গুরু!! আমিও ডিরেক্টর হতে চাই! । সুপ্রভা জুঁই
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫, ৫:০০ অপরাহ্ণ, | ৩৮১৯ বার পঠিত
না, মোটেও ডিরেক্টর হতে চাওয়ার বিষয়টিকে হেয় করে এই শিরোনাম নয়। অনেক আগে থেকেই এই ইচ্ছা ছিলো আমার। ছিলো কী, এখনো আছে! আর থাকবে নাইবা কেন! পর্দায় যা দেখি তার সাথে নিজের তুলনা করতে যেমন সুবিধে হয় তেমনি আর কোথাও হয় নাকি! অনেক সময় নানা scene দেখলে মনে হয়—এইটা তো আমি-ই এর থেকে ভাল পারতাম!
কিংবা,
উফফ!! কি আইডিয়া! যদি পারতাম!
খুব সম্ভবত এরকম কিছু ভাবনা থেকে আর ছবি তোলা, গল্পের idea, ক্যামেরার সহজলভ্যতা এ জাতীয় কিছু ভাবনা থেকে ডিরেক্টর হওয়ার ইচ্ছাটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কিন্তু এরপর থেকেই শুরু হয় সমস্যা। গল্প তো জানি, কিন্তু সেগুলো সংলাপে লিখতে হয় কী করে! জবাব আসে— কমন-সেন্স!
আচ্ছা এবার দৃশ্যে ভাগাবাটি করা হলো কোন মতে। বাহ বাহ! হয়ে গেল চিত্রনাট্য লেখা! দারুণ লাগছে! এবার বন্ধুদের দেখানোর পালা। তিনজনকে দেখানোর পর তিন রকমের interpretation তৈরি হল সেই চিত্রনাট্যের। বলাই বাহুল্য কোথাও সিরিয়াস গ্যাঞ্জাম হচ্ছে। ফলে সবাই মিলে আরেকটা কিছু দাঁড় করানো গেলো। এবার দৃশ্যে তো ভাগ হল কিন্তু অভিনেতা অভিনেত্রী কই পাই! আচ্ছা একে তাকে ধরে সেটাও ঠিক করা হলো। কোনটা মন মত হল তো কোনটা নয়। কীসের যেন একটা তাড়া কাজ করতে থাকে মনের ভিতর। মনে হয় এখনই শেষ না করলেই না। লোকে দেখে কেমন তব্ধা বনে যাবে মনের মাঝে তারই আঁকিবুঁকি সর্বদা চলতে থাকে। এরইমাঝে কাজ করতে যেয়ে বন্ধুদের সাথে খানিক মনোমালিন্যও হয়। এরপর শ্যুট করতে গেলে বোঝা যায় কম্পোজিশনে সমস্যা হচ্ছে। মনের ভাবনার সাথে মিলছেনা। কখনোবা মনের ভাবনাটাও আঁকতে পারছিনা। কে কেমন পোশাক পরবে সেটা নিয়েও কোন ভাবনা হয়নি। ঘরের ভেতরে না বাইরে কাজ করা উচিৎ তা নিয়েও ভাবনার জট! ঘরের ভেতরে হলে কী কী থাকবে সেই ঘরে? আবার ফিরতে হয় চরিত্রের কাছে। আমার চরিত্র এই, অতএব তার ঘরেও এই এই জিনিস থাকবে। কিন্তু অত ভাব্বার সময় কই! টাকাও বা কই! তাই কোনমতে মিলিয়ে একটা কিছু করা হল। বাকিটা এডিটিঙে দেখা যাবে। হক নাম ভরসা!
এখন এডিটিং কই করে! কোনভাবে ম্যানেজ করা হল কিছু একটা। মিলেনা কিচ্ছু। মনে যেমন ছিল তার ধারে কাছেও আসতে পারিনা। সাউন্ড নিয়ে যেমন ভাবনা ছিলো তার কিচ্ছুই হলোনা! ধার করা সাউন্ড যে দিবো লোকে তো গালাবে। আচ্ছা কি আর করা তাই-ই হোক। মন খারাপ হতে থাকে। শেষমেশ একটা কিছু হলো এরপরেও। যা হলো তা দেখে মরে যেতে ইচ্ছা করে। এত কঠিন আর ঝামেলার ব্যাপার একটা ফিল্ম বানানো! আমার ভাবনার ধারে কাছে নেই এর কিছুই! In fact যেসব সিনেমার সমালোচনা করে ফাটিয়ে ফেলি তার ধারেকাছেও নেই। কিন্তু শ্রম গেছে অনেক।
এই ক্ষেত্রে আরেক দলের যা হয় তা হল তিনারা নিজেদের এই অপরিণত কাজ নিয়ে বেজায় খুশি থাকেন!!
এতটুকুন পুরাটাই কমন-সেন্স নিয়া কমন-সেন্স ওয়ালা মানুষদের কাজ নিয়া লিখা। কিন্তু আক্ষরিক অর্থে ফিল্ম বানানো মোটেও চাট্টিখানি কথা নয়। প্রথমত এইটা একটা team-work। ভীষণ organized হওয়া জরুরী। স্ক্রিণ-প্লে থেকে শুরু করে চিত্রগহণের নানা সময়েও আগে পিছে করে বারংবার করে কাজ করতে হয়। চমৎকার একটা co-ordination সবকটা বিভাগে দরকারি হয়ে ওঠে। অর্থাৎ, কাহিনী থেকে চরিত্রের গঠন, চরিত্রের develop, বিশেষ করে চরিত্রের তিন ধরনের profile তৈরি অত্যন্ত জরুরী। সেগুলো হলো—
- সামাজিক profile
- ব্যক্তিগত profile
- শারীরিক profile
এইটা চিন্তার ক্ষেত্রে খুব সুবিধে করে। যাই হোক এখন কথা হলো, এই ধারণা পাওয়া যাবে কই থেকে? সমাজ থেকে, মানুষ দেখে, সমাজ আর মানুষ আর সময়ের সাথে সাথে সেই সমস্ত শ্রেণীকে বোঝা জানা থেকে। উফফ কত্ত জটিল!!! research আমাদের কাজে আমি খুঁজে পাইনে। হয়তো করেন কেউ কেউ ভালোমতনই। আমি সেটার খুব কমই দেখেছি, হতে পারে আমার দেখাও কম!! সেক্ষেত্রে বলা চলে একজন ডিরেক্টর হবেন একজন দার্শনিক। কি পরিমাণ প্রস্তুতির দরকার পড়ে তার জন্য! পাশাপাশি চর্চাটাও। সেইটা কিভাবে করা যায়? যে ব্যাপক মাত্রায় এবং নিখুঁত ভাবে সিনেমাতে detailing এর দরকার পড়ে তা কী করে অর্জন করা যায়? উত্তর জানা নাই।
এইবারে আসি এই লিখার মূল বক্তব্যে। ইদানিং কালে রেডিওতে যে গান আমরা শুনি সেগুলোর কথা আর সুর আমার একইরকম লাগে। অনেক সিনিয়রদের বলতে শুনেছি যে হিন্দি শব্দের ছন্দ ভালো হয় বাংলার থেকে। আমারও সেরকমই ধারণা ছিলো। কিন্তু এ যে নিছকই পাশ কাটিয়ে যাওয়ার ছল সেটা বুঝিনি। সব ভাষারই একটা রহস্যময়তা আছে, একটা গণিত আছে।
সে তো গেলো গানে। কিন্তু চিত্রনাট্য কিংবা সংলাপে কি করে humor, detailing গুলো আমরা এড়িয়ে যাই? সাহিত্যের aesthetic কে কেন অবজ্ঞা করে কিছু একটা লিখে বাকিটা visualization দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া যাবে এই ধারণা নিয়ে চলবো? সেটা অবশ্যই করা সম্ভব কিছু ক্ষেত্রে। কারণ মাধ্যমটাই যে দেখবার!! সুতরাং সেটিকে খাট করে ভাব্বার কারণই নেই। তীব্র হাওয়ার দমকে পতপত করে পালটে যাচ্ছে বইয়ের পাতা তার মানে যে ঘোর সঙ্কট সেটা না বলে দিয়েই তো সবাই দিব্বি টের পেয়ে যায় ! কিন্তু সাহিত্যের সাথে তো চিত্রনাট্যকে এড়িয়ে দেখলে চলবেনা। এবং এরা খুবই কাছাকাছি দুটি মাধ্যম যেখানে প্রায় একই ধরনের কাজ করা হয়। একটা বইকে সাধারণ ভাবে একটা ছবির থেকে নিচের স্তরের ভাবলে একটা মজার কথা শেয়ার করি—
অরুন্ধুতি রয়ের ‘The God of Small Things’ বইটি সিনেমার জন্য চাইলে তিনি সেটার অনুমতি দেননি। তাঁর মতে যত মানুষ বইটি পড়েছে তারা তাদের মাথার ভেতর প্রতিটি চরিত্র নিয়ে, প্রতিটি scene নিয়ে একটা একটা করে সিনেমা বানিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু এটা নিয়ে যদি একটা film বানিয়ে ফেলা হয় তখন সবার মাথা থেকে সেই filmগুলো মুছে যাবে। সেটা তিনি চাননি। হ্যাঁ একজন লেখকের কাছে তাঁর পাঠকের মাথায় তৈরি সেই সিনেমাটায় হয়তো সব।
এ তো হলো একজন লেখকের কথা। আরেকটা মজার প্রতিফলন যে আমাদেরই তৈরি সেটা কি খেয়াল করেছি? সিনেমাকে কিন্তু আমরা বইও বলি। কেন বলি? তার মানে অবশ্যই সিনেমার মাঝে আর একটা বইয়ের মাঝে আমরা কিছু similar অনুভূতি পাই। সেক্ষেত্রে আমাদের চিত্রনাট্যের দক্ষতা ভীষণ দরকার। অনেক সময় একটা সংলাপ কী একটা চরিত্রের নাম এসব কিছুর জন্যই মানুষের মনে আচড় কাটে একটা ছবি। এসব কিছুই চিত্রনাট্যের maturity’র উপর নির্ভর করে। এ জিনিস কী করে অর্জন করবো? এদেশের হয়ে বিটা মুভমেন্টের(Beta Movement) এর সমন্বায়কের দায়িত্ব পালন করার সময় সময় মোস্তফা মনোয়ার স্যারের বাসায় যাই। বলি যে স্ক্রিণ-প্লে technique এ পড়ছি। শুনে বললেন,
‘ভালো চিত্রনাট্য লিখতে হলে প্রচুর সাহিত্য পড়তে হবে। রবীন্দ্রনাথ পড়তে হবে, নজরুল পড়তে হবে।’
এ দু’জন কিংবদন্তীর নাম এলেও আসলে সব-ই পড়তে হবে। সব থেকে ভালোটাও আবার সব থেকে খারাপটাও। কারণ সিনেমা বানাতে হলে আমার সবটাই জানতে হবে যে! এখন কী ভাল আর কী মন্দ সে আলচনায় না যাই, সেটা যার যার দৃষ্টিভঙ্গির উপর তোলা থাক। আমার কথা হলো সেখানে আমরা কতটা কাজ করছি, কতটা সময় দিচ্ছি? আমি কী আমার সংস্কৃতি নিয়ে জানি? আমার শিকড় নিয়ে জানি? আমার এখনকার সময় নিয়ে জানি? আমার মানুষগুলো কী করে এখানে থাকে তা জানি। প্রত্যেকটা চরিত্রের জায়গায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে পরিষ্কারভাবে কী তাকে ধরতে পারি?
কমন-সেন্সের উপর ভর দিয়ে একটা ছবি বানিয়ে ফেলতেই পারি। আর সেটা যদি সবাই দেখেন তবে সবাইকে আমি প্রভাবিত করছি আমার কাজ দ্বারা, আর কাজে যদি কোন বক্তব্য থেকে থাকে তার দ্বারা। এই স্বল্প জানা দিয়ে এবং ভুল জায়গায় শ্রম দিয়ে সমাজে কী প্রভাবটা আমি ফেলছি? কিছু কিছু কাজের ক্ষেত্রে তা রীতিমত crime বলে মনে হয়। team-work -ই যদি হবে তো সেরকম একটা দল কী বানাতে চাচ্ছি? ডিরেক্টর ছাড়া আর কিছু কেন হতে চাই না? আর কি কি হওয়া যায় সেটা কি জানি? একটা কাজের frame-work কাজের design-ই তো করতে শিখলাম না আমরা। এই সকল প্রস্তুতি কী করে নেওয়া সম্ভব? উত্তর জানা নাই। Art Direction, Costume Design তো ছেড়েই দিলাম। Scene গুলি নিয়েও এতটা Detail এ এখনো ভাবতে শিখিনি আমরা। প্রতিটা scene ধরে ধরে এঁকে ফেলার একটা minimum দক্ষতা থাকা উচিৎ। মাথায় যা আনতে পারছি তা physically আনার দক্ষতা থাকা উচিৎ। অর্থাৎ ঐ আঁকার 2d জায়গা থেকে 3d তে তার রূপান্তর ঘটানোর যোগ্যতা থাকা উচিৎ।
স্থান, কাল, পাত্র সম্পর্কে ঠিক ঠিক ভাবে জানা থাকলেই সেটা সম্ভব। এতটা confident হতে হলে যে পড়াশুনা আর পর্যবেক্ষণের অসাধরণ একটা প্রস্তুতি দরকার তা কী করে করি? উত্তর জানা নাই। এ শুধু আমরা যারা কাজ করতে চাই তারাই নয় অনেক নাম করা লোকজনেরও নেই। এমনকি কমন-সেন্সও যে কত খারাপ হতে পারে সেটাও এখন অনেক কাজ দেখলেই বোঝা যায়। একটা কথা শোনা যায় যে, উনি একজন Director Material। তার মানে কিছু গুণাবলি থাকতে হয় একজন ডিরেক্টরের। সেটা লাভ করার উপায় কী? আগের সব প্রশ্নের মতই এরো উত্তর জানা নাই।
ছবি যে একটা দৃশ্যমান কবিতা! কোন প্রকার শব্দ ছাড়াও তা সম্ভব। আমি সেটা জানিনা তেমন তাই সে ব্যাখ্যায় না যাই। কিন্তু simply ‘অপুর সংসার’এর এই যে অংশটুকুন—
— অপর্ণা
— হুম
— তোমার অনুশোচনা হয় না?
— কি হয়না?
— অনুশোচনা।
— অত শক্ত কথা বুঝিনা।
— আফসোস বোঝ? আফসোস?
— বুঝি।
— আফসোস হয় না?
— কিসের আফসোস?
— তাও বুঝিয়ে দিতে হবে?
— হ্যাঁ হবে।
— বড়লোক বর ফস্কে গেল তাই আফসোস।
— (হাসি)
— হাসছ!
— না হাসছি না কাঁদছি।
— তোমার নিশ্চয় আফসোস হয়। তুমি আমাকে বলনা।
— তা হয় বৈকি। কেমন পায়ের উপর পা দিয়ে বসে থাকতে পারতাম।
— চললুম।
— কোথায়!
— ঝিয়ের খোঁজ করতে।
— এই শোনো, কি ছেলেমানুষি করছ! উঠে এস!
— সরো।
— ঝিয়ের মাইনে দিবে কে?
— আরেকটা টিউশনি নিবো।
— তাহলে আমার বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিও।
— কেন?
— এমনিতেই আপিস করে ছেলে পড়িয়ে সেই তো রাত্তির করে বাড়ি ফের। তার উপর আবার…
— আর উপায় কি বল।
— আমি বলবো? যে টিউশনি টা আছে সেটাও ছেড়ে দাও।
— তারপর?
— তারপর আমার গরীব বর সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরে আসবে। আর আমার কোন অনুশোচনা থাকবেনা।
শুরুর কথাটাও কিন্তু অনুশোচনা! এই যে একটা শব্দ দিয়ে শুরু হলো আর সেই শব্দটিকেই শেষে যেভাবে মুক্তি দেওয়া হলো, এই পুরো অভিজ্ঞতাটাই অনন্য! শেষ সংলাপটি দর্শকদের কাছে মনে হবে, মোক্ষম এই কথাটাই অপর্ণার বলার কথা! সেই সাথে চরিত্রের সাথে যে justice টা করা হলো সেটিও অসামান্য! ঠিক যেন একটা puzzle মিলিয়ে ফেলা হলো!
চিত্রনাট্যের দৃশ্যরূপ হল সিনেমা। তাই এ দু’জনকে আলাদা করে রেখে একটা complete কিছু আশা করা যায় কি? আমাকে অনেকেই বলেন মুভি বানাই না কেন কিংবা কবে বানাবো। আমার এত কাজ করার কোন সাহস নেই, সময় নেই, গাইড লাইনও নেই। সেটা কাজ করতে থাকলে সম্ভব। রেসিপি জোগাড় করবো কিন্তু রাঁধবনা সেটা কিন্তু বলছিনে। কিন্তু এই জানার প্রস্তুতিটা না থাকলে আমি যে কিছুই করতে পারবোনা! আর সেটা খালি আমি একা হয়েও হবেনা। এই দল আমি কই পাই, কেমন করে বানাই! উত্তর জানা নাই। আসলে জানা নাই’টা একটা escape। এ পর্যন্ত যতবার বলেছি ‘জানা নাই’ তার সবটাই আসলে জানি। আসল কথা হলো কাজ না করার ধান্দা!! এই ধান্দাবাজি যতদিন থাকবে ততদিন একটা করে সিনেমা বানিয়ে তা সবাইরে দেখানো একটা crime এর সমান আমার কাছে। কারণ এর ফলাফল অতি ভয়ংকর। কমন-সেন্সওয়ালারা যেইটা আঁচ করারো ক্ষমতা রাখেননা। এ বিষয়টা আমাকে দারুন আতঙ্কিত করে তোলে! হু, আমি ভীতু।
. # #