দিগন্ত সঙ্গীতে মেশা তোমার ডানা । মেঘ অদিতি
প্রকাশিত হয়েছে : ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১০:১১ পূর্বাহ্ণ, | ২৪২৪ বার পঠিত
১
বড় টানের হাওয়া আজ। বন্ধ চোখের মায়ায় ভেতর জন্ম নেয়া সবুজের কাছে বড় বেশি ঋণের দিন আজ। চোখ খুললেই ছড়িয়ে পড়ে কি তাই অরণ্য! রোদের গায়ে কে দিচ্ছে এত কারচুপি টান। হুল্লোড়ে উঠে আসছে দু পাশের নীলাভ জল। দিগন্তের সঙ্গীতে দূরে সমুদ্র জাগছে।
আমি তো মুগ্ধ ওই সবুজ আধিক্যে। সবুজের ভেতর কে যেন অহর্ণিশ ডেকে যায়। ডাকতেই থাকে। কে? হয়ত কেউ সত্যি ডাকে হয়ত ডাকে না কিন্তু আমি শুনতে পাই সে ডাক। পিছু ফিরে তাকাই। সময় পিছিয়ে চলে, সময় এগিয়ে চলে। তাপমাত্রা কমতে কমতে গুটিগুটি আরও উত্তর ছাড়ায়। শীত করে খুব। সবুজ আরও ঘন হয়ে টুপটাপ রঙ ছড়াতে থাকে, কী করে যেন আমি এক প্রাচীন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে যাই। ভাবি, কেউ আছো বলে ডেকে উঠব কি না। তখনই শঙ্খধ্বনি। দরজা খুলে যায় আপনি। দেখি এক নবজাতকের মুখে আলো পড়ে জেগে উঠছে উষ্ণতা। এক আশ্চর্য ছবির ভেতর দিয়ে ভ্রম নয়, আমি যেন কারো ভ্রমণ আঁকি । চেতন থেকে যাতায়াত ঘটে চলে অচেতনে। বাস্তবতা থেকে এক লহমায় নেমে আসে পরাবাস্তবতা।
সময় ঘুরে দাঁড়ায়। সিনেফ্রেমে পরপর জুড়তে থাকে কার শৈশব, কৈশোর। কার? ক্লোজফ্রেমে ধরা হয় স্পর্ধিত যৌবন। কার?
বিপন্নতাকে ছুঁয়ে তুমি হেঁটে এলে যত পথ, সে পথের শেষে এসে কেন থেমে আছে অমন বিমর্ষ মুখ.. সত্যি কী ভীষণ আনমনা.. নাকি সত্যি ক্লান্ত আজ? অভিমানে থেমে গেলে তুমি? বুঝি তারপর,গেলে মিশে মহাশূন্যে সবার অলক্ষ্যে!
রঙ ছড়ায়। কেবলই রঙ? না কি অক্ষরও? দিগন্ত থেকে আঙুল মুগ্ধতায় তুলে নিই সে রঙ। অবাক হয়ে দেখি কুয়াশার ভেতর থেকে এক বাইসাইকেল ফুটে ওঠে। চাকা গড়ায়। অস্পষ্ট থেকে ধীরে ধীরে ফুটে ওঠে ছবি। চাকার সাথে পথ থেকে উঠে আসে ধুলো । প্যনারমিক ভিউ থেকে ঘুরে ক্যামেরা স্থির হয় বুকের আভাসে ঘাপটি মেরে বসে থাকা এক জাদুকরের আবাছায়ায়। জ্বলজ্বলে সবুজ চোখ, আর শব্দ, কী নির্জনতায় রেখে যাও তুমি জলছাপ !
২
পাহাড় বললে পাহাড়। আবার চা বাগানও। নির্জনতার ভেতর ভেতর মগজে যে ঘোর তৈরি হয় তাতে ঝলসে ওঠে বিদ্যুৎ । বিদ্যুতের চলমানতায় যাত্রা শুরু হলে লেখা হয় পাহাড়। মাথায় প্রবল ঘোর। হয়ত বাইরে থাকে লড়াই। জীবিকার, যাপনের। তবু কী করে যেন তৈরি হয় শব্দ। বিপন্নতা থাকে তবু শব্দের পর শব্দ জুড়ে যারা আসে তার নাম পঙক্তি আর তার জন্য কাগজ, কলম কিস্যু দরকার নেই, নেইই। অনেক কিছুই তো থাকে না। হয়ত আলাদা কোনো লেখার টেবিল নেই, নেই একলা হবার কোনো আলাদা ঘর। তবু তারা আসে যখন তখন, এভাবেই কবিতার শিষ বেজে ওঠে। ক্যানভাসে শব্দের ব্যবহার দমকা হাওয়ার মত উঠে আসে। কথা বলে তারা অন্যরকম সুরে। আর সেইসব কবিতা যার হাতে সে এক মস্ত জাদুকর। নইলে কী করে মগজের ঘোর লাগা লেন ধরে হেঁটে যেতে যেতে সে শব্দ নিয়ে খেলে। খেলে একা!
পৃথিবীতে তুমি-আমি যতটা একা বলে মনে করি নিজেদের, আসলে তা কিন্তু নই আমরা। পৃথিবীর কোনো প্রান্তে হয়তো কেউ না কেউ থাকে। হয়ত মনে ও মননে সে তোমার সংকেতগুলো ধরতে পারে। থাকেই, নইলে অমন আড়াল করা খেলায় তুমিই বা কী করে লিখে রাখো পাহাড়! তোমার সাংকেতিক শব্দমায়ার ভেতর কিভাবে জ্বলে ওঠে দ্যুতি? কোলাহলের বিপরীতে নিমগ্ন নির্জনতায় তুমি আশ্চর্য সে জাদুকর যতিচিহ্নের বাইরে বা ভেতরে শব্দজাদুতে নিস্পৃহ ভঙ্গীতে লিখে চল স্বকীয় একক কবিতা। ধর সারাদিন তুমি আড্ডায় কাটিয়েছ, অথবা কাজে নিমগ্ন ছিলে, কত বিষয়ে নানাজনের সাথে তোমার মত বিনিময় হয়ত হয়েছে। কিন্তু তোমার গভীর থেকে বেরিয়ে এল যে কবিতা তা এক্কেবারে আলাদা। হয়তো কোন এক বিকেলে তুমি পথ হাঁটছিলে। মেঠো পথ। হাঁটতে হাঁটতে দেখেছিলে কীভাবে নুয়ে পড়ছে সূর্য। শহুরে পথে দেখেছিল পথচলতি ঘরে ফেরা অসংখ্য মুখ। হয়তো তাদের সাথে কথা বলেছিল, হয়তো বলোনি, ছবিগুলো তোমার ভেতর ঘটিয়েছিল অনুরণন। আর তুমি অনুবাদ করেছিল সেইসব মুখ ও মুখরতা। এভাবেই চলতে চলতে চিহ্ন রেখে গেছো তুমি প্রতি পদক্ষেপে।
৩
হাওয়ার দাপটে বড় চিরকুট ওড়ে আজ। ঝরা বকুলের আছে এই বিকেলের সামান্য সুবাস আর আগাগোড়া সেই যে বাইসাইকেল, তার চাকার দাগ! কিজানি কতটা ভাবনার সাথে রঙ মিশিয়ে নেবার পরও সে দাগগুলো ঠিক সরানো যায়নি। হয়তো তুমি ভাবো বহুদিন পথ হাঁটার পর আজ তুমি ক্লান্ত। সে দিনগুলো আর নেই। সত্যি কি নেই! চৈত্রের দুপুরগুলোতে তুমি বলতে পারো এখনও তোমার মন কেমন করে ওঠে না কবিতার জন্য! বলতে পারো বৃষ্টিতে ভিজতে গিয়ে কখনও তোমার মনে হয় না কেউ আছে যার হাত ধরলে তোমার মাথার ভেতর জ্বলে ওঠে স্ফূলিঙ্গ! ওটুকুই তো ঠাঁই। ওটুকু আশ্রয়ের লোভই তোমার অস্তিত্ব । যেন আড়া চৌতাল কুহু!
যেমন আমার— ছিল বলতে ছিল— অল্প কিছু সুর। ছিল অপেক্ষা। ধরো, যেখান থেকে ওই নীল আকাশটা ঘাসের সবুজে মিশেছে তাকে কী বলে? দিগন্ত কি! ঠিক সেখান থেকে কখনও আকাশ কালো হয়ে গেলে মনে হত কেউ আসছে। বাতাসে ভেসে আসছে তার শরীরের গন্ধ। আর পেন্সিলবক্সের ভেতর ঘাপটি মেরে আছে মন্থর পাসওয়ার্ড যা ঠিকঠাক বসিয়ে দিলে সেই ঘন্টা বাজবে ঢং ঢং ঢং , আর তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে স্পষ্ট হবে এক বাই সাইকেল।
কোথা থেকে কোথায় গেলে যে ভাবনা নামের সম্পর্কের ভেতর এইসব ঝমঝম বাজনা বাজে। বাক্যবন্ধে জমতে থাকে বসন্তোৎসব। পরিযায়ী মেঘেদের গায়ে সেভাবেই তো লাগল লাল ঘোর চুমু সমেত ঠোঁটছাপ। দামাল ঘোড়া ছুটল কোথাও। খুরে উঠে এল ধুলোর আবির। কতটা পথ পেরিয়ে তবেই ছুঁতে হল আনকোরা সেইসব অভ্র প্রাচীর। অথচ— কোনোমতে টিকে থাকার খেলাটাও যখন সাথে, সেটাই জীবন। সেন্টিগ্রেডে হু হু বাড়তে থাকা তাপ যে ফারেনহাইটেও বাড়তে থাকা পারদ হয়ে উঠবে না তা তুমি জানো?
তুমি-আমি আলো নির্মাণের কথা ভেবেছি। তুমি-আমি এক আধটু স্বপ্ন দেখতে দেখতে আলো জ্বেলেছি ঘোরের অন্ধকারে। এবং আমরা দেখেছি আদিবাসী ওই মেয়ে, চলনে যার অন্তর্গত কবিতার ছাপ।
সেসব দেখতে দেখতে ঘাসের ওপর পা ফেলে হেঁটে আসছিলে তুমি। তোমার দৃষ্টি থেকে সবুজ ক্লোরোফিলে তখন তৈরি হচ্ছে আমার প্রাণশক্তি। কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে কল্পিত মেরুরেখা ধরে এগিয়ে আসছিলে তুমি। নির্মিত হচ্ছিল আমার আকাশ, নূপুর নয়, ভো-কাট্টাও নয় কেবল খুব বড় একটা আ-কা-শ যাতে তুমি নির্মাণ করবে আমাকে।
তারপর?
কী এমন ঘটে গেল হঠাৎ? কেন থেমে পড়লো তোমার ধুলোমাখা ধূসর পা?
বিপন্নতাকে ছুঁয়ে তুমি হেঁটে এলে যত পথ, সে পথের শেষে এসে কেন থেমে আছে অমন বিমর্ষ মুখ.. সত্যি কী ভীষণ আনমনা.. নাকি সত্যি ক্লান্ত আজ? অভিমানে থেমে গেলে তুমি? বুঝি তারপর,গেলে মিশে মহাশূন্যে সবার অলক্ষ্যে!
তোমার ডানার মায়া, হৃদয়ে রাখছি তুলে, স্বাক্ষর রেখেছে সে মহাকাল, জেনো শব্দজাদুকর!