জন্য সাহিত্য’-মানসিকতা নিয়ে নব্বইয়ের দশকে সিলেটের বিভিন্ন বয়সের কিছু তরুণ-যুবক সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। এদের সাথে যোগ দেয় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী — জাহিদুল কবির, আলিফ হোসেন, ঋত, রেজাউল ইসলাম সুমন, পলাশ দত্ত, আবদুল্লাহ আল মামুন, জহিরুল ইসলাম, এমদাদ রহমান, নিখিল নীল, রানা, সাদিকুর রহমান, ফরহাদ, আবদুল্লাহ আল মামুন, সুব্রত সরকার, আনন্দ, মুক্তা রাণী ধর, জহির সিদ্দিকী, মুহম্মদ ইমদাদ প্রমুখ এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এদের কার্যক্রম শুধু বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ছিল না; তারা সিলেট শহরের অন্যান্য সাহিত্যমনাদের সাথে মিশতেন, অন্যদের লিটলম্যাগে লেখা দিতেন, নিজেরাও লিটলম্যাগ করতেন। এদেরই একজন কবি, লেখক ও ‘হরমা’-সম্পাদক মুহম্মদ ইমদাদ বলেন —
“সে–সময় অন্যরকম একটা সময় ছিল। সবাই মিলে একসাথে আড্ডা দিতাম, গান শুনতাম, ক্লাসিক সিনেমাগুলো দেখতাম, কবিতা-সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতাম। দেখা গেল কেউ–একজন হয়তো আড্ডায় একটা বিদেশী ম্যাগাজিন নিয়ে আসলো, কোনো বিদেশী লেখকের সাক্ষাৎকার ছাপিয়েছে। পড়ে মনে হলো অনুবাদ করা দরকার, সবাই লেগে পড়লাম অনুবাদে। দেখা গেল এক সাক্ষাৎকার তিন-চারজন মিলে অনুবাদ করছে — কেউ উপরের অংশ, কেউ মাঝের অংশ, কেউ শেষের অংশ। একদিকে আড্ডা চলছে, গান চলছে, আরেকদিকে অনুবাদ চলছে। একবসায় অনুবাদ শেষ। ভয়ঙ্কররকম উৎসাহ ছিল সবার।”
সাহিত্য করার এই তাড়নার পাশাপাশি সে-সময় লিটলম্যাগে লেখা প্রকাশ করার আরেকটা আদর্শগত ভিত্তিও কিন্তু ছিল। কবি, লেখক ও ‘মুনাজেরা’-র সম্পাদক মোস্তাক আহমাদ দীন বলেন, “বড়কাগজ বা দৈনিকে তো লেখা শুরু করেছি এই সেদিন। আমরা তখন দৈনিকে লিখতামই না। লেখা চাইলেও দিতাম না। কেন দিব? দৈনিক পত্রিকা ছিল খবরের কাগজ। তারা সাহিত্যকে গুরুত্বই দিত না। যারা সাহিত্যকে গুরুত্ব দেয় না, তাদেরকে লেখা কেন দিব? এখন বড়কাগজেও লিখি … লিখতে হয় … এখন তেমন লিটলম্যাগ কোথায় যে লিখব?”
কবি ও ‘ঘাস’-এর সম্পাদক নাজমুল হক নাজুর বক্তব্যও উপরের অন্যদের বক্তব্যের সাথে মিলে যায়, —
“নব্বই দশকে এখানে খুব লিটলম্যাগ হয়েছে, বিশেষ করে শুরু থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত। তখন সবাই ছোটকাগজ আর বড়কাগজের মধ্যে পার্থক্য করত। দুইটার গুরুত্ব, মান-মর্যাদা ছিল দুই রকম। ছোটকাগজে লেখা প্রকাশ করাটা ছিল গৌরবের, আনন্দের। তরুণ-যুবকরা গ্রুপওয়াইজ সাহিত্য চর্চা করত। একেকটা গ্রুপের আড্ডার জন্য একেকটা নির্দিষ্ট জায়গা ছিল। তারা কবিতা লিখত, কবিতা পড়ত, কাগজ বের করত। দেখা গেল আজ এই গ্রুপ কাগজ বের করেছে তো কাল আরেক গ্রুপের কাগজ বের হচ্ছে। একটা প্রতিযোগিতার মতো … সবার মাঝে আগ্রহ কাগজ সংগ্রহ করার … কে কি লিখছে দেখি তো … এখন তেমন হয় না। এখন তো মানুষ লেখা একটা চিন্তা করার আগেই ফেসবুকে দিয়ে দেয়।”
সংখ্যায়, মানে, বিষয়বৈচিত্র্যে, মৌলিকত্বে, তারুণ্যে ও প্রতিবাদী মানসিকতায় নব্বইয়ের দশকের লিটলম্যাগগুলো ছিল উজ্জ্বল। এ-সময়ের বেশিরভাগ লিটলম্যাগ ছিল আসলে সাহিত্যপত্র; আরো নির্দিষ্ট করে বললে কবিতাপত্র।নব্বইয়ের দশকে সিলেট জেলার পাশাপাশি সুনামগঞ্জেও লিটলম্যাগের কাজ হতে থাকে। শূন্য দশকে লিটলম্যাগ বেশি হয় সিলেটে ও মৌলভীবাজারে। এ-দশকে সিলেট জেলা থেকে প্রকাশিত লিটলম্যাগগুলো ছিল আগের চেয়ে আরো বেশি মৌলিক ও বিশ্লেষণপ্রবণ। এদের বেশিরভাগই অবশ্য কবিতাকেন্দ্রিক। বুদ্ধিভিত্তিক ও যুক্তিচর্চা বিষয়েও লিটলম্যাগ প্রকাশিত হয় এই সময়ে। শূন্য দশকে মৌলভীবাজারের লিটলম্যাগগুলোতে গবেষণাধর্মী প্রবণতা দেখা যায়। মৌলভীবাজারের লিটলম্যাগগুলো বিশেষ সংখ্যা এবং ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে ভবিষ্যৎ গবেষণার জন্য পাথেয় রেখে যাচ্ছে সে-সময় থেকেই। এ-সময় মৌলভীবাজারের লিটলম্যাগগুলো সিলেটেরগুলোর চেয়ে তুলনামূলকভাবে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছিল। মৌলভীবাজারের লিটলম্যাগগুলোর আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রবণতা হচ্ছে, তারা সাহিত্যের পাশাপাশি শিল্পের বিভিন্ন শাখাকেও গুরুত্ব দিয়েছে। ‘সাহিত্যের লিটলম্যাগ’ হওয়ার চেয়ে ‘শিল্পসাহিত্যের লিটলম্যাগ’ হওয়ার প্রতি তাদের ঝোঁক ছিল বেশি। মৌলভীবাজারে নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক লিটলম্যাগ সিলেটের চেয়ে বেশ কম। উচ্চশিক্ষা, চাকুরী, ব্যবসা ইত্যাদি কারণে বিভাগের অন্যান্য জেলার অনেক লিটলম্যাগসম্পাদক ও উদ্যোক্তা বিভাগীয় শহর সিলেটে চলে আসলে সেসব জেলায়, বিশেষ করে সুনামগঞ্জে লিটলম্যাগ চর্চায় আগের তুলনায় বেশ ভাটা পড়ে। হবিগঞ্জে শুরু থেকেই লিটলম্যাগের কাজ তুলনামূলকভাবে কম হয়েছে। শূন্য দশকের শেষের দিকে এবং প্রথম দশকের শুরুতে জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক লিটলম্যাগউদ্যোক্তা সিলেট বিভাগ ছেড়ে ঢাকা বা দেশের অন্যান্য জায়গায় এবং বিদেশে অবস্থান করেন। একই সাথে এ-সময়ে তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের ফলে দেশের অন্যান্য জায়গার মতো পুরো সিলেট বিভাগেই লিটলম্যাগ কার্যক্রম সীমিত হয়ে আসে।
সাম্প্রতিক সময়ে সিলেট বিভাগে সংখ্যার বিচারে লিটলম্যাগ কম হলেও মানের বিচারে প্রকাশিত লিটলম্যাগগুলো প্রত্যাশা মেটাচ্ছে। সিলেট বিভাগের উল্লেখযোগ্য কিছু লিটলম্যাগের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক।
সিলেট জেলার উল্লেখযোগ্য কিছু লিটলম্যাগ
ভাস্কর : ১৯৯০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে পুলিন রায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় কবিতাবিষয়ক লিটলম্যাগ ‘ভাস্কর’ প্রথম সংখ্যা। সেই সংখ্যাটি সহ ভাস্করের পরের দুটি সংখ্যা ছিল ভাঁজপত্র। ভাস্করের দ্বাদশ সংখ্যা (এপ্রিল ১৯৯৪) থেকে সম্পাদক প্রতি সংখ্যায় তার বিবেচনামতো একজন করে নবীন সম্ভাবনাময় লিখিয়েকে পরিচয় করিয়ে দিতে শুরু করেন; যাদের অনেকেই আজ লেখালেখির জগতে সুনাম অর্জন করেছেন। গুচ্ছ কবিতা, দীর্ঘ কবিতা বা পাণ্ডুলিপির সাথে প্রকাশ করেন সম্ভাবনাময় সেই তরুণ কবির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়য়ের ছাত্র টি.এম. আহমেদ কায়সার ও তার কবিতাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে তিনি ভাস্করের এ-পর্বটি শুরু করেন, পরবর্তীকালে যা খুব প্রশংসিত হয়। ২০ বছর পূর্তি সংখ্যা প্রকাশিত হবার পরের বছর অর্থাৎ ২০১১ সালে রাজশাহী থেকে ‘ভাস্কর’ পায় ‘চিহ্ন লিটলম্যাগ সন্মাননা পুরস্কার’। ২০১৪ সালে প্রকাশিত ভাস্করের কবি দিলওয়ার সংখ্যাটি সুধীমহলে খুব প্রশংসিত হয়। সে-বছরই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ সংখ্যাটিকে রেফারেন্স বই হিসেবে সিলেবাসভুক্ত করে। “ভাস্কর করে আমার স্বীকৃতি দুটি। ‘চিহ্ন সন্মাননা পুরস্কার’ আর শাবি–র বাংলা বিভাগের সিলেবাসভুক্ত হওয়া।” — পুলিন রায় বলছিলেন। লিটলম্যাগ তো করে তরুণরা, এই মাঝবয়সে এসেও লিটলম্যাগ করার এত উৎসাহ পুলিন রায় পান কোথা থেকে? “আমিও আগে তা–ই ভাবতাম। ছোটকাগজ তরুণদের, তারাই করবে। ‘একবিংশ’-সম্পাদক খোন্দকার আশরাফ হোসেনকে দেখে আমার ভুল ভাঙে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন, মাঝবয়সেও ছোটকাগজ করেছেন। দুই বাংলা থেকে অনেক ভালো লেখা তিনি প্রকাশ করেছেন। তিনি বলতে গেলে আমার ছোটকাগজ করার আদর্শ। তাকে দেখেই সামনে এগিয়েছি। তাকে মনে করেই আমি উৎসাহ পাই।”
শুদ্ধস্বর : আহমেদুর রশীদ টুটুলের সম্পাদনায় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ সালে প্রকাশিত হয় সাহিত্যপত্র ‘শুদ্ধস্বর’। ‘শুদ্ধস্বর’-এর পঞ্চম সংখ্যাটি (ডিসেম্বর ১৯৯৩) হয় সবচেয়ে বেশি আলোচিত। সম্পাদকীয়তে সে-সংখ্যাটিকেই মৃত্যুসংখ্যা ঘোষণা দেয়া হয়। মৃত্যুঘোষণার পাশাপাশি এ-সংখ্যাটি আলোচিত হবার মূল কারণ এ-সংখ্যায় কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ারকে নিয়ে প্রকাশ করা হয় ক্রোড়পত্র। কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ারের নির্বাচিত কিছু লেখা প্রকাশের পাশাপাশি ছিল তাকে নিয়ে তিনজন কবির আলোচনা। তবে ক্রোড়পত্রের মূল আকর্ষণ ছিল কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ারের সাক্ষাৎকার। এ-রকম চমৎকার একটি সংখ্যা প্রকাশের সাথে সাথে ‘শুদ্ধস্বর’-এর মৃত্যুঘোষণা পাঠকদেরকে কষ্ট দিয়েছিল। পরবর্তীকালে (ফেব্রুয়ারি ২০০১ সালে) অবশ্য ঢাকার মিরপুর থেকে ‘শুদ্ধস্বর’-এর ৬ষ্ঠ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় এবং ‘শুদ্ধস্বর’ এখন প্রায় নিয়মিতভাবেই প্রকাশিত হচ্ছে। আহমেদুর রশীদ টুটুল এই লিটলম্যাগের নামেই ঢাকায় একটি প্রকাশনী সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন, যা আজ স্বনামে ধন্য।
গ্রন্থী : ১৯৯৩ সালে শামীম শাহানের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় শিল্প-সাহিত্যের কাগজ ‘গ্রন্থী’। গল্প, অনুবাদ-গল্প, কবিতা, অনুবাদ-কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ-প্রবন্ধ, গান, গ্রন্থপরিচিতি, শিল্পকলা ইত্যাদি নিয়ে প্রকাশিত ‘গ্রন্থী’ পাঠকপ্রিয়তা পায়। দুটি সংখ্যাই প্রকাশিত হয় ‘গ্রন্থী’-র। সুসম্পাদনা ও পরিকল্পিত প্রকাশের কারণে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল ‘গ্রন্থী’। গ্রন্থী চট্টগ্রাম থেকে পেয়েছে ‘লিরিক লিটলম্যাগ সন্মাননা পুরস্কার’।
প্যারাডাইম : ১৯৯৪ সালে নাসিমুল হক, সারওয়ার চৌধুরী, টি এম আহমেদ কায়সার এবং আহমদ মিনহাজের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সাহিত্যপত্র ‘প্যারাডাইম’। এর একটি সংখ্যাই প্রকাশিত হয়।
নদী পাখি মেঘ : গল্প, কবিতা, গুচ্ছকবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ ইত্যাদি নিয়ে ১৯৯৪ সালে হেলাল উদ্দিন চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘নদী পাখি মেঘ’। এর একটি সংখ্যাই প্রকাশিত হয়েছে।
ঋতি : ‘চলমান সময়ের কবিতাচিন্তন’ স্লোগ্যান নিয়ে ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয় কবিতাপত্র ‘ঋতি’। সম্পাদক ফজলুলরহমান বাবুল। ‘ঋতি’-র মোট পাঁচটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। সর্বশেষ প্রকাশিত হয় ২০০০ সালে। প্রথম সংখ্যায় কবিতার আধিক্য ছিল। পরের সংখ্যাগুলোতে কবিতার পাশাপাশি কবিতাবিষয়ক গদ্য ও প্রবন্ধ সমান গুরুত্বে প্রকাশিত হয়েছে। ‘ঋতি’ সে-সময় খুব জনপ্রিয় ছিল। বিশেষ করে পত্রিকাটি ঘিরে তরুণদের আগ্রহ ছিল তুঙ্গে। সে-সময় দুই বাংলার প্রতিষ্ঠিত-অপ্রতিষ্ঠিত, নবীন-প্রবীণ অনেকের লেখাই স্থান পেয়েছে ‘ঋতি’-র দুই মলাটের ভেতরে।
প্রতিশ্রুতি : একই বছর প্রকাশিত হয় ‘প্রতিশ্রুতি’ এবং আলোচিত হয়। সাহিত্য-সমাজ-অর্থনীতি ও সংস্কৃতির উন্নয়নভাবনা বিষয়ক এই লিটলম্যাগটির একটি সংখ্যাই প্রকাশিত হয়। বিষয়বৈচিত্র্যে সে-সময়ের ব্যতিক্রমী এই লিটলম্যাগটির সম্পাদক ছিলেন যৌথভাবে মো. আবদুল আজিজ, মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান, মোহাম্মদ আবুল বশর, শুভেন্দু ইমাম, তাজুল মোহাম্মদ ও আফতাব হোসেন।
খোয়াব : ১৯৯৬ সালে ‘খোয়াব’ প্রকাশিত হয় হাবিবুর রহমান এনারের সম্পাদনায়। পরপর দুটি সংখ্যা প্রকাশিত হয় শুধু কবিতা নিয়ে। খোয়াবের তৃতীয় সংখ্যায় গল্প-কবিতার পাশাপাশি বাউলগানের উপর একটি ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়। ছিল বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমকে নিয়ে আলাদা আয়োজন; সম্ভবত কোনো লিটলম্যাগে এই প্রথমবারের মতো শাহ আবদুল করিমকে এত গুরুত্ব দেয়া হয়। সে-সংখ্যায় আহমদ মিনহাজের ‘বাউল গান : একটি মধ্যবিত্ত ভাবনা’ শীর্ষক প্রবন্ধটি খুব আলোচিত হয়।
ঘাস : ১৯৯৭ সালের মে মাসে নাজমুল হক নাজুর সম্পাদনায় শুধু কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘ঘাস’। দ্বিতীয় সংখ্যা থেকে কবিতার সাথে যুক্ত হয় কবিতাবিষয়ক গদ্য ও প্রবন্ধ। ‘ঘাস’ মোট পাঁচটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। সর্বশেষ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় এই সেদিন — ডিসেম্বর ২০১৫ সালে। দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদে প্রকাশিত এ-সংখ্যায় ছিল কবিতা, অনুবাদ-কবিতা, কবিতাবিষয়ক গদ্য ও কবিতার বইয়ের আলোচনা।
পাঠকৃতি : ‘পাঠকৃতি’-র মাত্র দুটি সংখ্যা প্রকাশিত হলেও দুটি সংখ্যাতেই তরুণদের সুনির্বাচিত কবিতা, তপোধীর ভট্টাচার্যের প্রবন্ধ, আহমদ মিনহাজের প্রবন্ধ, প্রথম সংখ্যায় তপোধীর ভট্টাচার্যের একগুচ্ছ কবিতা এবং দ্বিতীয় সংখ্যায় শেখ লুৎফরের লেখা ‘উলটারথে’ গল্পটির কারণে ‘পাঠকৃতি’ পাঠকমনে জায়গা করে নিয়েছে। শুভেন্দু ইমামের সম্পাদনায় ২০০০ সালে প্রকাশিত হয় ‘পাঠকৃতি’র প্রথম সংখ্যা।
অর্কিড : ২০০০ সালে সৈয়দ আফসারের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘অর্কিড’। এখন পর্যন্ত অর্কিডের আটটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। অর্কিড মূলত কবিতা ও কবিতাবিষয়ক গদ্য প্রকাশ করে থাকে। কিছু সংখ্যায় অবশ্য গল্পও প্রকাশিত হয়েছে। ‘অর্কিড’-এর তৃতীয় সংখ্যায় পশ্চিমবঙ্গের নিভৃতচারী কবি নির্মল হালদারের উপর একটি অঘোষিত ক্রোড়পত্র ছাপা হয়। অষ্টম সংখ্যায় সিলেটের অকালপ্রয়াত কবি সৈয়দ নীরবের একগুচ্ছ কবিতার পাশাপাশি তাকে নিয়ে তিনজনের স্মৃতিকথা প্রকাশ করে ‘অর্কিড’। সত্যজিৎ রাজনের আঁকা কবি সৈয়দ নীরবের একমাত্র পোর্ট্রেটটিও স্থান পায় এ-সংখ্যায়।
চর্চা : ২০০০ সালের জুনে সাদিকুর রহমানের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় যুক্তি-ও-তত্ত্ববিষয়ক কাগজ ‘চর্চা’।
সূনৃত : সুপরিকল্পিত, গোছানো, রুচিশীল — সিলেটের অন্যতম একটি লিটলম্যাগ ‘সূনৃত’ সম্পর্কে এর সবটাই খাটে। ‘সুকুমার চেতনার অনুরণন’ স্লোগ্যান নিয়ে ২০০০ সালের অক্টোবরে সূনৃতের প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এখন পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে মোট আটটি সংখ্যা। শুধু কবিতা নিয়ে সর্বশেষ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে। কী বহরে, কী বিষয়ে — ‘সূনৃত’ প্রতি সংখ্যায় বৈচিত্র্যময়। ৭০ পৃষ্ঠার ‘সূনৃত’ যেমন হয়েছে, আবার সাড়ে ছয়শ পৃষ্ঠার ‘সূনৃত’ও হয়েছে। অষ্টম সংখ্যাটি বাদে অন্য সব সংখ্যার বিষয়বৈচিত্র্য চোখে পড়ার মতো। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, অনুবাদ, সাক্ষাৎকার, বইপত্রের আলোচনা, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র, গান, সাক্ষাৎকার, পাণ্ডুলিপি — সবই প্রকাশ করেছে ‘সূনৃত’। বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে ‘সূনৃত’, তৃতীয় সংখ্যায় যেমন ছিল আহমদ ছফা উপজীব্য করে একটি বিশেষ আয়োজন।
সহবাস : হাসান মোরশেদের সম্পাদনায় ২০০০ সালে প্রকাশিত হয় গল্পবিষয়ক লিটলম্যাগ ‘সহবাস’। এ-পর্যন্ত চারটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। গল্প ও গল্পবিষয়ক প্রবন্ধই মূলত প্রকাশিত হয়েছে কাগজটিতে।
বুনন : ২০০১ সালে খালেদ উদ-দীনের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘বুনন’। প্রথম সংখ্যাটি ছিল গল্পের সমাহার। বেশকিছু ভালো গল্প প্রকাশিত হয় সংখ্যাটিতে। ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয় বুননের দ্বিতীয় সংখ্যা। এ-সংখ্যায় গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প-অনুবাদ ও সাক্ষাৎকার-অনুবাদ প্রকাশিত হয়।
অভিমত : মুক্তাদির আহমদ মুক্তার সম্পাদনায় ২০০১ সালে প্রকাশিত হয় ‘অভিমত’। অভিমতের শাহ আবদুল করিমের উপর বিশেষ সংখ্যাটি আলোচিত হয়। অভিমতের বেশকিছু সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে।
জারুল : ২০০১ সালে কাজী জিননূরের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় কবিতাপত্র ‘জারুল’। ২০০২ সালে ‘জারুল’-এর দ্বিতীয় এবং শেষ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়। দু-সংখ্যাতেই তরুণ কবিদের নির্বাচিত কবিতা স্থান পেয়েছে।
ছায়ালাপ : আবিদ ফায়সালের সম্পাদনায় ২০০৩ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহে প্রকাশিত হয়েছে কবিতার ভাঁজপত্র ‘ছায়ালাপ’। ‘ছায়ালাপ’-এর প্রতি পঞ্চাশ সংখ্যার উল্লেখযোগ্য লেখা নিয়ে প্রকাশ করা হতো একটি করে সংকলন।
হরমা ৩১০০ : সুরমার আদি নাম ‘হরমা’, এবং ৩১০০ হচ্ছে সিলেটের পোস্টাল কোড। দুয়ে মিলে ‘হরমা ৩১০০’। সৈয়দ কামরুজ্জামানের সম্পাদনায় ২০০৬ সালের জুলাই মাসে এর প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়। কবিতাই বেশি ছিল; কবিতার সাথে ছিল অল্প কয়েকটি গল্প ও গদ্য।
যুক্তি : অনন্তবিজয় দাশের সম্পাদনায় ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয় বিজ্ঞান, বুদ্ধি ও যুক্তি চর্চা বিষয়ক লিটলম্যাগ ‘যুক্তি’। মোট তিনটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞানচর্চা ও প্রগতিশীল মানসিকতা ছড়িয়ে দেয়াই ছিল এ-পত্রিকার মূল লক্ষ্য।
হরমা : আবুল হাসনাতের সম্পাদনায় ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয় ‘হরমা’-র প্রথম সংখ্যা। মুক্তগদ্য-গল্প-কবিতার পাশাপাশি দশজন কবি, লেখক, লিটলম্যাগ সম্পাদকের ‘ছোটকাগজ ভাবনা’ প্রকাশ করে সংখ্যাটি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ‘হরমা’-র দ্বিতীয় সংখ্যার (ফেব্রুয়ারি ২০০৯) সম্পাদক মুহম্মদ ইমদাদ। এ-সংখ্যাটিও আলোচনায় আসে তরুণদের ‘রবীন্দ্রনাথ ভাবনা’ প্রকাশ করে। ‘তরুণ কবির রবীন্দ্রনাথ দেখতে কেমন? রবীন্দ্রনাথের কবিতা তাকে স্পর্শ করে? আমরা কি খুঁজে পাই আমাদের আশ্রয় তার লেখায়? তার গান কি আমাদের অস্থির জীবনে কোনো দাগ কাটে?’ — এ-রকম বেশকিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে নয়জন তরুণ কবি-লেখকের লেখায়। হরমা-র দুটি সংখ্যাই প্রকাশিত হয়েছিল।
প্রিটোরিয়া : ‘জারুল’-সম্পাদক কাজী জিননূরের সম্পাদনায় ২০০৮ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত হয় কবিতা নিয়ে লিটলম্যাগ ‘প্রিটোরিয়া’। ‘প্রিটোরিয়া’-র একটি সংখ্যাই প্রকাশিত হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রিটোরিয়াতে সম্পাদকের নাম লেখা হয় জিননূরেশ্বরী!
মুনাজেরা : সাম্প্রতিক সময়ে সিলেটের সবচেয়ে আলোচিত লিটলম্যাগের নাম বলতে বললে বেশিরভাগ মানুষ ‘মুনাজেরা’-র নাম বলবেন। মোস্তাক আহমাদ দীন সম্পাদিত এই লিটলম্যাগটি দেখতে সাদামাটা ধরনের, পৃষ্ঠাও খুব বেশি নয়। প্রচ্ছদে, কাগজের মানে ঝকঝকে চকমারি ব্যাপার এতে নেই; ‘মুনাজেরা’-র মূল আকর্ষণ তার বিষয়বৈচিত্র্য, প্রকাশনার নিজস্ব ধাঁচ আর লেখার মান। “আমি একটা উদ্দেশ্য নিয়ে, আদর্শগত জায়গা থেকে লিটলম্যাগ করি। আমার যদি অনেক অনেক টাকাও থাকে মুনাজেরার প্রচ্ছদ চার রঙে হবে না, কাগজ উন্নতমানের দামী হবে না।” — মুনাজেরাসম্পাদক বলছিলেন। ২০০৮ সালের এপ্রিলে মুনাজেরার প্রথম সংখ্যা প্রকাশের পর ২০০৯, ২০১১ এবং ২০১৪ সালে আরো তিনটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। ‘মুনাজেরা’ মূলত কবিতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার কাগজ। মুনাজেরাকে বোঝার জন্য প্রথম সংখ্যায় কি কি প্রকাশিত হয়েছিল সেটা জানা যেতে পারে : সাতজন লেখক-কবি তাদের প্রত্যেকের প্রিয় একটি করে কবিতা নিয়ে আলোচনা করেছেন, একজন কবি তার নিজের একটি কবিতা নিয়ে আলোচনা করেছেন (কবি তার কোন কবিতা নিয়ে আলোচনা করবেন সেটা সম্পাদক-নির্বাচিত), পুনর্মুদ্রিত হয়েছে ফালগুনী রায়-এর কবিতা ‘কৃত্রিম সাপ’ নিয়ে উৎপলকুমার বসুর আলোচনা এবং রামকিঙ্করের সঙ্গে শোভন সোমের সাক্ষাৎকার। পরের সংখ্যাগুলোতে এই পর্বগুলোর পাশাপাশি কবিতাবিষয়ক প্রবন্ধ ও প্রবন্ধের অনুবাদ, কবিতার বই আলোচনা, অনুবাদ-কবিতা, গান এবং চিত্রশিল্প বিষয়ক কিছু লেখাও যুক্ত হয়।
সুরমস : সিলেট থেকে প্রকাশিত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ লিটলম্যাগ জফির সেতু সম্পাদিত ‘সুরমস’। সুসম্পাদনা, বিষয়বৈচিত্র্য আর মার্জিত রুচির কারণে কাগজটি সুনাম কুড়িয়েছে। ২০১০ (বর্ষা ১৪১৭) সালে সুরমসের প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। কবিতাকেন্দ্রী এই কাগজে ছিল সমকালের দশজন কবির পাঁচটি করে নির্বাচিত কবিতা, কবিতাবিষয়ক প্রবন্ধ, কবিতার অনুবাদ, কবিতাবিষয়ক প্রবন্ধের অনুবাদ, কবিতার বইয়ের আলোচনা এবং একটি গান। ২০১৪ (শীত ১৪২১) সালে প্রকাশিত হয় সুরমসের দ্বিতীয় সংখ্যাটি। এ সংখ্যায় এসে লিটলম্যাগটি কবিতা ও কবিতা-অনুবাদ পুরোপুরি বাদ দিয়ে কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ-গদ্য-আলোচনাকেই প্রাধান্য দেয়। এ-সংখ্যায় ছিল কবিতাবিষয়ক প্রবন্ধ, প্রবন্ধের অনুবাদ, প্রিয় কবিতার আলোচনা, কবিতাভাবনা ও নিজের কবিতা সম্পর্কে আলোচনা এবং লোরকার কিছু চিঠির অনুবাদ; সাথে প্রকাশিত হয় শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক আরও দু-একটি লেখা।
কথা পরম্পরা : অল্পকিছু পৃষ্ঠায় ট্যাবলয়েড পত্রিকার আকারে জফির সেতুর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় বিজ্ঞান, বুদ্ধি ও যুক্তি চর্চা বিষয়ক লিটলম্যাগ ‘কথা পরম্পরা’। একই নামের একটি পাঠকগোষ্ঠী লিটলম্যাগটি প্রকাশ করে। প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। এখন পর্যন্ত মোট চারটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে।
পলিমাটি : শিব্বির আহমদ ও বাশিরুল আমিনের যৌথ সম্পাদনায় ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয় ‘পলিমাটি’। এখন পর্যন্ত মোট পাঁচটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম দুটি সংখ্যা ছিল ভাঁজপত্র।
গান্ধারী : ঝিলিক খায়রুননিসার সম্পাদনায় সেপ্টেম্বর ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় কবিতা ও কবিতাবিষয়ক গদ্যের কাগজ ‘গান্ধারী’-র প্রথম সংখ্যা।
দইয়ল : সুমনকুমার দাশের সম্পাদনায় ১৬ অক্টোবর ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় ‘দইয়ল’ প্রথম সংখ্যা। “…দইয়ল অর্থাৎ দোয়েল, আমাদের জাতীয় পাখি। পাখির নামে গানের কাগজের নাম! পাখি যেমন গান গায় মনের আনন্দে, তেমনি এ কাগজও আপন স্বভাবগুণে গান নিয়ে নানান লেখকের ভাবনা-চিন্তা প্রকাশ ঘটাবে অব্যাহতভাবে…” (সম্পাদকীয়, ‘দইয়ল’)। সাহিত্যতাত্ত্বিক তপোধীর ভট্টাচার্য, কলকাতা দূরদর্শনের সাবেক ঘোষিকা শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্ত, অধ্যাপক স্বপ্না রায় সহ একুশজনের ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের ২১টি লেখা সংকলিত হয়েছে এই সংখ্যায়।
প্রাণস্রোত : পলাশ দত্তের সম্পাদনায় ‘প্রাণস্রোত’-এর মোট চারটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। ‘কবিতাবিষয়ক বিকল্প কাগজ’ স্লোগ্যান নিয়ে প্রকাশিত এই লিটলম্যাগের সর্বশেষ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ২০০২ সালের জুলাইতে। সুসম্পাদনা ও ভালো কিছু লেখা প্রকাশ করার জন্য ‘প্রাণস্রোত’ পাঠকহৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে।
লোকন : ওয়ালি মাহমুদের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সাহিত্যের ছোটকাগজ ‘লোকন’। এখন পর্যন্ত এর চারটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। ‘লোকন’ বেশ বড় আকারে প্রকাশিত হয়। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, পাণ্ডুলিপি, অনুবাদ সবই প্রকাশিত হয় এক-মলাটের ভেতরে।
মণিপুরী ভাষার লিটলম্যাগ
সাহিত্য-সংস্কৃতিমনা কয়েকজন উৎসাহী মণিপুরী যুবক ১৯৭৫ সালে গড়ে তোলেন ‘বাংলাদেশ মণিপুরি সাহিত্য সংসদ’। মণিপুরী ভাষা ও সাহিত্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব এ.কে. শেরামকে কেন্দ্র করে সংগঠনটি এখনও মণিপুরী ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে কাজ করে যাচ্ছে। এর প্রভাবে সিলেট জেলা ছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় আরো কিছু মণিপুরী সাহিত্যবিষয়ক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ‘বাংলাদেশ মণিপুরি সাহিত্য সংসদ’ যে-বছর প্রতিষ্ঠিত হয় সে-বছরের ১৬ ডিসেম্বরে এ.কে. শেরামের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘দীপান্বিতা’। ‘দীপান্বিতা’-র মোট চৌদ্দটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে ‘দীপান্বিতা’ ১৯৮৮ সালের ১১ এপ্রিল থেকে ‘মৈরা’ নামে প্রকাশিত হতে থাকে। এ.কে. শেরামের সম্পাদনায় ‘মৈরা’ নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত এর পঞ্চাশটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। ‘দীপান্বিতা’ এবং ‘মৈরা’-র প্রভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে পরবর্তীকালে বিভিন্ন মণিপুরী ব্যক্তির উদ্যোগে প্রকাশিত হয়েছে বেশকিছু শিল্প-সাহিত্যের কাগজ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : ইপোম, শজিবু, মৈঙাল, ইঙ্খোল, শায়োন ও ঔগ্রী।
সনাতন হামোম, খোইরোম ইন্দ্রজিৎ, কন্থৌজম সুরঞ্জিত প্রমুখের যৌথ সম্পাদনায় ১৯৯০ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় ‘ইপোম’।এর মোট দশটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। ‘শজিবু’ প্রকাশিত হয় শেরাম নিরঞ্জনের সম্পাদনায় ১৯৯২ সালের এপ্রিলে। সর্বমোট প্রকাশিত সংখ্যা দশটি। ‘শজিবু’ বেশ কয়েকটি কবিতাসংখ্যা ও গল্পসংখ্যা প্রকাশ করেছে। মংগেথাবা-র সম্পাদনায় ‘ঔগ্রী’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৯ সালে। এখন পর্যন্ত ‘ঔগ্রী’র তিনটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। এম.ইউ.কে. সাধনের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘মৈঙাল’ (২০০৩); আর ‘ইঙ্খোল’ (২০০৪) প্রকাশিত হয় নামব্রম শংকরের সম্পাদনায়। ‘মৈঙাল’-এর তিনটি ও ‘ইঙ্খোল’-এর চারটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৩ সালে হামোম প্রবিত-এর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘শায়োন’। এখন পর্যন্ত ‘শায়োন’-এর মোট প্রকাশিত সংখ্যা দুটি।
হবিগঞ্জের উল্লেখযোগ্য কিছু লিটলম্যাগ
বিভিন্ন সময়ে হবিগঞ্জ থেকে প্রকাশিত হয়েছে এম.এ. রব সম্পাদিত ত্রৈমাসিক কাগজ ‘শ্বেতপায়রা’, আহমেদ রাসেল সম্পাদিত ‘খোলা জানালা’, সুমন আজাদ সম্পাদিত কবিতার কাগজ ‘বটতলা, অপু চৌধুরী সম্পাদিত ‘বিবিয়ানা, পার্থসারথি রায় সম্পাদিত ‘পূজা ও যাত্রা’ ।
সুনামগঞ্জের উল্লেখযোগ্য কিছু লিটলম্যাগ
নগরবাউল : নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে সুনামগঞ্জ থেকে প্রকাশিত হয় সোহেল আহমদ খান সম্পাদিত ‘নগরবাউল’।
বিকাশ : নগরবাউলের কাছাকাছি সময়ে প্রকাশিত হয় মোস্তাক আহমাদ দীন সম্পাদিত কবিতাপত্র ‘বিকাশ’। কবিতা ও কবিতাবিষয়ক গদ্য প্রকাশিত হতো বিকাশে। এর মোট পাঁচটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। বিকাশের সর্বশেষ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালে।
ভিন্নায়ন : শ্যামসুন্দর দে রাধেশ্যামের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘ভিন্নায়ন’-এর একমাত্র সংখ্যাটি। তরুণদের মানসম্মত গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ প্রকাশ করে সংখ্যাটি পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে।
এ-দশকে আরো প্রকাশিত হয় এনামুল কবিরের সম্পাদনায় কবিতাপত্র ‘জলসা’, সৈয়দ মুহাদ্দিস আহমদের সম্পাদনায় ‘ভাটির কথা’, মাসুক ইবনে আনিসের সম্পাদনায় ‘আদি কাকতাড়ুয়া’, সিরাজ উদ্দিনের সম্পাদনায় ‘নলজুর’ এবং আব্দুল মালিক আহমদের সম্পাদনায় ‘অঙ্গন’।
ভিন্নমুখ : শূন্য দশকে সুনামগঞ্জ থেকে প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ লিটলম্যাগের মধ্যে আছে সেজুল হোসেনের সম্পাদনায় ‘ভিন্নমুখ’। এর একটি সংখ্যাই প্রকাশিত হয়।
গন্দম : সুনামগঞ্জ থেকে প্রকাশ-পাওয়া আলোচিত একটি লিটলম্যাগ মালেকুল হক সম্পাদিত ‘গন্দম’ (প্রথম প্রকাশ, ২০০৫)।‘গন্দম’-এর মোট চারটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম তিনটি সংখ্যা সুনামগঞ্জ থেকে এবং শেষটি (২০০৮) সিলেট থেকে। ‘গন্দম’-এর প্রকাশনা বৈচিত্র্যময়; এটি মূলত বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার কাগজ। প্রথম তিনটি সংখ্যায় সমাজ, রাষ্ট্র, দর্শন বিষয়ে লেখা প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম সংখ্যায় গল্পও ছিল। কিন্তু চতুর্থ সংখ্যাটি ছিল কবিতাসংখ্যা। গুরুত্বপূর্ণ এ-সংখ্যায় ছিল একাধিক কবির একাধিক কবিতা, কবিদের কবিতাভাবনা, কবিদের সাক্ষাৎকার, অনুবাদ-কবিতা এবং চারজন লিটলম্যাগ সম্পাদকের সাক্ষাৎকার। গন্দমের আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য — ‘তারুণ্যের দ্রোহ’ বলে যে-একটা ব্যাপার আছে সেটা গন্দমের প্রতিটি সংখ্যার বিভিন্ন পৃষ্ঠায় ছড়িয়েছিটিয়ে আছে; অলঙ্করণে, ছবিতে, লেখায়, কবিতায়, সাক্ষাৎকারের প্রশ্নে!
চৈতন্য : ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজীব চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সাহিত্যপত্র ‘চৈতন্য’-এর প্রথম সংখ্যা। দ্বিতীয় (ফেব্রুয়ারি ২০০৭) এবং তৃতীয় (ফেব্রুয়ারি ২০০৮) সংখ্যা দুটি প্রকাশিত হয় সুনামগঞ্জ থেকে। রাজীব চৌধুরী আরো দুইজনের সাথে যৌথভাবে ২০১৩ সালে এই ছোট কাগজের নামেই সিলেটে প্রতিষ্ঠা করেন প্রকাশনী সংস্থা ‘চৈতন্য’। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে সিলেট থেকে প্রকাশিত হয় চৈতন্যের চতুর্থ সংখ্যা। দুই ফর্মার এই সংখ্যাটি আগের তিনটি সংখ্যার থেকে বহরে সবচেয়ে ছোট, কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ছোট্ট এই সংখ্যায় ছিল কবিতাবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রবন্ধ, টি.এস. এলিয়টের ‘নোবেল ভাষণের অনুবাদ’, আতানাস দালশেভ ও নেড ও’গোরম্যান-এর কবিতার অনুবাদ; আর একঝাঁক তরুণ কবির কবিতা তো ছিলই। এই সংখ্যায় ‘চৈতন্য’ তার লেখার বিষয়, প্রকাশকাল ও লক্ষ্য নিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছে — “…এখন থেকে নিয়মিতই ‘চৈতন্য’ প্রকাশিত হবে। থাকবে কবিতাবিষয়ক মৌলিক প্রবন্ধ, অনুবাদমূলক প্রবন্ধ ও কবিতা, কবিতা ও গ্রন্থালোচনা। নবপর্যায়ে চৈতন্যের প্রতি সংখ্যায় সংকলিত হবে ‘এ-সংখ্যার কবি’ নামে নতুন কবির গুচ্ছকবিতা। নতুনকে আবাহন জানানোই আমাদের লক্ষ্য।” (সম্পাদকীয়, ‘চৈতন্য’) পরের মাসে (অক্টোবর ২০১৪) প্রকাশিত চৈতন্যের পঞ্চম সংখ্যাটি ছিল আগের যে-কোনো সংখ্যার চেয়ে সমৃদ্ধ — কী লেখায়, কী প্রকাশনায়! তৌহিন হাসানের দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদে প্রকাশিত এ-সংখ্যায় ঝলমল করছিল ইমরাউল কায়েস, জালালউদ্দিন রুমি, সিমাস হিনি, নাটালিয়া গরভানেভস্কায়া, মায়া অ্যাঞ্জেলোর কবিতার অনুবাদ, হোর্হে লুইস বোরহসের সাক্ষাৎকার অনুবাদ, ছয়টি কবিতাবিষয়ক মৌলিক প্রবন্ধ, কবিতাবই পরিচিতি; আর সাথে ৩৭ জন তরুণ কবির কবিতা! চৈতন্যের ষষ্ঠ সংখ্যাটি আছে প্রকাশের অপেক্ষায়।
জাঙ্গাল : ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত হয় শামস শামীম সম্পাদিত ‘জাঙ্গাল’। ‘জাঙ্গাল’-এর মোট চারটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। সুসম্পাদনার জন্য পাঠকপ্রিয়তা পায় লিটলম্যাগটি।
ধানশি : মাহবুবুল হাসান শাহীনের সম্পাদনায় ২০০৮ সালে প্রকাশিত হয় কবিতার কাগজ ‘ধানশি’। মোট চারটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে ‘ধানশি’-র। সর্বশেষ প্রকাশিত হয় ২০১২ সালে।
সবুজ প্রান্তরে সোনার রোদ : শামস শামীমের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘সবুজ প্রান্তরে সোনার রোদ’। মোট দুটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে।
ভূমিজ : আহমদ ময়েজের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘ভূমিজ’। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, সংগীত, পাণ্ডুলিপি, বুকরিভিউ প্রকাশিত হয়েছে ‘ভূমিজ’-এর আওতায়।
মৌলভীবাজারের উল্লেখযোগ্য কিছু লিটলম্যাগ
শব্দপাঠ : আতাউর রহমান মিলাদের সম্পাদনায় ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত হয় শিল্প, সাহিত্য, নন্দনতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ক লিটলম্যাগ ‘শব্দপাঠ’-এর প্রথম সংখ্যা। প্রতিবছর একটি করে সংখ্যা প্রকাশিত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে ১৮টি সংখ্যা । সর্বশেষ প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালের আগস্টে।
স্রোতচিহ্ন : সুমন সুপান্থের সম্পাদনায় ২০০১ সালে প্রকাশিত হয় শিল্প, সাহিত্য, নন্দনতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ক লিটলম্যাগ ‘স্রোতচিহ্ন’। এর মোট তিনটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। সর্বশেষটি প্রকাশিত হয়েছে ২০০৫ সালে।
কোরাস : মুজাহিদ আহমদের সম্পাদনায় ২০০২ সালে প্রকাশিত হয় পূর্ণাঙ্গ সাহিত্যপত্র ‘কোরাস’। ‘কোরাস’-এর মোট আটটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। সর্বশেষ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে।
আলোছায়া : আহমদ আফরোজের সম্পাদনায় ‘আলোছায়া’ প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০২ সালে এবং সর্বশেষ প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালে। মোট প্রকাশিত সংখ্যা পাঁচটি।
ক্ষত্রিয় : সুমন তুরহানের সম্পাদনায় ২০০৩ সালের জুনে প্রকাশিত হয় ‘ক্ষত্রিয়’-এর একমাত্র সংখ্যাটি। গল্প, কবিতা, অনুবাদ ও কবিতা-আলোচনা ছিল সংখ্যাটিতে।
লেখাবিল : শিল্প, সাহিত্য, নন্দনতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ক লিটলম্যাগ লেখাবিলের সম্পাদক সামন্ত সাবুল এবং নির্বাহী সম্পাদক জয়নাল আবেদীন শিবু। লেখাবিলের প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে এবং সর্বশেষ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। মোট প্রকাশিত সংখ্যা ১৩টি। ‘লেখাবিল’ লোকসংস্কৃতি ও বাউল বিষয়ক সংখ্যা প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের সাহিত্যের প্রথম দশকের উপর একটি ক্রোড়পত্রও প্রকাশ করেছে ‘লেখাবিল’।
জলপাই : জাভেদ ভুঁইয়ার সম্পাদনায় ‘জলপাই’ প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০৫ সালে এবং সর্বশেষ প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে। মোট প্রকাশিত সংখ্যা ২টি।
দাহপত্র : ‘দাহপত্র’ নামে সৌরভ সোহাগের সম্পাদনায় লিটলম্যাগটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০৫ সালের অক্টোবরে এবং শেষ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে। মোট প্রকাশিত সংখ্যা তিনটি।
মনুস্বর : কাজল রশীদের সম্পাদনায় ‘মনুস্বর’ প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে এবং সর্বশেষ প্রকাশিত হয় অক্টোবর ২০১৫। ‘মনুস্বর’-এর মোট ছয়টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে।
খনন : আব্দুল খালিক ও দীপংকর মোহান্ত-এর সম্পাদনায় ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয় সাহিত্যের কাগজ ‘খনন’-এর প্রথম সংখ্যা। আলোচিত হয় খননের দ্বিতীয় সংখ্যাটি (ডিসেম্বর, ২০১৪)। এ-সংখ্যাটি ছিল সৈয়দ মুজতবা আলী সংখ্যা। তপোধীর ভট্টাচার্য, ড. আনিসুজ্জামান, সমীরণ চন্দ্র রায়, মধুমিতা ঘোষ, সুদীপ্তা মোহান্ত, ড. রামী চক্রবর্তী, মঈনুস সুলতান সহ প্রকাশিত হয় এগারোজনের লেখা। পুনর্মুদ্রিত হয় সৈয়দ মুজতবা আলীর একটি বেতার কথিকা, ‘সিলেটী মাত’ এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার পক্ষে যুক্তিতর্ক বিষয়ক দুটি প্রবন্ধ এবং তার পিতার আত্মজীবনীমূলক একটি লেখা।
মৃত্তিকা : কোরাসের সম্পাদক মুজাহিদ আহমদ জানালেন, “ওবায়দুর রহমান শালিকের সম্পাদনায় ‘মৃত্তিকা’ নামের একটি লিটলম্যাগের কাজ চলছে। এটা এ-বছরের মাঝামাঝি মার্চ/এপ্রিল নাগাদ বা শেষের দিকে প্রকাশিত হবে।”
আমার কথা
সিলেট বিভাগের লিটলম্যাগ নিয়ে এই লেখাটিকে কোনো অর্থেই পরিপূর্ণ বলা যাবে না; খসড়া কাজ বলা যেতে পারে। লিটলম্যাগ নিয়ে কাজ করা সব সময়ই কঠিন। এদেরকে কখনও একসাথে পাওয়া যায় না — না লাইব্রেরিতে, না বইয়ের দোকনে। একমাত্র ভরসা বিভিন্নজনের ব্যক্তিগত সংগ্রহ আর সংশ্লিষ্টদের সাথে সাক্ষাৎ। অনেক চেষ্টার পরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমি সংগ্রহ করতে পারিনি; হবিগঞ্জের লিটলম্যাগ সম্পর্কে বলতে গেলে কোনো তথ্যই পাইনি। সিলেটের লিটলম্যাগ নিয়ে এখনও তেমন-একটা কাজ হয়নি। ‘বাংলাদেশে লিটল ম্যাগাজিন চর্চা : অতীত ও বর্তমান’ বইতে সংকলিত মোস্তাক আহমাদ দীনের ‘বৃহত্তর সিলেটের কাগজ’ লেখাটি এই লেখার মূল ভিত্তি ছিল। আমি চেষ্টা করেছি মোস্তাক আহমাদ দীন যতটুকু করেছেন তার চেয়ে ভিন্ন কিছু করতে; যাতে ভবিষ্যতে আগ্রহী কেউ দুটি লেখা থেকে সহযোগিতা নিয়ে আরো ভালো কিছু করতে পারে। তথ্য কম থাকুক, কিন্তু কোনো তথ্যে যেন ভুল না থাকে সে-চেষ্টা করেছি। অনেক ভালো লিটলম্যাগের হয়তো শুধু নাম উল্লেখ করা হয়েছে, বিস্তারিত তেমন-কিছু লেখা হয়নি। এর মানে কিন্তু এই নয় যে আমি সেই লিটলম্যাগকে কম গুরুত্ব দিয়েছি; আসলে এর মানে সেই লিটলম্যাগটি সম্পর্কে আমি কম তথ্য জানি।
সিলেটের লিটলম্যাগ চর্চা তার সবটুকু মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে অব্যাহত থাকুক।
[রচনাকাল : ফেব্রুয়ারি ২০১৬]
কৃতজ্ঞতা স্বীকার :
আবিদ ফায়সাল, আহমদ সায়েম, এ. কে. শেরাম, চিংখৈ অঙোম, জফির সেতু, জয়নাল আবেদীন শিবু, জাহেদ আহমদ, নাজমুল হক নাজু, ফজলুলরহমান বাবুল, মালেকুল হক, মুজাহিদ আহমদ, মুহম্মদ ইমদাদ, মুহম্মদ শফিকুল ইসলাম, মেকদাদ মেঘ, মো. আবু বকর সিদ্দিক রনি, মোস্তাক আহমাদ দীন, রাজীব চৌধুরী, শামস শামীম, সুফি সুফিয়ান।
তথ্যসূত্র :
১. বাংলাদেশে লিটল ম্যাগাজিন চর্চা : অতীত ও বর্তমান – মিজান রহমান সম্পাদিত
২. বাংলাদেশে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন; আবু দায়েন