লন্ডন ১৯৭১ : অগ্নিদিনের লগ্ন । উজ্জ্বল দাশ
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১০:২৯ পূর্বাহ্ণ, | ২১১৪ বার পঠিত
সম্প্রতি বাংলাদেশের ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ‘লন্ডন ১৯৭১ : ভিনদেশে বাঙালির আগুনঝরা দিনের গল্প’ শিরোনামে একটি স্থিরচিত্রালেখ্য প্রদর্শনী। তিনদিনব্যাপী প্রদর্শনীটির উদ্বোধন হয় ১৮ অগাস্ট এবং সমাপন হয় ২০ অগাস্ট। মুক্তিযুদ্ধের মোটামুটি অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও গরিমার সেই দিবারাতিগুলোর অদেখা হাজারও অধ্যায় এখনও গোচরে আনয়নের অপেক্ষায়। ঠিক তেমনি বিস্মরণকুঠুরি থেকে উঠিয়ে এনে এই প্রদর্শনীতে দেখানো শ-তিনেক আলোকচিত্রগুচ্ছ দর্শক ও ইতিহাসানুধ্যায়ীদেরে দিয়েছে এক লুকনো স্বর্ণভূখণ্ড সন্দর্শনের বিরল সুযোগ। প্রদর্শনী চলাকালীন দর্শক ও অনুধ্যায়ীদের সমাগম ছিল লক্ষণীয়। জাতীয় গণমাধ্যমে এই প্রদর্শনী নিয়ে একটি ইতিবাচক সাড়া লক্ষ করা গিয়েছে এরই মধ্যে।
‘প্রোজেক্ট লন্ডন ১৯৭১’-এর উদ্যোগে এবং সার্বিক ব্যবস্থাপনায় এই স্থিরচিত্রগুচ্ছ অবলোকনের সুযোগ পেয়ে তারিফি ফিচারধর্মী রিপোর্ট পাওয়া গিয়েছে ব্যতিক্রমহীন প্রায় সর্বত্র। উঠেছে এর পুনরুৎপাদন এবং অন্তত বিভাগীয় পর্যায়ে এই প্রদর্শনী পুনরায়োজনের দাবি। শিল্পকলা অ্যাকাডেমি ঢাকায় এর আয়োজন সফলভাবে সম্পন্ন হবার পরবর্তী পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা সম্পর্কে এহেন অনন্য উদ্যোগের সমন্বয়কারী উজ্জ্বল দাশ একটি মিতায়ত রচনায় আলোকপাত করেছেন।
রচনাটি থেকে ‘প্রোজেক্ট লন্ডন ১৯৭১’ সম্পর্কে, এই উদ্যোগের পূর্বাপর প্রকল্পপরিকল্পন ও প্রাক্কলন সম্পর্কে, এর নেপথ্য অভিপ্রায় ইত্যাদি সম্পর্কে বেশ খানিকটা জানার সুযোগ পাওয়া যায়। এটি লিখেছেন ‘প্রোজেক্ট লন্ডন ১৯৭১’-এর উদ্যোক্তা ও প্রকল্প-সমন্বয়ক উজ্জ্বল দাশ। রাশপ্রিন্টপাঠকদের জন্য প্রদর্শনী-নিদর্শনস্মারকপত্র থেকে সংগ্রহপূর্বক রচনাটি বিশেষ-গুরুত্ব-বিবেচনায় লেখকের অনুমোদনক্রমে এখানে ছাপানো হলো। [সঞ্চালক, রাশপ্রিন্ট]
দূর পরবাসে থেকেও বহু মুক্তিকামী বাঙালি এবং অবাঙালি নাগরিক বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কাঁপিয়েছেন বিলেতের রাজপথ। প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বের বিক্ষুব্ধ, প্রতিবাদী দিনমালা থেকে লন্ডন হয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন — পুরো সময়কাল নিয়ে ‘লন্ডন ১৯৭১’ শিরোনামের আলোকচিত্র ও ঐতিহাসিক স্মারক প্রদর্শনীর আয়োজন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বহু অজানা ইতিহাসের সরব সাক্ষী লন্ডন। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতিপর্ব থেকে মুক্তিযুদ্ধকালীন দীর্ঘ নয়মাস বিলেতের প্রতিটি শহরে বিলেতপ্রবাসী মুক্তিকামী বাঙালিরা জোরালো দাবি তুলেছেন স্বাধীন বাংলাদেশের সমর্থনে।
বাঙালিদের পাশাপাশি ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সমর্থনে বিশ্বজনমত গঠনে ব্রিটিশ এমপি, রাজনীতিক, সাংবাদিক, সমাজকর্মী, প্রগতিশীল শিক্ষার্থীরাও রেখেছেন অনন্য ভূমিকা। একাত্তরের সেইসব উত্তাল দিনগুলো থেকে উল্লেখযোগ্য কিছু তারিখ তুলে ধরছি, যেমন :
- ০৫ মার্চ ১৯৭১-এ লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাই-কমিশন থেকে পতাকা নামিয়ে পুড়িয়ে দেন মুক্তিকামী বাঙালিরা।
- ০৩ এপ্রিল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসবভনে স্মারকলিপি দেন মহিলা সমিতির নেতারা।
- ২৬ জুলাই ১৯৭১ হাউস অব কমন্সে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম আটটি ডাকটিকেট ও উদ্বোধনী-খাম প্রদর্শন করা হয়।
- ১ আগস্ট ১৯৭১ স্বাধীন বাংলাদেশের সমর্থনে ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’-এর উদ্যোগে লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে অনুষ্ঠিত হয় কালজয়ী বিশাল জনসমাবেশ।
- ২৭ আগস্ট লন্ডনে বাংলাদেশ কুটনৈতিক মিশন স্থাপন।
- ০৮ জানুয়ারি ১৯৭২-এর ভোরে হিথ্রো উড়োজাহাজবন্দরে নামেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সন্ধ্যায় ক্লারিজ হোটেলে তাঁর উপস্থিতিতে হয় জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলন।
বিলেতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে জনমত গঠন ও ‘বাংলাদেশ ফান্ড’ শীর্ষক তহবিল সংগ্রহে বিশেষ ভূমিকা পালন করে স্টিয়ারিং কমিটি অফ অ্যাকশন কমিটিস্, সকল আঞ্চলিক অ্যাকশন কমিটি, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, মহিলা সমিতি ইউকে, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন ইন ইউকে, অ্যাকশন বাংলাদেশ ও অপারেশন ওমেগা।
বিলেতে দীর্ঘ সাতবছর আমার ব্যক্তিগত গবেষণার ফসল ‘লন্ডন ১৯৭১’ শীর্ষক এই আলোকচিত্র ও স্মারক প্রদর্শনীর আয়োজন। সুদীর্ঘ এই গবেষণা করতে গিয়েই খোঁজ পেয়েছি ব্রিটিশ আলোকচিত্রী রজার গোয়েনের। যাঁর তোলা দুর্লভ সব ছবি ভিনদেশে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নানা অদেখা মুহূর্তের সাক্ষী।
উল্লেখ করা যেতে পারে বিলেতে বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত ইউসুফ চৌধুরীর তোলা ছবিগুলোর কথাও। পাশাপাশি সংগ্রহ করেছি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাংলা ও ইংরেজি সংবাদপত্রের কাটিং, পোস্টার, প্রচারপত্র ইত্যাদি। সামনের দিনগুলোতে সিলেট এবং পর্যায়ক্রমে যুক্তরাজ্যের লন্ডন ও বার্মিংহ্যামে এই প্রদর্শনী আয়োজনের জোর প্রচেষ্টা চলছে।
‘প্রজেক্ট লন্ডন ১৯৭১’ প্রকল্পের মাধ্যমে ‘লন্ডন ১৯৭১’ শিরোনামের অভিজ্ঞতাস্মারক সংগ্রহগ্রন্থ প্রকাশের পাশাপাশি বিলেতে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের তথ্য নিয়ে ডিজিটাল আর্কাইভ অতি শীঘ্র উন্মুক্ত হতে চলেছে।
‘প্রজেক্ট লন্ডন ১৯৭১’-এর দীর্ঘ প্রচেষ্টায় দেশে-বিদেশে অগণিত বাঙালি/ অবাঙালি বন্ধু, প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনসমূহ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, পেয়েছি অসংখ্য মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা আর ভালোবাসা।
কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ শিল্পকলা অ্যাকাডেমি, লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাই-কমিশন, স্বাধীনতা ট্রাস্ট ইউকে, দ্য এথনিক মাইনোরিটি অরজিনাল হিস্ট্রি অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার ইউকে, সেক্যুলার ম্যুভমেন্ট ইউকে, পাক্ষিক ব্রিকলেন, বাংলাদেশ ওল্ড ফোটো আর্কাইভ, ম্যাজিক কিডস সহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের অকুন্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতাকে।
আমাদের বিশ্বাস, এই প্রকল্পের নানা আয়োজনের ও উদ্যোগের মধ্য দিয়ে দেশ-বিদেশের তরুণ বাঙালি প্রজন্মকে ১৯৭১ সালে ভিনদেশে অবস্থানরত বাঙালিদের স্বাধীনতাসংগ্রামে তীব্র প্রত্যয় এবং দৃঢ়-চৈতন্য লড়াকু ভূমিকার কথামালা সম্পর্কে উৎসাহী হতে প্রেরণা জোগানো সম্ভব হবে, জানতে দেবে ভিনদেশে বাঙালির গৌরবগাথার ইতিহাস।