ওসমান সমাচার – পর্ব-১৪। আহমদ মিনহাজ
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ৭:২৯ অপরাহ্ণ, | ৩৪৮৬ বার পঠিত
‘রাং রাজওয়া’ ইন্দ্রজাল : পিট সায়েব ও বাইজি–কন্যা সমাচার (৬)
অনেক ঘাটের পানি খেয়ে বাইজি-কন্যা অবশেষে বাপের ভিটায় ফিরে। আগ্রার লু হাওয়া ঠেলে ঘন মেঘে সজল এক শহরে পৌঁছায়। টিলা ও চা বাগানে আচ্ছাদিত শহরটি বড়ো সবুজ! দীর্ঘ নদীটি শান্ত ও নিস্তরঙ্গ। শহরকে প্যাঁচিয়ে ধরে অলসভাবে বইছে। শহরটি আগ্রার মতো জেল্লাদার নয়। বাদশাহী ঠাটবাট চোখে পড়ে না। খেয়াল ও গজলের তরঙ্গ এখানে প্রকট নয়। বাইজিরা সংখ্যায় সীমিত। ঠুমরির গমকে তারা রাজসিক নয়। শহরটি শান্তবিধুর। নদী, বিল ও হাওরের তরঙ্গে টইটম্বুর হয়ে আছে।
কন্যা দেখে এ এক জলের দেশ। এই দেশে গান চলে জলের তালে। দরবারি রাগ এখানে জলের ছন্দে দোলে। মাঝির বৈঠা গান করে ভাটিয়ালি। রমণীর মন বিধুর হয় নাইওরী গানে। নববধূ উচ্ছ্বল হয় ধামাইলের ছন্দে। ঘরের বউ-বিনিরা উদাস হয় বিচ্ছেদী সুরের টানে। এখানে ফকিরের কণ্ঠে বেলাশেষের আরতি বাজে। এই শহর বাউল ও ফকিরের। পীর ও দরবেশের মাজারগুলো মৌচাকের মতো ঘনীভূত হয়ে আছে। বাউলরা সে মৌচাক ঘিরে গানের তরঙ্গ উঠায়। গানের ভাষা মিষ্টি ও সুরেলা। ‘মন কেমন করা’ বিষাদে ডুবে থাকে। ইংরেজ সায়েবরা এখানেও বিরাজ করছে। রায় ও খান বাহাদুর ফিটনে চড়ে খাওয়া খায়। রইস আদমিরা বাইজি নাচায়। কীর্তনের রাগ-রাগিনীর মাঝে নবাবী রাগ উছলে ওঠে। শহরটি তবু আগ্রা নয়। বাদশাহী গমকে বনেদি নয়। সে বরং ধানখেতের মতো সবুজ ও সোনালি। কন্যা মুগ্ধ হয় সবুজ ও সোনালির এই যৌথ আলিঙ্গনে!
সময় থেমে থাকে না। যুগ পালটায়। মানুষের বেঁচে থাকার ধরনে নতুন দিনের হাওয়া লাগে। শহরটি সে-নিয়মের বাইরে নয়। বিলেতি কেতা বেনো জলের মতো এখানে ঢুকছে। তবে সম্পূর্ণ দখল নিতে পারেনি। সায়েবি, আমিরি ও বাবুগিরি সামাল দিয়ে শহরটি এখনো গ্রামীণ ও প্রাকৃতিক রয়ে গেছে। ওর এই শ্যামলিমা বাইজি-কন্যাকে বিমোহিত করে। এখানে রামবাগ ও খসরুবাগ নেই। ইরানী ছাঁচে বাগিচার বাহার নেই। তাতে কী! পুরো শহরটি এক বাগিচা। ইন্দ্রজাল আশ মিটিয়ে তাকে বন্য করে গড়েছেন। বুনো গাছপালা ও জংলী ফুলে শহর ছেয়ে আছে। মালির প্রয়োজন ইন্দ্রজাল নিজের হাতে মিটিয়েছেন। শহরটি জংলী ফুলের বাহারে রঙিন।
যুবতী সেই বাগিচার মধ্যে ঘুরে। বাপের চোখ দিয়ে শহরের বুনো প্রকৃতির খবর করে। তার নাকে জংলী ফুল ঝাপটা মারে। ওরা প্রচণ্ড বুনো। কড়া মদের মতো ঝাঁঝালো। কন্যার অশান্ত হৃদয়ে বর্ষার কদম্ব ফোটে। জলের ঝাপটা লাগে দেহে। রবি বাবুর গান সে এই প্রথম শুনছে। বাপ তাকে গানের অর্থ ও ভাব বুঝিয়ে দেয়। সুরের প্রবাহ ধরতে সাহায্য করে। রবি-গানের শান্ত ভেলায় চড়ে কন্যা নিরুদ্দেশে হারায়। তার চোখে অশ্রুর ঢল নামে। এতো কান্না কোথায় লুকিয়ে ছিল কে জানে! অচিন ইন্দ্রজালের আহবানে কন্যার মন উদাস হয়। রবি বাবুর গান প্রেম ও ঈশ্বরঘন। হাজার বছর গাইলেও পুরোনো হওয়ার নয়। গানগুলো এই ভূ-বর্ষের মতো প্রাচীন ও শতবর্ষী। কখনো ফুরায় না।
শহরটি তার সুরের তালে কন্যাকে মাতাল করে। কন্যা রাধারমণের সঙ্গে দোলে। জলের ঘাটে কোমর ঝুঁকিয়ে ধামাইল গান ধরে। সে খবর করে জেনেছে নিমাই সন্ন্যাসী এই এলাকার লোক ছিল। এলাকাটি তার পিতৃপুরুষের ভিটে। নবদ্বীপে পাততাড়ি গুটানোর আগে গোরা চাঁদের পূর্ব-পুরুষরা এখানে বিচরণ করে গেছে। ভূ-বর্ষকে রাধা-কৃষ্ণ লীলায় মাতিয়ে তোলার আগে নিমাই নাকি শহরে পা রেখেছিল। বাপ-দাদার ভিটেয় তার রাঙা চরণ পড়ে। নিমাই এক রসিক সন্ন্যাসী। প্রেমের রসে হৃদয় মজায়। সেই রসে লোকে ধর্ম ও জাতি ভোলে। সাধকরা এখানে রাধা ও গোপিনীর সঙ্গে কৃষ্ণের প্রেমলীলার মধ্যে খোদার রঙ্গ-তামাশা দেখে! খোদাকে ডাকতে গিয়ে কালাচানকে ডাকে। কালাচানের রঙ্গরসে মজে খোদার মাঝে বিহার করে।
শহরটি বাউল ও কীর্তনিয়ায় ঠাসা। এখানে এসে কন্যা হাসন রাজার প্রেমে পড়ে। বাপের কাছে খেয়ালি জমিদারের গল্প শুনে তার পিলে চমকায়। গ্রাম্য জমিদার পিয়ারিকে বড়ো ভালোবাসে। বাইজি-কন্যা পিয়ারির মাঝে আমির খসরুকে চোখ ঠারতে দেখে। নিমাই ও পিয়ারির সঙ্গে পরিচয় করানোর সুবাদে বাপকে মনে-মনে ক্ষমা করে। কন্যা অবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার করে বাঙালি জনকের প্রতি তার ক্ষোভ ভালোবাসায় পালটে গেছে। এখন সে বুঝতে পারে মা কেন লোকটিকে এতো ভালোবাসতো!
শহরটি কন্যাকে ফরিদা করেছে। বাপের অক্ষমতা সে এখন বুঝতে পারে। জনক কেন আগ্রা ও লখনৌ ছেড়ে এখানে পড়ে থাকে সেটা অনুভব করে মন শান্ত হয়ে আসে। মনে-মনে ভাবে, যে আদমি এই শহরে জন্মেছে তার পক্ষে রইস থাকা অসম্ভব। ধানখেত তাকে টানবে। নদী ও মাঝিরা ডাক দেবে। ধ্যানমগ্ন দরবেশ তাকে ইশারা পাঠাবে। বাউল ও ফকির হৃদয়ে তরঙ্গ বহাবে। কীর্তনিয়ার প্রেমরসে হৃদয় মজবে। রইসের সঙ্গে এসবের দূরত্ব আকাশ-পাতাল। তা-বলে এসবকে উপেক্ষা করে জীবন এখানে টিকে না।
শহরটি ভাতগন্ধি। হাঁড়িতে চাল টগবগ করে ফোটে। রূপালী ইলিশ আচানক সুগন্ধে বাড়ি মাত করে। মৎস্যের প্রাণঘাতি সুগন্ধের কাছে বিরিয়ানির মনমতানো গন্ধ হার মানে। কোনো রইসের পক্ষে এখানে আভিজাত্য ধরে রাখা মুশকিল। চাপাতি ও কাবাবে নিজেকে অভ্যস্ত করার পরে শরীরে মাছের গন্ধ সে লুকিয়ে রাখতে পারে না। ওটা আচমকা বেরিয়ে পড়ে। এই শহর মৎস্যগন্ধি। মাংস নয়, মাছেরা এখানে রাজা। তারা লাফঝাঁপ দেয় নদী ও খালেবিলে। লু হাওয়ার বদলে পুবালী বাতাস এখানে সম্রাট। যখন-তখন ঝাপটা মারে। এই সত্যকে উপেক্ষার সাধ্যি অন্তত এই শহরের নেই।
কন্যা দেখে জলকণারা উন্নাসিক রইসের চোগা ও চাপকান বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। রইসরা এখানে দিল্লী বা আগ্রাওয়ালা নয়। লখনৌর প্রবাহ ধরে না। ঢাকা ও কলকাতার নবাবী তারা ধারণ করেছে। তবে পুরোপুরি নবাব হতে পারেনি। জলের দোষে নবাবিটা লঘু হয়ে গেছে। নবাব হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা শেষে ভেতো বাঙালি রূপে নিজেকে প্রকট করছে। তাদের ঊর্দু বা হিন্দি বচনের মাঝে হুট করে বাঙলা বেরিয়ে আসে। কন্যার রইস-সঙ্গের অভিজ্ঞতা ব্যাপক। সে তাই মনে-মনে ভাবে এবং তুলনা করে। বাপকে দেখে আপনমনে হাসে। তার রক্তে নবাবের পরিবর্তে এক বাঙালি ঘনীভূত হয়।
কন্যা আরো দেখে রইসরা এখানে আরবি-প্রবাহী বলে নিজেকে দাবি করছে। তাদের রক্তে নাকি সৌদি ও ইয়েমেনের প্রবাহ বইছে! তুর্ক ও সমরখন্দকে তারা বক্ষে ধরেছে। দিল্লীর সালতানাৎ ও মোঘল বাদশাহরা নাকি পরিজন লাগে! অনেকে আবার হাতের পেশী ফুলিয়ে পেশোয়ার ও পাঞ্জাবকে পরখ করে। প্রমত্ত পাঠান বা আফগান বনে যায়। করাচি ও লাহোরী হওয়ার সুখে ঊর্দু জবান কপচায়। কন্যা দেখে আর মনে-মনে হাসে।
আরবি-প্রবাহীরা এখানে সৈয়দজাদা বলে নাম কিনেছে। যদিও এই উপাধিতে নিজেকে জাহির করার ক্ষণে ধুতি ও পৈতা পরা বাঙালি বাবুটি হুট করে বেরিয়ে পড়ে। তার গায়ে দধি ও পায়েসের গন্ধ। বিন্নি চাল ও দুধপুলি খুব ভালোবাসে। নিরামিষ ভক্ষণকে ধর্ম বলে মানে। চাপাতি দিয়ে মাংসের কোরমা ভক্ষণের কালে সুক্তো ও বেগুনভাজার জন্য ব্যাকুল হয়। কাবাব খেয়ে মিষ্টির খোঁজ করে। শহরটি পায়েসগন্ধি। লোকেরা এখানে মিষ্টান্নবিলাসী। এটা কোনো রইসজাদার শহর নয়। এখানে বাঙ্গালরা থাকে। প্রমত্ত তুর্ক বা আফগান এই শহরের জলের গুণে ভেতো বাঙালি হয়ে পড়ে। নান ও চাপাতি ছেড়ে ভাতের গন্ধে মজে। পোলাওকে পলান্ন ডেকে সুখ পায়। খালে-বিলে মাছের খোঁজ করে। ভাপা পিঠার ভাপে সৈয়দজাদির চোখে লক্ষ্মীমন্ত দিদি ও বৌদিরা প্রকট হয়। আম্মিজান ও আব্বিজানরা নিজের শুদ্ধতা ধরে রাখতে পারে না। তাদের মধ্যে মাতৃদেবী ও পিতৃদেব আভাসিত হন। বাইজি-কন্যা নিশ্চিত,- শহরটি কস্মিনকালে রইসদের ছিল না। এটা বাঙ্গালদের শহর। এই সত্য অস্বীকার করে রইসগিরি অন্তত এ-শহরে চলে না!
প্রায় শয্যাশায়ী বাপের মাধ্যমে আগ্রাওয়ালি শহরের প্রতিটি খুঁটিনাটি পরখ করে। তার সংস্পর্শে রইস বাঙালি যেন জীবন ফিরে পেয়েছে। ‘যমুনাকে তীর’ নতুন করে রক্তে ঢেউ তুলছে। তাজমহল ও রামবাগ নবযৌবন ফিরে পেয়েছে। মেয়ের মধ্য দিয়ে সেকাল ও একালের আগ্রায় সে বিহার করে। বাপ-মেয়ের মধ্যে পরিবারের লোকজনরা ঢুকে পড়ে। বাইজি-কন্যাকে তাদের আর খারাপ লাগে না। সম্পর্কটি যদিও স্বস্তির নয়, তবে কন্যার চপল কৌতূহলের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে তাদের দ্বিধা ও তাচ্ছিল্য গলে জল হয়। ওর গলাটি চমৎকার। দেহের বাঁকে বাদশাহী তরঙ্গ তুলছে। কোমরের ঘূর্ণিতে পাহাড়ি নদীরা ডাকে। হাসি ও আবেগে কন্যা বড়ো চমৎকারা। মেধার দীপ্তিতে অতিশয় উজ্জ্বল। বাইজি তারা অঢেল দেখেছে। শিল্পী দেখেনি। এবার সেটা প্রাণভরে দেখছে।
এইসব বোঝাপড়ার মধ্যে বিষয়ের বন্দোবস্ত চলে। কন্যার সেদিকে মন নেই। ওটা নিয়ে কোনো বক্তব্য নেই। সে অল্প-স্বল্পে খুশি। যা পায় সেটা নিয়ে শহর ছাড়বে। না পেলে ক্ষতি নেই। এখানে এসে বেঁচে থাকার আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে। তার কাছে এটা সোনার চেয়ে দামি। তবে যাবার আগে শহরটিকে জানার ক্ষুধা মনে প্রবল হয়ে উঠেছে। কন্যা তাই খুটিয়ে সব লক্ষ করে। শিল্পী কন্যার অদম্য কৌতূহলে বাপ চমকিত হয়।
কন্যা লক্ষ করে শহরের মাটি পাহাড়ি হলেও পাথুরে নয়। বারিপাত প্রবল হলে টিলাগুলো দেবে যায়। রমণীরা লজ্জাবিধুরা। লালপেড়ে শাড়ি পরে জানালার ফাঁক দিয়ে জগৎ দেখে। তাদের লাবণ্যে চা পাতার ঘন কষ। মুখগুলো কচুপাতা। চিবুকে জলের ফোটা জমে থাকে। একটু নাড়া দিলে টুপ করে মাটিতে গড়ায়। শহরটি আগ্রার মতো গ্রীষ্মবহুল, তবে গ্রীষ্মের অধীন নয়। শীতকাল এখানে ক্ষণস্থায়ী। জল-নূপুরের প্রবল ছন্দে খরতাপ ও কুয়াশা অধিক দাঁড়াতে পারে না। শহরটি বর্ষাবহুল। বৃষ্টির ছাপ এর সর্বাঙ্গে।
আগ্রাওয়ালির কাছে এই অভিজ্ঞতা একেবারে নতুন। ঘন বর্ষায় নিজেকে সিক্ত করে যুবতী। ঠাণ্ডা লাগার পরোয়া করে না। পরিবারের নিষেধ মানে না। সে শিল্পী, সাদামাটা বাইজি নয়। শিল্পী মায়ের হাত ধরে কালাকার হয়েছে। জল-নূপুরের একেঘেয়ে বোল তাকে বিরক্ত করে না। মনে খুশি ও আবেগ ঘনায়। এমন অঝোর বর্ষণ আগ্রায় কখনো দেখেনি। নদী ও বিলের এমন ফুঁসে ওঠা জীবনে প্রথম দেখছে। বৃষ্টি চরাচর মুছে দেয় বলে শুনেছে। এখন সেটা চোখের সামনে ঘটতে দেখছে। বর্ষা এতো হৃদয়-বিদারক হতে পারে এটা জীবনে ভাবেনি। এই শহরে না এলে অভিজ্ঞতাটি হতো না। মায়ের জন্য মনে-মনে আফসোস করে। তাকে যদি বর্ষার ঘনঘোর রূপটি দেখানো যেতো!
অবিশ্রান্ত বারিপাতে নাকি হৃদয়ের সব ক্ষত ধুয়েমুছে যায়। বর্ষা মানুষকে শুচি করে। মেঘের গম্ভীর গর্জনে ক্ষত নিরাময় হয়। কন্যা সিদ্ধান্ত করে,- জলের চেয়ে বড়ো সঙ্গীত জগতে নেই। বৃষ্টির চেয়ে বড়ো ঔষধী আবিষ্কারের সাধ্য কোনো কবিরাজের নেই। বর্ষা তাকে সজল ও প্রসন্ন করেছে। কষ্ট ও নির্বেদ মুছে দিচ্ছে। বিলেত প্রবাসী সাহেবজাদাকে তার অস্তিত্ব থেকে ধুয়ে-মুছে নিশ্চিহ্ন করতে সাহায্য করছে। রইসজাদাকে নিয়ে কন্যার মনে কোনো পীড়া আর অবশিষ্ট থাকে না।
মেঘের গায়ে হেলান দিয়ে ইন্দ্রজাল সব দেখছেন। কন্যা কষ্ট ভুলেছে দেখে মুচকি হাসেন। এটা তার সংকল্প ও পরিকল্পনার বিরোধী নয়। দুখের শেষে সুখের ঢেউ তোলা ইন্দ্রজালের স্বভাব। আবার সুখ উপচে পড়লে দুখের ডাক দিতে কালবিলম্ব করেন না। তবে এই মুহূর্তে দুঃখের দেবদূত ডাকার কোনো কারণ তিনি দেখছেন না। কন্যা অনেক ঘাটের দুঃখ সয়েছে। কষ্টের দংশন সহ্য করেছে। প্রতারণার বিষে নিজেকে নীল করেছে। এবার একটু প্রাণভরে হাসুক।
প্রেমের কবিতা আসলে যুক্তি দিয়ে লেখা। যে কবি যুক্তি পরিহার করে লেখে সে প্রেম ও ভোগকে পৃথক করতে পারে না। ওই কবি প্রেমের মধ্যে ভোগকে দেখে এবং ভোগের মাধ্যমে প্রেমকে সম্ভোগ করে।
কন্যাকে হাসতে দেখে ইন্দ্রজাল খানিক বিমনা হয়েছেন। ইংরেজ সায়েবের কথা তার মনে পড়ে গেছে। সায়েবটি মাতাল হয়ে গাছতলায় পড়ে ছিল। আর একটু হলে অক্কা পেতো। সারা রাত তাকে পাহারা দিতে হয়েছে। ওদিকে শহর ক্রমে অশান্ত হয়ে উঠছে। সায়েব খেদানোর গান মাত্রা ছাড়িয়েছে। নেটিভ ও ইংরেজ এখন মুখোমুখি। এর মধ্যে সায়েবকে বাড়ি পৌঁছে দিতে হলো। কন্যা এসবের কিছুই জানে না। মনের সুখে বৃষ্টিতে ভিজছে। গানের তরঙ্গে মজে আকাশে উড়ছে। শান্ত শহরে অশান্তির ঘনঘটা তাকে তাই বিচলিত করে না।
কন্যা উলটো গানের রসে মজে। মুকুন্দ দাসের গানের সুরটা তার ভালো লাগছে। চোখ বড়ো করে বাপকে জিজ্ঞেস করে,- ‘আব্বা, ইয়ে লোগ্ বড়া শোর মাচা রাহি হ্যায়! কিউ!’ মেয়ের বিস্ময়ে বাপ হাসে, -‘কিউ বেটিয়া, আজাদি পসন্দ নেহি তুমে?’ বাপের প্রশ্নে কন্যা থমকায়। আজাদির এই হুল্লোড় বুঝ হওয়ার পর থেকে দেখছে। মহাত্মা গান্ধী, নেতাজি সুভাষ ও জিন্না সাহেবের নাম বালেগ হওয়ার দিন থেকে শুনছে। লোকে ওদের খুব ভক্তি-শ্রদ্ধা করে। তাদের নিয়ে হরহামেশা কথা বলে। কথায়-কথায় ইংরেজ সায়েবদের সঙ্গে ঝামেলা পাকায়। এইসব বড়ো মানুষদের নামডাক সে অনেক শুনেছে। নেহেরু, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ও সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলকে আগ্রায় বিচরণ করতে দেখেছে। তারা সবাই আজাদির জন্য লড়ছেন। কিন্তু নিজে এই লড়াইয়ে শামিল হওয়ার আগ্রহ বোধ করেনি। এটা নিয়ে মাকে উচ্চকণ্ঠ হতে দেখেনি। তাদের জীবনে আজাদি কোলাহলের অতিরিক্ত কোনো অর্থ কখনোই বহন করেনি!
তার বেশ মনে আছে, গান্ধীজি ও জিন্না সাহেব একবার আগ্রা ঘুরতে এসেছিলেন। লোকজনের উৎসাহের সীমা ছিল না। রইসরা সভা ডেকেছিল। প্রচুর লোক সমাগম হয় সেখানে। গান্ধীজী স্বভাব-শান্ত স্বরে আজাদি নিয়ে ভাষণ দিলেন। অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে স্বরাজ কায়েমের পন্থা বোঝালেন। এবার জিন্নার পালা এলো। উনি সাহেব মানুষ। চোখ দুটো তীক্ষ্ণ। কাটা-কাটা স্বরে কথা বলেন। গান্ধীজীর সঙ্গে তার দ্বি-মতের কথা কারো আজানা নেই। সেদিনের ভাষণে ওটা যথারীতি বজায় থাকে।
জিন্নার বক্তৃতায় অহিংসা ছাপিয়ে হিন্দু ও মুসলমানের ন্যায্য হিস্যার দাবি প্রকট হয়। মুসলমানদের বঞ্চিত হওয়ার ইতিহাস তীব্রতা লাভ করে। তার ঠোঁটকাটা বাক্যে মঞ্চে আসীন অনেক নেতা অস্বস্তি বোধ করছিলেন। ব্যারিস্টার সাহেব নির্বিকার। তার এক কথা,- আজাদির মূলমন্ত্র হিন্দু ও মুসলমানের সমবণ্টন। ওটা ছাড়া অহিংসা ফল দেবে না। সমবণ্টন ছাড়া বিভক্তি যে অনিবার্য সেই ইঙ্গিত জিন্না গোপন করেন না। এর ফল কী হয়েছিল সেটা ভিন্ন ইতিহাস। ওই মুহূর্তে লোকেরা জিন্নাকে বিবেচনা করতে বাধ্য হয়। গান্ধী ও জিন্নাকে নিয়ে রইসরা সেদিন খৈয়ের মতো ফুটছিল। এমনকি গানের জলসায় দুজনে ঢুকে পড়েন। কন্যার বয়স তখন অল্প। তার মনে আছে এইসব বাতচিতে মা বিরক্ত হচ্ছিলেন। খেয়াল ও ঠুমরির তালে বারবার বিঘ্ন ঘটছিল। সত্যি কথা হলো, মা ও মেয়ের জীবনে আজাদি একটা বিঘ্ন ছাড়া কিছু ছিল না।
আজাদ হওয়া নিয়ে লোকের মত্ততায় বাইজি কখনো উৎসাহ বোধ করেনি। ওটা তার পেশা ও নেশার সঙ্গে খাপ খায় না। যে নিজে আজাদ নয়, দেশের আজাদি তার কাছে কোনো অর্থ বহন করে না। কাজেই আজাদির উত্তেজনায় নিজেকে শরিক করার আগ্রহ বোধ করেনি। গান্ধী ও জিন্নার কারণে সেদিনের জলসায় রসভঙ্গ ঘটে। ওটা আর জমেনি। রইসরা আজাদি নিয়ে বকবক করে বাড়ির পথ ধরেছে। তারা বিদায় নিলে মা ঘর গুছানোয় মন দিয়েছিল। এই একটিবার তাকে বলতে শুনেছে,-‘আজাদি সে কিয়া ফায়দা! যব্ ইয়ে তুমে আজাদ নেহি কর সাকে!’
মায়ের কথার মাথামুণ্ডু কন্যা সেদিন ধরতে পারেনি। ধরার বয়স সেটা ছিল না। বাইজি ম্লান মুখে মেয়েকে সবক দিয়েছিল:-
‘খোদা কি দুনিয়ামে আজাদি নেহি হোতি হ্যায় বেটিয়া। ইনসান আজাদিকে লায়েক নেহি। খোদা ইনসানকো দাবাকে রাখ দিয়া। শায়েদ ও বিগাড় না যায়। আব্ ইনসান খোদাকি তারাহ ওহি শুরু কিয়া। এক্ ইনসান দুসরা ইনসানকো দাবাকে রাখ দিয়া। ইসমে আজাদি কাহা হ্যায়? আগার ইংরেজ সে তুম আজাদ হো যাওগি তো কেয়া ফায়দা হোগা! আব্ তুম আপনা আদমিকো দাবাকে রাখোগি। আজাদি ঝুটা হ্যায়। খোদাকি দুনিয়ামে ও নেহি চলতি।’
বাপের প্রশ্নে কন্যা অতীতে ডুবে গিয়েছিল। বাইরে আজাদির শোরগোল শুনে বর্তমানে ফিরে আসে। তার প্রশ্নের উত্তর করে,-‘ইয়ে মে কাভি সুচা নেহি আব্বা। লেকিন এক বাত্ বাতাইয়ে, আগার আজাদ হো যায় তো হাম সব আচ্ছি হো যায়েগি? ইস্ দেশমে কোই বুরা আদমি নেহি রহেগি?’
কন্যার প্রশ্নে বাপ বিপদে পড়ে। বিব্রত মুখ করে কন্যাকে বোঝায়:-
‘ইয়ে আচ্ছি আওর বুরি কা বাত্ নেহি বেটিয়া। গোলামি হটানে কেলিয়ে হামে আজাদ হোনা চাহিয়ে। হামলোগ খোদাকি গোলাম হ্যায়। কোই ইনসানকা নেহি। ইংরাজ হামে গোলাম বানাকে রাখ্ দিয়া। আব্ ও হটে তো তুম আপনা আতমাকো পেহ্চান সাকোগে। তুম আচ্ছি না বুরা হোগি, ইয়ে আলগ বাত্ হ্যায় বেটিয়া। পেহলি তুম খুদ কি পেহ্চান করকে দেখো। ফির ওয়ি বাত্ পুছ লেনা।’
বাপের যুক্তি কন্যার মনে ধরলেও আজাদির চেয়ে আজাদি-সঙ্গীত তাকে বেশি টানে। লোকের শোরগোলের মধ্যে সুরের তরঙ্গ বইছে। কন্যাকে সেটাই বেশি রোমাঞ্চিত করে।
বাপ-মেয়ের আজাদি-কথনের মধ্যে ইন্দ্রজাল ইংরেজ সায়েবকে নিয়ে ভাবেন। দেবদাস তাকে চিন্তিত করে তুলেছে। বাপের বাড়ি এসে বাইজি-কন্যা সাহেবজাদাকে ভুলতে পেরেছে। কিন্তু এই শহরে আসার পর পিটার নামের এক সাহেবজাদা তাকে দেখে মজেছে। তার জন্য মাথা কুটে মরছে। কন্যা সে খবর রাখে না। শহরে পা রাখার পর ইন্দ্রজাল তাকে পিটার সায়েবের দোকান ঘুরিয়ে এনেছেন। তার জন্য সেটা ছিল বিলেতি দোকান পরখ করার সুখ। কিন্তু সায়েবের ক্ষেত্রে অসুখ। বায়রনের শিষ্য সেই থেকে কন্যার বিরহে মরছে। বিষয়টি উদ্বেগজনক বটে!
পরের ঘরের বউকে দেখে বায়রন চমকে উঠেছিল। পরস্ত্রীর অপার্থিব সৌন্দর্যে মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছিল। তবে কলমের ভাষা হারায়নি। রমণীকে রাত্রিসুন্দরী বলে বন্দনা করেছে। তার সৌন্দর্যে ডুবে নিজেকে কবি বলে প্রমাণ করেছে। তাকে প্রেম-নিবেদনের বাসনা করেনি। ইচ্ছে করলে ডন জোয়ান হতে পারতো। রমণীকে পটিয়ে প্রেমের সাধ মিটাতে পারতো। সম্ভোগের লালসায় নিজেকে তৃপ্ত করা ওর জন্য কঠিন ছিল না। লর্ড বায়রন সে-পথে পা বাড়ায়নি। তার হয়তো মনে হয়েছে কেবল বাসনা দিয়ে এই রমণীর অপার্থিব সৌন্দর্যকে ঠিক বুঝে উঠা যাবে না। এতে সে পার্থিব ও স্থূল হয়ে পড়বে। তার দেবীত্ব নিঃস্ব হবে রমণীত্বে। অন্ধকারের মধ্যে অন্ধকার কিংবা দ্যুতির মধ্যে দ্যুতির আবেশটি আর বজায় থাকবে না। সুতরাং বায়রন নিজেকে সামলে নিয়েছে।
দেবীকে মানুষের ভোগে লাগালে সে আর দেবী থাকে না,- রক্ত-মাংসের মানবী হয়ে পড়ে। বহু রমণীর সংসর্গে অভিজ্ঞ বায়রন সেটা চায়নি। রমণীপটু কবি নিজের পুরোনো অভ্যাস থেকে সরে এসেছে। রমণীকে না-পটিয়ে নিজের কলমকে পটিয়েছে। সৌন্দর্যের নতুন সংজ্ঞায় তাকে অভিনন্দিত করেছে। রক্ত-মাংসের এক রমণীর মধ্যে নতুন রক্তে-মাংস যোগ করেছে। তার কাছে রমণী হয়েছে রাত্রিসুন্দরী। ওর নশ্বর দেহের খবর নিয়ে লাভ নেই। গৎবাঁধা পথে তাকে পটানোর চেষ্টা বৃথা। এতে ঘোর কেটে যায়। এহেন রমণীকে কল্পনায় প্রেম ও সম্ভোগ করতে হয়। কলমের নিবে আকার দিতে হয়। রমণীকে নিয়ে কাব্য ফেঁদে বায়রন সে কাজটি করে গেছে।
পিটার কবি হলেও লর্ড বায়রন নয়। বাইজি-কন্যাকে দেখে তার হৃদয় উতলা হয়েছে। তাকে রাত্রিসুন্দরী বলে জল্পনা করছে, খৈনিকণ্ঠি নামে সম্বোধন করছে, কিন্তু বায়রনের মতো কলমের নিবে স্থির থাকার বাসনা সেখানে নেই। রমণীকে সে হৃদয়ে বন্দি করতে চাইছে। শরীর দিয়ে ঘিরে ধরতে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। দেহ-মনের এই বাসনা মিটাতে হলে তাকে উদ্যোগী হতে হবে। সায়েবের সেটা ধাতে সইছে না। খৈনিকণ্ঠি রমণীকে পটানোর কোনো চেষ্টা তার মধ্যে নেই। যেচেপড়ে খবর করার উৎসাহ নেই। সে ধরে নিয়েছে রাত্রিসুন্দরী আপনা থেকে একদিন দোকানে দেখা দিবে। অপার্থিব এক সৌন্দর্য মৈথুনের সুযোগ তাকে করে দেবে। পুরো বিষয়টি এখানে এসে জটিল হয়ে পড়েছে। ঘটনায় নাক গলাতে ইন্দ্রজালকে বাধ্য করছে।
বাইজি-কন্যাকে রাত্রিসুন্দরী ভাবার সময় পিটার কবি বায়রন হয়ে পড়ে। তার বাস্তবজ্ঞান লোপ পায়। কিন্তু খৈনিকণ্ঠি বলে তাকে কল্পনা করার সময় সায়েব বাস্তবে ফিরে। তার রক্তে লাম্পট্য প্রবল হয়। কলমের পরিবর্তে নিজের দোকানে রমণীকে পাওয়ার বাসনাটি চাগা দিয়ে ওঠে। প্রেমের আলিঙ্গনে রমণীকে কামাতুরা করার সাধ জাগে। সায়েবের দ্বৈত-বাসনা বুঝিয়ে দিচ্ছে প্রেমের বায়বীয় ও বাস্তব অস্তিত্বকে সে একত্রে ধরে রাখতে ইচ্ছুক। বাইজি-কন্যাকে নিয়ে কল্পনায় ও বাস্তবে সমভাবে বিচরণ করতে আগ্রহী।
পিটারের এই আগ্রহ প্রমাণ করে স্বভাবে বায়রন-রসিক হলেও সায়েব আসলে নিজে বায়রন নয়। জগতে কবিরা প্রেমকে ভোগের সামগ্রী মনে করে না। কলমের নিবে একে তারা আপার্থিব করে তোলে। ভোগ থেকে প্রেমকে আলাদা করে বর্ণনা করে। সেই বর্ণনার ভিতর দিয়ে ভোগের বাসনাটি মৃদু ও নিস্তেজ হয়। বাস্তবে কবিরা বিবেচনা পরিহারের ভান করে মাত্র। প্রেমকে ভোগ থেকে আলাদা করার সময় তাদের মনে বিবেচনাবোধ প্রবল হয়। প্রেমের কবিতা আসলে যুক্তি দিয়ে লেখা। যে কবি যুক্তি পরিহার করে লেখে সে প্রেম ও ভোগকে পৃথক করতে পারে না। ওই কবি প্রেমের মধ্যে ভোগকে দেখে এবং ভোগের মাধ্যমে প্রেমকে সম্ভোগ করে। বায়রনের সঙ্গে পিটারের এটা হলো তফাত। বায়রন-ভক্ত হলেও সায়েবটি প্রেমিক কবির দলভুক্ত নয়। সম্ভোগ-প্রেমী কবিকুলের দলে তাকে রাখা যেতে পারে।
বিষয়টি ইন্দ্রজালকে ভাবিয়ে তুলেছে। হতচ্ছাড়া প্রেম ও ভোগকে একত্রে মিশিয়ে ফেলছে। নিরামিষ ও মাংসভোজী কবিকুলকে সমানে বহন করছে। ওর মধ্যে বিবেচনা ও বিচারের আজব সহাবস্থান দেখে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। বাইজি-কন্যাকে তার দোকানে আরেকবার পাঠালে ‘কী ঘটবে’ সেটা এই মুহূর্তে অনুমান করা যাচ্ছে না। একবার ভাবছেন পাঠিয়ে কাজ নেই। হতচ্ছাড়া দেবদাস হয়ে মরুক। আবার ভাবছেন, না পাঠালে বাইজি-কন্যাকে নিয়ে তার পরিকল্পনা ও সংকল্প কোনো গতি পাবে না। তাকে তিনি মরণ থেকে ফিরিয়ে এনেছেন। এই শহরে ঘুরিয়ে আত্মবিশ্বাসী করেছেন। যদিও আগ্রায় এটা কাজে লাগবে বলে ভরসা হয় না। রইসরা সেখানে শকুন হয়ে গেছে। কন্যাকে একা তিষ্ঠাতে দেবে না। তাকে দখল করার জন্য নির্লজ্জ হবে। তার মাকে আগেই মাটি করেছেন। বাপকে ঘরবন্দি করে অসুস্থ করেছেন। বেচারা এখন ঘুমের ঘোরে কবর দেখে। মেয়েকে বেশি দিন আগলে রাখতে পারবে না। কন্যার জন্য শহরটি উপযুক্ত নয়। ওটা দু’চার দিনের জন্য হয়তো ভালো। লম্বা সময়ের জন্য বিপজ্জনক। এই বিষয়টা মনে রাখতেই হচ্ছে।
ইন্দ্রজাল জানেন, কন্যা এখানে অচিরে হাঁপিয়ে উঠবে। বর্ষা তার ভালো লাগবে না। গানের তরঙ্গে ভাসার সুখ কোনো স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তা দিতে পারবে না। শহরটি সংকীর্ণ। সময় হলে এই সংকীর্ণতা তার উপর চেপে বসবে। তাকে নিয়ে শহরের লোকজনের আগ্রহ ফুরিয়ে যাবে। রইসরা নানা প্রশ্ন উঠাবে। ঠেস দিয়ে কথা বলবে। মওকা বুঝে মেয়েটিকে তাদের ঘরে বন্দি করতে চাইবে। তাকে রক্ষিতা হওয়ার নিয়তি বরণ করতে বাধ্য করবে। দুটো শহরের একটিও মেয়ের জন্য নিরাপদ নয়। বাইজিদের জীবনে খেয়াল ও ঠুমরি ছাড়া কোনোকিছু নিশ্চিত বা নিরাপদ নয়। এরচেয়ে তাকে সায়েবের মুখোমুখি করা ভালো। দ্বিতীয়বার ওকে দেখে সায়েব ‘কী করবে’ সেটা অবশ্য বলা কঠিন। তবে অন্য নিশ্চয়তার তুলনায় এই অনিশ্চয়তা অনেক নিরাপদ। মা-হারা মেয়ে একটা গতি ও দিশা পাবে। নিজের জীবন সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি নিতে পারবে। সব ভেবে ইন্দ্রজাল দেবদূতকে ইশারা করেন। বাপের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার আগে বাইজি-কন্যা আরেকবার পিট সায়েবের বিলেতি দোকানে গিয়ে ঢোকে।
ইন্দ্রজালের ইশারায় কন্যা দোকানে ঢোকে, সেইসঙ্গে লম্বা কাহিনীটি তার শেষ অধ্যায়ে ঢুকে পড়ে। শহরের প্রবীণরা হলেন এই কাহিনীর কথাকার। তারা অতীতচারী। একালে বাস করে সেকালে বিচরণ করেন। দূর অতীতে ঘুরে বেড়ান। নিজেকে সেখানে জীবিত ও চঞ্চল রাখেন। এই প্রবীণরা হচ্ছেন বর্তমান ও অতীতের সংযোগ-সেতু। একালের কতিপয় যুবক তাদের মনোযোগী শ্রোতা। শহরে রাক্ষস ওসমানের উৎপাত চলছে। তাকে ধরা যাচ্ছে না, যদিও তার উৎপাতে সবাই অতিষ্ঠ। যুবকরা তাকে মোকাবিলা করতে জোট বেঁধেছে। শহরের অলি-গলিতে রাক্ষস খুঁজছে। ওসমানকে অনুসরণ করে মেয়র সাহেবের বাগানে ঢুকেছে। নগরপিতার বাগানে চাঁদের ঢল নেমেছে। এমন চাঁদরাতে শহরের লোকজন ঘরে থাকে না। তারা বাইরে বেরিয়ে পড়ে। মান্যগণ্য লোকেরা মেয়রের বাগানে জড়ো হয়। খোশগল্পে মেতে ওঠে। এই সুযোগে ওসমান বাগানে ঢুকে পড়েছে। তার হাতে সুঁই-ছুরি-কাঁচি। চোখে মানুষ খুনের নেশা। চাঁদ আজ গজগামিনী হয়েছে। এমন গজগামিনী রাতে রাক্ষসরা খোক্কস হয়ে ওঠে। ফুলখেকো ওসমান আজ খোক্কস হয়ে বাগানে ঘুরছে। জটলায় চুপিসারে চলাফেরা করছে। সবকিছু তছনছ করার খিদে তার মধ্যে তীব্র হয়ে উঠেছে। বোঝা যাচ্ছে সে আজ ফুল ছেড়ে মানুষ নেবে। যুবকরা এটা টের পেলেও বাকিরা এখন অব্দি নির্বিকার!
প্রবীণরা বয়স ও অভিজ্ঞতায় পরিপক্ক। রাক্ষসের উপস্থিতি বোঝার কৌশল যুবকদের শিখিয়ে দিয়েছেন। সেটা এখন কাজে লাগছে। ওসমানকে তারা পরিষ্কার টের পেয়েছে। কিন্তু বাকিরা কিছু বুঝতে পারছে না। চাঁদরাতের প্রভাবে খোশগল্পে মশগুল হয়ে আছে। নিজের করণীয় স্থির করতে না পেরে যুবকরা হতবিহ্বল অবস্থায় বাগানের জটলা পরখ করে। জটলায় কোনো ছদ্মবেশী রাক্ষস হয়তো লুকিয়ে আছে। তারা সেটা নিশ্চিত হতে চাইছে। প্রবীণদের কাছে শোনা দূর অতীতের কাহিনী তাদের মনে উঁকিঝুকি দিচ্ছে। একালের ওসমানের সঙ্গে লুকোচুরি খেলার মুহূর্তে সেকালের শহরে ঘুরছে।
ইন্দ্রজাল এই যুবকদের পিট সায়েবের শহরে নামিয়ে দিয়েছেন। খৈনিকণ্ঠি বাইজি-কন্যার বিড়ম্বিত জীবনের ভাগিদার করেছেন। মানুষের নিয়তি ও স্বেচ্ছাচারের অংশীদার হতে বাধ্য করছেন। সায়েব খেদানোর গানে উত্তাল এক শহরে যুবকরা ঘুরছে। তারা দেখছে ইংরেজ সায়েবের মনে রাক্ষস জেগে উঠেছে। খৈনিকণ্ঠি বাইজি-কন্যাকে ভক্ষণ করতে সে মরিয়া হয়ে আছে। শহরের লোকজন আর মানুষ নেই। তারা সবাই রাক্ষস হয়ে গেছে। সায়েবদের ভক্ষণ করার খিদেয় ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছে। বিড়ম্বিত বাইজি-কন্যা ছাড়া সবকিছু অশান্ত ও অস্থির। যুবকরা অস্থির এক শহরে ঘুরছে।
পিট সায়েবের শহরে এখন সায়েব খেদানোর হাওয়া। স্বদেশী, স্বরাজ ও সত্যাগ্রহ সব এক-তরঙ্গে মিলেছে। অসহযোগ ও বিপ্লব একসাথে মাথা তুলছে। অহিংসা ও ব্রহ্মচর্যে লোকজনকে উজ্জীবিত করতে গান্ধী শহরটি ঘুরে গেছেন। বিলেতি সায়েবের সঙ্গে বিলেতি সামগ্রী বর্জনের কথা আবারো স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। গুরুসদয় দত্ত এই এলাকার লোক। ব্রতচারী মন্ত্রে শহরের যুবকদের তিনি প্রস্তুত করছেন। শরীরচর্চায় ব্রতচারীদের অসীম উৎসাহ। তারা নিয়মিত ডাম্বেল ভাজে। লাঠি ঘুরিয়ে রায়বেশী নৃত্য করে। পুকুরের আবর্জনা পরিষ্কার করতে নামে। ময়লা নিষ্কাশনের জন্য নর্দমা সাফাই করে। কর্মের মন্ত্রে উজ্জীবিত ব্রতচারীরা স্বাধীনতার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে।
শুধু স্বাধীন হয়ে লাভ নেই। দেশগড়ার দায়িত্ব কাঁধে নিতে হবে। গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারীরা সেই মন্ত্রে কর্মী হয়েছে। শহরে ব্রহ্মচর্য ও ব্রতচারী সমানে রাজত্ব করে। যুবকরা বিবাহে অনিচ্ছুক। লালপেড়ে শাড়ি ও সিঁদুররঙা রমণী ফেলে ‘মাতঙ্গিনী কালী’ হতে চাইছে। ভালো করে কান পাতলে অনেকের ঘরে চরকার আওয়াজ শোনা যাবে। ওরা গান্ধী-ভক্ত। বিলেতি কারখানা ছেড়ে দেশী কুটিরশিল্পে ফেরত যেতে ইচ্ছুক। দেশজ শিল্পায়নের ভাবনাটি তাদের মনে বাসা গেড়েছে। গান্ধীজি নিজে চরকা কাটেন। ছাগদুগ্ধ দোহন ও পান করেন। নিজের হাতে আশ্রম গড়ে তুলেছেন। দীনহীন বেশে সেখানে থাকেন। সায়েব তাড়ানোর দিক-নির্দেশনা দেন। তার প্রভাবে শহরটি আদি ভূ-বর্ষে ফিরতে চাইছে। গুরু ও শিষ্যের পরম্পরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। তপোবনের পুরোনো ঐতিহ্যে অনেকে ফেরত যেতে অনেকে অধির এখন।
এদিকে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু কিন্তু বসে নেই। ‘আজাদ-হিন্দ ফৌজ’ গঠনের নেশায় ভূ-বর্ষ চষে বেড়ানোর পথে এই শহরে এক পাক ঘুরান দিয়ে গেছেন। বুকে তার দুরন্ত সাহস। বাহুতে শিরা ফোলানোর আহবান। নেতাজি দুরন্ত ধামাকা বটে! ধুন্ধুমার বোমাবাজির মাতন চলছে ভূ-বর্ষে। তার প্রভাব শহরেও পড়েছে। বিপ্লবীরা কেউ অহিংসায় নেই। যুবকদের অনেকে সশস্ত্র বিপ্লবকে আজাদির নিশানা করেছে। ‘সায়েব ধরো, সায়েব মারো’র উত্তেজনায় নববধূরা যুবক স্বামীকে ঘরে বেঁধে রাখতে নাচার। মুকুন্দ দাসের রণগানে শহরের লজ্জাবতি ঘরণী অব্দি রণরঙ্গিনী হয়েছেন। শখের বালা-চুড়ি দেশব্রতীদের পুঁটলিতে বিসর্জন দিতে মনে দ্বিধা নেই। ক্ষুদিরাম সবার হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। মুকুন্দ তাকে রণগানে অমর করেছেন।
ওদিকে চট্টলায় মাস্টারদা সূর্যসেন অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ছক কষেন। ওরিয়েন্টাল স্কুলের নিরীহ গণিত শিক্ষকের মধ্যে এক গেরিলা জন্ম নিয়েছে। লোকজনের সহায়তায় অনেক আগে জাতীয় বিদ্যালয় গড়ে তুলেছেন। ওরিয়েন্টাল ছেড়ে সে-বিদ্যালয়ে ছাত্র পড়ান। পড়ানোটা আসলে বাহানা। বিপ্লবী গেরিলা হওয়া মূল লক্ষ্য। সেখানে বসে সায়েবদের স্থাপনায় হানা দেয়ার পরিকল্পনা চলে। গেরিলা কায়দায় সরকারি কোষাগার লুণ্ঠন করেন। বিপ্লবী দল গঠনে সেই অর্থ কাজে লাগে।
সূর্যসেন সাহসী। ব্রিটিশ রাজের পোষা বাহিনী তাকে বিপ্লবী সন্দেহে সমানে তাড়া করে। মাঝেমধ্যে ধরা পড়েন। জেল থেকে বেরিয়ে আবার বিদ্যালয়ে যোগ দেন। নিরীহ স্কুল মাস্টারের বেশে চলাফেলা করেন। বিনোবিহারীদের নিয়ে গোপনে বৈঠক সারেন। নতুন আক্রমণের ছক তৈরি হয়। প্রীতিলতা ওয়েদ্দেদার ও কল্পনা সাহারা তার শিষ্য হয়েছে। রমণীরা সাহসী। স্বাধীনতার প্রশ্নে নির্ভয়া। মাস্টারদা সূর্য হলে প্রীতিলতা তার ছায়া। সায়েবদের ঘাঁটিতে গেরিলা কায়দায় হানা দিতে তার উৎসাহের সীমা নেই।
ইউরোপিয়ান ক্লাবে আক্রমণ চালানোয় মাস্টারদা’র বিশেষ আপত্তি ছিল। কারণ এটা আত্মঘাতী হতে পারে। প্রীতিলতা ও অন্যরা মিলে তাকে রাজি করিয়েছে। প্রীতিলতার হাতে আক্রমণ পরিচালনার ভার তুলে দিয়েছেন সূর্য। সফল আক্রমণ শেষে দ্রুতপদে ফিরছে রমণী। পেছন থেকে ইংরেজ বাহিনী গুলি চালিয়ে বসে। গুলি শরীরে ঢুকে তাকে জখম করে। ব্রিটিশ রাজের হাতে ধরা পড়ার আগে সাহসী রমণী গলায় সায়ানাইড ঢালছে। ঢলে পড়ছে মৃত্যুর কোলে। স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রথম নারী শহিদ এই প্রীতিলতা!
এতোকিছুর পরেও সূর্যসেনের সায়েব খেদানো বিপ্লবটি সফল হবে না। চট্টলার অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর ব্রিটিশরাজ পাগলা কুকুর হয়ে তার পিছু নেবে। ইউরোপিয়ান ক্লাবে হানা দেয়ার কারণে ‘মোস্ট ওয়ানটেড’-এর তকমা তাকে তাড়া করে ফিরবে। সূর্যসেনের মাথার মূল্য দশ হাজারে গিয়ে ঠেকবে। ব্রিটিশ রাজের সঙ্গে পাহাড়-জঙ্গলে অক্লান্ত লড়াই শেষে বিপ্লবী ধরা পড়বেন। তার গলায় ফাঁসির দড়ি ঝোলানো হবে। মরণের কয়েক ঘণ্টা আগে কমরেডদের লক্ষ করে জীবনের শেষ চিঠি লিখবেন সূর্যসেন। সেখানে সংগ্রাম জারি রাখার সুর বজায় থাকবে। কমরেডদের সম্বোধন করে দেদীপ্যমান সূর্য লিখবেন:-
‘আমার শেষ বাণী হচ্ছে আদর্শ ও একতা। ফাঁসির রজ্জু আমার মাথার উপর ঝুলছে। মৃত্যু দরোজায় করাঘাত করছে। মন আমার অসীমের পানে ছুটছে। এই তো আমার সাধনার সময়। এই তো আমার বন্ধুরূপে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার সময়। হারানো দিনগুলোকে নতুন করে স্মরণ করার এটাই সময়।…এই পরম সুন্দর মুহূর্তে আমি তোমাদের জন্য রেখে গেলাম স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন। জীবনের এক শুভ মুহূর্তে স্বপ্নটি আমায় অনুপ্রাণিত করেছিল। সারা জীবন উৎসাহভরে এবং অক্লান্তভাবে পাগলের মতো সেই স্বপ্নের পিছনে আমি ছুটেছি। জানি না আজ আমাকে কোথায় থেমে যেতে হচ্ছে।…আমার বন্ধুরা,-এগিয়ে চল, তোমরা এগিয়ে চল,-কখনো পিছু হটো না। পরাধীনতার অন্ধকার দূরে সরে যাচ্ছে। ঐ দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতার নবারুণ। কখনো হতাশ হয়ো না। সফল আমরা হবোই।…’
প্রমত্ত বিপ্লবীর ফাঁসি অনেক পরের ঘটনা। এই মুহূর্তে তিনি ব্রিটিশরাজের পোষা বাহিনীর সঙ্গে লড়ছেন। তারা তাকে পাহাড়ে তাড়া করেছে। কমরেডদের সঙ্গে নিয়ে সূর্যসেন পাহাড়ে আত্মগোপন করেছেন। সে-খবর এই শহর অব্দি পৌঁছে গেছে। বিপ্লবী যুবকরা তাকে নিয়ে উৎকণ্ঠিত হলেও বিলেতি স্থাপনায় হানা দেয়ার সংকল্প থেমে নেই। তালিকা প্রস্তুতির কাজ পুরোদমে চলছে। সেই তালিকায় কালেকটর ভবন থেকে শুরু করে আরো অনেক কিছু রয়েছে।
এদিকে বিনয়, বাদল ও দীনেশ ঢাকা থেকে সুদূর কলকাতায় পৌঁছে গেছে। সায়েবি কোট-প্যান্ট পরে ডালহৌসি স্কয়ারে চক্কর দিচ্ছে। একটু পরে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ঢুকবে। সায়েবি আমলাতন্ত্রের নাভিকেন্দ্র ধ্বংস করার সংকল্প নিয়ে তারা সেখানে পাক খাচ্ছে। তাদের চোখে-মুখে সায়েব মারার মন্ত্র। বুকে সিংহের বিক্রম। ত্রি-রত্ন এখন রাইটার্সে ঢুকে পড়েছে। আচমকা গুলিবর্ষণে আমলাতন্ত্রের প্রাণকেন্দ্রটি কেঁপে ওঠে। কর্ণেল সিম্পসন কিছু বুঝে উঠার আগে গুলির আঘাতে মাটিতে লুটি য়ে পড়েছে। তার বুক থেকে ফিনকি দিয়ে রক্তের ফোয়ারা ছুটছে। সিম্পসন আর জগতে নেই। অত্যাচারী কর্ণেলকে ইন্দ্রজাল উপরে তুলে নিয়েছেন। রাইটার্সের গুরুগম্ভীর অলিন্দে ব্যাপক গুলাগুলি শুরু হয়। ব্রিটিশ রাজের পোষা বাহিনী যুবকদের ঘেরাও করে ফেলে। যুবকরা এতে একটুও বিচলিত নয়। এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়ছে। টোয়াইনাম, প্রেন্টিস ও নেলসন নামধারী পুলিশরা গুলি খেয়ে কাতরাচ্ছে। তাদের পায়ে বুলেট ঢুকে গেছে। ওটা আসলে বুলেট নয়,- প্রবঞ্চিত হওয়ার ক্ষোভ। অত্যাচারিত হওয়ার বিক্ষোভ। এই বুলেট এখন ক্ষুদিরাম হয়ে গেছে। ত্রি-রত্নের উপর দেশব্রতী বালকের আসর পড়েছে। বিচ্ছুরা নিজেকে নিয়ে মোটেও ভাবছে না।
পেশাদার বাহিনীর সঙ্গে অপেশাদার বিপ্লবীর লড়াই কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয় না। ত্রি-রত্ন বুঝতে পারছে তাদের সময় ঘনিয়ে এসেছে। ইন্দ্রজাল তাদেরকে জিততে দেবে না। তাতে কী! সিম্পসন তো গেছে! রাইটার্সকে কাঁপিয়ে তোলার কর্মটি চুকেছে। ওটা এখন বারুদ হয়ে ভূ-বর্ষে ছড়িয়ে পড়বে। শহরে ও গ্রামে যুবকদের সশস্ত্র প্রতিরোধের ডাক দেবে। বাদল আর দেরি করে না। পকেট থেকে সায়ানাইড বের করে গলায় ঢালে। বিনয় ও দীনেশ নিজের উপর গুলি চালায়। ইন্দ্রজাল বড়ো নিষ্ঠুর। কালো ডানার দেবদূতকে বিনয় ও দীনেশের প্রাণ হরণে নিষেধ করেন। তার সংকল্প ও পরিকল্পনা বোঝা যাচ্ছে না। তবে বিনয়ের কাছে তাকে হার মানতে হয়। সে ডাক্তারির ছাত্র। নিজেকে মারার একশো কায়দা জানে। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে ক্ষতস্থানে সেপটিক ঘটায়। ইন্দ্রজালের ইশারা বানচাল করে তার মাংসে পচন ধরছে। মাংসে পচন ধরিয়ে কেউ মাটি হতে চাইলে তাকে রোখার সাধ্য ভাগ্যবিধাতার নেই। কালো ডানার দেবদূতকে তিনি ইশারা করেন। দেবদূত যুবকের প্রাণ সংহার করে।
দীনেশ কিন্তু মরতে পারে না। নিজেকে গুলি করা সত্ত্বেও বেঁচে থাকে। ব্রিটিশ রাজ তাকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলায়। ত্রি-রত্নের আত্ম-বলিদানের খবরে ভূ-বর্ষ কেঁপে ওঠে। অদূর ভবিষ্যতে এই রাইটার্স মহাকরণ হবে। ব্রিটিশদের বদলে দেশী মন্ত্রী ও আমলারা মহাকরণে জাঁকিয়ে বসবে। ডালহৌসি স্কোয়ার বিবিডি বাগ নামে খ্যাতি ও সমীহ কুড়াবে। ঢাকার পোলাদের মূর্তি গড়বে ভাস্কর। সে অনেক পরের কথা। এই মুহূর্তে বিনয়, বাদল ও দীনেশের খবর প্রতিটি শহরে পৌঁছে গেছে। এই শহরটি তার বাইরে নয়। ত্রি-রত্নের দুঃসাহস দেখে যুবকরা উজ্জীবিত হয়। গুলি ও বোমা ঝোলায় ভরে রাস্তায় নেমে পড়ে। সতর্ক পথচারীর ভান করে শহরের চৌরাস্তা ধরে অগ্রসর হয়। আজ তারা হাঙ্গামা বাঁধাবে। যুবকদের তালিকায় গুরুত্বপূর্ণ অনেক নাম ও স্থাপনা রয়েছে। পিট সায়েবের দোকানটি অবশ্য ভুলে বাদ পড়েছিল। এখন সেটা তালিকায় উঠে গেছে।