কমলেশের প্রেম অথবা সামারটাইম স্যাডনেস । আফরোজা সোমা
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ অক্টোবর ২০১৬, ৩:৫৪ অপরাহ্ণ, | ১৬৪০ বার পঠিত
ব্রেকআপটা হলো। হয়েই গেলো। ঠেকানো গেলো না। ফাবিহার ডিভোর্সটা ধরলে এটা তৃতীয়বার ছাড়াছাড়ি। আর সবচেয়ে বাজে ব্যাপারটা হলো সময়টা নিয়ে। এবারেও সেই সামার টাইম!
‘ওহ! ফাকিং সামার! আই হেট দিস ডিসগ্রেসফুল টাইম!’ এই লিখে সে তার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়। স্ট্যাটাস দেখে কমেন্টে অনেকে অনেক কথা জিজ্ঞেস করে। কেউ উদ্বেগ বোধ করে। কেউ মস্করা করে। সুন্দর সময়ের প্রত্যাশায় কেউ জানায় শুভকামনা। আর অফিসের এক ছোটো ভাই লিখেছে, ‘ব্রো, সামার টাইম আপনের লাগি কুফা কেলা!’
সামার যে কেন কমলেশের জীবনে একের পর এক বিচ্ছেদ নিয়ে এসেছে তার কারণ তো সে নিজেও জানে না! কী লিখবে উত্তরে। আর উত্তর দেয়ার মানসিক পরিস্থিতিতেও সে নেই। নিজের রাগ বাইরে আসতে না দিলে ভেতরে থেকে তা ক্ষতি আরো বেশি করে। তাই, ফেসবুকের ওই কোনো-কথা-স্পষ্ট-করে-না-বলা স্ট্যাটাসে নিজের ব্যাথার খানিক হিলিং খুঁজেছে। কিন্তু কোনো কমেন্টের উত্তর দেয়নি।
শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডি-তে সে এসেছে একটা কনফারেন্সে। ৫দিনের কনফারেন্স। কনফারেন্সের পরে আবার দুই দিন মিলে গেছে সাপ্তাহিক বন্ধ শুক্র-শনি। এর সাথে মিলে কমলেশ ছুটি নিয়েছে আরো ৫ দিন । কনফারেন্স শেষে আজকে থেকে তার সেই বাড়তি ছুটির দিন শুরু। সব মিলিয়ে এতো বড় ছুটি জীবনে প্রথম পেয়েছে।
ছুটির আনন্দে সে ডুবে ছিল। জীবনের টানা-পোড়েন, ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ার বেদনা হঠাৎই যেনো মন থেকে হাওয়া হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া ক্যান্ডি নিয়ে ওর একটা আলাদা স্মৃতিও আছে। ফাবিহা’র সাথে বিয়ের পর হানিমুনে তারা এসেছিল ক্যান্ডি। বিরাট সাগরকে সামনে নিয়ে ওরা দু’জন নিঃশব্দে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকেছে! নিঃশ্বাসই যেনো পরস্পরকে তখন বলে দিয়েছে সকল কথা। ফেনিল ঢেউ আর সমুদ্রের অথৈ জলরাশির উপরে মায়াচাদরের মতন ছড়িয়ে থাকা উজ্জ্বল ঝলমলে রোদই যেনো পরস্পরের হৃদয়ে তখন পৌঁছে দিয়েছে সকল ব্যাকুলতা।
ব্যাকুলতা ভরা সেই সম্পর্ক-ও যে একসময় ডিভোর্স পর্যন্ত গড়াতে পারে কমলেশ তা বিশ্বাসই করতে পারেনি বহুদিন। পরস্পরের সম্মিতিতেই ডিভোর্সটা হয়েছিল। বিয়ের পরে ছয় মাসের মাথায় দেখতে-দেখতে ওদের সম্পর্কটা কেমন যেনো হয়ে গিয়েছিল! তারপর সেই খিটিমিটি-খিটিমিটি সম্পর্কে কাগজে-পত্রে একদিন ছেদ টানা হলো।
এরপর টানা তিন বছর কমলেশ কেবল অফিসের কাজ নিয়ে থেকেছে। বিষন্নতা কাটানোর জন্য দিন-রাত ডুবে থেকেছে কাজে। নাক-মুখ গুঁজে ভূতের মতন কাজ করতে করতে অফিসে খুব ভালো জায়গা করে নিয়েছে। তিন বছরে তিনটা প্রমোশন পেয়ে সে এখন অফিসের টপ বসদের কাছাকাছি পদে আছে।
অফিসেরই কাজে একদিন সৌমিনির সাথে পরিচয়। বড় বিজ্ঞাপনী সংস্থায় বড় পদে কাজ করে সৌমিনি। আর কমলেশ বড় মোবাইল কোম্পানির বড় কর্তা। বিজ্ঞাপন নিয়ে নানান সময়ে দেখা হওয়া, কথা বলা, বিভিন্ন পার্টিতে টুকটাক আলাপ। এমন করেই একদিন কী করে যেনো পরস্পরই বুঝতে পারে তাদের একটা টান তৈরি হয়েছে। কিন্তু বিপত্তিটা তৈরি হয় সৌমিনির পরিবারকে নিয়ে। সৌমিনির পরিবার থেকে বলেছে, ডিভোর্সড কোনো ছেলের সাথে মেয়ে বিয়ে দেবে না। আর মেয়ে যদি বিয়ে করতেই চায় তবে যেনো পরিবার ছেড়ে চলে যায়। এই নিয়ে বাবা-মা ও বড় বোনের সাথে বহু যুদ্ধের পর, অবশেষে সৌমিনি পরিবারকে বেছে নিয়েছে। পরিবারকে বেছে নেয়ার এই বার্তা যখন সৌমিনি কমলেশকে পাকাপাকি ভাবে দেয় তখন ছিল গ্রীষ্মকাল। ছাদের রেস্টুরেন্টে ছিল মেঘমুক্ত আকাশ। এই ব্রেক আপটা হবার পর কমলেশের হঠাৎ খেয়াল হয়, ‘আরে! ফাবিহার সাথে ছাড়াছাড়িটাও তো গ্রীষ্মকালেই হয়েছিল! এপ্রিলের শেষের দিকে! আর সৌমিনির সাথে ছাড়াছাড়িটাও গ্রীষ্মেই! মে মাসে।’ সময়ের এই মিলটা ছাড়া সামার নিয়ে ওর আর বিশেষ কিছু মাথায় আসেনি তখন। কিন্তু এবার মেখলা’র সাথে ব্রেক আপটায় কমলেশের মন যতটা না তেতো হয়েছে তারচেয়ে বেশি তেতো হয়েছে ঘটনাটা মে মাসে ঘটায়!
সাগর পাড়ে ঢেউ এসে উপছে পড়ছে। ঢেউয়ের শব্দে চারিদিকে একটা সুরমূর্ছনা বাজছে যেনো। সেই সুরলহরীর ভেতরে বসে ফাবিহা, সৌমিনি আর মেখলার কথা ভাবছে কমলেশ। ‘মানুষ হিসেবে ওরা কেউই তো মন্দ ছিল না। ইনকনসিডারেট ছিল না। কমলেশ-ও ইনকনসিডারেট নয়। বরং সবাই গড়পড়তার চেয়ে একটু আলাদাই ছিল বলা যায়। তবুও এমন কেন হতে হলো! কেন!’
যতবার মে মাসের কথাটা ওর মনে আসে ততবারই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, ‘ওহ! ফাকিং সামার!’
কমলেশ সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মন ঘরের একমাত্র সন্তান। রীতি-নীতিও বেশ মেনেই চলে তার পরিবার। কিন্তু গোঁড়া নয়। ফলে, পারিবারিকভাবেই মুসলিম পুত্রবধূ ফাবিহা আফসারকে মেনে নিয়েছিল ওর বাবা-মা। কিন্তু ফাবিহার পরিবার মানেনি। একদিনের জন্যেও কমলেশকে জামাতার স্বীকৃতি দেয়নি।
কমলেশের এখনো মনে হয়, ওদের বিয়েটা ভেঙেছে ফাবিহার নার্ভাস ব্রেকডাউনের কারণে। পরিবারকে ছেড়ে আরেক পরিবারে মানিযে নেওয়া, নিজের বাড়িতে প্রবেশাধিকার না থাকা, অফিসে হঠাত দেখা দেওয়া কিছু বাড়তি সমস্যার সাথে ডিল করতে-করতে ক্লান্ত হওয়া, এই সকল কিছু সামলাতে গিয়ে চাপে পড়ে ফাবিহা হয়তো তখন মানসিকভাবে কমলেশের উপরে অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে গিয়েছিল। একটু বেশিই হয়তো সংবেদনশীল হয়ে উঠেছিল ওর মন। কমলেশেরই তখন উচিত ছিল আরেকটু বেশি সময় দেয়া। নিজের অফিসে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত অমন করে বাড়তি কাজ করতে গিয়ে ফাবিহাকে সময় না দেয়াটা অন্যায়ই ছিল বটে।
কিন্তু মেখলার সঙ্গে ব্যাপারটা এভাবে শেষ হোক কমলেশ তা চায়নি। মনে প্রাণে চায়নি। যদিও সে দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছিলো মেখলার সঙ্গে ওর কোনো ভবিষ্যত নেই। এই সত্য দেখে ফেলায় ভেতরে ভেতরে কমলেশ যেনো অস্থির হয়ে উঠেছিল। যেনো বাঁচার জন্য ও যতই হাত-পা ছুঁড়ছিল ততই তলিয়ে যাচ্ছিলো গহীন জলে।
কমলেশ থিতু হতে চাইছিলো। একটা ডিভোর্স এবং একটা ব্রেকআপের পর বয়স ৩৪-এ এসে থিতু হওয়ার আকাঙ্ক্ষাটা যেনো ভেতর থেকে কাবু করেছিল তাকে। তাই সে প্রায় বছরখানেক প্রেমের পর মেখলাকে বিয়ের তাড়া দিল। মেখলা-ও হিন্দু। ডিভোর্সড ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে ওর পরিবারের কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সমস্যা বাঁধালো স্বয়ং মেখলা। হঠাত একদিন রেস্টুরেন্টে ডিনারে ডেকে নিয়ে মেখলা খুব সিরিয়াস হয়ে জানালো, ও কোনো সন্তান নেবে না এবং সন্তান নেওয়ার জন্য ভবিষ্যতে ওকে কখনো কিছু বলা যাবে না। এই শর্ত ভালো করে ভেবে নিয়ে বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে বললো।
সেই রাতে কমলেশের গলা দিয়ে খাবার নামেনি এবং যক্তি-তর্ক-ঝগড়া কিছুই সে করতে পারেনি। বিষন্নতায় নীল হয়ে যাওয়া একটা মুখ নিয়ে সে ঘরে ফিরেছে। মেখলার যদি কখনো ন্যাচারালি সন্তান না হতো তাতে তার কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু সে নেবে না। সে চায় না। এমনকি পরে অন্য সময় ঠাণ্ডা মাথায় যখন কমলেশ মেখলাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে এই বলে যে, ‘ঠিক আছে যতদিন নিতে ইচ্ছে না করে নিও না। কিন্তু যদি কখনো ইচ্ছে করে, যদি কখনো মন বদলায় তখন তুমি হয়তো নিতে পারো এমন একটা অপশান তো খোলা রাখা যায়’, তখন মেখলা বলেছে, ‘না, যায় না। কারণ আমি সন্তান নেবো না।’
ব্যাস! এই কথার পরে আর কথা চলে না। সন্তান না নেয়ার কারণ হিসেবে মেখলার-ও যুক্তি আছে। ভিটেয় প্রদীপ জ্বালানোর জন্য উত্তরাধিকার রেখে যাওয়ার ধারণাতেই ও বিশ্বাসী নয়। তাছাড়া জীবনের ৩০ বছর ওর নানান রকমের দায়-দায়িত্ব পালন করতে করতেই গেছে বলে ও মনে করে। যেগুলো-কে মেখলা বলে ‘ডিউটি’। মেখলার ভাষায়, ‘ডিউটি মারতে-মারতে জীবনের ৩০ বছর গেছে। আমি হইতে চাইছিলাম নৃত্যশিল্পী। পড়তে চাইছিলাম শান্তি নিকেতনে। কিন্তু বাবা আমারে ইঞ্জিনিয়ার বানাইছে। অনেক টাকা খরচা কইরা বড় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াইছে। ওই পড়াটাও বাপ-মায়ের প্রতি আমার ডিউটিরই পার্ট ছিল। চাকরিটা যে করি সেইটাও নিজের জীবনকে পেলে-পুষে রাখার ডিউটিজনিত কারনেই করি। তারপরে এখন আমি স্বামীর প্রতি ডিউটি মারতে গিয়া বাচ্চা জন্ম দিবো এবং সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালনে ডিউটি মারতে-মারতে জিন্দেগী পাড় হবে; এইটা আমি চাই না।’
এই শর্তেও কমলেশ রাজি হয়েছিল প্রায়। শুধু মেখলাকে অনুরোধ করেছিল যেনো কমলেশের বাবা-মাকে এই কথাটা না জানায়। কিন্তু মেখলা নাছোড়বান্দা এবং যুধিষ্ঠিরের চেয়েও সত্যবাদী। যুথিষ্ঠির তো অশ্বথামাকে নিয়ে কুরুক্ষেত্রে কৌশলে সত্য ও মিথ্যার মিশ্রণ রটিয়েছিল। মেখলা তা-ও করবে না। সে বলেছে, বিয়ের আগেই কমলেশের বাবা-মাকে এই কথা জানাতে হবে। তাদের মতামত জানতে হবে। নইলে এটা অন্যায় হবে। কারণ কমলেশ যেহেতু তাদের ছেলে ফলে তার উপরে তাদের হক আছে, দাবী-দাওয়া আছে। কিন্তু তাদের সাধ-আহ্লাদ মিটাতে গিয়ে সন্তান নিয়ে মেখলা তার ‘জীবন ডিউটি- মারার পিছনে খরচ’ করতে রাজি নয়।
এই নিয়ে কমলেশ আর মেখলার টানাপোড়েন চলেছে মাসাধিক। অবশেষে আজ ক্যান্ডিতে এই সাগরপাড়ে বসে টানা দুই ঘন্টা ২৭ মিনিট আলাপের মাধ্যমে পারস্পরিক সম্মতিতে তারা বিচ্ছেদ কবুল করেছে।
আবারো মে মাস। আবারো সামার। আবারো বিচ্ছেদ।
সাগর পাড়ে ঢেউ এসে উপছে পড়ছে। ঢেউয়ের শব্দে চারিদিকে একটা সুরমূর্ছনা বাজছে যেনো। সেই সুরলহরীর ভেতরে বসে ফাবিহা, সৌমিনি আর মেখলার কথা ভাবছে কমলেশ। ‘মানুষ হিসেবে ওরা কেউই তো মন্দ ছিল না। ইনকনসিডারেট ছিল না। কমলেশ-ও ইনকনসিডারেট নয়। বরং সবাই গড়পড়তার চেয়ে একটু আলাদাই ছিল বলা যায়। তবুও এমন কেন হতে হলো! কেন!’
আর এই সকল চিন্তা ছাপিয়ে একটা অক্ষম রাগ ফুলে ফেঁপে উঠছে নিদারুণ গ্রীষ্মের প্রতি। কমলেশ ভাবছে, ‘কেন! কেন সবগুলো বিচ্ছেদ এই সামারেই হতে হবে!’ যতবারই সামারের কথাটা মাথায় আসছে ততবারই কমলেশের ভেতর থেকে সশব্দে বেরিয়ে আসছে, ‘ফাকিং সামার! হোয়াট অ্যা ডিসগ্রেসফুল টাইম!’