পাত্রী । পারভেজ হাসান
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ অক্টোবর ২০১৬, ১১:০০ অপরাহ্ণ, | ১৮৯৯ বার পঠিত
সুজন, সুন্দর যুবকদের একজন। বয়স প্রায় ২২ এর মত। পাত্রীর খোঁজে মা- বাবা সদা বেকুল। গত পাঁচ বছরে প্রায় তিন কুড়ি পাত্রীকে ছেলের সম্ভাব্য বউ টার্গেট করেছেন। কিন্তু কোন পাত্রীই আর ফাইনাল পর্যন্ত আসতে পারেনি। তাঁরা সুজনকেও স্ব-পাত্রী খোঁজার আদেশ দিলেন। সুজন গাঁয়ের সকল মেয়েদের তুচ্ছ মনে করে। কাওকে পছন্দ করবার পারে না। বরং গৃহবন্দি হয়ে রং নাম্বারে সফিনার সাথে প্রেমের আলাপ করে।
সুজনের গৃহবন্ধিতা সবাইকে বিরক্ত করে। সারাদিন বাবার বকুনি, মায়ের শোকানি, বোনের বিরক্তি, বন্ধুর মিনতি শ্রবণ করতে হয়। তাদের বিরক্তি সুজনের পুলকিত হবার শক্তি। সে সুখের জোয়ারে বলতে থাকে;
আধুনিক যুগ, জনমের সুখ, কর উপভোগ ভাই,
—এ যুগের মতো আরাম- আয়েশি, স্পৃহার প্রেয়সী অন্য যুগে নাই ।
সফিনার কণ্ঠ ও মোবাইল নাম্বার ছাড়া সুজন আর কিছুই জানেনা। তবুও তার মোবাইল কণ্ঠ তাকে আত্নিয়-পরমাত্মীয় বলে মনে সাড়া জাগায়। এই মুহূর্তে সুজনের মনস্থা সে সফিনার সঙ্গে দেখা করবে। দিন তারিখ সব ঠিক, পূর্বাহ্ণে ফুলবাগানে সুজন উপস্থিত। সুজনের আঙ্গিক ভঙ্গিটা আজ ভিন্ন মাত্রার;
হাতেতে ফুল, গায়েতে জামা, কাটিং টুপি শিরে
সুজন গান গায় মধুর সুরে সুরে;
তুমি আইলে বন্ধু দেখতাম চক্ষু দিয়া
পরে রং সাজাইয়া করতাম তোমায় বিয়া।
একা একা সুজন ঘুরে আর মনে মনে বলে; সফিনারে দেখিনা। আচমকা সফিনা পেছন হতে এসে তার অদ্ভুত পরিচয় দিল। লার সাড়ি পড়া নারী, লম্বায় সুজন হতে একহাত বেশি, মুকে কিঞ্চিত হাসি, সামনের দুই দাঁত ফাঁকা, কাটো কেশে শির যে তার ঢাকা। এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি দেখে সুজনের মুখে কোন বাঁক না ফুটে চোখে কিছুটা অশ্রু বাতির হল। ‘ভাবছিলাম সুন্দরি, ওরে বাবা অমন নারী বউ হইয়া যাইব আমার বাড়ি!’ পালাও পালাও বলে পলায়ন করল সুজন।
অতঃপর নিরাশ হয়ে বাবা-মাকে সব কথা খুলে বলল সুজন। বলল, ‘তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দাও। এখন তোমাদের পছন্দই আমার পছন্দ।’ এবার মা-বাবার ভাবনা যে একখানা সুন্দরি পাত্রী ঘরে আনতে হবে। পাত্রী খুঁজতে খুঁজতে সুজন নবীন হতে প্রবীণে পরিণতি হতে লাগল। তবে পাশের বাড়ির ঘটক হায়দার, তালুকদার বাড়ির এক সুন্দরি মেয়ের ঘটকালির সংবাদ দেয়। এতে খুশি হয়ে সুজনকে নিয়ে পরদিন বাবা-মা তাদের সম্ভাব্য পুত্রবধূ দেখতে যান।
কনের ঘরের আশপাশ ফুল দ্বারা ঘেরাও করা। কনের বাড়ির পরিবেশ সুজন ও তার মা-বাবাকে যথেষ্ট মুগ্ধ করে। তারা যখন ঢুকল কনের ঘরে, কনে পক্ষ প্রতুল আপ্যায়ন করে। সবশেষে কনে দেখার পালা।
রাশিরাশি পায়ে, নীল শাড়ি গায়ে, মাথায় ঘুমটা পড়া
আসছে এগিয়ে, মাথা কিছুটা নুয়ে, বসল দেখে সে কেদারা।
কনের বান্ধবীরা তার মুখের আঁচল সরিয়ে তার চুখবুজা চন্দ্রমুখ খানি দেখায়। মুখে আলতা নাকে নোলক কানে কানের দোলা, এবার হয়তো কঠিন হবে সুন্দরিকে ভুলা। অমনি সুজন শুরু করে মোবাইলে ছবি তোলা।
বিয়ের দিন তারিখ পাকা। ছবি নিয়ে সুজন এবার ঘুরে একা একা । সপ্তাহ পর বিয়ে। ‘একটি সপ্তাহ চলমান যেমন একটি বছর। কোনদিন জানি বউ আসবে আমার ঘরের ভেতর।’ সুজন বেহুশ দিশেহারা প্রায়।
গুনতে গুনতে বিয়ের দিন আসল। বিয়ের বাজনা বাজল। সকলেই বিয়ের পুলকে মাতল। অনন্ত আনন্দে বিয়ের দিন সাঙ্গ হল।
কিন্তু দুঃখের বিষয়টি বাসর রাতেই বুঝা গেল। কনের কর্ণে শ্রবণ করতে পারেনা, কিছু বলতে পারেনা, দৃষ্টিভঙ্গি আড়াআড়ি। হায়,হায়! পুলকে বাজল আজ ধ্বনি হাহাকারি। এবার সুজন অসহ্য শোকে বিলাপ করতে থাকে;
‘আরে এ দেহি বলেনা, শোনেও না, খালি কিছুটা খায়
আমার দিকে না তাকিয়ে অন্য দিকে চায়।
ওমা, ওবাবা এ কেমন বউ আনলে?
কত দেখেছি অমন বউ খালে আর বিলে।…. হায়, হায়, হায়।।’
মা-বাবার মনেও এই একই হায়, হায় ধ্বনি বাজতে লাগল। কারণ তারা কনে দেখলেও কনের বাক ও শ্রবণ শক্তি দেখে নাই। তাছাড়া, চোখ বুজা ছিল বলে দৃষ্টির দণ্ডটাও বুঝবার পারে নাই। কি আর করার, এতদিনের কনে বাছাইয়ের ফাইনালে এসে এভাবে গোল খেতে হবে তা কে জানে?
গাঁয়ের কেও কেও বলে, ‘বাঁচা মাছ পচা থাহে।’ তাদের মতে বেশি বাঁচনের লাগি সুজন পাইল পচা বউ। আসলে কাওরে দোষনের কিছু নাই, নিশ্চয় এটা সুজনের কপারের মন্দ। সুতরাং বিয়ের আগে এত বেশি পাত্রপাত্রী বাছাই না করাই ভাল। কপালে যা আছে ততো হবেই।