ওসমান সমাচার – পর্ব-১৫। আহমদ মিনহাজ
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ৭:০০ অপরাহ্ণ, | ৩০৮৬ বার পঠিত
ওসমান সমাচার – পর্ব-১৫। আহমদ মিনহাজ
‘রাং রাজওয়া’ ইন্দ্রজাল : পিট সায়েব ও বাইজি–কন্যা সমাচার (৭)
এমন অস্থির দিনে পিটার সায়েবের বিলেতি দোকানে বাইজি-কন্যা দ্বিতীয়বার গিয়ে ঢোকে। শহরে আজ তার শেষ দিন। আগামীকাল কলকাতার উদ্দেশে রওয়ানা দেবে। সেখান থেকে আগ্রা। তারপর কোথায়, কন্যা সেটা নিজেও জানে না। বাপকে ছেড়ে যেতে তার খুব কষ্ট হচ্ছে। প্রচণ্ড ক্ষোভ নিয়ে এখানে পা রেখেছিল। জনকের জন্য তিলমাত্র দয়া বা করুণা ছিল না মনে। প্রতারণার বিষে হৃদয় তিক্ত ছিল। প্রশ্ন ও বিদ্বেষের ঝড় নিয়ে প্রতারক পুরুষটির মুখোমুখি হয়েছিল। কিন্তু তাকে দেখার পর সব এলোমেলো হয়ে গেলো! জনকের বিষাদঘন আলিঙ্গন ও ক্রন্দন কন্যাকে বিকল করে দিয়েছে। মানুষটি নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতাপ করছে। জোরে চাপ দিলে ভেঙে পড়বে। আত্মজার কাছে জানু গেড়ে ক্ষমা চাইতে দ্বিধা করবে না। তার মধ্যে বিপন্ন ও অসহায় এক মানুষ উঁকি দিচ্ছে। কন্যার তখন মাকে মনে পড়েছে। মা একদিন বলেছিল বটে:-
“তেরি ধোঁকেবাজ পিতাকো মে পিয়ার নেহি কিয়া। মেরা পিয়ার ধোঁকেবাজিকা পর্দা হটা কর এক ইনসানকো নিকলা দিয়া। মে উস্ আদমিসে পিয়ার কিয়া থা।”
কন্যা ভেবেছিল তার জনক এক নিষ্ঠুর ধোঁকেবাজ। আগ্রার রইসদের মতো চতুর ও মাংসলোভী। এখন দেখছে লোকটি মাংসলোভী হলেও চতুর নয়। অতোটা পুরুষত্ব রাখে না। মোহ ও দোটানায় নিজেকে বারবার জখম করেছে। সে আসলে সাহসী নয়। ধূর্ত বা সেয়ানা নয়। লোকটি আসলে কাপুরুষ। প্রেমিকাকে প্রতারণা করতে গিয়ে নিজে প্রতারিত হয়েছে। তার বিত্ত ও পরিবার তাকে সংসারী করলেও প্রেমিক হওয়ার যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি মেলেনি। ওটা মুছে ফেলে নিজেকে সে গৃহী করে তুলতে পারেনি। যে-কারণে আত্মজাকে বুকে চেপে কাপুরুষের মতো কান্না করছে। লোকটি আগ্রার সাহেবজাদা নয়। হোলি শেষে মুখ থেকে রঙ উঠিয়ে ফেলার কায়দা শিখেনি। কবেকার প্রেমের রঙ তার বয়স্ক মুখের রেখায় লেপ্টে রয়েছে। এতোদিন পরেও কাপুরুষটি সেই দাগ মুছে ফেলতে পারেনি!
লোকে বলে বাইজিরা প্রেমে পড়ে বোকা হয়। বোকা হয়ে ধোঁকা খায়। সে পাঠ চুকে গেলে তাদের জ্ঞানচক্ষু খোলে। তারা তখন চালাক হয়ে পড়ে। রইসজাদার চোখ দেখে মনের বাসনা বুঝে ফেলে। প্রেম ও ধোঁকার তফাত ধরতে ভুল করে না। বাইজি-কন্যার ধোঁকাপর্ব সমাপ্ত হয়েছে। সাহেবজাদা তাকে আচ্ছা করে ধোঁকার ঘাটে কেঁচেছে। রস নিংড়ে ছিবড়ে করেছে। তার জ্ঞানচক্ষু খুলে দিয়ে গেছে। কন্যা এখন প্রেম ও ধোঁকাকে আলাদা করতে পারে। কোনো পুরুষের পক্ষে তাকে আর প্রেমের ধোঁকায় কাবু করা সহজ নয়।
লোকের চোখ দেখে তার মন পড়ার কায়দাটি কন্যা এখন রপ্ত করে ফেলেছে। জনকের বাষ্পাতুর চোখের মাঝে প্রেম দেখতে পেয়েছে। অকালমৃত স্ত্রীর প্রতি নিখাদ অনুরাগ অনুভব করে অবাক হচ্ছে। তার মনে হচ্ছে লোকটি আসলে কিছু জেতেনি। জীবনে সে একবার ভালোবেসে ছিল, তবে সেটা ধরে রাখতে পারেনি। ভালোবাসাকে ধরে রাখার পৌরুষ তার নেই। আবার ওটাকে ভোলার মতো পাষাণ-দিল নয়। আপন আত্মজার সমুখে দাঁড়িয়ে বোকা লোকটি তাই চোখের জল ফেলছে। কন্যার মনে হলো এই অশ্রু দরকারি। এটা তার প্রতারণার পুরষ্কার! সব ভেবে বাইজি-কন্যা নিজেকে শান্ত করেছে। প্রেমের রঙ মুছে ফেলতে অক্ষম এক বাঙালির জননী হয়েছে। একথা বিদিত সংসারে, রমণীরা জননী হলে পুরুষের প্রতারণা লঘু হয়ে পড়ে। সৃষ্টির খেলা জারি থাকে ভুবনে।
শহরে পা রাখার পর বাইজি-কন্যার দেহে শেখ ফরিদ ভর করে। বুড্ডা ফরিদ কন্যার কানে গুনগুন করে,- ‘উঠ্ ফরিদা শুত্থিয়া দুনিয়া ভিখার যা/ শায়েদ কোই মিল যায়ে বখশিয়া তু ভি বখশিয়া যা।’ ফরিদ বড়ো সর্বনাশা। তার আহবান মানুষকে দুর্বল করে ফেলে। প্রতিহিংসার বাসনা বজায় থাকে না। অন্যায়কে পালটা অন্যায় দিয়ে মিটানোর দম হারিয়ে ফেলে মানুষ। বুড্ডা ফরিদ তাকে বিরক্ত করে মারে। সে হয়তো ঘর ঝাঁট দেয়। কলসিতে জল ভরে। চুলায় আগুন ধরায়। মতিচ্ছন্ন মানুষের মতো বাইরে বেরিয়ে পড়ে। শত্রু সামনে পড়ে গেলে তাকে ছোবল দেয়ার পরিবর্তে ক্ষমা করে বসে। ক্ষমা ও করুণা বখশানোর চাপে প্রতিহিংসার আগুন নিভে যায়। কন্যা এখন ফরিদা হয়েছে। বাপের প্রতি সকল ক্ষোভ তাই মিইয়ে গেছে।
এই শহরটি কন্যাকে ফরিদা হতে বাধ্য করেছে। এর জল-মাটি-হাওয়া বড়ো সজল! নাড়া দিলে ঝুরঝুর করে ঝড়ে পড়ে। বাপের দেহে সেই ধস আবিষ্কার করে মেয়ে রাগ ধরে রাখতে পারেনি। বঞ্চনার ক্ষত বৃষ্টিধারায় ধুয়েমুছে গেছে। বাপকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে। তবে কষ্ট হলেও তাকে এই শহর ছাড়তে হবে। কন্যার মনে শঙ্কা ঘনিয়েছে। কানের কাছে কে যেন ফিস ফিস করে মন্ত্র জপছে,- ‘তেরা যানে কা বখত আ গায়া। আব্ মাত্ ঠেরো ইহা পে।’ কন্যার কেন যেন মনে হচ্ছে এখানে বেশি দিন থাকা ঠিক হবে না। শহরটি তাকে প্রীত করেছে। ফরিদা হওয়ার শক্তি যুগিয়েছে। হারানো মনোবল ফিরে পেতে সাহায্য করেছে। এইসব সুখস্মৃতি বুকে নিয়ে তার এখন আগ্রায় ফেরা উচিত। নতুবা ঘোর ভেঙে যেতে পারে। সুখস্মৃতি বিষাদে ম্লান হয়ে উঠতে পারে। কন্যা তো শেখ ফরিদ নয়। রক্ত-মাংসের কাম পুত্তলি। তার পক্ষে বেশি দিন ক্ষমা বখশানো কঠিন। বরং সময় থাকতে প্রস্থান করাই উত্তম। তার বিড়ম্বিত জীবনে সুখস্মৃতির প্রয়োজন রয়েছে। শহরটি না-হয় সেটা হয়ে থাকলো!
কন্যা আর বিলম্ব করে না। ত্বরা করে নিজেকে গোছায়। এখানে আর নয়, সুখস্মৃতি সঙ্গী করে প্রস্থান করা উত্তম। আগ্রায় গিয়ে জীবনকে মোকাবিলা করা দরকার। শহরে আজ তার শেষ দিন। যাবার আগে বিলেতি দোকান তাকে টানছে। আজব সায়েবকে আরেকবার দেখার সাধ জেগেছে। সাধ কেন জাগছে কন্যা সেটা জানে না, তবে ইন্দ্রজাল জানেন। সায়েবকে তিনি তার মনে ভাসিয়ে তুলেছেন। কন্যা ভাবে সায়েবটি অদ্ভুত। অন্য ইংরেজের মতো নয়। বড়ো রূপবান! চোখ দুটি ঘোরগ্রস্ত! বিব্রত এক পিপাসা সেখানে লেগে রয়েছে। সেটা কার জন্য কে জানে!
সায়েবকে নিয়ে কন্যা জল্পনা করে। তার মনে হতে থাকে সায়েবটি হয়তো কাউকে ভালোবেসে মরেছে। হতে পারে কোনো রমণীকে সে প্রতারণা করেছে। এখন অনুতাপের ঘোরে হা-হুতাশ করছে। বেচারা! লোকটির ভিতরে সম্ভোগের ক্ষুধা লুকিয়ে রয়েছে। তার চোখ দেখে কন্যার সে কথাই মনে হচ্ছে। কী লজ্জা! হ্যাংলামুখো এক সায়েবকে নিয়ে সে এতোদূর জল্পনা করে ফেলেছে! এখানে পা রাখার পর সায়েবের অনেক কেচ্ছা-কাহিনী তার কানে এসেছে। সব শুনে লোকটিকে বদমাশ ছাড়া কিছু মনে হয়নি। কিন্তু ওর চোখ সেটা বলছে না। বিষয়টি কন্যাকে সত্যি ভাবিয়ে তুলেছে।
“মানুষের জীবনে প্রেম হচ্ছে প্রচণ্ড সুন্দর। ওটা আকস্মিক। অন্ধ ও বিবেচনাহীন। বিচারবোধের ঊর্ধ্বে। অনুমান ও পরিকল্পনা তাকে নাগালে পায় না। কারণ, পরিকল্পনা করে প্রেম হয় না। মনের মাঝে যুক্তির ছক কষে নিজেকে প্রেমে পড়ানো যায় না।”
কন্যা ভাবে, এদেশের চোখ দিয়ে দেখলে সায়েব হয়তো লম্পট। কিন্তু সে বিলেতি। ওই দেশে প্রেমে পড়ার ধারা ভিন্ন। সম্ভোগের ক্ষুধা অন্যরকম। বিলেতিরা প্রেম ও সম্ভোগকে একত্রে মিশিয়ে পান করে। আবার নেশা কেটে গেলে আলগা হয়ে পড়ে। নতুন করে প্রেম ও সম্ভোগের রসদ খুঁজতে থাকে। সাহেবজাদার কল্যাণে কন্যা বিলেত ঘুরে এসেছে। সায়েবদের রীতি-নীতি খানিক বুঝে। তবে এই সায়েবকে ওসবের সাথে পুরোপুরি মিলানো যাচ্ছে না। লোকটি কেমন যেন! তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিল। বিলেতি সামগ্রী পরখ করার সময় বারবার মনে হয়েছে একজোড়া ক্ষুধার্ত চোখ তাকে অনুসরণ করছে। অপলক চোখে দেহের ছন্দ গিলে খাচ্ছে। পুরুষটিকে প্রেমের আবেগে বশীভূত মনে হয়েছে। তার চোখে সম্ভোগের নেশা প্রকট হয়ে উঠেছিল। একটু আশকারা দিলে ঝাঁপিয়ে পড়তো! বিলেতে এটা কোনো দুর্লভ ঘটনা নয়। সায়েবরা কাম ঘনালে বন্য হয়ে ওঠে। প্রেমের নাম করে লাম্পট্য করে। মেমরা সব টের পেয়েও মানা করে না। নিজেরা উলটো ঝাঁপ দেয়।
বিলেতে প্রেমের গতি বড়ো বিচিত্র। মন সাড়া দিলে দেহ সাড়া দিয়ে ওঠে। দেহে তরঙ্গ উঠলে মনে দোলা লাগে। তারা তাই ঝাঁপ দেয়ার জন্য অধীর থাকে। আবার নিমিষে আলগা হয়ে পড়ে। তার ভাগ্য যে সায়েব সেদিন ঝাঁপিয়ে পড়েনি। দৃশ্যটি ভেবে কন্যা মনে-মনে আরক্ত হয়। নিজেকে শাসায়। দুর! কীসব উলটা-পালটা ভাবছে। ওসব কিছু নয়। সায়েব হয়তো কোনো কারণে উদ্বিগ্ন ছিল। সেটার ছাপ তার চোখে-মুখে পড়েছে। ঘটনা যেমন হোক, প্রেমের লালসায় বন্য সায়েবটিকে আরেকবার দেখতে মন চাইছে। এমন রূপবান পুরুষের দেখা সহজে মেলে না। তার রূপ রমণীতুল্য। রমণীয় এক দ্যুতি তাকে সুপুরুষ করেছে। দ্যুতিটা যদিও মেয়েলি নয়,- রীতিমতো পৌরুষঘন। এমন পুরুষ দেখে মন চঞ্চল হলে নিজেকে দোষ দেয়া যায় না। এই মুহূর্তে কন্যা অন্তত নিজেকে দোষ দিতে পারছে না।
সায়েব সুপুরুষ। তার কণ্ঠ কমনীয় হলেও বলিষ্ট ছিল। সব মিলিয়ে অন্যরকম। যাবার আগে একবার বাজিয়ে দেখলে মন্দ কি! কোনো প্রাপ্তির আশা এখানে নেই। ওটার জন্য দুজনের চিন-পরিচয় নিবিড় হওয়া জরুরি। এক লহমায় সেটা ঘটে না। সুতরাং প্রাপ্তি এখানে অপ্রাসঙ্গিক। তবে কৌতূহল রয়েছে। লোকে বলে রমণীরা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের অধিকারী। পুরুষের চোখের ভাষা দেখে মনের ভাষা আঁচ করতে পারে। বাইজি-কন্যার মধ্যে সেটা জেগে উঠেছে। রমণীর চিরন্তন কৌতূহল তাকে ভিতর থেকে ঠেলছে। কৌতূহলে অভিভূত কন্যা তাই দেরি করে না। বাপকে বলে-কয়ে সায়েবের দোকানে প্রবেশ করে।
কন্যা ফিটন থেকে দ্রুতপদে নামে। দুপুর তখন ঘন হয়েছে নির্জনে। সায়েবের ভাবনায় আবিষ্ট না-হলে কন্যা ফিটন ঘুরিয়ে বাড়ির পথ ধরতো। কারণ আজকের দুপুরটি অন্যরকম। গলির মোড়ে ও রাস্তায় যুবকরা জটলা পাকাচ্ছে। ছোট-ছোট দলে ভাগ হয়ে শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। দেখে মনে হবে ব্যস্ত পথচারী নিজের কাজ সেরে ত্রস্তপদে বাড়ি ফিরছে। ফলে তাদেরকে চোখে পড়েও পড়ছে না। সায়েবদের ছ্যাকরা ও ফিটন যথারীতি চলছে। প্রধান সড়ক ও গলির পাশ দিয়ে পুলিশবাহী শকট হুঁশ করে বেরিয়ে যায়। হঠাৎ দেখলে স্বাভাবিক টহল মনে হবে। কিন্তু ওটা স্বাভাবিক ছিল না। শহরে হাঙ্গামার আশঙ্কায় টহলের মাত্রা বাড়ানো হয়েছে। সন্ধ্যার পরে রাস্তা ও গলির মোড়ে পুলিশী শকট জোরদার হয়ে ওঠে। লোকে সেটা দেখে বিচলিত হয় না। এতে তারা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। টহল তাই গায়ে মাখে না। পুলিশ কোনো কারণে জেরা করলে নিরীহ স্বরে উত্তর করে। যেন কিচ্ছু জানে না। পুলিশ সন্দেহভাজন লোকের তালিকা করেছে। সেটা ধরে প্রায়শ এখানে-সেখানে হানা দেয়। কোনো ফল অবশ্য হয়নি। সন্দেহ করার মতো কিছু পাওয়া যায়নি। নিশ্চিত প্রমাণ পেয়েও পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।
ঘটনা যেমন হোক, আজ দুপুর থেকে টহল জোরদার করা হয়েছে। গোপন সূত্রে খবর রয়েছে নেটিভরা শহরে দাঙ্গা বাঁধাতে চাইছে। এখনো অবশ্য সেরকম কিছু ঘটেনি। তবে ঘটতে কতোক্ষণ! টহল তাই জোরোলো হয়েছে। কন্যা খেয়াল করলে দেখতো গলির মোড় ও প্রধান সড়কে লোকের গমগমে ভাব খানিক স্তিমিত। দুপুরে গলিপথ নির্জন হয়ে পড়ে। ঝিমধরা আবেশে ভদ্রঘরের রমণীরা সুঁই-সুতা নিয়ে বসে। ছেড়া কাপড় রিফু করে। পুরুষরা অনেকে ভাতঘুমের প্রভাবে মৃদু স্বরে নাক ডাকায়। তবে সেটা সবার ক্ষেত্রে নয়। প্রধান সড়ক ও হাট-বাজার লোকের ভিড়ে মোটের উপর গমগম করে। অফিস ও কাছারি ঝিমধরা আবেশে নথিপত্র উলটায়। মৌমাছির মতো গুনগুন শব্দের কারণে দুপুর তাই পুরোপুরি নির্জন থাকে না।
গুনগুনে সেই ভাবটা আজ থমকে গেছে। অজানা আশঙ্কায় অনেকে ঘর থেকে বের হয়নি। কন্যার বাপের সেটা খেয়াল ছিল না। পরিবারের দায়িত্বশীল পুরুষরা এখনো ঘরে ফেরেনি। নইলে বাধা দিতো। আজ রাতে জলসার আয়োজন করা হয়েছে। খানাপিনার প্রস্তুতি চলছে। রমণীরা রসুইঘরে ব্যস্ত। কন্যা এই সুযোগে বেরিয়ে পড়ে। সকলের অগোচরে পিটার সায়েবের দোকানে গিয়ে ঢোকে।
দুপুরটি সত্যি নির্জন। চৌরাস্তার মোড়ে বিলেতি দোকানগুলোয় ক্রেতার ভিড় নেই। দৃশ্যটি অবশ্য নতুন নয়। গত কিছুদিন ধরে এটা চলছে। শহরে সায়েব খেদানোর চাপা অস্থিরতা বিরাজ করছে। সেই চাপে বিলেতি দোকানগুলো দুপুরের আগে জনশূন্য হয়ে পড়ে। ফ্লেচার টি শপে ভিড়বাট্টা আগের মতো নেই। আশপাশের বিলেতি দোকানে বেচাকেনা ব্যাপক কমে গেছে। পিটারের দোকান আজকাল নেটিভশূন্য থাকে। বনেদি নেটিভরা যাওয়া-আসা কমিয়ে দিয়েছে। কালেভদ্রে দু’এক জন আসে। তার ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। সায়েবরা এই শহরে সংখ্যালঘু। শুধু তাদের উপর ভর করে শৌখিন এই ব্যবসা টিকিয়ে রাখা মুশকিল। চিন্তিত পিটার ক্রেতাশূন্য দোকানে একা বসে রয়েছে। বেচাকেনার মন্দা দেখে কর্মীদের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। বিকেল হলে তারা আবার আসবে। বিলেতি ক্রেতারা বিকালের আগে দোকানে ভিড় করে না। মনের মাঝে মন্দা নিয়ে সায়েব একলা বসে আছে।
ব্যবসায় মন্দা দেখা দিলে মদের প্রতি টান বাড়ে। মদ্যপান ছাড়া তখন কিছু করার থাকে না। সায়েবের মধ্যে সেই টান বেড়েছে। মদিরার প্রভাবে চোখ ঢুলুঢুলু হয়ে উঠেছে। সায়েব বিড়িবিড় করে শেলী ও কিটস আওরায়। মানুষের জীবনে মন্দা ঘনিয়ে এলে অবসর ও নির্বেদ প্রকট হয়। এতে কবি কিটসের কপাল খুলে যায়। কবিটি বড়ো অবসরপ্রিয়। বিষণ্নতায় নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে ভালোবাসে। পিটারের দোকান এখন কিটস-গুঞ্জনে ভরে উঠেছে। তার মন নির্জনতার অঢেল বিষাদে ডুবে আছে। মাথায় চিন্তার ব্যথা প্রবল হতে পারছে না। সায়েব এখন বোধশূন্য। মদের ঘোরে কিটসকে আঁকড়ে ধরেছে।
বিষাদের এই সর্বনাশা গুঞ্জনের মধ্যে ক্রেতার আগমন ঘটলে চমকে উঠা স্বাভাবিক। বিব্রত হয়ে পড়া বেখাপ্পা নয়। ক্রেতা যদি রমণী ও নেটিভ হয় তবে চমক সকল সীমানা ছাড়ায়। আর ক্রেতাটি যদি খৈনিকণ্ঠি রাত্রিসুন্দরী হয়?- সেক্ষেত্রে মন্তব্য না-করলেও চলে। এতোদিন পর তাকে দেখে পিটার তাই পিলে পর্যন্ত চমকে ওঠে। বিস্ময়ে তার মুখে কথা সরে না। ঘোরলাগা চোখে রমণীর ত্রস্ত ছন্দ অনুসরণ করে। সায়েবের মনে হয়, খৈনিকণ্ঠি আড়চোখে তাকে লক্ষ করছে। বিলেতি সামগ্রী দেখার ফাঁকে তাকে চোখ ঠারছে। তার ঠোঁটে মৃদু হাসি। অনতিস্বচ্ছ নেকাব সেই হাসি গোপন করতে পারছে না। নেকাব ভেদ করে কাউন্টারে বসা সায়েবের উপর আছড়ে পড়ছে।
পিটারের নেশা কেটে গেছে। দোকানে নেটিভ রমণীকে ঢুকতে দেখে শেলী ও কিটস আলগোছে সরে পড়েছেন। পাগলা পিটারকে এখন আর বিরক্ত করে লাভ নেই। এতোদিন পর খৈনিকণ্ঠি রমণী তার দোকানে ঢুকেছে। তাকে দেখে সায়েবের চিনতে ভুল হয়নি। কেন হয়নি সেটা শেলী ও কিটস বিলক্ষণ বোঝেন। দুজনে তাই সরে পড়েন। পিটারকে রমণীর হাতে ছেড়ে দিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে যান।
কাব্যের রমণী বাস্তবে দেখা দিলে কবির প্রয়োজন ফুরায়। এখানে সেটা ঘটেছে। বাইজি-কন্যাকে চিনে নিতে পিটারের ভুল হয়নি। মনের মধ্যে রমণী গাঢ় হলে লক্ষবার দেখতে হয় না। প্রথম দর্শনে মনে গেঁথে যায়। নতুবা লক্ষবার দেখার পরেও স্মরণ থাকে না। আড়াল হলে ভুল পড়ে। নেটিভ কন্যাকে দোকানে পেয়ে সায়েবের রক্ত ছলকে ওঠে। কাউন্টারে বসে বিড়বিড় করে,- ‘আঃ! কতোদিন পরে তুমারে হেরিলাম। তুমার লাজুক চাপল্য দেখিলাম! আজ আর বাধা মানিবো না। আজ যদি না হয় তবে কোনোদিন হইবে না। নিঠুরা রমণী, আমি আর নিষেধ মানিবো না। তুমারে চাপিয়া ধরিবো। প্রলয় যদি ঘটে তো ঘটিবে। পিটার আজ তুমারে প্রেমের আলিঙ্গনে শক্ত করিয়া বাঁধিবে। দেখি তুমি কেমন করিয়া মানা করো! কী করিয়া পলায়ন করো!’
সায়েবের চোখ খৈনিকণ্ঠি বাইজিকে অনুসরণ করছে। মদের রসে সিক্ত অধরে রাত্রিসুন্দরী ভর করেছে। কন্যার কেনাকাটা শেষ। সে এখন কাউন্টারে চলে এসেছে। হাতে ব্রেসলেট ও অধর-রঞ্জক। অনতিস্বচ্ছ নেকাব কপালের উপর তুলে দিয়েছে। সম্ভ্রান্ত ঘরের কোনো রমণী এই কাজটি পারতপক্ষে করে না। সংস্কারের বশে করে না। ধর্মের মানা ও নিষেধ ভেবে করে না। সহজাত অভ্যাসের বশে পরপুরুষের সমুখে সহজে নেকাব তোলে না। বাইজি-কন্যা সেই কাজটি করেছে। উপায় নেই দেখে করেছে। বাইজির ঘরে জন্ম নেওয়ার কারণে করেছে। রইস আদমির সমুখে বাইজিরা মুখ গোপন করে না। এতে খেয়াল ও ঠুমরির তালে বিঘ্ন ঘটে। মনের মধ্যে রাগ-রাগিনীর আবেশ ক্ষুণ্ন হয়। শ্রোতারা নেকাবে ঢাকা গায়িকা দেখতে বাইজি-সদনে ভিড় করে না। দর্শনধারী ও গুণবিচারি একসঙ্গে না-থাকলে বাইজি পুষে ফায়দা কি! সুতরাং সংকোচ অনাবশ্যক।
গানের সঙ্গে দেহের তরঙ্গ উপভোগ করতে লোকে বাইজি ভাড়া করে। ধর্মের নিষেধ এখানে খাটে না। সমাজের রক্তচক্ষু গৃহী রমণীর জন্য প্রযোজ্য হতে পারে। বাইজি গৃহী নয়। তাকে ওটা মানলে চলবে কেন! নিজের সৌন্দর্য গোপন রাখার বাতিক তার নেই। সুতরাং কন্যার নেকাব উঠানোর মধ্যে কোনো জড়তা কাজ করে না। সে এতে অভ্যস্ত। সায়েবটি এই জগতে আর নেই। বায়ুমার্গে বিহার করছে। তাকে মাটিতে ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। কন্যা তাই নেকাব তোলে। কণ্ঠ গাঢ় ও তীক্ষ্ণ করে সায়েবকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনে।
কন্যার হাতে ব্রেসলেট ও অধর-রঞ্জক। ওগুলো কাউন্টারে ঠেলে দিয়ে সায়েবকে দাম জিজ্ঞেস করে। অদ্ভুত লোকটি শুনতে পেয়েছে বলে মনে হয় না। আচ্ছা, ও কি কালা? নাকি ইচ্ছে করে কালা সাজার ভান করছে! কন্যা সেটা বুঝতে পারে না। তার হাবভাবে মনে বিরক্তি ধরে। দুচ্ছাই! কেন যে এখানে মরতে এসেছিল! খোদা জানে ব্যবসাটি সে কীভাবে চালায়! কন্যা এবার সায়েবের নজর ফিরানোর চেষ্টা করে:-
‘গোরা সাহাব, ইয়ে কোই তামাশা হ্যায় কিয়া। মে তুমে পুছ্ রাহা হো। মাগার তুম কাহা খো বৈঠে। ইস সামানমে ডিসকাউন্ট হ্যায় কি? বলো কিতনা চাহিয়ে তুমে।’
সায়েবের মদের ঘোর অনেক আগে কেটে গেছে। কিন্তু খৈনির ঘোর কাটেনি। ঠোঁটের ফাঁকে খৈনি গুঁজে আবিষ্ট হয়ে আছে। মুখের ভিতরে খৈনি রসিয়ে উঠছে। মদ্যপ সায়েব পানুক হয়ে পড়েছে। পান ও খৈনির রসে মুখটি ভরা। কথা বলে কী করে! কোনোক্রমে তাই উত্তর করে,- ‘কুছ্ নেহি!’ বাইজি-কন্যা এবার ধন্দে পড়ে যায়। লোকটা কি পাগল! নাকি মদ টেনে ভুলভাল বকছে। যদিও চোখে মদের ঘোর নেই। আঁখিপট তীক্ষ্ণ ও ঝকঝকে। ক্ষুধার্ত নয়ন মেলে প্রলাপ বকছে। কণ্ঠে বিরক্তি ঘনিয়ে কন্যা আবার শুধায়,- ‘কিয়া! কিয়া কাহা তুমে? মে সমঝা নেহি। আজিব আদমি হো তুম। আব্ বলো কিতনা চাহিয়ে। মুঝে জানা হোগা।’
সায়েব তখন আত্মহারা। শেলী ও কিটস্ বিদায় নিয়েছে ভালো কথা, কিন্তু বায়রন যে ঘাড়ে চেপে বসেছে! ডন জোয়ানের শিষ্য লাই পেয়ে ঘাড়ে চড়ে নাচছে। মাথায় ভোগী এক লম্পট বাঁদর-নৃত্যে মেতে উঠেছে। বাঁদরকে আশকারা দিয়ে সায়েব নিজেকে ভুলেছে। চোখের সামনে রাত্রিসুন্দরী না খৈনিকণ্ঠি দেখছে সেটা বুঝতে পারছে না। তার দাঁতের ফাঁকে খৈনির রস তুরতুর করে। হৃদয় প্রেমের জোয়ারে কলকল করতে থাকে।
মেঘের গায়ে হেলান দিয়ে ইন্দ্রজাল সায়েবকে লক্ষ করেন। বোকা পাঁঠাটার উপর তিনি এখন প্রচণ্ড বিরক্ত। ওর কাজকারবার বুঝতে পারছেন না। এদিকে সময় দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে। নির্জন দুপুরটি আর নির্জন নেই। কিছুক্ষণ আগে কালেকটর সাহেবের অফিসে একদল যুবক বোমা ফাটিয়েছে। তারা অতর্কিতে কালেকটর ভবনে ঢুকে পড়ে। বাধা দেয়ার আগে দুমদাম গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। পালিয়ে যাবার সময় বোমা ফাটায়। বেচারা কালেকটর অল্পের জন্য বেঁচে গেছে। তার পায়ে গুলি লেগেছে। শহরের সার্জন গুলি বের করতে ব্যস্ত। প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। কালেকটরের রূপবতী স্ত্রী ও সুশ্রী কন্যার মুখ আতংকে মলিন হয়েছে। সুন্দরী মেমদের এখন আর বিলাসী লাগছে না।
কালেকটর গুলি খাওয়ার পর ভবনটি পুলিশ ঘিরে রেখেছে। বোমাবাজ যুবকদের তাড়া করেছিল। তবে ধরতে বা জখম করতে পারেনি। শহরের প্রধান সড়কটি আর থমকে নেই। জটলা ক্রমে বড়ো হচ্ছে। পুলিশের শকট দেখলে বিচ্ছু যুবকরা ঢিল ছুঁড়ে মারছে। তাদের মনে ডর-ভয় নেই। গলা ফাটিয়ে মুকুন্দ গাইছে। এইমাত্র পুলিশ সুপারের বাড়ি ও কার্যালয় আক্রান্ত হলো। যুবকরা সেখানে বোমা ফাটিয়ে সরে পড়েছে। প্রধান সড়ক ও চৌরাস্তায় মানুষের ভিড় ক্রমে বাড়ছে। খণ্ড-খণ্ড জটলা একত্রে মিশে বড়ো জনস্রোতে পরিণত হয়। চৌরাস্তা থেকে বিলেতি মার্কেটের দূরত্ব বেশি হলে দেড় কিলোমিটার। জনস্রোত বুনো গতিতে সেদিকপানে অগ্রসর হতে থাকে। সুড়কিফেলা রাস্তায় গুলির খোসা এবং ছত্রভঙ্গ জনতার গড়াগড়ি ও দৌড়ঝাঁপ চলে। পুলিশের শকট বিলেতি দোকানগুলোর অভিমুখে ছুটছে। তবে এখনো পৌঁছাতে পারেনি। শকটের চেয়ে বুনো স্রোতের গতি অনেক বেশি। জনস্রোত প্রায় নিকটে চলে এসেছে। শহরে আজ সত্যি অশান্তি ঘনিয়েছে!
ইন্দ্রজাল অস্থির হয়ে পড়েন। হাতে সময় নেই। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। সায়েব এখনো উলটো-পালটা বকছে। মরণ তার দুয়ারে কড়া নাড়ছে সেই হুঁশ নেই। দেবদূতকে তিনি ইশারা করেন। বাইরে হল্লা প্রবল হয়। দুম করে গুলি ফোটে। গুলির শব্দে বাইজি-কন্যা চমকায়। চঞ্চল চোখে দরোজা দিয়ে বাইরে তাকায়। দোকানের চারপাশ এখনো নির্জন। পিটার ও ফ্লেচারের মধ্যস্থলে একটি গোল চত্বর রয়েছে। বিলেতি দোকানগুলো চত্বরের ডানে-বায়ে নিজেকে বিস্তৃত করেছে। প্রকাণ্ড এক বট গাছ চত্বরে ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে আছে। তার বয়সের ঠিকুজি নেই। চত্বর ও আশপাশকে ছায়া দিয়ে ঢেকে রাখে। বটের ডালে অজস্র কাক বসে আছে। বটবির ছায়ায় ঠোঁট ডুবিয়ে তারা ঘুমাচ্ছে। এবার কা কা রবে ডানা ঝাপটে আকাশে উড়াল দেয়।
কন্যার মনে হলো সে ভুল শুনছে। ওটা হয়তো গুলির শব্দ নয়,- কাকের ত্রস্ত কলরব হবে। তাকে অন্যমনষ্ক করে ইন্দ্রজাল নিজের জাল ছড়িয়ে দিলেন। পিটারের জন্য এটা ছিল সুযোগ। বেকুব সায়েব এবার আর দ্বিধা করে না। খৈনিকণ্ঠি কন্যার হাত চেপে ধরে। সুদৃশ্য ব্র্রেসলেট সেই হাতে পরিয়ে দেয়। সায়েবের মুখে বোল ফোটে:
“তুমি অপরূপা। ব্রেসলেট তুমারে সুন্দরী করিবে। ঈশ্বর জানেন, আমি তুমারে কতোখানি ভালোবাসি। তুমি রাত্রিসুন্দরী। দোহাই লাগে, অন্ধকারের মইদ্যে অন্ধকার হইয়া থাকিও না। দ্যুতির মইদ্যে দ্যুতি নিয়া প্রকাশিত হও। তুমারে না পাইলে পিটার মরিবে। তুমি…।”
সায়েব তার কথা শেষ করতে পারে না। গলা আটকে যায়। হতবিহ্বল কন্যার হাতের নিকটে নিজের অধর নামিয়ে আনে। সায়েবের ঠোঁট এখন কন্যার কব্জি স্পর্শ করেছে। তার মুখ আবেগে থরথর করে কাঁপছে। এক ফালি রৌদ্র সেই মুখে এসে পড়েছে। দূর থেকে প্রচণ্ড সুন্দর লাগছে দেখে।
মানুষের জীবনে প্রেম হচ্ছে প্রচণ্ড সুন্দর। ওটা আকস্মিক। অন্ধ ও বিবেচনাহীন। বিচারবোধের ঊর্ধ্বে। অনুমান ও পরিকল্পনা তাকে নাগালে পায় না। কারণ, পরিকল্পনা করে প্রেম হয় না। মনের মাঝে যুক্তির ছক কষে নিজেকে প্রেমে পড়ানো যায় না। মায়ের প্রতি শিশুর দরদ দিয়ে সেটাকে বুঝতে হয়। মা তার শিশুকে বিচার-বিবেচনা করে ভালোবাসে না। স্নেহের দুর্মর টানে শিশুকে বক্ষে লুকায়। নিষ্পাপ দেবদূতের কচি অধরে নিজের অধর সিক্ত করে। মায়ের আদর পেয়ে শিশু তখন খিল খিল করে হাসে। মা হাসে তার অবোধ রঙ্গ দেখে। সায়েব এখন অবোধ হয়ে গেছে। তার ভিতরে বিরাট এক শিশু জন্ম নিয়েছে। নিজের পিপাসাকে সে প্রাণভরে পান করছে। শিশু যেমন মায়ের স্তন পান করে! জগৎকে দুই হাতে সরিয়ে আঁকড়ে ধরে মায়ের ওই দুধের বাটি। সায়েব এখন শিশু। জগৎকে দুই হাতে সরিয়ে বাইজি-কন্যার হাত ধরে আছে। অধর নামিয়ে এনেছে সেই হাতে। দূর থেকে প্রচণ্ড সুন্দর লাগছে তাকে দেখে!
সায়েবের বল্গাহারা আবেগে কন্যা বিমূঢ় হয়ে পড়ে। সে এখন বোধশূন্য। তার মাথা ঘুরছে। এটা সত্যি না দুর্ঘটনা বুঝতে পারছে না। মনের মধ্যে দুর্বার এক বিস্ময় ও ক্ষোভ জমা হয়েছে। চোখের তারায় ক্রোধের ফুলকি ছুটছে। রূপমুগ্ধ পুরুষের আকস্মিক প্রেম-নিবেদন তার কাছে নতুন নয়। সাহেবজাদা আকস্মিক ছিল। আমির খসরু শুনে স্থান-কাল-পাত্র ভুলে প্রেমের বাসনা প্রকাশ করেছিল। এতে সম্মতি দিতে তাকে বাধ্য করেছিল। ওখানে শেষ নয়। বহু রইসজাদা কন্যাকে আকস্মিকের অভিজ্ঞতায় ধনী করেছে। আচমকা হাত টেনে ধরে বাসনা জানাতে দ্বিধা করেনি। বাইজি-ঘরে যার জন্ম তাকে এটা বিচলিত করে না। ‘আকস্মিক’ ক্রমে গা-সওয়া হয়ে পড়ে। ধোবিনী-রঙ্গে রইসজাদাকে প্রেমের ঘাটে কাঁচতে বাইজিরা বিলম্ব করে না। চতুরা ও মুখরা হলে এর থেকে ফায়দা উঠায়। সময় বুঝে রইসকে ঘাটে রেখে পালায়। এক রইস ছেড়ে অন্য রইসকে ইশারা করে। প্রেমের ঘাটে কাঁচার নামে ছলনা করে। মনের বদলে দেহে তরঙ্গ তুলে রইস ভোলায়।
রইস ভোলানোয় বাইজির দক্ষতা সহজাত। তবে এইমাত্র যেটা ঘটে গেলো সেটা তার ধারণার বাইরে। আকস্মিক বললে কম বলা হয়। ওটা আকস্মিকের চেয়ে অধিক আকস্মিক! কন্যা বুঝতে পারে না কী করবে। তার চোখে কয়েক ফোঁটা অশ্রু এসে জমে। সায়েবকে সে পাগলাটে ভেবেছে। এখন লম্পট বলে টের পাচ্ছে। যদিও সায়েবের চোখ সেটা বলছে না! নীল চোখের গভীর থেকে আশ্চর্য এক দ্যুতি ঝিলিক দিচ্ছে। কন্যা এই দ্যুতির রহস্যটি ধরতে পারছে না। ওটা কি তবে ভালোবাসা? নাকি লালসা? সায়েব-কাণ্ডে কন্যা এখন খানিক বেদিশা।
কন্যা ফাঁপরে পড়ে গেছে। বুঝতে পারছে না কী করবে। সায়েবকে দেখে বোকা ও ভোগী বলে মনে হচ্ছে। সে ফাঁপরে পড়লো দেখে ইন্দ্রজাল মুচকি হাসেন। তার পরিকল্পনা ও সংকল্প সফল হয়েছে। বাইজি-কন্যাকে তিনি বিহ্বলা করতে পেরেছেন। প্রেমের ঘাটে অভিজ্ঞ রমণী আকস্মিক এই লালসার সম্মুখে পড়ে বোকা বনে গেছে। ওটা ধর্ষণ হলে বরং ভালো ছিল। সুন্দরী রমণীকে বাগে পেয়ে পুরুষরা ধর্ষক হয়। নিজের লালসা মেটায়। সায়েব তাকে ধর্ষণ করলে ল্যাঠা সেখানেই চুকে যেতো। ইন্দ্রজাল মুখ ঘুরিয়ে অনন্তের উদ্যানে ঢুকতেন। কারণ, ধর্ষণ তার পরিকল্পনা ও সংকল্পের অধীন নয়। মানুষকে তিনি বিবেচনা ও বিচারবোধের স্বাধীনতা দিয়ে মর্ত্যে পাঠিয়েছেন। বিবেচনার দোষে সে যদি ধর্ষক হয়ে পড়ে, ইন্দ্রজালের সেখানে কিছু করার নেই। এটা কর্মফলের অধীন। ধর্ষকের ভাগ্য তার কৃতকর্মের উপর নির্ভর করবে। সে হয়তো ভুগবে। অথবা বেঁচে যাবে। পুরো বিষয়টি পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল। মানুষের তৈরি নিয়ম ও নৈতিকতার অধীন। ধর্ষকের কী হবে সেটা মানুষ ঠিক করবে। এখানে তিনি নিষ্প্রয়োজন। তার কিছু করার নেই।
সায়েবের কাণ্ডটি সেদিক থেকে ভিন্ন। বাইজি-কন্যাকে ধর্ষণ করার সুযোগ তার সামনে খোলা ছিল। কিন্তু সায়েব সেটা করেনি। করার ছিটেফোঁটা ইচ্ছে তার আছে বলে মনে হয়নি। যদি থাকতো, ইন্দ্রজাল মুখ ঘুরিয়ে নিতেন। মানুষের হাতে সায়েবকে ছেড়ে উদ্যানে ঢুকতেন। সায়েব ও বাইজি-কন্যাকে নিয়ে তার সকল আগ্রহে ইতি ঘটতো। কিন্তু সায়েবের মধ্যে এখন পর্যন্ত সেই লক্ষণ দেখতে পাচ্ছেন না। বাইজি-কন্যাকে সে প্রেমের আবেগ মিশিয়ে চুম্বন করছে। ধর্ষণের খিদে প্রকাশ করেনি। লালসার সঙ্গে প্রেমের বিকার মিশিয়ে কন্যার হাতে নিজের অধর চেপে ধরেছে। বোকা মুখ-করে তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কন্যার সম্মতির অপেক্ষায় আছে।
ইন্দ্রজাল কন্যাকে নিয়ে ভাবেন। যুবতী হতবিহ্বল হয়ে গেছে। নিজের করণীয় ঠিক করতে পারছে না। তাকে খানিক দয়া করা প্রয়োজন। এসব ক্ষেত্রে রমণীরা চিরকাল যে-কাজটি করে অভ্যস্ত কন্যাকে দিয়ে সেটা করানো প্রয়োজন। ইন্দ্রজাল তার জাল বিস্তার করেন। বাইজি-কন্যা মুখ গম্ভীর করে সায়েবের অধর থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। তার মুখের দিকে চেয়ে সায়েব হাতটি ছেড়ে দেয়। কন্যার মুখ থমথমে। অশনির আভাস লেগেছে চোখে। সায়েব দেখে রাত্রিসুন্দরীর নাজুক হাত কঠিন থাপ্পড় হয়ে তার গালের পানে ধাইছে।
সায়েবের এখন আত্মরক্ষা করা উচিত। মাথা ঝুঁকিয়ে নিজেকে সরানো উচিত। বোকা সায়েব নিজের মুখটি সরাতে পারছে না। আজব এক ভাবনা তাকে দখল করেছে। গালের পানে ধাবমান হাতটি সে দেখতে পাচ্ছে কিন্তু নড়ছে না! ওটাকে থাপ্পড় ভাবার সহজাত ক্ষমতা সে হারিয়ে ফেলেছে। তার মনে আশা জাগ্রত হয়েছে। বেচারা ভাবছে কোমল হাতের মৃদু চাপড়ে কন্যা তাকে প্রেমের প্রতিদান দেবে। থাপ্পড় ও চাপড় সমার্থক হলেও সমার্থক নয়। দুটিতে ব্যাপক তফাত রয়েছে। সায়েব সেটা বুঝতে পারছে না।
মানুষ রেগে গেলে থাপ্পড় কষায়। রাগ লঘু করে গালে মৃদু চাপড় দিয়ে। প্রথমটি হলো বন্য। দ্বিতীয়টি দুষ্টু। থাপ্পড়ের মাঝে প্রচণ্ড ক্রোধ জেগে থাকে। ওটা খেলে মুখে অন্ধকার ঘনায়। চাপড়ের মধ্যে প্রেম ও প্রশ্রয়ের আশকারা থাকে। দিলে খুশির তুফান ছুটে। চাপড় বড়ো চপলা! থাপ্পড়কে চাপড় ভেবে সায়েব বোকামি করছে। ওর এই ভাবাভাবির মধ্যে বাইজি-কন্যার হাত তার গালে এসে পড়ে। ‘ঠাস্’ শব্দটি থাপ্পড়কে জগৎ-বিখ্যাত করেছে। ওটা অপমানজনক। মানুষকে ছোট করে ফেলে। সায়েবের গালে অপমানটি এবার বোমার মতো ফাটে। তার এই অপমানে গাছের ডালে বসা কাকেরা চমকে ওঠে। তারা আবার ডালে ফিরে এসেছে। লম্বা ঠোঁট নামিয়ে ঝিমাচ্ছে। এখন কা কা কুজনে ডাল ছেড়ে শূন্যে পাক খায়।
সায়েবের গালে বাইজি-কন্যার থাপ্পড় কষানোর মুহূর্তটি এই গল্পের ক্লাইমেক্স। শহরের প্রবীণকুল সে গল্পের কথাকার। রাক্ষস ওসমানকে পাকড়াও করতে ইচ্ছুক একদল যুবকরা এর শ্রোতা। কাইমেক্সে পৌঁছে প্রবীণরা প্রতিবার চুপচাপ হয়ে পড়েন। চোখ বুজে কী যেন ভাবতে থাকেন। দূরাগত স্বরে যুবকদের শুনিয়ে বিড়বিড় করেন:-
‘বুঝলে খোকারা, ঈশ্বর মানুষকে দেখার চোখ দিয়েছেন। অনুভব ও যুক্তির সাহায্যে বিবেচনা করার শক্তি যুগিয়েছেন। বিচারবোধ প্রয়োগের ক্ষমতা দিয়েছেন। এরা হলো মারণাস্ত্র। সঠিকভাবে ব্যবহার করলে শত্রু মারা পড়ে। ভুল ব্যবহারে শত্রু ও মিত্র দুজনে মরে। খেয়াল করলে দেখবে মানুষ এইসব মারণাস্ত্র সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে না। সে বুঝে না তার দেখার শক্তি সীমিত। অনুভবশক্তি তীক্ষ্ণ নয়। বিবেচনার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। মানুষ প্যাঁচার চেয়ে বিজ্ঞ নয়। তার চোখ নিশাচর প্রাণীদের চেয়ে তীক্ষ্ণ নয়। রাক্ষসের প্রখর শ্রবণ ও ঘ্রাণশক্তি মানুষের নেই। তার ইন্দ্রিয়রা সবল নয়। মানুষের চোখ সবকিছু সঠিকভাবে দেখে না। একটা দেখতে গিয়ে আরেকটা দেখে। অনুভব ও বিবেচনা তাকে বারবার ভুলপথে চালিত করে। মানুষের এইসব ভুলের কারণে জগতে ‘মায়া’র খেলাটি শেষ হয় না। ঈশ্বর এটা বজায় রাখেন।
ঈশ্বর মহান। মানুষকে তিনি আলোর সাহায্যে জগৎ দেখতে শিখিয়েছেন। আলো ছাড়া সে অন্ধ। অথচ আলোয় বিচরণ করার সময় অনেক সূক্ষ্ম বস্তু তার চোখে ধরা পড়ে না। অন্ধকারে সে ভালো দেখতে পায় না। ফলে অন্ধকারে বিদ্যমান অজস্র খুঁটিনাটি তার চোখ ফাঁকি দিয়ে যায়। সেখানে আলো ফেলার পরেও বেশি কিছু দেখতে পায় না। মানুষের চোখ আলো-অন্ধকারে বিরাজিত সূক্ষ্ম বা খুঁটিনাটি দেখার উপযুক্ত নয়। অতিরিক্ত বৃহৎ ও অতিরিক্ত ক্ষুদ্রকে সে খালি চোখে দেখতে পায় না। কারণ তার চোখ আণুবীক্ষণিক নয়। স্থূল এক জগতে সে বিচরণ করে। সেখানে বিকশিত হয়। সেটার সাপেক্ষে নিজের বুদ্ধি ও শক্তিমত্তা যাচাই করে। অতিরিক্ত সূক্ষ্ম ও বৃহৎকে দেখার জন্য মানুষ তাই যন্ত্র তৈয়ার করেছে। যন্ত্র দিয়ে সূক্ষ্ম ও বৃহৎকে দেখার চেষ্টার করে। সেগুলো সম্পর্কে ধারণা পেতে চায়। তবে যন্ত্রের সাহায্যে মানুষ যা দেখে সেটা আসলে যথেষ্ট নয়। তার এই দেখাটা নির্ভুল নাও হতে পারে। সঠিক ও বেঠিক দুটোই হতে পারে। আরো তীক্ষ্ণ যন্ত্র তৈরি করলেও মানুষ সবকিছু ঠিকঠাক দেখতে পারবে বলে বিশ্বাস হয় না।
শোন খোকারা, মানবদেহের ইন্দ্রিয় মোটেও সবল নয়। কুকুরের প্রখর ঘ্রাণশক্তি মানুষের নেই। তার চোখ হায়েনার চেয়ে তীক্ষ্ণ নয়। ঈগল ও বাজের মতো প্রখর নয়। সুউচ্চ পাহাড়-চূড়ায় বসে ঈগল পাখি শিকারকে দেখতে পায়। নির্ভুলভাবে নিচে নেমে আসে। শিকারকে নখরে বেঁধে পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে বসে। তার চোখ, ঠোঁট ও নখর তাকে মহান করেছে। প্রকৃতি ঈগল পাখিকে সীমিত ক্ষমতা উপহার দিলেও তার এই ক্ষমতাটি নির্ভুল। ঈগলের শক্তিমান অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ শিকার চিনতে ভুল করে না। যদি ভুল করে, নিজেকে সে চট করে শুধরে নেয়। তার মধ্যে শত্রু-মিত্র চেনার সহজাত ক্ষমতা রয়েছে। মানুষ এক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ।
মানুষ ছাড়া জগতের সকল প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য এটা প্রযোজ্য। মানুষের বেলায় ঈশ্বর বড়ো অবিচার করেছেন। তাকে অসীম শক্তি প্রদান করতে গিয়ে সীমাবদ্ধ করেছেন। স্বাধীনতা দেয়ার নাম করে বন্দি ও পরাধীন করে তুলেছেন। তিনি তাকে পর-নির্ভর ও অসহায় করে মর্ত্যে নামিয়ে দিয়েছেন। অসহায় মানুষ তাই অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে জগৎকে দেখে। অন্যদের উপর ভর করে নিজের শক্তিমত্তা বিচার করে। ফলে সহজে বিভ্রান্ত হয়। নির্ভরতা কাটানোর জন্য সে কতো কিছু আবিষ্কার করেছে! নিজেকে বিজ্ঞ ও জ্ঞানী করে তুলছে! এতে কোনো লাভ হয়নি। ভুল দেখা ও ভুল বোঝার হেঁয়ালি থেকে মানুষ নিজেকে মুক্ত করতে পারেনি। তার অসীম ক্ষমতা এভাবে সংকীর্ণ হয়ে গেছে।
একটা কথা মনে রেখো, মানুষ অবিরত ভুল দেখে। অবিরাম ভুল শোনে। অবিশ্রান্তভাবে নিজেকে ভুল বুঝে। এই কারণে সে ভয়ংকর হয়ে পড়ে। অন্যকে অযথা জখম করে। নিজে জখম হয়। লক্ষ করলে দেখবে, মানুষ একে অন্যকে রাক্ষস বলে গালি দিচ্ছে। সে ভুলে যায়, রাক্ষস তার আদি বংশধর হয়। মানুষ এই দানবের অংশীদার। কিন্তু ওর মতো নির্ভুল থাকার ক্ষমতা রাখে না। মানুষ তার রক্তে রাক্ষসের স্বভাব বহন করলেও ঘ্রাণশক্তি ধরে রাখতে পারেনি। নিজের মধ্যে রাক্ষসের শ্রবণ ও অনুমানশক্তিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি।
রাক্ষসের সঙ্গে দিন কাটানোর সময় মানুষ এতোকিছু জানতো না। এতোকিছু তখনো আবিষ্কার করেনি। শিখতে বা ভাবতে পারেনি। অঢেল চাহিদা দিয়ে নিজেকে অস্থির করেনি। জীবন ধারণের জন্য এতোকিছুর দরকার হয় না। অল্পতে কাজ চলে। রাক্ষস থাকার দিনে মানুষ অল্পে সন্তুষ্ট ছিল। এতে কোনো অসুবিধা হয়নি। অন্যদের মতো জগতে চরে খেয়েছে। কারণ, তার আত্মরক্ষার জ্ঞানটি তখন নির্ভুল ছিল। সেটা ব্যবহার করে দিব্যি করে খেয়েছে। নিজের শক্তি সম্পর্কে সজাগ থাকতে পেরেছে। আবার দুর্বলতা বুঝতে ভুল করেনি।
রাক্ষস থেকে মানুষে ওঠার রাস্তায় নিজের এই বিবেচনাশক্তি মানুষ হারিয়ে ফেলেছে। জগতে রাক্ষস প্রজাতি এখন সংখ্যালঘুদের সংখ্যালঘু। তবে এখনো যারা টিকে আছে তারা সেই শক্তি ধরে রেখেছে। ওসমান এখানেই এগিয়ে। সে মানুষের পিছে লাগে। মানুষকে জ্বালিয়ে মারে। তোমরা তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছো। তাকে পাকড়াও করতে চাইছো। একবার ধরতে পারলে হয়তো মেরে ফেলবে। এতে কোনো লাভ হবে না। বরং তার আত্মরক্ষার কৌশলটি যদি শিখতে পারো, আখেরে কাজে লাগবে। আবারো বলছি, ওসমানকে ধরা সহজ হবে না। রাক্ষসটির ক্ষমতা সীমিত হলেও ভয়ংকর। নিজের শক্তি সম্পর্কে সে সজাগ। দুর্বলতা নিয়ে সতর্ক। ফলে তাকে পাকড়াও করা সহজ হবে না। কথাটি তোমরা মনে রাখলে ভালো করবে।
খোকারা, মানুষ ইশ্বরের ছকের বাইরে চলে গেছে। সে এখন প্রকৃতির নিয়মকে শাসন করতে চায়। এটা ভালো নয়। স্বর্ণলতা হয়ে বট গাছকে শাসন করা যায় না। নিজে পর-নির্ভর হয়ে অন্যকে তোমার উপর নির্ভর করানো যায় না। মানুষের ইন্দ্রিয় দুর্বল। তার চোখের ক্ষমতা অতি নগণ্য। শ্রবণ ও ঘ্রাণশক্তি প্রখর নয়। অনুমানশক্তি হাস্যকর। ফলে অনেক কিছুর উপর তাকে নির্ভর করতে হচ্ছে। যন্ত্রের পর যন্ত্র বানিয়ে এই নির্ভরতা সে কাটিয়ে উঠতে চাইছে। নিজেকে শক্তিশালী করতে গিয়ে যন্ত্রের অধীন করেছে। যন্ত্র তৈরি ও ব্যবহারের জন্য মানুষ তার মস্তিষ্কের শক্তিকে ব্যবহার করে। নিজের মস্তিষ্ককে সে প্রবল করে তুলেছে। লাভের লাভ কিচ্ছু হয়নি। এর ফলে অন্য ইন্দ্রিয়রা দুর্বল হয়ে গেছে। তার দেহের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। বিষয়টি পীড়াদায়ক।
বুঝলে খোকারা, এমন দিন দূরে নেই, মানুষকে একটা চলমান মস্তিষ্ক ছাড়া কিছু ভাবা যাবে না। মস্তিষ্কের প্রচণ্ড চাপ সইতে না পেরে সে ধসে যাবে। কারণ, দেহের প্রতিটি অঙ্গ একে অন্যের উপর নির্ভর করে বাঁচে। পরস্পরের হাত ধরে দেহকে সবল রাখে। ভারসাম্য ভেঙে গেলে দেহ মাটি হয়। মানুষের মস্তিষ্কের তুলনায় অন্য অঙ্গ দুর্বল হয়ে পড়েছে। ভারসাম্য বজায় থাকছে না। একদিন এটা মানুষকে পঙ্গু করে দেবে। যে-অঙ্গ নিয়ে তার এতো বড়াই সেই অঙ্গের কারণে মানুষের মরণ ঘনাবে। খেয়াল করলে তোমরা সেটা ধরতে পারবে।
মানুষের মস্তিষ্ক আজকাল তাকে ভুল সংকেত পাঠায়। কারণ অন্য অঙ্গের সঙ্গে মস্তিষ্কের বোঝাপড়া আগের মতো সবল নয়। স্বচ্ছন্দ ও প্রাকৃতিক নয়। যন্ত্র সেখানে ঢুকে পড়েছে। অনেক গোলমেলে বিষয় ঢুকে গেছে। মানুষ একদিন প্রকৃতি নামক যন্ত্রের ছকে বন্দি ছিল। বন্দিত্বের সেই শিকল ছিঁড়তে গিয়ে নিজের হাতে বানানো যন্ত্রের শিকলে বাঁধা পড়েছে। আরো বেশি বন্দি ও অসহায় হয়ে উঠছে। মানুষ আসলে বোকা। সে বুঝে না জগতে কেউ মুক্ত নয়। মানুষ কখনো স্বাধীন ছিল না। ভবিষ্যতেও স্বাধীন হবে না।
একটা কথা মনে রেখো খোকারা, মানুষ খুব অসহায় এক প্রাণী। তার দৃষ্টি ও শ্রবণ গলদে ভরা। ঘ্রাণ ও অনুমান তাকে হরহামেশা বিভ্রান্ত করে। যন্ত্রে করে সে গ্রহ-নক্ষত্র চষে ফেলেছে। অথচ সামান্য চিন্তার ত্রুটি সারিয়ে তুলতে পারে না। মানুষের মতো নিজেকে কেউ এতো ভুল বুঝে না। ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে না। ভুলকে সংশোধন করার নামে আরো বেশি ভুল করে না। নিজেদের মধ্যে ব্যাপক এই ভুল বোঝাবুঝির জন্য সে নিজে দায়ী। এখানে তৃতীয় শক্তির হাত নেই।
ভুলের বহর মানুষকে দুর্বল করে ফেলেছে। এই গ্রহটি একদিন মানুষের ভুল দেখা ও ভুল বিবেচনার দোষে ধ্বংস হবে। এটা হচ্ছে তার কর্মফল। ঈশ্বরের এখানে কিছু করার নেই। ধ্বংস করার জন্য তিনি সৃষ্টিতে ফুঁ দেননি। মানুষ নিজের দোষ তার ঘাড়ে চাপিয়েছে। ঈশ্বর ধ্বংসের পক্ষে ছিলেন না। মানুষ তাকে সেদিকে টানছে। ঈশ্বরের ত্রুটি হলো, মানুষকে তিনি গিনিপিগ করে ধরায় পাঠিয়েছেন। তাকে দিয়ে নিজের ভুল-ত্রুটির অংক কষছেন। তিনি অপরাধী, কারণ, তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। তাকে খাঁচায় পুরে গবেষণায় মেতে উঠেছেন। মানুষকে নিয়ে তার এই বিজ্ঞানী হওয়ার দরকার ছিল না। এতে করে ঈশ্বরের মহিমা এতোটুকু বাড়েনি। তিনি এখন নিজের ভুলে নিজে মরেছেন। এরচেয়ে তাকে রাক্ষস করে রাখাটা তার জন্য ভালো ছিল। স্বাধীনতা যদি তোমাকে স্বাধীন না করে তবে এর জন্য মাথা কুটে লাভ নেই। ঈশ্বর কাজটি মোটেও ভালো করেননি।
খোকারা, আমরা বুড়ো হয়েছি। আজ বাদে কাল কবরে ঢুকবো। মাটির নিয়মে এই দেহ মাটি হয়ে যাবে। তোমরাও একদিন বুড়ো হবে। মাটিতে মিশে গিয়ে সূক্ষ্ম হবে। তবে সূক্ষ্ম হওয়ার আগে তোমাদের ছেলেপিলেকে এই গল্পটি শুনিয়ো। এটা তাদের শোনা প্রয়োজন। মনে রাখা দরকারি। কারণ, এই কাহিনী মানুষের লক্ষ্য ও পরিণামকে প্রকট করছে। তার বিকার ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ভাবার সুযোগ করে দিয়েছে। তোমরা এর শেষ অঙ্কে পৌঁছে গেছো। এখন যা ঘটবে সেটা মানুষের সীমাবদ্ধতাকে নগ্ন করবে। তোমাদের চোখ অশ্রুতে সজল হতে পারে। পরিশেষে পৌঁছে মনে হবে দেখা ও বোঝার ভুলে গল্পটি সুখের না হয়ে বিষাদে পরিণত হয়েছে। এতো লঙ্কাকাণ্ডের পর ‘কী জুটলো’ সে-প্রশ্ন তীব্র হলেও হতে পারে। গল্পের শেষে শহরের লোকজনকে তোমরা দোষ দিও না। তাদের সাধ্য ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে ভাবার চেষ্টা করো। এবং, সম্ভব হলে পিট সায়েব ও বাইজি-কন্যার স্মরণে দু ফোঁটা চোখের জল জমা রেখো। জগতে প্রেম হলো কুহকী। ওরা সেই কুহকী-ফাঁদে বন্দি হয়ে পড়েছে।
(ক্রমশ)