দোষোন্তরে । রাখাল রাহা
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ অক্টোবর ২০১৬, ১০:০৭ পূর্বাহ্ণ, | ২১৭৪ বার পঠিত
ঠিক সেদিন থেকেই রশীদের ঠনঠনে বালুঘাটে পুকুরটা দোষোন্তরে হয়ে গেল।
গ্রামে পুকুর আছে পাঁচ-সাতটা। জর্দ্দারগের শানবাঁধানো পুকুর, বিশ্বাসগের পাড়-না-থাকা মাটেলে পুকুর, মোল্লাগের পানা পুকুর, মণ্ডলগের পচাকাদা পুকুর, খাঁগের গোবরে পুকুর, ফিরু মিঞার সাহেবী পুকুর, আর রশীদের এই ঠনঠনে বালুঘাটে পুকুর। রশীদের পুকুরের বয়স বেশী না, তার বাপ বশীরের কাটা। খানের আমলে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় রাস্তার ওপারের তিরপুল্য ঘোষ দেশ ছাড়লে রাস্তার এপারে বাড়িঘেঁষা বিঘেদুই জমি বশীর একরকম এমনি-এমনিই পেয়ে যায়। পরের বছরই সে পুরো জমিটায় পাড়বাঁধিয়ে বেশ একটা মানানসই পুকুর কাটিয়ে ফেলে। কাটার সময় কোদালেরা বলেছিল, ছোট্ভাই, এত ঝরঝরে মাটির পুকোর জীবনে কাটিনি! কুদাল মারলিই ঝুড়ি ভর্তি!
কিন্তু ঝুড়ি ভরতে ভরতে কোদালেরা যখন হাত-বিশেক গভীর এক খাদ কেটে ফেলেও পানির দেখা না পায় তা দেখে বশীরের জান কেঁপে ওঠে। খাল কাই্টে কুমীর আনতিছি নে তো! দশ হাত গভীরিই তো আগে আমরা পানির দেখা পাইছি!
কোদালেদের মাথায় চিন্তা বাড়ে। পাতালনাগের মনে কি আছে তা আল্লাই জানে। চিন্তা ভুলতে তারা দুপুরে খাওয়ার সময় পাড়ে বসে ঢোল-সমুদ্দুর পুকুরের গল্প জোড়ে।
কাটলাম কাটলাম পুকোর আমি পোতাপাদিত্যর দ্যাশে
বাঁনলাম বাঁনলাম পাড়ি আমি ঢোল-সমুদ্দুর এসে
খুড়লাম খুড়লাম পাতাল আমি পাতালপুরী মিশে
তবু কার-বা দোষে সেই পাতালে পানি তো না আসে গো
পানি তো না আসে!
পানি পাওয়া যাবি বলে পাতালনাগ স্বপ্পন দেখায়। সাত-রাণী আর সত্তুর রাজপুত্র-রাজকই্ন্যা মিলে যদি নিশুতি রাত্তিরি ঢোলডগর নিয়ে উলঙ্গ হয়ে পুকুরি নাইবে নাচ-গান করতি পারে তবে গে পানি উটপি। রাজা তা-ই কইরলেন। আমাবস্যের রাত্তিরি নিকষ কালো আন্ধারে রাজা নাচে, রাণী নাচে, আর নাচে রাজপুত্র-রাজকই্ন্যা। ঢোলডগরের আওয়াজ চারপাশে পাড়িতি বাড়ি খায়ে কোন আকাশে উঠে যায়! উলঙ্গ মানুষ নাচতি নাচতি মাতাল হয়ে যায়। কখুন হঠাৎ মাটি ফাই্টে বগ বগ করে পানি উঠা শুরু করেছে টেরই পায়নি। আহা, সেই পানির এমন তোড় যে তারা আর পুকোরির মধ্যিত্তে উঠতি পারলো না! রাজা-রাণী, রাজপুত্র-রাজকই্ন্যা সব ডুবে মোলো!
—আরে না, তারা নাকি মরিউ নি! এখুনউ নাকি গভীর রাত্তিরি পুকোরির পাশ দিয়ে গেলি তাগের কান্দা শুনা যায়। মা কান্দে বাপের ধইরে, ভাই কান্দে বুনির ধইরে, রাজা কান্দে রাণীর ধইরে।
বশীর পাড়ে দাঁড়িয়ে হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে, ওরে এ মাটি আমি কি করতি কিনতি গেলাম তিরপুল্য ঘোষের কাছতে? ও শালা আমার কি বদ-দুয়া দিয়ে থুয়ে গেল রে?
হেড-কোদালে খাওয়া থুয়ে উঠে গিয়ে বশীরকে বোঝায়, ছোট্ভাই, এতো অস্থির হচ্ছো ক্যা? দ্যাখো পানি কাল সকালেই উঠপিনি। সিবার বিরামপুর গিরামে পুকোর কাটতি যাইয়ে পানি আর ওটে না। মালিক কয়, পানি উটোয়ে দিওয়া লাগবি। না হলি কুনো কোদালের হাজরে নেই। সে পুকোর হয়ে গেল তিরিশ-পঁয়ত্রিশ হাত গভীর! দেখে তো আমার জান কাঁপতি নাগলো। গরমের সুমায়। রাত্তিরি বেলায় সব কোদালে ঘোম। আমার আর ঘোম আসে না। পুকোরপাড়ে শুয়ে শুয়ে আল্লা-আল্লা করি। পাতালনাগের দুহাই পাড়ি। দেখি ব্যাঙ ডাই্কে উটলো হটাৎ। আমি কই, বিষ্টি-বাদলা নেই, শালার ব্যাঙ আসলো কোনতে? ডাই্কে তুললাম সব। লাইট মাইরে দেখি, পানি। সকাল হতি হতি তুমারগে অর্ধেক পুকোর ভরে গেল।
সেই ঢেউ বিলের মাঝের থেবড়ো রাস্তা দিয়ে ক’গ্রাম পরেই যখন প্রফুল্লর কানে পৌঁছে, সে পড়তে পড়তে ছুটে আসে। পুকুরের চারপাশ ধরে সে ঘুরতে থাকে। একদিন, দুদিন, প্রতিদিন। কোনো এক দোষোন্তরে যেন তাকে ঘাড়ে ধরিয়ে ঘোরাতে থাকে। সে ঘুরছে। হরিপুরের রথের মেলার বিশাল উঁচু রসিকলালের নাগরদোলা যেন। এত উঁচু নাগরদোলা সারা তল্লাটে নেই।
বশীরের চোখে ঝলমলে পানি খেলা করে। পানির বুক জুড়ে তেলতেলে মাছ। মাছের পেটভরা থলথলে ডিম। বশীর মাছ ধরে ধরে খালুই ভরে। চারপাড়ে নারকেল-সুপারীর সারি সারি গাছ। গাছের ছায়ায় পুকুরের পানি আন্ধার হয়ে থাকে। এমন স্বপ্ন তার সেই কবে ছোটবেলায় নানীবাড়ি গিয়ে ফরেন-সাহেবদের পুকুর দেখে দেখা! বেশ দূরে। তবু নানীবাড়ি গেলে চারদিক প্রাচীর দেওয়া নারকেল-সুপারী গাছের সাজানো সারির ওপাশের পুকুরের পানি আর বিশাল শানবাঁধানো ঘাট দেখার লোভ সে সামলাতে পারতো না। কোমরের গেঁজে খুলে সবচেয়ে বড় ডাগা আর চক্রাবক্রা মার্বেলগুলো মামাতো ভাই খবিরকে দিয়ে রাজী করিয়ে তার সাথে তিন-চার মাইল পথ পায়ে হেঁটে সে পৌঁছাতো হাজরামণি গ্রামে। প্রাচীরের ভাঙা ইট খুঁজে খুঁজে তাতে পা দিয়ে সে উপরে উঠতো। ফরেন-সাহেবরা ফরেনে থাকে। এখানে তাদের একঘর গরীব কুটুম আছে, সে বাড়ি দেখাশোনা করে। কারো ভিতরে ঢোকার অনুমতি নেই। বশীর একবার প্রাচীরের উপর থেকে লাফ দিয়ে ভিতরে নেমে পিচ্ছিল শ্যাওলাপড়া শানবাঁধানো ঘাটে গিয়ে বসেছিল। সেই কালচে-সবুজ পানিতে পা ডুবিয়ে শিউরে উঠতেই ঘাটের উপর পাহারাদার দেখে সেই-যে জান হাতে নিয়ে দৌড়ে প্রাচীর পার হয়েছিল সেইদিন থেকে তার প্রতিজ্ঞা, জীবনে পুকোর আমি কাটপোই। আর সুযোগও এসে যায় পাক-ভারত যুদ্ধের সময়। তিরপুল্য ঘোষ কানতি কানতি আই্সে কয়, ছোট্ভাই, কি আর দিবা, তুমার যা মন চায় দিয়ে জমিখেন নেও। আর আমাগের বিদায় দেও। তেরো টাকা তিন সিঁকে দিয়ে এই জমি নিওয়া। আর সেই এতো সাধের পুকোরি এখুন পানি নেই!
— পানি আসপিনি, ছোট্ভাই, ইট্টু ধৈর্য্য ধরো। অতো আশা হারালি হয় নাকি!
আশা নিয়ে বশীর পাড়ের ওপাশের কাচারীঘরে শুতে যায়। শুয়ে স্বপ্ন দ্যাখে, ঢোল সমুদ্দুর রাজা তাকে ডাকছে —বশীর রে, তিরপুল্য না তোর খাঁটি গরুর দুধির দই খাওয়াতো? খাঁটি গরুর দুধির দই! পাতে দিলি খাড়া পাহাড় হয়ে দাঁড়ায়ে থাকতো! পাহাড় কাই্টে কাই্টে তুই না দই খাতি! সেই দই খাবি? খা।
বশীর দই খাচ্ছে। তার পছন্দের দই। তিরপুল্য ঘোষের নিজ হাতে বানানো খাঁটি গরুর দুধের দই। ঢোল সমুদ্দুর রাজা তাকে দই খাওয়াচ্ছে। পেট ফেটে যাচ্ছে! তবু সে খেয়েই যাচ্ছে। হাঁড়া নয়, ভাড় নয়, ইয়া বড় বড় মাটির কোলা থেকে পাতের উপর পড়ছে এক একটা পাহাড়। আর সে সড়াৎ করে পাহাড় গিলছে! আস্ত আস্ত পাহাড়! তার ইয়া বড় বড় পাথর! তার দাঁত-মুখ ভেঙে যাচ্ছে! গল গল করে রক্ত পড়ছে। তবু সে গিলছে! গিলতে গিলতেই একসময় চিৎকার করে ওঠে।
— আল্লা রে!
কোদালেরা ছুটে আসে। বশীর ঘামতে থাকে। কোনো কথা বলে না। সারাদিনের কাজ সেরে কোদালেরা সন্ধ্যায় ফিরে যায়। পরদিন ভোরসকালে এসেই তারা দ্যাখে পুকুরে একহাঁটু পানি। তারা বশীরকে ডেকে তোলে। বশীর তখনও কথা বলে না। কোদালেরা সাক্ষী-নিশানা দেখে মোট মাটির হিসাব কষে। তারপর পাওনা-দাওনা বশীরকে জানিয়ে চলে যায়।
আস্তে আস্তে পুকুরের পানি বাড়তে থাকে। আস্তে আস্তে নতুন পানিতে গোসলের জন্য ছেলেমেয়েরা ভেঙে পড়ে। আস্তে আস্তে বশীর নীরব হয়ে যায়। এবং ক’মাস পরেই ক’বছরের ছেলে রশীদকে রেখে কিছু না বলেই সে পরপারে যাত্রা করে।
কিশোর রশীদ সহায়-সম্পত্তি হাতে পেয়েই বাপের স্বপ্নপূরণে শানবাঁধানো ঘাট তৈরী করে ফেলে। কিন্তু ঘাটের পাশ থেকে ক’মাস পরেই হঠাৎ পাড় ভাঙতে শুরু করে। ভাঙতে ভাঙতে পাড়টা এমনভাবে ঢালু হয় আর নীচে এমন ঠনঠনে বালি চিকচিকায় যে সবাই তখন শানের ঘাট বাদ দিয়ে সেখানে নেমে গোসল করতে থাকে। দিনে দিনে শানের ঘাটে শ্যাওলা জমতে থাকে, কাদা জমতে থাকে। শ্যাওলা-কাদায় সেই ঘাট মজে উঠতে থাকে। আর পাশেই জমে ওঠে বালুঘাট। এভাবেই আস্তে আস্তে পুকুরটা হয়ে যায় রশীদের বালুঘাটে পুকুর।
তা আজ প্রায় বিশ বছর হয়ে গেল। ছেলেবুড়ো, হিন্দু-মুসলমান, বেটাসাওয়াল-মিয়াসাওয়াল সারা গ্রামের মানুষ সব-পুকুর ফেলে এই বালুঘাটে পুকুরে আসে। গোসল করতে করতে তারা গল্প বলে। কালীগাঙের গল্প। শীতলীডাঙার কাঙালী ঘাটের গল্প। কি নিজল ঠাণ্ডা পানি! কাঙালীর আখড়ার বটগাছের গোড়া থেকে চিকচিকে বালি পানির মধ্যি নাইবে গেছে। মাছগুনু সব ঝকঝক করতি থাকে। ডুব মারলি ধবধবে ঝিনুক, মনে হয় ফুলির মতো ফুটে আছে। দুপোর সুমায় ক্ষ্যাত নিড়োয়ে আইসে ঘাটে নাবলি শরীল ঠাণ্ডা হয়ে যায়। উঠতি আর মন চায় না। শীত নেই, বর্ষা নেই গোসল করে উঠলি পায়ে এক ফুঁটাও কাদা লাইগে থাকে না! এরকম পুকোর আর জীবনে দেখিনি। সারা বছর এক রকম পানি। কমেও না, বাড়েও না।
কিন্তু গোল বাঁধলো যখন পুকুরের দু’ঘর পরে তিরপুল্য ঘোষেরই জ্যাঠাত ভাই প্রফুল্ল ঘোষ হঠাৎ পার হওয়ার যোগাড়-যন্ত্র করছে বলে শোনা গেল। কিছুদিন থেকেই সে নাকি ঘন ঘন ওপারে যাচ্ছিল। আর সুযোগ পেলেই কয়, এ দ্যাশ মেলেটারীর হাতেরতে আর ফিরবি নে! এ দ্যাশের কপালে আর ভাত নেই!
এ যে ঘটবেই রশীদের তা একরকম প্রত্যাশিতই ছিল। প্রফুল্ল দু-কলম লেখাপড়া শিখে বিটিসি-র দালালগিরি করে বেড়াতো। তামাকের মাঠে মাঠে ঘুরতো। মাঠান জমি যেটুকু ছিল একে একে বিক্রি করে দিয়েছে। সবাই বলে, বিক্রি করে ওপারে জমি রেখেছে। আছে শুধু আশি শতক জমির উপর তার বাপের ঠাকুর্দার করে যাওয়া আটচল্লিশ বন্দের আটচালা টিনের বিশাল একখান ঘর। আর ঘরের চারপাশে শত বছরের ছায়াঘেরা কিছু আম-কাঁঠালের গাছ।
খবরটা কানাঘুঁষো হয়েই ছিল, কানাঘুঁষো হয়েই হয়তো থাকতো, যদি না জাসদের বল্টু এর মধ্যে প্রবেশ করতো। সারা এলাকার সবাই তাকে বোম্বেটে বল্টু নামে চেনে। মাঝে মাঝেই সে রশীদের কাছে হাই ফেলে – পুরোন আমলের কাঁঠালের গাছগুনু কি সব! সিন্দুরির মতো টকটক করতেছে! কাটতি গেলি মনেহয় ভিতরেত্তে রক্ত বার হয়ে আসপিনি! এমুন সারি কাঠ! দাম কত সেসব কাঠের!
বল্টু নাকি এরমাঝে রাতের বেলা তিন দিন করে সরাফতের বাড়ি থেকে প্রফুল্লকে বের হতে দেখেছে। এতে সে নিশ্চিত হয় ভিটেটা তার খাতিরের লোক রশীদ পাচ্ছে না। পাচ্ছে শরাফত, শালা বাকশালী দালাল! কিন্তু এই এলাকায় বল্টু চায় না, এমন কাম কারো বুকির পাটা নেই করার!
এমন বুকের পাটা অথচ একদিন ভোরসকালে সে পুকুরঘাটে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে। সে কেন এত ভোরে গোসলে নামলো তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল, কিন্তু পাত্তা পায়নি। প্রশ্নটা তুলেছিল শরাফত। কারণ প্রফুল্ল ঘোষ দিনকতক আগে তার শালার বিয়েতে সপরিবারে শ্বশুরবাড়ি যায় ক’গ্রাম পরে। সেদিন রাতে ফেরার পথে বিলের মাঝের বাঁকাপথের ব্রীজের কাছে তিন গ্রামের বাড়ি-ফেরতা মানুষের জটলা। বলে, ওদিকে আর যাইয়ো না। গুলাগুলি হচ্চে। জাসদ আর কমেনিস। শরাফত কমেনিসগের ডাইকে নিয়াসে রাত্তিরি ঘরে থাকতি দেছে। এই শুনে জাসদ গেছে ক্ষেপে।
প্রফুল্ল ব্রীজের রেলিঙের উপর বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে বসে পড়ে। কেউ পরামর্শ দেয়, আজ আর ঘরে উঠতি পারবানানে, শ্বশুরবাড়ি ফিরে যাও।
অন্ধকারে বসে প্রফুল্ল বাড়ির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে শব্দ শোনে। গোলাগুলি বলেই মনে হয়। তবে হঠাৎ করে টিনের ঝন ঝন শব্দ কানে এলে তার বুকের মধ্যেও ঝন ঝন করে বাজতে থাকে। সেই শব্দ শুনতে শুনতে সে বিলের মাঝের ভাঙাচোরা পথ বেয়ে আবার শ্বশুরবাড়ি ফিরে যায়। সারারাত তার মাথা থেকে ঝনঝনানি যায় না। বউছেলেমেয়ে রেখে পরদিন ভোরসকালে নিজের ভিটেয় ফিরে সে চিৎকার করে ওঠে। তার আটচল্লিশ বন্দ আটচালা টিনের ঘরের কোনো নিশানা নেই। এক কোণে রান্নাঘরটা পড়ে আছে।
প্রফুল্লর চিৎকারে ফজরের নামাজ-ফেরতা মুসল্লীরা যখন এক-এক করে জমবে, ঠিক তখনই রশীদের বালুঘাটে পুকুরের দিক থেকে চিৎকার ওঠে, ওরে আল্লারে! আমার ঠ্যাং ধরে নিয়ে গেল রে!
সবাই তখন প্রফুল্লকে ফেলে রেখে বালুঘাটে পুকুরের দিকে দৌড় দেয়। বলটু তখন ঘাটের উপরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। তার পায়ে কিসের দাঁতবসানো কামড়ের দাগ রশীদই আগে দেখতে পায়। হাত দিয়ে দেখতে গিয়ে তার হাতেই প্রথমে রক্ত লেগে যায়। ভোরসকালের আবছা আলো-আঁধারে সেই কালো রক্ত সে সবাইকে দেখিয়ে বেড়ায়। সবাই নিশ্চিত হয় এরকম কামড়ের দাগ তারা জীবনে দেখেনি। এমন কুচকুচে কালো রক্ত কোনো জীবজন্তুর আছে বলেও তারা জানে না।
তখন প্রফুল্ল একা একা নিজের ভিটেয় চোখের জল ফেলে। আস্তে আস্তে আলো ওঠে। আস্ত আস্তে শান্ত হয়ে প্রফুল্ল একে বলে, ওকে বলে। কিন্তু সারা গ্রামের মানুষের আগ্রহ তখন বলটুর পায়ে দেখা অদ্ভুত দাঁতের দাগ, কুচকুচে কালো রক্ত। প্রফুল্লর আটচল্লিশ বন্দ আটচালা টিনের ঘর কোথায় কোন ঝড়ে উড়ে গেছে! অবশেষে আটভাগ হওয়া শরীর আর মন নিয়ে সে একসময় শ্বশুরবাড়িই ফিরে যায়।
এরপর থেকে সবাই বালুঘাটে পুকুরের গল্প বলে, চিকচিকে বালির গল্প বলে, ঠাণ্ডা পানির গল্প বলে। কিন্তু পুকুরের দিকে ভয়ে আর পা বাড়ায় না। কি আয়ছে এই দোষোন্তরে পুকোরি তা কেউ কতি পারে না!
কিন্তু কোনো দ্যাও-দৈত্য নয়, একদিন এক ঠাঁ ঠাঁ দুপুরে কে যেন দেখে পুকুরের মাঝে কাঠের জানালার মতো কি একটা ভেসে উঠছে। সারা গ্রামের মানুষ ভিড় করে। পাড়ে দাঁড়িয়ে তারা আবার ঢোলসমুদ্দুর পুকুরের গল্প করে, রাজপ্রাসাদের গল্প করে, খাট-পালঙ্কের গল্প করে, পাতালনাগের গল্প করে। এমন দরজা-জানালা তো আমরা জীবনে কারো বাড়ি-ঘরে দেখিনি! কিন্তু পরদিন কেউ আর সেই দরজা-জানালার হদিস পায় না। সব পাতালনাগের কায়কারবার! তবু সবাই আরো কিছু দেখার আশায় থাকে। দূর থেকে উঁকি মেরে মেরে হতাশ হয়ে ফিরে যায়। সে কোন রাজার আমলের দরজা-জানালা! আর কি দেখা যাবি?
কিন্তু একদিন ভিন্ন একটা কিছুর দেখা মেলে। খাঁদের বাড়ির অকাটা ছেলে নুবল বলে, পুকোরের পানির মধ্যি টিন আছে। এ খবর সারা গ্রামে বছর কয়েক আগের বৈকালী অপেরার প্রিন্সেস জাপটে-ধরার মতোই হইচই ফেলে দেয়। সবাই নুবলকে জাপটে ধরে – শিগগীর করে ক, কি দেকিছিস তুই!
নুবল কাঁপতে কাঁপতে বলে, তার বল একদিন পানিতে পড়ে গেলে চুপিচুপি তুলতে গিয়ে পায়ে টিন বাধে। রশীদ কষে একটা ধমক দেয়। নুবলের মা হাতে-পায় ধরে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে পরদিনই ঝাউদিয়ার পীরের কাছে নিয়ে যায়। পড়া-পানি খাইয়ে তার বুকে পিতলের আজমিরী তাবিজ ঝুলিয়ে দেয়। সে আর পুকুরের ত্রিসীমানামুখো হয় না। অকাটা ছেলে নুবল কাঠ হয়ে ঘরে বসে ঝিমোয়।
তবু ঢোল সমুদ্দুর পুকুর আর বালুঘাটে পুকুরের গল্পের সাথে নুবলের গল্প মিলেমিশে ঢেউ তোলে। সেই ঢেউ বিলের মাঝের থেবড়ো রাস্তা দিয়ে ক’গ্রাম পরেই যখন প্রফুল্লর কানে পৌঁছে, সে পড়তে পড়তে ছুটে আসে। পুকুরের চারপাশ ধরে সে ঘুরতে থাকে। একদিন, দুদিন, প্রতিদিন। কোনো এক দোষোন্তরে যেন তাকে ঘাড়ে ধরিয়ে ঘোরাতে থাকে। সে ঘুরছে। হরিপুরের রথের মেলার বিশাল উঁচু রসিকলালের নাগরদোলা যেন। এত উঁচু নাগরদোলা সারা তল্লাটে নেই। ছোটবেলার মতো কোন আসমানে যেন সে উঠে যায়। সেখানে উঠেই দেখতে পায় কোন এক ঘূর্ণিঘড়ে তার আটচল্লিশ বন্দ আটচালা টিনের ঘর, দাদার-দাদার আমলের শাল-সেগুন কাঠের দরজা-জানালা সব উড়ে উড়ে এসে পুকুরের পানিতে ঝপঝপ করে পড়ছে। আর সে শব্দ গুনছে। এক, দুই, তিন, নয়! তার ভুল হতে থাকে। আবার শুরু করে। এক, দুই, তিন, নয়…
এরপর সে কত ভোরসকালে ঘূর্ণি খেলো পুকুরের চারপাশে! ঘুরতে ঘুরতেই একদিন এই দোষোন্তরে পুকুর আর দোষোন্তরে দেশ ছেড়ে বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে পার হয়ে গেল।