মানুষের মতো আচরণ । সুপ্রভা জুঁই
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১০:১৯ অপরাহ্ণ, | ২৮৮১ বার পঠিত
সিনেমার নাম samsara, অর্থ দাঁড়ায় ‘birth, death and rebirth’ or ‘impermanence'”.
সিনেমাটাকে non-narrative documentary film বলা হইছে। পাঁচ বছর ধরে ২৫ টা দেশের বিভিন্ন জায়গায় শ্যুট করা হয়েছে। এক একটা ফ্রেম মাথা খারাপ করিয়ে দেয়। পাহাড়ের মাঝে প্রত্যন্ত এলাকায় ভিক্ষু সম্প্রদায়ের নানা মনেস্ট্রি। Los Angeles Times এ সিনেমাটা নিয়ে লিখা হয়েছে “as frustrating as it is beautiful.” ভালো কথা কিছু লিখা হয়েছে কিন্তু সেগুলো ভালো ফ্রেম, ভালো মনতাজ, ভালো টেকনিক- এইসব নিয়ে। আমি দেখেছি গল্পটা। আর পাঁচটা দর্শক যেমন দেখেন। আর সে হিশাবে একটা কথাও পেলামনা।Rotten Tomatoes এর ক্রিটিক বলছেন,
Average Rating: 7/10
Reviews Counted: 77
Fresh: 59
Rotten: 18
Critics Consensus: It’s a tad heavy-handed in its message, but Samsara’s overwhelmingly beautiful visuals more than compensate for any narrative flaws.
সিনেমার কোন সাবটাইটেল নেই। সে দরকারই পড়েনি। ছবির এক তৃতীয়াংশ মানে শুরুর কিছু সময় ঐ ‘’free our minds’’ মার্কা একটা অনুভূতি যোগায়। কারণ, ভিক্ষুরা অন্য এক স্তরের বলে দেখতে, ভাবতে ইচ্ছে হয়। তারা মানুষের মতো আচরণ শুরু করলে সেটা নেওয়া যায়না। আচ্ছা বলোতো, দুম করে কি কেউ সাধু হয়?
শুরুতে দেখা যায় আকাশে উড়তে থাকা একটা চিল ঢিল দিয়ে বিস্তৃত বরফি পাহাড়ের সমতল এলাকায় থাকা একটা ভ্যাড়াকে মেরে ফেলে। এই সিন গুরুত্বপূর্ণ। ক্যান সে ব্যখ্যায় পরে আসছি।
একদল ভিক্ষু চলেছেন এক নির্জন গুহায় যেখানে আরেক ভিক্ষু লম্বা সময় ধরে ধ্যানস্থ আছেন। এই ধ্যানস্থ ভিক্ষুর জীবন হলো আমাদের গোটা সিনেমাটা। পরম মমতার সাথে তার ধ্যান ভাঙ্গান অন্যরা। বিশাল নখ, চুল কেটে গায়ের ময়লা মুছে তাকে নিয়ে আসেন নিজেদের ঘাঁটিতে। ভিক্ষু সম্প্রদায়ে এই ভিক্ষু খুব আদরের পাত্র। লম্বা সময় ধ্যানে থাকার ফলে তার চেহারার মাঝে যে নির্লিপ্ততা তা দেখে মনে হয় জগতের সকল কিছুরই উপরে চলে গেছে সে। আমার খুব স্পষ্ট করে জানা নেই তবে আন্দাজ করতে পারি যে মনেস্ট্রির বুদ্ধ ভিক্ষুর চর্চায় শারীরিক সম্পর্কের স্থান নেই। তো সেই মনেস্ট্রিতে বাৎসরিক এক অনুষ্ঠানে আমাদের ভিক্ষু প্রথমবারের মতন ব্রেস্ট ফিডিং দেখেন। এবং তার অভিজ্ঞতার বাইরের এই ঘটনা দেখে তার গভীরে এক নতুন দুনিয়ার সৃষ্টি হলো…
তার ভিতরে কামনা জাগতে থাকে। সে রাতে যৌন স্বপ্ন দেখে, বীর্যপাত ঘটে। গুরু সেসব দেখে বুঝে চিন্তিত হয়ে তাকে আরেক উচ্চতর গুরুর কাছে পাঠান যৌনতার ব্যাপারে জানার জন্য। সেই গুরু কিছু বহু প্রাচীন লিপি দেখান ছবি সহ। একই ছবি। নারী পুরুষ সঙ্গমের। সেই ছবির পাতা একটু বাঁকালে একই পজিশনের মানব মানবী উবে যেয়ে চলে আসে দুটো কঙ্কাল। অর্থাৎ, ক্ষয়। এসব দেখে কি তার কামনা বাসনা চলে যাওয়ার কথা?
আমাদের ভিক্ষু নিজ আস্তানায় ফেরত আসে। ভীষণ ডিপ্রেসড, কিচ্ছু ভালো লাগেনা। যুক্তি ধর্মের নিকুচি করে এক ভোরবেলায় সে ভিক্ষু আশ্রম ছেড়ে লোকালয়ে চলে আসে। ভিক্ষুর পোশাক ছেড়ে বেছে নেয় সাধারণ চাষির পোশাক। এরপরের কাহিনী সুদীর্ঘ। এখানে আর মনোহরা সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য নেই, নেই নিস্তব্ধতার মাঝ দিয়ে সংযোগ স্থাপনের প্রচেষ্টা। এবারে সবটাই বস্তুগত আর সবটাই ছোঁয়ার ভিতর। সে প্রেমহীন কামনার যৌনতায় অংশ নেয়। সামাজিক চাপে তাকেই বিয়ে করে। তার ধারনা সেই মেয়েটিকেই সে ভালোবেসে চলেছে। তাদের সন্তান হয়। ততদিনে সে খুব ভালো মাপের ঘরের পুরুষ হয়ে উঠেছে। তার বাড়ি, চাষ সবকিছুই দুর্দান্ত। জান প্রাণ দিয়ে কাজ করে চলেছে। দেখলে মনে হয় সে সুখী। ছেলে বড় হচ্ছে দিনদিন। কোন কিছুর অভাব নেই। এরমাঝে একদিন এক নারীকে দেখে আবার তার মাঝে যৌন ইচ্ছা জাগ্রত হয়। সে নতুন ধরনের শূন্যতার সাথে পরিচিত হয়। বউ বাচ্চা বাড়িতে না থাকাকালীন এক সময়ে সেই নারীর সাথে সে সঙ্গমে লিপ্ত হয়।
একদিন তার এতদিনের পরিশ্রমে তিলে তিলে দাঁড় করানো এই ফসলের সম্ভারে আগুন লেগে যায়। সব শেষ হয়ে যায়। একই সাথে লোকাল পলিটিক্সের সাথেও পেরে ওঠেনা আর। এতদিনের গুহায় ধ্যানে থাকা লোকও কতটা ভালনারেবল হতে পারে সেটা যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানো হলো। কোন কিছুর অভাব না থাকাটা আমার কাছে জাগতিক মুক্তির মূল হাতিয়ের মনে হয়।
আবারো সেই ভোর রাত… সে ঘুমন্ত স্ত্রী পুত্রকে রেখে ভিক্ষু আশ্রমে ফেরত আসে। ঘাড় অব্দি নেমে আসা সিল্কি সুন্দর সমস্ত চুলকে মুড়িয়ে ন্যাড়া হয়। যেন বিষয় থেকে মুক্তির চেষ্টা। তুলে নেয় ভিক্ষুর পোশাক। এমন সময় স্ত্রী চলে আসে। হয়তো সংসারের দায় এড়ানোর ফলে খিস্তী করে। আর ভিক্ষু থাকাকালীন শেষ চিহ্ন হিশাবে সন্তানকে উপহার দেয়া (তসবীর মতন একটা মালা) ছুড়ে দিয়ে সে চলে যায়। আমাদের ভিক্ষুটি মাটিতে শুয়ে হাত পা ছড়িয়ে কান্না করে। একেবারে ব্রেকিং পয়েন্টের উপর এখন তার অবস্থান।
বিষয় যখন ছিলোনা তখন কি বিষয় শূণ্যের ধ্যান মানানসই? বিষয়ে থেকে মজে পচে তবে তা থেকে মুক্তির চেষ্টা করাটাই যুক্তিগত। বুদ্ধ ধর্মের অনুসারীদেরও তবে কি এক প্রকারে গোড়ামি পাওয়া গেলনা চর্চার সময়ে? (কমন সেন্সের উপরে বলছি কেউ জানলে শুধরে দিবেন)
ঘুমন্ত স্ত্রী সন্তান ফেলে চলে গেছিলেন স্বয়ং বুদ্ধ। সিনেমাতেও এই সিনটা দেখে আমার কেবল রবীন্দ্রনাথের কবিতার একটা লাইন মনে পড়ে। ঐ যেখানে মুক্তির নেশায় মত্ত এক ভক্ত সন্যাস জীবন যাপনের আশায় ঘুমন্ত স্ত্রী পুত্র ফেলে- ঈশ্বর দেখা দাও টাইপ চিন্তায় বেরিয়ে পড়লে অশরীরে থাকা ঈশ্বর ভক্তের উদ্দেশ্যে বলেন-
‘’আমারে ছাড়িয়া ভক্ত চলিলো কোথায়’
নো ওয়ান্ডার নির্বাণ বুদ্ধের প্রাপ্ত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের নয়। কিন্তু রবির দর্শনে আমি আস্থা রাখি। সংসারে থেকে সংসার মুক্তির লীলা আমার কাছে আদরণীয়।
সিনেমার শেষ দৃশ্য ঐ শুরুটার মতন। ভিক্ষুর মাথার উপরে চিল ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাথর পড়বে কি?
আমাদের সকলের মাথার উপরেই ওই চিল ঘুরে বেড়াচ্ছে। কথায় বলে,
‘’ধাক্কা খেলে মক্কা যায়’’
এইসব ধাক্কার জন্য একটা করে চিল মাথার উপরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শুধু ধাক্কা চেনার অপেক্ষা।