ওসমান সমাচার —পর্ব ১৩ । আহমদ মিনহাজ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ আগস্ট ২০১৬, ৯:০০ পূর্বাহ্ণ, | ৩৮৮০ বার পঠিত
‘রাং রাজওয়া’ ইন্দ্রজাল : পিট সায়েব ও বাইজি–কন্যা সমাচার (৫)
বাইজি-সদনে রইসদের সেই ভিড়ে সাহেবজাদাও ছিল। বাইজি আয়োজনে ত্রুটি রাখেনি। দাওয়াতিরা তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে। তাদের হাতে সাকির পেয়ালা। বহুদিন পর বাইজিকে দেখে মনে চমক লাগছে। ভেতো বাঙালি সুকণ্ঠি রমণীকে ছিবড়ে করতে পারেনি। নিঃস্ব হওয়ার পরেও সে নিঃস্ব হয়নি। বাইজিগিরির ঠাট ধরে রেখেছে। দেহটি পৃথুলা হলেও মুখের রেখা ও আঙুলের মুদ্রায় ত্রুটি নেই। কণ্ঠ আগের মতোই সুরেলা ও আবেশ জাগানিয়া। ইচ্ছা করলে পুরুষকে প্রেমরসে খুন করতে পারে! রইস শ্রোতারা মনে-মনে রমণীকে কুর্নিশ করে। স্বীকার করতে বাধ্য হয়,—জাত শিল্পী কখনো মরে না। তাদের কদর কমেও কমে না। বাইজিরা কালাকার হলে আর বাইজি থাকে না,—শিল্পী হয়ে পড়ে। এই শিল্পগুণ সে তার কণ্ঠে ধরে রাখে। মুখের রেখা ও হাতের আঙুলে তরঙ্গ উঠায়। বাইজি এখন শিল্পী বটে!
মা ও মেয়ের যুগলবন্দি শ্রোতাকে চমকিত করে। হৃদয়ে আবেশ জাগায়। বাইজির কণ্ঠে জাদু লুকানো থাকে। চোখ ও আঙুলে এক জাদুকর ঘোরে। সুরের বিস্তার ঘন হলে সে জলসায় নেমে পড়ে। কণ্ঠের সঙ্গে তাল দিয়ে দেহের প্রতি অঙ্গ নিজের জাদু দেখায়। শ্রোতার গোপন কোটরে ঘাই মারে। নিজের অজান্তে সে বাহবা দিয়ে ওঠে। ‘বহুত খুব’ বলে বাইজি-চরণে বিগলিত হয়। আজ তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। জলসা ক্রমে ঘনীভূত হচ্ছে সঙ্গীতে।
বাইজি-কন্যা এই প্রথম ভরা জলসায় নিজেকে মেলে ধরছে। তার কণ্ঠে সুর ও বাদ্যযন্ত্রের রাজা ভর করেছেন। কালো চোখের মণি আমির খসরুর কালামে ডুবে আছে। সারগাম শেষে কন্যা গানের কলি ধরে। সে এখন ইন্দ্রজালের অধীনে। বাইজি-কন্যা নামটি খসরু-প্রভাবে ঘুচে গেছে। যৌবনের চটকে ভরা পসারিণী নয় সে। আমির খসরু তার হৃদয়ে হানা দিয়েছেন। প্রেমাতুর সঙ্গীত-সম্রাট তাকে প্রেমের তালিম দিচ্ছেন। রূপ-রঙ্গিনী নিজেকে ভুলে গাইছে,-‘ছাপ্ তিলক সব ছিনি-রে মুসে নয়না মিলায়কে/ প্রেম ভাক্তিকা মদওয়া পিলায়কে/ মাতওয়ালি কর লেনি রে মুসে নয়না মিলায়কে…।’ জলসা ঘন হয় নিজাম আউলিয়ার প্রেমে বিভোর আমির খসরুর কাওয়ালে।
বয়সের ওজনে গুরুভার রইস আদমির মাঝে কচি সাহেবজাদাটিও ছিল। বেমানান হলেও সে ছিল সেখানে। তার দেহে আগুন লেগেছে। হৃদয় প্রেমরসের ফেনায় রসিয়ে উঠতে চাইছে। সাহেবজাদা আর নিজের মধ্যে নেই। আমির খসরু তাকে মদে বেহুশ করে ফেলেছে। বাইজি-কন্যা তার রূপের জাদু দিয়ে হৃদয় অবশ করছে। খসরু শুনতে গিয়ে সে খসরুকে ভুলেছে। নিজামির জায়গায় যুবতী কন্যাকে দেখছে। তার চোখে প্রেমের নেশা ঘনিয়েছে।
যৈবতী কন্যার বাঁকা চোখের ঠারে সাহেবজাদা ঘায়েল হয়েছে। কন্যার ফর্সা হাতে সবুজ চুড়ি মনোহর লাগছে দেখে। ইচ্ছে করছে চুড়ি পরিহিত হাতটি চেপে ধরে নয়নে নয়ন মিলায়। খসরুর প্রেমের আবেশে কন্যা ‘রাং রাজওয়া’ হয়ে পড়েছে। নিঠুরা ধোবিনী রূপে সাহেবজাদার সঙ্গে রঙ্গ করছে। চোখের পলক ফেলে তার হৃদয় চুরি করেছে। তাকে রানি ও ধোবিনীর তফাত ভুলিয়ে ছেড়েছে। সাহেবজাদা এখন ধোবিনী দেখতে বাইজি দেখছে। বাইজির মাঝে রানিকে দেখছে। রানিকে দেখতে গিয়ে ধোবিনী ও বাইজির রঙ্গ সইছে। কাতর কণ্ঠে রঙ্গিনীকে মিনতি করে,—‘ও নিঠুরা ধোবিনী, এ অধম তোমার জন্য মরতে বাকি রাখেনি। তুমি আচ্ছা করে আমায় কেঁচেছো। এবার রেহাই দাও। নয়নে নয়ন মিশিয়ে তোমায় আপন করি। এ বিরহ আর সইছে না!’
‘রাং রাজওয়া’ যুবতী সাহেবজাদার মনে রূপের ঘোর এনে দিয়েছে। নিষ্ঠুর রজকিনীর পাল্লায় পড়ে সে স্থান-কাল-পাত্র ভুলেছে। সবুজ চুড়ি পরে রমণী আজ রঙ্গিনী সেজেছে। ওর এই রঙ্গ আর সইছে না। হাতটি চেপে ধরতে মন চাইছে। সাহেবজাদা কন্যাকে মিনতি করে:—
‘ও নিঠুরা বাইজি, খসরু তো নিজামের প্রেমে শহিদ হলো! নিজাম তাকে চোখের বাণ মেরেছে। সেই বাণের টানে খসরু আর খসরুতে নেই! নিজামকে শাদি করে তার বধূ হয়ে গেছে। তার নয়নে নয়ন মিলিয়ে নিজের নাম-ঠিকানা ভুলেছে। আর এই অধম তোমার প্রেমে মরেছে। তোমার চোখের নিঠুর বাণে ঘায়েল হয়েছে হৃদয়। তবে আর দেরি কেন, নয়নে নয়ন রেখে অধমকে তোমার বধূ করে নাও। ‘খসরু নিজামকে বাল্ বাল্ জায়ে/ মোহে সোহাগন কেনি রে মুসে নয়না মিলায়কে।’
নিঠুরা ধোবিনী আমার, দোহাই লাগে আর কেঁচো না। এবার নয়নে নয়ন মিলাও। তুমি ছাড়া এই সাহেবজাদা লাচাড়। তোমার নয়নে নিজেকে মিলাতে পারলে সে বাঁচবে। নয়তো মরবে অকালে!’
সাহেবজাদার মিনতি বৃথা যায়নি। অকালপক্ক যুবকের আবদার কন্যার মায়ের কানে উঠেছে। বিবাহের পয়গাম গেছে ত্বরা করে। সাহেবজাদা বিলেত ফেরত। রুচি ও শিক্ষায় বনেদি। শহরের এক সম্ভ্রান্ত কালাকারের মেয়েকে ঘরে তুলছে,—পরিবারকে এটা বোঝানোর হিম্মত তার ছিল। আপনজনের আপত্তি তাই ধোপে টেকেনি। প্রেমের নেশা প্রবল হলে রইসরা আপত্তি করে না। কারণ তারা জানে এই নেশা ভয়ংকর। বাধা দিলে প্রবল হয়। মেনে নিলে আপনা থেকে নামে। হোলি উৎসবে রঙ মাখানো ও বাইজিরঙ্গের মাঝে আসলে কোনো তফাত নেই। উৎসবের দিনে মুখে তীব্র হয়ে লাগে। দিন ঘুরলে ফিকে হতে থাকে। সাহেবজাদার চোখে হোলির রঙ ঘনিয়েছে। এই রঙ সে মুখে মাখবেই। ওজর-আপত্তি সেখানে টিকবে না। সুতরাং বাধা দিয়ে লাভ নেই। রঙ মাখতে চাইছে মাখুক! সময় হলে রঙটা ফিকে হয়ে যাবে। বাইজি-কন্যা তখন রানি থেকে উপপত্নীর হারেমে নির্বাসিত হবে।
রইসদের এইসব সাতপাঁচ অংকের মধ্যে বাইজির ঘরে বিয়ের পয়গাম পৌঁছায়। রমণীর স্মৃতিপটে রইস বাঙালির মুখটি তখন ভেসে উঠেছে। প্রতারণার পুরোনো ইতিহাস আরেকবার মনে উঁকি দিচ্ছে। মেয়েকে জেনেশুনে খাদে ফেলছে বুঝে রমণী শঙ্কায় কেঁপে ওঠে। কিন্তু মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে নিষেধ করতে পারে না। যুবতী কন্যার আবেশঘন মুখে নিজের প্রেমঘন মুখটি দেখতে পায়। সে এখন না করে কী করে!
ইন্দ্রজালের ইশারায় বাইজির মেয়ে সাহেবজাদা ছাড়া চোখে কিছু দেখছে না। নয়ন মিলানোর নেশায় তার গোড়ালি চপল হয়ে আছে। মন রসিয়ে উঠেছে প্রেমরসে। সে আর নিজের মধ্যে নেই। সাহেবজাদা তার বক্ষে ছুরি মেরেছে। প্রেমশরে ঘায়েল করেছে হৃদয়। যুবতীর কাজে মন বসে না। মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে না। খাবারে অরুচি ধরেছে। দেহে পাগলা গালিব হানা দিচ্ছে। যুবতীর মনের ঠিক নেই। চিত্ত বেভুল সাহেবজাদার ইশারা পেয়ে। দিশেহারা গালিব যখন-তখন অন্দরে ঢুকে পড়ে। যুবতী গুনগুন করে নিজেকে শুধায়:—
‘দিল-ই-নাদান তুজে হুয়া কিয়া হ্যায়?/ আখির ইস্ দরদ্ কি দাওয়া কিয়া হ্যায়।/ হাম হ্যায় মোশতাক/আওর ওহ বেজার/ ইয়া ইলাহি!/ ইয়ে মাজরা কিয়া হ্যায়?/ মেয়নে ভি মুখ্-মে জবান রাখতা হু/ কাশ! পুছো কী মাদওয়া কিয়া হ্যায়?’
সাহেবজাদা যুবতীকে আচ্ছা করে মদ পিলিয়েছ। নেশাতুরা ধোবিনী ‘কী হয়েছে’ বুঝতে পারছে না। তার দিল দর্দে ভরে আছে। এতো কষ্ট কেন সেটা তাই বুঝে আসে না। সাহেবজাদার সুদর্শন বচন যুবতীকে বিকলাঙ্গ করে দিয়েছে। যুবকটির মধ্যে বিলেত ও হিন্দুস্থান একসঙ্গে ক্রিয়া করে। সে শুধু রইস হয়ে নেই, তার বচন ও বেশভূষায় সায়েবি কেতার হাওয়া বইছে। বদলি যুগের ঢেউ তরঙ্গ তুলেছে। কন্যা এখন না করে কী করে! যুবকের কণ্ঠে নতুন দিনের গান শুনতে পায় যুবতী। তার হৃদয়ে উল্লাসমত্ত এক পাঞ্জাবি ভাংড়া নাচে,—‘আজ দিন চাড়ে তেরে রাং ভারগে/ তেরে চুম্মন পিছ্লি সাং ভারগে…।’
সাহেবজাদা পালাবদলের হাওয়া এনেছে সুদূর বিলেত থেকে। সেই হাওয়া ভাসছে যমুনার তীরে। ওটা ঢুকে পড়ছে রামবাগে। আছড়ে পড়ছে টাঙ্গাওয়ালার চাকায়। প্রবাহিত হচ্ছে ফতেপুর সিক্রির বাদশাহী দালানে। নতুন দিনের রঙে রঙিন হচ্ছে আগ্রা। সাহেবজাদার চুম্বনে আরক্তিম হয়েছে যুবতী কন্যা। সে এখন না করে কী করে!
রঙ্গিনী যুবতী ভাবছে প্রেমের জুয়া খেলে মা হেরে গেছে, তাই বলে তাকে হারতে হবে কেন! দিন বদলেছে। সাহেবজাদা তাকে নারীর মর্যাদা দিতে কৃপা করছে না। তাকে বাইজি না ভেবে কালাকার বলে সমীহ করে। স্ত্রী ও প্রিয়তমা ভেবে সম্ভোগ করতে চায়। বনেদি সাহেব তাকে ভ্রমণ করাবে বিলেতে। ‘যমুনাকে তীর’ ছেড়ে বাইজি-কন্যা এবার টেমস নদীর উজানে ভাসবে। নিজেকে বনেদি ও সায়েবানি করার অঢেল সুখ তার সম্মুখে। এটা ঠিক সে বাইজি-কন্যা। এই পরিচয় কোনোদিন মুছবে না। কিন্তু নিজে তো বাইজি নয়। বাইজিকলায় পারদর্শী হলেও মা তাকে রইস আদমির খেলনা করেনি। সে কারো পোষা রক্ষিতা নয়। যুগের পালাবদলে পরিচয় পালটে যাচ্ছে। তার পরিচয়টিও নতুন। মায়ের মতো পুরোনো পরিচয়ে তাকে ব্যবহার করার হিম্মত রইসদের নেই। নতুন পরিচয়ের জোরে রইস ঘরের বাইজি-নির্বাসনের রীতিকে কচুকাটা করবে সে।
বাইজিরা বড়ো অদ্ভুত। ঘরামি তার জন্য অভিশাপ বুঝেও ওতেই মজে। প্রেম এক জুয়া খেলা জেনেও সেটার উপর বাজি ধরে। কন্যা বাজি ধরেছে জিতবে বলে। মায়ের মতো সে হার মানবে না। নতুন যুগের নতুন পরিচয়ে নিজেকে প্রমাণ করার জেদ তার মনে তীব্র হয়েছে। জেদি কন্যাকে মা নিষেধ করে কী করে! নিরুপায় জননী বাধ্য হয়ে ‘হ্যাঁ’ বলে। নয়নে নয়ন মিলিয়ে কন্যা এবার সাহেবজাদাকে কবুল করে। বাইজি একা হয় মেয়েকে ঘরামি করে।
সুকণ্ঠি বাইজি এখন একা। খোদাকে ছাড়া তার পাওয়ার কিছু নেই। ফরিদা হওয়া ছাড়া কিছু বাকি নেই জীবনে। নিঃসঙ্গ রমণী খোদার সঙ্গে গান করে। নিজেকে ডুবিয়ে রাখে রুমি ও ফরিদে। বুল্লে শাহ’র কালাম জপে দিবানিশি। সন্ত কবিরের ভজনে বিমনা হয়। শেখ ফরিদকে রক্তে টের পায়। তার মতো বুড্ডা ভাবে নিজেকে। রমণীর দেহ অবসন্ন। সুডৌল ত্বকে বলিরেখা জেগেছে। সে এখন শেখ ফরিদ হয়ে গেছে। আরো একশো বছর আয়ু পেলেও যৌবন ফিরে পাবে না। ফরিদের মতো বুড্ডা থেকে যাবে। এবং এটাই নিয়তি!
মাংসের পুত্তুলি মাটি হবে,-এই বিধান স্বয়ং ইন্দ্রজাল জারি করেছেন। পুত্তুলির মধ্যে জীবন ফুঁকে দেয়ার ক্ষণে বিধানটি তিনি জারি করেছেন। এর অন্যথা ঘটার সুযোগ নেই। তিনি বলে দিয়েছেন বয়স ঘনালে মানুষ বুড়ো হবে। তার মাংসে পচন ধরবে। মাংস তখন মাটি হতে শুরু করবে। হাজার বছর আয়ু বাড়লেও ফায়দা নেই। বুড্ডা ফরিদ বুড্ডাই থেকে যাবে। বয়সের ভারে হাজার বছর ধরে মাটি হবে। খোদার কাছে রমণী তাই আয়ু-বৃদ্ধির প্রার্থনা করে না। অস্তগামী সূর্যকে দেখে তার কণ্ঠ বেলাশেষের কাওয়ালি ধরে,-‘চাড়তা সুরুয্ ধীরে ধীরে ঢলতা হ্যায়/ ঢল্ যায়ে ঢল্ যায়েগা ঢল্ যায়েগা।’ ঢলে পড়ার কাওয়ালে রমণীর সঙ্গী বলতে নিঃসঙ্গতা। এছাড়া দ্বিতীয় কেউ নেই জীবনে। সে এখন একা গান করে, আর মনে-মনে অপেক্ষা করে ইন্দ্রজাল কখন তাকে ডাক দেবেন,—উপরে!
ইন্দ্রজাল বড়ো চতুর। নির্দয় তার হৃদয়! মানুষের কোনোকিছুতে নাক না গলানোর সংকল্প করেছেন, অথচ সুযোগ পেলেই নাক গলান। মেঘের গায়ে হেলান দিয়ে দেবদূতদের নিয়ে ঘোঁট পাকান। মানুষের স্বাধীনতায় অকারণে হস্তক্ষেপ করা তার স্বভাব। তিনি তার বিবেচনাকে বিচারবোধ দিয়ে প্রভাবিত করান। একের দায় অন্যের ঘাড়ে চাপে। সবকিছু জটিল করেন ইন্দ্রজাল। সুখের দিনে দুঃখ ঘনিয়ে আনেন। মানুষকে দুর্দশায় বোঝাই করে রাখেন। নিয়তির আচমকা আঘাতে তার হৃদয় চুরমার হয়। স্বাধিকার-মত্ত মানুষ ইন্দ্রজালের কাছে তখন ফরিয়াদ জানায়। নিয়তিকে অভিশাপ দেয়। তবু তার দুঃখ ঘোচে না। দুর্দশার বিরতি ঘটে না। মানুষকে দুর্ভোগে নিক্ষেপ করে ইন্দ্রজাল মুচকি হাসেন। তাকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে মজা দেখেন। লড়াই ও সংগ্রামের কষ্টকর পথে নামতে বাধ্য করেন। তিনি তার সহ্যশক্তি পরখ করেন। আজব পরিস্থিতির মধ্যে তাকে ছেড়ে দেন। নিজের সংকল্প ও পরিকল্পনার সঙ্গে মানুষের নিয়তির সংযোগ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় মেতে উঠেন। ইন্দ্রজাল এক কঠোর পরীক্ষক। মানুষ তার ছকে ঘুরে। নিজেকে বারবার নিঃস্ব ও বিভ্রান্ত করে চলে।
বাইজি-কন্যার ক্ষেত্রে সেই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটে না। ইন্দ্রজালের ইশারায় কন্যার জীবনে দুঃখ ঘনিয়ে আসে। বাপছাড়া কন্যা এবার স্বামীছাড়া হয়। সে তখন সুখের দোলনায় দুলছে। ‘যমুনাকে তীর’ ছেড়ে টেমস নদীতে বিহার করছে। টেমস থেকে পুনরায় যমুনায় গিয়ে পড়ছে। সাহেবজাদা তার সামনে অঢেল এক দুনিয়াবি খুলে দিয়েছে। সে দেখছে ইচ্ছে করলে সব পাওয়া যায়। সাধ জাগলে বাসনা মেটানো যায়। নানা রঙের মানুষ ও বাসনার ভিড়ে যুবতী কন্যাকে বিভোর করে সাহেবজাদার সুখের সীমা নেই। স্ত্রীকে অঢেল সুখে বিহার করানোর বিপরীতে তার চাওয়াটি যৎসামান্য। সাহেবজাদার ইচ্ছে, কন্যা যেন ধোবিনীর মতো তাকে প্রেমের ঘাটে কাঁচে। কন্যার এতে আপত্তি করার কী আছে! যুবক স্বামীর কাছে নিজেকে সে নিঃসঙ্কোচে সমর্পণ করে।
সায়েবজাদার চোখের সমুখে কন্যা তার রূপের ডালি মেলে ধরে। তাকে খসরু শোনায়। গালিবের গজলে আচ্ছন্ন করে। বিলেত থেকে আগ্রায় এলে দুজনে টাঙ্গায় করে ঘুরে বেড়ায়। রামবাগে ঢুকে খুনসুটি করে। আচমকা বেরিয়ে পড়ে এখানে-সেখানে। দুজনে মিলে কাশি ও লখনৌ সফর করে। আগ্রা ছেড়ে এলাহাবাদে গিয়ে থামে। খসরুবাগে ঢুকে বাদশাহ ও বেগম বনে যায়। মনে খেয়াল চাপে কাস্মীরি হবে। হুট করে গুলমার্গে চলে আসে। কাস্মীরি রমণীর আদলে কন্যা মাথায় স্কার্ফ বাঁধে। ‘শাম রঙা ভোমরা’ হয়ে উড়ে সেই ভূ-স্বর্গে। ভোমরা উড়ছে দেখে সাহেবজাদার চোখে নেশা লাগে। ঝাপটা মেরে পতঙ্গকে সে বক্ষবন্দি করে। সাহেবজাদার প্রশস্ত বক্ষে ভোমরা প্রেমের হুল ফোটায়। কন্যার এখন সুখের সীমা নেই। প্রণয় ও রমণে বিরতি দেয়ার মতো বিরতি নেই।
মেয়ের সুখে মায়ের সুখ। বাইজি-কন্যার সুখ দেখে মা মনে-মনে হাসে। বিলেতের গল্প শুনে গালে হাত দেয়। ইংরেজ সায়েব ও মেমদের বেশরম মিলামিশার কাহিনী শুনে মেয়েকে ‘বেশরম’ বলে গাল পাড়ে। মেয়ে সুখে আছে। প্রমোদে দিন কাটছে। তার মা জানে না কচি বরের পাল্লায় পড়ে সে কতোটা ‘বেশরম’ হয়েছে। এটা অবশ্য তাদের গোপন জগৎ। মাকে বলার নয়। সাহেবজাদা আগ্রা ও বিলেতি মিশিয়ে কন্যাকে ভালোবাসে। শোবার ঘরে সে এখন রাজস্থানী চোলি ও ঘাঘড়া পরে। সেলোয়ার ছেড়ে স্কার্টে নিজেকে পরখ করে। রাতের অন্তর্বাসে বিলেতি যোগ হয়েছে। ফিনফিনে অন্তর্বাসে সাহেবজাদার আঙুল খেলা করে। ওটার ফিতে ধরে যখন-তখন টান মারে। যুবতী কন্যার চোখে শরম ঘনায়। ভ্রূ বাঁকিয়ে বরকে শাসন করে। যতো শাসায় ফিতের বাঁধন ততো আলগা হয়। কন্যা বাধা দিয়ে কুল পায় না।
বিলেতি বড়ো বিপজ্জনক! ওটা খালি খুলে পড়তে চায়। নগ্ন ও স্বাধীন হতে চায়। সাহেবজাদার পাল্লায় পড়ে রঙ-রঙ্গিনী ধোবিনী এবার সায়েবানি হয়েছে। শোবার ঘরে ইংরেজ মেমের ছলাকলায় স্বামীকে বশ করে। সাহেবজাদার কল্যাণে ইংরেজি বচন ধরতে ওর এখন কষ্ট হয় না। হিন্দি টানে মাঝেমধ্যে ইংরেজি ছলকে ওঠে। ঠুমরির সঙ্গে কলের গানে জ্যাজ ও ব্লুজ শোনে। অপেরা সঙ্গীতের উচ্চনাদে রাগ-রাগিনীর বিস্তার টের পায়। তার রক্তে প্রেমের পিপাসা জাগে। প্রেম ছাপিয়ে কাম-বাসনার নহর ওঠে হৃদয়ে। আগ্রাওয়ালির দিন বড়ো সুখে কাটে বিলেতে!
সুখের দিনে মেঘের গর্জন তোলা ইন্দ্রজালের স্বভাব। তিনি বড়ো হিংসুটে। বাইজি-কন্যার সুখ তার সহ্য হয় না। মেয়ের মনে ঘরামি রসিয়ে উঠছে দেখে এবার নাক গলান। কারণ এটা তার সংকল্প ও পরিকল্পনার বিরোধী। সাহেবজাদার ঘাড়ে দেবদূতরা চড়াও হয়। যুবতী স্ত্রীকে তার মায়ের কাছে রেখে সে বিলেতে পৌঁছায়। মাস ঘুরে চলে। ক্রমে বছর ঘুরে যায়। সাহেবজাদা আর দেশে ফেরে না। কন্যাকে আগের মতো খবর করে না। বড়ো ব্যস্ত সে বিলেতে। কন্যা উতলা হয় মায়ের ঘরে। মন মেদুর করে টাঙ্গা হাঁকায় রামবাগে। মমতাজের সমাধিতে বসে চোখের জল ফেলে। তাকে দেখে রইসরা মুচকি হাসে। তাদের অনুমান সত্য হয়েছে। হোলি শেষে সাহেবজাদা আবার রইস হতে যাচ্ছে। আপনজনরা এবার বাইজি-সদনে ঢোকে। মেয়েকে শুনিয়ে মাকে ঠেস দিয়ে কথা বলে। পত্নী থেকে রক্ষিতা হওয়ার ইঙ্গিত উঠায়। বাইজিকে তার নিয়তি স্মরণ করিয়ে দেয়।
আকাশে এখন মেঘের ঘনঘটা। অনুমান সত্য হলে সাহেবজাদা অচিরে বাইজি-কন্যার সঙ্গ ছাড়বে। রইস ঘরের কোনো সাহেবজাদিকে কবুল করে বনেদি হওয়ার সুখ পুরা করবে। আপনজনদের অনুমান মিথ্যে নয়, তবে সেটা ভিন্ন পথে হাজির হয়। তাদের মুখ শুকায় এই গর্জন শুনে যে সাহেবজাদা এবার বাইজি ছেড়ে ইংরেজ মেমের রূপে মজেছে। বিলেত থেকে ফিরে আসা অনিশ্চিত। সে এখন সায়েব হয়েছে। ইংরেজ মেম বিয়ে করে বাইজিকে তালাক দিচ্ছে। আপনজনরা এই খবরে রুষ্ট হলেও বাধা দেয় না। তারা জানে মেমরঙ্গ ও বিলেতি মুখোশ উৎসবে কোনো ফারাক নেই। সাহেবজাদা মেমের মুখোশ পরে নাচছে। নাচছে নাচুক। বাধা দিয়ে লাভ নেই। উৎসব শেষ হলে মুখোশটা খসে যাবে। মেম ছেড়ে সাহেবজাদির ফর্সা আঙুলে আংটি পরাবে। আপনজনরা সেই দিনের অপেক্ষায় ঘটক ডাকে। সম্ভ্রান্ত সাহেবজাদির পাত্তা লাগায় রইসদের ঘরে।
বাইজি-কন্যার জন্য কিছু আর অবশিষ্ট নেই। ঘরণী হওয়ার জুয়া খেলায় সে হেরে গেছে। যুগ পালটেছে, তবে সেটা বাইজির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। যুগের পালাবদল তার জন্য বরং দুর্দশা ডেকে এনেছে। নতুন বিনোদন এসে গিয়েছে শহরে। লোকে এখন খেয়াল ও ঠুমরি ছেড়ে কলের গান শুনছে। বিলেতি গান-বাজনা ও বাদ্যযন্ত্রের চল ঘটেছে শহরে। নতুন প্রতিদ্বন্ধীর সাথে পাল্লা দিতে হলে বাইজিকে বায়োস্কোপে ঢুকতে হবে। রইস ছেড়ে আম আদমির হৃদয়-রানি হতে হবে। এতোদিন রইসকে উতলা করেছে। এখন আম আদমিকে উতলা করার সময় হলো।
বাইজি এক অভিনয় শিল্পী। এবার তার নায়িকা হওয়ার দিন এসেছে। খেয়াল ও ঠুমরিকে আগের মতো আবেশ দিয়ে গাইলে পেটে কিছু পড়বে না। ওটা শামুকের তালে চলে। সুতরাং চটক দিয়ে বাজিমাত করা ছাড়া টিকে থাকা কঠিন। যুগের টানে বাইজিকে গায়িকা ও নায়িকা করার শখ জেগেছে ইন্দ্রজালের। একে রোখার সাধ্য জগতের কোনো শহরের নেই। এই পালাবদল বাইজির জন্য কিছু অবশিষ্ট রাখেনি। আগে সে কালাকার হতে গিয়ে রক্ষিতা হয়েছে। নায়িকা ও গায়িকা হওয়ার যুগে তাকে আম আদমির নটি হতে হবে। আগে তাকে রইসরা সম্ভোগ করেছে। এবার আম আদমির যুগ এলো বাইজি–সম্ভোগের। তার জন্য এটা হলো ইন্দ্রজালের বিধান!
বাইজি-কন্যার মা নীল হয়েছিল প্রবঞ্চনার বিষে। ইন্দ্রজাল তার কপালে সুখ লেখেনি। এবার মেয়ে নীল হয়েছে প্রতারণার বিষ-ছোবলে। ইন্দ্রজালের এই রসিকতায় কন্যার চেয়ে মা বেশি জখম হয়। তার ফরিদা হওয়ার আবেশে বিঘ্ন ঘটে। শয্যাশায়ী রমণী চোখ মুদে নিয়তিকে নালিশ করে। মেয়ের শিরে হাত উঠিয়ে জীবনরঙ্গের ইতি টানতে চলে। চোখ বোজার আগে আত্মজার কাছে বাইজিগিরির রহস্য ভাঙে মা:—
‘মেরে বেটিয়া, আব্ তুম খোদাকো পেহ্চান সাকোগে। বাইজি এক রান্ডি হ্যায়। খোদা উসকো রান্ডি বানা কেলিয়ে ভেঝা। তুম রান্ডি থি। রান্ডি রোহোগি। মেনে তুমে কাহা তা, বাইজি এক কালাকার হোতি হ্যায়। ও কাভি রান্ডি নেহি হোতি। আব্ মে কেহ্ রাহা হু,-বাইজি খোদাকি রান্ডি হোতি হ্যায়। উসকি শাদি খোদা সে হো চুকি। তুমহারি লিয়ে আব্ খোদা বিনা কোই নেহি বাঁচি। আগার জিনা চাহো তো খোদাকি ইশক মে ডুব যাও। ইনসানকো ফেক্ দেও আপনা অন্দর সে।’
মেয়ের কাছে বাইজিগিরির চিরন্তন রহস্য ভেঙে মা পালায়। তাকে একা ও নিঃসঙ্গ করে মাটি হয় কবরে। মাকে মাটি হতে দেখে মেয়ে ভাবে,—‘মেরে লিয়ে কুচ্ নেহি বাঁচা! আব্ মে কিয়া করু? কাহা যায়েগি হাম? শায়েদ এহি বেহ্তর হোগি কি আব্ মে খুদকুশি কর লে।’ কন্যা গলায় দড়ি দিতে যাচ্ছে দেখে ইন্দ্রজাল উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেন। এটা তার সংকল্প ও পরিকল্পনার বিরোধী। কালো ডানার যমদূত কন্যার শিয়রে উড়ছে। পুলিশটাকে রোখা দরকার। মেয়েটির কচি প্রাণে বসন্ত সবে মাত্র এসেছে। অকালে সে কেন ঝরে যাবে! তার জন্য আরো কিছু বাকি রেখেছেন তিনি। এবার সেটা পুরা করার সময় হয়েছে।
ইন্দ্রজাল পরিকল্পনা করে রেখেছেন, অখ্যাত শহরে এক ইংরেজ সায়েব বাইজি-কন্যাকে দেখে কাতর হবে। সায়েবের চোখে রূপের নেশা ঘনাবে। সম্ভোগের ক্ষুধা জাগবে মনে। প্রেমের লালসায় বেচারা দেবদাস হবে। দেবদাসের একটা গতি করার জন্য মেয়েটিকে বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন। মেয়ে এখন বিবেচনায় নেই। বিচারবোধের কবলে পড়েছে। ইন্দ্রজালের সংকল্পের বাইরে গিয়ে খুদকুশি করতে চাইছে। খুব স্বাধীন ভাবছে নিজেকে। তার এই জ্ঞান নেই যে জগৎজোড়া নিয়মের রাজত্ব চলে। নিয়মের আগে কেউ চাইলেও যেতে পারে না। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ নিয়মের ফাঁদে বন্দি বা পরাধীন থাকে। ইন্দ্রজালের সংকল্প ও পরিকল্পনার বাইরে গিয়ে সে মরবে, এটা হতে পারে না। এবার তাকে রোখা প্রয়োজন।
মেয়েটি আসলে অজ্ঞ। তার দুর্ভাগা মা তাকে কিছু শেখাতে পারেনি। মায়ের উপদেশ মেয়ের হৃদয়ে প্রবেশ করেনি। সে বুঝতে পারেনি জগতে ইন্দ্রজাল তার জাল বিছিয়ে রেখেছেন। সেটা ছিন্ন করার ক্ষমতা কারো নেই। লোকে এই জালকে বহু নামে সম্ভাষে। তার মা এটাকে খোদা বলে ডাকতো। অসুবিধা নেই। জালকে এক নামে ডাকলেই হলো! তুমি যে নাম ধরে ডাকো, শেষ পর্যন্ত সেটা জাল ছাড়া অন্য কিছু নয়। জীবন-জুয়ায় হেরে গিয়ে মেয়ের মা জালের টোপ গিলেছে। মানুষ ছেড়ে খোদার ঘরণী হয়েছে। এখন মেয়েকে টোপ গেলানো দরকার। ফাঁদ-রহস্য সম্পর্কে তার ধারণা স্বচ্ছ নয়। তাকে সেটা বোঝানো প্রয়োজন।
জীবনজুয়ায় বাজি ধরে মানুষ সব হারে। তবু কিছু বাকি থেকে যায়। মানুষ তখন সেটা আঁকড়ে বেঁচে থাকতে চায়। নিজের জীবনীশক্তি পরখ করে। মেয়ের জীবনীশক্তি পরখ করতে তাকে বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন। খোদা নামের খড়কুটো ধরে আপাতত বাঁচুক। পরেরটা পরে দেখা যাবে। মেঘের গায়ে হেলান দিয়ে ইন্দ্রজাল এবার গালিবকে স্মরণ করেন।
খোদা চেনার জন্য মির্জা আসাদুল্লা গালিবের তুলনা হয় না। মতিচ্ছন্ন এই কবিকে কন্যা খুব ভালো করে চেনে। তাকে ভালোবেসে হৃদয়ে জড়ায়। গালিব এক মতিচ্ছন্ন শায়েরি। মদে চুর হয়ে থাকে। বাইজি ও রমণীসঙ্গ করে। সে ঠোঁটকাটা। উচিত কথা বলার সময় স্থান-কাল-পাত্র ধারে না। তার প্রেমে পড়ার ধারা ভিন্ন। খোদা চেনার তরিকা ভিন্ন। একদিনের ঘটনা ইন্দ্রজালকে এখনো হাসায়। পাগলা কবির শখ হয়েছে মসজিদে নামাজ পড়বে। মদ্যপ অবস্থায় উপাসনালয়ে ঢুকে পড়েছে। ঢোকার পর তার মনে হলো নামাজের আগে আরেক ঢোক পান করলে মন্দ হয় না। জেব থেকে বোতল বেরিয়ে এলো। ছিপি খুলে গলায় ঢকঢক করে ঢালছে কবি। গালিবের কাছে এক চুমুক মানে পুরা বোতল সাবাড়। নেশা বেশ জমে উঠেছে। শায়ের জাগছে চিতে। পাগলা কবির কাণ্ড দেখে নামাজিরা তাকে ঘিরে ধরে। তার দুঃসাহস দেখে সবাই ক্ষুব্ধ ও স্তম্ভিত। পারলে মারতে উঠবে। পাগলা নির্বিকার,—‘ক্যায়া হুয়া ভাই! আব্ মারো গি ক্যায়া!’
গালিব শহরের মশহুর কবি। লোকে তার শের শুনে। তাকে ভালোবাসে। তাদের কাছে কবির খামখেয়াল নতুন কিছু নয়। তবে আজকের পাগলামি মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। নামাজির মধ্যে একজন তাই রেগে ওঠে,-‘ইয়ে কোই শরাব পিনে কা জাগা হ্যায় কিয়া! খোদা কী ঘরমে শরাব পি রাহে হো। নাফরমান!’
নামাজির রাগ দেখে গালিব হাসে:—
‘মেরা কিয়া কসুর হ্যায় ভাই? আগার কুছ্ হ্যায় তো ও খোদা কী! ইস্ দুনিয়ামে কোই জাগা হ্যায় কিয়া, যাহা পে খোদা রাজ নেহি করতি! কোই ঘর হ্যায় কিয়া যাহা পে উনকো নেই মিলতা। মসজিদ আওর শরাবখানাসে ক্যায়া ফারক হ্যায় ভাই। বাতাও মুজে!’
প্রশ্নটি গুরুতর। খোদা সর্বত্র বিরাজ করেন। তার সংকল্প ও পরিকল্পনা অনুসারে উপাসনালয়ে বিরাজ করেন। ঘর এবং ঘরের বাইরেও থাকেন। সুতরাং সরাইখানা ও শরাবখানায় না থাকার কোনো যুক্তি নেই। কারণ তিনি এক জায়গায় থাকবেন এবং আরেক জায়গায় থাকবেন না, এটা তো হয় না। নামাজিরা তাই কথা বাড়ায় না। কবি তখন উঠে দাঁড়িয়েছে। বাড়ির কথা ওর মনে পড়েছে। একবার সেখানে যাওয়া দরকার। যদিও পা দুটো ঈষৎ টলছে। এই অবস্থায় মদ্যপ কবি তার নিদান হাঁকে:—
‘আব্ চলতা হ্যায় ভাইসাব। লেকিন মেরে যানেকো বাদ ইয়ে ইয়াদ রাখনা,—‘না থা কুছ্ তো খোদা থা, কুছ্ না হোতা তো খোদা হোতা/ ডুবায়া মুজকো উনোনে, না হোতা ম্যায়নে তো কিয়া হোতা।’
নামাজিরা যা বোঝার বুঝে নিয়েছে। পাগলা কবিকে যাওয়ার রাস্তা করে দিয়ে নিজেরাও বাড়ির পথ ধরে।
গলায় দড়ি দিতে প্রস্তুত মেয়েকে ঠেকানোর জন্য ইন্দ্রজাল তাই গালিবকে স্মরণ করেন। মেয়ের নয়নে কবিকে প্রকটিত করান। খুদকুশির ক্ষণে কবি কোথা থেকে উদয় হয় মেয়ে সেটা বুঝতে পারে না। গালিবের মসজিদ-রঙ্গ দেখে তার হাসি পায়। নামাজিদের বেকুব হতে দেখে মন হালকা হয়ে আসে। বিষাদে ভার চিত্ত পরিশ্রুত হয় খোদার ব্যাপকতা অনুভব করে। কন্যা দড়ি ছুঁড়ে ফেলে। না, আত্মহত্যা সে করবে না। জীবনকে মোকাবিলা করবে। সর্বত্র বিদ্যমান খোদার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়াবে। তার লড়াই ইনসানের সঙ্গে। প্রয়োজনে খোদার সঙ্গেও লড়াই চলবে। দেখা যাক্ ভাগ্যবিধাতা তাকে কোথায় নিয়ে যায়!
বাইজি-কন্যা ঠিক করে নিয়েছে যে সে দুর্ভোগ সইবে, ভাগ্যবিধাতার মার হজম করবে, তবু হার মানবে না। তার মা বলেছে বাইজি হলো খোদার রক্ষিতা। যদি তাই হয় তবে ইনসানকে দায়ী করে কী লাভ! মা আরো বলেছে খোদার রক্ষিতা হওয়ার দোষে বাইজিকে নিয়ে ঘর করা ইনসানের পোষায় না। যে-কারণে ইনসানকে দিলে জায়গা দিলে দরদ্ খালি বাড়ে। দরদ্ থেকে বাঁচতে হলে ইনসানকে ছাড়তে হবে। তার প্রেমে পড়া চলবে না। তাই যদি হয় তবে ইনসানকে ছেড়ে লাভ কী! বাইজির জীবননাট্যে খোদা ও ইনসান অভিন্ন। সে তাদের রক্ষিতা। উভয়ের কাছে সে হলো ঘরকা মুরগি ডাল বরাবর। এই অবস্থায় ইনসানের জন্য বেঁচে থেকে লাভ নেই। আবার খোদার জন্য ফানা হয়েও লাভ নাই। দুজনের উপর রাগ পুষে রেখেও ফায়দা নেই। বরং নিজের জন্য বাঁচার চেষ্টা করা ভালো। কন্যা এবার সেটাই করবে।
খোদার এই আশ্চর্য দুনিয়ায় বাইজি আসে একা। রক্ত-মাংসের কাম-পুত্তলি প্রস্থান করে একা। লোকেরা তাকে একলা ফেলে চলে যায়। তার নির্যাস চুষে তাকে পরিত্যাগ করে। একা বাইজির পাশে বুড্ডা ফরিদ ছাড়া কেউ থাকে না। সব ভেবেটেবে কন্যা দড়ি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে। মেঘের গায়ে হেলান দিয়ে ইন্দ্রজাল স্বস্তি প্রকাশ করেন। কন্যার সিদ্ধান্ত তাকে তুষ্ট করেছে। খানিক জিরিয়ে নিতে অনন্তের উদ্যানে প্রবেশ করেন।
এই অবসরে কন্যা তোরঙ্গ থেকে একতাড়া হলুদ খাম বের করে। খামের ভিতরে সাহেবজাদার প্রেমপত্র রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে লেখা। সেগুলো হাতে নিয়ে নড়াচড়া করে। পুরোনো দিনের কথা ভেবে মন উদাস হয়। ‘যমুনাকে তীর’ ও টেমস নদীর শান্ত স্রোত নয়নে তরঙ্গ বহায়। রামবাগ ও খসরুবাগের সুগন্ধ নাকে ঝাপটা মারে। গুলমার্গের তুষারকণা ঝরে যুবতী-হৃদয়ে। ‘শাম রঙা ভোমরা’ উড়ে বেড়ায় তার দুঃখ-শীতল চোখের গভীরে। ভ্রমরটি উড়তে-উড়তে ভুলভুলাইয়া’র সর্পিল প্রাসাদে ঢুকে পড়ে। লখনৌর নবাবরা বড়ো বিলাসী ছিল। সহস্র রঙের গোপিনীতে তাদের হারেম বোঝাই থাকে। ভুলভুলাইয়া’র সর্পিল প্রাসাদে গোপিনীরা রঙ্গ করে বেড়ায়। নবাব ও গোপিনী মিলে লুকোচুরি খেলে সেই প্রাসাদে। গোপিনীরা এক কক্ষে ঢোকে আরেক কক্ষে লুকিয়ে পড়ে, আর নবাবরা তাদের ঘরময় খুঁজে বেড়ায়।
ভুলভুলাইয়া হেঁয়ালির অন্য নাম। হেঁয়ালিভরা সেই প্রাসাদে ঢুকে কাস্মীরি ভ্রমর পথ হারিয়ে ফেলে। সে আর বেরুতে পারে না। সাহেবজাদা এক কক্ষ থেকে আরেক কক্ষে তাকে খোঁজে। ‘ভোমরা ভোমরা, শাম রঙা ভোমরা’ বলে ভ্রমরকে ডাকে। ‘কাহা হো তুম। বাহার আ যাও।’ বলে গলা ফাটায়। ভ্রমর কিন্তু দেখা দেয় না। দেবে কী করে! লখনৌর বাদশাহী ধাঁধায় কাস্মীরি ভ্রমর পথ হারিয়েছে। তাকে ছেড়ে সাহেবজাদা এখন বিলেতি বিটলের সঙ্গে হাইড পার্কে লুকোচুরি খেলছে। ভ্রমরকে তার আর মনে নেই!
ভ্রমরকন্যা কুঁচিকুঁচি করে প্রেমপত্র ছিঁড়ে ফেলে। ঘরের মেঝেয় সাহেবজাদাকে ছিঁড়ে টুকরো-টুকরো করে। তার হাত তোরঙ্গের গভীরে ঢোকে। ফুলস্কেপ কাগজে লেখা চিঠি সযত্নে হাতে তুলে নয়। মা মারা যাওয়ার পর থেকে ওটা তোরঙ্গে পড়ে ছিল। ভূ-বর্ষের অখ্যাত শহর থেকে এক পিতা তার কন্যাকে সম্ভাষণ করে পত্রটি লিখেছে। খুলে দেখার পর পড়তে ইচ্ছে হয়নি। বাইজি-কন্যার জীবনে তার বাঙালি জনকের কোনো স্মৃতি নেই। বুঝ হওয়ার পর থেকে বাবা নামের পুরুষটিকে সে দেখেনি। বাবা ও মেয়ের মমতাঘেরা খুনসুটির অভিজ্ঞতা হয়নি। তবু লোকটি তাকে স্মরণ করছে দেখে কিছুটা অবাক হয়। কন্যা এবার পত্রে চোখ বোলায়।
সুদূর শহর থেকে জনক তার কন্যাকে মিনতি করে পত্র লিখেছে। পত্রের ভাষা বলে দিচ্ছে মা ও মেয়ের সব খবর সে রাখে। গোপনে মাকে সাহায্য করার তথ্যটি গোপন করেনি। মায়ের মাটি হয়ে যাওয়ার খবর তাকে বিচলিত করেছে বোঝা যায়। কন্যার বেড়ে উঠা থেকে সাহেবজাদার কাছে দাগা খাওয়ার সকল ঘটনা সে জানে। এমনভাবে লিখেছে যেন সে ওখানে ছিল। এটা প্রমাণ করে ভালোবাসা সর্বনাশা। ওটা ফুরিয়ে গেলেও পিছুটান রেখে যায়। সব চুকেবুকে যাবার পরেও কিছু বাকি থেকে যায়। বাঙালি পিতার জীবনে আগ্রাওয়ালি কন্যাটি হচ্ছে সেরকম। মেয়ের দায়িত্ব সে নিতে পারেনি, তার পাশে দাঁড়াতে পারেনি, অথচ এক-মিনিটের জন্য মেয়েকে ভুলতে পারে না। তার মা ভুল কিছু বলেনি,-‘প্রেম নিভতা নেহি বেটিয়া। হারগিজ জ্বলতি রাহি অঙ্গার কী তারাহ।’ রইস বাঙালির হৃদয়ে প্রেম ধিঁকি-ধিঁকি জ্বলছে। শত চেষ্টা করে ওই আগুনটি সে নিভাতে পারেনি!
বেলাশেষের রাগিনী বাঙালিকে ঘিরে ধরেছে। বুড্ডা ফরিদের সঙ্গে দিন-যাপনের সময় ঘনিয়েছে। তার বড়ো ইচ্ছে মেয়েকে দেখে নয়ন জুড়ায়। ওর মা বাইজি নয়, শিল্পী ছিল। রমণীর অনুমান অভ্রান্ত। ‘সুতে হুয়া’ আদমি এবার জেগে উঠেছে। একদিন এই প্রেমকে সে হাতের ফাঁক গলে ফেলে দিয়েছিল। এখন দেখছে ওটা তার হাতে রয়ে গেছে। তাকে কন্যার খবর করতে বলছে। ‘মুঝে গলতি হো গায়ি বেটিয়া’ বলে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরার আবেগ তীব্র হয়েছে রক্তে।
রইস বাঙালির অগাধ সম্পদ তার জন্য বোঝা হয়ে উঠেছে। ওয়ারিশানদের মধ্যে সম্পদের বাটোয়ারা নিয়ে গোল বেঁধেছে। আপনজনকে আর আপন বলে চেনা যাচ্ছে না। কালো ডানার দেবদূত তার চারিধারে উড়ছে। রইস তাই দেরি করতে ইচ্ছুক নয়। সম্পদের বণ্টন শেষে কবর-যাত্রার ইচ্ছে তার মধ্যে প্রকট হয়েছে। সে এখন ঘুমের ঘোরে কবর দেখে। চোখ বোজার আগে আগ্রাওয়ালি মেয়েকে একবার নয়নভরে দেখবে,-এই তার একমাত্র বাসনা।
মেয়েকে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দিয়ে বাঙালি চোখ মুদতে চাইছে। মেয়ে যেভাবে চায় সেভাবে সব হবে। কারণ বাঙালি জানে মেয়ে এই শহরে থাকবে না। এখানে কেউ তাকে মেনে নিবে না। এই শহরে তার পোষাবে না। যমুনার তীর ধরে সে বড়ো হয়েছে। রামবাগের খুশবু শুঁকে যুবতী হয়েছে। শাজাহান ও মমতাজ তাকে টানবে। নিজাম আউলিয়ার মাজার না দেখলে তার গলায় কাওয়ালির বোল ফুটবে না। কুতুব মিনার ছাড়া ঠুমরি ঘন হবে না। আমির খসরু তরঙ্গ তুলবে না হৃদয়ে। সে আগ্রাওয়ালি। আগ্রা তাকে শিল্পী করেছে। বাঙালি শহরে তার মন টিকবে না। সেই বুঝ ও খ্যাপামি নিয়ে মেয়েকে সে খবর করেছে। তার বিশ্বাস, মেয়ে না করবে না।
জনকের পত্র পাঠ করে মেয়ে ঝিম ধরে বসে থাকে। তার মন অবসন্ন। দেহ উৎকণ্ঠার ভারে ক্লান্ত। মাথা কাজ করছে না। ইন্দ্রজালের জন্য এটা হলো মোক্ষম সময়। নিজের সংকল্প ও পরিকল্পনার হাল-হকিকত দেখতে অনন্তের উদ্যান থেকে বেরিয়ে এসেছেন। মেঘের গায়ে হেলান দিয়ে দূর থেকে সব দেখছেন। দেবদূতদের কাছে কোথায় কী ঘটছে তার খবর করেন। বাইজি-কন্যার প্রতি তার আগ্রহ এখনো অটুট রয়েছে। দূর থেকে তাকে লক্ষ করছেন। কন্যাকে ক্লান্ত ও হতবুদ্ধি দেখে তার মায়া হয়। মেয়েটি বিবেচনা ও বিচারবোধ ঘুলিয়ে ফেলেছে। নিজের সম্পর্কে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছে না। দেবদূতকে তিনি মায়া বিস্তার করতে ইশারা করেন।
ইন্দ্রজালের ইশারা পেয়ে বাইজি-কন্যার হৃদয়ে দেবদূতরা মায়া বিস্তার করে। নিজেকে নিয়ে উদভ্রান্ত কন্যা কিছুটা সুস্থির হয়। বাঙালি পিতার পত্র হাতে অস্ফুটে উক্তি করে,-‘মেরে লিয়ে আব্ কুছ্ নেহি বাঁচি। পিতাজি, মে আয়েগি। জরুর আয়েগি তুমহারি পাস্।’