ওসমান সমাচার – পর্ব-১৬ । আহমদ মিনহাজ
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ অক্টোবর ২০১৬, ১১:১৫ পূর্বাহ্ণ, | ২৬২৯ বার পঠিত
‘রাং রাজওয়া’ ইন্দ্রজাল : পিট সায়েব ও বাইজি–কন্যা সমাচার (৮)
…
প্রবীণদের যুক্তি মানলে স্বীকার করতেই হয় যে থাপ্পড় ও চাপড় আসলে সমার্থক নয়। অভিন্ন অর্থ প্রকাশ করলেও অভিন্ন নয়। বাইজি-কন্যার আঙুল নাজুক হলেও নাজুক নয়। থাপ্পড় কষানোর মুহূর্তে তার আঙুলে রাক্ষস ভর করে। সায়েবের ফর্সা গাল নাজুক আঙুলের চাপে লাল হয়ে ওঠে। চপেটাঘাতের শব্দে কবি বায়রন চমকে উঠেন। সায়েবের ঘাড় থেকে সুড়সুড় করে মাটিতে নামেন। নামার সময় ভাবেন, তার জাতভাইটি আসলে বোকা। রমণীকে বিব্রত করার দরকার ছিল না। সে হচ্ছে রাত্রিসুন্দরী। অন্ধকারে হাঁটে। নিকষ আঁধারে নিজের দ্যুতিকে ডুবিয়ে রাখে। দিনের আলো সে-দ্যুতির নাগাল পায় না। কারণ দ্যুতিটি কাল্পনিক। কবির হৃদয়ে এর জন্ম হয়। হৃদয়ের গহীন গুহায় রাত্রিসুন্দরী দ্যুতিময় হয়ে ওঠে। অন্ধকারকে দ্যুতির আবেশে চমকিত করে হাঁটে। সুন্দরীকে কবির চোখ দিয়ে দেখতে হয়। মস্তিষ্কের অন্ধকার আকাশে অনুভব করতে হয়। সুন্দরী সেই আকাশে তারা হয়ে জ্বলে। তাকে মাটিতে নামিয়ে আনা অনুচিত। এতে দ্যুতিভঙ্গ হয়। রাত্রিসুন্দরী তুচ্ছ রমণী হয়ে পড়ে। আফসোস, বোকা ইংরেজ সায়েব সেটা বুঝতে পারেনি!
পিটারের কাণ্ড দেখে বায়রনের মনে রাগ জমে। সারা জীবন তার কবিতা আওরে পাঁঠাটা এই শিখেছে! মনে-মনে তাকে শাপশাপান্ত করেন। রমণী ঠিক কাজটি করেছে। সায়েবের উচিত শিক্ষা হয়েছে। সম্ভব হলে তিনি আরেকটা থাপ্পড় কষাতেন ওর গালে। জাতভাইকে থাপ্পড় কষানোর ইচ্ছে কবি বহু কষ্টে দমন করেন। পিটারের দোকান ছেড়ে যাবার আগে কাউন্টারে বুট জুতো দিয়ে জোরে লাথি মারেন।
বায়রন কবি হলেও জাত যোদ্ধা। অটোমানদের হাত থেকে গ্রিসকে বাঁচানোর জন্য জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছেন। গ্রিকরা তাকে জাতীয় বীর বলে মানে। নাক-উঁচু ইংরেজের চেয়ে গ্রিক ও ইতালিয়ানরা তাকে অধিক আপন মনে করে। ইংরেজ পিটারের কাণ্ডে তিনি এখন বিরক্ত। হতভাগা শৌখিন হলেও কিছু শেখেনি। ডন জোয়ান পাঠ করলেও এর মর্ম ধরতে পারেনি। রমণী পটানোর কায়দা শেখেনি। সে একটা আবেগের পিণ্ড। অপার্থিব সম্পর্কে কিচ্ছু না জেনে রমণীর হাত ধরে টান দিয়েছে। নাহ! এই পাঁঠার সঙ্গে আর থাকা যায় না। কাউন্টারে ফের লাথি কষিয়ে পিটারের দোকান থেকে তিনি গটগট করে বেরিয়ে পড়েন। জাতভাইয়ের প্রতি তার মুখে বিতৃষ্ণা প্রবল হয়।
বায়রনকে চলে যেতে দেখে সায়েবের হুঁশ ফিরে না। রাত্রিসুন্দরীর জনক তাকে ছেড়ে যাচ্ছেন দেখেও কবিকে সে আটকায় না। উলটো খৈনিকণ্ঠির হাতটি নিজের গালে চেপে দাঁড়িয়ে থাকে। তার গালে কন্যার আঙুলের দাগ বসে গেছে। এটা তাকে বিচলিত করে না। থাপ্পড় ও চাপড়ের ব্যবধান সে আগেই ভুলেছে। থাপ্পড়ের মাঝে চাপড়ের মিঠে আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছে। কী সৌভাগ্য! কন্যা তার গালে হাত রেখেছে। চপলা নয়ন তুলে তাকে দেখছে। তার চোখের তারায় বিদ্যুতের ঘনঘটা। আঁখিপল্লব মেঘে ঢাকা। মেঘ ফুঁড়ে কন্যা এখন চমকাচ্ছে। সায়েব সেই চমকটি ধরতে পারছে না। কন্যার রক্তিম গণ্ডদেশকে তার কাছে নাজুক ও মনোহর মনে হয়। মেঘকালো ভ্রূ–যুগলে কোমলতা ও শান্তির আভাস টের পায়। সেই ছটার মধ্যে সায়েব ‘এক মাইল শান্তি কল্যাণ’ হয়ে শুয়ে পড়ে।
খৈনিকণ্ঠি রমণীর ভ্রূ-যুগলে সায়েব অন্য ইশারা দেখে। তার মনে হয় রমণী আর খৈনিকণ্ঠি নেই। রাত্রিসুন্দরী হয়ে গেছে। নির্জন দুপুরে তার চেতনায় অন্ধকার বিস্তার করেছে। সুন্দরীর ভ্রূ-যুগল শান্ত এবং কোমল হলেও স্তব্ধ নয়। শান্তি ও কোমলতা ছাপিয়ে মুখর হতে চাইছে। বাকপটিয়সী রমণীর বাগ্মীতায় নিজেকে প্রকাশ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। সুতরাং রমণীর হাতটি ছাড়া যাবে না। থাপ্পড়কে চাপড় ভেবে মনকে লঘু করে নিতে হবে। ওটা চপেটাঘাত নয়, ওটা হলো প্রেম। এর মধ্যে অপার্থিব লুকিয়ে রয়েছে। রমণীর হাত নিজের গণ্ডদেশে চেপে ধরে সায়েব বায়রনকে স্মরণ করে। চোখ মুদে কবিকে আওরায়,- ‘And on that cheek, and o’er that brow,/ So soft, so calm, yet eloquent’। সে এখন নিজের মধ্যে নেই। অপার্থিবকে পাওয়ার আবেশে থাপ্পড়ের যাতনা ভুলেছে!
কন্যা ভাবে এমন পাগল ও আহাম্মককে লাইনে আনা মুশকিল। রমণীর সুন্দর মুখটি অপমানে লাল হয়ে উঠেছে। চপলা ভুরু সায়েবের প্রতি রাগে কুঁচকে আছে। তার বুকের ভিতরে হাসির বেগ উঠছে। উন্নত বক্ষজোড়া দ্রুত তালে ওঠা-নামা করে। কাঁচুলি হটানো সম্ভব হলে দেখা যেতো নিটোল স্তনের খাঁজে ঘামের বিন্দু জমেছে। স্তনের সরু গিরিখাত বেয়ে তরল স্রোতের প্রবাহ নামছে। নাসিকা-গহ্বর দিয়ে বাতাসের ফুলকি ছুটে। এটা উত্তেজনার লক্ষণ। তবে প্রেমের না ক্ষোভের সেটা স্পষ্ট নয়।
কন্যার মনে ছলকে-ওঠা হাসির কারণে অপমান ও অনুরাগকে পৃথক করা যাচ্ছে না। ওটি হয়তো বিড়ম্বনা। তবে তার চোখ সেটা বলছে না। বিড়ম্বিত কন্যার আঁখিপট মোলায়েম হয়ে উঠেছে। চোখের তারায় কোমলতা ঘনিয়েছে। বায়রন কি তবে সায়েব ছেড়ে কন্যায় ভর করলেন! কিন্তু সে তো দোকান ছেড়ে চলে গেছে। কাউন্টারে তার বুট জুতার ছাপ স্পষ্ট লেগে রয়েছে। কন্যা তাহলে হাত ছাড়িয়ে নিচ্ছে না কেন! সায়েবের কণ্ঠ কাব্য করে দেখে তার শিল্পী হৃদয়ে কি ঠুমরির বোল ফুটেছে? সে কি তবে সায়েবে মজেছে?
বাইজি-কন্যার আঁখিজোড়া কোমল হয়ে পড়ায় ক্ষোভের বহ্নি ও প্রেমের শিখাকে তফাত করা যাচ্ছে না। এ কি তবে প্রথম দেখায় প্রেম? পিটার সায়েবের ক্ষেত্রে এটা সত্য হতে পারে। খৈনিকণ্ঠিকে প্রথম দেখায় কুল-মান ভুলেছে। রূপের চোরাটানে দেবদাস হতে বাকি রাখেনি। কিন্তু কন্যা তো প্রেমের টানে এখানে আসেনি। কৌতূহল সামলাতে না পেরে দোকানে পা রেখেছিল। এমন বিড়ম্বনায় পড়বে স্বপ্নেও ভাবেনি। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সায়েবকে নিয়ে যৎসামান্য জল্পনা করেছে। রূপবান পুরুষ ও রমণীতে বিশেষ ফারাক থাকে না। দুটোই মনকে কাছে টানে। বারবার দেখতে ইচ্ছে করে। কন্যা এখানে সায়েবের রূপ দেখতে এসেছিল। ওই রূপের প্রেমে পড়তে আসেনি। তার মনের মধ্যে ধোবিনী-রঙ্গ তখনো ছলকে উঠেনি। প্রেমের ঘাটে রূপবানকে কাঁচার কোনো বাসনা ছিল না। তবে কি বিড়ম্বনায় পড়ে কন্যার মনে ধোবিনী প্রকট হলেন!
কন্যার নাজুক আঙুল সায়েব শক্ত করে গালে চেপে ধরেছে। লক্ষণ দেখে বোঝা যাচ্ছে সহজে ছাড়বে না। এতোদিনে ধরার সুযোগ পেয়েছে। সহজে কী ছাড়ে! প্রেমের রাজা এপেলো তার উপর ভর করেছে। আফ্রোদিতি সাগর ছেড়ে ডাঙ্গায় উঠেছে। দোকানে এখন প্রেম ছাড়া আর কোনো কোলাহল নেই। এপেলো ও আফ্রোদিতি ছাড়া কেউ দর্শক হয়ে নেই। সায়েব আবেশে চোখ বোজে। তার কান এখন বধির। বাইরের হট্টগোল শুনতে পায় না!
বাইজি-কন্যার নাজুক আঙুল নিজের গালে চেপে ধরে পিটার চোখ বুজে বায়রন জপছে। দৃশ্যটি এই কাহিনীর এন্টি-ক্লাইমেক্স। প্রথম দেখায় প্রেমের ক্ষেত্রে এটা হচ্ছে মেলোড্রামা। দোকানের ভিতরে এখন প্রেমের দৃশ্যায়ন চলছে। মেঘের গায়ে হেলান দিয়ে ইন্দ্রজাল সিনে ডিরেক্টর বনে গেছেন। দেবদূতকে আবহ-সঙ্গীত জোরোলো করতে তাগিদ দিয়েছেন। এন্টি-কাইমেক্সে আবহসঙ্গীত জরুরি। কাহিনীতে ক্লাইমেক্স ঘনালে এন্টি-ক্লাইমেক্স অনিবার্য হয়। এটা ছাড়া দৃশ্য জমে না। জগতে প্রেম নির্বিঘ্ন নয়। পদে–পদে বাধা ও বিপত্তি দেখা না দিলে এর মহিমা বাড়ে না। প্রেম বলে কেউ একে চিনতে পারে না। এন্টি–ক্লাইমেক্স ছাড়া প্রেম কখনো জমে না। সায়েব খেদানোর গানে মত্ত যুবকরা সেই ভূমিকায় নেমে পড়েছে।
শহর আজ অশান্ত। গলি ও রাস্তায় বারুদের গন্ধ। রক্ত ও গুলির খোসায় দুপুর আর নির্জন হয়ে নেই। ভদ্র ঘরের রমণীরা নভেলে মগ্ন নেই। শ্লোগান ও গুলির বিকট শব্দে সুখের ভাতঘুম উবে গেছে। খেটে খাওয়া গরিব-গুর্বোর দল পুলিশের শকটে উঠছে। তারা হচ্ছে বলির পাঁঠা। দিশেহারা ছুটোছুটির কারণে পুলিশের ‘সন্দেহভাজন’ হয়ে পড়ে। ‘অশান্তি’ ও ‘বিশৃঙ্খলা’র অভিযোগ সবসময় তাদের পানে ধায়। যদিও এর সঙ্গে নিজের সম্পর্কটি তারা কোনোদিন মিলাতে পারে না। পুলিশি বুটের লাথি খেয়ে ভাবে,- ‘আজ্ঞে, আমার কী দোষ!’
এই গরিব-গুর্বোরা চিরকালের উলুখাগড়া। ‘বিশৃঙ্খলা’র দায় কাঁধে নিয়ে আচমকা গুলি খায়। পুলিশি লাথির চোটে চ্যাংদোলা হয়ে শকটে ওঠে। জেলের কক্ষে চিৎপটাং শুয়ে থাকে। লাথি বা ব্যাটনের ঝাড়ি খায়। সব শান্ত হলে আচমকা নিজেকে জেল-ফটকের বাইরে আবিষ্কার করে। মাথা চুলকে তখনো ভাবে,- ‘আজ্ঞে, আমার কী দোষ! খামোখা ধরে নিয়ে গেলো। কোমরটা বড়ো টনটন করছে। শালারা মানুষ না,- হারামি। কী মারটাই মেরেছে বাবা!’ আজ তার ভিন্নতা ঘটেনি। উলুখাগড়ার দল এই মুহূর্তে প্রধান আসামি। পুলিশি শকটে চড়ে জেলের রাস্তা ধরেছে। ওদিকে যুবকরা সর্পিল ছন্দে ছুটে চলে। মুকুন্দ গাইতে-গাইতে বিলেতি মার্কেট দখল করে ফেলে। এন্টি কাইমেক্সের বেশ ধরে তার এবার পিট সায়েবের দোকানে ঢোকে।
যুবকরা মরিয়া। মুকুন্দ দাসের রণগানে রক্ত গরম করে পিটারের দোকানে ঢুকছে। ঢোকার আগে ফ্লেচারকে একহাত দেখে নিয়েছে। এটা বিলেতি মার্কেট। সায়েবরা এখানে সর্বেসর্বা। তারাই সম্রাট। যুবকরা এতোদিনে সম্রাটদের বাগে পেয়েছে। প্রমত্ত ডাকু সেজে লুণ্ঠন করছে। গুলি ও চাকু সমানে ঝিলিক দিচ্ছে মার্কেটে। বিলেতিরা আগুনে পুড়ছেন। যুবকরা সব ডাকু হয়ে গেছে। ডাকু থেকে রাক্ষসে রূপ নিচ্ছে।
এই ঘটনার অনেক পরে ইন্দ্রজাল এক ডাকুর কাহিনী ফাঁদবেন। তাকে দেখে লোকে চমকে উঠবে। গব্বর সিং নামে সমীহ করবে। ওই নাম শুনে গরিব-গুর্বোর কলজে শুকায়। ডাকুটি ভয়ংকর। তার মানুষ মারার কায়দাটি অভিনব। শত্রুকে বন্দুকের সামনে দাঁড় করিয়ে ভারী কণ্ঠে তালিয়া বাজায়। অনেক পরের গব্বর সিং অনেক আগের যুবকদের উপর ভর করেছে। তারা এখন প্রাণোচ্ছল যুবা নয়। চিরচেনা ঘরের ছেলেটি নয়। মায়ের ‘খোকা’ কিংবা বাপের ‘অপোগণ্ড’ নয়। বোনের ‘ভাই’ এবং ভাবিদের রসিক ‘দেবর’ নামে এই যুবকদের আর চেনা যাচ্ছে না। ইন্দ্রজাল তাদের নামধাম পালটে দিয়েছেন। মুকুন্দ গাইতে-গাইতে তারা সবাই ডাকু বনে গেছে। ফ্লেচারের দোকানে চায়ের সরঞ্জাম ভাঙছে।
ফ্লেচারের সঙ্গে এই শহরের অনেক স্মৃতি জড়িত। চায়ের প্রচলন ও চা পানের ইতিহাসটি জড়িত। চা পানের জন্য সবাই সেখানে ঢোকে। ফ্লেচার সবার প্রিয় ও পরিচিত লিকার হাউজ। নেটিভ এবং সায়েবের জন্য লিকার হাউজে সময় ভাগ করা থাকে। সায়েবদের চা পানের সময়ে নেটিভরা সহজে ঢোকে না। নেটিভদের সময়ে সায়েবরা পারতপক্ষে ফ্লেচারে ভিড় করে না। নিয়মটি অলিখিত। ফ্লেচার শুরুর দিন থেকে চলছে। আজ অব্দি এতে ছেদ পড়েনি। ইতিহাসের অন্যথা ঘটেনি। তবে আজকের দুপুরটি অন্যরকম।
যুবকরা ডাকু হয়ে পড়ায় ইতিহাস আজ গৌণ হয়ে গেছে। এই প্রথম চা পানের জন্য তারা ফ্লেচারে ভিড় করেনি। সেখানে বসে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দেয়ার রুচি আর নেই। দাপুটে সায়েবের তৈলচিত্র দেখে সমীহ বা রসিকতার মেজাজ তারা নেই। যুবকরা আজ চা পান করতে আসেনি। বিলেতি সায়েবকে তছনছ করতে এসেছে। কম্পিত সায়েবদের হাঁটুতে কাঁপন ধরানোর বাসনায় ফ্লেচার দখল করেছে। তারা ইতিহাস বোঝে না। তাদের কাছে ফ্লেচার আর ইতিহাস নয়। সায়েবদের কারখানা। আজাদির জন্য ওটি মুছে ফেলা প্রয়োজন। সায়েবের বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে আজাদিরা গব্বর সিং হয়েছে। ভারী কণ্ঠে ডায়ালাগ ঝাড়ছে,- ‘তেরা কিয়া হোগারে কালিয়া! লে, আব্ গুলি খা।’
গুলি ও ভাঙচুরের তাণ্ডবে লিকার হাউজকে চেনা যাচ্ছে না। চায়ের পরিবর্তে বারুদের গন্ধ প্রকট হয়েছে। রক্তের ফোয়ারা বইছে। ফ্লেচার বিলীন হচ্ছে ইতিহাসে। অদূর ভবিষ্যতে ইতিহাস নতুন করে পালটাবে। চায়ের বদলে ফ্লেচারে শস্তা সুতি ও নাইলনের গন্ধ ছুটবে। বিলেতি মার্কেট নিজের সায়েবিয়ানা হারিয়ে হকারদের দখলে চলে যাবে। সায়েবদের বদলে হকার ও গরিব-গুর্বোরা সেখানে বিচরণ করবে। শস্তা দামে বস্ত্র কিনে নিজের সাধ-আহ্লাদ মেটাবে। সেসব অনেক পরের কথা। বিলেতি মার্কেট থেকে হকার মার্কেটে ইতিহাসের পালাবদল ঘটতে ঢের দিন বাকি। এই মুহূর্তে ওটা বিলেতি। সায়েবদের প্রিয় ও পছন্দের তীর্থস্থান। যুবকদের জন্য সায়েব মারার ঘাঁটি। ইন্দ্রজালের ইশারায় তারা সব বন্দুকবাজ ডাকু হয়ে মার্কেটে হামলা করছে। বিলেতি দোকানের একটিও আর অবশিষ্ট নেই। বিখ্যাত ফ্লেচারকে তছনছ করে সম্ভ্রান্ত পিটারকে খুঁজছে। তাণ্ডবের ক্ষণে সায়েবটি বাদ পড়ে যাচ্ছিলো। খবিশ সায়েবকে এবার পরপারে পাঠানো দরকার।
সময় বিবরণের আগে চলে। নিজের গালে সুন্দরী রমণীর হাত চেপে ধরে পিটার সায়েব প্রেমের কাব্য জপছে,- এই দৃশ্যটি এবং যুবকদের হল্লা-গল্লার মধ্যে সময়ের ফারাক বেশি নয়। পিটারের চোখ বুজে কাব্য করার কিছুক্ষণ পর ফ্লেচার মুছে যেতে শুরু করে। দুটো ঘটনার মাঝে সময়ের ব্যবধান অবশ্যই রয়েছে। তবে ব্যবধানটি যৎসামান্য। ঘড়ি ধরে মাপলে কাছাকাছি মনে হবে। যুবকদের হল্লা-গল্লার সময় সায়েব হাত সরিয়ে নিতে পারতো। ফ্লেচারে হানা দেয়ার সময় বাইজি-কন্যা নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারতো। দোকান থেকে বের হয়ে ফিটনে উঠার সময় তার হাতে ছিল। হাঙ্গামা টের পেয়ে ফিটনওয়ালা হন্তদন্ত হয়ে বিলেতি মার্কেটে ঢুকেছিল। সে তখন সাহেবজাদিকে খুঁজছে। তার এই খোঁজাখুজির মুহূর্তে যুবকরা মার্কেটে ঢুকে পড়ে। তাদের ডামাডোলে পড়ে বেচারা আর দিশা পায়নি। বাধ্য হয়ে নিজেকে ডামাডোলে শরিক করে।
সে যাকগে, সত্যিটা হলো পিটার ও বাইজি-কন্যা পরস্পরকে ছাড়ার অবস্থায় ছিল না। ইন্দ্রজালের প্রভাবে পিট সায়েবের মনে আবেশের ঢেউ উঠেছে। সে এখন জগতে নেই। পাগলা কবিকে থামাতে না পেরে বাইজি-কন্যা তার কাব্য শুনছে। মনের অতলে রাগ ও হাস্যের কলহ চলছে। কন্যার নয়নে আমির খসরু প্রকট হয়েছেন। খসরুর কারণে বহুদিন পরে সাহেবজাদা চোখে ভাসছেন। কন্যা তখন দ্বৈতে বিহার করছে। একইসঙ্গে দোকানে ও আগ্রায় অবস্থান করছে। এদিকে সায়েব বায়রন আওরাচ্ছে। ওদিকে কন্যার মনে খসরু গুনগুন করছেন,- ‘ছাপ্ তিলক সব ছিনি-রে মুসে নয়না মিলায়কে।’ নয়ন মিলানো ও গব্বর সিংয়ের দোকানে প্রবেশের সময়টি প্রায় সমানুপাতিক। ঘড়ি দিয়ে মাপলে ব্যবধান নেই বলে মনে হবে। কাহিনীর এটা হলো এন্টি ক্লাইমেক্স।
গব্বর সিং প্রমত্ত ডাকু। অর্থ ও রমণী ভালোবাসে। মুদ্রা পকেটে ভরে আশনাইয়ে মজে। এটা অনেক পরের ইতিহাস। আগের ইতিহাসে সে এক আজাদিলোভী ডাকু। মুদ্রা ও রমণী ছেড়ে আজাদির সঙ্গে পিরিতে মজেছে। পিট সায়েবকে মারতে তার দোকানে ঢুকেছে। ইন্দ্রজাল বড়ো বেরসিক। ডাকুটিকে অপ্রস্তুত করে খুব সুখ পাচ্ছেন। বিস্মিত ও স্থানু করে মজা দেখছেন। সায়েবের দোকানে ঢুকে এমন দৃশ্য দেখার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। বড়ো ঘরের বউ-বেটিদের আশনাই দেখতে আজ পিটারে ঢোকেনি। আশনাই দেখার শখ তার আছে। সে অন্য সময়ে দেখা যেতে পারে। এখন ওসবে রুচি নেই। আজকের দুপুরটি আজাদি ও প্রতিশোধের জন্য বরাদ্দ ছিল। সেটা ছিনিয়ে নেয়ার আশায় দলবল নিয়ে পিটারে হানা দিয়েছে। ঢোকার পর থমকে যেতে বাধ্য হলো।
গব্বরের চোখের কোণায় ক্রোধ ভর করে। বিস্ময় ছাপিয়ে বিতৃষ্ণা প্রবল হয়। সে কোনো ইন্দ্রজাল নয়। পিটার ও বাইজি-কন্যার মনে কী চলছে সেটা তার পক্ষে সেটা অনুমান করা কঠিন। গব্বর এক সামান্য ডাকু। তার দৃষ্টি তাৎক্ষণিকের অধীন। দোকানে ঢোকার সময় চোখে যা দেখেছে সেটাই সত্য বলে ধরে নিয়েছে। পেছনের ঘটনা সে দেখেনি। তার কাছে এর কোনো মূল্য নেই। সুতরাং বিবেচনার বাইরে।
দোকানে এর আগে কী ঘটে গেছে ডাকু সেটা দেখতে পায়নি। বাইজি-কন্যা কেন দোকানে ঢুকে এবং সায়েব কেন তার হাত নিজের গালে চেপে ধরে সেই রহস্য অনুমানের শক্তি তার নেই। মানুষ কোনো ইন্দ্রজাল নয়। অন্যের মন পড়ার নির্ভুল শক্তি কোথায় পাবে! সে নিজের মনের খবর করে। অন্যের মনের খবর জানা তার পক্ষে দুরূহ। গব্বর সিংয়ের এই শক্তি নেই যে সায়েব ও বাইজি-কন্যার মনের খবর করে। সে দেখছে ভরদুপুরে বড়োঘরের বেটি লম্পট সায়েবের সঙ্গে বেলেল্লাপনা করছে। এটা তাকে ক্ষুব্ধ করার জন্য যথেষ্ট। চারদিকে আজাদির শোর উঠেছে। সেটা সামাল দিতে পারছে না বুঝে সায়েবরা মুক্তকচ্ছ হয়ে ছুটোছুটি করছে। সেখানে বড়ো ঘরের বাইজি কিনা আজাদি ভুলে জাতশত্রুর সঙ্গে ফস্টিনস্টির খেলায় মেতে উঠেছে! রইসের সঙ্গে ফস্টিনস্টি করে খিদে মিটেনি। ভরদুপুরে সায়েবের সঙ্গে নষ্টামি করতে বেরিয়েছে। নির্লজ্জ এরেই বলে!
গব্বর জানে কন্যা অতিব সুন্দরী। গানের জলসায় তাকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। বড়ো ঘরের বেটি খেয়াল ও ঠুমরি দিয়ে বাজিমাত করতে জানে। চোখের কটাক্ষে পুরুষ ভোলায়। সে নিজে কতোবার ভুলেছে! গান শোনার বাহানায় রসিক বিনোদিনীকে আড়চোখে নজর করেছে। তাকে ঝাপটে ধরার নেশায় মনটা তখন আকুলি-বিকুলি করেছে। কিন্তু সাহস হয়নি। কারণ, তখনো সে ডাকু হয়ে উঠেনি। নিছক যুবক রূপে শহরে বিচরণ করছে। ‘অপোগণ্ড’ বলে বাপের ঝাড়ি সহ্য করতে হচ্ছে। বড়ো ঘরের বেটিকে দেখে মনে পিপাসা জাগতেই পারে, তবে ছোঁয়ার আগে দশবার ভাবতে হয়। ওসব বড়ো ঘরের পেছনে পুলিশ থাকে। পুলিশের পেছনে সায়েবরা বসে কলকাঠি নাড়ে। রইস, পুলিশ ও সায়েব একতারে বাঁধা। ছুঁতে গেলে আঠারো ঘা। সুতরাং মনের খিদে মনে চেপে শহর দাপিয়ে বেড়িয়েছে।
গব্বরের ডাকু হওয়ার দিন তখনো আসেনি। নদীর ঘাটে বসে ইয়ার-দোস্তের সঙ্গে বাইজি-কন্যাকে নিয়ে ইয়ার্কি মারলেও যুবতীকে ছোঁয়ার সাহস হয়নি। বড়ো ঘরের বউ-বেটিদের নিয়ে তার চাহিদা এভাবে অবদমিত থেকে গেছে। ওসব আগের ইতিহাস। আজকের দুপুরটি অন্যরকম। কয়েক ঘণ্টায় ইতিহাস পালটে গেছে। যুবকরা প্রত্যেকে গব্বর সিং হয়েছে। আজাদি ছাড়া অন্য কিছু তাদের মাথায় খেলছে না। সুতরাং এমন দিনে কন্যার এহেন ছেনালি সহ্য করা কঠিন।
লোকে বলে বাইজি আজাদি বোঝে না। সে বনিতা বোঝে। প্রেমের ঘাটে বজরা ভিড়িয়ে খদ্দেরকে ইশারায় ডাকে। দেশ-ফেশ নিয়ে ভাবে না। রাজা-প্রজার লড়াই তাকে বিচলিত করে না। তার কাছে সায়েবে ও রইসজাদায় তফাত নেই। বাইজি পয়সা বোঝে। রঙ্গ দিয়ে পয়সা আদায় করে। সে এক রঙ্গিনী ধোবিনী। যে তার রূপ ও গানের কদর করবে তাকে নিয়ে প্রেমের ঘাটে রঙ্গে মাতে। খদ্দরের বজরায় ওঠে। বাইজি ও বনিতা সমার্থক না হলেও সমার্থক। তারা পয়সা ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না। আজাদি নিয়ে খামোখা মাথা নষ্ট করে না। বাইজি দেশপ্রেমী নয়, সে হলো আত্মপ্রেমী। নিজেকে ছাড়া কাউকে ভাবে না।
বড়ো ঘরের বেটিকে সায়েবের সঙ্গে রঙ্গ করতে দেখে গব্বর সিং তাই আশ্চর্য হয় না। অবেলায় সায়েবের সঙ্গে ফস্টিনস্টি তাকে বিস্মিত করলেও বিস্ময়টা বেশিক্ষণ বজায় থাকে না। সে বরং ক্রোধে অন্ধ হয়। তার মনে বিবমিষা প্রবল হয়ে ওঠে। মনে-মনে ভাবে,- এই রইস ও রক্ষিতারা সকল অনিষ্টের মূল। ওদের কারণে সায়েবরা টিকে থাকে। মত্ত ডাকু এবার টিটকিরি দিয়ে ওঠে:-
‘বাহ! সাহেবজাদা ছেড়ে এবার গোরা সায়েব ধরেছো। নষ্টামির বাকি থাকলো কী! বাপের নাম এভাবে ডোবালে! রইস ছেড়ে ওই হারামির সঙ্গে পিরিতি চলছে। তোমরা পারোও বটে!’
প্রেমিক যুগল ততোক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। গব্বরের বিদ্রূপবাণ শোনার আগে আলগা হয়ে গেছে। সায়েব হতচকিত। খানিক বিব্রতও বটে। কোথা দিয়ে কী ঘটে গেলো বুঝতে পারছে না। আজাদি নিয়ে তার আগ্রহ কোনোকালে ছিল না। এখনো নেই। বাইরে যুবকদের হল্লা ও তাণ্ডব সমানে চলছে। কেন চলছে সায়েব সেটা ধরতে পারে না। তার চোখ জাতভাইদের খোঁজ করে। পুলিশ কেন নেই সেটা বুঝে আসছে না। পরিস্থিতি আঁচ করে বাইজি-কন্যা মুখের নেকাব নামিয়ে ফেলে। কন্যা এখন ভীতসন্ত্রস্ত। তার বুকজোড়া ধিকিধিকি কাঁপছে। মাথা নিচু করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।
কন্যার অবনত মুখটি স্তব্ধ হয়ে আছে। মনের কিনারায় বাপের চেহারা ভাসছে। এই অবস্থায় তার পক্ষে কথা বলা কঠিন। কিন্তু ডাকুর টিটকিরি গায়ে লেগেছে। এক অপমান থেকে আরেক অপমানে পড়ছে বুঝে মুখটা লাল হয়ে ওঠে। ইন্দ্রজাল ভীষণ নির্দয়। কন্যাকে বিড়ম্বিত করে মজা পাচ্ছেন। তার সংকল্প ও পরিকল্পনায় মানুষের জন্য কোনো দয়ামায়া নেই, শুধু পরীক্ষা করার অঢেল আমোদ রয়েছে। মানুষ বড়ো অসহায়। পরিস্থিতি তাকে নিয়ে খেলে। নিয়তি রঙ্গ করে। অপমানের একশেষ করে ছাড়ে। অপমানিত কন্যা বাধ্য হয়ে ঠোঁট নাড়ায়। ডাকু গব্বরের চোখা মশকরা তাকে জবান খুলতে বাধ্য করে:-
‘মুখ্ সামালকে বাত্ করো। তুম গলদ সুচ রাহা। মে কোই বাজারি আওরাত নেহি। সামান খরিদনে আয়া থা। গোরা সাহাব মুঝে মজবুর কিয়া। মে…’।
কন্যা তার কথা শেষ করতে পারে না। পদ্মপাতা চোখজোড়া জলে টলমল করে। জীবনের অপার বিড়ম্বনা ও বঞ্চনা তাকে বাকরুদ্ধ করে ফেলে। গলা আটকে আসে বঞ্চনার দুখে। কন্যার পাশে এখন কেউ নেই। ইন্দ্রজাল মাকে অনেক আগে মাটি করেছেন। মাথার উপর থেকে জীবনের সবচেয়ে বড়ো সাহারাটি গুটিয়ে নিয়েছেন। বাপ থেকেও নেই। তাকে ছায়া দেয়ার শক্তি রাখে না। সাহেবজাদা ছিল। কন্যাকে ‘রান্ডি’ বানিয়ে বিলেত ফিরে গেছে। ইংরেজ সায়েবটি উদ্ভট। ছিটগ্রস্ত লোকটি ঘরভর্তি মানুষের সামনে তাকে বাজারি করেছে। যুবকরা নিষ্ঠুর। তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। তারা যা দেখেছে সেটা ব্যক্ত করছে। হাজার ব্যাখ্যা দিয়ে কোনো ফায়দা নেই। তাদের দেখাটা এতে পালটে যাবে না। ইন্দ্রজাল এই যুবকদের চোখে মায়া-অঞ্জন পরিয়েছেন। এক সত্য দেখিয়ে অন্য সত্যটি গোপন করেছেন।
মানুষ দেবরাজ ইন্দ্র নয়। সহস্র চক্ষুর অধিকারী নয়। স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালকে এক লহমায় দেখতে পায় না। সে সীমাবদ্ধ। তার চোখ তাকে প্রতারণা করে। মস্তিষ্ক ভুল সংকেত পাঠায়। একটা পাঠাতে গিয়ে অন্যটা পাঠাতে পারে না। বাস্তবের ভিতরে বাস্তব থাকতে পারে। সত্যের গভীরে সত্য মুখ লুকিয়ে থাকে। মানুষ তা দেখতে পায় না। অনুভব করলেও প্রমাণ দিতে পারে না। অনুমান করতে গিয়ে বারবার ভুল অংক কষে। চোখের দেখা বড়ো হয় সেখানে।
বিচারক মহাশয়ের আদালতে মানুষের চোখ হচ্ছে রাজসাক্ষী। দুর্বল ইন্দ্রিয়টির উপর তার অগাধ আস্থা। ওটার উপর ভর করে বিচারক মামলা ডিসমিস করেন। যুবকরা এর বাইরে নয়। তাদের বুঝিয়ে কী ফায়দা! হাজার বুঝালেও সত্য বদলাবে না। দৃশ্যমান জগতে সকলেই খেলার পুতুল। এক দৃশ্যের ভিতরে অন্য দৃশ্য দেখার শক্তি রাখে না। সেই অন্তর্দৃষ্টি মানুষের নেই। ওটা হয়তো প্যাঁচার রয়েছে। সত্য লুকিয়ে থাকে অন্ধকারে। প্যাঁচা সেটা জানে। তাই দিনে ঝিমায়, রাতে চোখ খুলে রাখে। ক্রন্দন ছাড়া কন্যার কী আর করার আছে! তার জন্য ইন্দ্রজাল এটা শুধু বাকি রেখেছিলেন। কন্যা তাই স্তব্ধমুখে রোদন করে চলে!
কন্যাকে কাঁদতে দেখে ডাকুর দল দল হো হো করে হাসে। আজ তাদের অট্টহাস্যের দিন। বঞ্চনা ও অবিচারের বিরুদ্ধে গলা ফাটানোর দিন। পদে-পদে অপমান ও ছোটো হয়ে থাকার শোধ তোলার দিন। প্রতিশোধ নিতে তারা এখন মরিয়া। সময়ের ঘড়ি আজ উলটো ঘুরছে। সায়েব ও রইস এক-অঙ্কে ধরা পড়েছে। সায়েবকে শিকার করতে এসে রইসকন্যা শিকার বনে গেছে। এখন বুঝুক ঠেলা কাকে বলে! দুটোকে একত্রে পরপারে পাঠানো দরকার। এই রইস ও সায়েবের কারণে শহরে এতো ব্যাভিচার! গব্বর গলা ফাটিয়ে হাসে। কন্যাকে লক্ষ করে কথার বাণ ছোটায়:-
‘হয়েছে! আর নাকি-কান্না কাঁদতে হবে না। তোমায় আমরা ভালো করে চিনি। তোমার বাপকেও চিনি। দুজনে মিলে কতো কাণ্ড করলে! ওই হারামিটা বাকি ছিল। নেকাব তুলে ওকে পটিয়েছো। তবে সময়টা ধরতে পারোনি। সায়েবের আজ শেষ দিন। তোমায় সঙ্গে নেবে কিনা জিজ্ঞেস করো।’
পিটার সায়েবের দোকান এক রঙ্গমঞ্চ। মেলোড্রামা তুঙ্গে উঠেছে। মেঘের গায়ে হেলান দিয়ে ইন্দ্রজাল নাটক জমিয়ে দিয়েছেন। গব্বর সিংয়ের বাণ ক্রমে ধারালো হচ্ছে। তার বুকের ভিতরে অনেক কিছু না পাওয়ার ক্ষোভ। অজস্র স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণ থাকার বিক্ষোভ। বিদ্রূপবাণের ভিতর দিয়ে সেটা বেরিয়ে আসছে। তার দলবল সেটা উপভোগ করে। তারা সবাই এখন গব্বর। এক কাতারে দাঁড়িয়ে বড়ো ঘরের বেটিকে অপমানের সুখ নিচ্ছে। বহুদিন পর আজাদির মওকা মিলেছে। স্বেচ্ছাচারী হওয়ার সুযোগ জুটেছে কপালে। এতোদিন এটা পিট সায়েবদের দখলে ছিল। রইসদের অধীনে ছিল। ঘড়ির কাঁটা আজ ঘুরছে। তাদের খোঁচা তাই তীব্র হয়ে ওঠে:-
‘আরে না, যেতে হয় সায়েব একা যাবে। বাইজি কেন যাবে! সে আমাদের ঘরের মেয়ে। ভালো গান-বাজনা করে। তাকে নিয়ে জলসা হবে। গানের সঙ্গে ও আজ নাচবে।’
গব্বর সিং হাসে। তাকে হাসতে দেখে বাকিরা তাল মিলায়। সায়েব ও বাইজি-কন্যা দুজনেই স্তব্ধ। মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। কন্যা অবনত মুখ করে কাঁদে। নেকাব উঠালে দেখা যেতো তার পদ্মপাতা চোখজোড়া এরিমধ্যে জলপ্রপাত হয়ে গেছে। ওটা আর কখনো থামবে না। ইন্দ্রজাল তাকে জলপ্রপাত উপহার দিয়েছেন। এটা হচ্ছে পুরস্কার। বাইজি ঘরে জন্ম গ্রহণের পুরস্কার। নিয়তিছকে কেউ বাইজি হলে লোকের ঠাট্টা-বিদ্রূপ তাকে সইতে হয়। লোকে বাইজি ও বনিতায় তফাত করে না। বাইজি–ঘরে যার জন্ম সে নিজেকে সতী বলে প্রমাণ করতে পারবে না। লোকের চোখ ও অনুমান এর উপর ভরসা রাখে না। বাইজিকে নিষ্কলঙ্ক বলে কেউ বিশ্বাস করবে না। বাইজি বেশ্যা হবে,-এটাই জগতের বিধান। গব্বর সিংয়ের বিদ্রূপ চোখে আঙুল দিয়ে সেই সত্যকে নগ্ন করে ফেলে:-
‘ওরে, আমাদের বাইজি আজ সতী হয়েছেন। ভর দুপুরে সায়েবের সঙ্গে সতীপনা কচ্ছেন। উনি আজাদি চাইছেন না। লালমুখো সায়েবের ডার্লিং হতে চাইছেন। সাহেবজাদা বিলেতে ভাগা দিয়েছে। এবার বিলেত যাবার জন্য গোরা সায়েব ধরেছেন। নষ্টা মাগী হয়ে সায়েবের মাথা খাচ্ছেন।’
আজাদিমত্ত ডাকুরা এখন বেপরোয়া। দোকানে ও দোকানের বাইরে সমানে খিস্তি ছুঁড়ছে। কিছু ডাকু মার্কেট-চত্বরে গলা ছেড়ে শ্লোগান ধরে। কিছু আবার মুকুন্দ গাইতে থাকে। ওদিকে পিটারের দোকানে জটলা ক্রমে হিংস্র হয়। পরিস্থিতি গুরুতর বুঝে পিটার মুখ খোলে। এতোক্ষণ ধরে সে শুনছে। একটি কথাও বলেনি। যুবকদের বিদ্রূপবাণ সুখকর না হলেও তার কাজে লেগেছে। খৈনিকণ্ঠি রমণীর আদি-ইতিহাসটি বোঝা হয়ে গেছে। সে বুঝতে পারছে রমণী এক বিড়ম্বিত রাত্রিসুন্দরী। প্রেমের কারণে প্রবঞ্চিত ও প্রতারিত হয়েছে। যে-কারণে অন্ধকারে শরীর ডুবিয়ে রাখে। প্রেমের ডাকে সহজে সাড়া দেয় না। রমণীর অপমান তার হৃদয় স্পর্শ করে। অবনত মুখে কাঁদতে দেখে নিজেকে অপরাধী মনে হয়। পিট সায়েব এবার যুবকদের জবাব করে। সায়েব এই প্রথম বুকটান করে যুবকদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বাইজি-কন্যার হাত শক্ত করে চেপে ধরে। গব্বর সিংয়ের দলবল দুজনকে ঘিরে রেখেছে। ঘেরাওয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পিটার মুখ খোলে। তার কমনীয় বাচনে দৃঢ়তা ফোটে:-
‘দয়া করিয়া বিরত হও। অনেক হইয়াছে, আর নহে। সেই তখন হইতে উলটা-পালটা বকিতেছো। কোনো কিছু না জানিয়া এবং না বুঝিয়া কথা কহিয়ো না। এই রমণী নির্দোষ। স্বেচ্ছায় এইখানে আসে নাই। স্বয়ং ঈশ্বর তারে অত্র আনয়ন করিয়াছেন। তিনি জানেন আমি এই রমণীরে অত্যধিক ভালোবাসি। উহার জন্য মনে-মনে অস্থির হইয়া আছি। তারে পাঠাইয়া ঈশ্বর আমায় অশেষ দয়া করিয়াছেন। আমার জীবন রক্ষা পাইয়াছে।
রমণীরে তুমরা অযথা বিদ্রূপ করিয়াছো। সে অতুলনীয়। আজাদির জন্য পাগল না হইলে তুমরা তার মূল্য বুঝিতে! রমণী কে কিংবা কাহার কন্যা, সেইটা আমি ধরি না। তারে আমি ভালোবাসিয়াছি। আমার পক্ষে ইহা যথেষ্ট। অধিক জানিবার প্রয়োজন দেখি না। রমণীকে রাজি করাইতে আমি তার হাত ধরিয়াছি। সে রাজি হইলে এই শহর ছাড়িবো। দুজনে ইংলণ্ডে ফিরিয়া যাইবো। এই শহরটি মনোহর ছিল। তুমরা আমার পরিচিত। আমিও নতুন নহি। দীর্ঘদিন একত্রে কাটিয়াছে। এখন মনে হয় তুমাদের শত্রু হইয়াছি। তুমরা আমারে শত্রু এবং অপরিচিত করিয়াছো। আমার নিকট তুমাদের অপিরিচিত ঠেকিতেছে। শহর অচেনা হইলে তবু সেখানে বসবাস করা যায়। পরিচিত মানুষ অচেনা হইলে বসবাস সম্ভব নহে। এই শহরে থাকিবার ইচ্ছা ছিল। অদ্য আর প্রয়োজন দেখি না। তুমরা আমাদের রেহাই দাও। দয়া করিয়া বিদায় হও।’
পিটার সায়েবের কথায় গব্বর সিংয়ের দলে তরঙ্গ ওঠে। সায়েব হাঁপাচ্ছে। ধকল ও উত্তেজনা তাকে কাবু করে ফেলে। বাইজি-কন্যার হাতটি সে এখনো ধরে আছে। কন্যা যথারীতি অবনত মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। সায়েব হাত ধরেছে দেখে কিছু বলে না। নীরবে রোদন করে চলে। কন্যা নীরব থাকতে পারে, তবে ডাকুদের পক্ষে চুপচাপ থাকা কঠিন। আজ তাদের কথা বলার দিন। যেমন খুশি সাজার দিন। যাকে ইচ্ছা তাকে আঘাত করার দিন। ছিটেল সায়েবের অনুরোধ শুনে গব্বর তাই শিস দিয়ে ওঠে:-
‘লে দাদা! সায়েব দেখি মজনু হয়েছেন। লাইলীর হাত ধরে তাকে নিকা করতে চাইছেন। তা সায়েব, খালি লাইলীকে নিকা করলে তো চলবে না। কালেকটর সায়েবের বউয়ের কী হবে! তার মেয়েটির কি গতি হবে! ওরা বাদ যাবে কোন দোষে। শহরসুদ্ধ লোক জানে, তারা তোমার ডার্লিং। শুধু কালেকটর নিজে জানে না! হা! হা!’
এক গব্বরের শিস ধরে অন্য গব্বর ঠেস মারে:-
‘বিলক্ষণ। চলো সায়েব, আমরা তোমায় লাইলীর সঙ্গে বিয়ে দেবো। কালেকটর সায়েবের বউ ও মেয়ে আনতে লোক গেছে। তারা এলে একসঙ্গে তিনজনকে কবুল বলে ঘরে তুলতে পারবে। ওরে, কাজী ডাক্। সায়েব আজ কবুল বলবে। তিন বউকে সঙ্গে নিয়ে গঙ্গাযাত্রা করবে।’
অশ্লীল এই হুল্লোড়ে পিটারের মেজাজ বিগড়ায়। স্বভাব-শান্ত সায়েবের দেহে বায়রন ভর করে। এই বায়রন কবি নয়। ডাকুদের টিটকিরি তার রক্ত গরম করে তুলেছে। এই বায়রন যোদ্ধা। পিটারের উপর সে ভর করে। রমণীসঙ্গে অভ্যস্ত শৌখিন সায়েব এই প্রথম কারো গায়ে হাত তোলে। গব্বর সিংয়ের গালে ঠাস করে থাপ্পড় বসায়। গব্বর বোকা নয়। থাপ্পড় ও চাপড়ের তফাত বিলক্ষণ বোঝে। পরিস্থিতি জটিল হয় পিট সায়েবের থাপ্পড়ে।
থাপ্পড়টি সায়েব না দিলেও পারতো। বিদ্রূপ শুনে খাপ্পা না হলে পারতো। গব্বর কিছু ভুল বলেনি। কালেকটরের রূপবতী স্ত্রী ও কন্যার সঙ্গে পিট সায়েবের আশনাই নিয়ে গুঞ্জন আজকের নয়। বহুদিন ধরে বাতাসে উড়ছে। সে শুধু স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। উড়ো খবর থেকে লোকে অনেক কিছু আন্দাজ করে। গব্বর সেই আন্দাজি কথাটি বলেছে। তাকে থাপ্পড় মারার কারণে লোকের আন্দাজ সত্য হয়ে পড়লো। সায়েব এতো রমণীলোভী কেন ডাকুর সেটা বোঝার কথা নয়। বাইজি-কন্যার প্রতি তার দুর্বলতা রয়েছে। ওই রমণীর সঙ্গে অন্য রূপবতীর তুলনা করে না। কেন বা কী যুক্তিতে করে না, ডাকুর পক্ষে তা আন্দাজ করা মুশকিল।
মানুষের ইন্দ্রিয় সীমিত শক্তির অধিকারী। এক মনের পক্ষে অন্য মনের জটিলতায় প্রবেশ সহজ নয়। মানুষ সহস্র চক্ষু ও অযুত মনের মালিক নয়। এসব বিবেচনা করে সায়েব হাত না উঠালে ভালো করতো। আত্মসমালোচনা করলে আত্মহারা হওয়ার দোষ কাটে।কিঞ্চিৎ আত্মসমালোচনা করলে সে হয়তো নিজের রাগ গুটিয়ে নিতে পারতো। গব্বর সিংদের ক্ষমা করা তার পক্ষে কঠিন ছিল না। সেটা না ঘটায় নাটকের অঙ্ক গোলমেলে হয়ে পড়ে। মেলোড্রামা চরমে ওঠে।
সায়েবের থাপ্পড় পরিবেশকে বিষাক্ত করেছে। ডাকুরা অপমানের জ্বালায় খেপে ওঠে। এতোদিনের জমানো ক্ষোভ হৃদয় ফেটে বেরিয়ে আসে। চটুল তামাশা ও অশ্লীল ইশারা নিমিষে উধাও হয়। রক্তপাতের আভাস জাগে দোকানে। গব্বর সিংয়ের দলবল দোকানের ছাদ লক্ষ করে গুলি ছোঁড়ে। সিলিংয়ে লটকানো ঝাড়বাতি ঠাস করে মেঝেয় এসে পড়ে। ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়। ভাগ্য যে আকস্মিক এই পতনে কেউ জখম হয় না। ডাকুরা এবার ভাঙচুর শুরু করে। পোশাক ও জুয়েলারি তছনছ হয়। ব্যাপক হট্টগোলে কন্যা ডুকরে কেঁদে ওঠে। সায়েবের হাত শক্ত করে চেপে ধরে। এই মুহূর্তে তার পাশে কেউ নেই। আতংকে অভয় দেয়ার ভরসা নেই। ছিটেল সায়েব ছাড়া কন্যার কেউ নেই জগতে।
বাইজি-কন্যাকে সায়েব শক্ত করে ধরে রাখে। হট্টগোলের মাঝে দুজনের এই আলিঙ্গন ইন্দ্রজালকে বিরক্ত করে। ড্রামাটি তার মনঃপুত হয় না। সাসপেন্স আরো চরম করা দরকার। তিনি জাল বিস্তার করেন। ভাঙচুরে মত্ত গব্বর সিংকে সাসপেন্স বাড়াতে উৎসাহ যোগান। ডাকুর আস্তিন থেকে ধারালো চাকুর ফলা ঝিলিক দিয়ে ওঠে। বাইরে তখন পুলিশি শকটের আওয়াজ উঠছে। তাণ্ডব ও রণগানে উজ্জীবিত যুবকের দল মার্কেট-চত্বরে বোমা ফাটায়। পুলিশ ও যুবকরা মুখোমুখি লড়াই শুরু করে। প্রশিক্ষিত বাহিনীর সঙ্গে অপেশাদার বাহিনীর লড়াইয়ে প্রাণহানী মাত্রা ছাড়ায়। যুবকরা অনেকে গুলি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। লক্ষণ দেখে বোঝা যায় আজাদি সহসা আসছে না। এর জন্য হয়তো আরো অপেক্ষা করতে হবে! পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসায় পুলিশ এবার পিট সায়েবের দোকানে ঢোকে।
(ক্রমশ)