দাস পার্টির খোঁজে : সঙ্গে-প্রসঙ্গে … । শামস শামীম
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১২:২৮ পূর্বাহ্ণ, | ৪০০৫ বার পঠিত
সম্ভবত ২০১১ সালের এক বর্ষাকাল। সদলবলে টাঙ্গুয়ার হাওর দেখার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আমাদের মোরশেদ ভাই। আমাদেরও এই ঘুরঘুরন্তির সঙ্গে যুক্ত করলেন। টাঙ্গুয়া ঘোরাঘুরির আগে একদিন আসলেন শহরে। এক বন্ধুর বাসায় রাত্রিযাপন করি সকলে। ওই সময় বন্ধুর বাসায় ‘মুক্তিযুদ্ধে দাস পার্টি’ নামের একটি গ্রন্থ তার চোখে পড়ে। বইটিতে দাসপার্টি ও তাদের যুদ্ধক্ষেত্র, প্রেক্ষাপট, দাসপার্টি গঠনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে কিছুই ছিল না। শুধু যোদ্ধাদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ছিল। বইটি তিনি এক পলকে নেড়েচেড়ে দেখলেন। পরে বললেন, এটা নিয়ে একটি মহাকাব্য বা উপন্যাস হতে পারে। তিনি উপন্যাস লেখার আগ্রহের কথাও জানালেন।
তারও আগে ওয়ান-ইলেভেন প্রাকপূর্বে তিনি যখন ইউরোপের ঝলমলে জীবন ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গাট্টিবোঁচকা নিয়ে চিরতরে এই দেশে চলে আসেন তখনও ফোনে একদিন কথা হয় সামহোয়ারে (সামহোয়ার-ইন ব্লগে) আমার প্রতিবেদনধর্মী একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্টোরি নিয়ে। সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের মুক্তিযুদ্ধে শহিদ তিন যোদ্ধা শহিদ জগৎজ্যোতি দাস, শহিদ তালেব উদ্দিন আহমেদ এবং শহিদ গিয়াস উদ্দিনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় ও যুদ্ধক্ষেত্র সম্পর্কে যৎসামান্য ছিল ওই লেখায়। ওই প্রতিবেদনে দাসপার্টির মৃত্যুঞ্জয়ী কমান্ডার শহিদ জগৎজ্যোতি সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়েছিল। তখনো দাসপার্টি নিয়ে টুকটাক কথা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের অসম সাহসী ও দুর্ধর্ষ দাসপার্টির যোদ্ধাদের নিয়ে কাজ করবেন — এই স্বপ্ন হয়তো দীর্ঘদিন ধরেই লালন করছিলেন তিনি।
‘দাস পার্টির খোঁজে’ গণযুদ্ধের এক মৌলিক উপাখ্যান রচনা ও প্রকাশের পর এ নিয়ে লেখকের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নের সঙ্গে-প্রসঙ্গে ছিলাম বলেই অপ্রাসঙ্গিক হলেও বিষয়টি উল্লেখ করতে হয়েছে। কারণ ঘরে বসে, উঁচু তলায় স্বপ্নের ঘোরে থেকে হাসান মোরশেদ এই গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থটি রচনা করেননি। রোদে-বৃষ্টিতে, ঝড়-আফালের দুর্ভোগ পেরিয়ে তার দীর্ঘদিনের স্বপ্নটি তিনি বাস্তবায়ন করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য সেক্টরের মতো দাসপার্টির যুদ্ধক্ষেত্রের বিন্যাস ছিল না। এর অবকাঠামোগত অবস্থা ছিল ভিন্ন ও প্রতিকূল। দুর্গম এলাকা হিসেবে ভয়াল ও বিপদসংকুল ছিল যুদ্ধক্ষেত্র। সাহস, একাগ্রতা, বুদ্ধিমত্তা দিয়ে কিশোর-তরুণরা ভয়াল ও বিপদসংকুল যুদ্ধক্ষেত্রকে তীর্থভূমিতে পরিণত করেছিলেন। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে, জীবন ও মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে প্রতিনিয়ত লড়াই করেছেন। যারা শহিদ হয়েছেন, শেষ পর্যন্ত বুক চিতিয়ে সামনে এগিয়ে লড়াই করে গৌরবের মৃত্যু বেছে নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন তাদের বীরত্বগাথার কথা শুনে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা উজ্জীবিত হতেন।
হাওর। তারের মতো জড়িয়ে রেখেছে শান্তি ও সম্প্রীতির সোমত্ত জনপদ সুনামগঞ্জকে। দুর্গম জনপদ হিসেবে পরিচিত এই অঞ্চল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর উন্নয়ন-অবকাঠামো পৌঁছেছে হাওরেও। বদলেছে হাওরের কাঠামো ও গঠন। তারপরও উন্নয়ন-অবকাঠামোয় হাওরের জনপদ কতটুকু বদলেছে সেই প্রশ্ন এখনো প্রাসঙ্গিক।
‘দাস পার্টির খোঁজে’ আখ্যানের লেখক হাসান মোরশেদ। যুদ্ধকালীন একাধিক সেক্টরের অন্তর্ভূক্ত এই দুর্গম হাওর এলাকার দাসপার্টির গেরিলা যোদ্ধাদের একের পর এক সাহসী অপারেশনের দৃশ্য কল্পনা করে হয়তো উজ্জীবিত হয়েছেন গ্রন্থকার স্বয়ং। ৪৫ বছর পর দাসপার্টির দুর্গম যুদ্ধের ময়দান সেই সময়ের দৃষ্টিতে কল্পনা করে তিনি রচনায় নয়া দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন। এই গ্রন্থে সবচেয়ে বড় ও মোটা দাগে যেটা দেখিয়েছেন সেটা হলো মুক্তিযুদ্ধকে ‘বিশেষ বাহিনী’-র যুদ্ধ না দেখে গণযুদ্ধ হিসেবে দেখা। দাসপার্টির এই গণযোদ্ধারা খেতাব না পাওয়ার প্রেক্ষাপটও আকার-ইঙ্গিতে বলেছেন।
দাসপার্টির কমান্ডার রাষ্ট্র কর্তৃক ঘোষিত সর্বোচ্চ খেতাব না পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সকল গণযোদ্ধাদের পুঞ্জিভূত ক্ষোভও ফুটে উঠেছে। যুদ্ধের পর গণযোদ্ধাদের বাদ দিয়ে একটি ‘বিশেষ বাহিনী’ ক্ষমতাবলয়ের ছত্রচ্ছায়ায় বড় খেতাব ঘরে তোলার ঐতিহাসিক ঘটনাটি মোটা দাগে দেখিয়েছেন তিনি। এই বাহিনীর কমান্ডারের করুণ মৃত্যুর প্রসঙ্গটি সহযোদ্ধা ইলিয়াসের চোখ দিয়ে দেখিয়েছেন অত্যন্ত আবেগঘন করুণভাবে। সেই দৃশ্যকল্পনায় চোখ ভিজে যায়। ইলিয়াস মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কমান্ডারকে সঙ্গ দিয়ে গেছেন। কমান্ডার জগৎজ্যোতি তাকে পালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। আমার মনে পড়ছে দাসপার্টির যোদ্ধাদের খোজ করতে গিয়ে মোরশেদ ভাইকে এই ইলিয়াসের খোঁজ আমিই একদিন দিয়েছিলাম!
৪৫ বছর আগে কেমন ছিল হাওর? তখনো স্থল ও নৌপথে এতটা আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। বর্ষার হাওরে আফাল ছিল আরো ভয়ঙ্কর। তিনটি সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা বিশাল এই নৌপথে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করতে প্রতিনিয়ত প্রতিবন্ধকতার মুখে ছিলেন। তাই ভূপ্রাকৃতিক ব্যবস্থা বিবেচনায় একটি গেরিলা পার্টি গঠনের সিদ্ধান্ত নেন সংগঠকরা। তরুণ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও ভারতীয় জনৈক মেজর বাথ এই বাহিনী গঠনে বিরাট ভূমিকা রাখেন। যদিও ‘দাস পার্টির খোঁজে’-র লেখক সুরঞ্জিত সেনের ভূমিকাকে স্মরণ করেছেন। তবে ভোটের রাজনীতিতে তার নানা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে তিনি হতাশ হয়ে দাসপার্টির তথ্যসংগ্রহ পরিকল্পনায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত থেকে মুখও ফিরিয়ে নিয়েছেন! সুরঞ্জিতের সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন তিনি! এই যুক্তিসঙ্গত আবেগকে ঝেড়ে ফেলে সুরঞ্জিতের সঙ্গে কথা বলতে পারলে হয়তো দাসপার্টির প্রসঙ্গে আরো নতুন কিছু জানা যেত।
‘দাস পার্টির খোঁজে’ তিনি করেছেন এর যোদ্ধাদের খোঁজ। জীবিত যোদ্ধাদের স্মৃতি লোপ পাওয়ার আগে তাদের জবানি ধরেছেন গ্রন্থে। তাদের চোখে দেখেছেন দাসপার্টির অ্যাকশন। দুর্ধর্ষ এ গেরিলা যোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদানে ক্ষমতাসীনদের উদাসীনতায় লেখক হতাশ হয়েছেন। দাসপার্টির খোঁজ করতে গিয়ে তিনি খুঁজে পেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চাপাপড়া কয়েকটি গণহত্যার ঘটনা ও বীরাঙ্গনাদের। অন্যান্য যুদ্ধ, যোদ্ধা ও সংগঠকদের ভূমিকাও আলোচনা করেছেন গুরুত্ব ও নতুনত্বে। যুদ্ধপরবর্তী রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন ও মুক্তিযোদ্ধাদের নির্যাতনের বিষয়ও আলোকপাত করেছেন মুক্তিযুদ্ধের এই প্রামাণ্য গন্থে।
দাসপার্টির যোদ্ধাদের মাধ্যমে লেখক ফিরে দেখেছেন একাত্তরকে।
বিস্মৃতপ্রায় জাতি বাঙালির প্রতিনিধি হয়েও তিনি ৪৫ বছর পর মুক্তিযুদ্ধের এক তরুণ গেরিলা বাহিনীর যোদ্ধাদের জবানিতে দাসপার্টির সহযোদ্ধা সহ মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনার অশ্রুত, উপেক্ষিত, চাপাপড়া অধ্যায়কে শুধু গুরুত্বই দেননি, — মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নানা বিভ্রান্তিকর তথ্য ও তত্ত্বকেও প্রজন্মের সামনে নিয়ে এসেছেন।
স্বজাতির রক্তাক্ত অবয়ব ও গৌরবের আখ্যানকে তরুণ প্রজন্মের কাছে পরিচিত করে তুলতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে ‘দাস পার্টির খোঁজে’। মুক্তিযুদ্ধের সামাজিক অধ্যায় ও গণযোদ্ধাদের মৌলিক আখ্যানে ডায়েরির আদলে সাজানো অনন্য গ্রন্থখানি সাম্প্রতিক মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। দাসপার্টির খোঁজ দিতে গিয়ে বিরুদ্ধ-বৈরী স্রোত ঠেলে তিনি আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন গণযুদ্ধ একাত্তরের অজানা অনেক মৌলিক ঘটনাকে। অভাবী মুক্তিযোদ্ধাদের পাণ্ডুর মুখগুলোকে এই গ্রন্থের মাধ্যমে আবারও নতুন করে পাঠ করা গেল।
মেরিট ফেয়ার প্রকাশনী থেকে আগস্ট মাসে প্রকাশিত ‘দাস পার্টির খোঁজে’ সম্ভাব্য পাঠক ও গ্রাহকদের সরবরাহ করছে প্যাপিরাস পাব।
পাদটীকা : দাস পার্টি। ১৯৭১ সনে হাওরাঞ্চলে দাপিয়ে-বেড়ানো অসম সাহসী এক গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদল। এর নেতা সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের ছাত্র শহিদ জগৎজ্যোতি দাস। অনন্য ও অসম সাহসী এই যোদ্ধার কীর্তির কারণে যুদ্ধকালীন রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁকে সর্বোচ্চ খেতাব দেওয়ার ঘোষণা হয়েছিল। দুর্গম হাওরাঞ্চলে দাসপার্টির নেতৃত্বে তাঁর নেতৃত্বাধীন এই গেরিলা বাহিনী পাকিস্তানী হানাদার ও তাদের দোসরদের পর্যুদস্ত করেছিল। দাসপার্টির যোদ্ধারা জীবন তুচ্ছ করে একের পর এক গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করে শক্রুমুক্ত করেছিলেন স্বদেশভূমি। এই গেরিলা বাহিনীর অনেকেই এখনো জীবিত আছেন। তাদের জবানিতে দাসপার্টির সহযোদ্ধা সহ মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনার অশ্রুত অধ্যায় সংকলিত করেছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক ও বাংলাদেশের ব্লগিং আন্দোলনের কর্মী হাসান মোরশেদ। ২০১৬ সনের ২৯ আগস্ট হাসান মোরশেদের ‘দাস পার্টির খোঁজে’ শীর্ষক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রামাণ্য গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে মেরিট ফেয়ার প্রকাশন। ডায়েরির আদলে লেখা এই গ্রন্থখানা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-অনুসন্ধিৎসু পাঠককে সেই সময়ের সড়কে এক-লহমায় টেনে নিয়ে যায়।